আড়ালে আবডালে - পর্ব ১৯ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


আমানের কথা শুনে নিরব বড় বড় ঢোক গিলে। অবিশ্বাসের চোখে একবার আমানের দিকে তাকায় আবার আরেকবার নিহির দিকে তাকায়। আমান টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বিছানার ওপর বসে। টাওয়ালটা বিছানার ওপর রেখে ফাইলগুলো হাতে নিয়ে বলে,
"কোনটায় সাইন করতে হবে?"

বিছানার ওপর ভেজা টাওয়াল রেখেছে বলে নিহি রেগে যায়। টাওয়ালটা হাতে নিয়ে আমানকে ধমক দিয়ে বলে,
"খাইচ্চরা কামকাজ!"
টাওয়াল নিয়ে হনহন করতে করতে নিহি বারান্দায় চলে যায়। নিহির ধমক খেয়ে আমান নিহির চলে যাওয়ার পথে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। এদিকে নিরব একটার পর একটা শকড খেয়েই চলেছে। বারান্দায় টাওয়ালটা মেলে দিয়ে আমান ও নিরবকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিহি রান্নাঘরে চলে যায়। নিরব কাচুমুচু হয়ে প্রশ্ন করে,
"সত্যিই কি উনি আপনার ওয়াইফ স্যার?"

নিরবের কথায় ধ্যান ভাঙে আমানের। নিহির ধমকের প্রভাব প্রয়োগ করে নিরবের ওপর। পিঞ্চ মেরে বলে,
"না, না। জুলাপাতি খেলার জন্য জামাই-বউ সেজেছি। খেলা শেষ হলেই বাড়ি চলে যাবে।"
নিরবকে কথা শুনিয়ে আমান ফাইলগুলো চেক দেওয়ায় মন দেয়। আমানের পিঞ্চ মেরে বলা কথাগুলো বুঝতে সামান্যতম ক্লেশ পেতে হয় না নিরবকে। পাল্টা কোনো প্রশ্ন করতেও সাহসে কুলাচ্ছে না। আবার স্যার কাউকে না জানিয়েই বিয়ে করেছে এই বিষয়টাও নিরবের বিশ্বাস হচ্ছে না। সব কেমন যেন পেটের মাঝে গুলিয়ে যাচ্ছে। আমানের মন ভালো করতে নিরব প্রশ্ন করে,
"স্যার চা খাবেন? বানিয়ে আনব?"

নিরবের সরলতা দেখে আমান হেসে ফেলে। মূলত নিরবকে এজন্যই আমানের এত ভালো লাগে। এবং অন্য সব এমপ্লয়িদের চেয়ে নিরবকে আলাদা চোখে দেখে। আমানকে হাসতে দেখে মনে সাহস ফিরে পায় নিরব। আবার জিজ্ঞেস করে,
"স্যার আনব?"
আমান ফাইল দেখতে দেখতে হেসে হেসেই বলে,
"চা বানাতে হলে লোক আছে আমার। তুমি বানাবে কেন?"
"কী যে বলেন না স্যার! আপনার জন্য চা বানাতে পারলে আমার ভালো লাগবে।"

আমান আড়চোখে একবার দরজার দিকে তাকায়। এখান থেকে ড্রয়িংরুমের অনেকটা অংশ দেখা যায়। নিহি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সে জায়গাটা স্পষ্ট। আমান নিহিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
"বুঝলে নিরব, তোমার মতো করে কেউ বোঝে না। আমায় চা বানিয়ে দেওয়া যে সৌভাগ্যের বিষয় সেটাও সবার বোধগম্য হয় না।"

আমানের কথা পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে নিহি। দাঁতে দাঁত চেপেও রাগকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। এই লোকটার সমস্যা কী হ্যাঁ? না, সমস্যাটা আসলে কী? পেছনে না লেগে থাকলে লোকটার যেন বদহজম হয়! আমান মুখ টিপে টিপে হাসছে। পরিস্থিতি সুবিধার ঠেকছে না নিরবের। নিরবের ভাবভঙ্গি দেখে আমান বলে,
"যেকোনো সময় বোম ফুটতে পারে। সাবধানে থেকো।"

আমানের বলতে দেরি, নিহির তেড়ে যেতে এক সেকেণ্ডও সময় লাগে না। নাক ফুলিয়ে চোখ দুটো ছোট ছোট করে যত রাগ আছে সব ঢেলে বলে,
"আমি কেন বানাতে যাব চা? আমার কী ঠ্যাকা পড়ছে? একজন মানুষ থাকতেন বাসায়। তার জন্যই তো দুজন মানুষ কাজের জন্য রেখে দিছেন। তাহলে আমি কেন চা বানাতে যাব?"
নিহির রাগে একটুও পরিবর্তন এলো না আমানের। ও চুপচাপ ফাইল দেখছে। তাও মনোযোগ দিয়ে। বেচারা নিরব সব গিলেছে নিহির দিকে তাকিয়ে। আমান আগের ভঙ্গিতেই বলে,
"দেখেছ নিরব, আমার বউ কত সংসারী? এখনই আমার টাকা-পয়সা নিয়ে কত ভাবছে।"
"স্যার, কেন সেধে সেধে বোম ফুঁটাতে যান?" বিড়বিড় করে অসহায় ভঙ্গিতে বলে নিরব।

নিহি আমানকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমান টুকটুকি আর আবুলকে ডাকে। আমানের এক ডাকেই দুজন সঙ্গে সঙ্গে হাজির। আবুল বলে,
"কন ভাইজান।"
হাতের ফাইলটা বন্ধ করে আমান সোজা হয়ে বসে। ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
"তোদের আপামনি যে তোদের চাকরী খেয়ে দিতে চাচ্ছে সে খবর কি তোরা রাখিস?"
আমানের কথা শুনে নিহি বড় বড় চোখ করে তাকায়। কী রকম মিথ্যাবাদী ভাবা যায়? আমান আবার বলে,
"আমি একা মানুষ হয়ে তোদের দুজনকে কাজে রেখেছি বলে তোদের আপামনির রাগ হয়েছে। টাকার হিসেব করছে।"

আবুল আর টুকটুকি দুজনেরই মনঃক্ষুণ্ণ হয়। টুকটুকি মাথা নত করে অসহায়ভাবে বলে,
"আপনেরে অনেক ভালা ভাবছিলাম আপাজান। আপনে যে আমগোর চাকরী খাইতে চাইবেন এইটা আমরা আশা করি নাই।"
"হ আপামুনি। এই কামডা আপনে কেমনে করতে পারেন?" টুকটুকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে আবুলও।
"এসব মিথ্যে। আমি এমনভাবে কিছু বলিনি। বিশ্বাস করো। আমি কেন তোমাদের চাকরী খেতে যাব?" বিশ্বাসের সুরে বলে নিহি।

আমান এবার হো হো করে হেসে ফেলে। নিহির আরো রাগ বেড়ে যায়। নিহি বলে,
"দেখেছ, দেখেছ? কীভাবে হাসতেছে এখন? আপনি একটা ফাজিল লোক।"
আমান তবুও হাসে। এদিকে নিহি যে এমনকিছু বলেনি তা আবুল আর টুকটুকিকে বিশ্বাস করানোর জন্য উপায় খুঁজছে। নিরবকে দেখতে পেয়ে বলে,
"এইযে ক্যাবলা ভাই, আপনিই বলুন আমি কী এমনকিছু বলেছি?"

নিরবের চোখ দুটো লাড্ডুর মতো হয়ে যায়
আমানের হাসি আরো বেড়ে যায়। এবার হাসিতে যোগ দেয় আবুল আর টুকটুকিও। নিরব ডানে, বায়ে তাকিয়ে অসহায়ের মতো নিজের দিকে আঙুল তাক করে বলে,
"আপনি কি আমাকেই ক্যাবলা বললেন ম্যাম?"
"আরে হ্যাঁ, আপনাকেই বলেছি।" দৃঢ়তার সঙ্গে বলে নিহি।

নিরব এবার অসহায়ের মতো আমানের দিকে তাকায়। হাসতে হাসতে আমানের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছে। নিরবকে চুপ থাকতে দেখে নিহি বলে,
"কী হলো? চুপ করে আছেন কেন? বলুন।"
নিরব আহতভাবে বলে,
"আমি জানিনা ম্যাম।"
"জানিনা বললে তো হবে না। আপনাকে বলতেই হবে। বলুন বলছি।"
"বলব না ম্যাম।"
"সাধে কি আর আপনার নাম ক্যাবলকান্ত দিয়েছি? আসার পর থেকে দেখছি উনাকে প্রতিটা কথায় কথায় স্যার ডাকছেন। এখন আবার আমায় প্রতিটা কথায় কথায় ম্যাম ডাকছেন। দেখতে তো যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। তাহলে এমন ক্যাবলকান্ত কেন আপনি?"
"এটাকে সম্মান বলে ম্যাম।" কণ্ঠে আহতের সুর নিরবের।
"তাই? গার্লফ্রেন্ডকে কী বলেন? গফ, গফ?"
নিরব এবার ন্যাকীসুরে আমানের দিকে তাকিয়ে বলে,
"স্যার!"

আমান হাসি থামিয়ে নিহিকে বলে,
"বেচারাকে আর পঁচাবেন না প্লিজ। ও অনেক ভালো ছেলে।"
"মোটেও না। ভালো হলে সত্যটা আবুল আর টুকটুকিকে বলত।"
"আচ্ছা বেশ। আমিই বলে দিচ্ছি।"
এরপর আবুল আর টকটুকির দিকে তাকিয়ে বলে,
"তোদের আপামনি তোদের চাকরী খেতে চায়নি। আমি মজা করে বলেছি।"
"এখন বিশ্বাস হলো? তখন তো আমার কথা শুনলে না।" অভিমানিসুরে আবুল আর টুকটুকিকে কথাটা বলে নিহি অন্য ঘরে চলে যায়। আবুল আর টুকটুকিও যায় নিহির রাগ ভাঙাতে। আমান যাওয়ার পথে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে। গুমোট বাড়িটা হাসিখুশিতে পরিণত হয়েছে। বাড়ির প্রতিটা আনাচেকানাচে এঁটে যাচ্ছে হাসি, মান-অভিমানের ছোঁয়া।

নিরব প্রশ্ন করে,
"স্যার কীভাবে কী হলো? লুকিয়ে কেন বিয়ে করেছেন?"
"কীভাবে যে কী হলো নিজেও বুঝিনি। তবে মন বলেছে, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। আমি এমনিতেই হাসি-খুশি মানুষ। কিন্তু জীবনটাকে আরো বেশি রঙিন করতে আল্লাহ্ নিহুকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ও'কে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি চাই জীবনের বাকিটা সময় ও আমার সাথেই থাকুক। কিন্তু নিহুটা চায় না আমার সঙ্গে থাকতে। সরাসরি বলে দিয়েছে চলে যাবে।"
"আপনি কিছু বলেননি স্যার?"
"বলেছি। থেকে যেতে বলেছি।"
"যদি থাকতে না চায়?"
"তবে মুক্ত করে দেবো। নিহু আমার কাছে একটা ছোট্ট সুন্দর পাখির মতো। যে হঠাৎ করেই আমার জীবনে উড়ে চলে এসেছে। তাই বলে কি আমি ও'কে শক্ত শিকলে আঁটকে রাখব? কখনোই না। আমি ও'কে আগের মতোই মুক্ত করে দেবো। যদি ওর মনে হয়, ভরসা করার মতো যোগ্য মানুষটা আমি, তাহলে নিহু পাখিটা আমার কাছেই ফিরে আসবে। আমি না হয় সে পর্যন্ত আকাশপানে তাকিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণব।"
"বড়-ই কঠিন আপনার ভালোবাসা স্যার।"
"তোমাদের কাছে হয়তো কঠিন। কিন্তু যেদিন নিহু পাখিটা চাইবে সেদিন সব ভালোবাসা ও'কে উজার করে দেবো। নিহু কিন্তু সেদিন তোমাদের মতো বলবে না, আমার ভালোবাসা কঠিন। ও বলবে, নরম। সবচেয়ে নরম ভালোবাসাটাই আমি।"
"আর বলবেন না স্যার। মেয়ে হলে প্রেমে পড়ে যেতাম ঠিক।"
"ইডিয়ট!"
নিরব হাসে। সঙ্গে হাসে আমানও।


গায়ে সুয়েটার, শাল জড়িয়ে সোফায় পা তুলে বসে টিভিতে গান দেখছিল আর শুনছিল নিহি। আবুল আর টুকটুকিও ওর সঙ্গে টিভি দেখছে। গান হচ্ছে শাহরুখ খান আর মাধুরীর 'হামকো হামেসে চুরালো।' গানের চেয়ে আবুল আর টুকটুকির কথাই বেশি হচ্ছে। আবুল মাধুরীর বিশাল বড় ফ্যান আর টুকটুকি শাহরুখ খানের। দুজনেই গল্পজুড়ে দিয়েছে দুজনকে নিয়ে। নিহি নিরব শ্রোতা হয়ে দুজনের কথা শুনছে। আমান ঘরে বসে অফিসের কাজ করছিল। নিহির ফোন বাজছে। ফোনের স্ক্রিনে লেখা 'উপমা'। ফোনটা ঘরেই ছিল। আমান ঘর থেকেই ডাকে,
"নিহু আপনার কল এসেছে।"

নিহি উঠে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হতেই আবুল বলে,
"আপামুনি আপনে বসেন। আমি ফোন নিয়া আইতাছি।"
"যান।" হেসে বলে নিহি।
আবুল দৌঁড়ে গিয়ে ফোন নিয়ে আসে। ততক্ষণে প্রথম কল কেটে গিয়েছে। দ্বিতীয়বার আবার কল করেছে উপমা। এবার ফোন রিসিভ করে নিহি। উপমা ধমক দিয়ে বলে,
"কোথায় থাকিস বাল! প্রথমবার ফোন দিয়ে তোরে পাই না ক্যান?"
"জামাইর বাড়ি!" অস্ফুটস্বরে বলে নিহি।
উপমা জিজ্ঞেস করে,
"কী? কার বাড়ি বললি?"
"কিছুনা। কলেজ কখন ছুটি হলো? কোথায় আছিস?"
"মাত্রই ছুটি হয়েছে। রিক্সায় আছি এখন। আচ্ছা তুই কলেজে কেন আসিস না বলতো?"
"বলব। তোকে আমার অনেককিছু বলার আছে। কিন্তু ফোনে বলা যাবে না। আমি তোকে আপুর বাড়ির ঠিকানা দেবো। তুই আসতে পারবি?"
"তা পারব। কবে আসব বল?"
"সম্ভব হলে কালকেই।"
"আচ্ছা কালই আসব। আমিও তাহলে কাল কলেজে যাব না। তোকে ছাড়া একা একা ভালো লাগে না।"
নিহি হাসে। জিজ্ঞেস করে,
"দীপ্ত কেমন আছে রে?"
"ইশ! কী ঢং। একবারও জিজ্ঞেস করেছিস আমি কেমন আছি? দীপ্তর কথা ঠিকই জিজ্ঞেস করলি। আমি কে? আমি তো আর কেউ না।"
"হয়েছে বলা? দম নে একটু বাপ!"
"হুহ।"
"তুই এত হিংসুটে কবে থেকে হলি?"
"তোর জন্যই তো হয়েছি। আগে তো ছিলাম না। তুই কেন আসলি আমার জীবনে?"
"কীসব অদ্ভুত প্রশ্ন করছিস উপমা?"
"বাল! জানিনা। ভালো লাগে না তোরে ছাড়া। তুই তাড়াতাড়ি ফিরে আয়। না, শোন। কালকে তো আমি যাবই। আমি গিয়ে তোকে নিয়ে আসব। তুই কিন্তু বারণ করতে পারবি না। লক্ষী মেয়ের মতো আমার সঙ্গে চলে আসবি। ঠিকাছে?"

নিহির আনন্দ হয় খুব। আনন্দেও বুকের মাঝে কেমন করে ওঠে। মেয়েটা এত কেন ভালোবাসে? যখন কলেজ থেকে চলে যাবে তখন কী করে থাকবে? বোকা মেয়ে! এত ভালোবাসার দাবী কি আমি রাখি? নিহিকে চুপ থাকতে দেখে উপমা বলে,
"তোকে যেই কারণে ফোন করেছি, তা বলতেই তো ভুলে গেছি।"
"বল।"
"আজকে অনল ভাইয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে।"
"কী কথা হলো?"
"সেই এসে কথা বলেছে। তোর কথা জিজ্ঞেস করল। তুই কেন কলেজে আসিস না জানতে চাইল। আমিও কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছি।"
"পরে?"
"পরে আর কিছু বলেনি। চলে গেছে।"

নিহি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,
"বাদ দে। তার কথা শুনতে ভালো লাগে না। বাড়িতে গেছিস?"
"এইযে রিক্সা থেকে নামলাম এখন।"
"আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। তারপর রেষ্ট নে কিছুক্ষণ। আর কালকে কখন আসবি বল?"
"সকালের দিকেই আসব।"
"আচ্ছা। রাতে কল দিবোনি।"
"আচ্ছা। আল্লাহ্ হাফেজ।"
"আল্লাহ্ হাফেজ।"

ফোন কাটার পরও নিহি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আবুল জিজ্ঞেস করে,
"আপনের বন্ধু ফোন দিছিল আপামুনি?"
"বান্ধবী।"
"আপনের চোখে পানি আইছিল ক্যান? হেয় কি বকছে?" জিজ্ঞেস করে টুকটুকি।
নিহি চোখের কার্ণিশে হাত দিয়ে বলে,
"কই? কেঁদেছিলাম নাকি?"
"হ। আপনে বুঝেন নাই। বকছিল হেয়?"
নিহি হেসে বলে,
"আরে না। ও আমায় বকবে কেন? কলেজে আমার সবথেকে কাছের বান্ধবী ও। ওর নাম উপমা। অনেক ভালোবাসে আমায়। এজন্যই বোধ হয় ইমোশোনাল হয়ে পড়েছিলাম।"
"আপনে মানুষটাই জানি কেমন আপামুনি। আপনেরে চিনি দুইদিন হইব। আমরাই তো আপনের মায়ায় পইড়া গেছি।"
আবুলের সঙ্গে টুকটুকিও বলে,
"হ আপাজান। আবুল কিন্তু এইটা ঠিক কথা কইছে।"
নিহি মৃদু হেসে বলে,
"এত অল্পতেই কারো মায়ায় পড়তে নেই গো। পরে চলে গেলে তখন কষ্ট লাগবে।"
"এহ্! কই যাবেন আপনে? আপনেরে কুনোখানে যাইতে দিমু না।"

নিহি এবারও হাসে। হেসে হেসে বলে,
"কাল উপমা আসবে। আমায় নিয়ে যাবে বলেছে।"
"নিয়া যাইব ক্যা? আপনের বিয়া হইছে ঐ আপায় জানে না?" জিজ্ঞেস করে টুকটুকি।
উত্তরে নিহি বলে,
"না, জানে না। এজন্যই কাল ও'কে আসতে বলেছি। সব বলব কাল।"
"যাই হোক, আপামুনি আপনি কিন্তু যাইবেন না।"

নিহি এবারও হাসে। রহস্যজনক হাসি। কথা তো ওদের দেওয়া যাবে না। নিহি জানে না সামনে ওর জন্য কী অপেক্ষা করছে। আর কী-বা আছে ওর ভবিষ্যতে। তবে যাই হোক না কেন, সবকিছুর জন্যই নিহি এবার নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে।

সন্ধ্যার দিকে আবুল আর টুকটুকি সব কাজ শেষ করে বাড়িতে চলে গেছে। নিহি এখন বাড়িতে একা। আমানও বাইরে গেছে। তমা ফোন দিয়েছিল। সুন্দর করে সেজেগুজে ভিডিওকলে আসতে বলেছে। সবাই নাকি কথা বলবে। নিহি আবদার ফেলতে পারেনি। পরিবারকে তো আর কিছুই দিতে পারেনি। একটু হাসিমুখে না হয় কথাই বলুক। হালকা গোলাপী রঙের একটা সুতী শাড়ি পরেছে এখন। আমানই এনে দিয়েছিল। মুখে হালকা প্রসাধনী আর চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়েছিল। আমান তখন বাইরে থেকে এসে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। নিহি যে আয়নার সামনে বসে সাজছে সেটা খেয়ালই করেনি। খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসতে গিয়ে নিহির মুখোমুখি হয়েছে। ড্রেসিংটেবিল খাটের পাশেই রাখা। আমান মুগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমান নিজের দিকে তাকায়। সাদা টি-শার্টের ওপর ব্লু ডেনিম জ্যাকেট পরেছে। আর কালো প্যান্ট। নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
"কালো বা সাদা, নীল শাড়ি পরতে পারেননি?"
নিহি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
"কেন?"
"তাহলে আমার সঙ্গে ম্যাচিং হয়ে যেত।"
"ঢং!" মুখ বাঁকিয়ে বলে নিহি।

আমান হাসে। জিজ্ঞেস করে,
"হঠাৎ এত সাজগোজ?"
"জামাইর জন্য সাজছি। কোনো সমস্যা? নিহির বাঁকা উত্তর।
আমান খুশিতে গদগদ হওয়ার অভিনয় করে বলে,
"না, না। আমার জন্যই যখন সেজেছেন তখন আমার সমস্যা কেন হবে?"
নিহি আমানের দিকে সোজা হয়ে বসে বলে,
"শুনুন, ওভার স্মার্ট সাজার চেষ্টা করবেন না।"
"আমি তো এমনিতেই ওভার স্মার্ট, কুল, হ্যান্ডসাম ছেলে। আর কী চেষ্টা করব?" নিজের চুলের মাঝে হাত চালাতে চালাতে বলে আমান।

নিহি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। ভালো করে আয়নার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখতে পায় এক চোখের কাজল একটু লেপ্টে গেছে। শাড়ির আঁচলের কোণা দিয়ে লেপ্টে যাওয়া কাজলটুকু মুছে নেয়। আমান গালে হাত দিয়ে নিহির দিকে তাকিয়ে থাকে। বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে বলে,
"হায়ে! এই, আমায় তোমার চোখের লেপ্টে যাওয়া কাজল বানাবে? চোখে স্থান না পেলেও তোমার শাড়ির আঁচলে রয়ে যাব।"
"সরেন তো। আপনার মতো আমার মনে এতো রং-তামাশা, প্রেম নাই।"

আমান খালি গলায় গান শুরু করে,
"প্রেম জেগেছে আমার মনে, বলছি আমি তাই। তোমায় আমি ভালোবাসি। তোমায় আমি চাই। উরি, উরি বাবা! কী দারুণ!"

শেষের লাইনটা এমন হাস্যাত্মকভাবে বলেছে যে নিহি না হেসে আর পারে না। আমানের নিজেরও হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ। আমানের হাসির জন্য আরো হাসি পায় নিহির। পেটে হাত দিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে চোখের কোণা বেয়ে পানিও চলে আসে। আমান হাসি থামিয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখে নিহিকে। মেয়েটা সবসময় এরকম হাসলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যায়? আমানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আকস্মিক নিহির হাসি বন্ধ হয়ে যায়। আয়নার দিকে সোজা হয়ে বসে চুল ঠিক করে। এবার আমান আবেদনময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে গান শুরু করে,

"Gori ae, tu kinni gori ae
Tu zameen pe chaand ki jodi hai
Buri ae, badi buri ae
Duniya ki neeyat chhoriye

Nazar na lag jaaye jaanu
Thought yeh ghabraye saanu
Nazar na lag jaaye jaanu
Thought yeh ghabraye saanu."

নিহি একবার আমানের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। উঠে যাওয়ার সময় পেছন থেকে এসে নিহির কাঁধে হাত রাখে আমান। আয়নার দিকে তাকিয়ে 'নজর না লাগুক' কথাটায় হাত দুটো যেমন করে আয়নায় নিহিকে দেখে তেমন করে বলে,

"Nazar na lag jaaye jaanu
Thought yeh ghabraye saanu
Nazar na lag jaaye jaanu
Thought yeh ghabraye saanu."

নিহি আমানকে সরিয়ে সেখান থেকে সরে যায়। টেবিলের ওপর থেকে ফোন নিয়ে তমাকে ভিডিও কলে ফোন করে। আমান তখনও নিহির দিকে তাকিয়ে আছে। নিহি চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
"এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। আমার অস্বস্তি লাগে।"

আমান বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে বুকের মাঝে একটা বালিশ জড়িয়ে ধরে। পরক্ষণেই বালিশটাকে বুকে জড়িয়ে হাতের কনুইতে ভর দিয়ে হাতের ওপর মাথা রাখে। নিহির দিকে তাকিয়ে আবার গায়,

"মন বোঝেনা, বোঝেনা, বোঝেনা
মন বোঝেনা, বোঝেনা, বোঝেনা...

পড়ছে কেন বিনা মেঘেই বাজ
পদ্য লেখা আমার তো নয় কাজ,
চাইছি দিনে অল্প দেখা তোর
পাল্টে দিতে আমার গল্পের মোড়
কিছুতেই উপায় মেলে না!

ওহ হো হো...

মন বোঝেনা, বোঝেনা, বোঝেনা
মন বোঝেনা, বোঝেনা..."

নিহি আমানের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে যে তমা ভিডিও কল রিসিভ করেছে খেয়ালই করেনি। তমাও শুনতে পাচ্ছে আমানের গান। তিতির কথা বলতে গেলে তমা তিতিরকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে। পাশেই রয়েছে সালেহা বেগম আর নীলম। ওরাও শুনছে আমানের গান।

আমান বালিশ কোলে নিয়ে বসে এবার। বালিশের ওপর হাত রেখে গালে হাত রাখে। নিহির দিকে তাকিয়ে বাকিটুকু গায়,

"রোজ বিকেলে আঁতর ঢেলে
তোকে সাজাবই।
মেলায় যাব রিক্সায় চড়ে,
বসবি পাশে তুই।

বন্দি আছে হাজার আশা
বুকের মাঝে দেখ;
একটু চিনে নিলেই হব
দুজন মিলে এক।

তবু স্বপ্নেরা মুখ তোলে না!
ওহ হো হো...
মন বোঝেনা, বোঝেনা, বোঝেনা
মন বোঝেনা, বোঝেনা..."

আচমকা ফোনের দিকে তাকাতেই নিহি চমকে যায়। সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে নিহির দিকে। নিহি কিছু বলতে গেলে তমা ইশারায় নিহিকে কিছু বলতে বারণ করে। এদিকে এখন নিহির অস্বস্তি লাগা শুরু হয়েছে। আমানের গান গাওয়া শেষ হতেই ফোনের ওপাশ থেকে সবাই হাত তালি দেয়। নিহি হেডফোন নেয়নি। তাই সবার হাত তালির শব্দ আমানও শুনতে পায়। বড় বড় চোখ করে নিহির দিকে তাকিয়ে আবার ভ্রু কুঁচকে ফেলে। আস্তে আস্তে বলে,
"তারা লাইনে ছিল?"

নিহি হেসে ফেলে। হেসে হেসে মাথা দুলিয়ে উপর-নিচ করে। যার অর্থ 'হ্যাঁ।' আমান কিছুটা লজ্জা পায়। মাথার পেছনে হাত দিয়ে মাথা মৃদু নত করে চুলকায়। তারপর রুম থেকে চলে যায়।ফোনের ওপাশে তমাই আগে কথা বলে,
"এত সুন্দর করে গান গায়! আমান না?"
নিহির উত্তর,
"হুম।"
"কোথায় সে? ফোনটা দাও তাকে। কথা বলি।"
"বাইরে গেছে।"

দরজার পাশেই আমান দাঁড়িয়ে ছিল। নিহির কথা শুনে দৌঁড়ে ভেতরে এসে বলে,
"না, আছি আমি।"
নিহি আচমকা ভয় পেয়ে যায়। রাগী দৃষ্টিতে তাকায় আমানের দিকে। আমান সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। নিহিকে চাপিয়ে নিহির পাশে বসে। সালেহা বেগমকে সালাম দেন,
"আসসালামু আলাইকুম মা।"
"আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।" নীলমকে সালাম দেয়।
"আসসালামু আলাইকুম ভাবি।" তমাকেও সালাম দেয়।
তিতিরের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে বলে,
"হ্যালো প্রিন্সেস।"
সবাই হাসিমুখে আমানের সালামের উত্তর দেয়। আমানের সৌজন্যতা, আচার-আচরণ দেখে তারা মুগ্ধ হয়। তিতির বলে,
"হ্যালো হ্যান্ডসাম আঙ্কেল।"

আমান শব্দ করে হেসে বলে,
"একদম নিহুর মতো হয়েছে।"
নিহি আড়চোখে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমানের দিকে তাকায়। তমা বলে,
"ঠিকই বলেছেন।"
আমান নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
"ওভাবে তাকিও না জানু। মরে যাব।"

নিহি থতমত খেয়ে যায়। একবার ফোনের দিকে তাকায়। আরেকবার আমানের দিকে। সালেহা বেগম এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন। ভাব এমন নিচ্ছেন যেন তিনি কিছু শোনেননি। নিহি দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
"কী যা তা বলতেছেন? মা আছে ওপাশে।"
তমা আর নীলম মুচকি মুচকি হাসছে। তিতির মুখে হাত দিয়ে শব্দ করে হাসছে। আমান তিতিরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
"ভাবি আপনার মেয়েটার হাসিও একদম নিহুর মতো। ভাইয়া শুনেন, আমার একটা ছেলে হলে আপনার মেয়েকে আমার ছেলের জন্য নিয়ে আসব। রহিম-রুব্বান হয়ে যাবে হয়তো বয়সের জন্য। এইটা কোনো ব্যাপার না।"

নিহি এবার আর রাগকে কন্ট্রোল করতে পারে না। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আমানের পিঠে কিল বসিয়ে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। বারান্দার দরজাও আটকে দেয়। ফোনের ঐপাশে সবাই হতবাক। আমান কুঁজো হয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
"নিহু!"
.
.
.
চলবে.................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন