অস্তিত্বে তুমি - পর্ব ০২ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৩!! 

-তোমার সাহস হয় কি করে নিহার আমার বোনের কাছে ওই ফ্রড ছেলেটার হয়ে ওকালতি করার? আমার বোনের খুশির সওদা করে কি পাবে ওই ফ্রডের কাছ থেকে? সাহস হয় কি করে তোমার আমার একমাত্র বোনের জীবন নিয়ে খেলা করার? দেখছ তো নীলা চাইছে না ওকে বিয়ে করতে। তবু কেন তুমি ওকে বাধ্য করছ? ও না তোমাকে ভাবিমা বলে ডাকে? মা শব্দটার এই মূল্য দিচ্ছ তুমি? এতোগুলো বছর নিজের সন্তানের মতো মানুষ করে একটা চরিত্রহীন, প্রতারকের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিতে একবারও বুক কাঁপলো না তোমার নিহার?

নিহার নীলার চোখ বেয়ে পড়া কান্নার জলগুলো মুছে দিতে দিতে নিচু গলায় জিহানের কথাগুলো বলছিল নীলাকে। হুট করে আবরার কোথা থেকে নিহারের হাতটা টেনে নীলার মাথার কাছ থেকে সরিয়ে সজোরে একটা চড় বসিয়েছে নিহারের গালে। নিহার রুমের কাঠের আলমারিটা ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে ফ্যালফ্যাল চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলো। অজান্তেই গলা দিয়ে ফোঁপানোর শব্দ বেরিয়ে গেল মেয়েটার। নীলা চোখ বুজে ছিল এতোক্ষণ। আবরারের রাগী চিৎকারটা শুনে চোখ মেলে আবরারের গায়ে ধুমধাম কয়েকটা কিল বসালো। নিহারও ফুঁপিয়ে উঠতে দেখে নীলার রাগ উঠে গেল।

-কি সমস্যা কি তোর ভাইয়া? তুই আমার ভাবিকে মেরেছিস? তোর সাহস হয় কি করে ভাবির গায়ে হাত তোলার?

-চুপ একদম নীলা। একটাও কথা বলবি না তুই। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ। যেই অমানুষটার জন্য আজ তোর এই অবস্থা এই মেয়ে তার হয়েই সাফাই গাইছে তোর কাছে? আবার ওই প্রতারকের কাছে পাঠাতে চায়? ও কি চায় আমাকে বলতে বল। সব দিয়ে দিবো। কিন্তু আমার বোনের গায়ে একটা ফুলের আঁচড়ও এলাউ করবো না আমি। কিছুতেই না।

-আমি তোর বোন তাই এতো দরদ। আমার কষ্ট দেখতে পারছিস না তুই, তাহলে ভাবি? ভাবি কারো মেয়ে, কারো বোন এটা তুই ভুলে যাস কি করে?

-নীলা? আমি কিচ্ছু ভুলি নি। আজ পর্যন্ত তোর ভাবির গায়ে কখনো হাত তুলেছি কিনা ওকে জিজ্ঞেস কর। কখনো বাজে বিহেভ করেছি? না। কিন্তু আমার বোনের ক্ষতি চাইলে কাউকে ছাড়বো না আমি। সে আমার স্ত্রী হলে তাকেও না।

-দাঁড়া ভাইয়া। একদম পালাবি না এখান থেকে। তুই ভাবির চোখের দিকে তাকিয়ে বল তো কখনো খারাপ বিহেভ করিস নি ওর সাথে? কখনো না?

-না। কখনো করি নি।

-তাই নাকি? ছয় সাত বছর আগে তোদের বিয়ে হয়েছে ভাইয়া। মনে আছে তোর কোন পরিস্থিতিতে বিয়েটা করেছিস তুই? এর পর থেকে এতোগুলো বছরে ভাবির সাথে হেসে দুটো কথা বলেছিস কখনো? মনে করে বলতে পারবি কখনো এনিভার্সারিতে বা ভাবির বার্থডেতে উইশ করে একটা গোলাপও হাতে দিয়েছিস কিনা?

-নীলা? চুপ কর। যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না।

-জানি না। কিন্তু জানতে চাই। বাবা পছন্দ করে ভাবিকে তোর বউ করে এনেছে। তুই নিজে না চেয়েও শেষপর্যন্ত রাজি হয়েছিস। কিন্তু এতো সবের ভিতরে ভাবির দোষটা কি?

-ওর দোষ হলো ও আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করতে চাইছে। সাত বছর আগে না চাইলেও এখন চাইছে। এক প্রতারক জীবন থেকে বিদায় হয়েছিল বলে ও আমার জীবনে এসেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ও আমার জীবনটা কন্ট্রোল করার অধিকার পেয়ে গেছে। সবাইকে ক্ষমা করা যায় নীলা। কিন্তু বিশ্বাস নিয়ে যে খেলা করে তাকে কখনো ক্ষমা করা যায় না। 

-ভাবি তোর কি বিশ্বাস নিয়ে খেলা করলো? ভাবি নিজের কথাটা আমাকে বলেছে তাই বলে------।

-কি বিশ্বাস ভেঙ্গেছে ওকেই জিজ্ঞেস কর না? ও জানতো না জাহিন ছেলেটার রক্তেই প্রতারণা আছে। ওর পুরো পরিবার একেকটা চিট, ধোঁকাবাজ, চরিত্রহীন। ওই ছেলে তোর পিছনে লেগেছে সেটা ও জানতো, জেনেও কাউকে কিচ্ছু বলে নি। তুই ওই ধোঁকাবাজের জালে ধীরে ধীরে জড়িয়ে যাচ্ছিস সেটাও তোর ভাবি জানতো। তবু তোকে একটাবারের জন্যও আটকায় নি। কেন কেন কেন? এখন তুই ওই প্রতারকের আসল রূপটা দেখে যখন নিজে পিছিয়ে আসছিস তাহলে কেন ও আবার তোকে ওই নর্দমার কীটের কাছেই পাঠাতে চাইছে? কেন কেন কেন? কেন নিহার? কেন? 

-ভাইয়া? খবরদার ভাবিকে কিছু করবি না। ভাইয়া?

আবরার নীলাকে কথাগুলো বলতে বলতে নিহারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিহারের হাত দুটো চেপে ধরে নিজের সামনে দাঁড় করালো। আবরারের চাপা গলার প্রশ্নগুলো শুনে নিহার কেঁপে উঠতেই নীলাও ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো। নীলা যে বিছানায় বসে আবরারকে কিছু বলছে সেদিকে আবরারের খেয়ালই নেই। সে সোজা নিহারের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আবরারের শক্ত হাতের চাপটা ধীরে ধীরে চেপে বসছে নিহারের বাহুতে। 

-বলো নিহার? কেন? কেন আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করতে চাইছ তুমি? আমার উপরে রাগ তো তোমার? স্বামীর কোনো দায়িত্বই আমি পালন করি না, তোমার কাছে আসি না, প্রয়োজনের বাইরে কথাও বলি না। এই তো অভিযোগ তোমার? তারজন্য আমার বোনটাকে ওই অমানুষটার কাছে ঠেলে দিলে পারলে তুমি? নীলার ভালোবাসাটা তোমার রাগের কাছে হেরে গেল? এতো সহজে? নাকি ওকে কখনো ভালোই বাসো নি? তাই দায়িত্ব,  কাঁধের বোঝা নামাতে চাইছ?

-প্লিজ চুপ করো আবরার। অনেক বলে ফেলেছ তুমি। আমি তোমার মতো চোখের দেখা আর কানের শোনা দিয়েই মানুষকে বিচার করি না। তাই সেদিনও বলেছিলাম তুমি ভুল ছিলে, আজও বলছি, আজও তুমি ভুল। জিহান ভাইয়াকে চিনতে তুমি ভুল করছ। যে মানুষগুলো জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে জানে তারা এমন অন্যায় করতেই পারে না। তুমি মানো আর না মানো কোনো ছলনা, প্রতারণা জিহান করে নি। যদিও কোনো প্রতারণা হয়েও থাকে তবে সেটা অন্য কেউ করেছে। জিহান বা কায়রা নয়।

-নিহার?

নিহারের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আবরারের শক্ত হাতের আরেকটা থাপ্পড় এসে পড়লো নিহারের গালে। নিহার আরেকবার আলমারির উপরে ছিটকে পড়লো। এবারে নিজেকে সামলাতে না পেরে কপালের বেশ খানিকটা কেটে গেল মেয়েটার। এদিকে আবরার নিহারকে থাপ্পড় দিয়ে সরিয়ে দিতেই নীলা বিছানা থেকে হুড়মুড় করে ফ্লোরে পা দিতেই ওর পায়ের সাদা ব্যান্ডেজ জোড়া টকটকে লাল রক্তে ভিজে গেল। ড্রেসিংটা ভেদ করে পায়ের তাজা ঘা দিয়ে আবার রক্ত বেরোনোয় অসহ্য যন্ত্রণাটা সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা ফ্লোরেই ধপ করে পড়ে গেল। না চাইতেও গলা দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে গেল নীলার। আর নীলার কান্না আর ছটফটানির শব্দে পিছনে ফিরেই আবরার আর নিহার দুজনেই ছুটে এসে নীলাকে বিছানায় তুলে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসলো। আবরার নীলার পায়ের ব্যান্ডেজটা বদলে দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই নীলা রাগ করে নিজের পা দুটো বিছানার সাথে শক্ত করে চেপে ধরে নিজেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। কিন্তু আবরারকে পায়ের ব্যান্ডেজ বদলাতে দিবে না বলে নিজের ব্যথাটা ঠোঁট কামড়ে সহ্য করার বিফল চেষ্টা করলো মেয়েটা।

-ভাবি? এই লোকটাকে বলো আমার চোখের সামনে থেকে যেন চলে যায়। নইলে আমিই--আমিই এই রক্তাক্ত পা নিয়ে এই বাড়ি ছেড়েই চলে যাবো।

-নীলু? বাড়াবাড়ি করবি না একদম। পায়ের ড্রেসিংটা বদলাতে দে আমাকে। আর একটাও কথা বলবি না বলে দিলাম। আর পা সোজা কর? কত রক্ত বের হচ্ছে?

-ভাবিইইই? তুমি কাউকে যেতে বলবা? নাকি আমি চলে যাবো রুমটা থেকে?

-তোদের দুজনের যা মন চায় কর। বাট ওই ছেলেকে নিয়ে আর কোনো আলোচনা যেন এই বাড়িতে না শুনি। তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কিন্তু আর কেউ হবে না নীলু। কথাটা মাথায় রাখিস।

আবরার রাগ করে বেড সাইট টেবিলটার উপরে থাকা গ্লাসটা তুলে সজোরে ফ্লোরে আছড়ে ফেলে নিজেই সেই ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোগুলোকে জুতোর তলায় পিষে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিহারও ছুটে এসে নীলার মাথার কাছে বসে নীলার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে কেঁদে ফেললো। আর নীলা? মেয়েটা নিহারের কোলে মুখ লুকিয়ে ক্লান্তিতে চোখ বুজে নিল। শরীরটা যেন আর চলতে চাইছে না মেয়েটার। দিনশেষে নিজেকে ক্লান্ত, শ্রান্ত, পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছে।

অন্যদিকে, বেশ গভীর রাত। চারদিকে নিস্তব্ধ গভীর অন্ধকার। এই ঘন কালো অন্ধকারে ধীর পায়ে খন্দকার বাড়ির ড্রইংরুম পার করে নীলার রুমের দিকে এগিয়ে গেল কেউ একজন। এই বাড়িটার প্রত্যেকটা রুম, প্রত্যেকটা নকশা তার পরিচিত। তাই এই অন্ধকারেও নীলার রুমটা খুঁজে পেতে তার কোনো সমস্যাই হয়নি। রুমটার সামনে এসে কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে হালকা হাতে দু টো টোকা দিল লোকটা। আর প্রায় সাথে সাথেই রুমের দরজাটা খুলে নিহার বেরিয়ে এলো। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে নিহারের ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির একটা হাসি ফুটে উঠলো।

-আমি জানতাম ভাই তুমি আসবে। মেয়েটার এই অবস্থা আর তুমি কি না এসে থাকতে পারো?

-আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাবি। আপনার এই ঋণ আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। যদি ওকে কখনো নিজের করে পাই তাহলে আপনার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো। 

-কৃতজ্ঞ হয়ে পরে থেকো। আগে মেয়েটার এই অবস্থা কি করে হলো সেটা বলো? 

-আমার দোষেই আজ আমার নীলার এই অবস্থা। ওর কাছে দুটো দিন সময় চেয়ে নিলাম যাতে সবার সব ছলচাতুরির জবাব দিতে পারি। উল্টো ওরা সেটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আমার আর নীলার মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দিল।

-কি হয়েছিল? আর নীলার পায়ের এই অবস্থা? মেয়েটা ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কেঁদেছে। কিন্তু একবারও বলে নি কি হয়েছে আপনার ফার্মহাউজে।

-একটা মেয়ে আমার ফার্ম হাউজে ঢুকেছিল ইম্পরট্যান্ট একটা প্রোজেক্টের ফাইল চুরি করতে। পালানোর আগে অনেক কিছু স্বীকার করে মেয়েটা। এমন সময়ই নীলা চলে আসে। আর ও ভুল বুঝে আমাদেরকে-----।

-ও নাহয় ভুল বুঝেছিল। তুমি ওর ভুলটা ভাঙ্গালে না কেন? কেন মেয়েটাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছ তোমরা? তোমাকে বিয়ে করবে না বলে দিয়েছে। অথচ সারাদিন মেয়েটার চোখের কোণ দিয়ে কান্নার বন্যা বয়ে গেছে। জানো?

-জানবো না আবার? ওকে তো চিনি। কেমন পাগলি মেয়েটা। আর বিয়েটা ক্যানসেলের খবরও পেয়ে গেছি। আপনার শ্বশুরমশাই বাড়িতে গিয়ে মামা মামিকে মিষ্টি দিয়ে এসেছে, বিয়ে ক্যানসেল করে।

-মানে? কিসের মিষ্টি?

-তেমন কিছু না ভাবি। এসব বিজনেস স্ট্রাটেজি। আপনাকে আবারো অসংখ্য ধন্যবাদ ভাবি। আমার বউটার খেয়াল রাখার জন্য।

-শুকনো ধন্যবাদ নিবো না ভাই। এমনিতে কত কিছু হয়ে গেল আপনার বউয়ের খেয়াল রাখতে গিয়ে।

-কেন? কি হয়েছে?

-কিছু না ভাই। এবার আপনার বউয়ের খেয়াল আপনিই রাখুন। আমার ডিউটি আবার ভোররাত থেকে নাহয় শুরু হবে। ততক্ষণ এঞ্জয় ইওর কোয়ালিটি টাইম উইথ ইওর ওয়াইফ। 

-হা হা হা। ওকে ভাবি। আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। আপনি একটা ঘুম সেরে আসুন। আবার নাহয় নিজের ননদিনীর খেয়াল রাখবেন।

-জি জি। কেমন বেশিক্ষণ থাকবেন না আমিও দেখবো। চলি। আর বিরক্ত করবো না আপনাদের। 

নিহার একটা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই জিহান রুমের দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দিয়ে নীলার পাশে এসে গা এলিয়ে দিল বিছানায়। ঘুমের মাঝেও মেয়েটা একটু পর পর ফুঁপিয়ে উঠছে টের পেয়ে জিহান নীলাকে আলতো হাতে জড়িয়ে নিয়ে নীলার ঠোঁট জোড়ায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। গভীর ঘুমের মধ্যেও নীলা কেঁপে উঠেছে দেখে জিহান হেসে নীলার কপালে ছোট্ট করে একটা আদরের চিহ্ন এঁকে দিল।

-সারাটা দিন কেঁদেছ কি ভেবে মেয়ে? তোমাকে এতো সহজে ছেড়ে দিবো এটা ভেবে? নাকি বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারটা ফিরিয়ে দিলাম, ছিড়ে ফেলতে বললাম এটা ভেবে? একবার তো কিসের পেপার দিয়েছি চেক করে দেখবে পাগলি। তা না কেঁদে কেটে নিজেও পাগল হয়ে যাচ্ছে, আমাকেও পাগল করে দিচ্ছে? পাগলি একটা বউ আমার।

০৪!! 

-তুমি জানো নীল? তোমার দুষ্টুমি মাখা হাসি, ছেলেমানুষিভরা আচরণ, অল্পতেই এতো খুশি হয়ে যাওয়া, কারো কষ্টে তোমার চোখ জোড়ার ছলছলানি, সবই আমার দারুণ লাগে জানো? শুধু এই অবুঝের মতো রাগ?! উফ! এটা একদমই নিতে পারি না আমি জানো? রাগ করো ভালো কথা, লজিক থাকা তো উচিত রাগের নাকি? আর সবসময় চোখের সামনে যা দেখছ তাই যে সত্যি এমনটাও তে না রাইট? তাহলে সামনের মানুষটাকে নিজের সাফাই দেয়ার অন্তত একটাবারের জন্য সুযোগ তো দিবে নাকি? কিন্তু নাহ। আপনার তো নাকের ডগায় রাগ। বাপরে বাপ! এতো রাগ করলে ভবিষ্যতে একসাথে সংসারটা করবো কি করে? দু মিনিট পর পরই তো ঝগড়া বাঁধিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তখন কি না খেয়ে থাকবো সপ্তাহে সাতদিনই? কি মুশকিল রে বাবা!

জিহান হালকা হাতে নীলাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে নিজের মনেই বকবক করে চলেছে। মেয়েটা যে ঘুমিয়ে কাদা সেদিকে ছেলেটার যেন খেয়ালই নেই। জিহান আরেকবার নীলার দিকে তাকিয়ে নীলার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে নীলার মাথাটা আলতো করে নিজের বুকের উপরে টেনে নিল। ওর বুকের মধ্যে করা ঢিপঢিপ শব্দগুলো নীলার কান পর্যন্ত পৌঁছোচ্ছে কি না কে জানে! জিহানের ভিষণ ইচ্ছে করছে নীলাকে ঘুম থেকে ডেকে তু্লে কতোগুলো বকা দিতে। কিন্তু মেয়েটার ক্লান্ত মুখটা দেখে প্ল্যানটা এই মূহুর্তে বাদ দিল মাথা থেকে জিহান। 

-তোমার মনে পড়ে নীল? আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটার কথা? কয় বছর হলো বলো তো? চার বছর হয়ে গেছে না ঘটনাটার? অথচ জানো এখনও মনে হয় এইতো গতকালের ঘটনা। তুমি প্রথমবার প্রথমদিন কলেজে এসেছ। এসেই ওই বখাটেগুলোর র‍্যাগের শিকার হলে। আচ্ছা বলো তো নীল? তোমার এই যে বাঘিনী রূপটা কি শুধু আমার সামনেই দেখানোর জন্য? নইলে এতো পাওয়ারফুল বিজনেসম্যানের মেয়ে, সফল বিজনেস আইকন মিস্টার আবরার খন্দকারের একমাত্র কলিজার টুকরো বোন? সে কিনা ওই সামান্য সিনিয়ারদের সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতো ঘাবড়ে যায়? এটা কোনো কথা হলো বলো? অবশ্য এক দিক থেকে ভালোই করেছিলে। তোমার ভীত হরিণীর মতো কাঁপা কাঁপা ঠোঁটজোড়া, ছলছল করা কাজল কালো চোখের চাহনিতে এক নিমিষেই ঘায়েল হয়ে গেছি। পাগলি একটা!

জিহান কথাগুলো বলতে বলতে ঠোঁট কামড়ে হেসে ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিলো নীলার কপালে।

-তুমি ছেলেগুলোর সামনে কাঁপা কাঁপা এসে দাঁড়াতেই যখন আমি এসে যখন সবগুলোকে ধরে ইচ্ছে মতো চড় থাপ্পড় মেরেছিলাম নিউ কামারদের র‍্যাগিঙ্গ করার অপরাধে, তখন ওদের চেয়ে বোধ হয় তুমিই আমাকে ভয় পেয়েছিলে বেশি, তাই না নীল? এমন কেন হয় বলো তো নীল? তুমি যত আমার থেকে দূরে পালাতে চাইছিলে, আমি ততই তোমার দিকে পাগলের মতো খিঁচে চলে আসছিলাম? যেন কোনো চুম্বকের অদৃশ্য টানে ছোটো ছোটো লোহার টুকরোগুলো তার দিকে ছুটে আসে তেমন। কি অদ্ভুত জানো নীল? বাবা মা বোনকে হারিয়ে জীবনটা একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। মামা আর মামনি ভালোবাসলেও সেটাকেও পাত্তা দেইনি কখনো। রাজনীতি, মারামারি, স্মোকিং আর প্রতিশোধের নেশা, এসবই জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল আমার। ভেবেছিলাম স্টুডেন্ট লাইফটা এভাবেই নষ্ট হয়ে যাবে। কোথাও বিরোধী পার্টির কারো গুলির বুলেটে বা ছুরির ঘায়ে মরে পড়ে থাকবো রাস্তার কোনো এক কোণে। ভেবেছিলাম কেউ কোনোদিন এই গুন্ডা ছেলেটার জন্য চোখের পানি ফেলবে না। অথচ সব আশা যখন ছেড়ে দিয়েছি সেই সময়টায় আমার জীবনে তুমি এলে নীল। আমার সুখের দূত হয়ে। তোমার এক কথায় সব ছেড়ে স্বাভাবিক একটা জীবনে এসেছি আমি। তুমিও আমার এক কথাতেই কোনো আপত্তি ছাড়াই ম্যারিজ রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিয়েটাও করে নিলে। আর এখন? এখন চাইছ আমি তোমাকে ভুলে যাই? এটা কি আধো সম্ভব? আমার জীবন থেকে তোমার নামটা মুছে দিবে এমন সাধ্য কার আছে? তোমার বাবার? নাকি তোমার ভাইয়ের? কারো নেই নীল। কারো না।

নীলাকে এবারে বালিশে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে জিহান নীলার মুখের দিকেই ঝুঁকে এলো কিছুটা। নিজে নিজে বকবক করতে করতে নীলার চেহারাটা না দেখেও ভালো লাগছে না ছেলেটার।

-আর কি যে বলেছিলে তুমি? অসময়ে চলে এসে খুব অন্যায় করে ফেলেছ। দুদিন ধরে আমি কাজের দোহাই দিয়ে এসবই চলছিল তাহলে ফার্মহাউজে তাই না? আগামী সপ্তাহে বিয়ে আর আমি অন্য মেয়ের সাথে সময় কাটাচ্ছি?! মেয়েবাজি করে বেড়াচ্ছি? তোমার হাতের থাপ্পড় আমার বুকে এতোটা লাগে না, যতটা ক্ষত বিক্ষত করেছে তোমার এই কথাগুলো। তোমাকে ইচ্ছে করেই ভুল বোঝানো হয়েছিল, মানছি। তাই বলে এই বিশ্বাস তোমার আমার প্রতি? এর যোগ্য শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে ম্যাডাম। শাস্তির আগে নিজের সাফাই ও হয়তো দিতাম, যদি তুমি বলে দিতে ফার্মহাউজের এড্রেসটা তোমাকে কে দিয়েছে। আমার অফিসেরই কেউ পিঠ পিঠে ধোঁকাবাজি করছে সেটা টের পেয়ে রানিং প্রোজেক্টটা আমি একাই করছিলাম। কাউকে না জানিয়ে ফার্মহাউজের বাড়িটাতেই সব ইম্পরট্যান্ট ডকুমেন্ট, সেইভ করছিলাম। সারা রাত টানা কাজ করে প্রোজেক্টটা রেডি করে বের হবে এমন সময় বুঝলাম কেউ একজন আছে ফার্মহাউজে। মেয়েটা আমার অফিস স্টাফ। তাই ওকে কয়েক ঘা দিতেই সব সত্যিটা উগড়ে দেয় মেয়েটা। সেটা ভেবেই হাসি পাচ্ছিল আমার। বাট তুমি ওই মূহুর্তে কোথা থেকে এলে সেটাই বুঝতে পারলাম না আমি। তোমাকে সবটা তখনই বলেও দিতাম। বাট তোমার পিছুপিছু তোমার ড্রাইভারও এসে জানালার আড়ালে লুকিয়ে আমাদের কথাগুলো শুনছিল। এতো কিছু তো কো ইন্সিডেন্ট হতে পারে না বলো? কে গন্ডগোল করছে সেটা বের করে তোমার সামনে আনা পর্যন্ত তুমিও যে বিয়েতে রাজি হবে না এটা তো বুঝতেই পারলাম। আর কি বুঝলাম জানো? আমার চেয়েও তুমি ওদেরকেই বেশি বিশ্বাস করো। ভরসা করো। আমার মুখের কথা মানবে? নাহ নিশ্চয়ই। দ্যাটস হোয়াই আই বোরো সাম টাইম ফ্রম ইউ। দেখা যাক সব সত্যি সামনে এলে তুমি কাকে সাপোর্ট করো। আমাকে? নাকি তোমার নিজের পরিবারকে?

কথাগুলো বলতে বলতে নিজের হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠে বসলো জিহান। ঘড়িতে প্রায় তিনটা বাজে। নীলার সাথে দেখা করেই চলে যাবে ভেবে এসেছিল জিহান। এখন এতো রাত হয়ে গেল কি করে সেটা ভেবেই নিজেরই হাসি পাচ্ছে ওর। এই মেয়েটার কাছে এলেই সময়গুলো কোন দিক দিয়ে উড়ে যায় টেরই পায় না ছেলেটা।

-দেখেছ তোমার সাথে বক বক করতে গিয়ে কতো রাত হয়ে গেছে? কাল সকালেই একবার আর্জেন্ট হসপিটালে যেতে হবে আমাকে। কি করে উঠবো ঘুম থেকে বলো তো? আজ তো তুমিও কল করে জাগিয়ে দিবে না? ধ্যাত। গেলাম আমি এখন। বায় বউপাখি। উম্মাহ। তুমি রাগ করে কয়দিন কথা না বলে থাকতে পারো আমিও দেখবো। বায়য়য়। 

জিহান আরেকবার ঘুমন্ত নীলার কপালে আর ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হতেই রুমের বাইরে নিহারকে করিডোরে পায়চারি করতে দেখে অবাক হয়ে নিহারের দিকে এগিয়ে এলো। নিহারও জিহানকে আসতে দেখে ঠোঁটের কোণে শুকনো একটা হাসি ফুটিয়ে তুললো ধীরে ধীরে।

-ভাবি আপনি ঘুমান নি? আমি তো ভাবলাম আপনাকে ডাকবো কি ডাকবো না। আপনি তো দেখছি জেগেই আছেন। রাত দুপুরে কি জগিং করছেন নাকি?

-জি না ভাইয়া। আসলে ঘুম আসছিল তাই হাঁটছিলাম। আপনি চলে গেলে মেয়েটা রাতে একা থাকবে, অসুস্থ, তার উপরে ব্যথার কমাতে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে ডক্টর। কি হয় না হয় তাই।

-ওই পাগলিটার আবার ঘুমের ওষুধ লাগে নাকি ঘুমাতে? কি যে ঘুমকাতুরে নীলা! 

-হুম। জানি। তাই তো আরো ভয়। দেখা যাবে ঘুমের ঘোরে কোনদিকে ঢলে পড়বে। তাই রাতটা ওকে একা ছাড়তে ভয় করছিল।

-অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাবি। আমার বউটাকে আপনার জিম্মায় দিয়ে গেলাম। একটু খেয়াল রাখবেন। পরে কিন্তু আপনার কাছেই ওর খবর নিবো। ওকে?

-জি ঠিক আছে। এখন আবরার চলে আসার আগে বিদায় হন। ও হুট করে এসে দেখে ফেললে মহা সর্বনাশ হবে।

-ভাইয়া বাড়িতে ফিরে নি এখনো?

-ওর বাড়িতে ফিরতে লেইট হয় প্রতিদিনই। কাজ থাকে তো অফিসে।

-কিসের এতে কাজ যে ওয়াইফকে জাগিয়ে রেখে রাত তিনটে বাজাতে হবে বাসায় আসতে? আমি তো রোজ দশটার মধ্যে বাসায় এসে হাজির হবো। শুধু আপনার ননদটা আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসুক।

-জি আচ্ছা। তখন দেখবো কেমন দশটায় বাড়িতে আসেন, নাকি বউয়ের অত্যাচারে বিবাগি হয়ে যান। এখন যান। আমারও ঘুম আসছে।

-বাহ রে ভাবি! বাড়ির জামাইকে এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছেন? আপনার ননদকে নিয়ে যাই একবার। আর এদিকের পথ মাড়াবো না প্রমিস।

-আগে তো আমার ননদকে বিয়ে করে ঘরে তুলুন। বাকিটা আমার ননদ সামলে নিবে। সেই ভরসা আমার আছে।

-বাহ! কি ভরসা। ওকে ভাবি। আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। এখন আসছি। অনেক রাত হচ্ছে। বায়। গুড নাইট। হ্যাভ এ সুইট ড্রিমস।

-হ্যাভ এ সেইফ জার্নি।

নিহার নীলার রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই জিহানও সতর্ক দৃষ্টিতে একবার চারদিকে তাকিয়ে বাড়ির পিছনে গার্ডেনের দিকে চলে গেল। এই রাস্তাতেই দেয়ালটা টপকে এসেছিল জিহান। দেয়ালের অপর প্রান্তেই জিহানের রাখি রাখা আছে। জাস্ট দেয়াল টপকানোর অপেক্ষা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা দেয়ালের দিকে এগিয়ে যেতেই কেউ একজন পিছন থেকে জাপটে ধরলো জিহানকে। অতর্কিত হামলায় জিহান চমকে উঠলেও হামলাকারীর দৃঢ় বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারলো না। এদিকে নীলার কাছে এসেছে বলে কোনো প্রস্তুতিই নিয়ে আসে নি জিহান। এভাবে শত্রুর ঘাঁটিতে ঢুকে কি বোকামি করলো ছেলেটা? তবে কি আজ এখানেই নীলা জিহানের প্রেম কাহিনীটার ইতি ঘটবে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন