অনুভবে - পর্ব ১২ - নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা - ধারাবাহিক গল্প


রবিবারে সকাল দশটা সোজা অফিসে আসতে বলা হয় তাকে। সময়ের আগেই পৌঁছায় সে। সেখানে যেয়ে দেখে রিহার্সাল রুমে অন্য কেউ নেই, জোহান ছাড়া। 

জোহানকে দেখে অবাক হয় সে। জোহান তো আরও দশদিন পর আসতো। জোহান মোবাইল টিপছিলো। এর দরজা খোলার শব্দে তাকায় ইনারার দিকে, "সরি, আপনাকে চিনলাম না।"
প্রশ্নের উওর দিলো না ইনারা। জোহানকে দেখে তার গলায় যেন শব্দেরা গুচ্ছ বেঁধেছে। হাজার কথা বলতে চাইছে সে, পারছে না। 

জোহান উঠে এসে দাঁড়ায় ইনারার সামনে, "আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। আপনি এখানে কি করছেন জানতে পারি? আর এই সেক্টরে আপনি এন্ট্রি কীভাবে পেলেন? অনুমতি আছে আপনার কাছে?"
ইনারা দ্রুত মাথা নাড়ায়।
জোহান আবার জিজ্ঞেস করে, "কে দিয়েছে?" 

"আমি," সভ্য দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে উওর দেয়, "আমি দিয়েছি। ও আমাদের গ্রুপের নতুন এসিস্ট্যান্ট।"
জোহান তাচ্ছিল্য হাসে, "আমি না থাকার সুযোগে নিজের মন মতো একজনকে রেখে দিলি?"
"তো এখন কী তোর থেকে অনুমতি নিতে হবে?"
"একদম।"
" সভ্য কারও থেকে অনুমতি নেয় না। অন্যেরা তার থেকে অনুমতি নেয়। তোর বাবা সবে আমার থেকে অনুমতি নিয়ে একটা কাজ জমা দিলো।"
কথাটা শুনতেই জোহানের চোখে মুখে কেমন ক্রোধ ভেসে উঠে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, "আমার বাবাকে মাঝে আনার প্রয়োজন নেই।"
সভ্য ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি এঁকে তার কাঁধে হাত রেখে চোখ টিপ মেরে বলে, "যদি কথা সহ্য করতে না পারিস তাহলে খোঁচা মেরে কথা বলার প্রয়োজন কী?" সভ্য যেয়ে সোফায় বসে। পা'য়ে পা তুলে। কোলে গিটার নিয়ে তা ঠিক করতে থাকে। 

সামি, ইরফান এবং ঐশি সভ্যের পিছনেই এসেছিলো। তাদের দুইজনের এমন কথা কাটাকাটি দেখে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। সভ্য যেতেই পরিস্থিতিটা হাল্কা করার জন্য সামি জোহানকে বলে, "ব্রো তোর ট্রিপ এত জলদি শেষ? আরও ক'দিন পর না আসতি?"
"তোর বন্ধুর ঝামেলার কারণে সব ছেড়ে আসতে হয়েছে। এমন কান্ড ঘটায় কেন যে এসব ঝামেলায় পড়বে?"
"আরে তুই তো জানিস সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়াতে থাকে। সভ্য এমন কিছু করতে পারে না। পাবলিক স্টেটমেন্টও দেওয়া হয়েছে।" 

সভ্য তার কাজ করতে থাকে। কারও দিকে না তাকিয়েই বলে, "কিন্তু সামি ও আসলেই বা আমার ঝামেলার সমাধান কীভাবে হতে পারে আমি বুঝতে পারছি না। এর উপর একদিনে রিটার্ন টিকিট পাওয়াও গেছে, অবাক কান্ড!"
সামি বলে, "আহা সভ্য থাক না। কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।" আবার সে জোহানের সাথে ইনারাকে পরিচয় করিয়ে বলে, "জোহান ওর সাথে পরিচিত হো। ওর নাম ইনারা। আমাদের গ্রুপের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট এবং তোর অনেক বড় ভক্ত। এতদিন অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে তুই কবে আসবি।"
"তাই না'কি? আমার ফ্যানকে তোর বন্ধু কাজে রেখেছে কথাটা হজম হচ্ছে না।" জোহানের হঠাৎ ভাব পরিবর্তন হয়ে যায়। সে হাসিমুখে ইনারাকে বলে, "নাইস টু মিট ইউ। তুমি আসলে আমার ফ্যান?"
ইনারার গলা দিয়ে শব্দই বের হচ্ছিল না। তার চোখেমুখে খুশির ঝলক উপচে পড়ছে। সে দ্রুত মাথা নাড়ায়। 

সভ্য আড়চোখে তাকায় তাদের দিকে। বিরক্তির সুরে মৃদুস্বরে বলে, "সারাক্ষণ বকবক করতে করতে আমার মাথা ধরিয়ে দেয়, এখন তার মুখ দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না।" 

ইনারা বহু কষ্টে বলে, "আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমার কাছে। আপনি বেস্ট, বেস্ট, একদম বেস্ট। আমার কাছে আপনার সব এলবাম, ফটো এলবাম সব আছে। আমার ফোনের গ্যালারিও আপনার ছবি দিয়ে ভরা দেখবেন?"
ইনারা ফোন বের করতে নেবার সময় জোহান ভালো করে দেখে ইনারাকে। সে হঠাৎ করে বলে, "তোমাকে আমি আগেও কোথায় দেখেছি যেন। কোথায় তা মনে পড়ছে না।"
সামি কনুই মারে জোহানকে, "ভাই ওকে তো ছেড়ে দে। ওর সাথে ফাজলামো করবি না।"
"আমি সিরিয়াস।" 

এমন সময় একটি ছেলে এসে জোহানকে বলে, "মিঃ জোহান আপনাকে বড় স্যার মনে করেছে।"
"আসছি।"
ছেলেটা যাবার পর জোহান ইনারাকে বলল, "তোমার গ্যালারি পরে চেক করবো। সাথে একটা সেল্ফিও তুলে দিব। তুমি তো এখন আমাদের সাথেই আছো।" 
কথাটা জোহান সভ্যকে দেখে বলে। যেন সভ্য বুঝে তারও ভক্তও কোনো দিক থেকে কম নেই। আর মুখের উপর তা প্রদর্শন করাতে অন্যরকম এক আনন্দ পাচ্ছে সে। কিন্তু সভ্যের বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। যেন তার কিছুই আসে যায় না। 

জোহান বের হবার পূর্বে ঐশির সামনে পড়ে। তার ছোট বোন। তাকে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে আগ্রহ সহকারে বলে, "তোর ফেভারিট পারফিউম এনেছি প্যারিস থেকে।"
"আমার এখন আর সে পারফিউম পছন্দের না।"
"তোকে তো বলিনি কোনটা এনেছি।"
"জানার ইচ্ছাও নেই।" 
ঐশি অনেকটা রাগী ভাব দেখিয়ে যেয়ে সভ্যের পাশে বসে। হয়তো জোহানের মনও খারাপ হয় তার এমন ব্যবহারে। কিন্তু সে কিছু না বলেই চলে যায়। 

ইনারা অবাক ভঙ্গিতে সামিকে জিজ্ঞেস করে, "এটা কি রেগুলার ডোস না আজকে বিশেষ দিন?"
"রেগুলার। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার তিনবেলা।"
ইনারা ভ্রু কপালে তুলে বলে, "তাহলে তো ফ্রি এর ড্রামা দেখা যাবে। যাই হোক অসভ্য এত কাজ করায় যে মুভি দেখার সময় পাইনা। এখন লাইভ ড্রামা দেখে বেতনের টাকা অসুল করুম।"
সামি হাসে তার কথায়, "আমি এবং ঐশী তো মাঝেমধ্যে পপকর্ন নিয়ে আসি।"
"আচ্ছা ঐশি আপু জোহানের সাথে এমন ব্যবহার করলো কেন?"

সামি এবং ইনারার কথাপোকথন এর মাঝে সভ্য এসে দাঁড়ায়। ইনারার শেষ কথাটা শুনে ফেলে সে। সে কড়া গলায় বলে, "তোমার এত কিছু জানার প্রয়োজন নেই। নিজের কাছে ধ্যান দেও।"
সে সভ্যের কথায় পাত্তাই দেয় না। উল্টো খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে, "আমার জোহান এসেছে। এখন আমার ধ্যান কেবল তার দিকে থাকবে।"
সে লাফাতে লাফাতে সভ্যের পাশ কেটে যায় সোফার দিকে। আর গুনগুন করতে থাকে। সভ্য বিরক্ত হয়ে যেতে নিলেই ইনারা আবার দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়, "জোহানকে দেখে তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সে পোস্টের ব্যাপারে কি হলো?"
"এত কথা বলতে পারব না। আমার কাজ আছে। তুমি জোহান আসার খুশিতে নেচে বেড়াও।" বলেই সভ্য বিরক্তি নিয়ে চলে গেল।
.
.
জোহান অনুমতি নিয়ে মিঃ হকের কক্ষে প্রবেশ করল । সে ফোনে কথোপকথনে ব্যস্ত থাকায় চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। কল রাখার পর সে জোহানের দিকে তাকায়। কঠিন সুরে বলে, "তোমাকে বলেছিলাম কোথাও যাবার প্রয়োজন নেই। এসব ঘুরাঘুরির শখ থেকে গেলে কীভাবে বেস্ট হতে পারবে? এত বড় এক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।"
জোহান চুপ করে থাকে। সে ভেবেছিলো এই একসাপ্তাহ দূরে থাকার পর তার বাবা সর্বপ্রথম তার খবর জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু তার প্রথম কথোপকথনই হয় এই বিষয়ে। ব্যাপারটা হতাশ করে তাকে। তবুও সে কিছু বলে না। চুপ করে শুনে যায়। 

মিঃ হক আরও বলেন, "সভ্যের উপর এত বড় অপবাদ লাগার পর তোমার কাছে সুযোগ ছিলো ফ্যান-ফলোয়ার বাড়ানোর। কিন্তু না। জনাব তো ঘুরে বেড়াবে। এ দুইদিনে তোমার আলাদাভাবে ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করলে কত ভক্ত বাড়তো তোমার বুঝতে পারছ? এখন তো সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। সভ্য সাইদকে বলে অলরেডি আসল পোস্টটা মিডিয়ার কাছে দিয়ে দিয়েছে। সে আবার জনপ্রিয়। মানুষ তাকে উল্টো সহানুভূতি দেখাচ্ছে। তার ভক্ত আরও বাড়ছে। আর এদিকে আমার ছেলে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। বাহ! ওর থেকে এগিয়ে না থাকতে পারলে কিছু শিখতে তো পারো।" অনেকটা ধমক দিয়ে উঠে সময়। 

কিন্তু জোহান গলার স্বর উঁচু করে না। মৃদুস্বরে উওর দেয়, "আর কোথাও যাব না আব্বু।"
মিঃহক চুপ করে থাকে কিছু সময়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও কঠিন গলায় বলে, "দেখ জোহান, আমি যা করছি কেবল তোমার জন্য করছি। জানো তো?"
"জ্বি।"
"আমি চাই তুমি সব সময় সবার থেকে বেশি এগিয়ে থাকো। তোমার থেকে বেশি কৃতিত্ব অর্জন আর কেউ না করতে পারে। আমি তোমাকে ছোটবেলা থেকে সবচেয়ে ভালো সংগীতশিল্পীর কাছে গান শিখালাম। দেশে, দেশের বাহিরের সব জায়গায়। এরপর তুমি যদি কারও থেকে পিছয়ে থাকো তাহলে আমার কেমন লাগতে পারে? তোমার দলের এক-তৃতীয়াংশ ফ্যানরা সভ্য-ভক্ত। একারণে ওকে আমি বের করতে পারছি না। এর উপর দলের সকল দায়িত্ব ওর উপর। আমি চাই তুমি যেন সবার হৃদয়ে রাজত্ব করো। বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?"
"জ্বি আব্বু।"
"গুড। আচ্ছা দীপার সাথে কেমন কথাবার্তা চলছে তোমার? ও এখনকার নামকরা অভিনেত্রী। তোমাদের দুইজনের সমালোচনা হলে দুইজনেরই লাভ হবে। আর তোমাদের লাভ মানেই আমাদের কোম্পানির লাভ।"
"বের হয়েই ওকে কল দিব।"
"ঠিক আছে এখন যেতে পারো।" 

অতিরিক্ত কোনো কথা না বলে জোহান রওনা দিলো। দরজার কাছে আসতেই থেমে যায় সে। মিঃ হককে জিজ্ঞেস করে, "আব্বু ঐশির সাথে কী তোমার কোনো ঝামেলা হয়েছে? আভাস হলো ওর মন খারাপ।"
"ওর কথা তোমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। মুখের উপর কথা বলছিলো তাই একটু আদব শিখিয়েছে। মেয়েদের মুখের উপর কথা বলার সাহস থাকবে কেন? মেয়েরা থাকবে পুতুলের মতো। তুমি নাচাবে, তারা নাচবে। এমনিতেই ওর জেদ মেনে দলে আসার সুযোগ দিয়েছি তাও বেয়াদবি করতে আসে। তুমি নিজের দিকে খেয়াল করো। কীভাবে নিজের নাম আরও বড় করবে তার চিন্তা করো। ওর কথা ভাবার প্রয়োজন নেই।"
"আচ্ছা।"
জোহান বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।
.
.
দুপুর পর্যন্ত ইনারা জোহানের পিছু ছাড়ে না। জোহানও সভ্যকে দেখানোর জন্য তার সাথে কথা বলে যায়। কিন্তু ইনারাকে তার এতটা পছন্দ হয় না। মেয়েরা হবে মার্জিত এবং শোভন। যেন তাকে এক নজরে দেখেই ভালো লাগে। ইনারা একদম উল্টো। তার কথা বলার ধরণ, ব্যবহার, পোশাক কিছুই মার্জিত নয়। একারণেই তাকে ভালো করে দেখতে মন চায় নি জোহানের। যদিও তাকে কিছুটা চেনা পরিচিত লাগছিলো কিন্তু তাও মনে করতে চাচ্ছে না সে। এমন মেয়ে তার চেনা হবে এই ধারণা করাটাও তার কাছে মন্দ লাগে। 

এমনিতেও সে খারাপ ব্যবহার করতে পারে না ইনারার সাথে। তার একটা প্রতিমা আছে তার ভক্তদের নজরে। সবার সাথে ভালো মতো কথা বলতে হয়। এই ইমেজ সে নষ্ট করতে পারে না। কোনো কিছুতেই না। 

দুপুরে সকলে একসাথে খেতে ক্যান্টিনে যায়। সভ্য তাদের সাথে যায় নি। এ কারণেই ইনারা সর্বপ্রথম তার জন্য খাবার নিয়ে এলো। এসে দেখে সভ্য পিয়ানো বাজাচ্ছে। 
কী মধুর!
বাতাসে যেন মিষ্টি সুর ভেসে উঠে। অকারণে ভালো লাগা সৃষ্টি হয় ইনারার মনের মাঝারে। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে। হাসি নিয়ে সে সভ্যের পাশে যেয়ে দাঁড়ায়, "আপনার জন্য খাবার এনেছি।"
সভ্য একপলকও তার দিকে তাকায় না। জিজ্ঞেস করে, "কেন?"
"কেন মানে? খাবার তো খাওয়ার জন্যই এনে তাইনা? খাবেন।"
বাঁকা হাসে সভ্য। সে দাঁড়িয়ে ইনারার হাতের প্লেটটা পিয়ানোর উপর রাখে। তার দিকে খানিকটা ঝুঁকে আসে। 

ইনারা হতবাক। আকস্মিকভাবে সভ্য তার কাছে এসে পরে। বুঝতে পারো না কেন! সে খানিকটা অপ্রস্তুত থাকে।পিয়ানোর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। পিয়ানোতে হাত রাখে সে। সভ্য যতটা তার দিকে ঝুঁকে আসে সেও ততটা পিছনে ঝুঁকে। সংকোচন সৃষ্টি হয় তার মাঝে। সে লজ্জারুণ দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। 

সভ্য ইনারার দিকে ঝুঁকে তার দু'পাশে হাত রাখে পিয়ানোর উপর। তার আঙুলে আঙুল ছোঁয়া লাগে। খানিকটা শিউরে ওঠে ইনারা। সভ্য তাকে জিজ্ঞেস করে, "সারাক্ষণ জোহান জোহান করার পর আজ যখন জোহান এলো তখন প্রতিঘন্টায় তোমার আমার কথা মনে পরছে কেন? সত্যি বলো তো, জোহানকে ছেড়ে আবার আমার প্রেমে পড়ে যাও নি তো তুমি?" 
.
.
.
চলবে.................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন