ভোরের রোদ - পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!! 

-ভোরপাখি? ঘুমিয়ে গেলি নাকি? তোর জন্য দেখছি আজকে আমার ঘুমটাই মাটি হবে। বলছি ভোর? শুনতে পাচ্ছিস? হলো তোর? বিশ মিনিটের জায়গায়-----।

রোদের আর কথাটা শেষ করা হলো না। এর আগেই রুমের দরজাটা খুলে যেতেই রোদ হা করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট পরীটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভোরের লাজুক মুখটার দিকে তাকিয়ে রোদ যেন ঘোরের মধ্যেই এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে ভোরের মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো। 

-এটা কি সত্যিই আমার ভোরপাখিটা? নাকি অন্য কেউ?

-কেন চিনতে পারছ না?

-পারছি না ই তো। আমার পিচ্চি ভোরটা তো শাড়ি পড়তে পারতো না। কিন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পরীটা তো কি সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে? কি করে মানবো আমি এখন যে এ কোনো মায়াবিনী নয়, আমার ভোর পাখি? বল?

-তুমি তো আগেরবার বলে গেছিলে শাড়ি পড়া শিখে নিতে। তাই তো আমি----।

-তাই বলে আজই তোকে শাড়ি পড়ার কেরামতি দেখাতে হলো? আমি আরো ভাবলাম আজ আমি নিজের হাতে আমার ভোরকে শাড়িতে জড়িয়ে দিবো, তারপর তার লজ্জা রাঙা মুখটায় আদরের রঙে সাজিয়ে তুলবো। আমার সব প্ল্যান তো ভেস্তে দিলি? এবার এই কাজের শাস্তি স্বরূপ কি করা যায় বল তো?

-তুমি না বলেছিলে তুমি শাড়ি পড়াতে।পারো না? আমাকে তো তাই শিখতে বললে---?

-বলেছি তো? তুই শিখে নিতে পারলে আমি পারি না নাকি?

-না মানে------।

-আমার প্ল্যানের চৌদ্দটা বাজানোর শাস্তিও পাবি আজ। তার আগে চল ছাদে যাই। নইলে তোর বড় আব্বু এসে আবার লেকচার দিবে এতো রাতে তোর ঘুমের ডিস্টার্ব করছি বলে----।

-সবাই তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আসবে না।

-পাকামি না করে চল। আর এতো জোরে চেঁচাচ্ছিস কেন? বাড়ির সবাইকে জড়ো করতে চাস নাকি আমার রুমে?

-আমি কি করলাম আবার?

-চুপ! তার বকবকানিই বন্ধ হয় না। বাপ রে! তোর কষ্ট করে হেঁটে যেতে হবে না, আমিই নিয়ে যাচ্ছি আয়।

-রোদ ভাইয়া? কি করছ?

রোদ কথা বলতে বলতে হুট করে ভোরকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিতেই ভোর ভয় পেয়ে হাত পা নাচিয়ে নামার চেষ্টা করলো। রোদ এবারে ভোরের দিকে চোখ লাল করে একবার তাকিয়ে ভোরকে ছেড়ে দেয়ার ভান করতেই ভোর ঘাবড়ে গিয়ে রোদকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। রোদ হেসে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।

-ছাদে পৌঁছানোর আগে এভাবে গলা জড়িয়ে ধরা হাতটার বাঁধন যদি ছাড়িয়ে নিস ভোর, তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি তোকে টুপ করে ফেলে দিবো। তখন আফসোস করিস বসে বসে।

-ওমা! ফেলে দিলে তো আমার কোমড় ভেঙ্গে যাবে! তখন তো তুমিও বলবা আমার দোষ।

-একশ বার বলবো তোর দোষ। যেভাবে জড়িয়ে ধরে আছিস সেভাবেই থাক। ছাড়বি কেন? 

-এই না না না। প্লিজ প্লিজ প্লিজ রোদ ভাইয়া। ফেলে দিও না। আমি ছাড়বো ন। প্রমিস। 

ভোর চোখ বুজে রোদকে অনুনয় বিনয় করতে করতে রোদ দোতলার ছাদটায় পৌঁছে গেছে। ভোরের মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে রোদ হেসে উঠে ভোরকে নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই ভোর আরো জাপটে ধরলো রোদকে। রোদ এবারে শব্দ করেই হেসে ফেললো। ভোরকে নিয়েই বসে পড়লো কিছু একটার। ভোর চোখ বুজে থেকেই ভাবার চেষ্টা করলো। ছাদে তো কিছুই ছিল না। তাহলে বসলো কিসের উপরে! ভোরের ভাবনার মাঝেই রোদ আলতো করে ভোরের কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

-আরে বাবা! এবার তো ছাড়বি নাকি? তখন নিজেকে ছাড়ানোর জন্য লাফালাফি করছিলি, আর এখন নিজেই ছাড়ছিস না। আমি ধরলে এতো নাচানাচি করিস যেন আমি বাঘ না ভাল্লুক, তোকে খেয়ে ফেলবো। আর নিজের বেলায় আমাকে ছাড়তেই চাস না। এসব কি ঠিক বল?

-ছাড়বো না।

-কেন?

-আমার ইচ্ছে।

-তোর ইচ্ছের জন্য কি আমার এতো কষ্টের ডেকোরেশনটা নষ্ট করবো নাকি? তাকা বলছি ভোর?

রোদের কথায় এবারে ভোর কৌতূহলী হয়ে চোখ মেলে তাকালো। ছাদের চারিধারে লাভ শেইপের বেলুন দিয়ে সাজানো দেখে ভোরের হাতটা আপনাআপনিই রোদের গলা থেকে সরে এলো। ভোর অবাক চোখে চারদিকে তাকিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই রোদ ভোরকে টেনে বসিয়ে দিয়ে ভোরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ভোর থতমত খেয়ে রোদের মুখের দিকে তাকালো।

-আরে! এখানেই শুয়ে পড়লে কেন? ছাদে কতো ধূলো বালি? ছি!

-আরে বাবা! ধূলো বালি পেলি কোথায় তুই? বেডিং করা আছে দেখছিস না? এখন চুপ করে বস তো একটু। আমি মন ভরে আমার ছোট্ট লালপরীটাকে দেখি। আর তো কয়টা দিন আছি। তারপর তো আর-----।

-তুমি কোথাও যাবে না। আমি তোমাকে যেতে দিবো না কোথাও। একদম না।

-তোর বড় আব্বু কি বলেছে দুপুরে শুনতে পাস নি? এখন বলে আর কি হবে? আমাকে তো যেতেই হবে ভোর। আর তাতেই তোরা সবাই খুশি হবি--।

-না না না। তুমি কোথাও যাবা না। 

-কেন যাবো না? তোরা কেউই তো চাস না আমি থাকি। তাহলে থাকবো কেন? থাকবোই না আমি---।

-আমি এতো কিছু জানি না। তুমি গেলে আমাকেও নিয়ে যেতে হবে। নইলে নইলে----। নইলে আমি----।

-নইলে কি?

রোদ শোয়া থেকে উঠে বসে ভোরের মুখের দিকে তাকালো। ভোরের কাঁদোকাঁদো মুখটার দিকে তাকিয়ে রোদের বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠলো। রোদ দু হাতে ভোরের মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।

-কি রে? কি হয়েছে ভোর? কাঁদছিস কেন এভাবে? তুই কাঁদলে আমার কতো কষ্ট হয় জানিস না?

-তুমি--তুমি আমাকে রেখে চলে গিয়ে থাকতে পারবে? একটুও কষ্ট হবে না তোমার?

-হুশ! আবার কাঁদে! এই ভোরপাখি? লক্ষীটা কাঁদিস না প্লিজ? এই ভোর? তাকা আমার দিকে?এই রে! কেঁদে কেটে চোখের কাজল ছড়িয়ে কেমন পেত্নীর মতো লাগছে তোকে ভোর। 

-ভালো হয়েছে। লাগুক পেত্নীর মতো--।

-ভোর? বলছি না তাকা আমার দিকে? 

রোদের চোখে চোখ পড়তেই ভোর চোখ বুজে নিয়েছিল। এবারে চোখ মেলে তাকাতেই রোদের চোখের তীক্ষ্ম ব্যথাতুর দৃষ্টিটা ভোরের চোখে পড়তেই ভোর আবার ফুঁপিয়ে উঠলো। এবারে আর ভোরকে কাঁদার সুযোগটা দিলো না রোদ। নিজের ঠোঁটের বাঁধনে ভোরের কাঁপা ঠোঁটটা আটকে নিলো। হুট করে রোদের কাজটায় ভোর চমকে উঠে কান্না ভুলে রোদের শার্টের একটা কোণা খামচে ধরলো। বেশ অনেকক্ষণ পর রোদ সরে এসে ভোরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে চুপ করে বসে রইলো। ভোরও চোখ বুজে একটু আগের রোদের স্পর্শটা মনে করে লজ্জায় লাল হতে লাগলো। একটু পরেই রোদ সরে আসছে বুঝতে পেরে ভোর রোদের হাত টেনে ধরে চোখ মেলে তাকালো। 

-কোথায় যাচ্ছ তুমি? যেও না প্লিজ?

-কোথাও যাচ্ছি না রে পাগলিটা। দু মিনিট চুপ করে বস তো এখানে। আমি এক্ষুণি আসছি। 

-কোথায়-------।

-আরে বাবা! দু মিনিট বস তো---।

-হুম।

রোদ ভোরের সামনে থেকে উঠে সিঁড়ি ঘরের দিকে চলে গেল। কয়েক মিনিট পরেই আবার ফিরে এসে ভোরের পায়ের কাছে বসলো। ভোর ভ্রু কুঁচকে রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো রোদ কি করতে চাইছে।

-পা টা বাড়িয়ে দে দেখি ভোর?

-কেন?

-উফ! ভোর? এতো প্রশ্ন করিস কেন তুই? তোর কিছু করা লাগবে না। যা করার আমিই করছি। 

-আরে! রোদ ভাইয়া---!

রোদ একবার ভোরের দিকে তাকিয়ে আরেকটু এগিয়ে এসে ভোরের পায়ের কাছ থেকে শাড়িটা একটু সরিয়ে দিয়ে এক জোড়া ঝলমলে নুপুর পড়িয়ে দিলো। ভোরের সেদিকে খেয়ালই নেই। ও একমনে রোদকেই দেখছে। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রোদকে দেখতে কোনো মায়ানগরের রাজপুত্রের মতো লাগছে। লোকটার চোখে মুখে ফুটে থাকা বিষণ্ণতাটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে দেখে ভোরের বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠছে। 

-এই যে ভোর ম্যাডাম? কোন দুনিয়ায় হারিয়ে গেলেন? দেখুন তো নূপুর জোড়া পছন্দ হলো কিনা? কি রে? হা করে আমাকে কি দেখছিস? এই ভোর?

-হ্যাঁ? হ্যাঁ বলো রোদ ভাইয়া---।

-কি এতে ভাবছিস? আমি যে এতো যত্ন করে তোর জন্য গিফটটা কিনে আনলাম তার দিকে তোর দেখি খেয়ালই নেই? পছন্দ হয় নি তোর? না হলে দে-- আমি ফিরত দিয়ে দিবো কালকে---।

-আরে না না--। নূপুর জোড়া আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

-কেমন পছন্দ হয়েছে দেখছি তো। 

-আরে?

রোদ মুখ কালো করে সোজা হয়ে বেডিং এর উপরে শুয়ে পড়লো। ভোর কি করবে ভাবতে ভাবতেই রোদ ভোরের একটা হাত ধরে টেনে নিজের বুকের উপরে এনে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। রোদের টানে ভোর সোজা এসে পড়েছে রোদের বুকের উপরে। রোদ ওকে জড়িয়ে ধরতেই ভোর গুটিশুটি হয়ে রোদের বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো। রোদ তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ভোরের চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো। 

-সবাই এতো খারাপ কেন বল তো ভোর? কেউ আমার বউটাকে আমাকে দেয় না কেন? আমার ছোট্ট ভোরটাকে আমার চাই তো এই সামান্য কথাটা ওরা বোঝে না কেন? কেন কেন কেন? কেন বারবার তোর থেকে দূরে পাঠাতে চায় বল তো? না ওরা আমাকে তোর পাশে থাকতে দিচ্ছে, আর না আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো। আমি আজ বড্ড দোটানায় পড়েছি রে ভোর। কি করবো তুই আমাকে বলে দিতে পারিস ভোর?

১০!! 

-যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে
কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে,
আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছো,
আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছো।

যেটুকু রোদ ছিল লুকনো মেঘ
দিয়ে বুনি তোমার শালে ভালবাসা,
আমার আঙ্গুল হাতে কাঁধে তুমি লেগে আছো,
আমার আঙ্গুল হাতে কাঁধে তুমি লেগে আছো।

তোমার নখের ডগায় তীব্র প্রেমের মানে
আমিও গল্প সাজাই তোমার কানে কানে,
তাকিয়ে থাকি হাজার পর্দা ওড়া বিকেল
শহর দুমড়ে মুচড়ে থাকুক অন্যদিকে,
ট্রাফিকের এই ক্যকোফোনি,
আমাদের স্বপ্ন চুষে খায়।

যেভাবে জলদি হাত মেখেছে ভাত
নতুন আলুর খোসা আর এই ভালবাসা,
আমার দেয়াল-ঘড়ি কাঁটায় তুমি লেগে আছো
আমার দেয়াল-ঘড়ি কাঁটায় তুমি লেগে আছো।

যেমন জড়িয়েছিলে ঘুম ঘুম বরফ মাসে
আমিও খুঁজি তোমায় আমার আশেপাশে,
আবার সন্ধ্যে বেলা ফিরে যাওয়া জাহাজ বাঁশি
বুকে পাথর রাখা আর মুখে রাখা হাসি,
যে যার নিজের দেশে,
আমরা স্রোত কুড়োতে যাই।

যেভাবে জলদি হাত মেখেছে ভাত,
নতুন আলুর খোসা আর এই ভালবাসা।
আমার দেয়াল-ঘড়ি কাঁটায় তুমি লেগে আছো
আমার দেয়ালঘড়ি কাঁটায় তুমি লেগে আছো।

যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে
কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে,
আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছো,
আমার আঙুল হাতে কাঁধে তুমি লেগে আছো,
তোমার চোখে ঠোঁটে গালে আমি লেগে আছি
তোমার আঙুল হাতে কাঁধে আমি লেগে আছি।

রোদের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ভোরের কানে রোদের গলার গুনগুন গান ভেসে আসতেই ভোর মুখ তুলে রোদের দিকে অবাক চোখে তাকালো। গান শেষ করেই রোদ ভোরের মুখটা দু হাতে তুলে ধরে ভোরের ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিলো। একটু পরে সরে আসতেই ভোরের বন্ধ করে রাখা চোখের দিকে তাকিয়ে রোদ হেসে ভোরকে শুইয়ে দিয়ে ভোরের মুখের দিকে তাকালো। রোদের উষ্ণ নিঃশ্বাস চোখে মুখে এসে পড়ায় ভোর আরো বেশি লজ্জায় লাল হয়ে চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। রোদ ভোরের ছোট্ট আঙুলগুলো নিজের আঙুলের ভাঁজে আটকে নিয়ে ভোরের কানে আলতো করে একটা চুমো খেয়ে কানের কাছে মুখ নিলো। 

-ওদের সবার চেয়ে বেশি খারাপ কে জানিস ভোর? তুই নিজে। তুই নিজেও আমার কাছে থাকতে চাস না, আমাকে তোর পাশে রাখতেও চাস না। বাকিদের দোষ দিয়ে আর কি হবে? মাঝে মাঝে তো মনে হয় ওরা সবাই মিলে তোর ইচ্ছেটাই পূরণ করতে চাইছে----।

রোদ কথাগুলো বলতে বলতে ভোরের গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে দুষ্টুমিতে মেতেছে। আর ভোরের কানে এখনো রোদের বলা কথাগুলো বাজছে। রোদের আদুরে ছোঁয়াও আজ ভোরের ঘোর কাটাতে পারছে না। ভোরের কোনো রেসপন্স করছে না দেখে রোদ মুখ তুলে ভোরের মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটা একমনে কি এতো ভাবছে যে রোদের ভালোবাসাটাকেও পাত্তাই দিচ্ছে। রোদ কয়েক সেকেন্ড ভোরের ভাবুক মুখটা দেখে এবারে ভোরের গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে আলতো করে কামড় বসালো। ভোর এবারে চমকে উঠে রোদকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। 

-দেখেছিস ভোরপাখি? তুই সত্যিই আমাকে ভালোবাসিস না তার প্রমাণ? আমি এতো করে তোকে ভালোবাসতে চাইছি, আর তুই কিনা কোনো দুনিয়ায় হারালি! আমাকে আর সহ্য হচ্ছে না তো তোর? ঠিক আছে। আমি কালই চলে যাবো। তোকেও আর জ্বালাবো না দেখিস---।

-কি বলছ এসব?

-কিছু বলছি না। রুমে যা এখন। অনেক রাত হলো। ঘুমিয়ে পড়। তোর না আবার মডেল টেস্ট শুরু হবে কাল পরশু থেকে?

-তুমি এভাবে বলছ কেন? আমি কি করেছি?

রোদ একটু রাগ করে ভোরের উপর থেকে সরে এসে চুপচাপ বসে রইলো বেডিংটার উপরে। ভোর কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করে শুয়ে থেকেই রোদের শার্টের পিছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা করলো। রোদ ভোরের দিকে না ফিরেই বিরক্ত হয়ে ভোরের হাতটা সরিয়ে নিলো।

-তোকে না রুমে যেতে বলেছি ভোর? কত রাত হয়েছে সে খেয়াল আছে তোর? রাতে দেরি করে ঘুমাস বলেই তো সকালে উঠতে পারিস না। কাল অন্তত একটু তাড়াতাড়ি উঠিস। যাতে যাওয়ার আগে তোর মুখটা দেখে যেতে পারি। 

-তুমি থাকো সেটা আমি চাই না-এ কথা কেন বললে তুমি? 

-কেন বলেছি সেটা তোর বড় আব্বুকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। আমাকে বিরক্ত করিস না তো এখন। 

-চলে যাবো?

-তুই কি আজকাল কানেও শুনতে পাস না ভোর? বলছি তো রুমে যা এখন। গিয়ে ঘুমা। আর দরজাটা ভালো করে লক করে তারপর------।

-তুমিও ঘুমাবে চলো?

-আমার কথা কেউ তোকে ভাবতে বলেছে? নিজের কাজ কর তো যা। যত্তসব!

-রোদ ভাইয়া! তুমি এতো রেগে যাচ্ছো কেন? আমি তো তোমাকে----।

-জাস্ট গেট আউট ভোর। তুই এক্ষুণি আমার সামনের থেকে যা। এক্ষুণি মানে এক্ষুণি----।

-যাবো না।

-কি বললি?

-তুমিও কি কানে কম শোনো নাকি রোদ ভাইয়া? আমি বলছি আমি যাবো না যাবো না যাবো না। হুহ। 

-ভোর? তোকে তো আমি-----।

রোদ রেগে গিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে ভোরের দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেল। ভোর একদম সোজা হয়ে বেডিং এর উপরে গা এলিয়ে দিয়েছে। ছাদের আধো বাতাস একটু পর পর এসে ঝাপটা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ভোরের পড়নের জর্জেটের টুকটুকে রাঙা শাড়িটা। আবছা আলো আঁধারিতে ভোরের ফর্সা পেট আর নাভির দিকে না চাইতেও চোখ চলে যাচ্ছে রোদের। রোদ চোখ বুজে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো বেশ কিছুক্ষণ। কাজটাশ কতোটুকু সফল হবে সেটা রোদ নিজেও জানে না। তাই সাহস করে চোখ মেলে তাকাতে চাইছে রোদ। অবশ্য চোখ জোড়া এই বন্দীত্ব স্বীকার করতে চাইছে না। চোখ জোড়া যেন আজ পণ করেছে রোদের সমস্ত সংযম ভেঙ্গে দিয়ে আজ তারা তাকাবে, ভোরকে দেখবে। মাথায় আরো কিছু ঘুরপাক খাওয়া শুরু হওয়ার আগে রোদ একটা বড় করে নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার শেষ চেষ্টা করলো।

-ভোর? এখনো শুয়ে আছিস কেন? রুমে যেতে বললাম না তোকে?

-যাবো কেন? আমি কি নিজে নিজে এসে যে তোমার কথা শুনেই চলে যাবো? হুহ। যাবো না আমি। কেউ যেভাবে এনেছে সেভাবেই যেন আমাকে রুমে দিয়ে আসে। আমি এতো হাঁটতে পারবো না। 

-ভোর?

-শশশশশ। আস্তে রোদ ভাইয়া। বাড়ি মাথায় তুলছ কেন? সবাই এসে পড়বে না?

-আমার কথা এখন আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছিস, আবার ফোঁড়ন কাটছিস কথার মাঝে। খুব সাহস হয়েছে না তোর?

-হুম। হয়েছে। তুমি বকেছ আমাকে। তোমার সাথে কথা নেই যাও।

-ভোর?

-----------------------------------------

-এই ভোরপাখি? রুমে যা না বাবা? ঘুম পাচ্ছে তো ভিষণ। 

-তোমার ঘুম পেলে তুমি যাও। আমি কি ধরে রেখেছি তোমাকে?

-তুই ছাদে একা একা কি করবি?

-যা ইচ্ছে হয় করবো। ইচ্ছে হলে নাচবো, হাসবো, কাঁদবো। তোমার কি তাতে?

-ভোর সোনা? রাগ করেছিস বউটা?

ভোর এবারও কথার জবাব দিচ্ছে না দেখে রোদ চোখ মেলে ভোরের মুখের দিকে তাকালো। ভোর ঢোক গিলে কান্না আটকাতে চাইছে সেটা খেয়াল হতেই রোদ সোজা ভোরের গায়েই নিজেকে এলিয়ে দিলো। ভোরের ছোট্ট শরীরটা রোদের নিচে চাপা পড়তেই ভোর ধড়ফড় করে রোদকে সরানোর চেষ্টা করলো নিজের উপর থেকে। কিন্তু বাচ্চা একটা মেয়ে কি আর রোদের শক্ত বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারে কখনো? ভোর এবারে হার মেনে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই রোদ শক্ত হাতে ভোরের মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। 

-ভোর সোনামনিটা রাগ করেছে বুঝি? 

-তোমার নাকি খুব ঘুম পেয়েছে? তাহলে রুমে না গিয়ে আমার উপরেই শুয়ে পড়লে কেন? যাও নিজের রুমে----।

-বউটাকে এখানে একা ফেলে যাই কি করে?

-আমি কারো বউ টউ না। হুহ।

-ঠিক তো? পরে আবার বলিস না আমি এসব বলি নি---।

-----------------------------------------

-এই ভোর পাখি? শোন---। শোনো না গো পাখি? তাকাও আমার দিকে? এমন করে রাগ করে কেউ? হুম? তুমি রাগ করে দূরে সরে গেলে কত কষ্ট হয় তোমার রোদের জানো না?

এই প্রথমবার রোদের মুখে 'তুমি' শব্দটা শুনে ভোর কি বলবে সেটাই ভুলে গেল। রোদ ভোরের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিচু হয়ে ভোরের ঠোঁটে ছোট্ট করে একটা কামড় বসালো। 

-তোমার চোখে ঠোঁটে গালে আমি লেগে আছি
তোমার আঙুল হাতে কাঁধে আমি লেগে আছি।

-রোদ----।

-আজকের জন্য অন্তত ভাইয়া শব্দটা বাদ দে। প্লিজ?

ভোর কিছু বলার আগে রোদ আবার উষ্ণ ঠোঁট জোড়া ভোরের গলায় আলতো করে ঠোঁট বুলিয়ে দুষ্টুমি শুরু করেছে। এক হাতে ভোরকে নিজের সাথে আকঁড়ে ধরে অন্য হাতটা ভোরের কোমড় ছাড়িয়ে উপরের দিকে উঠতেই ভোর রোদ কেঁপে উঠে রোদের হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো। রোদ এতোক্ষণে আবার মুখ তুলে ভোরের কাঁপাকাঁপা ঠোঁট জোড়ার দিকে ঠোঁট এগিয়ে নিতেই ভোর চোখ বুজে ফেললো শক্ত করে। 

-আমার ভয় করছে রোদ। 

এই একটা কথা রোদের থেমে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। রোদ নিজেকে সামলে নিয়ে ভোরের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে ভোরকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বেডিংটায় গা এলিয়ে দিলো। ভোর তখনো আলতো করে কাঁপছে বুঝতে পেরে রোদ ভোরকে একেবারে নিজের বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরলো। 

-ভয় নেই ভোর পাখি। আমি বেঁচে থাকতে কেউ তোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। স্বয়ং তোর রোদও নয়। ভয় পাস না পাখিটা।

-ভয় পাচ্ছি না।

-গুড। এখন চল তোকে রুমে দিয়ে আসি। সত্যই অনেক রাত হয়ে গেছে রে। সকালে তো বের হতে হবে আমার---।

-তুমি কোথাও যাবে না। কাল না, এক সপ্তাহ পর না। কখনো না। আমি বড় আব্বুকে বলবো তোমার যাওয়া চলবে না।।

-হুম আর?

-আর? তুমি চলে গেলে আমি খাবো না, ঘুমাবো না, পরীক্ষাও দিবো না। মরে যাবো।

-ভোর?

-ধমকাবে না একদম। আমি মানা করছি, তবু যদি তুমি যাও--তাহলে আমি সত্যি সত্যি বিষ খাবো। দেখে নিও। 

-কেন? আমি কে তোর যে আমার যাওয়ায় তোর এতো কষ্ট হবে? এতো কষ্ট হবে আমাকে ছেড়ে থাকতে যে মরে যাবি? কে বল?

-জানি না।

-তাহলে আমিও যাবোই। তাছাড়া তুই দেরি করে ফেলেছিস ভোর। তোর বড় আব্বু এখন আর তোর কোনো কথাও শুনবে না। উল্টো বলবে আমিই তোকে শিখিয়ে দিয়েছি।

-তবু আমি বলবো। নইলে আমিও যাবো তোমার সাথে---। তুমি না নিলে আমি বাড়ি থেকেই পালিয়ে যাবো। বিবাগী হয়ে যাবো। জঙ্গলে জঙ্গলে পাগল হয়ে ঘুরবো।

-তোর ঘুম পাচ্ছে ভোর। 

-হুম। চোখ মেলতে পারছি না। ঘুমে টানছে চোখ জোড়া।

-চল? রুমে যাই তাহলে?

-না। তুমি চলে যাবা সকালে। আমি ঘুমাবো না----।

-না রে পাখিটা। তোর ঘুম আদুরী মুখটা না দেখে কি করে যাই বল তো? তুই লক্ষী হয়ে ঘুমা। তুই জাগার আগে রুম থেকে এক পা ও বাইরে যাবো না, প্রমিস। এবার তো চল?

-হুম।

-আরে বাবা। চল? ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না। আর সে নাকি জেগে বসে থাকবে। আর এই? তোর ঘুমুঘুমু মুখটা দেখে বুকের মধ্যে কি চলছে বুঝিস না কেন? এখন আর বকবক না করে চল।

-কোলে?

-হ্যাঁ রে বাচ্চাটা। কোলে নিচ্ছি তো। আগে তো উঠ?

-হুম----।

রোদ ভোরকে বেডিং থেকে তুলে নিয়ে রুমের পা বাড়াতেই টের পেল ভোর রোদের বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। রোদ ধীর পায়ে ভোরকে রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিল। রোদ কয়েক মিনিট ভোরের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো করে ভোরের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েই রোদও নিজের মনেই পরের দিন কি হবে ভাবতে ভাবতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন