সংসার - পর্ব ০৪ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৭!! 

-অনু? অনু? অনুউউউউউউউউ?

সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গার পরে বিছানাটা ফাঁকা দেখে প্রায় লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসেছে অরণ্য। রাতে অনামিকার মাথায় জলপট্টি দিতে কয়টা বাজে ঘুমে চোখ বুজে এসেছিল জানা নেই অরণ্যের। ঘুমাতে যেমন রাত হয়েছে, তাই ঘুম ভাঙ্গতেও বেশ বেলা হয়ে গেছে আজ। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার পর অনামিকাকে যেখানে রাতে শুইয়ে দিয়েছিল বিছানার সেই অংশটুকু ফাঁকা দেখে রীতিমতো মাথায় বাজ পড়েছে অরণ্যের। এতো শরীর খারাপ নিয়ে মেয়েটা কোথায় গেছে চিন্তা করতেই নিজের গায়ের উপরে টানা চাদরটার দিকে চোখ পড়লো অরণ্যের। রাতে অনামিকা জ্বরে কাঁপছিল দেখে আলমারি থেকে কম্বল বের করে ওর গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিয়েছিল অরণ্য। তবুও যখন মেয়েটার কাঁপা থামে নি, তখন এই চাদরটাও অনামিকার গায়ে পেঁচিয়ে দিয়েছিল অরণ্য। এখন গায়ে চাদরটা দেখতে পেয়ে যতটা না অবাক হলো, তার চেয়ে আরো কয়েক গুণ বেশি অবাক হলো ভারি কম্বলটা পায়ের কাছে ভাঁজ করা দেখতে পেয়ে। মেয়েটা কখন ঘুম থেকে উঠেছে, কখন কম্বলটা ভাঁজ করেছে আর কখনই বা গতরাতে রাখা পানির মগ, রুমাল এসব সরিয়েছে টেরই পায় নি অরণ্য। এখন ঘুম ভাঙ্গতেই রুমের দিকে চোখ বুলিয়ে সবটা বুঝতে পারছে অরণ্য। এটাও বুঝতে পারছে মেয়েটা ইচ্ছে করেই ওকে না ডেকে, বা কিছুও জিজ্ঞেসও না করে চুপচাপ রুম থেকে চলে গেছে। একে তো গতকাল ফারহার কাছে নিজেকে কাজের মেয়ে পরিচয় দেয়া, আর এখন কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়া, অনামিকার এসব কাজে রীতিমতে মাথাটা গরম হয়ে গেছে অরণ্যের। 

রাগ থেকেই হোক, বা অনুর জন্য টেনশন থেকেই, অরণ্য দাঁতটা ব্রাশ দিয়ে হালকা ঘষে, হাতমুখ ধুয়ে ঘড়িধরা পাঁচ মিনিটের মাথায় রুম থেকে বেরিয়ে নিচে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। মেয়েটা যে এখন রান্নাঘরেই কোনো কাজ করছে সেই বিষয়ে অরণ্যের কোনো সন্দেহই নেই। এবং রান্নাঘরের দরজার সামনে আসতে অরণ্যের সন্দেহটা প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার আরো রাগ হলো এবারে অরণ্যের। চুপচাপ এগিয়ে এসে অনামিকার একটা হাতের বাহু ধরে টেনে নিজের দিকে ফিরালো। অনামিকা সকালের নাস্তায় গরম গরম লুচি ভাজছিল। গভীর মনোযোগ দিয়ে গরম তেলে লুচি ছাড়বে এমন সময় অরণ্য হুট করে কোথা থেকে এসে টান দেয়ায় মেয়েটার হাত থেকে লুচিটা ধপ করে সোজা তেলের মধ্যে পড়ে বেশ কিছুটা তেল উপচে এদিক ওদিক ছিটিয়ে গেল। অরণ্য আগেই টেনে অনামিকাকে নিজের দিকে নিয়ে এসেছিল বলে এবারের মতো মেয়েটার গায়ে গরম তেলের ছিঁটে এসে পড়ে নি। আরেকটু হলেই তেলটা অনামিকার গায়ে পড়তো টের পেয়েই মাথা আরো গরম হলো অরণ্যের।

-তোমার সমস্যাটা কি? হ্যাঁ? আরেকটু হলেই গায়ে গরম তেল এসে পড়ত সেই খেয়াল আছে? কে বলেছে তোমাকে এখন এসব লুচি ভাজতে? হ্যাঁ?

-সকালের নাস্তা বানাচ্ছিলাম। আজকে লুচি আর আলুর দম।

-লুচি আলুর দম! কমনসেন্সটা কি বাড়িতে রেখে এসেছ? তোমাকে রান্নাঘরে ঢোকার পারমিশনটা কে দিয়েছে হ্যাঁ? আনসার মি ড্যাম ইট!

-আমি তো এতোক্ষণ ধরে রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। কই কোনো প্রবলেম তো হয় নি? আপনি এসে এভাবে হুট করে টান দিলেন হাত ধরে সেইজন্যই তো তেলে লুচিটা পড়ে গেল। এবার বোধহয় পুড়েও যাবে। ছাড়ুন।

-পুড়ে যাবে মাই ফুট! তুমি কিছু না বলে রুম থেকে চলে এলে কেন? তোমাকে বলেছিলাম আসতে? আর গায়ে জ্বর নিয়ে আবার সকাল সকাল এসব করতে কে বলেছে তোমাকে? 

-কেউ বলে নি। এগুলো আমার কাজ তাই আমি করছি। কি করে রান্নাঘর থেকে আপনার রুমে চলে গেলাম সেটা বুঝতে পারছিলাম না। তাই চুপচাপ চলে এলাম যাতে আপনার ডিস্টার্ব না হয়।

-আমি কি একবারও বলেছি আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে?

-আমি সামনে থাকলেই তো আপনার ডিস্টার্বড ফিল হয়। এটা আবার নতুন করে বলে দেয়ার কি আছে? ডিস্টার্ব ফিল করেন বলেই সেদিন বাইরে থেকে খেয়ে না এসেও খাবারটা ফেলে দিয়েছিলেন, যাতে আমার হাতে ছোঁয়া খাবার আপনার খেতে না হয়। আলাদা করে বলে দিতে হবে কেন?

-আমি খেয়ে আসি নি তোমাকে কে বললো?

-গত তিনটে মাস আপনাদের বাড়িতে কাজ করছি স্যার। আর মেইড সার্ভেন্টরা খুব ভালো করেই বাড়ির মালিকদের আচার, আচরণ, দোষ, গুণ সবটা বুঝতে পারে। আমিও পারি এখন কিছুটা।

-অনু?

-লুচিটা পুড়ে যাচ্ছে। দয়া করে একটু ছাড়ুন। সবাই ডাইনিংরুমে বসে আছে। গন্ধটা নাকে গেলেই ছুটে আসবে। আপনাকে এভাবে আমার সাথে দেখলে ব্যাপারটা মোটেও শোভনীয় হবে না নিশ্চয়ই।

-একদম বাড়াবাড়ি করবে না অনু। কি পুড়লো, কে এলো আমার সেসব জানার কোনো প্রয়োজনও নেই। তুমি আমাকে কিছু না বলে চলে এলে কেন সেটার আনসার দাও। একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবে না।

-কথা ঘুরাবো কেন স্যার? বাড়ির কাজের মেয়ের কি আশ্রয়দাতার রুমে থাকাটা শোভা পায় বলুন? নতুন মেয়েটা এসেছে, দেখে কি ভাববে বলুন তো? অন্তত বাইরের একটা মেয়ের সামনে আপনার সম্মান নষ্ট হোক চাই নি, তাই চলে এসেছি।

-ফারহা খুব ভালো করে জানে তোমার আর আমার সম্পর্কে। আর তোমার সাহস হয় কি করে নিজেকে এই বাড়ির কাজের মেয়ে পরিচয় দেয়ার? 

-সরি স্যার। ভুল করে কাজের মেয়ে বলে ফেলেছি। আসলে তো আমি এই বাড়ির আশ্রিত। আপনি দয়া করে আশ্রয় দিয়েছেন বলেই তো থাকতে পারছি। নয়তো যাকে নিজের বাবা মা ই বাড়িতে রাখতে চায় না, তার এই পৃথিবীতে যাওয়ার মতো জায়গা আছে কি? 

-অনু?

রাগের চোটে কথাগুলো এলোমেলো হয়ে গেল অরণ্যের। এই মেয়েটা খুব একটা কথা বলে না। বাট যখন বলে তখন কাউন্টারে অরণ্য কিছু বলার মতো খুঁজেই পায় না। এখনও অরণ্য ভাষা হারিয়ে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। কতোটুকু সফল হচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছে না ছেলেটা। অরণ্যের রাগটা এবারে সপ্তমে উঠলো যখন দেখলো অনুর হাতটা ছেড়ে দিতেই মেয়েটা আবার ব্যস্ত হাতে গরম তেল থেকে লুচি ছেঁকে নেয়ার মন দিয়েছে। এতোক্ষণ ধরে গরম তেলে লুচিটা পুড়ে যেমন কয়লা হয়ে গেছে, তেমনি রান্নাঘরটা পোড়া গন্ধে ভরে গেছে। গন্ধটা নাকে যেতেই অরণ্য অনামিকার হাত ধরে টেনে চুলোর সামনে থেকে সরিয়ে আনবে ঠিক এমন সময় রান্নাঘরের দরজার কাছে বাবা মায়ের গলা শুনতে পেল অরণ্য।

-অনু? কি হয়েছে? এতো পোড়া গন্ধ আসছে কোথা থেকে? আর অরণ্য? তুই রান্নাঘরে কি করছিস? আজ অফিসে যাস নি? আমি তো আরো ভাবলাম তুই সকালেই বেরিয়ে গেছিস প্রতিদিনের মতো।

-আমি যে বাড়িতেই আছি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছো না। আমার প্রশ্ন হলো এই মেয়েটা রান্নাঘরে কি করছে?

-কি করছে মানে? সবসময় যা করে তাই করছে। সবার জন্য ব্রেকফাস্ট রেডি করছে।

-কেন? বাড়িতে কি আর একটাও লোক নেই যে নাস্তা বানাবে? আর যদি না ও থাকে বাইরে থেকে অর্ডার করলে না কেন? আমাকেই নাহয় বলে দিতে আমিই গিয়ে নিয়ে আসতাম। অর দারোয়ানকে পাঠাতে। হোয়াটস রং উইথ ইউ গাইজ? 

-নো নো নো। হোয়াটস রং উইথ ইউ মিস্টার অরণ্য? ডু ইউ ফরগেট যে অনুর কাজই ঘরের সব কাজ করা, কুকিং, ওয়াশিং, ক্লিনিং? রাইট? এজন্যই তো মেয়েটা বাড়িতে থাকতে পারছে রাইট? রিমেম্বার? তুমি কাল কি বলেছিলে? রাণীর হালে আছে মেয়েটা। এখন কেন জিজ্ঞেস করছ যে ও রান্নাঘরে কি করছে?

-কজ ওর শরীরটা খারাপ। জ্বরের কারণে রাতে সেন্সলেস ছিল পুরোটা সময়। ওকে জিজ্ঞেস করো এখন রান্নাঘর থেকে ভালোয় ভালোয় যাবে নাকি আমাকে কিছু করতে হবে?

-হোয়াট! তুমি না বলেছিলে অরণ্য মেয়েটা আমাদেরকে দেখানোর জন্য নাটক করছে? এবার কেন নাটক দেখেও এতো সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ বাবা?

-মম প্লিজ? 

-হোয়াট মম প্লিজ? জ্বর এসেছে অনুর? কই দেখি তো অনু?

অরণ্য কিছু বলার আগেই তাইয়্যেবা জামান এগিয়ে এসে অনামিকার কপালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে অনুর শরীরের উত্তাপ মেপে আবার অরণ্যের মুখের দিকে তাকালো।

-দেখেছ কান্ড আরহান? এই মেয়ের জ্বর টর কিচ্ছু নেই। কাজ না করার জন্য এমন নাটক করছে। এতোদিন এই মেয়ের নাটকটা আমরা ধরতে পারি নি, এবার তুমিও একই ভুল করছ অরণ্য।

-মম প্লিজ? অনুর রাতে এতো এতো জ্বর ছিল যে ওর সেন্সও ছিল না। আমি অনেক রাত পর্যন্ত ওর মাথায় জলপট্টি দিয়েছি। তখনও প্রচন্ড জ্বর ছিল ওর। বিশ্বাস না হলে ফারহাকে জিজ্ঞেস করো। ও ই তো আমাকে খবর দিয়েছিল যে অনু সেন্সলেস হয়ে গেছে। আস্ক হার। তারপর তুমি বলো নাটক নাকি অন্যকিছু।

অরণ্যের কথায় তাইয়্যেবা জামান একটু চুপ করে গেলেন। ফারহা একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসেছিল। বেচারি এসেই অরণ্য আর তাইয়্যেবা জামানের কথা কাটকাটি দেখে বোকার মতো কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করছিল। এবারে অরণ্য যখন ওকেই নিজের পক্ষ থেকে সাক্ষী বানিয়ে দিল তখন বেচারি পড়লো বিপদে। সিচুয়েশনের কিছুই বুঝতে পারছে না, তবুও মাথা নেড়ে অরণ্যের কথায় সায় দিল। অনু সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল এটা তো সত্যিই দেখেছে ফারহা। অবশ্য মিথ্যে হলেও যে চাকরি বাঁচাতে অরণ্যকে সাপোর্ট করতেই বাধ্য হতো মেয়েটা সেটা বলাই বাহুল্য।

-জি ম্যাডাম। অনু ম্যাডাম কাল সত্যিই বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিল। আমি তো কি যে ভয় পেয়েছিলাম! শেষে স্যারকে গিয়ে-------।

-হয়েছে হয়েছে। জ্বর হয়েছে তো কি হয়েছে? এমন একটু আধটু জ্বর সবার হয়। দু বেলা দুটো নাপা খেলেই জ্বর, ব্যথা, নাটক সব সেরে যাবে। সামান্য জ্বরের জন্য কি বাসার সব কাজ বন্ধ থাকবে নাকি?

ফারহা নিজের মনে আবার বকবক শুরু করার আগেই তাইয়েবা জামান ওকে থামিয়ে দিয়ে অরণ্যকে কথাগুলো বললো। অরণ্য অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। সাথে আরহান চৌধূরী আর তাহিয়াও। তাইয়্যেবার হঠাৎ এমন ব্যবহার কারোই হজম হচ্ছে না। অরণ্যের তো একদমই না। মায়ের দিকে তাই বেচারা অবাক হয়েই কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো।

-এতোটা পাষাণ কি করে হতে পারো মম তুমি? একটা মেয়ে জ্বরে সেন্সলেস হয়ে গেল আর তুমি কিনা বলছ-----।

-কেন? তুই পাষাণ হতে পারলে আমরা পারবো না? আর ও তো কাজের জন্য আছে আমাদেট বাড়িতে। কাজ যদি না করে তাহলে থাকবে কি পরিচয়ে? তুইই বল? 

-এনাফ মম। তোমাদের যা ইচ্ছে তোমরা করতে পারো। এই যে ম্যাডাম আপনাকেও বলছি। যা মন চায় করুন। শুধু আর একবার যদি অসুস্থ হয়েছেন তখন বুঝবেন অরণ্যের রাগটা কত গভীর হতে পারে। আর মা? কাল না আমার বাড়ির বউ এসব বলে আমাকে লেকচার দিচ্ছিলে? মাঝের একটা দিনেই সব বদলে গেল! বাহ! 

-সবাইকেই বদলাতে হয় অরু। বুঝবি না তুই। ফ্রেশ হয়ে এসেছিস তো? ডাইনিংরুমে গিয়ে বস নাস্তা করে অফিসের জন্য বের হস। আর এই যে অনু? আর কতোক্ষণ লাগবে? কখন থেকে সবাই বসে আছে? ছেলেটার অফিসে বের হওয়ার সময়ও তো হয়ে গেছে---।

-তোমাদের নাস্তা তোমরাই খাও। ডিজগাস্টিং।

অরণ্য রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই আরহান সাহেব, তাহিয়া আর ফারহা সবাই অবাক অবাক চোখে তাইয়্যেবা জামানের দিকে তাকিয়ে কি চলছে সেটা জানার আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। আর অনামিকা? গরম তেলে বাকি লুচিগুলো ভাজতে ভাজতে মুখ টিপে হাসছে মেয়েটা। অরণ্য যে মায়ের কাছে এতো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ওর অসুস্থতাটা প্রমাণ করতে চাইছিল তখন বহু কষ্টে হাসিটা চেপে রেখেছিল মেয়েটা। লোকটা এতো পাগল কেন ভেবে নিজের বাকি কাজগুলো করায় মন দিল। আর বাকিরা আগ্রহী চোখে তাইয়্যেবা জামানের ঘটনা ব্যাখ্যার অপেক্ষায় তাকিয়ে রইলো। উনিই বা হঠাৎ অরণ্যের সামনে এমন করলেন কেন? কি চলছে উনার মনে?

০৮!! 

-আহ! এদের সবার সমস্যাটা কি? আমাকে বুঝায় আমি নাকি জেদ ধরে বসে আছি! এখন নিজেরা কি করছে! ডিজগাস্টিং! আর মা! আহহহহ। অনুর এতো জ্বর শুনেও কি করে ওকে কাজ করতে বলতে পারে এই অবস্থায়? তাও আবার আমার কথা বিশ্বাসও করছে না! অদ্ভুত! আজ মেয়েটার কিছু হলে সবাইকে দেখে নিব আমি। সবাইকেই দেখে নিব। অনুকেও। সাহস কতো মেয়েটার আমার মুখের উপরে এতো কথা বলে! আমারও দিন আসবে মেয়ে। এক মাঘে শীত যায় না। তারপর তোমাকে দেখাচ্ছি।

রান্নাঘরে নিজের রুমে এসে রুমের বালিশ দুটো, চাদর সবকিছুকে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে বিছানার উপরে বসে নিজের মাথাটা চেপে ধরে কথাগুলো বিড়বিড় করছিল অরণ্য। মায়ের হুট করে এমন আচরণ কিছুতেই হজম হচ্ছে না অরণ্যের। আরো বেশি রাগ হচ্ছে মায়ের এমন উদ্ভট কথাগুলোর কোনো প্রতিবাদই করেনি ওর বাবা বা তাহিয়া কেউ, এটা দেখে। কি হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে না অরণ্য সেই কারণেই আরো রাগ উঠছে ছেলেটার। আর কিছু ভাবায় সময় নষ্ট না করে নিজের মোবাইলটা নিয়ে কাউকে কল করলো। একবার কলটা বাজার পরেই অপরপ্রান্ত থেকে বেশ খোশমেজাজের কারো কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। কণ্ঠস্বরটা শুনে অরণ্যের ঠোঁটের কোণেও একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কারো হাসি খুশি ব্যক্তিত্বটা যে এতো প্রশান্তি এনে দিতে পারে জানাই ছিল না অরণ্যের। 

-হেই হ্যালো মিস্টার জি এম? হোয়াটস আপ? 

-গুড মর্নিং স্যার। 

-ইয়েস ইয়েস। ভেরি ভেরি গুড মর্নিং মিস্টার অরণ্য। আজ কি আবার কোনো ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ের কথা মনে করাতে কল করেছেন? যেটা আমি ভুলে গেছি? 

-নো স্যার। একচুয়েলি স্যার আই নিড ওয়ান ডে লিভ।

-হোয়াট! সিরিয়াসলি! ও মাই গড! মিস্টার অরণ্য ওয়ান্ট এ লিভ! ও মাই গড! আজ অফিসের সবাইকে আমার পক্ষ থেকে পার্টি দেয়ার এনাউন্স করে দিচ্ছি। ওপস সরি। তুমি তো থাকতে পারবে না পার্টিতে। ওকে নো প্রবলেম। তোমার ট্রিট কাল পেয়ে যাবে।

-ওয়েট! হোয়াট! আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড স্যার। সরি স্যার। আমার আসলেই একটা দিন লিভ দরকার। প্লিজ?

-মিস্টার অরণ্য? এতোদিনে চাকরি করে একটাও এক্সকিউজ দেয় নি, অফিশিয়াল ছুটির বাইরে একদিনও বাজে কজ দেখিয়ে ছুটি দেয় নি, দেরি করে অফিসে আসার কোনো রেকর্ড নেই যার। সে ছুটি চেয়েছে আজ প্রথমবারের মতো। তাকে কি ছুটি না দিয়ে পারি? 

-স্যার? 

-ইয়াং ম্যান, তুমি একদিন না দুদিন ছুটি নাও। আই ডোন্ট মাইন্ড।

-নো স্যার। এক দিনই ঠিক আছে। আর নেক্সট উইকে বোনের বিয়ের ডেইট ফিক্সড হবে। মে বি তখন কিছুদিন ব্যস্ত থাকবো, হয়তো ছুটিও লাগতে পারে তখন।

-ওহ! ছুটি লাগতে পারে মানে! তুমি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। তুমি তোমার মতো সময় দাও। আপাতত কোনো শিপিং চলছে না আমাদের। তাই যতদিন ইচ্ছে টাইম দাও ফ্যামেলিকে। শিপিং শুরু হলে তুমি তো আবার রাতদিন অফিসেই পড়ে থাকো। এবার কিন্তু সেরকম করলে তোমার বউ আমাকে গালি দিবে। হা হা হা।

-আরে! কি বলছেন স্যার? এসব বলে প্লিজ লজ্জা দিবেন না। কোম্পানিটা আমাদের সবার। কাজ তো করতেই হবে।

-তোমার মতো বাকি স্টাফরা ভাবলে এতোদিনে বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান ইন্ড্রাস্টিয়াল কোম্পানি হয়ে যেতাম আমরা। হা হা হা। ওকে ইট'স নট এ বিগ ডিল। নেক্সট ওকশনে দেখা যাক কি হয়। বাট ইউ মিস্টার অরণ্য আর ডুয়িং এ গ্রেট জব।

-মাই প্লেজার স্যার।

-আই হ্যাভ এ লিটল কোশ্চেন মিস্টার অরণ্য। ওয়াইফের সাথে সব মিটমাট হয়ে গেছে, রাইট?

-------হোয়াট আর ইউ সেয়িং স্যার? তেমন কিছু না। আসলে অনুর শরীরটা একটু খারাপ। তাই ---।

-ওহো! এমনিতেই চুল পাকে নি ইয়াং ম্যান। হাসি খুশি আমাদের ম্যানেজারের ঠোঁটের কোণ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেছে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। হয় হয়। বিয়ের পর এসব হয়। নতুন নতুন বিয়ে করেছ তো তাই হজম করতে সময় লাগছে। ধীরে ধীরে দেখবে বউয়ের সাথে তুমুল ঝগড়া করে অফিসে সবার সাথে পিজ্জা পার্টিও করতে পারবে। হা হা হা।

-স্যারের মনে হয় আজ ম্যাডামের সাথে ভালোই মনোমালিন্য হয়েছে। তাই এতো দার্শনিক কথাবার্তা শুনছি।

-হা হা হা। এইতো বুঝতে পেরেছ। এই যে তোমার সাথে কি কথা বলছি সেটা তো ও দেখছে না, শুধু হাসিটা শুনেই ফুলছে লুচির মতো। হা হা হা। বেচারি ঝগড়া করে কথ বলবে না বলে নিজেই ফেঁসে গেছে হা হা হা।

-তাহলে অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করলাম মনে হচ্ছে স্যার।

-ওহ নো ইয়াং ম্যান। উল্টো কলটা করে ভালোই করেছ। নইলে আমার বউয়ের রাগটা আজ সেক্রেটারির উপরে ঝাড়তাম। হা হা হা। বাট তোমার কলটা আসায় মুড একদম ফ্রেশ হয়ে গেল। আই থিং আই শ্যুড থ্যাংক ইউ। 

-অল প্লেজার ইজ মাইন স্যার। ওকে স্যার। আপনি ম্যাডামের রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করুন। কাল অফিসে দেখা হবে।

-ওকে।

কলটা কেটে দিয়ে হেসে ফেললো অরণ্য। ওদের কোম্পানির এম.ডি লোকটা আসলেই অসম্ভব ভালো এবং প্রচন্ড ভালোবাসে অরণ্যকে। তাই হয়তো কাজ করে আনন্দও পায়। অরণ্যের কথাগুলো ভাবার ফাঁকেই নিচে ডাইনিংরুম থেকে মায়ের ডাক শুনতে পেল অরণ্য। আর সাথে সাথেই অনুর অসুস্থতার কথাটাও মনে পড়ে গেল অরণ্যের। রুম থেকে বের হতে গিয়ে খেয়াল করলো রাতের টিশার্ট আর ট্রাউজারও এখনো বদলানো হয়নি ওর। মোবাইলটা বিছানার উপরে রেখে একটা ফতুয়া আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকেই পা বাড়ালো অরণ্য। নিচে গিয়েই নাহয় ঠিক করবে কি করা যায়।

অন্যদিকে, অরণ্য রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বাকিরা তাইয়্যেবা জামানকে ঘিরে কৌতূহল দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখতে রাখতেই অনামিকা শেষ লুচিটাও ভাজা শেষ করে বাটিতে তুলে নিয়ে বাটিটা হাতে নিয়ে শাশুড়ির দিকে ফিরিয়ে। তাইয়্যেবা জামান কারো কৌতূহলী দৃষ্টিকে পাত্তাই না দিয়ে অনামিকার গালে আর কপালে হাত ছুঁইয়ে দিলেন আবার।

-দেখলি তো জ্বর বাঁধিয়েছিস তো এবারে? কতবার বলেছি তোকে ফ্লোরে শোয়ার দরকার নেই? নিজের রুমে তো যাবি না, অন্তত তাহিয়ার রুমে গিয়ে তো থাকতে পারিস। নাকি তোর ননদিনী রায়বাঘিনী? রুমে ঢুকতে দেয় না? তেমন হলে আমাকে বলিস না কেন?

-আরে মা! কিসব বলছেন? তাহু তো সবসময়ই বলে ওর রুমে গিয়ে থাকতে। ওরও ভালো লাগবে জানি আমি ওর রুমে থাকলে। কিন্তু উনি তো রাগ করবেন। হাজার হোক, কাজের মেয়ে উনার বোনের সাথে বেড শেয়ার করলে-----।

-একটা থাপ্পড় দিব মেয়ে। এতোক্ষণ কি ছটফট করছিল দেখিস নি? দেখবি আজ অফিসেও যাবে না। সারাদিন তোর পিছুপিছুই ঘুরবে। হা হা হা। এ্যাকটিংটাও একেবারে আগুনে ঘি ঢালার মতো হয়েছে না বল? 

-মা! আপনি হঠাৎ এমন করলেন কেন? উনি তো রেগে গেছে অনেক। এবার কি করবে এসে কে জানে!

-কি করবে মানে! আমার ছেলে তো আমি চিনি না? তিনমাস ধরে ভালোয় ভালোয় বলছি সব সমস্য। মিটিয়ে নে মিটিয়ে নে, শুনেছে আমার কথা? শুনে নি। এবার দেখবি যেই আমি দজ্জাল শাশুড়ির রোল প্লে করবো ওমনি আমার ছেলেও তোর জন্য স্ট্যান্ড নিবে। হা হা হা। 

-এমন কিছুই হবে না মা। হয়তো আমার শরীরটা খারাপ হয়েছিল দেখে একটু চিন্তায় পড়ে গেছে উনি। একটু পরেই দেখবেন সব বদলে যাবে, উনিও বদলে যাবে। চলুন অনেক বেলা হয়েছে। ব্রেকফাস্ট হয়নি আজ কারো। 

-কিচ্ছু বদলাবে না। আর বদলাতে লাগলেও আমি আছি কি করতে? এমন দজ্জাল শাশুড়ি হবো না, ছেলের জেদ আমি ভাঙ্গিয়েই ছাড়বো।

-জোর করে সব কিছু হয় না মা। হয়তো দেখবেন দুদিন পরে এসে বলবে আর জায়গা হবে না এই বাড়িতে তোমার। তাই এতো আশা করে ঠকতে চাই না।

-এই মেয়েটা আজ আমার হাতে মাইর খাবেই খাবে। তুই ও তো ওর সাথে সবটা মিটিয়ে নিতে পারিস নাকি? অন্তত কি হয়েছিল আমাদেরকে তো খুলে বলতে পারিস? আমরা নাহয় অরণ্যকে বুঝিয়ে বলবো সব? 

-না মা। আমি উনাকে তো বলতেই চেয়েছিলাম। কেন চলে যেতে গিয়েও ফিরে এসেছি, কেন বিয়েটা করেছি, সব তো বলতে চেয়েছিলাম। উনি শুনতে চাননি কখনো। সেদিনও না, এর পরেও কখনো না। এবার যদি শুনতে চায়ও তবু আমি কখনো বলবো না উনাকে কথাগুলো। উনি উনার রাগ, অভিমান আর জেদ নিয়েই থাক। কতদিন এভাবে চলে আমিও দেখবো।

-এই দুটোই এমন জেদী! বাপরে! এদের দুজনকে এক করতে করতে আমার জীববটা তেজপাতা হয়ে যাবে নির্ঘাত! আরহান! চলো নাতি নাতনির মুখ তো দেখা হবে না, পৃথিবীটাই ঘুরে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বেরিয়ে পড়ি। এখানে থাকলে এদের দুইজনের মান অভিমান ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বাকি চুলগুলোও সাদা হয়ে যাবে।

-মা? অনেক হয়েছে। এবারে খেতে চলুন না? এতো বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকলো শরীর খারাপ হবে তো আপনার আর বাবার? আর এই যে তাহুরাণী? আপনার আজ খিদে পায়নি মাই ডিয়ার প্রিন্সেস?

অনামিকার প্রশ্নটা শুনে তাহিয়া এগিয়ে এসে অনামিকাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

-এই যে ভাবি সাহেবা? আমি প্রিন্সেস নই, আপনার ননদিনী রায়বাঘিনী। বুঝলেন? আজ থেকে শুরু হবে আপনার উপরে অত্যাচার। হু হা হা। 

-তাহু? এখন তো আগে ব্রেকফাস্টটা করতে চলো?

-ওহ! হ্যাঁ তাই তো! প্রচন্ড খিদে লেগেছে। আর এই যে মিস-- ফারা নাকি সারা? এখানকার একটা কথাও যদি ভাইয়ার কানে যায়! তাহলে সোজা তোমার পুটলি পাটলা সুদ্ধু তোমাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে ফেলে দিব বলে দিলাম। আর গতকাল ওভাবে বলার জন্য সরি। তুমি রাতে ভাবির জ্বরের কথাটা ভাইয়াকে গিয়ে বলেছ তাই তোমার সব দোষ মাফ করে দিয়েছি এবারের মতো। কিন্তু এবার যদি ভুলেও ভাইয়ার সামনে মুখ থেকে একটা কথাও বের হয়, তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন। 

-হয়েছে তো বাবা! ফারহা বলবে না কিছু। হ্যাপি? চলো এবার।

-হুম। এই মেয়ের উপরে আমার চব্বিশ ঘন্টা নজর থাকবে। ওকে?

তাহিয়ার কথা শুনে অনামিকা আর বাবা মা দুজনেও হেসে ফেললো এবারে। সবাই মিলে আস্তে আস্তে ডাইনিংরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তাইয়্যেবা জামান একটু উঁচু গলায় অরণ্যের নাম ধরে ডাকলেন। অরণ্য নিচে এলেই শুরু হবে এ্যাকটিং পার্ট ২। এবারে নাটকে অংশ নিবে বাকিরাও। ভাবতেই অরণ্যের রাগী মুখটার কথা ভেবে হাসি পেল তাইয়্যেবা জামানের। মেয়েটার জন্য ভালোবাসাটাকে কতদিন মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারে অরণ্য সেটাই এবারে দেখতে চান উনি।

আর অন্যদিকে বেচারি ফারহা। কোন দল থেকে কোন দলে চলে এসেছে বুঝতেই পারছে না মেয়েটা। অরণ্য যে অনুর খেয়াল রাখতে ওকে এনেছে সেটাও এদেরকে বলতে পারবে না, তাহলে চাকরি চলে যাবে। অন্যদিকে তাইয়্যেবা জামানের অরণ্যকে শায়েস্তা করার প্ল্যানটাও অরণ্যকে বলতে পারবে না, তাহলে চাকরি তো যাবেই, সাথে ঘাড়ধাক্কাটা মাগনা পাবে। ওর চেয়ে অসহায় আর এই দুনিয়ায় কে আছে সেটাই ভাবছে মেয়েটা। কবে যে এই দুজনের মান অভিমান ভাঙ্গবে, আর কবে ও নিজের পিঠ বাঁচিয়ে পালাতে পারবে কে জানে! এই পরিস্থিতিতে একটা আকুতিই মেয়েটার মাথায় ঘুরছে।

" হে আল্লাহ! সাহায্য করো। "

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন