বসন্তের ফুল - পর্ব ২৩ - তারিন জান্নাত - ধারাবাহিক গল্প


৪৫!!

রাত একটা ত্রিশ মিনিট।সবেমাত্র বাড়ি পৌঁছাল প্রেমা আর অভ্র। প্রেমা অভ্রকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলছে।কেমন তারাহুরো করছে অভ্র।বাড়ি চলে এসে তাতেও যেনো বাড়ি ফেরার চিন্তায় অশান্ত।তার উপর কথা বললে কখনো চুপ থাকে তো আবার 'হুম' 'হ্যাঁ' বলে কথার সমাপ্তি ঘটাচ্ছে।

সোফায় সাইকান আর জেরিন ঘুম চাদর জড়িয়ে।অভ্র এক পলক দেখে দ্রুত পা চালিয়ে উপরে উঠৈ যায়।

প্রেমাও ক্লান্তির শিষ তুলে দৃঢ় পায়ে রুমে আসল। মুখহাত ধুয়ে কাপড় চেঞ্জ করে রুম থেকে বাইরে যায়।
ক্ষিদায় পেট জ্বালা শুরু করে দিয়েছে প্রেমা।সেই এগারোটায় নাস্তা করেছিলো,এখন অবধি পেটে ভাত যায়নি। ভেবে-চিন্তে অভ্রের রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে করাঘাত করে। দু-তিন বার দরজায় আঘাত করতেই অভ্র দরজা খুলে।
অভ্রকে দেখতেই প্রেমার চোখমুখে আতংকিত হওয়ার চাপ ফুটে উঠে। বুকের ভেতর ব্যথা শুরু হয়ে যায় আচমকা। 

চোখমুখের অবস্থা  কেমন যেনো অদ্ভুদ হয়ে আছে অভ্রের। চোখ আধো নিভু নিভু,এলোমেলো চুল।প্রেমার ভাবনার মধ্যে অভ্র ব্যঘাত ঘটায়,
'কিছু বলবে'

হঠাৎ থমথম খেয়ে যায় প্রেমা,সেই অবস্থায় বলে,
'খাবে না?  ক্ষিদে পেয়েছে প্রচুর চলো।

'আমার ক্ষিদে নেই,তুমি খেয়ে নাও।
অভ্র দরজা বন্ধ করতে নিলে প্রেমা দরজা ঠেলে ঢোকে
অভ্রের হাত ধরে বলে, 'চলো। আমি একা খাবো না।

প্রেমার কথার মাঝে অভ্র হাত ঝাঁটকা মেরে দূরে সরে দাঁড়ায়। তাতেই প্রেমা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়।কিন্তু সেটা তোয়াক্কা না করে সেও এলোমেলো পায়ে হেঁটে অভ্র হাত শক্ত করে চেপে ধরে। হঠাৎ প্রেমা হতবিহ্বল হয়ে যায়।অভ্রের হাতের তালু বিষণ গরম।দ্রুত চোখ তুুলে অভ্রের দিকে তাকাল। গাল স্পর্শ করতেই প্রেমা উপলব্ধি করে অভ্রের গাল হাতের চেয়েও দ্বিগুন গরম।
কপালে হাত দিতেই দেখে  একি অবস্থা।
প্রেমা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠে, 
'অভ্র,তোমার তো জ্বর এসেছে, এবং সেটা অতিরিক্ত। 

অভ্র গরম শ্বাস ছাড়ে। অন্যদিকে ফিরতেই প্রেমা ক্ষেপে যায়। অভ্রের হাত ধরে বলে, ' চলো খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে হবে।চলো,

'প্লিজ আমাকে জোর করো না,আমার ইচ্ছে করছে না।

অভ্রের কথা প্রেমা কানে আসার আগে সে রুম থেকে চলে যায়। নিচ থেকে এক প্লেট খাবার এনে অভ্রের রুমে এসে উপস্থিত হয়।অভ্র তখন বিছানায় বসেছিলো। 
প্রেমা খাবার অভ্রের সামনে বিছানায় রেখে বলে 'নাও খেয়ে নাও।' 

অভ্র খাবারের দিকে তাকাল। এরপর মৃদু আওয়াজে বলে, খেতে ইচ্ছে করছে না,তুমি খেয়ে নাও।
প্রেমা চোখ ছোট করে অভ্রের দিকে তালাল।প্রেমার মনে হচ্ছে অভ্র ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্টে আছে। জ্বরের তোড় বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে অন্যরকম। তার উপর কেমন যেনো চিন্তিত ও দেখাচ্ছে। প্রেমা আপাততে অন্য ভাবনা মনে আনতে চাই না।তাই প্লেট হাতে নিয়ে এক লোকমা নিয়ে অভ্রের সামনে ধরে বলে, 'খাও নাহলে আমিও খাবো না,আর না খেয়ে আমি চলে যাবো। প্রমিস আমাকে জীবণেও খোঁজে পাবেনা।'
প্রেমার এতটুকু বাক্য ওষুধের মতো কাজে দেয়। 
অভ্রের বুক কাঁপে,প্রেমা ওর থেকে দূরে সরে যাবে ভাবলে। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো প্রেমার হাতে খাওয়ার। তবে মুখ ফুটে বলেনি।আজ যখন সুযোগ এসেছে সে খাবারে অনিহা দেখাচ্ছে। অভ্রের প্রেমার হাত ধরে বলে, 'আগে তুমি খাও তার পরেই আমি।'

প্রেমা সেকেন্ড মতো নিশ্চুপ থেকে এক লোকমা মুখে পুড়ে নিলো। পরে দৃঢ়ে দৃঢ়ে অভ্রকে খাইয়ে দেয়। দু'জনে আজ তৃপ্তি সহকারে খেয়েছে। অভ্রের তো এখন পেটওই ভরছে না। 

'জ্বরের ঔষুধ আছে? 
প্রেমার কথায় অভ্র ড্রয়ারের দিকে তাকাল।
'নেই, ওষুধ খেতে হবেনা।ঘুমালেই কমে যাবে।তুমি 
যাও। 
প্রেমা সেই সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল,আজ সে এমনিতেই ঘুমাতে পারবেনা।তাছাড়া জ্বর যদি আরো বাড়ে। অভ্রকে একা রেখে যেতে পারবেনা। কিছু বলতে নিবে তার আগেই হুড়মুড়িয়ে সাইকান আর জেরিন রুমে প্রবেশ করে। সাইকান ভিতূ চোখে অভ্রের দিকে তাকাল।
'কী হয়েছে তোর অভ্র?(সাইকান)

' জ্বর এসেছে সাইকান,আশেপাশে ডাক্তার পাওয়া যাবে? (প্রেমা)
'এখানে তো নেই তবে দূরে রয়েছে,ফো..
হঠাৎ অভ্রের কড়া চাহনি তে সে চুপসে যায়।তখন
 অভ্রের মেসেজটা সে দেখতে পাইনি।যখন দেখেছে তখন দেড়ি হয়ে যায়।হালকা হেসে সাইকান বলে, 'আপু তুমি যাও আমি অভ্রকে দেখে রাখবো। জেরিন তুমিও যাও। (সাইকান)
'হ্যাঁ হ্যাঁ চলো আপু।(জেরিন)
'তোমরা শুয়ে পড়ো যাও।আমি এখানেই থাকছি।

প্রেমা অভ্রের দিকে তাকালে অভ্র ধপ করে বিছানায় শুয়ে বলে, 'তোমরা সবাই যাও প্লিজ।আর লাইট নিভিয়ে দাও।আমার অস্বস্থি লাগছে। '
সাইকান আর জেরিন দ্রুত পায়ে চলে যায়,নাছোড়বান্দা প্রেমা। সে জেদ করে রুমেই থেকে
যায়। লাইট নিভিয়ে সোফায় শুয়ে অভ্রের দিকে তাকাল। প্রেমার অনুপস্থিতি অভ্র টের পেলেও চুপ মেরে থাকে যাতে প্রেমা চলে যায়।

আস্তে আস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে অভ্র।এতোক্ষণ চোখমুখ জ্বালা করছিলো।চোখ বন্ধ করতেই আরো বেশি অনুভব করছে। 
___________________

'ওই হারামি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস? উঠ....
উক্ত কথাটি বলে এক বালতি পানি এনে ফ্লোরে ঢালে অরি। তখনি আরিয়ান ধড়ফড়িয়ে উঠে, অরির কথা না বুঝলেও আরিয়ান কাঁথায় ভেজা অনুভব করে।লজ্জায় পড়ে যায় মুহুর্তেই। দ্রুত উঠে অরির সামনে গিয়ে দাড়ায়, 
-দেখো আমি কিন্তু এই আকাম করি নাই,খবরদার বলছি আমার দোষ দিবে না। (আরিয়ান)
অরি রেগে বলে, 
-ভালো কামে নাই তুই,আকামে সেরা। (অরি)
-দেখো সত্যি বলছি আমি করি নাই,মানে আমি বিছানায় ইয়ে করি নাই, (আরিয়ান)
অরি ভ্রু কুঁচিত করে বলে 'ইয়ে '৷ কী?
আরিয়ান থমথম গলায় বলল 'আমি ইয়ে মানে হিসু করি নি। (আরিয়ান)
আচমকা চারিদিকে তব্দা খেয়ে যায়। সেকেন্ড পাঁচেক পার হওয়ার কারো ধম ফাটানো হাসির শব্দে পুরো রুম কেঁপে উঠে। অরির হাসিতে আরিয়ান টাস্কি খেয়ে যায়।
তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
-এ মেয়ে হাসি থামাও। 
রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখে পুরো ফ্লোরে পানি।কাঁথা বলিশ সব ভিজে গেছে। এতক্ষণ সে টের পায় সে আসলেই এসব করেনি।ঘুমের ঘোরে কিছু বুঝতে পারেনি।

-বিছানা ভিজিয়েছো কেন? 
বিছানার দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে অরি বলেে উঠে, 
-হানিমুনের জন্য মানা করেছিলেন কেন?
-তোমার মতো মেয়ের সাথে আমি হানিমুন তো দূর ঘরের বাইরেও যাবো না।(আরিয়ান)
-সে সময় বলে দিবে,
কথাটা বলে অরি একটা ছুরি বের। আরিয়ানের দিকে তেড়ে যায়।ভয় দেখাতে শুরু করে। আরিয়ানও ভয় পেয়ে যায়। এতোরাতে ছুরি হাতে, কোন মেয়ের আক্রমণ। সে নিতে পারছে না।ভিতু গলায় বলে,
-প্লিজ ছুরি দূরে রাখো,আমাকে কী করতে হবে বলো?
এবার অরি ছুরি নামিয়ে বলে,
-গুড বয়।বেশি কিছু করতে হবেনা।কালকের হানিমুনটা কনফার্ম করতে হবে।আর যদি না করো,প্রমিস ইউ কুপিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে দিবো।
আরিয়ান নরম গলায় বলে, 'ঠিক আছে' এবং মনেমনে বলে 'আগে নিজের জান বাঁচানো ফরজ'
______________________

রাত তিনটা ছুঁই ছুঁই। বিছানায় শুয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছে অভ্র। প্রেমার চোখে পানি থামছেনা।অভ্রের ছটপটানি দেখে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে অভ্রের কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। মাথা মুখ যতক্ষণ মুছে ততক্ষণ ঠান্ডা হয়,একটু পরেই আবারও গরম উত্তাপে শরীর জ্বলে যাচ্ছে।

কাঁথা সরিয়ে প্রেমা অভ্রের গলা বুক মুছে দেয়।শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা ছিলো বিধায় পেরেছিলো।
অভ্রের শার্ট খুলতে প্রেমা ইতস্তত বোধ করে। মুছে দেওয়া জরুরি তাই চোখমুখ খিঁচে পুরো শার্ট খুলে ফেলে। চোখ মেলে অভ্রের লোমহীন  বুকের দিকে তাকাতেই প্রেমা আঁতকে উঠে। 
হাত আপনা-আপনি চলে যায় অভ্রের পেটে। প্রেমা হাত বুলিয়ে আরো কেঁপে উঠে। অভ্রের পেটে নাভির পাশেই লম্বা দু'টো বড় কাটা দাগ।যেনো অনেক বেশিই কেটেছিলো এবং সেলাই করতে হয়েছিলো।
দাগটা দেখে মনে হচ্ছে জীবিত।জানান দিচ্ছে কেমন নৃশংসতার সহে কাটা গিয়েছে। অভ্র কষ্ট পেয়েছিলো ভেবে প্রেমা আরো বেশি দুমড়ে যাচ্ছে।
অভ্রের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে বিষণ মায়া হয় প্রেমার। 

অভ্রের ডান হাত মুঠোয় নিয়ে আলতো করে ঠোঁট বুলায় প্রেমা। এরপর রেখে দেয়। আবারও জলপট্টি দেয়।তখনি প্রেমার নজর পরে যায় অভ্রের পকেটের ছাবির দিকে।একটা ছাবি। এতো যত্নে পকেটে রাখার মানে সে বুঝতে পারেনি। দৃঢ় গতিতে পকেটে হাত দিয়ে প্রেমা ছাবিটা নেয়। ছাবির দিকে লক্ষ করতেই আচমকা প্রেমার সেদিনের রুমটির কথা মনে পড়ে যায়। 
ছাবি মুঠো করে নিয়ে অভ্রের তাকাল।এখন সে কাঁপছে।একরাশ কৌতূহলের ভিড় এসে জমেছে। নিজেকে আঁটকাতে চাইছে।পারছেনা কোন মতেও।

প্রেমা একপলক অভ্রের দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ তবে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দে অনেক কিছুই বলছে যা সে বুঝতে পারছেনা।আবার হঠাৎ থেমে যায়। প্রেমা অভ্রের গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে দৃঢ় পায়ে রুম থেকে বের হয়।

সেই রুমটির সামনে দাঁড়ায় প্রেমা।খুলবে কী খুলবে না দু'মনা করে একসময় দরজাটা খুলে ফেলে।প্রেমার ভাবতেও অবাক লাগে।ভাগ্য এতো দ্রুত সহায় হয়েছে বলে।
রুমটিতে প্রবেশ করে দরজাটা চেপে দেয়। সুইচবোর্ড খোঁজে লাইট জ্বালায়। তখনি ভেসে উঠে পরিপক্ব রুমটির মধ্যে কিছু অপরিপক্ক জিনিস পড়ে আছে। 
প্রেমা টেবিলের সামনে আসতেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

টেবিলে অনেকগুলো ছবি রয়েছে।যা ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। নির্জীব ছবি।তারপরেও ছবির প্রতি এতো আক্ষেপ কিসের।কিংকর্তব্যভিমূঢ় হয়ে চেয়ে থাকে টেবিলটির উপরে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো ছবিগুলোর দিকে। হাতে নেয় দেখার জন্য। কিন্তু তেমন লাভ হয়নি। কারণ ছবিগুলোকে ছুরি দিয়ে অতিরিক্ত আঘাত করে এরপর টুকরো করেছে।
যদি মানুষ গুলো সামনে থাকতো তাহলে কী হতো?
অনুসন্ধানি দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাল। বড় একটা আলমারি দেখতে পায়। সেটা খোলে দেখে খালি।
হতাশ হয়ে টেবিলের দিকে ফিরলে নিচে চোখ যায় প্রেমার।একটা ডায়েরির পৃষ্টা।সেটা হাতে নিতেই দেখে একটা ছেড়া ছবি। পিন-আপ করা। 

ডায়েরির পৃষ্টার লেখাটা না পড়ে প্রেমা ছেড়া ছবিটির দিকে তাকাল। সাথে সাথে মাথা ঝিমঝিমিয়ে উঠে।যেনো কিছুর সাথে আঘাত পেয়েছে। 
অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,'এটা কি করে সম্ভব? 
তখনি একজোড়া হাতের স্পর্শ পায় প্রেমা।শক্ত করে তার পেট আঁকড়ে ধরেছে। অনুভূতিহীন হয়ে যায় প্রেমা।এভাবে ধরা পড়বে ভাবেনি। চোখ বন্ধ করতেই কানে একটা কোমল কিছুর স্পর্শ পায়। জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে আরো আঁটকে যায় প্রেমা।কাঁপা শরীরে শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। 

তখনি প্রেমার কানে একটা ফিসফিস শব্দ আসে,
"পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না,যেমন তার ভোগান্তুর একমাত্র আমি। 
অভ্রের স্পষ্ট ফিসফিস কন্ঠে বলা কথা প্রেমার মাথায় ঢোকেনি।বরং ভারি খেয়ে বেরিয়ে যায়।
প্রেমা ভয়ে আতংকিত হয়ে অভ্রের বুকে জায়গা নেয়,
-তোমার না জ্বর।  কেন এসেছো? প্লিজ আমার উপর রাগ করো না।
প্রেমার কথায় অভ্রের ভাবান্তর না হলেও, ঠোঁটের কোণায় অদ্ভুদ কষ্টের হাসি জায়গা দকল করে নেয়। 

৪৬!!

প্রেমা অভ্রের বুকে থাকা অবস্থায় অনুভব করতে পারে অভ্রের উদাম শরীর। আগের চাইতে কিছুটা শীতল হয়েছে। তবে হালকা উষ্ণ স্পর্শ পাচ্ছে। 
মন-মস্তিষ্ক যখন প্রেমার মাথায় করাঘাত করে জানিয়ে দেয় যে,'এভাবে আর কতক্ষণ? লজ্জা করে না?
দ্রুত সরে আসে অভ্রের বুক থেকে। অভ্রের অদ্ভুদ  ঘোলাটে দৃষ্টিতে প্রেমা বিষণ আতংকিত,এবং শিরাই-উপশিরাই বঁয়ে যাচ্ছে অস্তিরতা।
প্রেমাকে কাঁপতে দেখে অভ্র একটা হাসি দেয়। যে হাসি প্রেমা আগে দেখেনি।মৃদু,মুচকি,বা শব্দ করে হেসেছিলো তবে এভাবে হাসেনি। সব দাঁত দেখিয়ে হাসিটা দেখে এমন কঠিন মুহুর্তে প্রেমা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। অভ্র একবার প্রেমার হাতের দিকে তাকাল।ছেড়া ছবিটি নিয়ে এপিট-অপিট করে তাকাল।
এরপর নিজের পেটের পাশে কাটা দাগটির দিকে
 নজর দিলো।  

ছবিটা টেবিলে রেখে,অভ্র প্রেমার উদ্দেশ্যে বলে,
'মহিলাটির পুরো ছবি দেখবে?

প্রেমা কুঁচকিত কপালের ভাঁজ নিয়ে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।অভ্র আবছা হেসে বলে, ' তুমি বিষণ অধৈর্য! 
প্রেমা করুন চোখে তাকিয়ে থাকে,সে তো আসলোই অধৈর্য। নিজেকে সংযত রাখতে পারে না।
উঁচু আলমারি উপরে অভ্র নিমিষেই হাত চালান করে।এবং একটা ব্যাগ বের করে। ছোট ব্যাগটা চিমটি কেটে ধরে।যেনো ব্যাগটিতে থাকা জিনিস গুলো ধরলে তার হাত ময়লা হয়ে যাবে।
ব্যগটা নিয়ে অভ্র মেঝে ফেলে দিয়ে প্রেমাকে বলে,'ব্যাগটা খোলে দেখে নাও। 
প্রেমা সচকিত অবস্থায় অভ্রের কথায় মেঝে থেকে ব্যগটা উঠিয়ে টেবিলে রাখে। কাঁপা হাতে ব্যাগটা খোলে শুধুমাত্র একটা ছবি আছে।সেটা বের করতেই দু'জন মানুষের ছবি বেসে উঠে। প্রেমা ছবিটির দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে এরা কারা। মহিলাটিকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে খুব।কিছু একটা মস্তিষ্ক জানান দেয় প্রেমা।দ্রুত ব্যস্ত চোখো অভ্রের দিকে তাকাল প্রেমা।বিস্ময় পাহাড়ের তুঙ্গে পৌঁছায়। 
মহিলাটির চেহেরা হুবহু অভ্রের মতন।কোন অমিল নেই। মিল হওয়ার কারণটা এখনো অস্পষ্ট প্রেমার।

অভ্র আলমারির সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে প্রেমার আচরণ দেখছে।ছবি দেখে নিশ্চয় সে শান্ত থাকতে পারবেনা।আরো একদল কৌতূহল মাথায় এসে চেপে ধরবে।
তাতে কী? সেও আর এই চাপা কষ্টটা নিতে পারছেনা।অন্তত মানসিক শান্তির জন্য হলেও আজ সব ঝাড়বে।
এমনিতেই প্রেমাকে অভ্র নিজের থেকে আলাদা কেউ ভাবেনা।তার ভাস্যমতো মন আর অনুভূতির মিল অনেক আগেই হয়েছে প্রেমার সাথে।
মনে মনে অভ্র একটা বাক্য উচ্চারণ করে, 
"শরীরের মিল সবাই ঘটাতে পারে,মন-মস্তিস্ক,অনুভূতির মিল কয়জন ঘটাতে পারে?'

প্রেমা ছবিটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অভ্রের দিকে তাকাল।অভ্রের দৃষ্টি ওর দিকেই স্থির দেখে প্রেমা বিব্রতবোধ করে। প্রেমা অভ্র সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে অভ্রের উদ্দেশ্যে। 
'এই মহিলাটির চেহারা তোমার সাথে মিল কেন? যেখানে তোমার মায়ের সাথে তোমাদের চেহারার মিল নেই।কীভাবে অভ্র? 
ম্নান হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে অভ্র,অতঃপর চোখ বন্ধ করে। বড়সড় নিঃশ্বাা ত্যাগ করে, প্রেমার হাতের সর্বশেষ ছবিটি নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো করে মেঝেতে ছুঁড়ে মারে।তীক্ষ্ণ চাহনি ছুঁড়ে টুকরো গুলোর দিকে।
মাথা তুলতে তুলতে সেই তীক্ষ্ণ চাহনি শিথিল হয়ে আসে। 'এখান থেকে চলো,আমার গরম লাগছে। '

অভ্র এতটুক বলে প্রেমার হাত ধরে ওই রুম থেকে বের হয়ে যায়।দরজাটা আগের ন্যায়ায়ে তালাবদ্ধ করে দেয়।
রুমে এসে আবারও জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে অভ্র।যেনো দৌড় প্রতিযোগিতা হয়েছিলো,হাঁপিয়ে গেছে।

প্রেমার হাত ধরা অবস্থায় সোফায় বসে,প্রেমার কিছুটা দূরত্ব রেখে  বসে অভ্র। 
'একটা অনুরোধ? 
নীরব চাহনি ছুঁড়ে প্রেমা,এবং বলার হন্য অভ্রকে ইঙ্গিত দেয়। অভ্র বলে,' আমি এখন তোমাকে যা-ই বলি।তা যেনো অভ্র জানতে না পারে।মানে আমি চাই সব ওর অজানা থাকুক,সব! 
প্রেমা চকিত কন্ঠে বলে,কী? 
অভ্র হালকা রাগ মিশ্রিত গলায় বলে,
'ওই ছবির মানুষ দু'টির সম্পর্কে। 
"উনারা কে অভ্র?
-'উনারা আমার বায়োলজিক্যাল মা-বাবা।'
প্রেমা বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে, 'মানে?
প্রেমার মানে জানতে চাওয়াই অভ্র বিষণ অসন্তুষ্ট হয়।তবুও প্রেমাকে বুঝতে না দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয় এবং,তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, 'মানে জন্ম দিয়েছেন,এই যা। আর কিছুই না। উনাদের সাথে আমার সম্পর্ক এতোটুক। '
প্রেমা উদ্ধিগ্ন হয়ে বলে, 'প্লিজ অভ্র এলোমেলো কথা না বলে আমাকে আসল কথাটা বলো? সব বলো। উনারা তোমার মা-বাবা হলে বর্তমানে যারা আছেন উনারা কে?
অভ্র আঁড়চোখে প্রেমার দিকে তাকাল,চোখ সরিয়ে বলে, উনারা আমাকে জন্ম দিয়েছেন,লিভ ইন রিলেশনশীফে থেকে, মানে আমি উনাদের অ..বৈ..ধ 
সন্তান ছিলাম। 
এতটুক বলে অভ্র প্রেমার দিকে তাকাল, প্রেমার হাত দু'টো নিয়ে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে,'এখন নিশ্চয় আমার প্রতি তোমার ঘৃণা হচ্ছে,এটাই স্বাভাবিক! তাই বলতে চাই নি। এখন যদি তুমি আমাকে....

অভ্রের একনাগাড়ে বলা কথার সমাপ্তি ঘটানোর জন্য অভ্রের মুখ চেপে ধরে। চোখে বাঁধভাঙা অস্রু। অভ্রের কথার আসল মানে সে বুঝতে পেরেছে।সেদিন অভ্রের দেওয়া ছোট্ট উদাহরণে,যেটা সেদিন বুঝতে পারেনি। তবে আজ বুঝতে পেরেছে। এতোদিনের ধুম্রজালের অবসান আজ ঘটেছে।
কান্না জড়িত কন্ঠে বলে, 'আমি আর কিছু জানতে চাই না অভ্র। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে না? 
মুখ থেকে হাত সরিয়ে অভ্র বলে, ' আমাকে বিষ খাইয়ে দিয়েছিলো,যাতে আমি মারা যায়। কিন্তু মণিমা মানে আমার বর্তমান মা বাঁচিয়েছিলো। 
প্রেমার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়।যেনো শ্বাস আঁটকে যাবে। এমন ভয়ংকর অনুভূতি আজ অবধি হয়নি।
-" কতো খারাপ! 
-' বিষণ খারাপ উনারা প্রেমা। তাদের মিস্টেক করার সময় হুস ছিলোনা।অথচ আমার জন্মের পর সব জ্বালা। মণিমাকে আমি আদ্রের সামনে মা ডাকি যাতে ওর সন্দেহ না হয়। যাতে কোনদিন সে জানতে না পারে তার ভাই কতোটা কষ্টে থেকেছিলো।
-' নাহ আমিও চাই না আদ্র এসব না জানুক।কিন্তু আদ্রের...? 
প্রেমার মুখ থেকে বাকি উচ্চারিত কথা অভ্র বলে উঠে,'আদ্রের যখন জন্ম হয় তখন আমার বয়স নয় ছিলো। আদ্রের জন্মের আগে অবশ্যই উনারা বিয়ে নামক কাজটি করেছিলেন,যেটা আমার সময়ে করলেও পারতেন। 
প্রেমা বুঝতে পারছেনা অভ্রের কথার পরবর্তী উত্তর কী দিবে? তবে সে এসবের জন্য বিষণ কষ্ট পাচ্ছে।
তার মধ্যেই অভ্র বলে, ' তুমি,আর মণিমা দু'জন ব্যক্তিই হয়তো আমার পরিচয় জেনে ঘৃণা হচ্ছেনা। তবে আমাকে যারা জন্ম দিয়েছিলো তারাই নাক ছিঁটকে ছিলো। আমি ভাবি আমার জন্মের পর আমার শরীরে কোন রকম ট্যাগ ছিলো যে আমি....
তারপরেও কেন আমাকে সহ্য করতে পারতো না।আমিই একজন মানুষ যার সব থেকেও ভালোবাসা নামক অদৃশ্য সম্পর্কের ছিটেফোঁটাও নি। 
'-উনারা কোথায় থাকেন তুমি যানো? একসাথে আছেন?তাহলে আদ্র কেন?
প্রেমার প্রশ্নে অভ্র হাসে।অদ্ভুদ ভাবে। এ হাসির অর্থ উদ্ধারে প্রেমা অক্ষম। 
'ভালোবাসা এতো জোড় ছিলো যে আদ্র জন্ম হওয়ার পর তাদের মনে হলো তারা একে-অপরের জন্য ফার্পেক্ট নয়।কী জগন্য চিন্তা।
পরে আলাদা হয়ে যায়।ডিভোর্স করে।আমার কথা বাদ দিলাম আমার ছোট শিশু ভাইটির চিন্তাও করেনি।
সম্পর্কে ভেঙে দেয়।একজন বয়ফ্রেন্ডের সাথে চলে যায়।আর অন্যজনও হয়তো নিজের মতোই ঘুছিয়ে নিয়েছে তবে আমি জানিনা। জানতে চাইও না।

মাঝে মাঝে ওই অভিশপ্ত বাড়িটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাজারো প্রশ্ন করি। কেন হলো এমনটা আমার সাথে? কেন? 

প্রেমার চোখের পানি থামার নাম নেই,অথচ অভ্রের এতো কষ্টের মাঝে মন পাথরে পরিণত হয়েছে।কাঁদতে দেয় না তাকে। একটু থেমে অভ্র আবার বলে,
-' সেদিন রাতে আমার পিঁছু নিয়ে যেখানে গিয়েছিলে? সে বাড়িটাতেই আমার জন্ম হয়েছিলো। আমি সব দোষ ওই বাড়িটাকেই দিয়ে এসেছি। প্রতি জন্মদিনের রাত বারোটায় আমি সেখানে যেতাম।ইচ্ছেমতো অবশিষ্ট সব জিনিস ভেঙে ফেলতাম।রাগে ক্ষোভে।
তবে সেদিন পারিনি,তোমার জন্যে,তাতে আমার আফসোস নেই। আমি পণ করেছি আর ওই বাড়িতে যাবোনা।যদি তুমি সাথে থাকো তো। 
প্রেমার দিকে তাকাল অভ্র,নিজ হাত দ্বারা প্রেমার গাল স্পর্শ করে।চোখের পানি মুছে দেয় অভ্র,
' প্লিজ কান্না থামাও,  
'আমার খুব কষ্ট হচ্ছে অভ্র,তোমার সাথে তখন দেখা হয়নি কেন? সত্যিই আমি তোমাকে কষ্ট পেতে দিতাম না।
প্রেমার কথায় অভ্র হাসে। 
'মণিামা আর আমাকে জন্ম দেওয়া মহিলাটি,দু'জনে বোন। অথচ তাদের মধ্যে আকাশ পাতাল সমান। মণিমা আমাকে আর আদ্রকে ছাড়া বিয়েও করতে রাজি হয়নি। বাবাও চাইনি আমরা আলাদা হই,উনিও চেয়েছেন মণি মায়ের থাকি। তাই আমাদের নিয়ে যায় উনাদের সাথে।

সমস্যা বাঁধে আরিয়ানের মা  মানে বড় মা,আমাকে আর আদ্রকে উনি সবসময় বাইরের মানুষ বলতেন।আমরা যেনো উনার চোখের বিষ। 
একদিন উনার হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য মণিমা বাঁধা হয়েছিলন। পরে সিঁড়ি থেকে পড়ে উনার মিসক্যারেজ হয়ে যায়। মণিমার প্রথম বেবিটি চলে যায়। যার জন্য মা আজো নিসন্তান। শুধু আমার জন্য হয়েছে। 
তবে কী জানো? আমার মাকে কষ্ট দিয়েছে, সে কষ্ট আমিও দিবো।উনিও পাবেন!

প্রেমা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করে,'কীভাবে?
অভ্র বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, 'সেটা তোমার অজানা থাক। 
প্রেমাও চুপ হয়ে যায়। অভ্রের পেটে হাত রাখতেই,অভ্র প্রেমার দিকে তাকাল।নিচু স্বরে প্রেমা জিজ্ঞেস করলো,'এটা কীভাবে কেটেছে? 
অভ্র হেসে বলে, ওই মহিলাটি ধাক্কা দিয়েছিলো, যার ফলে পেটে ভাঙা কাঁচ ঢোকে গিয়েছিলো। ভাগ্য ভালো ছিলো মারা যায়নি। অনেক কষ্ট হয়েছিলো। এই ইনজুরির কারণে,তাই আমার হুটহাট জ্বর উঠে।তখন বিষণ ভয় হয়।সেই কষ্টটা মনে পড়ে যায় আবারও তবে জ্বর নিজে নিজে সেরে যায় এখন। 

প্রেমা কান্না থামছে না দেখে অভ্রের এবার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।সে তো এখন আর কষ্ট পায় না।তাহলে প্রেমা কেন কাঁদবে।
অভ্র প্রেমাকে হ্যাঁচকা টেনে নিজের সাথে মেশায়। এবং  ঘাঁড়ে মুখ ডুবিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে 'তুমি তোমার কান্না থামাও,নাহলে আমি আর থামবোনা'
অভ্রের কথায় প্রেমা জমে বরফ হয়ে যায়। অজানা অনুভুতি এসে মনের দরজায় করাঘাত করে। প্রেমাকে থামতে দেখে অভ্র সরে যায়। প্রেমার ডান হাতটা নিয়ে আলতো করে ঠোঁট বুলায়। 
তাতেও যেনো প্রেমা ধম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। 
-'অভ্র আমি যাই,ঘুমাবো।
অভ্র মিটিমিটি হেসে বলে,' আমি তো আগেই বলেছিলাম চলে যেতে,তুমি যাওনি।তার মানে কী?  তুমিও......
অভ্রের কথায় প্রেমা 'ধ্যাত 'বলে উঠে চলে যায়।আর অভ্র প্রেমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ছাড়ে। সত্যিই আজ তার নিজেকে হালকা অনুভব হচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন