জন্মদিন |
০১!!
চোখদুটো খুলতে ইচ্ছে করছে না আসাদ সাহেবের। কি সুন্দর নিকষ কালো অন্ধকার চোখের সামনে।চোখটা খুললে তো এই ঘুটঘুটে অন্ধকারটা উপলব্ধি করতে পারবেন না আর।।আচ্ছা-অন্ধকারও কি অনুভব করা যায়? উপলব্ধি করা যায়? যায় ই তো।।এই যে আসাদ সাহেব উপলব্ধি করতে পারছেন।
আচ্ছা-এখন কি রাত?গভীর রাত??নাকি সকাল হলো??সকাল হলে এতো আঁধার কেন??
খুট করে একটা শব্দ হল।তার মূহুর্ত পর চারপাশটাতে একটু আলোর আভা মতো হলো। কেউ কি জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে গেল? আশ্চর্য তো!! আসাদ সাহেব তো চোখ মেলেন নি। তবে আবছা আলোটা দেখছেন কেমন করে??জেগেই আছেন তো?নাকি স্বপ্ন দেখছেন?
স্বপ্ন দেখছেন না সেটা প্রমাণ করার জন্যই হয়তো চোখ জোড়া পিটপিট করে তাকালেন।বাহ-ভালোই আলো চারপাশে! আচ্ছা এতো আলো কেন?দিন না রাত এটা!!??ধুর-মনে করতে পারছে না আসাদ সাহেব।কেন যে দিন রাতের খেঁইটা হারিয়ে ফেলেন উনি নিজেও বুঝে উঠেন না।আচ্ছা-তাহলে কি ওই বুড়ো-কি যেন নাম!?ডাক্তার-প্রসাদ-হ্যাঁ হ্যাঁ প্রসাদ ই তো-ওই ডাক্তার কি ঠিকই বলেছিল?আসলেই কি সব ভুলে যাচ্ছে সে?কি কি ভুলেছে?!কি যেন রোগটার নাম???!!যাহ-সেটাও মনে পড়ছে না।
থাক মনে পড়ছে না যখন সে ভেবে আর কাজ নেই।এখন উঠা যাক।ভাবলেন আসাদ সাহেব।এভাবে আমড়া কাঠের ঢেঁকি হয়ে পড়ে থাকার কোন মানেই হয়না।। এমনিতেই ছেলের অত্যাচারে বাসায় টেকা দায় হয়েছে আসাদ সাহেবের। কি ছেলেরে বাবা!!বিয়ে করতে না করতেই বাবাকে একেবারে গৃহবন্দী করা??কেন রে বাবা?তোদের কি আমি এভাবে আটকে রেখেছিলাম বাসায়? আবার বলে কিনা আমি ভুলে যাই?আমি!!??আমি আসাদুল কবির।আমি একটা ব্যাংকে ৩৫ বছর ধরে হিসাবের দেখাশুনা করেছি।।অ্যাকাউন্টে ছিলাম।।আর আমি নাকি ভুলে যাই।।হাহ-।রাগে গজগজ করলেন কিছুক্ষণ আসাদ সাহেব। কিন্তু কিছুতেই কোন ব্যাংকের হিসাব করার এতো বড়াই করছেন সেটাই মনে করতে পারলেন না।।
হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলেন খাটের সাইড টেবিলটাতে চা রাখা।কে রেখে গেল চা টা?? নিলু??নাকি কামাল??কামালটা রাখবে চা??!!বাবার দিকে সে খেয়াল আছে তার?সে তো মহা ব্যস্ত!! তো কে রাখতে পারে!!?? নিলু! নাকি সায়েরা!!
আসাদ সাহেবের চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল-বাড়ির সবার চোখ এড়িয়ে কিভাবে সায়েরা তাকে চা দিতে আসতেন। আর লজ্জায় লাল নীল হয়ে যেতেন-এই বুঝি ডাক পড়বে রান্নাঘরে।।বিয়ের পরে সায়েরার লজ্জা দেখার জন্যই হোক বা অন্য কারণেই কিনা কে জানে আসাদ সাহেবের চা খাওয়ার অভ্যাসটা গুরুতর বেড়ে গেল।কথাটা মনে পড়তেই আসাদ সাহেব যেন বহুদিন পরে হো হো করে হেসে উঠলেন।
আসাদ সাহেবের হাসির শব্দে দরজার ফাঁক দিয়ে ছোট ছোট দুটি মুখ উঁকি দিল।কিন্তু কি কারণে কে জানে তারা ঘরে ঢুকলো না।তবে এই হাসিটা তাদের পরিচিত।প্রতিদিন এই সময়টায় এই একটি ঘটনা আসাদ সাহেবের ছিমছাম রুমটাতে একদম সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।আসাদ সাহেব ব্যাপারটা না জানলেও এই ছোট্ট মুখ দুটি ব্যাপারটা প্রতিদিন খেয়াল করে।আর খেয়াল করে কখনো মা-কখনো বাবা-কখনো দাদী বা কখনো ফুফুর কাছে এসে জানায়। কিন্তু কথাটা বড়রা কেউ পাত্তা দেয় বলে তো ওদের মনে হয় না।।এই বুড়ো মানুষটাকে কেন কেউ ঘর ছেড়ে বের হতে দেয় না সেটা বাচ্চাগুলো বুঝতেই পারে না।ওদেরও তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়-ঘরটাতে ঢুকে বলবে-চলো দাদু, আমরা আজ তোমার সাথে খেলি--।
০২!!
হাসতে হাসতে দরজার ফাঁক দিয়ে উকিঁ দেয়া মুখ দুটো হঠাৎই খেয়াল হলো আসাদ সাহেবের।কি মিষ্টি মুখ! বয়স কতো হবে ওদের? একজনের আট-নয় বছর,অন্যজনের ছয় কি সাত।চেহারার আদল ঠিক যেন কামালের মতো।যেন ছোট্ট কামালকেই দেখছেন।।গাল ভর্তি হাসি দিয়ে বাচ্চাদুটোকে কাছে ডাকলেন তিনি।
সাহস করে শিশু দুটি আসাদ সাহেবের কাছে এলো।।
-কে তোমরা বাবা? কামালের সাথে পড়ো?
বাচ্চা দুটো মুখ চাওয়া চাউয়ি করল একে অপরের।।
-দাদু-আমি রাফি-আর ও রিয়া---।।
-দাদু!!!???হা হা হা।।
আসাদ সাহেব গলা ছেড়েই হেসে ফেললেন।বলে কি বাচ্চা গুলো!!তার ছোট্ট কামালের বয়সী বাচ্চা-তাকেই কিনা বলে দাদু!!তাকে কি এতোই বুড়ো দেখতে লাগে!!এখনো তো রোজ চুল আঁচড়াতে খেয়াল করে দেখেন-কই একটা চুলেও তো পাক ধরে নি?!
রাফি আর রিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল।।
-দাদু??তুমি আমাদের সাথে খেলবে??
-খেলব বাবা--।।কি খেলা যায়??
-আমরা বাইরে গিয়ে খেলব চলো??
-আমার ছেলে কামাল দেখলে রেগে যাবে--।। যা বউ পাগল ছেলে--!!বউয়ের কথায় উঠে আর বসে--।নইলে নিজের বাবাকেই কিনা ঘরে আটকে রাখা!!!-----।
-বাবা কিছু বলবে না দাদু--।আমরা তোমার সাথে আজ খেলব---।
আসাদ সাহেব অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। কে বাবা?কার বাবা?
-কিন্তু দরজা তো বন্ধ-!!যাবো কি করে??তালা দেয়া থাকে তো বাইরে থেকে----!
-না দাদু-দরজা তো খোলাই থাকে।আমরা তো এলাম---।।
-ও--তাই তো---।।
রাফি আর রিয়া-দুজনে আসাদ সাহেবের দুহাত ধরে রুম ছেড়ে বের হয়ে এলো। আসাদ সাহেবের মনে হলো কতো যুগ বনবাসের পর তিনি আজ খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছেন। এভাবে বন্দী থাকতে কারো ভালো লাগে??আর দরজায় বাইরে থেকে তালা দেয়ারই বা মানে কি?তিনি কি ডাকাতি করেছেন নাকি যে তাকে জেলে বন্দী থাকতে হবে!!??অসহ্য!!!
কিন্তু বসার ঘরের চারপাশটা দেখে তিনি খুবি মুগ্ধ হলেন।কি সুন্দর ঘর!! আচ্ছা এট কি সেই ঘরটা যেখানে কামাল আর নিলু জন্মেছিল?? তার হাত ধরে হাঁটি হাঁটি করে পায়ে পায়ে হাঁটতে শিখেছিল??এই ঘরেই কি কামাল আর নিলুর জন্মদিনগুলোতে সারাঘর বেলুন দিয়ে আর জরি কাগজ কেটে নকশা করে সাজাতেন?? আচ্ছা??ঘরটা এতো সুন্দর করে সাজানো কেন?আজও কি কারো জন্মদিন?কার?? কামালের??নাকি নিলুর??নাকি কামালের বউয়ের??
আচ্ছা??সায়েরা কোথায়??সে কি আজো নীল রঙা শাড়ি পড়ে রান্না করছে??নাকি কামালের বউ তাকেও কোন ঘরে বন্দী করে রেখেছে??সেও কি আজ বের হবে? আজ কি বহুকাল পর সায়েরার মুখটা দেখতে পাবে??!!আচ্ছা-সায়েরাকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে গেলে হয় না?? ছেলে মেয়ে দুটো তো নিজেদের মতো করেই বিয়ে থা করে যে যার মতোই আছে।তবে তারা কেন নিজেদের মতো করে একটু থাকতে পারবে না??
ভাবতে ভাবতে আসাদ সাহেবের চোখে পানি এলো।কি ছেলেই যে জন্ম দিয়েছিলেন তিনি!!!তবে তার নীলু মেয়েটা ভালো।। তিনি ব্যাংক থেকে ফিরার পর থেকেই তার আগে পিছে ঘুরতে থাকে।।আর কামাল??কামালটাও কেমন?? মাঠে হুটোপাটি করে হাত পা কেটে ভেঙে আসছে।। মাঝে মাঝে আচ্ছা করে পিটাতে ইচ্ছা হয়।।
-বাবা তুমি???!!!
পিছন থেকে কামালের গলা শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত যেন নেমে গেল আসাদ সাহেবের।।
০৩!!
ছেলের গলার স্বর শুনে আসাদ সাহেবের এতো ঘাবড়ে যাওয়ার মতো কিছুই হয়নি-তবু তিনি সত্যি সত্যিই ঘাবড়ে গেলেন।সাথে একটু রেগেও গেলেন।কি এমন করেছেন তিনি?!একটু রুম থেকে বেরই তো হয়েছেন!
কামাল বাচ্চাদের বকাবকি করছে।
-রাফি-রিয়া-তোমাদের না মানা করেছি দাদুকে বিরক্ত করবে না?তবু কেন গেলে ওই রুমে!?? কি হলো জবাব দাও---??
-আব্বু---দাদু তো সারাদিন রুমেই বসে থাকে---।।আমরা একটু খেলি না দাদুর সাথে---???!!
-চুপ---।।।।আর বাবা---???
আসাদ সাহেব নিজের রুমে চলে গেলেন।এটা কোনো কথা? বাচ্চাদের সামনেও বকাবকি??আর বাচ্চাগুলোকে কেন বকছে?ওরা তো খেলতেই এসেছিল!আমি কি কোথাও চলে যাচ্ছি!!!আশ্চর্য ছেলে হয়েছে বটে!!!অসহ্য!!! ধুর থাকবোই না আর এখানে---।। কিন্তু রুমগুলো একটু বেশিই সাজানো লাগছিল না?আজ কি তাহলে বিশেষ কোন দিন??বিবাহ বার্ষিকী আমাদের!!কামালের জন্মদিন??নাকি নিলুর??নাকি কামালের বউটার!!যা বউ পাগল ছেলে-বলা যায় না---।।।তবে কিছু তো একটা আছে--!!! কিন্তু কি!!!
কই সায়েরাকে তো দেখলাম না!!ওকে কি কামাল বউয়ের কথায় ঘরবন্দী করে রেখেছে?নাকি বৃদ্ধাশ্রম না কি যেন বলে ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছে??? এতো বড়ো সাহস ওর???নিজের মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া!!আমাকেও কি আজ তাড়াবে বলে এতো সাজ সাজ রব বাইরে??কোন কুক্ষণে যে এই ছেলেটাকে জন্ম দিয়েছিলাম!!!!
আসাদ সাহেব খুব বিরক্ত বোধ করছেন৷ সাথে মেজাজটাও খুব খারাপ।এই বাড়িতে আর এক মিনিটও থাকবেন না। দরকার হলে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করবেন। অবশ্য ভিক্ষা করারও তো প্রয়োজন নেই। কি যেন একটা আছে-ছেলে-বৌ গুলো মিলে বুড়ো বুড়িদের রেখে আসে??! প্রয়োজনে সেখানেই চলে যাবেন সায়েরাকে নিয়ে। কিন্তু বললে তো যেতে পারবেন না।তাহলে??!!
মনে মনে হিসাব কষছেন আসাদ সাহেব। কিভাবে বেরিয়ে যাবেন এই বন্দি কারাগার থেকে?!আসাদ সাহেবের এবার রাগ হলো প্রচন্ড। নিজের বাড়ি থেকে বের হবেন তার জন্যও এখন এতো প্ল্যানিং করতে হচ্ছে!!
ছি!!!কি দিনকাল আসল!!!!
আরে??? দরজাটা তো খোলাই। তাহলে বের হতে তো সমস্যা নেই।কিন্তু বের হতে হবে চুপিচুপি।কেউ যেন দেখতে না পায়। আবার রুম থেকে বেরুলেন আসাদ সাহেব। এবার একদম একা। সামনে বসার ঘরে সবাই কিসব কাজ করছে। সেদিকে আর গেলেন না এবার। পিছন দিকে কোথাও বের হওয়ার কোন রাস্তা কি নেই?
ছোটবেলায় আসাদ সাহেব আসার পরে কামাল বাসায় ফিরলে সামনের দরজা দিয়ে আসতো না। ভয়ে লুকিয়ে আসতো পিছনের দরজাটা দিয়ে। তারপর চুপচাপ পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে পড়ত। আচ্ছা আজো কি রান্নাঘরের দিকে বের হওয়ার দরজাটা আছে?থাকলেও আজকাল বোধ হয় আর ব্যবহার হয় না। বা খোলাই হয় না দরজাটা আর। এ বাড়িতে তো কত কিছুই বদলে গেছে। পিছনের দরজাটা কি আর আগের মতো থাকবে?!
কারো আসার শব্দ পেয়ে তড়িঘড়ি করেই পা বাড়ালেন আসাদ সাহেব। আজ তিনি কারো চোখে পড়ে যেতে চান না।আজ তিনি চুপিচুপি পালিয়ে যাবেন অজানায়। যদি কখনো ফিরতে ইচ্ছে হয় ফিরবেন-নয়তো ফিরবেন না। তাতে কি?? তাকে খোঁজার কারো সময় হবে?? সে আশাও আজ আসাদ সাহেবের কাছে পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে।।
০৪!!
দরজা খুঁজতে গিয়ে এক সময় হতাশ হয়ে পড়লেন আসাদ সাহেব। তবে কি তিনি পারবেন না এই বন্দি দশা থেকে মুক্তির পথটা খুঁজে নিতে?! আরো একবার কি তিনি মুখ থুবড়ে পড়বেন সংসারের কাদাঘোলা জলে!? আরো একবার!? নিজেকে পরাজিত লাগছে তার। ঠিক সেদিনের মতো।ওই যে যেদিন তার আদরের নিলুটা কোন এক হাভাতের হাত ধরে ঘর ছাড়লো ঠিক সেদিনের মতো পরাজিত।অসহায়-দুর্বল-ক্লান্ত।।
হ্যাঁ-সেদিনের মতোই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত এক অথর্ব একজন পিতা।আসাদ সাহেবের দু চোখ ভরে গেছে জলে। তবু তিনি যেন পণ করেছেন-এই জলেরা চোখ ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়বে না। কার জন্য কাঁদবেন? কাদের জন্য??এতো বছরের ভালোবাসা দুমিনিটে যাদের পর হয়ে গেল তাদের জন্য?? বাপ-মায়ের চেয়ে বউ যাদের কাছে বেশি-তাদের জন্য??কোন প্রয়োজন নেই বৃথা চোখের জল ফেলে। শুধু শুধু অপচয়।।
সেদিনের মতো বুকে তীক্ষ্ম ব্যথায় আজ আসাদ সাহেবের চোখ মুখ আঁধার হয়ে এলো না আজ। একবারও মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন না। চোখের টলমল করতে থাকা জলের বিন্দুগুলো দৃষ্টিটা ঝাপসা করেছে ঠিকই-কিন্তু কারো শূন্যতায় আজ তারা গড়িয়ে পড়ল না একবারও। কেন পড়বে?সত্যিই তো! কেন ভাববেন আসাদ সাহেব তাদের কথা? কেন পাবেন কষ্ট?
হাত পা গুলো অবশ হয়ে আসছে। আর চলার বিন্দুমাত্রও শক্তি বা ইচ্ছা কোনটাই বাকি নেই আসাদ সাহেবের। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি দরজাটা দেখতে পেলেন। খুশিতেই কিনা কে জানে চোখের দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। চশমা আর চোখ মুছে নিয়ে দরজাটা একটানে খুলে ফেললেন। আজো বুঝি দরজাটা ব্যবহার হয়। তাই হয়তো বৃদ্ধ হাতের জোরেই খুলে গেল চট করে। যাক- তাতে আর মন্দ কি!!
দরজা খুলে আসাদ সাহেব বাইরে বের হলেন। মনে হলো এক যুগ পরে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কি সুন্দর চারপাশটা। কি সুন্দর বড় বড় বাড়ি!! নাহ এগুলো তো আগে ছিল না! কবে উঠল বাড়িগুলো!! তবে দেখতে বেশ! কি আলিশান সব বড় বড় বাড়ি!! একটা গাছও তো চোখে পড়ছে না আশেপাশে! আগে তো কতো কতে গাছ ছিল। বাড়ির সামনে বাগানটার অস্তিত্ব আর নেই। গেটটা পার হতেই ধুম করে রাস্তা শুরু হয়ে গেল!!?? এ কি রে বাবা?? বাড়ির উপরে রাস্তা?? নাকি রাস্তার উপরে বাড়ি??আর এতো ছোট মুদির দোকান!! তাও বাড়ির সামনে?! সে কি কথা? বাড়ি,দোকান, রাস্তা সবই যদি এক জায়গায় হবে-তো নিরবিলিটা কোথায়??!!
আসাদ সাহেব হা করে এসব দেখছেন আর বিরক্ত হচ্ছেন। এটা কেমন ধরনের কথা?! ফাইজলামি নাকি!! বাড়ি হবে প্রশান্তির জায়গা। এ তো বাড়ি নয়-জলজ্যান্ত অফিস!!!অফিস??? অফিসও না।। কি সেটা আর আসাদ সাহেব ঠিক মতো ভাবতেও পারলেন না।
তাদের বাড়ির লাগোয়া মুদি দোকানটার ছেলেটা আসাদ সাহেবকে দেখছে অনেকক্ষণ ধরে। চোখে চোখ পড়তেই ছেলেটা অমায়িক হাসল।
-স্লামাইকুম চাচা-কেমন আছেন?
-এই তো বাবা-ভালো। তুমি?
-জি চাচা ভালো।। -চাচা কি কোথাও যাচ্ছেন??
-হ্যাঁ একটু হাঁটতে বের হচ্ছি---।
-আজকে চাচার সাথে কেউ নাই যে?
আসাদ সাহেব অবাক হয়ে দোকানদার ছেলেটার দিকে চাইলেন। কি বলে কি ছেলেটা?!মাথা খারাপ নাকি? আমি তো আজ প্রথম দেখলাম এই ছেলেকে! আর বেরও হলাম আজই প্রথম! বলে কিনা আজকে কেউ নেই কেন?! আরে মুশকিল থাকবেটা কে!! ওই অসভ্য কামালটা!!! নিলু তো আর বের হবে না। সায়েরা তো কোথাও যায়ই না।। আর কামাল!!! তাহলেই হয়েছে!!!!!বাবাকে নিয়ে হাঁটতে বের হবে কোন সাহসে!! যা ঘরকুনো ছেলে হয়েছে!! ঘুরকুনো কেন হবে!! বউকুনো--।। কি যেন বলে!!!বউপাগল ছেলে।তার কি আর বাপ-মায়ের খেয়াল আছে!!
০৫!!
-একা না বাবা আমার ছেলেও আছে-।
-ও আচ্ছা-।কামাল ভাই সেদিন বললো আপনার নাকি শরীর খারাপ? তাই এই কয়দিন হাঁটতে বের হন নি চাচা??
-হুম?? হ্যাঁ বাবা--।
কি বললো ছেলেটা?! আমি কয়দিন হাঁটতে বের হইনি?আমি হাঁটতে বের হয়েছিলামটা কবে??আজীব!!!সব পাগল ছাগলের কান্ড!! আর আমি অসুস্থ হলামই বা কবে!!
আসাদ সাহেব ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেক্ষণ।। বোঝার চেষ্টা করছেন এই ছেলে কি পাগল?? নাকি তার সাথে তামাশা করছে??দেখে তো ভালোই মনে হয়।তবে???
কতোক্ষণ ধরে দোকানের ছেলেটাকে দেখছেন খেয়াল নেই।। হঠাৎ টুংটাং শব্দে হুঁশ হলো। তাকিয়ে দেখলেন তার একদম পাশ ঘেসে একটা রিকশা যাচ্ছে।।এ কি রে বাবা!!! দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছে আসাদ সাহেব।এটা ও কি রিকশা চালানোর জায়গা নাকি!! একটু আগেই কয়েকটা বাচ্চাকে দেখেছেন রাস্তার মাঝে হুটোপুটি করে খেলতে।। তারা গেল কোথায়??
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সামনে থেকে একটা গাড়ি আসছে।।সবুজ সবুজ রং করা টেক্সি। এ কেমন টেক্সি রে বাবা!!! বাচ্চারা টেক্সিটাকে সাইড দিয়ে যাওয়ার জন্য সরে দাঁড়িয়েছিল। চলে যেতেই আবার সবাই রাস্তার মাঝখানে ছুটে এলো খেলার জন্য।। ঘরে দেখা বাচ্চা দুটোকেও দেখলেন।।ওদের দেখেই কিনা কে জানে-আসাদ সাহেবের মনে হল এবার যাওয়া দরকার।।
সামনের দিক থেকে আবার টুংটাং করে একটা খালি রিকশা আসছে।।হাত দিয়ে থামতে ইশারা করলেন তিনি।।রিকশাটার গতি কমানোর কোন ভাব দেখা গেল না।। বরং মনে হলো রিকশাচালক তাকে দেখেনইনি।।
অবশ্য তবু রিকশাটা তার একেবারে পাশে এসেই থামল।।এক মূহুর্তের জন্য আসাদ সাহেবের মনে হয়েছিল তাকে বোধ হয় রিকশাটা চাপাই দিবে আজকে।। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল।কিন্তু মুখটা দেখে থেমে গেল।। কর্মদীপ্ত-উজ্জ্বল মুখ। বয়স কত হবে?? ৩০ কি ৩৫। তবুও দেখে মনে হয় উচ্ছ্বল যুবক-সবে হয়তো সে কৈশোর পেরিয়েছে।।
-চাচা-কই যাইবেন??
-হুম?? নিউমার্কেট যাবা??
-হ চচা...।যামু--।৮০ টাকা দেওন লাগবো।
-ওমা!!! ৮০ টাকা!! ভাড়া না ২০ টাকা??
-কি যে কন চাচা! ২০ টাকা ভাড়ার কি যুগ আছে? আর সব ভাঙাচুরা রাস্তা--।। বিরিজ-টিরিজও হইসে এহন।। কতকক্ষানি রাস্তা ঘুইরা যাইতো হইবো--।
-আচ্ছা--।।দেখো একটু কম রাখতে পার কিনা।।
-আইচ্ছা-।। আপনি মুরব্বি মানুষ ১০ টাকা কম দিয়েন---।।
আসেদ সাহেব একটু হাসলেন। তাকে দেখে কি এতোই মুরব্বি মুরব্বি লাগে?! এখনো তো তিনি রোজ নিয়ম করে চুলে ডাই করেন। চুলগুলো তাই কুচকুচে কালো।। মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। ছেলের বৌ ঘরে আনতে হবে। কতো কাজ বাকি তার। এতো তাড়াতাড়ি বুড়ো হলে কি তার চলবে? আসাদ সাহেব হাসছেন এসব ভেবে।। গর্তভরা রাস্তার উপর দিয়ে রিকশাটাও যেন হেলেদুলে চলছে।। এক একবার ঝাঁকুনিতে আসাদ সাহেবের মনে হচ্ছে হাড়-পাঁজর সব ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে।। আর এক এক বার রিকশায় না মনে হচ্ছে রকেটে করে চলছেন।।
রিকশার দুলুনিটাও ভালো লাগছে। জ্যামের মধ্যে জোয়ান রিকশাওয়ালা যখন ফাঁকফোকর পেরিয়ে-বড় বড় গাড়িগুলো কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে--তখন অন্য রকম এক অহংকার হচ্ছে তার।।অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছে।। খুশিতে ছেলে মানুষের মতো হেসেই ফেললেন তিনি।। মুক্ত মুক্ত লাগছে আসাদ সাহেবের।।আজকে স্বাধীন তিনি।। সত্যিকারের স্বাধীন।।
০৬!!
- তা চাচামিয়ার পরিবার কিমুন আচে?
-হ্যাঁ ভালো বাবা।
-তা চাচাসাহেবের পরিবার কয়জন?
রিকশাচালক পরিবার কয়জন বলতে স্ত্রী কয়জন বোঝালেও আসাদ সাহেব ভাবলেন পরিবারে কয়জন আছে সেটা জানতে চাইছে।
-চারজন।
চারজন পরিবার শুনে রিকশাচালক হা হয়ে গেলো।
-কি বলেন চাচা?? আমি আমার একজন পরিবাররেই সামাল দিবার পারি না। সবচাইতে ভালা কোন জন??
-ছোটজন।। আমার নয়নের মণি৷ আমার নিলু--।
-কচিগুলা বেশিই ভালা হয়৷ বড়গুলার মতো এতো খিটির পিটির করে না।
-ঠিকই বলসো বাবা--বড়জন বেশি করে--।।
বড়জন বলতে বলতে আসাদ সাহেবের কামালের কথা মনে পড়ে গেলো। বিরক্ত হয়ে উঠলেন কামালের কথা মনে পড়তেই। কেমন কুলাঙ্গার ছেলে!!!বিয়ে করতে না করতেই কিনা-----!!!
কথায় কথায় কখন যে মার্কেটে চলে এলেন বুঝতেই পারলেন না আসাদ সাহেব। মার্কেটে নেমে তো হা হয়ে গেলেন। এতো বড় মার্কেট!! সবে রোদ উঠেছে জমিয়ে। বাইরে বেশ তেজ রোদের। রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে মার্কেটের দিকে পা বাড়ালেন। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলেন৷ আজকে ঘর সাজানো হচ্ছে। সুন্দর করে সাজানো ঘর। তার মানে কারো জন্মদিন আজ!!! কার জন্মদিন হতে পারে?! কামালের নাকি নিলুর!!! সায়েরা নিজের জন্মদিন পালন করবে না। আসাদ সাহেবও নিজের জন্মদিন পালন করেন না। তার মানে কামাল কিংবা নিলুর।। কিন্তু ঠিক কার!!!!
কার জন্মদিন কিছুতেই মনে করতে পারলেন না আসাদ সাহেব।কয় তারিখ আজ?! তারিখটাও মনে করতে পারকেন না তিনি।মনে না পড়লেও সমস্যা নেই।একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। কার জন্মদিন জানারও প্রয়োজন নেই। সবার জন্য গিফ্ট নিয়ে যাওয়াই সবচেয়ে সুবিধার কাজ। কারো মন খারাপ হবে না। বহু বছর ধরে এই এক বুদ্ধির কারণে পার পেয়ে যান তিনি।হা হা। সবাইকে বোকা বানানোর মতো বুদ্ধি।ব্যাপারটা এবারেও মনে ধরল আসাদ সাহেবের। শুধু তিনি এটা মনে করতে পারলেন না বিগত ২৪ -২৫ বছর ধরেই একই কাজ করছেন তিনি।
প্রথমেই ঠিক করলেন সায়েরার জন্য একটা নীল শাড়ি কিনবেন। নীল শাড়ি সায়েরার খুব পছন্দের। তারপর নিলুর জন্য একটা সুন্দর দেখে ফ্রক।। আর কামালের জন্য পায়জামা পাঞ্জাবি।নিলুর জন্য ফ্রকের রঙটাও ঠিক করে ফেললেন আসাদ সাহেব। টকটকে লাল রং।। লাল নিলুর খুবই পছন্দের। আর কামালের জন্য সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি। সাদা রঙটা কামালের যদিও পছন্দ না-তবু পায়জামা পাঞ্জাবি সাদাই মানায় ওকে।
একটা পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দর করে শাড়ি পড়ানো। দেখতে বেশ লাগছে।শাড়িটা একটু ধুমড়ে মুচড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। তবে পুতুলটাকে ভিষণ রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে। পুতুলটা দেখতে দেখতে তার ভিতরেই সায়েরার মুখটা যেন ভেসে উঠতে দেখলেন আসাদ সাহেব। সাথে সাথে তার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল।শাড়িটাও নীল।শাড়ির জন্য ঘুরাঘুরি করা থেকে বাঁচা গেল। কাঁচের দরজাটা ঠেলে দোকানে ঢুকে পড়লেন আসাদ সাহেব। এই শাড়িটাই তার চাই।।
০৭!!
আসাদ সাহেবকে দেখে দোকানের একজন স্টাফ হাসিমুখে এগিয়ে এলো।
-আসুন স্যার। আমাদের এখানে বাচ্চাদের জামা কাপড় থেকে শুরু করে বড়দের শাড়ি-শার্ট-পান্জাবী-কোর্ট সবই পাবেন৷ বসুন স্যার। বলুন কি দেখাবো??
-আমি বাবা আমার স্ত্রীর জন্য একটা শাড়ি নিতে এসেছি।
-আপনার ওয়াইফের জন্য??----.. এই শাড়িটা দেখুন স্যার৷-- সাদার উপরে গোল্ডেন নকশা করা--৷ শাড়ির পাড়টাও গোল্ডেন---।। ম্যাডামের খুব পছন্দ হবে--।।
-না না--।। সাদা না।।। এই যে--।। ওই শাড়িটা৷ নীল রঙের---।।।
-জি স্যার। ওই নীল শাড়ির ডিজাইনের মধ্যে লাইট কালারের এই যে পাতা কালার আর পেস্ট কালার আছে---।। দেখুন পছন্দ হবে৷
-না বাবা--।৷ আমার ওয়াইফের জন্য নীল শাড়িটা দেখান৷ --ওটা দেখি একটু---।।
একজন বৃদ্ধ লোক তার স্ত্রীর জন্য চকচকে নীল রঙের শাড়ি কিনতে চান!!! তাও ভারি জামদানি!!ব্যাপারটা শুনে স্টাফটা হা হয়ে তাকিয়ে আছে।৷ কিন্তু পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে শাড়িটা দেখাতে শুরু করলো। কার কত বয়স-কি পছন্দ হলো-সেটা তার দেখার বিষয় না।।৷ শাড়ির গুনগান শুনিয়ে শাড়িটা বিক্রি করাই তার কাজ।। কে কি কিনল।। বা বাসায় গিয়ে পড়তে পারবে কিনা সেটা তার দেখার বিষয় না মোটেও।।
-হ্যাঁ স্যার--।। এই যে।। শাড়িটার ডিজাইন দেখুন একবার৷ আপনার পছন্দ আছে বলতে হবে--।। ম্যাডামকে অসম্ভব সুন্দর দেখাবে---।। স্যার শাড়িটা কি প্যাক করবো???
-হ্যাঁ করো। কিন্তু দামটা???
-স্যার--।। ভারি জামদানি।। ৪২০০ টাকা দাম।। স্যার শুধু আপনার জন্য ৩৫০০ রাখছি আমরা।।
-আরে কি বলো?? হাজার ১২০০ টাকা দাম হবে শাড়ির।।
-আল্লাহ!!! কি বলেন স্যার??? আপনি মুরব্বি মানুষ--৷ আপনার সাথে মিথ্যা বলবো স্যার?? আপনি আমার বাবার বয়সি--।। আচ্ছা স্যার আর ২০০ টাকা কম দিয়েন৷৩৩০০ টাকা।। আর কিছু বলিয়েন না স্যার।
-হুম।।
-স্যার প্যাক করে কাউন্টারে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ আপনি ওখানে পেমেন্টটা করে দিবেন-----।। ৩৩০০ টাকা।।-----।। ওই স্যারের থেকে ৩৩০০ টাকা রাখ।।
-টাকা???
এতোক্ষণে টাকার কথাটা মনে পড়লো আসাদ সাহেবের। শপিং করতে চলে এলো। টাকা কতো আছে?? চিন্তা করতে করতে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলো। কাউন্টারে শাড়িটা প্যাক করা হয়েছে। আসাদ সাহেব পকেটে হাত দিলেন। আজকে কয় তারিখ মনে পড়ছে না।। বেতনের কত টাকা পকেটে আছে তার?! আধো টাকা আছে কিনা কে জানে!!?
পকেট থেকে টাকাগুলো বের করলেন। কিন্তু কিছুতেই হিসেব করতে পারলেন না কত টাকা এখানে।। হাত কাঁপছে।। চোখটা একটু ঝাপসা হয়ে আসছে। বোঝ হয় খাওয়া দরকার কিছু। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এই মূহুর্তে আসাদ সাহেবের মনে হচ্ছে টাকা গুনে দেখার কাজটা জীবনে প্রথমবার করছেন।। বা জানেন ই না কিভাবে টাকা গুনতে হয়।।
কাউন্টারে যে ছেলেটা বসেছিল সে ও অবাক হয়ে এই ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধের কাজকর্ম লক্ষ্য করছে।। হাতে টাকা নিয়ে কিসব ভাবছে।৷ আর একটু একটু কাঁপছে ভদ্রলোক।।
-স্যার আপনি ঠিক আছেন??
-হ্যাঁ??! --হ্যাঁ বাবা ঠিক আছি--।। এখানে দেখো তো কত টাকা??
বৃদ্ধের এমন প্রস্তাবে অবাক হয়ে টাকাটা হাতে নিল ছেলেটা।সেও কিছুক্ষণ কি করবে বুঝতে না পেরে পরে টাকাটা গুনতে শুরু করলো৷
০৮!!
টাকাটা গুনে দেখল ছেলেটা। সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এর থেকে ৩০০০ টাকা রেখে বাকি সাড়ে ৯ হাজার টাকা ফেরত দিল ছেলেটা।
-নিন চাচা।। এখানে ৯৫০০ টাকা আছে আর। চাচির শাড়ির জন্য ৩০০০ টাকা রেখেছি।
-আচ্ছা বাবা।।
-আর চাচা-- যাকে তাকে যখন তখন টাকাটা দিয়ে দিবেন না।।
-হুম??!!
কি বলছে ছেলেটা আসাদ সাহেবের মাথায় ঢুকলো না। কাউন্টারের একটা ছেলে শাড়ির প্যাকেটটা দিয়ে গেলে। আসাদ সাহেব সেটা হাতে করে বাইরে বের হলেন দোকানের৷ এবার কি করবেন ভাবছেন। কি করা জানি বাকি মনে করতে পারলেন না। এদিক সেদিক ঘুরলেন অনেকক্ষণ। একটা খাবার দোকান দেখে মনে হলো খিদে লেগেছে। খাবার দোকানে ঢুকে মেনু দেখে বিরক্ত হলেন। এগুলা খাবার মেনু!!? পিজ্জা বার্গার!!?? নামের কি ছিরি রে বাবা!!! মেনুতে চিকেন বিরিয়ানি দেখে আসাদ সাহেবের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। একটা চিকেন বিরিয়ানি আর একটা চিলড কোকাকোলা দিতে বললেন।
অর্ডার দিতে দিতে তিনি পুরোনো দিনে ফিরে গেলেন। সায়েরা আর নিলুকে নিয়ে প্রথমবার রেস্টুরেন্টে যাবার ঘটনাটা মনে পড়েছে তার।৷ কামাল তখনও জন্মায় নি। দুবছরের নিলু একবার এদিক একবার ওদিক ছুটছে। সেদিনও চিকেন বিরিয়ানি নিয়েছিল ওরা। দু চামচ মুখে দিয়েই সায়েরার গা গুলিয়ে আসলে ছুটে ওয়াশরুমে ছুটল। আসাদ সাহেব এতো বকাবকি করেছিলেন রেস্টুরেন্ট মালিক আর ম্যানেজারকে। সায়েরা বহু মানা করছিল।। কিন্ত কে শুনে কার কথা!! পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল একটা খুশির খবর।ব্যাপারটা মনে করেই হেসে ফেললেন তিনি। কতোটা ভালোবাসতেন তখন তারা একে অপরকে।। ভালোবাসতেন না-এখনও ভালোবাসেন।
ওয়েটার এসে অর্ডার দিয়ে গেলো। আসাদ সাহেব তখনও হাসছিলেন। মনটা ফুরফুরে লাগছে তার আজকে খুব। খেয়ে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। তখনই মনে আসলো নিলু আর কামালের জন্য কিছু কিনা হয়নি। আগে নিলুর জন্য জামা নিবেন। কিন্তু সমস্যা হলো যা দেখছেন সব পছন্দ হচ্ছে। সবই কিনতে ইচ্ছে করছে মেয়ের জন্য।
একটা জামা ভিষণ পছন্দ হলো আসাদ সাহেবের। কিন্তু নিলুর গায়ে হবে কিনা কিছুতেই আন্দাজ করতে পারলেন না। একটা মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দেখে তাদেরকেই থামালেন আসাদ সাহেব।
-আসলে আমার মেয়ের জন্য এই জামাটা নিতে চাচ্ছিলাম---।। যদি একটু সময় দিতেন---।
-জি বলুন---৷
-আসলে আমার মেয়ে নিলু আপনার মেয়ের বয়সী। এই জামাটা ওর গায়ে হবে কিনা---।।
ভদ্রমহিলা মেয়ের গায়ে জামাটা মেপে দেখলেন। এক সাইজ ছোট মাপের। ঠিকঠাক মাপের জামাটাও চয়েজ করো দিলো মহিলা।।
-আপনার মেয়ে কিসে পড়ে ভাই??
-পড়া টড়া আর কি!!! বাবা মায়ের মুখে চুনকালি মেখে নিজের পছন্দের একজনকে বিয়ে করেছে---।।
একটা বারো-তেরো বছরের মেয়ে বাবা মায়ের কথা না শুনে বিয়ে করেছে শুনে মহিলা আর তার মেয়ে আঁতকে উঠে আসাদ সাহেবের দিকে চেয়ে রইলেন অবাক হয়ে।।
-তবে আমার মেয়েটা ভিষণ ভালো। আমার ছোট ছেলে কামাল।৷ সে তো বিয়ের পর আমাদেরকে যেন চিনেই না---।
-কামাল??
-নিলুর ছোট ভাই----।।
আসাদ সাহেব মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলতে তুলতে দোকানের ভেতরে চলে গেলেন জামাটার পেমেন্ট করতে।।আর মহিলা আর তার মেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আসাদ সাহেবের যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।।
০৯!!
নিলুর জন্য জামা আর কামালের জন্য পাঞ্জাবি কিনে খোশ মেজাজে মার্কেটের বাইরে পা দিলেন। হাতে তিনটা শপিং ব্যাগ। সায়েরার,নিলুর আর কামালের। মার্কেটের বাইরে বের হতেই কেউ যেন আলতো ধাক্কা দিয়েই চলে গেল। ঠিক কি হলো খেয়াল করতে পারলেন না আসাদ সাহেব। তো কিছু একটা হয়েছে মনে হলো। হাতটা একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে কি যেন পড়ে গেছে হাত থেকে। এমন সময় একটু চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ালেন তিনি।
-চোর-চোর-চোর---।।।
'চোর' শব্দটা শুনে ঘুরে ফিরে দেখলেন একজন রোগা পটকা লোকের হাতে তার দুটো শপিং ব্যাগ। ব্যাপারটা কি হলো বুঝতে আসাদ সাহেবের কিছুটা সময় লাগলো। তবে ততক্ষণে কিছুটা দেরিই হয়ে গেছে। আসাদ সাহেবও 'চোর-চোর' বলে ছুটলেন।
একটা সময় হাঁপিয়ে উঠলেন আসাদ সাহেব। কিন্তু একটু সামনেই একটা জটলা পাকিয়েছে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে একটু সামনে গিয়ে দেখলো একজন রিক্সাওয়ালা চোর ব্যাটাকে ধরে মারছে দমাদম।। আশেপাশের মানুষগুলোও দমাদম দু-এক ঘা দিচ্ছে।।
-আরে-মামা, আমি তহন থেইকা দেখতাসি ব্যাটা দুরাইয়া আইতেসে---।। আর বুড়া মানুষডায় তো খিয়ালই করে নাই।। এই সুযুগে---।। ব্যাটা বদমাইশ--।। মুরব্বি মানুষের তন চুরি--।
আসাদ সাহেবকে দেখে চোরটার হাত থেকে ছো মেরে ব্যাগ দুটো নিয়ে নিল রিকশাওয়ালা ছোকড়াটা।।
-আরে চাচা-লন লন আপনের ব্যাগ। আর এই চোর ছ্যাসড়াগুলা থেইকা একটু সাবধানে থাইকেন।।
আসাদ সাহেব শপিং ব্যাগ দুটো নিলেন। আশেপাশের লোকজন চোরটাকে আরো কয়েকটা চড় থাপ্পড় মেরে ছেড়ে দিয়েছে। ততক্ষণে আসাদ সাহেবও ধীরে সুস্থে হাঁটতে শুরু করেছেন। বার বার হাতের ব্যাগগুলোকে দেখছেন। আর আগলে রাখার চেষ্টা করছেন।।
বেশ অনেকক্ষণই হাঁটছেন।। ক'টা বাজে কে জানে!! তবে বিকেলের রোদের তেজ কমেছে সেই কখন। আধো আলো আধাঁরির খেলাও শুরু হয়েছে। গন্তব্য কোথায় আসাদ সাহেব জানেন না। কেবল মনে হচ্ছে সামনেই বাড়ি। ওই যে দেখা যায়-সামনের মোড়টা-ওটা পেরুলেই। কিন্তু ওই মোড় পেরুলে আরেকটা রাস্তার মাথা থেকে দেখা যায় আরেকটা মোড়।আসাদ সাহেব আবার ভাবেন-এই মোড়টা পার হলেই বাড়ি। সায়েরা পায়েস রেঁধে অপেক্ষায় বসে আছে। নিলু বসে আছে ঘর সাজিয়ে।। আর কামাল?? কামাল আজ নট আউট থেকে ৭৮ রান করে দলকে জিতিয়েছে। ম্যান অব দা ম্যাচের ট্রফিটা নিয়ে বসে আছে বাবাকে দেখাবে বলে।।
আসাদ সাহেব হাঁটছেন তো হাঁটছেন।। এই পথটা বুঝি শেষ হয় না আর। সন্ধ্যার আঁধার কেটেছে রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতিগুলোয়। সে আলোয়ও যেন সবকিছু ঘোলাটে লাগছে।। ক্রমশ চারপাশটা আরো ধোঁয়াটে লাগছে তার কাছে।মনে হচ্ছে আজও বুঝি মুখ থুবড়ে পড়বে-রাস্তার শক্ত নিষ্ঠুর পাথরের উপর।। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।৷ মুখ থুবড়ে পড়তে হলো না। কেউ একজন এসে হাতটা ধরে ফেলেছে।।
মুখটা তুলে তাকালেন আসাদ সাহেব।হাসিখুশি কর্মদীপ্ত-উজ্জ্বল মুখ। বয়স কত হবে ছেলেটার?? ৩০ কি ৩৫?! তবুও দেখে মনে হয় উচ্ছ্বল যুবক-সবে হয়তো সে কৈশোর পেরিয়েছে।।
-চাচামিয়া-আপনের কি শরীল খারাপ করতাসে???
তার বয়সী একজন মানুষ তাকে চাচা বলে সম্বোধন করছে এটা ভেবেই কি কে জানে-আসাদ সাহেব রিকশাওয়ালা যুবকটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।।
১০!!
বেশ অনেকক্ষণ হলো আসাদ সাহেব গুম হয়ে বসে আছে। কোথাও একটা নিয়ে এসেছে সেই ছেলেটা। কারো একটা বাসায়। সুন্দর করে সাজানো বাসাটা। রঙীন কাগজ কেটে নকশা কাটা। সেই কাটা নকশায় ঘর সাজানো। ছোট ছোট টিমটিমে ঝিলিক বাতিতে ঘর জ্বলজ্বল করছে।সেই মিটমিটে আলোতে সবার মুখে একটা অবাক বিস্ময় নাকি কৌতূহল কি যেন দেখতে পাচ্ছেন আসাদ সাহেব। তবে ঠিক কি সেটা ধরতে পারলেন না তিনি।
এতোগুলো মানুষের মধ্যে বড্ড বেশি বেমানান লাগছে নিজেকে আসাদ সাহেবের। সবাই কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। তবে শব্দগুলোর অর্থ বোধগম্য হচ্ছে না তার। কি ভাষার শব্দ এগুলো কে জানে!!একবার ওর-একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথার ভাববস্তু বুঝার অনেক চেষ্টাও করলেন।। কিছুই বুঝতে পারলেন না।। আরে শব্দ গুলোই না বুঝলে কি বলছে বুঝবে কেমন করে?? মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছে আসাদ সাহেবের।৷ কপালের মধ্যস্থলে ঠিক ত্রিনয়নের জায়গাটায় যেন গোল গোল করে সাইক্লোনের জন্ম নিচ্ছে। আজব এক অনুভূতি।। কি আশ্চর্য না??
- আমি তো চাচামিয়ারে এই বাসার সামনের রাস্তা থেইকাই রিশকায় উঠাইসিলাম।। ভাইজান---।। ওই যে মুদির দোকানের পোলাটাও দেখসে--।। জিগান তারে---।।
-হ কামাল ভাই--।। চাচায় কইসিলো আপনিও লগে আছেন--।। আমি একটু বেখেয়াল হইসে--একটু পরেই দেখি চাচা এই লোকের রিকশায় উইট্ঠা গেসে--।। আমি তো ভাবলাম আপনেও লগে গেসেন-----।।
-আর ভাই--।। চাচামিয়ার লগে রাস্তায় আমার কতো কতা অইসে।। মার্কেটে নামায়া দিসিলাম---।।
-নিউ মার্কেট!!!??? বাবা নিউমার্কেট কি করছিল???
-হেইডা ত জানি না ভাই--।। একটু আগে আমি বাসাত জাওনের লাইগা রিশকা জমা দিবার যাইতেসিলাম।।। তহন দেখি চাচামিয়া হাঁটতেসে রাস্তা দিয়া।। হঠাৎ মনে অইলো উনার কিসু অইসে--।। রিশকার তে নাইমা সামনে গেসি জিগাইতে।। পইড়া যাইতেসিলো--।। ধইরা ফালাইসি।।৷ হের পর থেইকা একটা কিসুও কয় নি।। তাই উনারে এইখানে লইয়া আইসি--। দোকানদার পোলাডাও চিন্না বাসাত লইয়া আইলো----।।।
-আর ভাই বইলেন না--।। সারাদিন আমরা সবাই চাচারে কতো জায়গায় খুঁজসি--।। পুলিশ ইস্টিশন পর্যন্ত গেসি---।। আমি তখন বেক্কলের মতো চাচার লগে ভাইজান আছে বিশ্বাস করসি বইলাই তো---।। নইলে তো----।।
-বাদ দাও রহিম---।। বাবাকে যে শেষমেশ সুস্থ পেলাম তাই অনেক।। জানোই তো এ বয়সে একটা ভুলে যাওয়া রোগ হয়??"ডিমেনশিয়া" নাম। তারই মারাত্মক একটা রূপ হলো "আলঝেইমার"। বাবার সেই রোগটাই হয়েছে।। আমাকে আর নিলুকে এখনো ছোট্ট বাচ্চা মনে করে।। চিনেও না মাঝেমাঝে।। আমরা যে কথা বলছি তার কিছুই হয়তো বুঝতেও পারছে না--।।
-ভাই--।। চাচা এতো রাগ করে কেন আপনার কথা বললে??
-কি জানি??? নিশার সাথে বাবা ই আমার বিয়েটা দিয়েছিল।৷ অথচ এখন প্রতিদিন বলে আমি নাকি ওর জন্য বাবাকে আর মাকে আটকে রেখেছি।৷যে ই আসে বাসায় তাকেই বলে।। বলে নিশা নাকি খেতে দেয় না।। অনেকে হয়তো বিশ্বাসও করেও নেয়।।এমনকি বাচ্চাগুলোকেও বলে---।।।
কামাল চোখ মুছে তার বাবার দিকে তাকালো। নিলুর বিয়েটাও বাবা ওর পছন্দের ছেলের সাথেই দিয়েছে।৷ সুখেই আছে ওরা। আর ওদের ছোট্ট ছেলে রাফি।। আর কামালের মেয়ে রিয়া।। ওদেরকেও চিনতে পারে না আসাদ সাহেব। আসাদ সাহেব এখনো মাথা নেড়ে আশেপাশে দেখে যাচ্ছেন।। চারদিকে সাজানো সবকিছু। কার জন্মদিন আজ?? নিলুর?? নাকি কামালের?? নাকি ওর বউটার?? কি যেন নাম---!!??
সায়েরাও এসে বসেছে পাশে। সায়েরাকে দেখেই একমুখ হাসলেন তিনি।।
-হাতে কিসের প্যাকেট তোমার??
এতোক্ষণে খেয়াল হল আসাদ সাহেবের। সবার জন্য জন্মদিনের গিফট এনেছেন তিনি।। একগাল হেসে সায়েরাকে প্যাকেটগুলো ধরিয়ে দিয়ে আশেপাশে ইতিউতি করে ছোট্ট নিলু আর কামালকে খুঁজতে লাগলেন।। সায়েরা ব্যাগ তিনটা খুলে দেখেই ফুঁপিয়ে উঠল।। কামালও এগিয়ে এসে ব্যাগ হাতে নিয়ে পাজামা পাঞ্জাবি দেখে দু মিনিট থ মেরে রইলো।। তার প্রতিবছরের বার্থডে গিফ্ট।। কামাল বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
-শুভ জন্মদিন বাবা।।
নিলুও ফ্রকটা হাতে নিয়ে হেসে ফেলল। কামালের মতো সেও আসাদ সাহেবের কানে চুপিচুপি বললোঃ-
-"শুভ জন্মদিন বাবা--।।জামাটা আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে বাবা---।"
জন্মদিন কথাটা শুনে আসাদ সাহেবের ঠোঁটের কোণে হাসি ছড়িয়ে পড়ল।। আর সায়েরা?? সে নীল শাড়িটা বুকে চেপে ধরে আসাদ সাহেবের দিকে চেয়ে রইলেন প্রতিবারের মতোই।।।
***(সমাপ্ত)***