০৩!!
আমিনের চারপাশটা ঘুরছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছুই ঝাপসা লাগছে আর একটা জিনিসকে দুটো করে দেখছে। এই তো ওর সামনে চারটে মানুষ দাঁড়িয়ে। মাথা ঝাঁকি দিলে আবার দুজন দেখা যাচ্ছে। কী অদ্ভুত! নেশাটা বোধ হয় বেশিই হয়ে গেছে। প্রিয়ু বুঝতে পারে আমিনের নেশা বেশি হয়ে গেছে। বিয়ে বাড়িতে এসেও নেশা ছাড়া থাকতে পারে না। দুচোখেও সহ্য হয় না। কিন্তু উপায় নেই। এখন তো প্রিয়ুকেই সাহায্য করতে হবে। প্রিয়ু রিশাদকে পাশ কাটিয়ে আমিনের কাছে যায়। আমিন মাতলামি করে বলে,
"আচ্ছা এইখানে কয়টা মানুষ?"
প্রিয়ু কিছু বলে না। নিচে কীভাবে নিয়ে যাবে আর মানুষজনই বা কী ভাববে সেটাই ভাবছে প্রিয়ু। রিশাদ নিজেকে সামলে নিয়ে ওদের কাছে এগিয়ে যায়। প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে বলে,
"এটাই আপনার ভাই?"
"সৎ ভাই!"
"ঐ হলো। দেখে তো মনে হচ্ছে নেশা করেছে।"
"হুম।"
"এখন তো নিচে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি চাইলে সাহায্য করতে পারি।"
"কী সাহায্য?"
"উনাকে চিলেকোঠার ঘরে রেখে আসতে পারি। যাওয়ার সময় না হয় নিয়ে যাবেন।"
প্রিয়ু কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
"হুম! সেটাই ভালো।"
রিশাদ এবং প্রিয়ু দুজনে মিলে আমিনকে ধরে চিলেকোঠার রুমে রেখে নিচে নামে। দুজনকে একসাথে নামতে দেখে অনিক। প্রিয়ু কনের কাছে চলে যায়। ওখানে আশা আর মিনাও ছিল। অনিক রিশাদের কাছে এসে বলে,
"ঘটনা কী?"
"কীসের ঘটনা?"
"দুজনে একসাথে ছাদ থেকে নামলি যে?"
"একসাথে নামলাম নাকি?"
"হ্যাঁ, তাই তো দেখলাম। তুই আর প্রিয়ু একসাথে নামলি।"
"তাহলে হতে পারে।"
"আচ্ছা বাদ দে। একটা কথা আছে।"
"বলে ফেল।"
"মুহিতের ছোট শালীকাকে দেখেছিস? কী সুন্দর! একদম পরী।"
"তোর এই ভালো লাগার বাতিক কবে যাবে?"
"এমন করিস কেন? তুই একটু মুহিতকে বলবি? যেন আমাদের লাইনটা করিয়ে দেয়।"
"তোর ভাই তুই গিয়ে বল। তাছাড়া কাল না প্রিয়ুর কথা বললি?"
অনিক মন খারাপ করে বলে,
"প্রিয়ু আমায় পাত্তা দেয় না। আমার কথা না শুনেই তোর কাছে ফুড়ুৎ করে চলে গেল।"
"আমার কাছে কেন যাবে আজব! ছাদে গেছিল। আর তোর কোনো লাইন টাইন সেট করার মধ্যে আমি নাই।"
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে বরযাত্রীরা বউ নিয়ে বাড়িতে ফেরে। আশা আর প্রিয়ু আলাদা সিএনজিতে করে আমিনকে নিয়ে যায়। বাড়ি থেকে গাড়ি পর্যন্ত আমিনকে আনতে সাহায্য করে রিশাদ আর অনিক। পরেরদিন বৌভাতের অনুষ্ঠানে রিশাদের সাথে শেষ দেখা হয় প্রিয়ুর। সেদিন রাতেই রিশাদ আর অনিক নিজেদের বাড়ি চলে যায়। মিনাদের বাড়ি থেকে আশা আর প্রিয়ু দুপুরে খেয়েই চলে আসে। বিকেলে মনসুর আলী আর আলেয়া বেগম আজ বাড়িতে ফিরবেন। তাদের জন্য রান্নাবান্না করতে হবে। দু'বোন মিলে রান্নাবান্নার সব জোগার করে। আশা রান্না করে আর আগুনের পাশে বসে থাকে প্রিয়ু। মুহিতের বিয়ের গল্প করছে দুজন। প্রিয়ু বলে,
"আপু তোমার বিয়ে হয়ে গেলে তখন আমি কীভাবে থাকব? যদি দুলাভাইর মতো তোমার স্বামীও আমার সাথে কথা বলতে না দেয়?"
"ওমন ছেলেকে বিয়েই করব না আমি।"
"তুমি জানবে কী করে কে কেমন?"
"সময় হোক তো আগে! আমি তো চাই আমার আগে তোর বিয়ে হোক।"
"যাহ্! কী বলো! বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে হয় নাকি?"
"হয় তো! আর না হলে আমার সাথে তোকে নিয়ে যাব।"
প্রিয়ু হাসে। কারণ প্রিয়ু জানে জীবন এত সহজ নয়। এখন যত সুন্দর করে কল্পনায় সব সাজানো হচ্ছে বিয়ে হলে সব পাল্টে যাবে। কল্পনাগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। কিন্তু আশা আপু সুখী হোক। খুব সুখী। ভালো মানুষের সুখী হওয়ার অধিকার আছে। শুধু কষ্ট একটাই। আমার বড় আপা সুখে নেই!
পরেরদিন আশা আর প্রিয়ু একসাথে ভার্সিটিতে যায়। বাজারে গেলেই ফার্মেসীর এক ছেলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে। আশার ধারণা ছেলেটা প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু প্রিয়ু লক্ষ করে দেখেছে তার দৃষ্টি আশার দিকে নিবদ্ধ। খারাপ দৃষ্টি নয়। ঐ দৃষ্টিতে আশা আপুর জন্য অনেক ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু আশা আপু দেখেও যেন দেখেনা! তার একটা কারণ অবশ্য আছে। এটা একান্তই প্রিয়ুর ধারণা। ছেলেটা ওদের থেকে অনেক বড়লোক। দেখতেও মাশআল্লাহ্। আর আশাদের অবস্থা এত ভালো নয়। তারমধ্যে মায়ের দুই বিয়ে। এমন পরিবারের মেয়েকে এত বড় পরিবার মেনে নেবে না। ভার্সিটির ক্লাশ শেষ হলে আশা বাড়িতে চলে যায়। প্রিয়ু যায় টিউশনি করতে। আশার পড়ার খরচ আব্বা দিলেও প্রিয়ুর পড়ার খরচ দেয় না। এর কারণ অবশ্য আলেয়া বেগম। সংসারের সবকিছু তো তার কথামতোই চলে।
টিউশনিতে যাওয়ার সময় দেখা হয়ে যায় অরণ্য ভাইয়ার সাথে। প্রায় দু'মাস পর তো হবেই। কোথায় যে উধাও হয়ে যায়! প্রিয়ুকে দেখে অরণ্য এগিয়ে এসে বলে,
"আরে টুনটুনি, কেমন আছিস?"
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করে প্রিয়ু।
"এতদিন কোথায় ছিলে?"
"ছিলাম এক কাজে। কোথায় যাচ্ছিস?"
"টিউশনি করাতে।"
"এই রোদে পুড়ে?"
"আগুনে পুড়লেও যে সহ্য করতে পারে তার কাছে রোদ তো কিছুই না।"
উত্তরে অরণ্য কিছু বলে না। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শুধু। বলে,
"আচ্ছা তাহলে যা। আমি এখানেই আছি। তুই ফিরলে একসাথে বাড়ি যাব।"
"আমার ফিরতে সন্ধ্যা হবে।"
"সমস্যা নেই। যা।"
প্রিয়ু টিউশনি করতে চলে যায়। মোট চারটা টিউশনি করায় প্রিয়ু। যা টাকা আসে তাতে মোটামুটি পড়াশোনার খরচ তো চলে যায়। শুধু এক্সামের সময়ই ঝামেলায় পড়তে হয়। আর তখন ঝামেলার মুশকিল আহসান হয়ে আসে মিনার আব্বা আর অরণ্য ভাইয়া। কলেজে ভর্তি হওয়ার টাকা দিয়েছিল মিনার আব্বা। এরপর বইখাতা এগুলো সব কিনে দিয়েছে অরণ্য ভাইয়া। উনাদের সহযোগিতার জন্যই হয়তো এতদূর আসতে পেরেছে। না হলে যাদের সাথে রক্তের কোনো সম্পর্কই নেই তারা এত সাহায্য করে? অথচ যার সাথে রক্তের সম্পর্ক সেই আব্বা-ই প্রিয়ুর প্রতি দায়িত্বহীন। এসব এখন আর গায়ে লাগে না। অভ্যেস হয়ে গেছে তো।
টিউশনি সব শেষ করতে করতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। ভার্সিটির সামনে চায়ের দোকানে অরণ্য ভাইয়াকে দেখতে পায়। সিগারেট খাচ্ছিল। প্রিয়ুকে দেখে সিগারেট ফেলে দেয়। প্রিয়ু এগিয়ে যেতেই অরণ্য বলে,
"বাসায় যাওয়ার তাড়া আছে?"
"না।"
"তাহলে চল হাঁটি।"
"আচ্ছা।"
দুজনই চুপচাপ হাঁটছে। এর আগেও দু ভাই-বোন এই রাস্তায় অনেক হেঁটেছে। রাতের তারা গুণেছে একসাথে। হাসি-ঠাট্টা করেছে। নিজেদের সুঃখ-দুঃখ শেয়ার করেছে। কিছু সম্পর্ক আসলে রক্তের নয়। আত্মার হয়! যেমন অরণ্য ভাইয়ার সঙ্গে প্রিয়ুর আত্মার সম্পর্ক। মৌনতা কাটিয়ে প্রিয়ু বলে,
"তুমি সিগারেট খাও?"
"আগে খেতাম না। কয়েকদিন ধরে খাচ্ছি।"
"খুবই বাজে স্বভাব।"
"সবই টেনশন দূর করার চেষ্টা।"
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডের দিকে যায়। ওখানে একটা ধাবা আছে। গরম গরম ডিম পরোটা, আলু কাবলী, আলুর দম আর চা বিক্রি করে। প্রিয়ুর যে খিদে পেয়েছে এটা অরণ্য জানে। সকালের পর পেটে আর কিছু যায়নি সেটাও জানে।
"তোর খিদে পেয়েছে প্রিয়ু?"
"পেয়েছে।"
"চল আজ আলুর দম দিয়ে ডিম পরোটা খাব।"
"আচ্ছা।"
"আমার সাথে ছাড়া আর এখানে এসেছিলি?"
"না। আসার মতো আমার কেউ নেই।"
"শোন, আমি মারা যাওয়ার আগে এই দায়িত্বটা তোর স্বামীকে দিয়ে যাব। আমি মরার আগে না কিন্তু!"
"আমি বিয়ে করব না।"
"হয়েছে! দু'দিন পরই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাবি।"
"এমন কেউ নেই যার জন্য পাগল হব।"
"নেই, হয়ে যাবে।"
ধাবায় এসে খাবার অর্ডার দিয়ে দুজনে চেয়ারে বসে। প্রিয়ু বলে,
"এবার বলো কী এত টেনশন?"
"তিতলির কথা তো জানিসই।"
"কী হয়েছে দিদির?"
"ওর কিছু হয়নি। ওর বাড়িতে আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছে।"
"তারপর?"
"আর তারপর! খুব রাগারাগি করেছে ওর সাথে ওর মা। ওর মাকে তো তুই ভালো করে চিনিস। তারমধ্যে আমরা দুজন দু'ধর্মের।"
"সম্পর্কে জড়ানোর আগে এসব নিয়ে ভাবা উচিত ছিল।"
"ভালোবাসা কি এতকিছু ভেবে হয়? আল্লাহ্ জানেন এখন কী যে হবে!"
"কথা হয় না?"
"খুব কম। লুকিয়ে ফোন দেয়।"
"আচ্ছা আমি কাল তিতলি দি'র বাসায় যাব।"
"সত্যিই যাবি?"
"হ্যাঁ। তুমি বরং একটা চিঠি লিখে দাও। আমি দি'কে দিয়ে দেবো।"
"তাই ভালো। দে একটা কাগজ আর কলম দে।"
খাবার চলে আসে। প্রিয়ু কাগজ আর কলম এগিয়ে দেয়। চিঠি লেখা শেষ হলে দুজনে খেয়ে নেয়। কিছু টাকা প্রিয়ুকে দিয়ে বলে,
"যাওয়ার আগে ওর জন্য কাঁচের চুরি কিনে নিয়ে যাবি। তোর হাতের মাপেই নিবি। দুজনই তো একই রকম শুকনা!"
"ইশ! তুমি কত মোটা।"
"তোর জামাই মোটা হবে।"
"হু! ঘেচু হবে।"
-----------------------------
রাত থেকে আশার ঠান্ডা-জ্বর। শীতে ঠান্ডা বসিয়ে ফেলছে। একটু পরপরই নাক টানছে। আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ডাক্তারের দোকানে নিয়ে গেছে প্রিয়ু। ফার্মেসীর ছেলেটা অস্থির হয়ে জানতে চায়,
"কী হয়েছে উনার?"
প্রিয়ু মুচকি মুচকি হাসে। বলে,
"আমি কী করে জানব? ডাক্তার আমি নাকি আপনি?"
প্রিয়ুর কথায় বোকা বনে চলে যায় ডাক্তার সিয়াম। আসলেই তো! ডাক্তার তো প্রিয়ু নয়। ঠান্ডা, জ্বর সব মেপে ওষুধ দেয় সিয়াম। সঙ্গে বলে দেয় নিয়মমতো খাওয়াতে। প্রিয়ু টাকা এগিয়ে দেয়। সিয়ামের নেওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও নেয়। নয়তো পরে সন্দেহ করবে। যাওয়ার আগে প্রিয়ু বলে,
"সবসময় আমার আপুকে এমন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন কেন? চোখ তুলে ফেলব একদম।"
সিয়াম হতবিহ্বহল হয়ে যায়। মুখটা কাচুমুচু করে ফেলে।
পরেরদিন সকালে প্রিয়ু একাই ভার্সিটিতে যায়। তিনটা ক্লাস করে চলে যায় শপিংমলে। তিতলির জন্য কাঁচের চুরি কিনতে হবে। বৃহস্পতিবারেও মার্কেটে এত্ত ভীড়! বাব্বাহ্! পা ফেলারও যেন জায়গা নেই। ধাক্কাধাক্কি করেই চুরির দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ-ই কিছুর সাথে চুলে টান লাগে। প্রিয়ু থেমে যায়। বিরক্ত নিয়ে পেছনে ফিরে দেখে রিশাদকে। রিশাদ দু'হাত সামান্য উঁচু করে বলে,
"আমি কিছু করিনি।"
প্রিয়ু তাকিয়ে দেখে রিশাদের শার্টের সাথে প্রিয়ুর চুল আটকে গেছে। রিশাদের ভাবমূর্তি দেখে হেসে ফেলে প্রিয়ু। কী কিউট করে ইনোসেন্টের মতো কথা বলে! এদিকে লোকজন ধাক্কাধাক্কি করে যাচ্ছে। শার্ট থেকে চুল ছাড়ানোর সুযোগটুকুও নেই। বিষয়টা খেয়াল করে কাপড়ের দোকানের এক কর্মচারী। প্রিয়ুকে বলে,
"আপা দোকানের এইখানে আইসা দাঁড়ান।"
প্রিয়ু চুল ধরেই দোকানের কাছে এগিয়ে যায়। পেছনে পেছনে আসে রিশাদ। ঐ দোকানেই টি-শার্ট দেখছিল অনিক। প্রিয়ু শার্টের বোতাম থেকে চুল ছাড়াচ্ছে তখন অনিক তাকায়। ঠোঁট দুটো চোখা করে বলে,
"বাব্বাহ্! সেটিং হয়ে গেছে? মামা! তুমি না চাইলে কী হবে? আল্লাহ্ আছে তো।"
রিশাদ চোখ গরম করে তাকায় অনিকের দিকে। অনিক যেন তাতে ভয় না পেয়ে আরো উৎসাহ পেল। বলে,
"খাড়া। দুইডা ছবি তুইলা লই। ফ্রেমে বাইন্ধা রাখমু।"
০৪!!
রিশাদ কিছু বলার আগেই ফটাফট ছবি তুলে নিয়েছে অনিক। রিশাদের শার্ট থেকে চুল ছাড়িয়ে নিয়ে প্রিয়ু অনিককে বলে,
"মাগনা ছবি কি সবাইরে তুলে দেন ভাইজান?"
অনিক মুখটা ছোট করে বলে,
"ভাই বলবা না।"
"ওকে কাকু!"
অনিক বিরস মুখে বলে,
"আচ্ছা থাক! ভাই ডাকটাই ঠিক আছে।"
প্রিয়ু মিটিমিটি হাসে। বলে,
"আচ্ছা আমি তাহলে যাই। পরে একদিন কথা হবে।"
"আরে, আরে! এত তাড়া কীসের? চলো কোথাও বসে কথা বলি।" বলে অনিক।
"না, আমার একটু কাজ আছে।"
"কিছু কিনবে?"
"হ্যাঁ। চুড়ি কিনব।"
"চলো আমরাও যাই।"
অনিকের আগ বাড়িয়ে এসব ঢং করায় রিশাদ খুব বিরক্ত হয়। কী দরকার এতসব ন্যাকামো করার? কিন্তু এখানে কিছু বলাও যাবে না। চুড়ির দোকানে গিয়ে চুড়ি দেখছে প্রিয়ু। পাশেই রিশাদ আর অনিক দাঁড়িয়ে আছে। চুড়ি কেনা শেষ হলে তিনজনে একটা ক্যাফে বসে। প্রিয়ু চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে। রিশাদ জিজ্ঞেস করে,
"চুড়ি কি খুব পছন্দ?"
"পছন্দ। তবে এগুলো আমার নয়।"
"কার?"
"তিতলি দি'র।"
"সে কে আবার?"
"অরণ্য ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড। কখনো সম্ভব হলে পরিচয় করিয়ে দিবনে।"
রিশাদ কিছু বলে না। অনিক বলে,
"আচ্ছা এসব বাদ দাও। প্রিয়ু একটা কথা বলি?"
"ওহ হ্যাঁ, আপনি তো সেই বিয়ের দিনই কী যেন বলতে চেয়েছিলেন? বলেন।"
"আর সে কথা! সে কথা বলে লাভ নেই।" আফসোসের মতো করে বলে অনিক। থেমে আবার বলে,
"এখন অন্য কথা বলব।"
"আচ্ছা।"
"তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?"
অনিকের প্রশ্নে রিশাদ রেগে যায়। কীসব প্রশ্ন করছে! প্রিয়ু হেসে ফেলে। হেসে হেসেই বলে,
"না।"
কফি আসলে তিনজনে কফি খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প করে। রিশাদের কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খায় খায় প্রিয়ু আর অনিক। রিশাদের ভালোই লাগে। দুঃখী মানুষ হাসলে বোধ হয় সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে। হঠাৎ হাসতে হাসতে প্রিয়ু থেমে যায় পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কাউকে কিছু না বলেই দৌঁড়ে ঐ টেবিলে চলে যায়। একটা চেয়ার টেনে এক মহিলার পাশে বসে। তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
"খালামনি!"
মমতা বেগমের বোন লিসা বেগম প্রিয়ুর একমাত্র খালা। প্রিয়ু লিসাকে দেখে যতটা খুশি হয়েছে ঠিক ততটাই বিরক্ত হতে দেখা যায় লিসা বেগমকে। পাশেই ছয় বছরের লিয়াদ বসে আছে। প্রিয়ুকে দেখে খুশি হয়ে বলে,
"আপাই! তুমি? ভালো আছো?"
প্রিয়ু খালামনিকে ছেড়ে লিয়াদকে কোলে নেয়। আদর করে বলে,
"ভালো আছি ভাই। তুই ভালো আছিস?"
লিসা বেগম ছো মেরে লিয়াদকে প্রিয়ুর কাছ থেকে নিয়ে যায়। রাগীস্বরে বলে,
"তোকে বলেছিলাম না কখনো আমার সামনে আসবি না? তাও তুই এসেছিস?"
"রাগ করছো কেন খালামনি?"
"কীসের রাগ? রাগ মানুষ আপন মানুষের সাথেই করে। তুই আমার কেউ নস। তোর ওপর রাগ করার কোনো মানেই হয় না। খবরদার বলে দিচ্ছি, ফারদার আমার বা আমার বাচ্চার সামনে আসবি না।"
এরপর তিনি লিয়াদকে নিয়ে কফির বিল দিয়ে চলে যায়। প্রিয়ু দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। ক্যাফের অনেকেই তাকিয়ে আছে প্রিয়ুর দিকে। লিসা বেগমের রাগী রাগী কথা সকলের কানেই গেছে। প্রিয়ুর চোখে পানি টলমল করলেও মুখে হাসি। কী অদ্ভুত মেয়ে! এত মানুষের সামনে অপমান করার পরও মুখে হাসি। রিশাদ আর অনিক প্রিয়ুর কাছে যায়। বিল দিয়ে তিনজনে বের হয়ে আসে। ক্যাফের বরাবর শপিংমল। ঐতো খালামনি লিয়াদকে নিয়ে দোতলায় হাঁটছে। লিয়াদ প্রিয়ুকে দেখে হাত নাড়িয়ে ডাকছে। লিসা লিয়াদকে ধমক দিয়ে সেখান থেকে সরে যায়। প্রিয়ু তবুও তাকিয়ে থাকে সেখানে।
"উনি আপনার আপন খালামনি?" জিজ্ঞেস করে রিশাদ। প্রিয়ু ছোট করে বলে,
"হু।"
"এমন ব্যবহার করলেন কেন সবার সামনে?"
"ভালোবেসে!"
"পাগল হয়ে গেছেন? ভালোবাসলে কেউ কাউকে অপমান করে না। উনাকে দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে উনি আপনাকে সহ্য করতে পারেন না।"
"আচ্ছা মুখে কিছু বলব না। চলেন খালামনির ভালোবাসাটা দেখাই।"
প্রিয়ু শপিংমলের দিকে এগিয়ে যায়। রিশাদ আর অনিক মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে পেছন পেছন যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর খালামনির দেখা মেলে। রিশাদ আর অনিককে কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে প্রিয়ু খালামনির কাছে যায়। পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলে,
"প্লিজ খালামনি! এমন কোরো না আমার সাথে।"
লিসা প্রিয়ুকে সরিয়ে দিয়ে চলে যায়। প্রিয়ু বুকের বাম পাশে হাত রেখে চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। লোকজন এগিয়ে আসে চিৎকার শুনে। রিশাদ আর অনিকও ভয় পেয়ে যায়। দ্রুত আসে সেখানে। লোকজনের ভীড় কাটিয়ে দেখে লিসা বেগম প্রিয়ুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন আর সবাইকে বলছেন সাহায্য করতে। অন্যরা সাহায্য করার আগে অনিক আর রিশাদই এগিয়ে আসে। অনিক রিশাদকে ঢেলে পাঠায় প্রিয়ুকে কোলে নিতে। অসুস্থ একজন মানুষকে কোলে নেওয়া মানে তাকে সাহায্য করা। তাই রিশাদ আর কিছু না ভেবেই প্রিয়ুকে কোলে তুলে নেয়। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। লিসা বেগম আর রিয়াদ কাঁদতে কাঁদতে পিছু পিছু আসছে। সাথে আসছে অনিকও। অদ্ভুত মহিলা! একটু আগেও প্রিয়ুর সাথে কত খারাপ ব্যবহার করল আর এখন কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছেন। একটা সিএনজি ডেকে প্রিয়ুকে পেছনে বসিয়ে দেয় রিশাদ। যখন সরে আসতে যাবে তখন প্রিয়ু ফিসফিস করে বলে,
"বড় হওয়ার পর কেউ কোলে নেয়নি কখনো। এই আপনিই নিলেন প্রথম। ভালোই হলো খালামনির ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে কোলে চড়াও হয়ে গেল।"
রিশাদ চমকে তাকায় প্রিয়ুর দিকে। প্রিয়ু সঙ্গে সঙ্গে চোখ মারে। তার মানে এতক্ষণ সব অভিনয় ছিল। খালামনি প্রিয়ুর পাশে এসে বসার পর প্রিয়ু স্বাভাবিক হয়ে বলে,
"হয়েছে আর কাঁদতে হবে না।"
তিনি থমকে যান। অবাক হয়ে বলেন,
"তুই..."
"আমার কিছু হয়নি। নাটক করলাম এতক্ষণ। তুমি সবার সামনে আমায় বকলে কেন তখন?"
"অসভ্য, বদ মেয়ে। এমন নাটক করার মানে কী? জানিস আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম?"
প্রিয়ু খালামনিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
"আমি জানি তো খালামনি। তুমি আমায় ভালোবাসো খুব ভালোবাসো।"
"কিন্তু আফসোস! তুই আমার ভালোবাসাটা বুঝলি না।"
রিশাদ দম নিয়ে মনে মনে বলে,
"সাংঘাতিক মেয়ে!"
পূজা সরকারের একমাত্র মেয়ে তিতলি সরকার। একই স্কুলে পড়েছে তিতলি আর প্রিয়ু। কিন্তু তিতলি প্রিয়ুর এক বছরের সিনিয়র ছিল। পূজা সরকার সেই স্কুলেই শিক্ষকতার চাকরী করতেন। যেমন ভালো তেমনই রাগী তিনি। কিন্তু প্রিয়ুকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। হয়তো প্রিয়ুর অসহায়ত্ব বা সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের জন্যই! প্রিয়ু বাড়িতে এসে দরজায় নক করে। দরজা খুলে দেয় তিতলি। প্রিয়ুকে দেখে খুশিতে লাফাতে শুরু করে। জড়িয়ে ধরে বলে,
"কত্তদিন পরে আসলি তুই!"
"তুমি তো কখনোই যাও না।"
"মা যেতে দেয় না।"
"জানি। ম্যাম কোথায়?"
"ঘরেই আছে। আয়।"
দরজা লাগিয়ে দিয়ে তিতলি প্রিয়ুকে রুমে নিয়ে যায়। পূজা সরকারও প্রিয়ুকে দেখে খুশি হয়। জিজ্ঞেস করে,
"ভালো আছো প্রিয়ু? আজকাল তো তোমার দেখাই পাওয়া যায় না।"
"ভালো আছি ম্যাম। আসলে পড়াশোনা, টিউশনি এসব করে তেমন সময় পাওয়া যায় না। আপনি ভালো আছেন?"
"ইশ্বর ভালোই রেখেছেন। তোমার বাড়ির খবর কী?"
"যেমন ছিল!"
"বিয়ে করে ফেলো। ঐ নরকে আর কত?"
"দেখি না কতদূর সহ্য ক্ষমতা আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন।" মৃদু হেসে বলে প্রিয়ু। পূজা সরকার বলেন,
"আচ্ছা তুমি তিতলির সাথে গল্প করো। আমি নাস্তা বানাই।"
প্রিয়ু সায় দেয়। পূজা সরকার চলে যাওয়ার পর প্রিয়ু আগে ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে বলে,
"অরণ্য ভাইয়ার চিঠি এটা। ম্যাম খাবার নিয়ে আসার পর তুমি চিঠি নিয়ে রুমে চলে যাবে। চিঠি পড়ে উত্তর লিখে দেবে। ততক্ষণ আমি ম্যামের সাথে গল্প করব।"
"ঠিকাছে।"
"এই নাও তোমার কাঁচের চুড়ি।"
ব্যাগ থেকে মোট ১০ ডজন চুড়ি বের করে প্রিয়ু। তিতলি খুশি হয়ে বলে,
"অরণ্য পাঠিয়েছে না?"
"জি না। ভাইয়া টাকা দিয়েছে আর আমি কিনেছি।"
পূজা সরকার নাস্তা আনার পর তিতলি নিজের রুমে চলে যায়। তিতলি না আসা পর্যন্ত প্রিয়ুও বিভিন্ন কথাবার্তা চালিয়ে যায়। কথার এক ফাঁকে পূজা সরকার জানান তিনি তিতলির বিয়ের কথা ভাবছেন। কিন্তু তিতলিকে রাজি করানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। তিনি এটাও বলেন প্রিয়ু যেন তিতলিকে বোঝায় একটু। প্রিয়ু বড়সড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে। বোঝানোর দায়িত্ব দেওয়ার আর মানুষ পেল না? তিতলি চিঠি লিখে আনার পর প্রিয়ু বিদায় নিয়ে চলে আসে। আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ যে কোনো টিউশনি নেই এটা বাড়ির সবাই জানে। আব্বা আর মা বাড়িতে আসার আগেই যেতে হবে। বাড়িতে গিয়ে রান্নাবান্না আবার নিজেকেই করতে হবে। আশা আপু তো অসুস্থ। যাওয়ার পথে একটা বিরাট বাড়ির সামনে আবারও রিশাদের সাথে দেখা হয়ে যায়। সিকিউরিটি গার্ডের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। ছেলেটার হাসিটা দারুণ। সাথে কণ্ঠটাও। সবার সাথে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। সূর্যের রক্তিম আভা রিশাদের মুখে পড়ায় মুখটা কমলা বর্ণ ধারণ করেছে। ফর্সা মুখটা আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। প্রিয়ুর হিংসা লাগে ভীষণ। একটা ছেলেকে কেন এত সুন্দর হতে হবে? সুন্দর হবে মেয়েরা। আর ছেলেরা মুগ্ধ হয়ে দেখবে। প্রিয়ুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিকিউরিটি সালাম চাচা। তিনিই রিশাদকে বলেন,
"ঐ মেয়ে এইদিকে তাকিয়ে আছে কেন বাবা?"
রিশাদ এবার প্রিয়ুর দিকে তাকায়। হেসেই বলে,
"আপনি এখানে?"
এরপর দুজনই এগিয়ে যায়।
"তিতলি দি'র বাড়িতে গিয়েছিলাম।" বলে প্রিয়ু। এরপর জিজ্ঞেস করে,
"আপনি এখানে থাকেন?"
"আমি ঐ তিন তলার ফ্ল্যাটে থাকি।"
"আর কে থাকে?"
"আমি একাই থাকি। ব্যাচেলর বলতে পারেন।"
"ওহ। একটু পানি খাব।"
"চলেন বাড়িতে যাই। নাকি ভয় পাবেন?"
"কাকে?"
"আমায়।"
"না, আপনাকে ভয় লাগে না।"
রিশাদ মিষ্টি করে হাসে। সালাম চাচার সাথে প্রিয়ুর পরিচয় করিয়ে দেয়। ফ্ল্যাটে গিয়ে রিশাদ প্রিয়ুকে পানি দেয়। প্রিয়ু ঘুরেঘুরে ফ্ল্যাট দেখছে। খুব সুন্দর ফ্ল্যাটটা। বিশেষ করে ব্যলকোনিটা অসাধারণ। রিশাদ শুধু পানিই আনে না। সঙ্গে করে চা আর বিস্কুটও আনে। রিশাদকে দেখে প্রিয়ু বলে,
"বাড়িটা অনেক সুন্দর।"
উত্তরে রিশাদ হাসে। চা প্রিয়ুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
"আপনি তো খুব ভালো নাটক করতে পারেন।"
"সে তো আমি প্রতিনিয়তই করি। খালামনির সাথে নাটকটা করা দরকার ছিল।"
"আপনার ওপর রাগ কেন উনি?"
"খালামনি চেয়েছিল আমি যেন তাদের সাথে থাকি। আমি প্রথমে রাজি না হলেও আব্বা বিয়ে করার পর রাজি হই। ১৫ দিন খালামনির বাসায় ছিলামও। একদিন শুনি খালু খালামনির সাথে ঝগড়া করছে খুব। ঝগড়ার রিজন ছিলাম আমি। খালু আমার দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। পরে আমি নিজেই কান্নাকাটি করে আবার বাড়িতে চলে আসি। খালামনি অনেক বুঝিয়েছিল। শুনিনি আমি। তারপর থেকেই আমার ওপর খালামনির রাগ। অথচ খালামনি এখনো জানেই না সেদিন আমি সব শুনেছিলাম। কী দরকার বলেন? শুধু শুধু আমার জন্য খালামনি আর খালুর মধ্যে ঝগড়া হবে বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাছাড়া এসব এখন অতি সামান্যই লাগে আমার কাছে।"
"এতকিছুর পরও আপনি কত ভালো থাকেন!"
"থাকতে হয়। আপনিই তো বলেছেন, 'নিজে যেমনই থাকো না কেন, যত কষ্টেই থাকো না কেন নিজের কষ্টটা কখনো কাউকে বুঝতে দিও না। সবাই না হয় তোমার মিথ্যে হাসিটা দেখেই ভালো থাকুক।' মনে পড়ে?"
"এটা তো..."
প্রিয়ু জিহ্বা বের করে বলে,
"আপনার ডায়েরীটা খুলেই লাইনগুলো দেখলাম। ভালো লেগেছে তাই মনে গেঁথে নিয়েছি।"
"মেমোরি ভালো।"
"ততটাও নয়। তবে মাথায় কিছু রাখলে সেটা ভুলে যাই। কিন্তু মনে কিছু রাখলে সেটা ভুলি না। আপনাকে মনেই রেখেছি।"
"ওহ আচ্ছা! আমায় মনে রেখেছেন?"
"আপনার কথাগুলো মনে রাখা মানে তো আপনাকেই মনে রাখা। যাই হোক, এখন আমি আসি। ওহ হো! একটা কথা।"
"কী?"
"একটা গান শুনাবেন? মনটা অস্থির অস্থির লাগছে খুব। বাড়িতে গেলে খারাপ কিছু হবে মনে হচ্ছে। গান শুনিয়ে দেন মনটা ফ্রেশ করে বাড়িতে যাই।" রিশাদ কিছু না বলে গাইতে শুরু করে,
"তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কী বা দূরে রও;
মনে রেখো আমিও ছিলাম,
এই মন তোমাকে দিলাম।"
প্রিয়ু হেসে বলে,
"মন ভালো হয়ে গেছে।"
"আশা করি খারাপ কিছু হবে না।"
"হবে না!"