খুনী - অন্তিম পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!!

অয়ন নাস্তা এনে সারিকাকে খাইয়ে দিতে দিতে নিজেও খেয়ে নিলো। প্লেট রাখতে উঠে দাঁড়াতেই সারিকা অয়নের হাত টেনে ধরলো।

-এই শোনো না?

-কি গো পরী?

-কাঁচা পেয়ারা খাবো---। এনে দাও না? লবণ আর গুঁড়ো লাল মরিচ দিয়ে ঝাল করে কাঁচা পেয়ারা মাখা খাবো--। বাবুও খাবে বলছে---।

-সারু? দুষ্টুমি হচ্ছে? এখন ঝাল ঝাল করে খেলে বাবুর ঝাল লেগে যাবে না?

-উহহহমম। আমি খাবো খাবো খাবো---৷ যাও না? নিয়ে এসো?

-বাসায় তো পেয়ারা নেই--। না?

-আমি কি জানি!

-আচ্ছা ঠিক আছে। নিয়ে আসছি। কোথাও যাবা না কিন্তু। ওকে?

-আচ্ছা। 

অয়ন প্লেট নিচে রেখে এসে রুমে এলো৷ চেইঞ্জ করে টিশার্ট আর জিনস পড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে উঠে ডাক্তারকে কল দিলো। 

-হ্যালো অয়ন সাহেব? কোথায় আপনি?

-সারিকার নাকি পেয়ারা খেতে ইচ্ছে করছে--। আনতে যাচ্ছি--।

-হা হা হা--।

-হাসছেন কেন ডক?

-আমার ধারণা সারিকা ম্যাডাম এই মূহুর্তে আপনার ডায়েরিটা পড়ছে। একটু পরে কল করে বলে দেখবেন যে পেয়ারা পেয়ে গেছেন---। দেখবেন অন্য কিছুর ফিরিস্তি আসবে আনার--।

-হা হা! আচ্ছা এই ব্যাপার? কিন্তু কাজটা কি ঠিক হলো বলুন? আমার ডায়েরিটা পড়ে ওর যদি মন টন খারাপ হয়?

-মন খারাপ হলে সেটা সামলে নিবেন--৷ তবু তো ভুলটা ভাঙবে উনার--।

-থ্যাংকস ডক--। রাখছি। বাকিটা জানাবো আপনাকে।

-ওকে।

এদিকে অয়নকে পেয়ারা আনতে পাঠিয়ে সারিকা আয়েশ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে অয়নের ডায়েরি পড়ায় মন দিলো। প্রথম পৃষ্ঠা খুলেই সারিকা চমকে গেল। সারিকা মুখ কালো করে সিঁড়িতে বসে আছে। ছবিটা দেখেই চিনতে পারলো ও। ছয় বছর আগের সারিকার কোচিং রুমের সামনে একা মন খারাপ করে বসে থাকা অবস্থায় তোলা ছবিটা। নিচের ক্যাপশনটা দেখে সারিকা একটু কেঁপে উঠলো। তারিখটা সহ দেয়া আছে৷ ২৬ শে জুলাই। আর নিচে লেখা, "একটা ছোট্ট পরী"। 

পরের পেইজ গুলো উল্টাতে শুরু করলো সারিকা।

"প্রথমদিনই নাম্বারটা কায়দা করে দিয়ে এসেছি। অথচ এক মাস হতে চললো এই বোকা পরীটার খবরই নেই। কয়দিন প্রচন্ড জ্বর ছিল। তাই পরীটাকে দেখতেও যেতে পারি নি। মেজাজটা অনেক খারাপ হয়ে ছিল। সবে ঘুমিয়েছি এর মধ্যে কল এসে কাঁচা ঘুমটাও ভেঙে দিলো। তার উপরে কল করে কথাও বলছিলো না৷ লাগে টা কেমন! আরেকটু হলে ধমকও দিয়ে দিতাম। তখনই বুঝতে পারলাম আমার ছোট্ট পরীটা কল করেছে। কি যে খুশি লাগছিলো! হাসিও পাচ্ছিলো। মেয়েটা একেবারেই বাচ্চা! ঠিক করে গুছিয়ে মিথ্যেটাও বলতে পারে না!"

"কোচিংয়ের ফেয়ারওয়েলের দিন পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গেছিল। গিয়েই এতো বড় একটা সারপ্রাইজ পাবো ভাবি নি একদম। পরীটা শাড়ি পড়েছে। লাল টুকটুকে বউয়ের মতো লাগছে৷ মিষ্টি একটা গানও গাইলো৷ কিন্তু সবাই ওর সাথে কথা বলতে আসছে, বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে দেখেই মাথাটা খারাপ হয়ে গেল আমার৷ ভেবেছিলাম একটু এদিক সেদিক ঘুরে তারপর পাগলিটাকে বাসায় দিয়ে আসবো। কিন্তু এতো রাগ হয়েছিল ও পাশে থাকলেও গুম হয়ে বসে ছিলাম৷ ইচ্ছে করছিল একেবারে বুকের ভিতরে পিষে ফেলি। পরীটা শুধু আমার। ওর দিকে কেউ তাকাবে কেন! 

পরীটা যখন বললোঃ "আমি তো আপনার জন্যই সেজেছিলাম আজ" তখন কি যে শান্তি লাগছিল। পাগলিটার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিতেই একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল আরেকটু আদর করে কাছে টানি--।"

"পরীটাকে অনেক বকেছি। এখন নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। ও তো আসলেই একটু বাচ্চা স্বভাবের। তাই আসলেই হয়তো বুঝতে পারে নি যে দেখতে আসা মানে বিয়ের জন্য সম্বন্ধ এসেছে৷ এতো বাচ্চা কেন রে তুই পাগলি?"

"আজকে আমাদের বিয়ে হলো। জিহানের সামনে থেকেই পরীটাকে নিয়ে এলাম। পাগলিটার সে কি খুশি! বন্ধুর বাসায় বিয়ের সমস্ত আয়োজন সকালেই করিয়ে রেখেছিলাম। দুপুরে আমরা আসার পরই বিয়েটা হলো। সারাদিনের আড্ডা আর দুষ্টুমির পর পাগলিটাকে একটু আগে একান্তে পেয়েছি। কিন্তু ওকে আদর কি করবো! এই বাচ্চাটা আরেকটা বাচ্চা কি করে সামলাবে! তবু আজকের রাতে পাগলিটাকে ভালোবাসার একটা নতুন দুনিয়ায় ঘুরিয়ে আনলাম। এক চাদরে পেঁচিয়ে আছে আমাদের দুজনের দেহ। পাগলিটা আমার বুকেই ঘুমিয়ে গেছে। অথচ ওর এই ঘুমন্ত মায়াবী মুখটা যেন আমার চোখের সমস্ত ঘুম কেড়ে নিয়েছে৷ ইচ্ছে করছে ঠোঁটে একটা কামড় দিয়ে ঘুম ভাঙাই ওর--। ধ্যাত কি সব ভাবছি!"

"ভিষণ রাগ লাগছিলো আজকে। একটা আন্টি এসেছিল বাসায়। মায়ের কোন এক বান্ধবী। মাকে বলছে, আজ তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে বাচ্চা কাচ্চা হয় না কেন? বউয়ের কোন সমস্যা আছে কিনা। সেরকম কিছু হলে তার নাকি পরিচিত কোন মেয়ে আছে। সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট। শুনেই রাগটা মাথায় চড়ে গেল। রাগ করেই বললাম আমি নিজেই এখন বেবি চাইছি না। বলার পরে নিজের কাছেও খারাপ লেগেছে প্রচুর। সেদিন আমার বুকে শুয়ে আমার পাগলিটা কতো প্ল্যানিং করছিল। একটা ছোট্ট পরীর প্ল্যানিং। ওকেও কথা দিয়েছিলাম ছোট্ট একটা পরী এনে দিবো ওকে। অনেক অনেক ভালোবাসায়ও ভরিয়ে দিয়েছিলাম পাগলীটাকে সেদিন। কেন জানিনা বেবি চাই না বলতে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠছিল।"

"আজকের দিনটার জন্য নিজেকে ভিষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। আমাদের ছোট্ট পরীটাকে বাঁচাতে পারি নি। মায়ের কল আসায় জানতে পারলাম সারু সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে। মিসক্যারেজের কথা শুনেই যেন আমার দুনিয়াটা থমকে গেল। ও আমাকে কনসিভ করার কথাটা কেন লুকিয়ে গেছে বুঝতে পারলাম না৷ হয়তো পরে কখনো সারপ্রাইজ দিবে ভেবে। অথবা লজ্জায়-! কিন্তু সব যে শেষ হয়ে গেল! পাগলিটাকে সামলাবো কি করে!"

"দুটো বছর পর ও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে ঠিকই। তবুও কোথায় যেন একটা দূরত্ব রয়ে গেছে। ওর মনে হচ্ছে আমি চাই নি বলেই আমাদের ছোট্ট পরীটা দুনিয়ায় আসে নি। ওকে কি বলবো! আমার নিজের কাছেও নিজেকে খুনী মনে হচ্ছে।  একটা কথা এভাবে ফলে যাবে ভাবতেই পারিনি। 

কিন্তু ডক্টর ওকে সুস্থ করার জন্য একটা লাস্ট সলিউশন দিয়েছে। নতুন করে কোলে ছোট্ট একটা প্রাণ এলে ও নাকি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে ধীরে ধীরে। কিন্তু পরীটা যে অসুস্থ! ওকে এই অবস্থায় কি করে কাছে টানি!"

"পরীটাকে খুব করে কাছে টেনেছি৷ পরীটাও সমান তালে পাগলামি করেছে। বহুদিন পাগলিটাকে এতোটা কাছে টেনে বুকের ভিতরের অপরাধবোধের আগুনটা যেন একটু ঠান্ডা হলো। আমার পাগলিটাকে অনেক করে ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিয়েছি। খুব করে চাই একজন জলদীই আসুক যাকে নিয়ে পরীটা আবার আগের মতো হেসে মেতে থাকবে।"

"ডক্টরের কাছ থেকে রিপোর্ট আনতে গিয়েই জানতে পারলাম পরীটা আবার কনসিভ করেছে৷ কি যে আনন্দ লাগছিলো! ইচ্ছে করছিলো ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরি। বাসায় এসে দেখি পাগলিটা ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে। এতো যে কাঁদে কি করে একটা মানুষ বুঝি না। তবে এরপরে এবার আর কাঁদতে দিবো না আমার পাগলীটাকে। আর কাউকে হারিয়ে যেতেও দিবো না। আগলে রাখবো তোমাদের দুজনকেই। প্রমিস।"

"এতোগুলো দিন পর ডাক্তারের কথায় চমকে গেলাম। কাকে রেখে কাকে সন্দেহ করবো! পাগলীটা রুমে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে যাচ্ছে জানি। কিন্তু কি করবো! তোমাদের দুজনকে নিয়ে তো কোন রিস্ক নিতে পারবো না পরী৷ ভয় লাগছে ভিষণ।"

সারিকা অয়নের ডায়েরিটা বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেললো। এই মানুষটা ওকে কতো ভালোবাসে! আর ও কিনা এই মানুষটাকেই ভুল বুঝে এতোটা কষ্ট দিলো! নিজের উপরেই প্রচন্ড রাগ হচ্ছে সারিকার। 

ঘন্টাখানেক পর অয়ন কাঁচা পেয়ার নিয়ে বাসায় ফিরলো। সারিকার পছন্দ মতো পেয়ারা ধুয়ে লবণ মরিচ দিয়ে মেখে রুমে এলো। রুমের দরজায় এসেই অয়ন থমকে গেল। সারিকা আলতো হাতে পেটে হালকা হালকা চাপড় দিচ্ছে আর হালকা গলায় গান করছে।

"ভালো আছি,
ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালা খানি ।।
বাউলের এই মনটারে
ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

পুষে রাখে যেমন ঝিনুক খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ ।।

তেমনি তোমার নিবিঢ় চলা ভিতরের এই বন্দরে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে ।।

ভালো আছি, ভালো থেকো; আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো ।।
দিও তোমার মালা খানি বাউলের এই মনটারে
ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে ।।

ঢেকে রাখে যেমন কুসুম পাপড়ীর আবডালে ফসলের ধুম ।।
তেমনি তোমার নিবিঢ় ছোয়া গভীরের এই বন্দরে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে ।।

ভালো আছি, ভালো থেকো; আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো ।।
দিও তোমার মালা খানি বাউলের এই মনটারে
ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে ।।"

১০!!

অয়ন রুমে এসে পেয়ারা মাখার বাটিটা সারিকাকে ধরিয়ে দিয়ে সারিকার পাশে শুয়ে সারিকাকে জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজল। আর নিজে নিজেই বাবুর সাথে কথা বলতে লাগলো। সারিকাও হেসে ঝাল পেয়ারা খাচ্ছে আর ঝালে এপাশ ওপাশ করছে। 

-আরে? সারু? কি করো? বাবুকে আদর করছি দেখছো না? এতো ডিস্টার্ব করছ কেন?

-ঝালে মরে গেলাম আমি--। উফ। সরো--? পানি খাবো---।

-এই খবরদার পানি খাবা না এখন। ফল খেয়ে পানি খায় না। 

-ঝাল ঝাল! প্রচন্ড ঝাল তো!

-আহারে! আসো একটু মিষ্টি খাওয়াই---। 

অয়ন উঠে বসে সারিকার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। অয়ন সরে এসে খাটে হেলান দিয়ে সারিকার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে৷ সারিকাও লজ্জা পেয়ে অয়নের বুকে মুখ ডুবালো।

-শোনো না?

-হুম?

-একটা গান শোনাও না?

-এখন!

-বারে? তুমি তো আগে রাত ২ টোয় ডেকে গান শুনতে চাইলেও শোনাতে। আর এখন বলছো! --। খারাপ একটা তুমি!

-ওরে আমার ড্রামা কুইন! শুনাচ্ছি ওয়েট।

-যাও যাও। শোনাতে হবে না। হুহ।

অয়ন হেসে সারিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে গান ধরলো।

-"Udja kaale kaawan tere moonh vich khand paawan
Leja tu sandesa mera, main sadke jaawaan
Baagon mein phir jhoole padh gaye
Pak gayan mitthiyaan ambiyaan
Yeh chhoti si zindagi te raata lambiyaan lambiyaan
O ghar aaja pardesi, ke teri meri ek jindri...

Chham chham karta aaya mausam
Pyaar ke geeton ka
Ho, chham chham karta aaya mausam
Pyaar ke geeton ka
Raste pe ankhiyaan rasta dekhe
Bichhde meeton ka

Aaj milan ki raat na chhedo baat judaai waali
Main chup, tu chup, pyaar sune
Bas pyaar hi bole khaali
O ghar aaja pardesi, ke teri meri ek jindri
Hoye, o ghar aaja pardesi, ke teri meri ek jindri...

O mitra, o yaara, yaari todke mat jaana
Ho, o mitra, o yaara, yaari todke mat jaana
Maine jag chhoda, tu mujhko chhodke mat jaana

Aisa ho nahin sakta, ho jaaye to mat ghabraana
Main daudi aaungi, tu bas ek awaaz lagaana
O ghar aaja pardesi, ke teri meri ek jindri
O ghar aaja pardesi, ke teri meri ek jindri...

Udja kaale kaawan tere moonh vich khand paawan
Leja tu sandesa mera, main sadke jaawaan
Baagon mein phir jhoole padh gaye
Pak gayan mitthiyaan ambiyaan
Yeh chhoti si zindagi te raata lambiyaan lambiyaan
O ghar aaja pardesi, ke teri meri ek jindri..."

-আম সরি অয়ন। শুধুশুধুই তোমাকে ভুল বুঝে এতোটা কষ্ট দিয়েছি। নিজেকেও, তোমাকেও। সেদিন এতো ভেঙে না পড়ে তোমাকে পরীটার কথা বললে হয়তো আমার মেয়েটা আজ----।

-শশশশ। চুপ---। যা হয়ে গেছে তা আমরা বদলাতে পারবো না পাগলীটা। এখন কান্নাকাটি করে বাবুটাকে অসুস্থ করছো কেন? আর তো কয়েকটা দিন শুধু---।

-হুম। সাড়ে সাত মাস চলছে---।

-আমার বাবাইটা আসার ওয়েট করতে পারছি না যে। শীঘ্রি আস না বাবা?

মাস দুয়েক পর। 

অয়ন সারিকাকে রাতে খাইয়ে দিয়ে আইসক্রিম আনতে বাইরে গিয়েছিল। পাগলিটার নাকি এতো রাতে আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে। আইসক্রিম নিয়ে বাসায় এসে একটা বাটিতে আইসক্রিম নিয়ে রুমে এলো অয়ন। রুমে ঢুকেই ভ্রু কুঁচকে গেল অয়নের। সারিকা গ্লাস ভর্তি দুধ হাতে করে মুখ কালো করে বসে আছে। অয়ন গ্লাসটা রেখে সারিকাকে আইসক্রিমের বাটিটা ধরিয়ে দিলো। 

-সারু? দুধ কে দিয়ে গেল?

-রহিমা খালা তো বাসায় নেই। মা ছাড়া আর কে দিবে বলো?

-মা! উপরে এলো!

-হুম। বাসায় তো আর কেউ নেই। খালা তো সন্ধ্যায় চলে গেল না?

-হুম। দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না পরীটার?

-উহু---। জানো তো দুধের গন্ধ সহ্য হয় না। ইয়াক---। কিন্তু মাকে কি করে বলি?

-ওলে বাবা---। খেতে হবে না তোমার। তুমি তোমার আইসক্রিম খাও?

-থ্যাংকু অয়ন। উম্মাহ--। লাভ ইউ।

-কিন্তু দুধটা তো নষ্ট হবে--। আচ্ছা বাদ দাও আমিই খেয়ে নেই। সামনে দুটো পিচ্চিকে সামলাতে হবে তো। অনেক এনার্জি লাগবে---।

-কি বললা তুমি?

-হা হা হা---।

রাত ১ টা বাজে। সারিকা বেডের পাশে দাঁড়িয়ে অয়নের কানে মোবাইলটা ধরলো। মা কল করেছে৷ অয়ন আলতো করে সারিকার চোখ মুছে দিলো। মেয়েটা যে এতো কাঁদতে পারে! হাতটা উঠাতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে অয়নের। তবু মোবাইলটা ধরলো কানে শক্ত করে। কণ্ঠটাও যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো৷ 

-হ্যালো মা? বলো?

-অয়ন? বৌমা কেমন আছে? আর বাবুটা?

-ওরা ভালো আছে মা। চিন্তা করো না। 

-ও! ভালো আছে না?

-মা তুমি কি হসপিটালে আসবে দেখতে?

-হ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা--। আসছি--। 

-আচ্ছা মা এসো--। ড্রাইভারকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি চলে এসো ওর সাথে। 

অয়ন কলটা কাটতেই সারিকা আবার ফুঁপিয়ে উঠলো।

-সারু? বললাম না কাঁদবে না?

-অয়ন! এসব!

- মা আসুক। তারপর --। প্লিজ? এখন একটু রেস্ট করো প্লিজ?

সারিকা পাশের চেয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। আধা ঘন্টার মতো পরে অয়নের মা হাসপাতালের রুমটায় ঢুকলেন। অয়নকে বিছানায় স্যালাইন আর ব্লাড দেয়া অবস্থায় দেখে, আর সারিকা, সারিকার বাবা, মা কে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেল অয়নের মা। অয়ন মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে মাকে দেখছে।

-কি মা? সারিকার জায়গায় আমাকে দেখে অবাক হলে! তোমার প্ল্যান অনুযায়ী তো এতোক্ষণে সারিকা আর আমার বাচ্চাটা মরে---মরে যাওয়ার কথা ছিল তাই না? কেন করলে মা এমনটা? আমাদের ফার্স্ট বেবিটাকেও খুন করলে! কেন মা!

কয়েক ঘন্টা আগের ঘটনা।
অয়ন সারিকার সাথে দুষ্টুমি করতে করতে গ্লাসের দুধটুকু খেয়ে নিলো। পনেরো মিনিটের মতো পর অয়নের সমস্ত শরীর ঘামতে লাগলো। সারিকা বাতাস করছে, ভিজে টাওয়াল দিয়ে মুছে দিচ্ছে-তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সারিকা ভয় পেয়েই ওর ডাক্তারকে কল করে সবটা বললো। ঘটনা শুনে ডক্টর নিজেও হতবাক হয়ে গেলেন। হসপিটালের উদ্দ্যেশে বের হতে হতে সারিকাকে বললেন অয়নকে ইমিডিয়েটলি হসপিটালাইডজ করতে। অয়ন মুখ শক্ত করে সারিকার মুখটা তুলে ধরলো।

-সারু? প্লিজ কাম ডাউন? আই উইল বি অলরাইট ওকে? ইউ জাস্ট কাম ডাউন?

-হুম।

-শুনো? জাস্ট একটা কাজ করো প্লিজ? কোন প্রশ্ন করো না? প্লিজ? নিচে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসা পর্যন্ত জাস্ট এটা এ্যাক্টিং করবা যে তোমার ভিষণ পেইন হচ্ছে --। ওকে?

-নিচে তো শুধু মা----?

-প্লিজ সারু? কি কেন এসব না? প্লিজ? আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে --।

-ওকে ওকে--। অয়ন--।

-একটু সাবধানে পাগলি----। 

বর্তমানে।

-কি হলো মা? আমাদের নাটক দেখে তো ভেবেছিলে তোমার ওষুধের কারণে সারিকার শরীর খারাপ বলে ওকে হসপিটালে নিয়ে এসেছি, তাই না? আসলে তখন দুধটুকু আমি না খেয়ে যদি সারিকা খেতো! আমি আবারও আমার আরেকটা সন্তানকে হারাতাম। আর হয়তো সারিকাকেও। কেন করলে এমনটা মা? তুমি তো ওকে অনেক ভালোবাসতে মা?

-কি বললি? এই মেয়েকে! আমি ভালোবাসতাম! ওকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি নি। এখন নয়--সেই ছয় বছর ধরে। তুই যে এই মেয়ের মধ্যে কি দেখলি! বিয়েটা না করানোর জন্য ওর বাবা মাকে কল করে থ্রেট দিলাম৷ বিয়ে হলে মেয়েকে মেরে ফেলবে বলে৷ সব ঠিকই চলছিলো। কিন্তু তোরা কি করলি? কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে বিয়েটাও করে নিলি। বিয়ের পরে তিনটা বছর খাবারের সাথে ওষুধ খাইয়ে কনসিভ করা আটকেছি--। আর এই মেয়েটা একদিন নাচতে নাচতে এসে আমাকে খবর দিলো ও নাকি মা হবে! হা! ওর মা হওয়ার শখ বন্ধ করাতে তোকেও ওর কাছে কালার করিয়েছি--। হালকা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে পরে আবার নিচে আসতে বলেছি--। মেয়েটা সিঁড়ি থেকে পড়ে বাচ্চাটা মরলো। কিন্তু এই মেয়ের তো কই মাছের প্রাণ! সে তো মরলো না। উল্টো ডিপ্রেশনে চলে গিয়ে আমার ঘাড়ে বোঝা বাড়ালো--।

-মা!

-এই মেয়ে! খবরদার আমাকে মা বলবি না। এতো কষ্ট করে ছেলে পেলেছি কি তোর লেজে লেজে ঘুরতে‌! তুই মরতি! আমি আমার পছন্দের একটা মেয়ে দেখে ছেলেটাকে বিয়ে করাতাম!

-যথেষ্ট বলেছ মা! আর একটা কথাও না। তোমাকে মা বলে ডাকতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার। তুমি নিজের পছন্দে বিয়ে করানোর কথা বলছো! আরে তুমি কি মানুষ! যে অনাগত শিশুটাকে তুমি পৃথিবীর আলোটাই দেখতে দিলে না সে কি তোমার কিছু ছিলো না? এই যে আজ যে বাচ্চাটা তোমার হাত থেকে বেঁচে গেল সে তো তোমার সন্তানেরই রক্ত! তার জন্যও একটু দয়া হয় নি মনে! তোমাকে পুলিশে দেয়ার আগে তুমি চলে যাও এখান থেকে। আর একটা কথা মনে রেখ। সন্তান হওয়ার দায়িত্ব আমি পালন করবো মা। ভয় নেই। মাসে মাসে টাকা তোমার বাড়িতে পৌঁছে যাবে---। 

-অয়ন---। মাকে এভাবে বলো না। উনি তো আমাকে পছন্দ করে না তাই---। কিন্তু তুমি তো উনার সন্তান বলো?

-খবরদার সারু---। আমি আমার সন্তানের খুনীকে কখনো মাফ করতে পারবো না। আর যে বাড়িতে আমার সন্তানের রক্ত লেগে আছে। সেখানে ফিরবোও না। সেদিন তোমার ডায়েরিতে যখন পড়লাম তুমি কনসিভের কথা মাকে বলেছ--অথচ মা ওই আন্টির সামনেও কোন প্রতিবাদ করেনি--আমাকেও বলে নি তখনই সন্দেহ হয়েছিল। আর আজ তো দুধটা মা দিয়েছি শুনে তোমাকে খেতে না দিয়ে নিজে খেলাম বলেই সন্দেহ টা ঠিক প্রমাণ হলো---। যদি ভুল করেও তুমি খেতে-----। আঙ্কেল আন্টি--। আপনারা প্লিজ উনাকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যান--। আমি চাই না উনার মতো মহিলার ছায়াও আমার সন্তানের উপর পড়ুক।। উনি মা নন, উনি একজন খুনী--। সি ইউ এ ড্যাম মার্ডারার---।

আরো কয়েকটা দিন পর সারিকার কোল আলো করে ফুটফুটে একটা ছেলে এলো। অয়ন আদর করে ছেলের নাম রাখলো সায়ন। অয়ন, সারিকা, সায়ন-তিনজনের ছোট্ট সংসার শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে সময় করে অয়ন সারিকাকে ওর বাবা মায়ের বাসা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে সে৷ মায়েরও খোঁজ খবর রাখে অয়ন। রহিমা খালার কাছে মাসে মাসে টাকা পাঠায়। তবে অয়নের নতুন সংসারে মায়ের জায়গা দেয় নি অয়ন। নিজের সন্তানের খুনীকে সংসারে জায়গা দেয়ার মতো শক্তি অয়নের নেই। হয়তো তাই সারিকা তত জোর করতে পারে না অয়নকে মাকে আনার জন্য। এভাবেই সমস্ত অপশক্তিদের আড়ালে ভালো আছে অয়ন-সারিকার ভালোবাসার সংসার। 



                                 ***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন