অবহেলিত সম্পর্ক - পর্ব ০২ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


০৩!!

অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে বাহিরে। যা বাড়ির ভেতর থেকে বুঝা দ্বায়। রূপকথার সাথে মনে হচ্ছে আজ আকাশেরও মন ভারী হয়েছে। এদিকে কোনো গাড়িও পাওয়া যাচ্ছে। রূপকথা ভিজলে সমস্যা নেই কিন্তু ঈশা আর ঈশানকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। একবার জ্বর এসে পড়লে খবর আছে। তাই একটা বন্ধ দোকানের ছাউনির নিচে রূপকথা ঈশা আর ঈশানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
রাত: ৯:৩০
রূপকথা ভুলে ওর ফোনটাও রেখে এসেছে আরিশের রুমে। কিন্তু এই মুহুর্তে যাওয়াও সম্ভব না। ফোনের চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় মনে করছে ঈশা আর ঈশানের কথা। ওদের সামনেই একটা গাড়ি থামে। রূপকথার সমবয়সীই একটা মেয়ে গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে নিচ্ছে।  কিন্তু রূপকথার কাছে মনে হলো মেয়েটা ঠিক তৃপ্তি পেল না। আর হলোও তাই। মেয়েটা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত ছড়িয়ে বৃষ্টি অনুভব করছে। দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টিবিলাসী! পড়নে একটা লং কামিজ আর তার সাথে লেগিন্স। গলায় ওড়নাটা বেশ সুন্দর করে প্যাঁচানো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বড়লোক বাবার কোনো আদুরে মেয়ে। গাড়ির ভেতর থেকেই আর একটা সুন্দর মেয়ে ধমকের সুরে মেয়েটাকে গাড়িতে আসতে বললো। কিন্তু মেয়েটা যেতে নারাজ। তাই ছাতা হাতেই বাহিরে বের হলো মেয়েটি। রূপকথা এতক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ওদের।  এবার গাড়ির ভেতর থেকে আসা মেয়েটি ছাতা হাতে রূপকথার সামনে গেল। পেছন পেছন বৃষ্টিতে ভেজা মেয়েটিও গেল। রূপকথাকে উদ্দেশ্য করে মেয়েটা বললো,
- কি গো মেয়ে এত রাতে বৃষ্টিতে ভিজছো কেন তাও এই ছোট দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে?
- আসলে আপু কোনো গাড়ি পাচ্ছিলাম না। আর ফোনটাও ভুল করে বাড়িতে রেখে আসছি। নয়তো ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে আসতে বলতে পারতাম।
- ওহ আচ্ছা।  তাহলে চলো তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেই।
- না, না ঠিক আছে আমি যেতে পারবো।
পেছন থেকে বৃষ্টিতে ভেজা মেয়েটি রূপকথার সামনে গিয়ে বললো,
- এই তুমি কি ভয় পাচ্ছো? ভয় পেয়ো না আমরা কোনো ছেলেধরা নই কিন্তু হিহি
- না ভয় পাওয়ার কি আছে!
- তাহলে চলো।
রূপকথাও আর কথা বাড়ায় না। ঈশা আর ঈশানকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে। 
- আচ্ছা তোমার নাম কি গো?
- রূপকথা।
- বাহ্! অনেক সুন্দর নাম। 
- ধন্যবাদ। আপনাদের পরিচয়টা?
- আমি পিংকি আর ও আমার ছোট বোন প্রিয়া।
- প্রিয়া কি বৃষ্টি খুব পছন্দ করো? 
রূপকথার প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে উঠে প্রিয়া। রূপকথা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায় এই ভেবে যে সে কি কোনো উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে ফেললো নাকি। 
পিংকি, প্রিয়ার মাথায় আস্তে একটা থাপ্পড় মেরে বলে,
- কথায় কথায় এত হাসিস কেন?
- উফ আপু! হাসবো না কেন? হাসিই তো সব আমাদের!
আর রূপকথা শুনো, বৃষ্টি আমার অনেক পছন্দ। একদিন আমাদের বাড়িতে এসো তুমি আর আমি মিলে বৃষ্টিতে ভিজবো কেমন! 
কথাগুলো বলেই হাসতে শুরু করে প্রিয়া। এবার প্রিয়ার কথায় রূপকথাও হেসে দেয়।
- না গো! বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসে। 
- জ্বরের ওষুধ কিনে দিবো তো!
- তাই?
- একদম!
- হাহাহা। তুমি অনেক চঞ্চল আর দুষ্টু!
- কি বলো! আমি তো অনেক ইনোসেন্ট!
- ইশ! আসছে আমার ইনোসেন্ট (পিংকি)

বাড়ির সামনে পৌঁছে পিংকি আর প্রিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে রূপকথা। ঈশান ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই রূপকথা ঈশানকে কোলে নিয়ে ঈশার হাত ধরে বাড়িতে যাচ্ছে। বাড়িতে যেতেই একটা ধাক্কা খায়। রুমের দরজা আনলক করা। তার মানে কি মা এসে পড়েছে!
দরজা ঠেলে ড্রয়িংরুমে যায় রূপকথা। সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে মিসেস মাহমুদা অর্থাৎ রূপকথার সৎ মা। রূপকথা তার সামনে যেতেই তিনি রূপকথাকে ইশারায় বলেন ঈশান আর ঈশাকে উপরে শুইয়ে দিয়ে আসতে।
মিসেস মাহমুদার কথামত রূপকথা ঈশা আর ঈশানকে উপরের রুমে শুইয়ে দিয়ে আসে। মিসেস মাহমুদার হাতে ঈশানের একটা কাঠের ব্যাট। যেটা কিনারে একটু ভেঙ্গে গিয়েছে বলে ঈশানকে আর ওটা দিয়ে খেলতে যায়নি। যদি খোঁচা লাগে বা ব্যথা পায় তাই। রূপকথা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক। সাধারণত বড় কোনো ঝড় আসার পূর্বাভাস এটা। মিসেস মাহমুদা রূপকথার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,
- কোথায় গিয়েছিলি?
- (চুপ)
- কি হলো? কথা বলিস না কেন? কোথায় গিয়েছিলি বল। (ধমক দিয়ে)
মিসেস মাহমুদার ধমকে কিছুটা কেঁপে উঠে রূপকথা।
- বাবার বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম।
- বাবার বন্ধুর বাসায়? গাধা পেয়েছিস আমাকে? তোর মত মাথামোটা আমি? তোকে কতবার ফোন দিয়েছি তুলিস নাই কেন? ফষ্টিনষ্টি করায় ব্যস্ত ছিলি?
- মা!!!!
- চুপ!  চিৎকার করিস কার সামনে তুই হ্যাঁ? একদম গলা টিপে মেরে ফেলবো। ফষ্টিনষ্টি করতে পারো আর আমি বললেই দোষ?
- মা! ফষ্টিনষ্টি তুমি  আর তোমার বড় মেয়ে করতে পারে কিন্তু আমি না।
- কিহ্! কি বললি তুই? মুখে মুখে কথা না? নাগর কি সাহস জুগিয়ে দিয়েছে?
- কথা ঠিক করে বলো বলছি।
- বলবো না। কি করবি? কি করবি তুই?
মারবি? মারবি আমায়?
- মেরে হয়তো তুমি প্রশান্তি পাও কিন্তু এগুলাতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। 
- সেই তো! তোর তো সব ইন্টারেস্ট নাগরের প্রতি। পড়নে শাড়িটা কি নাগরই দিয়েছে?
- এত বাজে মাইন্ড তোমার ছিহ্! বলছি তো বাবার বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম।
- বোকা মনে হয় আমায় তোর? তোর বাবার বন্ধুর বাসায় গেলে তোর বাবা সাথে আসেনি কেন? আর তোর ফোন কোনো ছেলে রিসিভড করলো কেন? 
ফষ্টিনষ্টি করে আসবি আবার বড় বড় কথাও বলবি।
এবার রূপকথা আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। কারণ রূপকথা জানে এই মহিলাকে বুঝানো কারো কাম্য নয়। সে তার মতামতে স্থির থাকবে। 
মিসেস মাহমুদা এবার হাত চালালেন। কষিয়ে দুই গালে দুইটা থাপ্পড় দিলো রূপকথাকে। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায় রূপকথা। কিন্তু থামেনি মিসেস মাহমুদা। সেই ভাঙ্গা ব্যাট'টা দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে রূপকথাকে। সাথে বিশ্রী কিছু মন্তব্য তো আছেই। রূপকথার চুলের মুঠি ধরে টি-টেবিলটার সাথে সজোরে আঘাত করে। যার ফলে রূপকথার কপাল অনেকখানি কেটে যায়। কিন্তু তাতেও শান্তি হয়নি মিসেস মাহমুদার।  রূপকথাকে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে যায়।
- নাগরের সাথে বৃষ্টিতে ভেজার খুব শখ তাই না? নে এবার সারারাত ছাদে বৃষ্টিতে ভিজ।
ছাদের দরজা বাহির থেকে লক করে মিসেস মাহমুদা চলে যায়। রূপকথা উঠে দাঁড়ানোর শক্তিও পাচ্ছে না। কপালের রক্ত, হাতের রক্ত, ক্ষত বিক্ষত হওয়া শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত বৃষ্টির পানির সাথে গড়িয়ে পড়ছে আর সেই সাথে যোগ হয়েছে চোখের অশ্রু!  রূপকথা ছাদের মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ে।  বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে অনবরত। এরপর আর রূপকথার কিছু মনে নেই। ধীরে ধীরে রূপকথা অজ্ঞান হয়ে যায়.......

আরিশ ফোনের ওয়ালপেপারে রূপকথার ছবি দেখছে। রূপকথার ফোনটা আরিশের বেডসাইডে খুঁজে পায় ফোনের রিংটোনে। রূপকথার মা ফোন দিয়েছিল কিন্তু কথা বলেনি। কণ্ঠস্বর শুনেই কেটে দিয়েছে। রূপকথার ফোনটা লক করা নয়। ইচ্ছে করছে একবার গ্যালারিতে যেতে। কিন্তু এভাবে পারমিশন ছাড়া কোনো মেয়ের ফোন গ্যালারি চেক করা কি ঠিক হবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় আরিশ। শেষমেশ কৌতুহল আর চেপে রাখতে না পেরে গ্যালারিতে ঢুকেই পড়ে আরিশ।
ফোনে ঈশা, ঈশান, স্নেহা, বাবা মা সবার ছবিই আছে। তবে সেই তুলনায় রূপকথার ছবি খুবই কম। মেয়েটা একটু সাধাসিধে কিন্তু অপরূপ! আহামরি সুন্দর না হলেও হাসিতে বেশ লাগে মেয়েটার। রূপকথার হাসি অনেকটা শ্রুতির মত। শ্রুতি আরিশের এক্স গার্লফ্রেন্ড। শ্রুতিকে কোনো এক কারণে আরিশ ভুল বুঝে অনেক অপমান করে আর ব্রেকাপও করে। যেটা শ্রুতি মেনে নিতে পারেনি। কারণ শ্রুতির আপন বলতে ছিল শুধু ওর বোন আর আরিশ। আর সেই আরিশই যখন তাকে ভুল বুঝলো তখন শ্রুতি অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে চলে আসে। শ্রুতির দেওয়া সব জিনিসই আরিশ রাগে পানিতে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু শ্রুতি বাংলাদেশে আসার আগে একটা কাঁচের শো পিছ পার্সেলের মাধ্যমে আরিশকে পাঠায় যেখানে সুন্দর করে লেখা ছিল আরিশ লাভ শ্রুতি!
শ্রুতির প্রতি আরিশের ভুল ধারণা ভাঙ্গে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেড়ি হয়ে যায়। শ্রুতি ছিল আরিশার বেষ্টফ্রেন্ড। আরিশার মাধ্যমেই পরিচয় হয়েছিল আরিশ আর শ্রুতির। শ্রুতি কখনো ওর বাংলাদেশের বাড়ির ঠিকানা আরিশ কিংবা আরিশাকে দেয়নি। কারণ জানতে চাইলে বলতো জাহান্নামের ঠিকানা দিয়ে কি হবে! 
রূপকথার ছবির দিকে তাকিয়ে শ্রুতির কথা ভাবছিল আরিশ। শ্রুতি মেয়েটা আস্ত একটা মায়াবতী ছিল। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করাই যেন ওর রুটিন ছিল। কিন্তু আরিশের ভুলের জন্য হারিয়ে ফেললো মায়াবতীকে। আজ ১ বছর যাবৎ কোনো যোগাযোগ নেই শ্রুতির সাথে।
আচ্ছা শ্রুতি কি ভুলে গিয়েছে সব!!

০৪!!

সকাল: ৭:৫
রূপকথার বাবা বাড়িতে এসে তন্নতন্ন করে খুঁজছে রূপকথাকে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে অবশেষে ছাদে রূপকথাকে পায় অজ্ঞান অবস্থায়।শরীরে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। চোখের কোণ থেকে পানি ঝড়ে পড়ে রূপকথার বাবার। রূপকথাকে কোলে নিয়ে রুমে শুইয়ে দিয়ে মিসেস মাহমুদার কাছে যায় সে।
- কি সমস্যা তোমার? 
- কিসের সমস্যা? 
- বুঝো না কিসের সমস্যা? রূপকথাকে এভাবে ছাদে সারা রাত বৃষ্টির মধ্যে রেখেছো কেন?
- ওহ আচ্ছা এই কথা। তুমি আসতে না আসতেই তোমার কানে বিষ ঢেলে দিয়েছে। তুমি কি জানো তোমার আদরের মেয়ে ছেলেদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়? 
- মুখ সামলে কথা বলো। আমার মেয়ে তোমার মত চরিত্রহীন না। রূপকথা আমার সাথে আমার বন্ধুর বাড়িতেই গিয়েছিল।
- কিহ? কি বললে তুমি? আমি চরিত্রহীন?
- কেন? তোমার সন্দেহ আছে? স্বামী রেখে রাত-বিরাতে পার্টি করে বেড়াও এই বয়সে সেই মহিলা কি তুলসী পাতা?
- হ্যাঁ যাও আমি তো খারাপ। তাহলে কেন আছো এখনো এই বাড়িতে?
রূপকথাকে নিয়ে বেড়িয়ে যাও এই বাড়ি থেকে।
- শোনো মাহমুদা তুমি খুব ভালো করেই জানো আমার আম্মুকে ভালো রাখার মত ক্ষমতা আছে আমার। কিন্তু আমার আম্মু এই বাড়ি ছেড়ে যাবে না। কারণ অনেক স্মৃতি আছে ওর, ওর মায়ের।
আর রূপকথাকে রেখে আমিও একা যেতে পারবোনা।
- হ্যাঁ সেই তো! আদরের মেয়ে বলে কথা।
রূপকথার বাবা আর কথা বাড়ায়নি। বাড়ির বাইরে চলে যায় ডাক্তার আনতে।

ডাক্তার রূপকথাকে এসে দেখে গিয়েছে এবং ওষুধ দিয়ে গিয়েছে। রূপকথার বাবা পাশে বসে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে।
এভাবে দেখতে দেখতে পাঁচদিন কেটে যায়। এখন রূপকথা সম্পূর্ণ সুস্থ না হলেও মোটামুটি সুস্থ।
রূপকথার বাবা রূপকথাকে সময়মত খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে বলেছে। রূপকথার থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে চলে যায় রূপকথার বাবা। রূপকথার বাবা বেড়িয়ে যেতেই রুমে আসে মিসেস মাহমুদা।
- কি নবাবজাদি?  আর কত? আর কতদিন এভাবে ঢং করে শুয়ে থাকবেন?
ওঠেন এবার। বাড়ির কাজ যে সব পড়ে আছে।
- আমার শরীরে শক্তি পাচ্ছি না উঠে দাঁড়ানোর মত মা। আমি কি করে এখন কাজ করবো?
- এতকিছু তো  আমি জানিনা। বাজারে যা বাজার করে আন। ঘরে কোনো বাজার নেই। আর বাড়ির দাঁড়োয়ানটাও অসুস্থ তাই আসেনি। আমি লিস্ট করে দিয়েছি তুই গিয়ে বাজার করে আন। বাজার এনে রান্নাবান্না করবি যা উঠ।

রূপকথা ক্লান্ত শরীর নিয়েই উঠে দাঁড়ায় বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রীতিমতো রূপকথার শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কিন্তু রূপকথাকে বাজার করে বাড়িতে পৌঁছাতে হবে।
বাজার করে রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছে রূপকথা। পেছন থেকে মনে হচ্ছে কেউ ওর নাম ধরে ডাকছে কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর মত শক্তিটাও খুঁজে পাচ্ছে না রূপকথা। নিজের সাথে যুদ্ধ করে না পেরে মাটিতে এলিয়ে দেয় রূপকথার নিস্তেজ শরীর।

চোখ মেলতেই প্রিয়া আর পিংকিকে দেখতে পায় রূপকথা। আবছা আবছা চাহনিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। প্রিয়া কিছুটা রাগী স্বরে বলে,
- এই মেয়ে তোমার কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? এত জ্বর নিয়েও কেউ বাজার করতে যায়? আর তোমার বাড়িতে কি কেউ নেই নাকি? তুমি কেন বাজারে গিয়েছো?
রূপকথা কিছু বলে না। চুপ করে আছে। কি-ই বা বলবে ভেবে পাচ্ছে না রূপকথা।
- কি হলো রূপকথা? বলো (পিংকি)
- (চুপ)
- দেখো আমি তো তোমার বড় বোনের মতই। আমাকে সব খুলে বলো আমি কাউকে কিছু বলবো না। শেয়ার করতে পারো আমাদের
- কি শেয়ার করবো আপু? অভাগীর কষ্টের কথা শুনলে আপনারাও আমাকে অবহেলা করবেন। আমার এই অবহেলার জীবনে অবহেলিত সম্পর্কগুলো বয়ে বেড়াচ্ছি আমি।
প্রিয়া রূপকথার বাম হাত'টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
- পৃথিবীতে আমি ৩টা ভালো মানুষই দেখেছি খুব কাছ থেকে। এক. আমার মা, দুই. আমার আপু আর তিন. আমার একজ ন প্রিয় মুখ।
আর তাই আমার আপুকে নিজের বড় বোন ভেবেই সব শেয়ার করতে পারো আর আমাকে না হয় ভালো একটা ফ্রেন্ডই ভাবো।
রূপকথার চোখের কোণ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। রূপকথা বলতে শুরু করে,
- তখন আমি খুব ছোট। মায়ের কাছে শুনেছি আমার বাবা-মায়ের লাভ ম্যারেজ ছিল। পরিবার থেকে মেনে নেয়নি বলে পালিয়ে বিয়ে করে আব্বু-আম্মু। বিয়ের পর আমার আম্মু অনেকবার কনসিভ করার চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। খুব ভয়ে থাকতো আমার মা। যদি কোনো সন্তান না হওয়ায় আমার আব্বু আমার আম্মুকে ছেড়ে দেয় এই ভয়ে। কিন্তু আব্বু আম্মু কে আশ্বাস দিয়ে বলে ভয় পেয়ো না শান্ত হও। আমি আছি। এভাবে কেটে যায় দীর্ঘ ৪ বছর।
রূপকথার গল্পের মতই আগমন ঘটে আমার আম্মুর গর্ভে। কারণ যেখানে তারা অলরেডি জেনে গিয়েছিল যে আম্মু কোনোদিন মা হতে পারবে না। সেই থেকেই আমার আম্মু আমার নাম রাখে রূপকথা।
আমি যখন বড় হই তখন আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় আব্বু। এতদিনে আমাদের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো হয়। আমার দুঃসম্পর্কের একটা খালা ছিল। মায়ের সাথে দেখা করতে প্রায়ই আসতো আমাদের বাড়িতে। খুব ভালোই কাটছিল আমাদের সময়গুলো।
যখন আমি ক্লাশ ফাইভে পড়ি তখন একটা বড় দূর্যোগ নেমে আসে আমার আর আব্বুর জীবনে। একটা বড় রোগে হঠাৎ করেই হারিয়ে যায় আমার মা। হাজার চিকিৎসা করেও আমরা আম্মুকে বাঁচাতে পারিনি। আমার পি.এস.সি পরীক্ষার লাস্ট দিন আম্মু স্বার্থপরের মতই কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে যায় পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। তখনও বুঝিনি আম্মুকে আর কখনো দেখতে পারবো না। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করতাম আম্মু কোথায় তাহলে তারা বলতো নানু বাড়ি গিয়েছে। কিন্তু নানুরা তো আম্মুকে মেনেই নেয়নি।তবুও ছোট মনে এতকিছু ভাবিনি।
আব্বু তখন যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। শুধু কান্না করতো।  আমার দেখাশোনা করার জন্য লোক রাখা হয়েছিল। আমি তাদের কাছে থাকতাম না যেতামও না। আব্বুর কোলে গিয়ে বসে থাকতাম। একদিন আমার সেই দুঃসম্পর্কের খালা আসে আমাদের বাসায়। আমি তাকে আগে থেকেই চিনতাম তাই তার কাছে যেতেও দ্বিধা করতাম না।  সে প্রতিদিন আমাদের বাসায় আসতো রান্নাবান্না করে আমাকে খাওয়াতো। আব্বুকেও অনেকটা স্বাভাবিক পথে এনেছিল সে। আস্তে আস্তে আম্মুকে ভুলে গিয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলে আব্বু। তাকে বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। আমি দ্বিমত করিনি কারণ তার কাছেও আমি মায়ের মতই ভালোবাসা পেয়েছি।

স্নেহাকে সাথে নিয়েই বিয়ে করে আব্বুকে। স্নেহা আমার সৎ মায়ের আগের ঘরের সন্তান। স্নেহা যখন সৎ মায়ের গর্ভে অর্থাৎ সাত মাস গর্ভে তখন কিছু ঝামেলার জন্য ডিভোর্স দেয় আমার সৎ মা কে। আমার আর স্নেহার বয়সের পার্থক্য ছিল মাত্র তিনমাস। স্নেহা এ বাড়িতে আসার পর আমার প্রতি বাবার অবহেলা দেখতে পাই। স্নেহাকে নিয়েই মেতে থাকতো সে। সারাক্ষণ স্নেহাকে মা মা করে ডাকতো।  আমার তখন খুব কষ্ট হতো কিন্তু তখন মনকে এই বলে শান্তনা দিতাম যে, স্নেহা তো জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছে। ও তো বাবার স্নেহ-ভালোবাসা কি জানে না। তাই কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সহ্য করতাম। বিয়ের তিন মাসের মাথায় বদলে যায় আমার সৎ মা। আগে যেমন আদর করে খাইয়ে দিত তার চেয়েও বেশি কাজ করাতো আমাকে দিয়ে। বাবাকে কিছু বলতাম না কারণ বাবা বিশ্বাস করতো না।
স্কুল থেকে এসে থালাবাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, ঘর মুছা যতটুকু আয়ত্তে ছিল তাই করতাম। 

ক্লাস সেভেনে পড়ি। তখন বাড়ির কাজের লোক ছাড়িয়ে দেয় সৎ মা। তখন থেকেই বাড়ির সমস্ত কাজ আমাকে করতে হতো। রান্না করতে গিয়ে যে কতবার হাত পুড়েছি কিন্তু চোখে পড়েনি বা দেখার সময় হয়নি আব্বুর। কোনো সময় যদি রান্না ভালো না হতো তাহলে তারা বাহির থেকে খাবার অর্ডার করে খেতো। আর আমাকে সেই পোড়া খাবার দিত। সহ্য করতাম সবার সেই অবহেলা শুধু মায়ের কথা ভেবে। মায়ের সাজানো এই সংসার ছেড়ে কোথায় বা যেতাম আমি।  বিয়ের এক বছর পর জন্ম হয় ঈশার। খুশির রোল পড়ে যায় আমাদের সম্পূর্ণ বাড়িতে।
ক্লাশ এইটে টেস্ট পরীক্ষার আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় বাবা। অবহেলা করলেও আব্বুর প্রতি কোনো রাগ ছিল না আমার। খুব ভালোবাসতাম আব্বুকে কারণ আব্বু যে আম্মুর সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ ছিল। বাবা চলে যাওয়ায় একদমই নিঃস্ব হয়ে পড়ি আমি। সৎ মা অনেকবার বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি।  কারণ বাবা সব সম্পত্তি আমার নামেই উইল করে রেখেছিল।
যখন নাইনের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে টেনে উঠি তখন একদিন হঠাৎ করেই মা একজন ভদ্রলোককে নিয়ে বাড়িতে আসে। জানতে পারি উনি মায়ের নতুন স্বামী। মায়ের প্রতি খুব ঘৃণা হয় আমার। ঈশা এখনো ছোট সে কিভাবে পারলো বিয়ে করতে। মেনে নিতে পারিনি তখন সেই নতুন বাবাকে। কিন্তু আমার প্রতি তার ভালোবাসার কোনো ঘাটতি দেখিনি আমি। আমার নিজের বাবার চেয়েও বেশি ভালোবাসা পেয়েছি আমি। আমাকে কখনো তিনি আম্মু ছাড়া কথা বলেনি আমার সাথে। বিয়ের এক বছরের মাথায় জন্ম হয় ছোট্ট ঈশানের। কোলেপিঠে করে আমিই বড় করি ঈশানকে। মায়ের সময় কই বলো। সারাদিন পার্টি অফিস করে ঈশানকে খাওয়ানোর সময়ও হতো না তার!
আমার সেই দুঃসম্পর্কের খালাই হয় আমার সৎ মা। আর তিনিই সে মিসেস মাহমুদা।
এভাবেই কাটছে আমার অবহেলিত জীবন। বাড়িতে কেউ নেই তাই এই অসুস্থ শরীরেও আমাকে বাজারে পাঠিয়েছে মা!
পিংকি আর প্রিয়ার চোখ থেকে পানি পড়ছে........

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন