০৫!!
-তোর সাহস হয় কি করে এতো রাতে তুই আমার বাড়িতে আসিস? তাও আবার আমি বাড়ি আছি জেনেও এসেছিস? আমার বোনটার জীবনটা নষ্ট করতে কেন এতো উঠে পড়ে লেগেছিস তুই? কি চাস কি তোরা সবাই মিলে? আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়ে শান্তি হয় নি তোদের? এবার আমার আদরের বোনের জীবনটা নষ্ট করতে এসেছিস? কি ভাবিস কি তোরা সবাই? আমার সামনে আমার বোনটারও একই দশা হবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো? কক্খনো না। আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করার আগে আমি তোদের সবাইকে একটা একটা করে পিঁপড়ের মতো পিষে মারবো। তোকেও, কায়রাকেও, তোকে বাঁচিয়ে রাখা তোর ওই মিথ্যেবাদী মামা মামী, আমার বোনের কাছে ঘেঁষতে চাওয়া প্রত্যেকটা ধোঁকাবাজকে আমি গুনে গুনে খুন করবো। তোকে দিয়েই নাহয় উদ্ভোধন করি আজকে। একটা একটা করে সবাইকে খুন করে নাহয় নিজেও এই জীবনটা থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নিবো।
জিহানকে পিছন থেকে শক্ত করে জাপটে ধরা মানুষটা যে আবরার সেটা বুঝতে জিহানের দেরি হলো না। ছেলেটার জন্য কেন যেন একটু মায়াই লাগলো জিহানের। কিন্তু অতীতের কিছু তিক্ত স্মৃতি সেই অনুভূতিটাকে টিকতে দিল না জিহানের মনে। আবরার যতটা আক্রোশে জিহানকে জাপটে ধরেছিল নিজের কথাগুলো বলতে বলতে সেই আক্রোশটাও যেমন কমে এলো, তেমনি হাতের বাঁধনটাও কিছুটা শিথিল হয়ে এলো। জিহান একবারের চেষ্টাতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবরারের মুখোমুখি হয়ে তাকাতেই আবছা আলোতেও আবরারের টলমল মদ্যপ রূপটা দেখতে পেল। এই লোকটাকে এক সময় নিজের সুপারম্যান মনে করতো জিহান। আর তার সুপারম্যানকে আজ তার শত্রু হয়ে এই পরাজিত সৈনিকের রূপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিহানের কেমন লাগছে জিহান হয়তো নিজেও জানে না। মনের মধ্যে সদ্য কৈশোর পার করা উঠতি যুবকের মনটা বড্ড বেশি কাঁদে এই লোকটার জন্য। সেদিনের সেই আবরার! কি থেকে কি হয়েছে আজ! কিন্তু যখন চোখের সামনে কায়রা বা দুজন বয়স্ক দম্পতির গলায় দড়ি দেয়া লাশ ভেসে ওঠে তখন এই আবরারকেই খুন করতে সমস্ত শরীরের রক্তগুলো টগবগ করে ফুটতে থাকে। শুধু একটাই বাধা আটকায় প্রতিবার জিহানকে। এই লোকটা নীলার ভাই, জিহানের নীলা, যার জন্য জিহান সব ছাড়তে পারলে এই লোকটাকে তিলে তিলে মারার ইচ্ছেটাকে মারতে পারবে না জীবনেও।
-কি ভেবেছিস কি তুই? আমি বাড়িতে থাকার পর, আমার সামনে দিয় তুই আমার বোনের সাথে দেখা করতে যাবি? এতোই সহজ? খুন করে ফেলবো তোকে আমি। খুন করে ফেলবো আবার যদি নীলার ধারে কাছেও দেখি। এই সব সস্তা আবেগের দাম নেই তোদের কাছে। কথাটা সময় থাকতে আমি বুঝি নি। বাট আমার বোনকে আমি এই ভুলটা করতে দিবো না মরে গেলেও।
-সস্তা আবেগ? সস্তাই তো। এতোটাই সস্তা যে বিয়ের আসরে একটা মেয়েকে অপেক্ষায় রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়া যায়। এতোটাই সস্তা যে নিজেকে ব্যবসার পণ্যের মতো বেচে দেয়া যায়। এতোটাই সস্তা যে টাকার জন্য যাকে বিয়ে করা তার সাথে কুকুর বেড়ালের মতো ব্যবহার করা যায়।
-তুই আর তোর বোন নাটক করতে ওস্তাদ! বাহ! বিয়ের আসর! বউ! ব্যবসা! হা হা হা! দারুণ বলেছিস জিহান। হাজারটা স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি একটা মানুষকে নিয়ে। কখনো কল্পনাও করি নি তার চাহিদা আমাতে নয়, অন্য কিছুতে ছিল। ও নিজের জিনিস তো আদায় করে নিয়েছে। আর আমি বিয়ে করলাম বলেই অপরাধী! হা হা হা।
-আবরার!
আবরারের কথায় জিহান রীতিমতো রেগে গিয়ে টলমল পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবরারের টিশার্টের কলার চেপে ধরলো। আবরার তখনো পাগলের মতো হা হা করে হাসছে। এই মাতাল লোকটাকে কিসের জন্য শায়েস্তা করবে সেটাই জিহানের মাথায় ঢুকছে না। যে লোকটার জন্য জিহানের পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে গেল, সেই লোকটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওকে ন্যায় অন্যায়ের পাঠ শিখাচ্ছে! এই মূহুর্তে জিহানের ইচ্ছে করছে লোকটাকে খুন করতে। কিন্তু কারো কাছে তো ও দায়বদ্ধ। নইলে আবরারের পুরো পরিবারটাকেই এতোদিনে ধ্বংস করে দেয়ার মতো ক্ষমতা জিহানের তৈরি হয়েছে।
-কি হলো মারবি? মেরে ফেল জিহান। আমি যতদিন বেঁচে আছি তোদের কারো একটা উদ্দেশ্যও সফল হতে দিবো না। তোদের মত ছোটোলোক, ধোঁকাবাজ, ইতর, প্রতারককে আমার বোনের ধারেকাছেও আসতে দিবো না। আই প্রমিস।
-আমরা ইতর? ধোঁকাবাজ? আর তুই কি? এতো বছর ধরে তোকে বাঁচিয়ে রেখেছি কেন জানিস? তোকে তিলে তিলে মারবো বলে। সেদিন নিজের দোষ, নিজের সব অন্যায় তুই নিজের মুখে স্বীকার করবি। আর তখন তুই নিজে আমাকে বলবি তোকে এই ধোঁয়াশার জীবন থেকে মু্ক্তি দিতে।
-হাহ। হা হা হা। নাইস জোক মিস্টার জিহান।
-এন্ড ওয়ান মোর থিংক। আমরা ধোঁকা দিচ্ছি বললি না তুই? তুই নিজে কি করছিস? তোর পি.এ কি যেন নাম মেয়েটার? ইয়েস! সুনয়না। ভালোই এক্টিং করে মেয়েটা। নাটকে কাজে লাগাতে পারিস।
-ওহ! রাইট! সুনয়না! ওই মেয়েটাই তো তোর পোল সব খুলে দিল না? হুহ। বেচারা জিহান। এতোদিন ধরে যে নাটকটা বানাচ্ছিল। সেটা এভাবে ফ্লপ খাবে আশাও করিস নি রাইট? কিন্তু একটা কথা জানিস কি জিহান? সবাই তোদের মতো ঠগ বা জোচ্চোর হয় না। কেউ কেউ নিজের দায়িত্বটাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি মূল্য দেয়। আর টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায় না যেমনটা তুই আর তোর পরিবার হয়ে যাস।
-হা হা হা। ওয়াও! দারুণ উপলব্ধি মিস্টার আবরার খন্দকার। এখন দেখছি মিস সুনয়নার চেয়ে আপনার এক্টিংটা দারুণ হচ্ছে। আমাকে নীলার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে কি সুন্দর করে নিজের পি.এ কে ইউজ করলেন, আর এখন জোচ্চোর, ঠগ, প্রতারক সব আমার ঘাড়ে? নিজের পি. এ কে আমার ফার্ম হাউজে পাঠিয়ে আবার আমাকেই নীলার চোখে কালার করলেন! ওয়াও! আর আমি ক্যারেক্টারলেস হলাম আমি! আপনি সাধু পুরুষ!
-আমি সুনয়নাকে পাঠিয়েছি? নাকি তুই ওকে তোর ফার্মহাউজে ডেকেছিস?
-ওয়াও! এবার নতুন কাহিনী বানাচ্ছেন মিস্টার খন্দকার? কোনো লাভ নেই। নিজের মনগড়া হাজারটা কাহিনী রেডি করে নিন। নীলাও তো একদিন আপনার এই ভালো মানুষির মুখোশটার পিছনের পিশাচটাকে চিনতে পারবে। সেদিন কি করবেন? আমি যেমন আমার বোনকে হারিয়েছি, সেদিন আপনিও নিজের আদরের বোনকে হারাবেন। আপনার মাথার উপর থেকে বাবার ছায়া, পাশ ফিরে যেদিন নিজের স্ত্রী বলে যাকে দু পয়সার দাম দেন না সেই মেয়েটাকেও পাবেন না সেদিন বুঝবেন প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণাটা কেমন হয়।
-খবরদার জিহান! নীলা, বাবা বা নিহার কারো যদি কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করিস তাহলে তোকে আমি-----।
-কি করবেন মিস্টার আবরার খন্দকার? চাইলে বহু আগেই অনেক কিছু করতে পারতাম। কিন্তু আপনার মতো আড়াল থেকে পিঠে ছুরি মারার তো আমার অভ্যেস নেই। আর আপনার ওয়াইফ? উনাকে নিজের বোনের মতোই সম্মান করি আমি। তাই আর যা করি না কেন নিজের বোন যাকে ভেবেছি তার ক্ষতি করবো না কখনো। অবশ্য মনে হয় আপনার মতো লোকের সাথে এতোগুলো বছর থাকার চেয়ে বড় ক্ষতি আর কিছু উনার জন্য হতেই পারে না।
-মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ জিহান।
-ইয়া, আই উইল। বাট আই হ্যাভ এ কোশ্চেন মিস্টার আবরার। বাড়িতে থেকেও যার সাথে পাড়া প্রতিবেশীর মতোও কথা বলার সময় পাও না তুমি, মিস বিহেভ করো প্রতিনিয়ত, স্ত্রী বলে হয়তো কারো সামনে আজ পর্যন্ত পরিচয়ও দাও নি, তাকে নিয়ে তোমার এতো মাথাব্যথা কেন?
-সেই কৈফিয়ত তোকে দিবো না আমি জিহান।
-আমাকে না দাও কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দিও। একবার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো যে মেয়েটাকে এতোটা অপমান করে এসেছ দিনের পর দিন সে কিসের আশায় তোমার পথ চেয়ে রাত জাগে। কিসের আশা বুকে বেঁধে সে এই বালির সংসারটা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। তারও তো কিছু আশা কিছু স্বপ্ন ছিল একদিন। সবই তো মিথ্যে হয়ে গেছে। তবু কেন যাচ্ছে না তোমাকে ফেলে এটা কখনো ভেবেছ তুমি মিস্টার আবরার সাহেব? যাকে ভালোবেসেছ তাকে প্রতিনিয়ত অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছ, যে তোমাকে ভালোবেসে তোমার ছায়া হয়ে পাশে থাকতে চায় তাকে দু পয়সার দাম দাও না। জীবনে চাও টা কি? আবার বলো আমরা ধোঁকা দিচ্ছি। নিজেকে যে নিজে কত বড় ধোঁকা দিচ্ছ সেটা আগে নিজেকে বোঝাও। তারপর অন্যের দোষ ধরতে এসো। তোমার মতো লোকের সাথে অযথা তর্ক করে নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। আর সম্ভবত আমার কতা বোঝার মতো অবস্থাও তোমার নেই। আর না আমাকে আটকানোর। সো মিস্টার আবরার খন্দকার, মিট ইউ সুন।
কথাগুলো শেষ করেই আবরারের দিকে তাকিয়ে হতাশ একটা ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে দেয়ালের দিকেই এগিয়ে গেল জিহান। অন্যদিকে জিহান যে চলে যাচ্ছে সেদিকে যেন হুঁশই নেই। তার কানে জিহানের কথাগুলোই যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন বুক চিড়ে বের হয়ে নিহারের প্রতি করা প্রত্যেকটা অন্যায়ের সাক্ষী দিচ্ছে আজ আবরারের কাছে। আজ একই দিনে নিহারের সাথে যা যা মিস বিহেভ করেছে সেগুলোই চোখের পর্দায় ভেসে উঠে জিহানের কথাগুলোর সত্যতার প্রমাণ দিচ্ছে আবরারকে। আসলেই তো আবরার ঠকিয়েছে নিহারকে। অন্য কারো উপরে জমা রাগগুলো প্রতিনিয়তই এই মানুষটাকেই দেখিয়ে গেছে। তবু মানুষটা রাতের পর রাত আবরারের অপেক্ষায় বসে ছিল। কিসের আশায়? যে সম্মানটা মেয়েটা ওকে দিয়েছে এতোগুলো বছর ধরে দিয়েছে সেটা পাওয়ার কি আসলেই যোগ্য সে?
০৬!!
সকালে জানলা দিয়ে দিনের আধো আলোটা চোখে মুখে এসে পড়ায় ঘুমের রেশটুকু ধীরে ধীরে কেটে যেতে শুরু করেছে নীলার। তখনো রাতের নেশা ধরা স্পর্শগুলো যেন ওর গালে ঠোঁটে লেগে আছে এখনো। ঠোঁটে কারো উষ্ণ স্পর্শগুলো যেন ঘুমের ঘোরে আধো জাগরণের মাঝে টের পাচ্ছে মেয়েটা। অনুভূতিটা এতোটা বাস্তব মনে হলো নীলার কাছে যে মেয়েটা ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো জিহান এতোক্ষণ ওর পাশেই ছিল। কথাটা মাথায় আসতেই অজান্তেই মুখটায় লজ্জার লালিমা খেলা করে গেল নীলার। বালিশের নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়েই কয়টা বাজে সেটা চেক না করেই জিহানের নাম্বারেই কল করলো মেয়েটা। পরপর দুবার কল হওয়ার পরেই অপরপ্রান্ত থেকে কলটা রিসিভ হলো। নীলা ঢিপঢিপ বুকে জিহানের ঘুমকাতুরে কণ্ঠস্বরটা শোনার অপেক্ষায় রইলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না নীলাকে। অপরপ্রান্ত থেকে আধো ঘুম জড়ানো জিহানের কণ্ঠস্বরটা কানে এসে পৌঁছাতেই বুকের ঢিপঢিপটা যেন আরো খানিকটা বেড়ে গেল নীলার।
-গুড মর্নিং নীলপাখি। বউটাকে তো বলি নি আজ সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে দিতে, আর্জেন্ট একটা কাজ আছে আমার। ব্যাপার কি? খুব মিস করছিল নাকি আমার বউটা?
-আপনাকে নিয়ে কিসব স্বপ্ন দেখেছি কাল রাতে। এখন মনে পড়ছে না। তাই কল দিলাম। আর্জেন্ট কাজ আছে বললেন। কোথায় যাবেন? এতো সকালে কি মিটিং আছে কোনো?
-উমমমম। মিটিং না ঠিক। একজনের সাথে মিট করতে যাবো। উমম। এই নীল? তোমার পায়ের কি অবস্থা এখন? বেশি ব্যথা করছে? মেডিসিন নিবে কিন্তু মনে করে। নইলে কিন্তু বিয়ের আগে ব্যথাটা সারবে বলে মনে হয় না।
-আমার পায়ে! কই পায়ে কি হয়েছে? আমার পায়ে তো কিছুই-----।
জিহানকে 'পায়ে কিছুই হয়নি' কথাটা বলতে বলতেই নিজের ব্যান্ডেজে জড়ানো পায়ের পাতার দিকে চোখ পড়তেই রীতিমতো বোকা বনে গেল নীলা। পায়ে কি হয়েছে কথাটা ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরেই নিহারকে পাশে শোয়া দেখে চমকে উঠলো নীলা। কিছু একটা মনে পড়তে গিয়েও মনে পড়ছে না মেয়েটার। কিন্তু কি! মস্তিষ্কে জোর দিয়ে গত রাতে কি ঘটেছে মনে করার চেষ্টা করার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে আবার জিহানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসায় থমকে গেল নীলা।
-নীল? তুমি এখনো রাগ করে আছো আমার উপরে? বিলিভ মিহ আমি তোমাকে একটাবারের জন্যও চিট করি নি। কেউ একজন ইচ্ছে করে তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে পুরো ব্যাপারটা। আর সিচুয়েশনটাও এমনভাবে ক্রিয়েট করেছে যেন তোমার মনে হয় ওই মেয়েটার সাথে-----। বাট ট্রাস্ট মি। আমি রিসেন্ট প্রোজেক্টটার কাজ কম্পপ্লিট করতেই ফার্মহাউজে---। হয়তো রাতের ঘুমের ওষুধ আর প্রতিদিনকার অভ্যেসের কারণেই কলটা দিয়ে ফেলেছো। বাট ট্রাস্ট মি বউটা আমি আমার বউটাকে কখনোই ধোঁকা দিই নি, মরে গেলেও সেটা পসিবল না করা আমার পক্ষে। এই নীল? শুনতে পাচ্ছ? নীলপাখি? নীলা? একবার আমার কথাটা শোনো প্লিজ? তারপর তুমি যা করতে বলবে আমি মাথা পেতে সব শাস্তি মেনে নিবো, প্রমিস। নীল?
জিহানের শেষের কথাগুলো আর নীলার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। গতকালের জিহান আর ওই মেয়েটাকে ফার্মহাউজে দেখার ঘটনাটা মনে পড়তেই মোবাইলটা ফ্লোরে আছড়ে ফেলে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠলো। সত্যিই লোকটা ওর প্রতিদিনের অভ্যেস হয়ে গেছে। কি করে এই অভ্যেসটা বদলাবে নীলা জানে না। কিন্তু নিজের চোখে যে দৃশ্য ও দেখেছে সেটাই বা ভুলবে কি করে? জিহানের ফার্মহাউজ, জিহান আর ওই মেয়েটা! একা! ছি! কালই ওকে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপারটা ছিঁড়ে ফেলতে বলে আজ আবার নতুন কোন নাটক করতে চাইছে লোকটা! এতোটাই সস্তা ছিল ওদের ভালোবাসাটা যে চাইলেই মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে নেয়া যায়, আবার চাইলেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যায় ইউজড টিস্যু পেপারের মতো! এদিকে নীলার মোবাইলটা ফ্লোরে আছড়ে পড়ার শব্দে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসেছে নিহার। নীলাকে বালিশে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে ফোঁপাতে কিছু একটা বিড়বিড় করতে দেখে নিহার নীলার চুলে হাত বুলিয়ে বেশ কয়েকবার ডাকলো। নীলা এতোক্ষণে মুখ তুলে নিহারকে দেখে নিহারের কোলেই মুখ লুকিয়ে আবার কাঁদতে লাগলো। নিহার অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটার কান্না থামাতে না পেরে নিজেই প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড় হলো এবারে।
-নীলা? কি হয়েছে তোর? এমন করে কাঁদছিস কেন?কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল? পায়ে ব্যথা করছে বেশি? এই লক্ষী মেয়ে না তুই? ভাবিকে বল প্লিজ কি হয়েছে? নীলা? শোন না? বল না আমাকে কি হয়েছে?
-ভাবি? বল তো এমন কেন হলো আমার সাথে? আমি কি করেছি বলো তো? একটা মানুষকেই নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালেবেসেছি, পৃথিবীর সবার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি। অথচ সেই মানুষটাই! কলেজে ফ্রেন্ডরা হাজার বারণ করা স্বত্ত্বেও তার প্রেমে পড়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারি নি। তার এক কথায় কাউকে না জানিয়ে কোর্টে গিয়ে বিয়েটাও করতেও একবার ভাবি নি। অথচ সেই মানুষটা কাল কি বললো জানো? ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপারটা নিয়ে যেতে, যেন ছিঁড়ে ফেলে দিই। নইলে নাকি কাগজটা ইউজ করতে ইচ্ছে হতেও পারে। উনি তো খুব সহজে রেজিস্ট্রি পেপারটা কাগজ বলে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেও আমি কেন সেটাকে শুধু কাগজ বলে ছিঁড়ে ফেলতে পারছি না? কেন ভাবি কেন কেন কেন?
-নীলা? শোন না? এভাবে কাঁদিস না সোনা। দেখ কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। জিহান ভাইয়া তোকে কতো পাগলের মতো ভালোবাসে সেসব তো তুই নিজেই আমাকে বলেছিস। তাই না বল? হয়তো এমন কিছু হয়েছে যে ওই মূহুর্তে উনি তোকে কিছু বলতে চেয়েও পারে নি।
-কাল দুপুরে আমি আসার পর কতো সময় পার হয়েছে জানো তুমি? পুরো দিনটা চলে গেল। না একবার কল দিল, না একবার নিজে এলো। বাবা গিয়ে বিয়েটা ক্যান্সেলও করে দিয়ে এলো। তবু একটা বার কিছু বলেও নি জানো? তুমিই বলো আমি কি ভুল করেছি? আমাকে ভালোবাসে না কথাটা আমাকে বলে দিলেই তো পারতো। সাত দিন পরে বিয়ে, তা জেনেও সে-------। ও আমার কতোটা অভ্যেস হয়ে গেছে জানো? আমার এখানে, এখানে, এখানে সব জায়গায় মনে হয় ওর স্পর্শ অনুভব করি। ও নেই, তবু মনে হয় ও পাশেই আছে। যেন ছায়ার মতো মিশে আছে আমার সাথে। আজ দেখো ঘুম ভাঙ্গতেই প্রতিদিনের মতো কল করে ফেলেছি। কাল হয়তো আবার দিবো। ও তো আমার অভ্যেস হয়ে গেছে গো ভাবি। আমি কি করে বাঁচবো ওই মানুষটাকে ছাড়া। আমি মরেই যাবো-----।
-নীলা? কিসব আবোলতাবোল বলছিস এসব? সময় হলে ভাইয়া নিশ্চয়ই তোকে সবটা বুঝিয়ে বলবে। অন্তত একটু শান্ত হয়ে অপেক্ষা কর কয়েকটা দিন?
-না না না। তুমি জানো না। ওই মেয়েটা সত্যি সত্যি ওকে বশ করে ফেলেছে। মেয়েটাকে ওর অফিসেও দেখেছি আমি। ওকে দেখলেই কেমন ছুটে ছুটে আসতো। প্রচন্ড বাজে রকমের একটা মেয়ে। কিন্তু ও কেন ওই মেয়ের কাছে যাবে। আবার আমাকে বলেছে আমি রূপের সাথে হ্যাপি আছি-----।
-নীলা? সবসময় আমরা যা দেখি বা শুনি সেসব সত্যি হয় না রে পাগলি। তুই ভাবির কথাটা শোন? দেখবি জিহানের কাজ শেষ হয়ে গেলে তোকে নিজেই সব বলবে।
-ও মোটেও কোনো কাজে এমন করছে না। নইলে আমাকে বলে যেত। ও কখনো আমাকে কিছু না বলে করে নি। এবারই লুকিয়েছে। আর কেন লুকিয়েছে সেটা তে নিজেই দেখতে পেলাম। এর জন্য আমি প্রয়োজনে মরে যাবো, তবু কখনো মাফ করবো না ওকে। কিছুতেই না, কিছুতেই না।
নীলা আবার নিহারের কোলে মুখ ডুবিয়ে বাচ্চাদের মতো কান্না জুড়ে দেয়ার নিহার থ হয়েই বসে রইলো। জিহান যে কাল রাতে সত্যিই এসেছে কথাটা এই মেয়েকে কি করে বোঝাবে? দুজন মানুষ দুদিকে বিনা অপরাধে শাস্তি পাচ্ছে। এর পিছনে কার হাত আছে সেটাও জানে নিহার। কিন্তু ওর কিচ্ছু করার নেই। চাইলেও কিছু করতে পারবে না নিহার। কারণ এই দুটো মানুষের কষ্টে ও যতটা না কষ্ট পাচ্ছে, তার চেয়ে হয়তো হাজার গুণ বেশি কষ্ট পাচ্ছে ওই মানুষটার কষ্টে বা যন্ত্রণায় সহযাত্রী হতে না পেরে। জীবন মাঝে মাঝে এমন মোড়ে এনে কেন দাঁড় করিয়ে দেয় কে জানে?
অন্যদিকে, নীলার কলটা কেটে যেতেই কিছুক্ষণ থমকে নিজের বিছানায় শুয়ে থেকে ধীরে ধীরে উঠে রেডি হয়ে হসপিটালে গেল। হসপিটালের একটা বিশাল কেবিনের কাচের জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে রুমের ভিতরে তাকালো জিহান। বেডে একজন মানুষ বেশ অনেকগুলো নলের মাঝে রীতিমতো পেঁচিয়ে শুয়ে আছে। দেখে মনে হয় মানুষটা কি শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। অথচ এই স্লিপিং বিউটির মতো যে মানুষটা ঘুমিয়ে আছে তার ঘুমটা ভাঙ্গার জন্য কত বছর ধরে যে জিহান অপেক্ষা করে আছে সেটা শুধু জিহানই জানে। আরো কত বছরের অপেক্ষার পর কালো মেঘের ঘনঘটা পেরিয়ে হাসিমাখা সূ্র্যের মুখটা দেখতে পারবে সেটাই ভাবছে জিহান।