অস্তিত্বে তুমি - পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!! 

-কত বেলা হয়ে গেল, অথচ মেয়েটার ওঠার নাম গন্ধও নেই? এই নিহারররররর? আর কতো ঘুমাবে আজকে কে জানে? এই নিহার? দেখো দশটা বেজে গেছে। নিহাররররররররররর।

কানের কাছে আবরারের জোর গলায় নাম ধরে ডাকার শব্দে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো নিহার। আবরার ভ্রু কুঁচকে নিহারের সদ্য ভাঙা ঘুমজড়ানো চোখ মুখের দিলে তাকিয়ে আছে দেখে নিহার একটু বিব্রতই হলো। এতো ঘুম পাচ্ছে যে চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না বেচারি। প্রচন্ড ঘুমে চোখ বুজে আসছে এমন সময় আবরারের হাতের স্পর্শে কেঁপে চোখ মেলে তাকালো নিহার। আবরার বিছানায় শুয়ে থেকেই হাত বাড়িয়ে নিহারের ঘাড়টা টেনে নিজের বুকের উপরে নিহারের মাথাটা টেনে নিয়েছে। নিহার থতমত খেয়ে আবরারের বুকে থুতনি ঠেকিয় ঢলুমলু চোখে ঘুম কাটানোর জন্য চোখ ডলছে। ঘুম তো কাটছেই না, উল্টো আবরারের শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ আর উষ্ণতায় আরো ঘুমঘুম পাচ্ছে মেয়েটার।

-এই যে মিসেস খন্দকার? এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমালে হবে? দশটা বাজতে চললো। আজ কারো ব্রেকফাস্ট করা লাগবে না নাকি ম্যাডাম? কাল রাতে না নীলা কি করছে দেখার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিলে? আজ দেখে বিছানা ছেড়ে উঠতেই চাইছ না? ব্যাপারটা কি ম্যাডাম?

-কি! দশটা বাজে! হায় আল্লাহ! কি বলছ! এতো বেলা পর্যন্ত শুয়ে আছি! ছি ছি ছি! তুমি আরেকটু আগে ডাকবে না? ধ্যাত! সবাই কি ভাববে এবার? হায় আল্লাহ!

-আরে বাবা! আমি তো সেই কখন থেকে ডাকছি, তুমিই তো উঠছ না? এখন আমার দোষ দিচ্ছ? এসব কি ঠিক বলো তো?

-তোমার দোষ দিচ্ছি না। সরি--আসলে এতো বেলা হয়ে গেছে তাই----। আমি ফ্রেশ হয়ে ৫ মিনিটের মধ্যেই নিচে যাচ্ছি----। ইশ! সবাই কি ভাববে?

-আরে আস্তে! এতো তাড়াহুড়ো করছ কেন? ঠিক আছে তো? একদিন দেরি হতেই পারে। আর বাবা তো ডেইলি এক কাপ চা খেয়েই চলে যায়। কাজের লোকেরা সেটার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। তুমি এতো হুটোপুটি করো না তো। টেনশন করতে গিয়ে নিজেই ব্যথা ট্যথা পাবা পরে।

-না না। আমি ঠিক আছি। তুমিও তো অফিস যাবে? আমি ফ্রেশ হয়ে নিই। তারপর তুমি যেও----। অলরেডি অনেক বেলা হয়ে গেছে----। দশটার বেশিই বোধহয় বাজে! ওয়েট-----। দশটা কোথায়? সাড়ে সাতটা বাজে! আবরার! তোমাকে আমি?

নিহার কথাটায় শেষ করতে পারলো না। এর আগেই আবরার একহাতে নিহারের কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে নিহারের মুখটা অল্প করে তুলে ধরে ঠোঁটে ঠোট ডুবিয় দিয়েছে। নিহার একবার কেঁপে উঠে চোখ বুজে নিয়েছিল। আবরার ইচ্ছে করে ওকে বোকা বানিয়েছে কথাটা মাথায় আসতেই এবারে আবরারের ঠোঁটেও জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। আবরার বেচারা হঠাৎ করে নিহারের এমন কাজে থতমত খেয়েই সরে এসেছে। পরমূহুর্তেই নিহার বিছানা থেকে নেমে পালানোর।আগেই আবরারের দু হাতের উষ্ণ বাঁধনে আবার আটকা পড়তে হলো নিহারকে। 

-এটা কি হলো নিহার? আমি কতো সফটলি তাকে আদর করছি, আর ম্যাডাম আমার আবেগে ছাই ঢেলে দিলেন, এটা কিছু হলো?

-মিথ্যে বলে আমাকে ভয় দেখানোর শাস্তি। হুহ। বলে কিনা দশটা বাজে! যতবার মিথ্যে বলবে ততবার শাস্তি পাবে এমন।

-ইশ! এতো আদুরে শাস্তি পেতে হলে তো প্রতিদিন ভোরে এমন দু চারটা মিথ্যে বলাই যায়, কি বলো জান?

-হুম বলো। আমার কি। এর পর থেকে শাস্তিটা এমন হবে যে কারো সামনে যেতেও পারবে না, এমন দশা করবো। তখন বুঝবে বউয়ের শাস্তিগুলো কেমন আদুরে হয়।

-তাই নাকি? তাহলে তো শাস্তির প্রতিদানে তোমার কিছু আদরও পাওনা তোমার। সেগুলোও শোধবোধ করে দিই কি বলো? যত গভীর শাস্তি, তত নিবিড় আদর। ডিল ডান? তাহলে আজকের আদরটা নিয়ে নাও?

-একদম ভালো হবে না আবরার। সরো? তুমি ঘুমাও। তোমার তো অফিসে যেতে দেরি আছে। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করে ডাকবো তোমাকে। ছাড়ো না?

-আজকে কাজের লোকেরা ব্রেকফাস্টটা রেডি করুক না বউ? তুমি আমার বুকেই থাকো। আমি লক্ষী ছেলের মতো ঘুমাবো। একদম জ্বালাবো না এখন আর, প্রমিস।

-ইশ রে! কি ভালো হাজবেন্ড আমার! এভাবে মিষ্টি করে বললে না করি কি করে বলো তো?

-না করবে কেন? তুমিও লক্ষী মেয়ের মতো আমার বুকে থাকো কেমন? এই নিহার? জানো আমার টিশার্টটায় তোমাকে কত্তো সুইট লাগছে দেখতে! ইশ! এতো মিষ্টি লাগছে কেন তোমাকে আজ বলো তো?

-এই? একদম দুষ্টুমি না বলে দিলাম। চুপচাপ ঘুমাও। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবো। তুমি চুপ করে ঘুমিয়ে থাকো।

-এটা কি হলো? বললাম না আজকে তোমার ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে না।

-খালাকে কি নাস্তা বানাতে হবে না বললে উনি কি নাস্তা রেডি করবেন? আর নীলাকেও তো ওষুধ খাওয়াতে হবে নাকি? বাবাও তো চলে যাবে অফিসে। সো মিস্টার? আমি গেলাম।

-আরে নিহার! এটা কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না। আমি রুমে ঘুমাবে আর তুমি থাকবে কিচেনে? নো ওয়ে। মানি না আমি।

-তাহলে তোমার আর ঘুমাতেও হবে না। আমি কিচেনে গেলাম। তুমিও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি কাজ করবো, আর তুমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখবে। সুযোগ পেলে হুটহাট এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাবে। বা হুট করে এসে আদর দিয়ে পালাবে। 

-সিরিয়াসলি? আমি কিন্তু সত্যি জ্বালাবো ম্যাডাম।।বারণ করলেও শুনবো না এবারে।

-ধ্যাত। আমি তো এমনি বললাম। ঘুমাও তো তুমি।

নিহার কোনোমতে লজ্জায় লাল হয়ে আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। আর আবরার হেসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবছে, এমন আরো কত না বলা আবদার জমা পড়ে আছে মেয়েটার কে জানে! 

দেখতে দেখতে আরো পাঁচ ছয়টা দিন কেটে গেছে এভাবে। নীলার পায়ের কাটা মোটামুটি ভালো হয়ে এসেছে। ব্যথাও নেই বললেই চলে। প্রায় প্রতিদিনই রাতে জিহানের উপস্থিতি টের পেলেও সকালে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না নীলার কাছে। রুমটা প্রতিদিনই ভিতর থেকেই লক করা থাকে, তাহলে জিহান আসার ব্যাপারটা যে ওর কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয় এটাই ভাবে নীলা। এতোগুলো দিন যে যোগাযোগ নেই সেটা আধো জিহানের খেয়াল আছে কিনা এসব ভেবেই নিজের রুমের কোণে বসে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই নীলার। 

এতোগুলো দিন পর আজ দুপুরে সবাই একসাথে বসে লাঞ্চ করেছে নীলারা। অন্য সময় নিহার আর আবরার থাকলেও আজ বাবাও যোগ দেয়ায় দারুণ লাগছে নীলার। কিন্তু বাবার সাথে ওই পি. এ শিহাব নামের ছেলেটাও আছে দেখে একটু বিরক্তই লাগছে নীলার। অফিসের লোকেরা বাসায় কেন আসবে? আবার ফ্যামেলি টাইমে কেনইবা একসাথে লাঞ্চ বা ডিনারে এটেন্ড করবে? এতোই জরুরি কাজ হলে নীলা নাহয় পরেই খেতে আসতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নীলা কোনোমতে ভাতগুলো খাওয়া শেষ করেছে। খাওয়ার পরে সবার সাথে ড্রইংরুমে ছোটোখাটো মিটিংয়ের মতো একটা আয়োজন দেখে নীলা একটু অবাকই হলো। আফসান খন্দকার মেয়ের কৌতূহলী দৃষ্টি খেয়াল করেই একটা বড়, মোটা প্যাকেট এগিয় দিল নীলার দিকে। নীলা ভ্রু কুঁচকে প্যাকেটটা নিতে নিতে বাবার দিকে তাকালো।

-এটা কি পাপা? চকলেটস? সেরকম তো মনে হচ্ছে না। কি আছে পাপা?

-নিজেই প্যাকেটটা খুলে দেখো মা। আই হোপ ইউ উইল লাইক ইট। 

-আই হোপ সো। আরে? এগুলো তো বিয়ের কার্ড! এতোগুলো ইনভিটেশন কার্ড! কার বিয়ের ইনভিটেশন কার্ড পাপা? রিলেটিভ কেউ আমাদের? 

-নিজেই দেখে নাও।

-ওকে। বাট পাপা। আমি কারো বিয়েতে পারবো না। 

-আগে তো পাত্র পাত্রীর নামগুলো চেক করো।

-ওকে ওকে। ওয়েট এ সেকেন্ড----। হোয়াট!

সুন্দর ডিজাইন করা ইনভিটেশন কার্ডটা দারুণ পছন্দ হয়েছে নীলার। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে কার্ডের উপরের পালকিতে করে বউ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা কেন জানি একদম হৃদয়ে গেঁথে গেছে নীলার। আফসান খন্দকারের কথায় বর আর কনের পরিচিতির অংশে চোখ পড়তেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার দশা হলো নীলার। হাতে ধরা প্যাকেট ভর্তি সবগুলো কার্ডই মাটিতে পড়ে গেল নীলার হাত থেকে। ফ্লোরে পড়ে থাকা কার্ডগুলোর দিকে তাকিয়েই ধড়ফড় করে নিজের সোফা থেকে ছিটকে কয়েক পা দূরে সরে এলো নীলা। এটা কি করে সম্ভব! যা দেখছে তা কখনো সত্যি হতেই পারে না। কিছুতেই না। 

১০!! 

-হোয়াদ্দা হেল ইজ দিস পাপা? এখানে কার্ডে আমার আর শিহাব! শিহাবের! শিহাবের নাম কেন? আর আমি তো বলেছি আমি বিয়ে করবো না। হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? আমি বিয়ে করবো না, করবো না, করবো না। আর এই লোকটা! আপনি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছেন? জাস্ট গেট আউট, গেট আউট, গেট আউট।

হাতে ধরা কার্ডগুলো ফ্লোরে পড়ে বিক্ষিপ্তভাবে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়তেই নীলাও নিজের সোফা থেকে ছিটকে পিছিয়ে আসলো। আবরার আর নিহার এগিয়ে এসে কার্ডে কার নাম লেখা আছে দেখার চেষ্টা করতেই নীলা সোফা ছেড়ে আফসান খন্দকারের সামনে এসে দাঁড়ালো। বিয়ের কার্ডে নিজের নামের পাশে শিহাবের নাম কেন সেটা নিয়ে যতটা না প্রশ্ন নীলার তারচেয়েও বেশি বোধ হয় রাগ জমা হয়েছে শিহাবকে আফসান সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আফসান খন্দকার এগিয়ে এসে নীলার মাথায় হাত রাখতেই নীলা কোনোমতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাবার দিকে ফিরলো। 

-নীলামা? পাপার কথাটা আগে শোনো একবার। তারপর তুমি যা ঠিক মনে করবে তাই হবে। 

-পাপা প্লিজ? আমি এই মূহুর্তে কিছু বলার বা শোনার মতো অবস্থাতেই নেই। যাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি, তাকে তুমি বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছ। তোমার বিজনেসের এন্টিপার্টি লোকটা, তবু একটাও কথা বলো নি শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ওই লোকটা ধোঁকা দিয়েছে শেষ পর্যন্ত। এটা তো তোমার দোষ নয় পাপা। আর এমনও না যে আমি ওই লোকটাকে ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো না। নো। আমি ওইলোকটাকে চিরদিনের জন্য নিজের জীবন থেকে, নিজের ব্রেইন থেকে, শরীরের প্রত্যেকটা লোপকূপ থেকেও মুছে ফেলবো। ইয়েস আই উইল। বাট আই নিড সাম টাইম মামা। প্লিজ?

-নীলামা। আমি তোমার কথাটা বুঝতে পারছি। জিহান ছেলেটা কত জেদী তার কোনো ধারণাই নেই মা তোমার। আমাদের বিজনেস বরবাদ করতে ও ইচ্ছে করেই তোমার সাথে ভালোবাসার এই নাটকটা করেছে। আর শেষ মূহুর্তে এসে নিজেই তোমার সামনে এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করেছে যাতে তুমি নিজেই বিয়েটা থেকে পিছিয়ে আসো। ওর প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইগো স্যাটিসফাইড হয় নি। হয়তো ভেবেছিল সবার অপমানের ভয়ে আমরা ওর হাতে পায়ে ধরবো যেন জিহান তোমাকে বিয়ে করে। গত কয়টা দিন নানা মানুষের নানা অপমান, প্ররচনা শোনার পরও আমরা যখন ওর বা ওর মামার কাছে মাথানত করিনি, তখন ওরা নতুন প্ল্যান করছে মা। আবার নতুন নাটক করে তোমার লাইফে ফিরতে চায় ওই জিহান চৌধূরী। 

-কক্খনো না পাপা। এইটুকু ভরসা নেই তোমাদের আমার উপরে? আমি বলছি তো পাপা। আমার লাইফে ওই লোকটার আর কোনো জায়গা নেই। 

-আমাদের একজন স্পাই আছে ওদের অফিসে। সে খবর দিলো ওরা ফেইক ম্যারেজ সার্টিফিকেট, ফেইক বিয়ের ফটো, সাক্ষী এরেঞ্জ করছে যাতে সোসাইটিতে আমরা মুখ দেখাতে না পারি। নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে তোমাকে বিয়ে করতে বলছি এমনটা ভেবো না মা। আমি বা তোমার ভাইয়া, কেউই চাই না জিহান আমাদের সাথে বিজনেস কম্পিটিশনের শত্রুতার জের ধরে তোমার জীবনটা নষ্ট করুক। 

-পাপা? প্লিজ? ওই লোকটার ভয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবো? জীবনটা কি ছেলেখেলা নাকি? একজন ধোঁকা দিল বলে অন্য কাউকে তার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে জীবনে জায়গা দিবো? তাও আবার এই লোকটাকে? যাকে চিনি না, জানি না, যার আবেগশূন্য মুখটা দেখলেই আমার কেমন জানি অস্বস্তি লাগে, মনে হয় কিসের এক রহস্য নিয়ে ঘুরছে লোকটা, তাকে বিয়ে করবো? নো ওয়ে পাপা।

-নীলা? শিহাব আমাদের অফিসে জব করছে ছয় সাত বছর হয়ে গেছে মা। ছেলেটার বাবা মা কেউ নেই। ছোটোবেলা থেকে দাদা দাদীর কাছে মানুষ। এখন উনারাও আর নেই। অফিসে কেউ আজ পর্যন্ত একটা কমপ্লেইনও করে নি। 

-পাপা?

নীলা আরো কিছু বলার আগেই শিহাব নিজেই এগিয়ে এসে আফসান খন্দকারের পাশে এসে দাঁড়ালো এবার। 

-স্যার ম্যামকে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে প্রেশার ক্রিয়েট করবেন না প্লিজ। আপনি আমার সাথে প্রবলেমটা শেয়ার করে আমাকে ম্যামকে বিয়ে করতে অর্ডার করলেন, আমিও মেনো নিলাম। বাট ম্যাডাম জানেনই না সিচুয়েশনটা কোনদিকে টার্ন করছে। জিহান আর উনার মামা আমাদের বিরুদ্ধে কত বড় ষড়যন্ত্র করছে সেটা ম্যাম জানেনই না বা জানলেও বিশ্বাসও করবেন না। তাই প্লিজ স্যার, ম্যাম না চাইলে উনাকে জোর করবেন না। আমি এতো বছর এই কোম্পানিতে জব করছি বাকি বছরগুলোও করবো। আজীবন আপনার অর্ডার মেনে নিবো। বাট ম্যামকে প্লিজ জোর করবেন না। 

নীলা কিছু বলার আগেই আফসান খন্দকার শিহাবের কাঁধে হাত রেখে নীলার দিকে তাকালো।

-নীলামা শিহাবকে বিয়ে করলে তোমাকে আমাদের চোখের আড়ালে যাওয়ার ভয়টা আর হবে না। জিহানের আর ওর মামার আসল রূপটা কতো ভয়াবহ সেটা নিজের চোখে দেখলেও হয়তো তুমি মানতে পারবে না। ওই লোকটা আবার নতুন করে তোমার জীবনে আসার ভয়টা আমি নিজের মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারি না এক সেকেন্ডের জন্যেও। পাপার এই ছোট্টো আবদারটা, এই প্রথম আর শেষ বারের মতো পাপার কথাটা মেনে নাও প্লিজ?

-পাপা!?

-এর বেশি আমার কিছু বলার নেই নীলামা। ওই ছেলে তোমার লাইফে আবার ফিরে আসার আগে ব্যাপারটা এখানেই শেষ করতে চাই। এবার তুমি নিজেই ঠিক করো কার্ডগুলো পরিচিত কয়জনের সাথে শেয়ার করবো কি না।

-তোমার যা ভালো মনে হয় করে দাও পাপা। 

-নীলা?

নীলা একছুটে ড্রইংরুম থেকে নীলার রুমে এসে বিছানায় মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয় উঠলো। নিজের পরিবারের সম্মানের কথাটা ভাববে নাকি জিহানের কথা সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না নীলা। নীলা রুমে যাওয়ার পরপরই আবরার আর নিহারও নীলার রুমে চলে এসেছে। নিহার নীলার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত ছুঁইয়ে দিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। পুরো ব্যাপারটা আবরারের নিজেরও মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বাবা কি মনে করে শিহাবের সাথে নীলার বিয়ে ফিক্সজড করলো, বিয়ের ডেইট ফিক্সজড করলো কিছুই বুঝতে পারছে না আবরার নিজেও।

-তোমরা সবাই মিলে কি শুরু করেছ বলো তো আবরার? একবার জিহান, একবার তুমি, একবার বাবা, যে যার ইচ্ছেমতো নিজের ডিসিশান এই ছোট্টো মেয়েটার উপরে চাপিয়ে দিচ্ছ। কেন? জিহান ভাইয়া নিজের সাফাইয়ে কিছু বলছে না, তুমি কি করেছ সেটা তুমি নিজেও ভালো করে জানো। আর এবার বাবা? উনি আর যার সাথে ইচ্ছে বিয়ে ফিক্সজড করতো, বাট ওই শিহাব! ওই লোকটাই যত ভেজালের মূল কারণ। 

-নিহার? রিল্যাক্স। আমি বাবার সাথে কথা বলছি। শিহাব ছেলেটা ভালোই বাট এভাবে হুট করে এভাবে বিয়ের ডিসিশান নিয়ে ফেললো বাবা। 

-আহা! ওই ছেলের হয়ে এবার তুমি ওকালতি করা শুরু করে দাও। আমাদের বিয়ের সময় থেকে উনি আপনাদের কোম্পানিতে জব করছে বলে এর মানে এই নয় যে লোকটা একেবারে ফেরেশতা। আপনি, বাবা, কোম্পানির সবাই যে হারে ওই লোকের ওকালতি করছেন তাতে ওই লোকের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা দরকার। 

-হোয়াট? এতোগুলো বছর ওর খারাপ কিছু দেখলাম না। আর আমি বুঝি না তুমি শিহাবকে সহ্য করতে পারো না কেন।

-সহ্য করতে পারি না কজ ওই লোকটাই সব ঝামেলার জড়। এখন পর্যন্ত জিহান ভাইয়া এই করেছে, সেই করেছে, এটা ষড়যন্ত্র করছে, ওখানে লোক লাগাচ্ছে সব কিছু তোমার শিহাবই খবর দেয়। জিহান ভাইয়াকে তোমাদের ভুল বোঝানোর পিছনের কলকাঠি নাড়ছেই ওই লোকটা। একদিন আমার কথা মিলিয়ে নিও তুমি।

-নিহার? সবাই মিলে আমাকে এতো কনফিউজড করছ কেন? আহহহহ! জিহানের ফ্যামেলি কি করেছে সেটা তুমি মানো বা না মানো সিচুয়েশন চেইঞ্জ হবে না। শিহাব, এতো বছর ধরে বিশ্বাসী কর্মচারী হয়ে ছিল। নীলাকে বিয়ে করতে রাজি হওয়ার পিছনে ওর নিজের কোনো স্বার্থ আছে কি না সেটাও জানতে হবে আমাকে। বাকিটা তারপর ভেবে দেখা যাবে।

-আবরার? 

-তুমি নীলাকে দেখো। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। কে এই নাটকটার পিছনে আছে আমাকে জানতেই হবে।

-হুম।

আবরার কথাগুলো বলে নীলার রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই নীলা নিহারের কোলে মুখ ডুবিয়ে বাচ্চাদের মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে দেখে নিহারও নীলাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। 

-কেন বলো তো ভাবি? কেন এতোদিন ভালোবাসার মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ে রাখার নাটক করে মাঝ রাস্তায় আমাকে ছেড়ে চলে গেল উনি? কখনো ফিরে এসে আমাকে নিজের দুই বাহুর বাঁধনে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে চায়, কখনো আমার পরিবারটাকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে চায়। কেন কেন কেন? কোনটা তার আসল রূপ? কোনটা বিশ্বাস করবো? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না ভাবি। এই শিহাব লোকটা? সেও যে নিজের স্বার্থে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে বাবার মন জুগিয়ে চলছে না সেটাই বা কে বলতে পারে বলো? অথচ এই আমার দোষে আত্মীয় স্বজন, সমাজ সবার কাছেই বাবাকে বারবার ছোটো হতে হচ্ছে। এসব থেকে মুক্তির পথ কি শুধু ওই লোকটাকে বিয়ে করা? তখন কি কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবে না? নাকি তখন জিহান নতুন কোনো নাটক করবে না?

-তোর সব দ্বিধা দ্বন্দ্বের জবাব একজনই দিতে পারে নীলু। আর সেটা জিহান নিজে। উনাকেই কল করে জিজ্ঞেস কর আসলে উনি চাইছেটা কি। দুটো পরিবারের শত্রুতার জের ধরে তোর জীবনটা আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দিবো না। তুই জিহানকেই কল করে জিজ্ঞেস কর কি চাইছে উনি আর উনার মামা। 

নিহার নিজের মোবাইলটা নীলার হাতে ধরিয়ে দিতেই নীলা মোবাইলের দিকে তাকিয়েই ভাবতে লাগলো জিহানকে কল করাটা উচিত হবে কি না। সবকিছু শেষ হওয়ার আগে একবার শেষবারের মতো চেষ্টা করবে কি নীলা? আরেকবার জিহানের মিথ্যে নাটকে জড়িয়ে পড়বে? নাকি আসল সত্যটূ জানতে পারবে এবার নীলা?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন