ভোরের রোদ - পর্ব ১৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


২৫!! 

-ভোরপাখি আর একটু খা না? লক্ষী না প্লিজ? সারাদিন না খেয়ে আছিস তো বাবা? শরীর খারাপ করবে না এবারে? আচ্ছা বেশি না আর একটুখানি খা পাখিটা? প্লিজ? একটু----।

রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে নিয়ে ভোরকে নিয়ে একটা ডুপ্লেক্স বাড়িতে এসেছে রোদ। শহরের কোলাহল থেকে বেশ কিছুটা দূরে হলেও আধুনিক সব সুযোগ সুবিধাই বাড়িটাতে আছে। ভোরকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই নিচতলায় ডাইনিং রুমে এসেছে রোদ। কিচেন থেকে একটা প্লেট নিয়ে এসে ভোরকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে বসে গেছে রোদ। ভোর বেসিন থেকে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে মনের হাজারটা কৌতূহল মনেই চাপা দিয়ে চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। জানে রোদ এখন ওকে না খাইয়ে ছাড়বেই না। অবশ্য সারাদিনের এতো ক্লান্তির পর ভোরের নিজেরও যে ভিষণ খিদে পেয়েছে সেটা রোদের খাবার কিনে আনার আগে ভোর একদম যেন টেরই পায়নি। আরো কয়েক লোকমা খেয়ে ভোর একটু ভয়ে ভয়েই মাথা নেড়ে জানালো যে ও আর খাবে না। রোদের বকা খাওয়ার ভয়ে মুখ ফুটে কথাটা বলারও সাহস পাচ্ছে না মেয়েটা। রোদ সেটা বুঝতে পেরে হেসে ভোরের মুখটা মুছিয়ে দিলো। 

-ভোর তুই উপরে যা কেমন? রুমগুলো দেখ। কি কি চেইঞ্জ করা লাগবে আমাকে বলিস। আমি খাবার আর প্লেট গুছিয়ে কিচেনে রেখে আসছি। 

-তুমি খাবে না?

-খিদে নেই রে পাখিটা। আর তুই খেয়েছিস না? আমারও পেট ভরে গেছে।

-আমি খেলাম, তোমার পেট ভরলো কি করে? ইয়ার্কি করো আমার সাথে তুমি? চুপচাপ খেয়ে নাও। নইলে আমি----। আমি কথাই বলবো না তোমার সাথে।

-কথা না বলে থাকতে পারবি ভোরপাখি? 

-হুহ। সেটা তুমি নিজেই দেখবা। আর তুমি না খেলে এরপর থেকে আমি তোমার হাতে খাবোও না। দেখবা তো। হুহ।

-আচ্ছা? আমার হাতে নাই বা খেলি। নিজের হাতে খেলেই চলবে। বাচ্চা বউটা আমার। নিজের হাতে খাওয়াটা শিখতে হবে না বল?

-আমি খাবো না। তোমার হাতেও না, নিজেরও হাতেও না, কারো হাতেই না। 

-এ কেমন জেদ ভোর? খিদে পায়নি তো বাবু আমার, তবু জোর করে খেতে হবে?

-১০০ বার হবে, হাজার বার হবে। আমাকে যে জোর করে, ধমক দিয়ে, বকা দিয়ে খাওয়াও তখন মনে থাকে না কথাটা? তখন তো আমারও খিদে থাকে না। তবু আমি খাই না?

-আচ্ছা? তো এখন আমাকে কি করতে হবে ম্যাডাম?

-তুমিও খেয়ে নাও। কতো রাত হলো দেখেছ? না খেয়ে ঘুমালে তোমার শরীর খারাপ হবে না?

-বাহ! আমার পিচ্চি বউটা তো অনেক কেয়ারিং হয়ে গেছে আজকে! শুধু মুখে বললে তো হবে না ম্যাডাম। খাইয়ে দিতে হবে তো নাকি? আমি তো নিজের হাতে কাউকে খাইয়ে দিয়েছিলাম। এখন সে যদি পানসা পানসা জ্ঞান দিয়েই পালায়, তাহলে কি আর খেতে ইচ্ছে হয় বল তো?

-খাইয়ে দিবো? আমি! তোমাকে?

