১৮!!
কিছুক্ষণ আগেই প্রিয়তি আর রিদু কুয়াকাটা থেকে ফিরেছে। প্রিয়তি বাসার সবার সাথে কথা বলছে। কার জন্য কী উপহার এনেছে তা দেখাচ্ছে। রিদু বাথরুমে ঢুকে গোসল সেরে নিলো। সারা রাস্তার ধুলো বালি যেনো সব ওদের শরীরে। বিচ্ছিরি অনুভূতি হচ্ছে সারা শরীরে। প্রিয়তি রুমে ঢুকে শাড়িটা খুলে পেটিকোট আর ব্লাউজের উপরেই বড় একটা ওড়না পেচিয়ে ফ্যান ছেড়ে বসল। রিদু বের হলে ও গোসলে করবে। বড় সুটকেস দুটোর দিকে তাকিয়ে মুখটা বিকৃত করে বলল,
" বেড়াতে যেতে খুব মজা। ঘুরতেও মজা কিন্তু জার্নির পর শরীরের অবস্থা পুরো নেতানো লাউ গাছ হয়ে যায়, দু চারদিন ঘরের পানি না পড়লে ঠিক হয় ন। আর বেড়াতে গিয়ে যেসব ড্রেস পরে নোংরা করি তা ধুতে অবস্থা পুরো হালুয়া টাইট। এখন আগামী তিনদিন শুধু কাপড় ধুতে হবে। একদিনে এতগুলো কাঁচতে পারব না। র্নিঘাত অসুস্থ হবো। রোজ দু চারটা করে কাঁচতে হবে। কাল রিদুর গুলো আগে ধুয়ে দিব। পরের দুদিন আমারগুলো। আর ঘরের কাজ তো আছেই।"
রিদু বাথরুম থেকে বের হয়ে প্রিয়তিকে দেখে শিস দিয়ে বলল,
" আমাকে আবার গোসল করাবে নাকি?"
" মানে?"
" পেটিকোট আর ব্লাউজের উপর যেভাবে ওড়না পেঁচিয়ে পরেছো তাতে মাথা নষ্ট না হয়ে উপায় আছে?"
" নষ্ট মাথা নিয়ে বসে থাকো। আমার এনার্জি নেই। আগামী এক সপ্তাহে খবরদার আমার কাছে কোনো আবদার করবে না। তাহলে ঠ্যাং ভেঙে দিব।"
রিদু মুখ বাঁকালো। প্রিয়তি আবার বলল,
" তাছাড়া মনে আছে মাত্র তিনদিন পর রকিব আর তিথির বিয়ে।"
" তুমি তো বললে তোমাদের বাড়ি যাবে না।"
" আমাদের বাড়ি যাবো না কিন্তু তোমার খালামনি অনেকবার বলেছেন তাদের বাসায় যেতে। তাই তাদের বাসায় তো যাবো। তাছাড়া বাসার সবাই তো যাবে।"
" হুঁ।"
" এখন সামনে থেকে সরো তো গোসল করতে যাবো। বালিতে গা গিজগিজ করছে।"
রিদু প্রিয়তিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
" সত্যি গোসল করতে যাবে?"
প্রিয়তি রিদুর চুল টেনে বলল,
" দিন দুপুরে বদমাইশি করলে চুল ছিড়ে দিবো। ছাড়ো বলছি। রাগ লাগছে কিন্তু।"
প্রিয়তি ওয়াশরুমে গেলো। রিদু শব্দ করে হেসে বলল,
" হিসাবটা তোলা রইল। পরে সুধে আসলে শোধ করব।"
প্রিয়তি বাথরুম থেকে বলল,
" তখন আমিও দেখব আপনি কিভাবে শোধ করেন।"
রিদু মাথা মুছতে মুছতে আলমারি খুলে ট্রাউজার বের করে পরল। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে ফোনটা চেক করল। প্রেমার একটা মেসেজ এসেছিলো সকালে কিন্তু পড়ার মত সময় পায়নি। রিদু মেসেজটা চেক করল, কিছু লেখা নেই জাস্ট ব্ল্যাংক একটা মেসেজ। রিদু মনে মনে বলল,
" ভেবেছিলাম কুয়াকাটা বসে প্রেমা কোনো ঝামেলা করবে। কারণ প্রেমা এ কয়দিন কুয়াকাটাতেই ছিলো। প্রিয়তি ওকে না দেখলেও আমি দেখেছি। এমন ফাজিল, বেহায়া মেয়ে জীবনে দেখিনি। কুয়াকাটা বসে কোনো ঝামেলা যে করেনি সেটাই অনেক। প্রিয়তি তবে খুব কষ্ট পেতো। এত দিন পর প্রিয়তির মনটা একটু ঠিক হয়েছে। নাহ এ প্রেমা নামক বিষাক্ত সাপের বিষয়টা শীঘ্রই সমাধান করতে হবে। যখন তখন সাপটা ফনা তুলে বিষাক্ত ছোবল মারতে পারে। আর দিন যত যাবে সমস্যা তত প্রখর হবে। আজ রাতেই সুযোগ বুঝে প্রিয়তিকে সব সত্যিটা বুঝিয়ে বলে দিব। অনেক লুকিয়েছি আর না। প্রেমা নামের কাটাটাকে এবার গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। সত্যিটা জানলে এমনি প্রিয়তি ভীষণ কষ্ট পাবে। কিন্তু প্রেমার মাধ্যমে জানলে আমাদের সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়বে। অামি প্রিয়তিকে ছাড়া থাকতে পারব না।"
১৯!!
তিথি চুপচাপ বইতে মুখ গুজে বসে আছে। পড়া কিছুই হচ্ছে না। এতদিন ওর মাথায় রকিব থাকলেও সেদিনের ঘটনার পর প্রিয়ম ওর মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। সেদিন প্রিয়মের অবস্থা দেখে ভেবেছিলো আজ বুঝি ওর সব শেষ। প্রিয়ম যখন জামার পিছনটা ছিড়ে ফেলেছিলো তখন ভয়ে কান্না করে পিছিয়ে গিয়েছিলো কয়েকহাত। হাতজোড় করে বলছিলো,
" প্রিয়ম ভাই আমার এত বড় সর্বনাশ করো না। আমি তোমার ছোট বোনের মত।"
প্রিয়ম ওর দিকে যত এগিয়ে আসছিলো ভয় তত বেশি বাড়ছিলো। কিন্তু হুট করে প্রিয়ম তিথির পা জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
" আমায় ক্ষমা কর তিথি। আমি যা করছি সব ভুল। কিন্তু তুই প্লিজ আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করিস না। তোকে ছাড়া আমি সত্যি বাঁচবো না। তুই যা বলবি তাই হবে। প্রয়োজনে বিয়ের পর তোকে নিয়ে আলাদা থাকবো। আমার মা বোনের ছায়া তোর পর্যন্ত পৌঁছাবে না তবুও আমায় ছেড়ে যাস না। প্লিজ তিথি তোর পায়ে পরি।"
প্রিয়মের কান্না দেখে তিথি নিজেও কেঁদেছিলো খুব। প্রিয়মকে নিজের পা থেকে তুলে জড়িয়ে বলেছিলো,
" প্রিয়ম ভাই তোমাকে আমি সত্যি সে নজরে কখনো দেখিনি। তাও তুমি যদি সত্যি আমায় ভালোবেসে থাকো, তবে আমার বাবা মাকে রাজি করাও। তারা যা বলবে আমি তাতেই রাজি।"
তারপর তিথি ওখান থেকে চলে আসে। কয়েক মিনিট পর প্রিয়মও নিজের রুমে চলে যায়। প্রিয়ম চলে যেতেই তিথি নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে সবার আগে নিজের ছেড়া কামিজটা বদলে নেয় তারপর দরজা বন্ধ করে অনেক্ষণ কাঁদে। ওর জীবনে এমন দিন আসতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেনি ও। তিথি মূলত সেদিন প্রিয়মকে শান্ত করে ঐ কথা গুলো বলেছিলো। তবে সত্যি এটাই ওর কিশোরী মনে এখনো কারো ভালোবাসার ছায়া পড়েনি। রকিবকে ভালো লাগতে শুরু করলেও তা ভালোবাসায় রূপ নেয়নি এখনো। হয়তো বিয়ের পর নিতেও পারে।
তবে সবচেয়ে বেশি ভয়টা তিথি তখন পেয়েছিলো যখন জাহানা ওর ছেড়া কামিজটা দেখে বলেছিলো,
" তিথি এটা তো নতুন কামিজ, এমন বাজে ভাবে ছিড়লো কী করে?"
তিথি কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছিলো না। হুট হাট মিথ্যা বলার অভ্যাস ওর নেই। তাছাড়া নিজের মায়ের কাছ থেকে কখনো কোনো বিষয় লুকায়নি তিথি। তাই তৎক্ষনাৎ কী বলবে তা ভেবে পাচ্ছিলো না। খানিক তুতলাতে শুরু করলে জাহানা বেগমের সন্দেহ হয়। তিথির হাতের ডানা ধরে ঝাকি দিয়ে বলেছিলেন,
" তিথি কী লুকাচ্ছিস আমার কাছ থেকে? সত্যি করে বল।"
" না মা কিছু না।"
" আমি তোর পেটে হইনি। তোর শিরা উপশিরার খবর আমার জানা। বল জামা কিভাবে ছিড়েছে?"
তিথি ছাড়া ছাড়া গলায় বলল,
" না মানে প্রি প্রিয়ম ভাই।"
জাহানা অনেক অবাক হয়ে বললেন,
" প্রিয়ম! কি করেছে প্রিয়ম?"
বেশ ধমকের শুরে কথাগুলো জিজ্ঞেস করলেন তিনি। তিথি ভয় পেয়ে ওর মাকে সব সত্যিটা বলে দিলো। জাহানা বেগমের প্রথমে ভীষণ রাগ হলেও পরে নিজের মেয়েকে নিয়ে ভীষণ ভয় পেলেন। চিন্তায় মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো তার। মনে মনে বললেন, পিশাচে ঘরটা ভরে গেছে। আমার যত কষ্টই হোক আর তিথির পড়াশোনার হোক ক্ষতি আকদের পর পরই কোনো না কোনো বাহানায় মেয়েটাকে জলদি শ্বশুর বাড়ি তুলে দিতে হবে। নয়তো কে কখন কিভাবে ক্ষতি করে বসবে কে জানে? মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয় আমার। তবে আপাতত প্রিয়মকে যে করে হোক বিয়ের আগে বাড়ি থেকে ভাগাতে হবে। নয়ত হতে পারে ও বিয়েতে একটা ঝামেলা করে বসবে। তখন তিথির জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।
সন্ধ্যাবেলা। জাহানা বেগম কেবল মাগরিবের নামাজ শেষ করে উঠেছেন। তখন প্রিয়ম তার রুমে ঢুকে বসল। প্রিয়মকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কিছু বলতে এসেছে। জাহানা বেগম নিজেও মনে মনে প্রিয়মকে কিছু কথা বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। প্রিয়ম জাহানা বেগমের চোখের দিকে না তাকিয়েই মাথা নিচু করে বলল,
" চাচি কিছু কথা ছিলো।"
" হ্যাঁ বল।"
" কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।"
" সোজা ভাবেই বলে ফেল। ঠিক যেমন আমরা সেদিন বাড়িতে না থাকার সুযোগে তুই তিথির ঘরে ঢুকে ওর সর্বনাশ করতে চেয়েছিলি। তোর মনে হয়েছিলো নিজেকে জড়িয়ে তিথির বদনাম করলে আমরা তোর কাছে সহজে তিথিকে বিয়ে দিতে রাজি হবো, তেমন সহজ করেই বল।"
প্রিয়ম মাথা নিচু করেই রইল। কারণ মাথা উঁচু করার মত কোনো কাজ ও করেনি। প্রিয়ম হুট করে জাহানা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে বলল,
" আমাকে ক্ষমা করে দাও চাচি। আমার সেদিন কী হয়েছিলো জানি না। চোখের সামনে তিথি অন্য কারো হবে তা ঠিক মানতে পারছিলাম না। আমি তিথিকে বিয়ে করতে চাই। চাচি তুমি যা শাস্তি দিবে তা মাথা পেতে নিব। শুধু তিথিকে অন্য কোথাও বিয়ে দিও না। তোমরা তিথিকে বিয়ে করতে যা শর্ত দিবে সব মেনে নিব আমি। শুধু তিথিকে আমার থেকে দূর করো না।"
জাহানা বেগম প্রিয়মকে বলল,
" প্রিয়ম পা ছাড় তারপর আমি কথা বলছি।"
প্রিয়ম পা ছাড়তেই জাহানা বেগম রুম থেকে বের হয়ে প্রিয়মের মা বাবা রেহেনা বেগম এবং পলাশকে ডেকে এনে বলল,
" আপনাদের ছেলে আমার মেয়ে তিথিকে বিয়ে করতে চায়। সে তিথিকে বিয়ে করতে যে কোনো শর্ত মানতে রাজি। এমনকি তিথিকে বিয়ে করে এ বাড়ি ছাড়তেও রাজি। আপনাদের কী মতামত?
রেহেনা এবং পলাশ দুজনেই যেনো আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে তারা প্রিয়মের দিকে তাকালো। প্রিয়ম মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখের কোনে জল। রেহেনা ছেলের কাছে গিয়ে বলল,
" কীরে জাহানা যা বলছে তা কী সত্যি?"
প্রিয়ম বেশ স্পষ্ট গলায় বলল,
" হ্যাঁ।"
রেহেনা প্রচন্ড রাগ করে বলল,
" দুনিয়ার সব মেয়েরা কী মরে গেছে যে, ঐ ফকিন্নিকে তোর পছন্দ করতে হলো?"
জাহানা চড়া গলায় বলল,
" মুখ সামলে কথা বলবেন ভাবি। ফকিন্নি কে তা সবাই ভালো করে জানে। আমার স্বামী আপনার দেবর। তার সহায় সম্পত্তি কম নেই। তিথি তার এক মাত্র মেয়ে। তার যা সব তিথির। হিসাব করে দেখলে আপনার স্বামীর সম্পত্তি তিন ভাগ হলেও আমার স্বামীর সম্পত্তিতে কোনো ভাগ হবে না। আমি আমার বাবার বাড়ি থেকেও কম পাইনি। বিয়ের সময় বাবা আমাকে দু হাত ভরে দিয়েছিলেন। আপনার বাবা আপনাকে কী দিয়েছেন? শুনেছিলাম আপনারা পাঁচ বোন বলে, আপনার বাবা পারলে এক কাপরে মেয়ে বিদায় করেন। আপনার বাবার বাড়ি থেকে তো মোটে চার শতাংশ জমি পেয়েছিলেন, যার দাম দুই লাখও হবে না। সে হিসাবে আমার বাবা বা তিথির বাবা দুজনেই আল্লাহর কৃপায় ভালো সম্পদের মালিক। এখন হিসাব করে দেখুন ফকিন্নি কে?"
রেহেনা চুপ হয়ে গেলেন। পলাশ বেশ ঠান্ডা গলায় বলল,
" প্রিয়ম তুই কী সত্যি তিথিকে বিয়ে করতে চাস?"
" জি বাবা।"
" আগে বলিসনি কেন?"
" হুট করে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। ভেবেছিলাম ওর পড়া শোনা শেষ হলে বলবো।"
পলাশ জাহানার দিকে তাকিয়ে বলল,
" জাহানা তোমার কী মতামত?"
" মাফ করবেন ভাইজান। আমি এ বাড়িতে তিথির বিয়ে দিব না। জেনেশুনে, নিজ চোখে সব দেখে তো আর নিজের মেয়েকে জাহান্নামে ধাক্কা দিতে পারি না! তাছাড়া রকিবের মাকে কথা দিয়েছি। আমি কথার খেলাপ করতে পারব না। বিয়ে শুক্রবারই হবে এবং রকিবের সাথে হবে। আপনারা আপনাদের ছেলেকে সাবধান করে দিবেন সে যেনো উল্টা পাল্টা কিছু না করে। মেয়েটা কম কষ্ট করেনি। এখন সুখের মুখ দেখার একটু আশা পেয়েছে তা আমি নষ্ট করতে দিব না। তাছাড়া যে ঘরে প্রিয়তির মত মেয়ের সাথে অন্যায় হয়, সে ঘরে আমার তিথিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে সময় লাগবে না।"
রেহেনা চোখ বড় বড় করে জাহানার দিকে তাকালো। জাহানা আবার বলল,
" দয়া করে প্রিয়মকে বোঝান নয়ত তিথির বিয়ের কয়দিন দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিন। আমি চাই না আমার জীবনের সবচেয়ে শুভক্ষণে কোনো রকম ঝামেলা হোক।"
পলাশ আর কিছু বলতে পারল না। আর রেহেনার মুখ তো জাহানা আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। জাহানা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল,
" আমি হাত জোড় করে তোর কাছে মিনতি করছি প্রিয়ম, দরকার হলে তোর পা ধরবো, তাও আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করিস না। মেয়েটাকে সুখী হতে দে।"
প্রিয়ম আর কিছু বলল না, মাথা নিচু করে, চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। যেদিন তিথির সাথে বদমাইশি করেছিলো সেদিন থেকেই নিজেকে নিম্ন প্রজাতির কীট মনে হয় ওর। আর আজ চাচির কথায় চূড়ান্ত অপদার্থ মনে হচ্ছে। যে নিজের ভালোবাসার মানুষকে সম্মান করতে পারে না, তার সম্মান রাখতে পারে না, তার সুখ দেখতে পারে না। সে তো নর্দমার পোকার চেয়েও জঘণ্য। তার জন্য সুখ, ভালোবাসার মানুষ প্রাপ্য নয়।
২০!!
রিদুর বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে প্রিয়তি। রিদু মনে মনে প্রিয়তিকে, প্রেমার বিষয়ে সবটা জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোথা দিয়ে শুরু করবে কী করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। প্রিয়তির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
" জান!"
" হুঁ।"
" প্রেমার বিষয়ে তুমি কী সব জানো?"
" সব বলতে?"
" ওর কার সাথে কী রিলেশন ছিলো বা চারিত্রিক বিষয়ে?"
" হঠাৎ এ প্রশ্ন কেনো?"
" তুমি জানতে প্রেমা বছর দুই আগে একটা এবরশন করিয়েছিলো?"
প্রিয়তি রিদুর বুক থেকে মাথা তুলে ওর মুখের দিকে তাকালো? তারপর বলল,
—————
" প্রেমার বিষয়ে তুমি কী সব জানো?"
" সব বলতে?"
" ওর কার সাথে কী রিলেশন ছিলো বা চারিত্রিক বিষয়ে?"
" হঠাৎ এ প্রশ্ন কেনো?"
" তুমি কী জানতে প্রেমা বছর দুই আগে একটা এবরশন করিয়েছিলো?"
প্রিয়তি রিদুর বুক থেকে মাথা তুলে ওর মুখের দিকে তাকালো? তারপর বলল,
" ঠিক বুঝলাম না। প্রেমার তো বিয়ে হয়নি তাহলে বাচ্চা কিভাবে? আর এবরশনই বা কিভাবে হবে?"
" বাচ্চা হওয়ার জন্য বিয়ে করতে হবে এ কথা তোমাকে কে বলল।"
" না মানে?"
" তোমার মতে প্রেমার চরিত্র কেমন?"
" ভালো বলবো না খারাপ বুঝতে পারছি না! কারণ প্রেমা খুব অল্প বয়স থেকেই বিভিন্ন ছেলের সাথে রিলেশনে জড়িয়েছে। ইঁচরে পাকা খুব। তাদের কারো সাথেই ও সিরিয়াস ছিলো না। কারো সাথেই সম্পর্ক বেশিদিন টিকতো না। কয়েকমাসের বেশি না। তবে ও প্রেগনেন্ট হয়েছিলো বা এবরশন করিয়েছে এমন কিছু তো জানতাম না।"
" বছর দুই আগে প্রেমা খুলনা গিয়েছিলো কোনো কাজে?"
প্রিয়তি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
" হ্যাঁ। আমার বড় খালার বাড়ি খুলনা। ও সেখানে প্রথমে মাস খানিকের জন্য বেড়াতে যায়। তারপর বাড়ি ফিরে বলে, সেখানের কোনো প্রতিষ্ঠানে নাকি ছয় মাসের ফ্যাশন ডিজাইনিং এর কোর্স করবে। আমরা বললাম তা তো এখানেও করা যায়, খুলনা যাবার কী প্রয়োজন? কিন্তু প্রেমা বরাবরই জেদি একঘেয়ে। ওর যা ইচ্ছা হবে তাই করবে। ওর কথার বাইরে তখন আর কেউ কিছু বলেনি। সে সময় ও ছয় মাসের জন্য খুলনা গেলেও চার বা পাঁচ মাস পর ফিরে আসে। তখন কিছুদিন ও অসুস্থ ছিলো।"
" তোমার পরিবার জানতে চায়নি কী অসুস্থতা?
" হ্যাঁ বলেছিলো হঠাৎ মাইগ্রেনের প্রবলেম খুব বেড়ে গেছে, জন্ডিস নাকি খুব বাজে ভাবে হয়েছে। যার কারণে শরীর এত অসুস্থ এবং বেড রেস্ট নিতে বলেছে ডাক্তার। যেহেতু ও নিজের বিষয়ে কারো হস্তক্ষেপ করা পছন্দ করে না, সেহেতু আমি অসুস্থতায় ওর দেখা শোনা করলেও তেমন নাক গলাইনি। অবশ্য নাক গলালেও যে তেমন বিশেষ লাভ হতো তা কিন্তু না।
" তোমার বাবা মা?"
" তারা তো প্রেমার কথা অকপটে বিশ্বাস করে। ও যা বলে তাই সঠিক।"
রিদু তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
" ওহ। বাঁধিয়ে রাখার মত বাবা মা তোমার। ছেলে মেয়ে কী করে না করে তার দিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই। মেয়েকে বিশ্বাস করে কিন্তু তা বলে অন্ধ বিশ্বাস! নূন্যতম দায়িত্ববোধ নেই তাদের? তাদের তো জাদুঘরে রাখা দরকার। এমন বাবা মা কয়জনের কপালে জোটে।"
" কী হয়েছে সেটা তো বলবে? আর প্রেমার এবরশন হলেও সে কথা তুমি কী করে জানলে?"
রিদু খানিক সময় চুপ থেকে বলল।
" প্রিয়তি এখন আমি যা বলব, তার জন্য তুমি নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত করো। কারণ কথাগুলো শোনার পর তোমার সাজানো দুনিয়াতে একটা তান্ডব হবে। কিন্তু তোমাকে নিজেকে সামলাতে হবে। প্রিয়তি একটা কথা বলি, আমি তোমাকে এবং তোমাকেই ভালোবাসি। আর এ ভালোবাসা সারা জীবন একই রকম থাকবে।"
" কতক্ষণ যাবত গোল গোল ঘুরাচ্ছো। কী হয়েছে সরাসরি বলো তো?"
একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে রিদু বলল,
" প্রেমা যে বাচ্চাটা এবরশন করিয়েছিলো তার বাবা আর কেউ নয় বরং আমি। যে কিনা তোমার স্বামী।"
হঠাৎ প্রিয়তির মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। মনে হলো ভুল কিছু শুনেছে বা রিদু মজা করছে। তাই বলল,
" মজা করছো? আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছো?"
রিদু প্রিয়তির হাতদুটো শক্ত করে ধরে বলল,
" প্রিয়তি নিজেকে শক্ত করো। যা বলব তা মন দিয়ে শোনো। প্লিজ নিজেকে স্থির রেখো।"
প্রিয়তির মাথা অলরেডি ঘুরতে শুরু করেছে। তবুও নিজেকে স্থির রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। রিদু বলল,
" তখন আমি খুলনা একটা কোম্পানিতে জব করতাম। তোমার খালার বাসাও ঐ একই এলাকায়। তোমার খালার বাসার পাশের বাড়িতে আমরা কয়জন ব্যাচলর মিলে ভাড়া থাকতাম। প্রেমাকে প্রথম তোমার খালাদের বিল্ডিং-ই দেখেছিলাম। প্রেমা যে সত্যি সুন্দর তা সবাই মানতে বাধ্য। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। সব সুন্দর তো আর প্রকৃত সুন্দর নয়। কিছু সুন্দর শুধু বাহিরে কিন্তু ভিতরে জঘণ্যও হয়। কিছু সুন্দর খুব বিষাক্ত হয়। যেমন কিছু ফুল দেখতে সুন্দর কিন্তু তা থেকে মারাত্মক সব বিষ তৈরী করা হয়।
তেমনি প্রেমা রেইনবো বোয়া আর ব্লু কোরাল বিষধর সাপের মত সুন্দর। যারা দেখতে ভংকর সুন্দর কিন্তু প্রচন্ড বিষধর। প্রেমার বাহ্যিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ওর কথা বলা বা চালচলন বেশ স্মার্ট। যা সত্যি ছেলেদের খুব সহজে মোহিতো করতে পারে। আমাকেও মোহিতো করে ফেলেছিলো। প্রেমার প্রেমের জালে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। প্রেমা ওখানে প্রথম একমাস ছিলো তখন টুকটাক কথার বাহানায় আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ধীরে ওর প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ে আর আগ্রহ, আকর্ষণ এক পর্যায়ে প্রেমে রূপ নেয়।
ওর চলে আসার আগের দিন ওকে অামি প্রপোজ করি। কিন্তু ও তখন কিছু না বলে চলে যায়। আমার অবস্থা পাগলের মত হয়ে যায়। ওর ঠিকানা জানতাম না বিধায় তোমাদের বাড়ি তখন যেতে পারিনি। গেলে হয়তো তুমিও দেখতে তখন। তাছাড়া প্রেমার ফোনও বন্ধ পেয়েছিলাম তখন। ওর সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম তোমার খালা থাকলেও, তার কাছে কী জানতে চাইতাম? বা কিসের ভিত্তিতে তার কাছে প্রেমার ঠিকানা চাইতাম। সাহস না থাকায় তা আর হয়ে ওঠেনি।
কিছুদিন পর প্রেমা আবার খুলনা যায়। আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। জানালো প্রেমাও আমাকে ভালোবাসে। সত্যি আমি সুখে ভাসছিলাম তখন প্রেমার ভালোবাসা পেয়ে। সবকিছুতে শুধু প্রেমা আর প্রেমা। হিতাহিত জ্ঞান বোধ হয় কমে গিয়েছিলো। ভুলেও তখন ভাবতে পারিনি আমি মরিচিকার পিছনে ছুটছি। ধূ ধূ মরূভূমিকে ও শুধু তৃষ্ণার্তের পানি দেখার মত মরিচিকা ছিলো মাত্র। যার পিছনে হাঁটতে গিয়ে চোরাবালির গভীরেও হারাতে পারি। ভালোবাসায় অন্ধ ছিলাম আমি। ওর ভালোবাসা লাগামহীন ছিলো।
সচারাচার দেখা যায় সম্পর্কে ছেলেরা যতটা দ্রুত এগোতে চায় মেয়েরা ততটা চায় না। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে উল্টো ছিলো প্রেমা দ্রুত সম্পর্কের গভীরে পৌঁছে যাচ্ছিলো যেটা আমি চাইতাম না। আমি তো ওকে বিয়ে করতে চাইতাম। কিন্তু বিয়ের কথা বললে ও এড়িয়ে যেতো। কিন্তু সম্পর্কে গভীরতায় যেতে ওর কোনো আপত্তি ছিলো না। শত হোক আমি একটা ছেলে। নিজেকে কয়দিন নিয়ন্ত্রন করতাম। পরে নিয়ন্ত্রনের সব বাঁধ ভেঙে গেলো। মাত্র দেড় দুই মাসের সম্পর্কেই আমরা গভীরতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাই। তারপর হুট করে প্রেমা একদিন আমাকে কিছু না বলে চলে আসে। ফোন বন্ধ, সোস্যাল মিডিয়া থেকে দূরে, একরকম গায়েব হলে গেলো।"
প্রিয়তি পাথরের মত জমে যাচ্ঠে। নিজের বোন আর স্বামীর প্রেম কাহিনী শুনছে, তাও লাগামহীন প্রেম কাহিনী। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু প্রিয়তি আজ মনে মনে শপথ করেছে যে, করে হোক নিজেকে শক্ত রাখবে। সবটা শুনবে। প্রিয়তি রিদুর দিকে না তাকিয়ে বলল,
" তারপর?"