-তো কে খাইয়ে দিবে? না খাওয়াতে চাইলে বরং থাক। একদিন না খেলে কিচ্ছু হবে না আমার।

-এই না। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি প্লেট নিয়ে আসছি----।

-আরে লাগবে না পাগলিটা। তোর প্লেটটা আছে না? 

-এঁটো তো? ধুয়ে দিই দাঁড়াও।

-আরে! নো ওয়ে। আমি এভাবেই এই প্লেটেই খাবো।

-ছি! কি বলো এসব? কিচ্ছু নেই প্লেটে বুঝলাম। তবু কেমন কেমন না? দাও না আমি শুধু একবার পানি দিয়ে ধুয়ে নিবো। একদম যাবো আর আসবো।

-বেশি বকবক করবি না তো ভোর। খাওয়ালে খাওয়া। না খাওয়ালে রুমে যা। বিরক্ত করিস না তো। 

-আমি কি করলাম আবার! ধুর! আচ্ছা দাও? তোমার যেভাবে মন চায় খাও। আমি খাবার নিই। তোমার এতো কাহিনী আমি বুঝি না ভেবেছ? আমি কিছু একটা বলি আর ওমনি তুমি বলবে খাবো না। উঁহু সেটা হবে না তো আজকে। তুমিও যে দুপুর থেকেই না খেয়ে আছো আমি জানি না ভেবেছ? আমি সব জানি।

রোদকে রাজ্যের ঝাঁড়ি দিতে দিতে ভোর নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে রোদকে খাইয়ে দিতে শুরু করেছে। রোদও অপলকে ভোরকে দেখছে, আর চুপচাপ ভোরের দেয়া খাবারটুকু মুখে পুরছে। আজ একদিনে ভোরকে কেন জানি আরো সম্পূর্ণা লাগছে রোদের কাছে। হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারণটা বুঝতে পারছে না রোদ। হারিয়ে ফেলতে ফেলতে ভোরকে ফিরে পাওয়ায় এমন অনুভূতি হচ্ছে? নাকি ভোরের মধ্যেই সূক্ষ্ম কোনো পরিবর্তন এসেছে যেটা দেখা না গেলেও অনুভব করতে পারছে রোদ। রোদ কিছুক্ষণ ভোরের মুখের ভঙ্গিমার বদল দেখতে দেখতে আলতো করে ভোরের আঙুলে কামড় বসালো। ভোর বেখেয়ালভাবে রোদকে এটা সেটা বলছিল বলে হঠাৎ চমকে উঠে চোখ কিটমিট করে রোদের দিকে তাকালো। রোদ মিটিমিটি হাসছে ভোরের রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে। সেটা দেখে ভোরের আরো রাগ হলো এবারে।

-কি সমস্যা কি তোমার? ভালোর জন্য খাইয়ে দিচ্ছি, আর তুমি আমার আঙুলটাই কামড়ে খেয়ে ফেলতে চাইছ? আবার এদিকে বলছ খিদে পায়নি? 

-ভাবছি তোকে এভাবে কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেললে কেমন হয় বল তো ভোর? তাহলে তোকে আর কেউ আমার কাছ থেকে নিয়ে পালাতে পারবে না। ভালো না বুদ্ধিটা বল তো ভোরপাখি?

-সারাদিন উপোস থেকে তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? নাকি খিদের চোটে নরখাদক হয়ে গেছ? কি সাংঘাতিক! আমাকে খেয়ে ফেলার জন্য এখানে নিয়ে এসেছ? আর আমি ভাবলাম তুমি সত্যি সত্যিই আমার আর তোমার জন্য বাড়িটা বানিয়েছ! কি বোকা আমি! এবার কি হবে আমার? আমি কখনো মাকে, বাবাকে, বড়াআব্বুকে, বড়মাকে দেখতে পাবো না? তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে খেয়ে ফেলবো রোদ ভাইয়া? বলছি রান্না করে খাবে? নাকি কাঁচা!

ভোরের এমন ছেলেমানুষি কথায় রোদ শব্দ করেই হেসে ফেললো। ভোরের ততক্ষণে রোদকে খাইয়ে দেয়াও শেষ হয়ে গেছে দেখে রোদ ভোরের ডান হাতটা ধরে টেনে নিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো। ভোর থতমত খেয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো রোদের পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক কি হতে পারে। রোদ ভোরকে আরেকটু ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্যই ভোরের নিচের ঠোঁটটা আলতো করে কামড়ে ধরে নিজের মুখে পুরে নিলো। ভোর একবার কেঁপে উঠে চোখ বুজে নিতেই রোদের যেন ঘোর লেগে গেল। ভোরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আরো শক্ত করে নিজের মাঝে টেনে নিলো রোদ। আর ততক্ষণে ভোরের সমস্ত শরীর জুড়ে রোদের ভালোবাসার শিহরণ খেলা করতে শুরু করেছে।

-এই যে ম্যাডাম? এভাবে তোর ঠোঁটটায় নিজের নামের মোহর বসাতে পারলে কি আর অন্য কিছু মাথায় আসতে পারে বল? আর এতো ভীতুরাণী কেন বল তো তুই? তোর শরীরে আদরের কামড় দিতেও আমার ভয় ভয় হয় জানিস না? সেই আদুরে শরীরটায় আমি কি করে দাঁতের দাগ বসাই বল তো? আর তুই কিনা ভাবছিস আমি তোকে খেয়ে ফেলবো! তাও আবার কাঁচা না রান্না করে খাবো ভাবছিস! হায় রে! কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম আমি?

-ভালো হয়েছে।

-ভালো হয়েছে না? তোর ইচ্ছেটাই পূরণ করবো আজ দাঁড়া। তোর এই আদুরে শরীরের প্রত্যেকটা ইঞ্চিতে আজ নিজের অধিকার ফলাবো আমি। আদরে, কামড়ে এমন অবস্থা করবো যাতে যে কেউই তোকে দেখে বুঝে যায় তুই শুধু রোদের সম্পত্তি। আর কারো তোকে ছোঁয়া তো দূর তোর দিকে তাকানোরও অনুমতি নেই। তোকে আদরে আদরে পাগল করে তুলবো। এতোটা পাগল যে আমাকে ছাড়া এক দন্ডও শান্তিতে থাকতে পারবি না তুই। এতোটা ব্যাকুল করবো তোকে যে নিজে এসে আমার কাছে ধরা দিবি পরেরবার থেকে। ভালো হবে না বল তো ভোরসোনা? 

রোদ ভোরের টুকটুকে লাল মুখটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে ভোরের মুখের পরিবর্তনটা খেয়াল করে হাসছিল। ভোর রোদের কথাগুলোয় পারছে না ছুটে রোদের কোলের উপর থেকে সরে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে পড়তে। লজ্জায় এমনভাবে গলা বুজে গেছে বেচারির যে টু শব্দটা পর্যন্ত করতে পারলো না। রোদ সেটা বুঝতে পেরে আবার হাসলো। এবারে আলতো করে ভোরের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে ভোরকে হালকা হাতে বুকে জড়িয়ে নিলো রোদ। 

-বউটা ভয় পেয়েছে নাকি গো? ম্যাডাম আপনার রোদ এমন কিছু করবে না যাতে সবার সামনে আপনাকে লজ্জায় পড়তে হয়, বুঝলেন? তবে আরো কিছুক্ষণ এভাবে আমার কোলে বসে আমার বুকে মিশে থাকলে কি ঘটবে সেটার নিশ্চয়তা কিন্তু আমি দিতে পারছি না ওকে? পরে কিন্তু আমাকে দোষ দিলেও কিছু করার থাকবে না।

-ছাড়ো না?

-জানিস ভোর? ছোটোমা যেদিন প্রথমবার আমাকে তোর আসার খবরটা দিলো আমি কত্তো খুশি হয়েছিলাম? ছোটোমা বলেছিল আমার জন্য একটা লাল টুকটুকে পুতুল নিয়ে আসবে। আমার সাথে খেলার জন্য কেউ ছিল না বলে আমি তো কাঁদতাম। আমার ছোট্টো পুতুল হয়ে তুই আসবি শুনে আর একদিনও আমি বায়না করে কাঁদি নি জানিস? একদিন আব্বু আর আম্মু কোথাও একটা পোগ্রামে গেছে আমাকে বাড়িতে রেখে। চাচ্চু আর ছোটোমা যায়নি। চাচ্চু কিসের যেন কাজ করছিল। আর ছোটোমা তুই দুষ্টুটার নড়াচড়ার কথা আমাকে বলছিল। ছোটোমার পেটের ভিতর তোর কিক করাটা টের পেয়ে আমার সে কি আনন্দ হয়েছিল জানিস? খেলা ফেলে আমি একটু পর পর তোর নড়ন চড়ন অনুভব করতে ছুটে আসছিলাম। কিন্তু খেলনাগুলো যে ফ্লোরে পড়েছিল সেটা আমার খেয়ালই ছিল না।

-তারপর কি হলো?

-তারপর? সেদিন আমার সারাটা দিন কেটেছিল তোকে ছুঁয়ে দিতে দিতে। সারাদিন কিছুই খাই নি। ছোটোমা সেটা খেয়াল করে আমার জন্য খাবার নিতে কিচেনে যাচ্ছিল---। ছোটোমাও খেয়াল করে নি, আর আমিও না। আমার খেলনা গাড়িটার উপরে একটা পা পড়ে যায় ছোটোমার। সাথে সাথেই ব্যালেন্স হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায় ছোটোমা। আমার ছোট্ট হাতগুলো সেদিন তোকে রক্ষা করতে পারে নি রে ভোর।

-ইশ! কিন্তু এখানে তো তোমার দোষ নেই। এটা তো এক্সিডেন্ট জাস্ট।

-ছোটোমার আর আমার কান্না শুনে চাচ্চু ছুটে আসে কাজ ফেলে। তড়িঘড়ি করে গাড়িতে করেই ছোটোমাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে। আমাকে একা বাড়িতে রেখে যেতে সাহস পায়নি চাচ্চু। আমাকেও সাথে নিয়ে গিয়েছিল। পুরোটা রাস্তা আমি ছোটোমাকে কাঁদতে দেখেছি। জীবনে প্রথমবার আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে এতো কষ্ট পেতে দেখলাম। তাও আমার বোকামির জন্য। তারপর তো শুরু হলো আরেক যুদ্ধ। একটা রুমের বাইরে সবাই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে কান্নাকাটি করছে। কেউ বলছে ছোটোমা মরে গেছে, কেউ বলে তুই মরে গেছিস। ছোট্টো আমি সেদিন তাদের কথাগুলো না বুঝলেও এখন ঘটনাটা মনে পড়লেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে আমার। মনে হয় একটুর জন্য আমি সেদিন আমার ভোরকে হারিয়ে ফেলতাম। 

রোদের কাঁপা কণ্ঠস্বরটা একটা থামতেই ভোর বুঝতে পারলো রোদের হাত দুটো আসলেই ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে। ভোর মুখ তুলে রোদের চোখে চোখ রাখলো। রোদ একটু হাসার চেষ্টা করেও সফল হলো না। রোদের মুখটা দেখে মনে হচ্ছে ভোরকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা আরো জেঁকে বসেছে রোদের মনে। ভোর রোদের আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে সোজাসুজি চোখ রাখলো রোদের গভীর চোখজোড়ায়।

-এই যে আমি আছি দেখো? এভাবেই তোমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখো সবসময়। তাহলে হারিয়ে ফেলবে না কখনো।

-যখন ওরা সবাই বলছিল তুই আর আসবি না তখন দরজার বাইরে তোকে একবার কোলে নেয়ার জন্য অপেক্ষায় বসেছিলাম আমি। সবাই কান্নাকাটি করছে, আর আমি সবাইকে বকছি তোকে নিয়ে বাসায় ফিরবো বলে। মাঝেমাঝে মনে হয় জানিস বাবা ঠিকই বলে। আমি আসলেই তোর জন্য শুধু বিপদই ডেকে আনি রে ভোর। 

-কিসব বলছ এগুলো? 

-ঠিকই বলে বাবা। এবারের ব্যাপারটাই দেখ। তাসমিদ তোকে এতো কষ্ট দিলো। কেন? সেই আমার জন্যই তো। আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্যেই তো তোকে ওই লোকটা----।

-আমি তো ঠিক আছি। আর এসব ভেবো না তো। 

-বাবা যদি কথাটা জানতে পারে আর কোনোদিন তোর কাছেও ঘেঁষতে দিবে না রে ভোরপাখি। তাই বাড়িতে যেতে ভয় হচ্ছে ভিষণ। আমার এই পিচ্চিটার থেকে দূরে থাকতে হলে তো মরেই যাবো বল?

-আরে?

-ছোটোবেলায় তুই যখন আমার সাথে বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে ভেজার জেদ ধরতি, তখন আমি কিছুতেই তোকে বারণ করতে পারতাম না। ভিজে চুপচুপে হয়ে যখন রাতে জ্বর বাঁধাতি তখনও বাবা মনে করতো আমার কারণেই তুই অসুস্থ হয়েছিস। একবার তো কতো বারণ করলাম তুই শুনলিই না। এতো জ্বর হলো যে তোকে হসপিটালে এডমিট করতে হলো। বাবা গুনে গুনে এক সপ্তাহ তোর কাছেও আমাকে ঘেষতে দিলো না। আমি চুরি করে এক নজর তোকে দেখার অপেক্ষাতে দিন কাটাতাম জানিস? এদিকে বাবাও জেদ ধরে বসলো তোর কাছে আমাকে যেতে দিবেই না। এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠলো আমাকে আর মাকে নিয়ে শুধু তোর কাছ থেকে আমাকে দূরে সরাবে বলে।

-ওমা! কি বলছ এসব?

-বাবা ধরেই নিয়েছে আমি তোর জন্য বিপদ ডেকে আনবো সারাজীবন। চাচ্চু আর ছোটোমাকে কেউ নাকি বলেছিল আমি তোর জীবনে একেবারে চলে এলে সব দোষ কেটে যাবে। তাই একদিন হুট করে কাজী ডেকে তোকে আমার হাতে তুলে দেয়। কি অদ্ভুত না ভোর? ভোর বহু আগেই তার রোদের হয়ে গেছে। তবু দেখ এখনো কতো বাধা তোকে ভালোবাসায়। কত জবাবদিহিতা, কত বাধা বিপত্তি। তবু একটাই আশা মনে একদিন ভোরপাখিটা আমার হবে। সব বাধা পেরিয়ে ভোরের রোদের হাসিতে ভরে যাবে আমার ভাগ্যাকাশ। ততদিন নাহয় আমি অপেক্ষাতেই থাকি। 

ভোর হা করে রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে রোদের বলা কথা শুনছিল। ভোর কি বলবে ভেবেই পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে রোদ ওকে কোনো রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে, আর ভোর চোখের সামনে তার প্রত্যেকটা অংশ দেখতে পাচ্ছে। রোদের বলা গল্পে যতটা না শিহরণ ছড়িয়ে যাচ্ছে ভোরের শরীরে, ততটাই শিহরণ বয়ে যাচ্ছে ঘটনাগুলো কল্পনা করে। রোদের বুকে গুটিশুটি হয়ে মুখ লুকিয়ে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করছে ভোর। ছোট্টো একটা জীবনে আর কতো ধামাকা বাকি আছে কে জানে!

২৬!! 

-ওই? তুমি এতো খারাপ কেন রোদ! আমার থেকে পারমিশন না নিয়েই তুমি আমাকে বিয়ে করে নিলে? আমি মানি না মানি না মানি না। যাও তোমার সাথে কথাই নেই আর।

ভোরের এমন সাংঘাতিক কথা শুনেও রোদ কোনো রেসপন্স করলো না দেখে ভোরের এবারে কিছুটা অভিমানই হলো। ভোর রোদের কোলের উপর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য হুটোপুটি শুরু করেছে প্রচন্ড অভিমানে। রোদের ঘোর লাগা অনুভূতিটা তখনও পুরোপুরি কাটে নি। ভোরকে নিজের এতোটা কাছে পেয়ে অনুভূতিগুলো কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে রোদের। মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে আজ ও আর ভোর ছাড়া কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। আজকের দিনটা শুধু ওদের দুজনের জন্য। অন্য কারো ক্যালেন্ডারে আজকের দিনটা থাকবে না। শুধু ভোরের রোদের জন্য সময়টা চলছে আজ, বাকি সবার জন্য সময় থমকে গেছে। রোদের এমন আগামাথা ছাড়া ভাবনার মাঝেই ভোর রোদের কোলের উপর থেকে সরে আসার চেষ্টা করতেই রোদ ভোরকে নিজের বুকের মাঝেই জাপটে ধরলো। ভোর একটু চমকে উঠলেও একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। আগের মতোই রোদের শক্ত হাতের বাঁধন থেকে বেরোনোর জন্য ছটফট করতে লাগলো। রোদ এবারে নিজেই ভোরকে নিজের মুখোমুখি করে চোখে চোখ রাখলো। 

-কি হয়েছে আমার ভোরপাখিটার? এমন করছিস কেন? 

-ছাড়ো।

-ছাড়বো? ওকে? তা ছেড়ে কি হবে?

-এভাবে তোমার কোলের মধ্যে বসে থেকেইবা কি হবে?

-উমম। অনেক কিছুই হতে পারে। ধর তোর জন্য জমিয়ে রাখা আদরগুলো নিতে পারিস। চাইলে আমাকেও কিছু আদর দিতে পারিস আজ। আজ তো তোর ছোঁয়া পেতে বাধা নেই কোনো বল?

-ছাড়ো আমাকে। তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই বললাম না?

-কথা নেই কেন? কি করেছি আমি? আর কি বললি? কখনই বা বললি?

-তার মানে আমি কি বলেছি তুমি শোনোই নি? বাহ! ছাড়ো বলছি না ছাড়ো? আমার কথা তোমাকে শুনতেও হবে না আর। আমি থাকবোই না তোমার কাছে।

-ভোরপাখি? আরে বাবা! রাগ করছিস কেন আমার সোনা বউটা? আমার কথাটা তো শোন ময়না পাখি? প্লিজ?

-ছাড়ো বলছি না তোমাকে?

-ভোর?

-তুমি ছাড়বে আমাকে?

ভোরের জেদি কণ্ঠস্বরটা শুনে রোদ ভোরকে আলতো করে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিতেই ভোর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা রোদের কাছ থেকে সরে আসতেই রোদ ভোরকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। প্রচন্ড অভিমানে ভোরের কান্না পেল এবারে। নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও সফল হলো না মেয়েটা। রোদ ভোরের চোখের পানিটুকু না দেখলেও ভোরের কেঁপে ওঠায় কিছুটা অস্থির হয়ে ভোরকে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে।

-ভোরসোনা? কাঁদছিস কেন তুই? কি হয়েছে পাখি? ভোর? কথা বলবি না আমার সাথে? এই ভোর? বল না লক্ষী না? কি হয়েছে?

-ছাড়ো।

-আচ্ছা ছাড়বো। আগে বল তুই কাঁদছিস কেন?

-আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই আমি কাঁদছি। তোমার তাতে কি?

-আমারই তো সব রে পাগলি। এখনও কি নতুন করে সেটা তোকে বলে দিতে হবে বোকা মেয়ে?

-সব নাকি ছাই দেখছি তো আমি। কথা বললে শোনার সময়টাও নেই তার আসছে 'তুই আমার সব' বলতে। হুহ।

-ও আচ্ছা। তাহলে এই ব্যাপার? বউ বুঝি আমার গোস্সা করেছে হুম?

-কে বউ? কিসের বউ? বিয়ের সময় পারমিশন নিয়েছিলে? আসছে বউ বলতে। এই বিয়ে আমি মানি না বললাম না?

-মানিস না? 

-না।

-সত্যি?

-১০০ বার সত্যি। মানি না মানি না মানি না। ছাড়ো এখন আমাকে।

-ওকে। কি আর করা। তুই যখন মানিসই না---। কেউ থাকতে না চাইলে তাকে জোর করে কি করে আটকে রাখবো বল? 

-ভালো হয়েছে।

ভোরের ভারি হয়ে আসা অভিমানি কণ্ঠটা শুনে রোদ সত্যি সত্যিই ভোরকে নিজের হাতের বাঁধন থেকে ছেড়ে দিলো। ভোর একটু অবাকই হলো। সাথে আরো কিছুটা অভিমান জমলো রোদের উপরে। একবার মুখ ঘুরিয়ে রোদের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। ভোর সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এক পা বাড়াতে গিয়ে আবার আটকা পড়লো। রোদ হুট করেই ভোরকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েছে বলে হাসবে নাকি বিরক্ত হবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না ভোর। এদিকে ভোরের চোখেমুখের অভিমানটা রোদের চোখেও ধরা পড়েছে। অভিমানীটাকে একটু রাগিয়ে দিয়ে বুঝতে পারলো কাজটা মোটেই ভালো হয়নি। এবারে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে ভোরের চোখে চোখ রেখেই দোতলার দিকে পা বাড়ালো রোদ। ভোর তখন রোদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিল কোথায় যাচ্ছে ওরা এবারে। কিন্তু অভিমানগুলো গলা চেপে ধরে প্রশ্নগুলোকে গলার ভিতরেই যেন আটকে দিয়েছে ভোরের। না রোদকে কোনো প্রশ্ন করতে পারছে মেয়েটা, আর না প্রিয় মানুষটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে। এ কেমন দোটানা!

-এভাবে কি দেখছিস বউটা? 

-দেখছি কেউ নাকি জোর করে আটকে রাখবে না, তাহলে এখন কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

-কেউ বিয়েটা মেনে লক্ষী বউ হয়ে থাকলে তাকে সারাজীবন আদর ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতাম। এখন সে যখন বিয়েটাই মানে না তখন তো জোর করেই তাকে আটকে রাখতে হবে, তাই না? কেউ মানুক না মানুক, আমি আমার বউকে ছেড়ে তো থাকতে পারবো না।

-হুহ। একলা ফেলে চলে যেতে রাজি হয়ে গেছিল সে। এখন আসছে বউকে ছেড়ে থাকতে পারবে না নাকি বলতে। নামাও আমাকে। আমি তোমার সাথে আর এক মিনিটও থাকবো না। 

-সেদিন না পাগল করে ফেলছিলি আমাকে? আমি চলে গেলে মরে যাবি না কিসব বলছিলি? তো আজ কি হলো? আগেই তোকে বিয়ে করে ফেলেছি শুনে সব ভালাবাসা ফুরুত? ছি ছি ভোর! এই ছিল তোর মনে?

-একটাও বাজে কথা বলবা না। তুমি কোথায় বিয়ে করেছ হ্যাঁ? কবে বিয়ে করেছ? তারিখ বলো তো? আন্তাজি বললেই-----।

-কবে এখনও জানিস না? প্রত্যেক বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ দিনটায় সব কাজকর্ম ফেলেও তোর কাছে ছুটে আসি কেন কখনো ভেবে দেখেছিস? বছরের শেষ দিনটায় তোর সব ছোট বড় পাগলামিভরা আবদার মুখ বুজে মেনে নিই কেন? কেন এতোগুলো বছর ধরে নিজের সাধ্যমতো তোকে নিজের মতো করে সাজাই সেদিন, সেটা কি এখনও বলে দিতে হবে তোকে?

-কি! তুমি? তুমি-----?

-বাকি বকবকানি রুমে গিয়ে করিস। তোর বকবক শুনতে শুনতে কতো রাত হয়েছে সেটাই ভুলে গেছি-----।

-কি বললে তুমি? আমি বকবক করছি? আমি?

ভোরকে আবার রাগিয়ে দিয়ে রোদ মিটিমিটি হাসতে হাসতেই সিঁড়ি বেয়ে একটা রুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। দরজার সামনে এসে রোদ ভোরকে কোলে নিয়েই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাতে ভোর আরো রেগে গিয়ে রোদের হাতে একটা জোরে খামচি দিয়ে বসলো। রোদ এবারে শব্দ করেই হেসে ফেললো। ভোর এবারে কটমট করে রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেও রোদের তাতে কোনো হেলদোল হলো না। সে নিজের মতোই হাসতে লাগলো। ভোর এবারে বিরক্ত হয়ে রোদের ঘাড়ের কাছের কয়েক গাছি চুল খামচে ধরলো। রোদ এবারে একটু ব্যথাই পেল।

-উফ! ভোর? বউসোনা কি করছিস কি? লাগছে তো আমার?

-আরো হাসো পাগলের মতো? এতো হাসির কি হলো তোমার হ্যাঁ? আরো লাগুক। বেশ হয়েছে।

-বাপ রে! নিজেকে আমার বউ বলে স্বীকার করিস না, আবার বউদের মতো কাজ করিস। হাসি পাবে না বল?

-বউদের মতো কি কাজ করলাম আমি আবার?

-কি করছিস সেটা না বুঝলে ত বলা যাবে না। সিক্রেট।

-কিহ! কিসের সিক্রেট?

-আছে আছে। বলা যাবে না বললাম না? তুই বউয়ের মতো কাজ করতে থাক, আমিও এক ফাঁকে বরদের মতো কাজ শুরু করবো। কোন সমস্যা নেই। কেমন বউপাখি?

-ওই? কি বললে তুমি? কি বললে?

-মনে হচ্ছে এখানে আসার আগে বউকে কানের ডাক্তার দেখানোর দরকার ছিল। কি আর করা! বউ? কষ্ট করে রুমের দরজাটা একটু খুলবেন? এই ৫০ কেজি ওজনের আটার বস্তাটা দুহাতে ধরে রেখেছি। দরজাটা খুলবো কি করে বলুন? এই ছোট্ট কাজটুকুও তো নিজের বুদ্ধিতে করা যায় নাকি?

-তুমি? তুমি আমাকে আটার বস্তা বললে? আআআআআআ। আমি থাকবোই না আর। আমি আটার বস্তা? অসভ্য লোক! আমার ওজন ৫০ কেজি? আর আমার বুদ্ধি নেই বললে তো? আমাকে এক্ষুণি বাড়িতে দিয়ে আসবে তুমি---। এক্ষুণি মানে এক্ষুণি।

-তো! ৫০ কেজির ১০০ গ্রামও যদি কম হয়---।

-তুমি নামাও আমাকে নামাও। আমি ৫০ কেজি মনে হয় তোমার? হ্যাঁ? গত সপ্তাহেও আমি ওয়েট মেপেছি। বরাবর ৪৪ কেজি-----।

-দেখলি তো আমার কথা মিললো কি না? ৪৪ আর ৫০ খুব বেশি তো পার্থক্য নেই। 

-কি বললে তুমি? তোমাকে তো আমি---।

রোদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভোরের ছোট্ট হাতের ধুপধাপ কিল এসে পড়লো রোদের বুকের উপরে। মেয়েটার রাগে টুকটুকে লাল মুখটা দেখতেও বেশ লাগছে রোদের। রাঙা মুখটা দেখে ভোরকে আরেকটু রাগাতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে সামলে নিল রোদ। আজকের জন্য যথেষ্ট রাগ অভিমান হয়েছে। তাছাড়া ভোরের মাইন্ডও ফ্রেশ হয়েছে। আর বিপদ বাড়িয়ে কাজ নেই। ভোরের এলোপাথাড়ি কিলের বর্ষণের মাঝেও রোদ আচমকাই রুমের দরজাটা খুলে ভোরকে নিয়ে রুমে ঢুকে পড়লো। রোদের সাথে রাগ করে এবারে ভোর মুখ ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই রুমটার দিকে চোখ পড়লো ভোরের। আর সাথে সাথে ভোরের চোখজোড়া যেন আটকে গেল। চোখের সামনে যা দেখছে সেটা সত্যি নাকি কল্পনা সেটাই ভেবে ঠিক করতে পারছে না মেয়েটা। যদি ব্যাপারটা বাস্তব না হয়ে স্বপ্নও হয়, তবে আজকের আগে এতো সুন্দর একটা স্বপ্ন ভোর হয়তো কখনো দেখেনি। ভবিষ্যতেও কখনো দেখতে পাবে কি না কে জানে। ভোর তাই সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে হ। করে রুমের দিকেই তাকিয়ে রইলো। আর রোদ ভোরের সেই মুগ্ধ দৃষ্টি দেখতে লাগলো দু চোখ ভরে। পাগলিটার এই বিস্মিত চাহনিটা দেখার আশ হয়তো রোদের এক জীবনেও মিটবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন