কাজললতা এবং সে - মুশফিকা রহমান মৈথি - অনু গল্প

পড়ুন মুশফিকা রহমান মৈথি'র লেখা একটি অনু গল্প কাজললতা এবং সে
কাজললতা এবং সে
কাজললতা এবং সে by মুশফিকা রহমান মৈথি

তেরোতম বারের মতো পাত্রপক্ষের সামনে সং সেজে বসবো। তানজিন ইচ্ছেমত মেকাপ ঘষে যাচ্ছে আমার মুখে, যাতে পাত্রপক্ষের এবার অন্তত আমাকে পছন্দ হয়। বারো, বারোবার তারা আমাকে দেখতে এসেছেন আর আমিও সং সেজে তাদের সামনে বসেছি। কিন্তু তাদের কথাগুলো এরকম,
“আপনার মেয়ে তো অসম্ভব কালো, ছবিতে তো এতো কালো লাগে নি”
“কালো মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন, কিছু তো দেয়ানেয়া করাই লাগবে”
“মেয়েটি আপনাদেরই তো? আপনারা তো এতো কালো নন”
“ছোট মেয়েটি বেশি সুন্দরী, ওর সাথে নাহয় আমাদের ছেলের বিয়েটা হোক”

এরকম আরোও কথা আমার বাবা-মাকে শুনতে হয়। বয়স পঁচিশে এসে ঠেকেছে এখনো বিয়ে হবার নাম নেই। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে পাত্রপক্ষের কিছুই যায় আসে না, মেয়েতো কালো। মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন। যে যা বলেন তাই আমার উপর প্রয়োগ করেন, কেউ দুধের সর খাওয়াতে বললে খাওয়াবেন, মুলতানি মাটি, চন্দন, কাঁচা হলুদ দিয়ে আমাকে গোসল করতে বলেন, মুখে মেখে বসে থাকতে বলেন, বেশি গাঢ় বা বেশি হালকা রঙ আমাকে পড়তে দেন না যাতে আমাকে বেশি কালো না লাগে; এজন্য আমার কোনো পছন্দের রঙ নেই। তানজিন আমার ফুফাতো বোন; তাকে প্রতিবার পাত্রপক্ষের আসার আগে বাড়ি এনে আমাকে সাজাতে বলবেন। মেয়েটি খুব সুন্দর করে আমাকে সাজিয়ে দেয় কিন্তু আমার কয়লা চামড়াকে কিছুতেই সাদা বানাতে পারে না। আমি ক্লান্ত কিন্তু মার উপর কথা বলতে পারি না। আমার জন্য মেহুলের বিয়েটাও হচ্ছে না। মায়ের নাকি খুব ইচ্ছে ছিলো তার বড় সন্তানের নাম শুভ্রা বা শুভ্র রাখবেন। কিন্তু যখন হয়েছিলাম এতোটাই কালো ছিলাম যে শুভ্রা নামটা ঠিক যাচ্ছিলো না। বাবা আমার নাম তখন রাখেন মৈথি। যার অর্থ নিরক্ষন করা। বাবা সবসময় বলেন আমি নাকি কষ্টি পাথরের মতো, যেমন কষ্টি পাথর কালো হলেও সোনা নিরিক্ষনে তার প্রয়োজন আমিও নাকি তেমন। মানুষকে নাকি আমাকে নিরিক্ষন করতে হবে; কার মন লোহার কার মন সোনার। হাহা। খুব হাসি পায় বাবার কথা শুনলে। বাবাই একমাত্র যিনি আমাকে কোনোদিন বলেন নি কালো রঙ আমার দূর্বলতা। আমি নাকি হুবহু দাদীর মতো দেখতে। আমার দাদা ছিলেন উচু-লম্বা, ফর্সা সুঠাম দেহী একজন পুরুষ অথচ তিনি আমার দাদীর মতো কৃষ্ণ বর্ণের, ছোটখাটো একজন নারীর প্রেমে পড়েছিলেন। তাদের প্রেমের কাহিনী শুনলে মনে হয় রুপকথার রাজকুমার আর মালিনীর কল্পকাহিনী। আমার জীবনে কি দাদার মতো ভালোবাসার মানুষ আসবে? কে জানে?

তানজিনের সাজানো শেষ; আজ সে মোটামুটি আমাকে কৃষ্ণ বর্ণ থেকে শ্যাম বর্ণের বানিয়ে দিয়েছে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারছি না।
- আপু এবার তোমাকে দেখে পাত্রপক্ষ চোখ ফেরাতে পারবে না দেখো

তানজিনের কথায় আমি নিজেকে দেখতে থাকলাম। আমার চাচী পাশ থেকে বলতে লাগলেন,
- যতই মাখামাখী করো না কেনো পাতিলের তলার কালি উঠানো যায় না গো তানজিন।

চাচীর কথায় মুচকি হেসে উনাকে বলি,
- চাচী, পাতিলের তলার কালি দিয়ে এক কালে কাজলের কাজ করা হতো।

চাচীর মুখটা মিয়ে গেলো। এক মিনিট না দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তানজিন, মেহুলকে রুম থেকে বের করে দিলাম। আজ খুব ইচ্ছে করছে একটা নীল শাড়ি পরতে, গায়ের হালকা ক্রিম কালারের শাড়িটা চেঞ্জ করে মেহুলের একটা নীল শাড়ি পরে নিলাম। মুখের আটা ময়দা সুজি তুলে আমার স্ব রুপকে প্রকাশ করলাম। সত্যি বলতে আমি ক্লান্ত, আমি চাই না কেউ আমার বাহ্যিক দেখে আমাকে পছন্দ করুক। আমাকে আমার মতো করে যদি কেউ ভালোবাসে সেটাই আমার সর্বোচ্চ পাওনা। ঘর থেকে বের হতেই মা হাত চেপে ধরে বললেন,
- কি পরেছিস এটা? পাত্রপক্ষ আসলো বলে!
- মা আগের বারোবার তো তোমার মতো করেই সং সেজেগুজে তাদের সামনে বসে ছিলাম। আমার সত্যি আর ভালো লাগছে না, আমাকে আমার মতো করে থাকতে দাও না। কি হবে বিয়ে না হলে? আমি একজন চাকরিজীবী ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেয়ে, বিবাহিত ট্যাগ ছাড়াও জীবন কাটাতে পারবো।

মা আর কিছু বললেন না, জানি তিনি কষ্ট পেয়েছে কিন্তু সত্যি তো এটাই। চাচু এসে জানালেন তারা এসে পড়েছেন। পাত্র, পাত্রের মা, বাবা, মামা আর বড় বোন এসেছেন। যথারীতি চা নিয়ে তাদের সামনে গেলাম। ছেলের মা আমাকে বসতে বললেন। পাত্রের দিকে এক নজর তাকাতেই বুকে কামড় পড়লো। বেশ না হলে পাঁচ ফুট ১০ তো হবেই উচ্চতা, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের একজন যুবক, বয়স নাকি আঠাশের কাছাকাছি, মুখে খোচা খোচা দাড়ি , সিল্কি চুল গুলো কপালে পড়ে রয়েছে, পরনে কালো রঙের শার্ট আর নেভী ব্লু জিন্স; এক মূহুর্তের জন্য সাউথের হিরোর মতো মনে হলো। ছেলে নাকি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। সম্পর্কটা চাচু এনেছেন, ছেলের বাবা চাচুর কলিগ। বাবার ছেলেকে খুব পছন্দ। বেশকিছুক্ষন কুশলাদি বিনিময়ের পর তাদের মধ্যে কানাগুসা শুরু হয়েছে। এবার ও তার মানে না।শুধু শুধুই আমার সং সাজা হয়েছে ফলাফল শূন্য। কিছুক্ষণ পর ছেলের মা বাবাকে বললেন,
- ভাই, আমরা এখানে কথা বলি। বাচ্চাদের আলাদা কথা বলার একটা সুযোগ হলে মন্দ হতো না। বিয়ে তো ওদের করতে হবে।

বাবার সম্মতিতে আমি তাকে ছাদে নিয়ে গেলাম। আমাদের বাড়িটা বেশ পুরোনা ধাচের। ছাদের প্যাটার্ন আগের কালের মতো। মাজা অবধি রেলিং। কর্ণিশ দিয়ে ফুলের টব দিয়ে সাজানো। আমি রেলিং এর কাছে দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে নজর দিলাম। কি কথা বলবো জানা নেই।
- আপনার নামটা খুব ইউনিক, আশা করি আপনি মানুষটিও খুব ইউনিক হবেন।

উনার কথা শুনে হতবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম, এতো সুন্দর করে কোনো পুরুষ কথা বলতে পারে? প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অন্যদিক ফিরে বলতে লাগলেন,
-তাই আপনাকে আমি কিছু কথা বলতে চাই, লুকানোটা ঠিক হবে না।

আমি জানি এবার ও বিয়েটা কেঁচে যাবে। তাই মুচকি হেসে তাকে বললাম,
- আমি জানি আমাকে আপনার ভালো লাগে নি, পরিবারের মানুষের চাপে এখানে এসছেন। আমাকে বলতে পারেন ইতস্তত হবার কিছুই নেই। আসলে কি বলুন তো, আমার অভ্যাস হয়ে গেছে রিজেকশন পেতে পেতে। এটা আমার জন্য নতুন কিছু না। আশা করি আমাদের কপোকথন শেষ, চলুন নিচে যাওয়া যাক।

উনাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আমি নিচে নামতে লাগলাম। নিচে নামতে থাকলে উহ শব্দ শুনতে পেলাম, পেছনে ফিরে দেখলাম আমাদের ছাদের জং ধরা  দরজায় হাত লেগে হাতের খানিকটা কেটে গেছে তার। গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে। মেহুলকে দিয়ে স্যাভলন আনিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করিয়ে ট্যাপ লাগিয়ে দিলাম। বললাম যাতে টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়ে নেন নয়তো ইনফেকশন হবে। উনি গাঢ় চাহনিতে আমাকে দেখছেন। অস্বস্তি লাগছে, এই চাহনি যে সে চাহনি নয়, তলিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।

উনারা চলে গেলেন। দু দিন কোনো খবর পাওয়া গেলো না। পরিবারের সকলকে বলে দিলাম যাতে আশা না রাখে। দু, দিন, চারদিন করে সপ্তাহ কেটে গেলো। দুপুরে খাবার পর কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম খেয়াল নেই। মাগরিবের আযানে ঘুম ভাঙলো। বাড়িতে খুব হৈচৈ চলছে। প্রথমে মাথাটা হ্যাং হয়ে আসছিলো, এতো কিসের সোরগোল মাথায় আসছে না। ডাকাত পড়লো নাকি?

রুম থেকে বের হতেই বাবার সাথে দেখা, বাবার মুখটা খুব উজ্জ্বল। আমাকে বললেন,
- মৈথি মা, তোমার কি সময় হবে? কিছু কথা বলার ছিলো।
- জ্বী বাবা, আসুন ভেতরে।

বাবা রুমে এসে বসলেন, একটু থেমে বললেন,
- মা, তোমাকে উনাদের খুব পছন্দ হয়েছে। উনারা পরশু এসে আংটি পরিয়ে দিতে চান। উনারা কোনো যৌতুক নিবেন না। তোমার গুনের জন্য তোমাকে তাদের পছন্দ। আকিফ ছেলেটাকে আমারও খুব পছন্দ। ভদ্র ছেলে, অধিক বেতনের চাকরি এখনো পায় নি। তবে পরিশ্রমী এবং সৎ। তোমার আপত্তি থাকলে বলতে পারো, আমি উনাদের মানা করে দিবো।
- বাবা আপনাদের পছন্দতেই আমার পছন্দ।
- মা, এতোদিন তোমাকে সৎ পাত্রে দান করার জন্য আল্লাহ এর কাছে দোয়া করতাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সময়টা খুব তাড়াতাড়ি কেটে গেলো। এই না সেদিন তোমাকে নার্স আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন মেয়ে হয়েছে অভিনন্দন; অথচ দেখো আমার সেই ছোট্ট মেয়েটি এখন অন্যের ঘরে চলে যাবে।

বাবার গলা ধরে এসছে। আমি বুঝতে পারছি তিনি এখন উঠে চলে যাবেন। নিজ রুমে যেয়ে কাঁদবেন, অথচ আমাকে বলবেন চোখের ড্রপ দেবার সময় হয়ে গেছে।
- মা আমার চোখের ড্রপ দেবার সময় হয়ে গেছে আসছি। ও হ্যা, আকিফ এই চিঠিটা তোমাকে দিতে বলেছে।

বাবা চলে গেলেন। বুকের মাঝে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, আকিফ কি এমন লিখেছেন। সেদিন আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন তবে কি সেটাই লিখে জানাতে চাচ্ছেন। কাঁপা হাতে চিঠিটা খুললাম,

 ওহে কাজললতা,
তুমি কি জানো, তুমি বড্ড নিষ্ঠুর। সেই প্রথম দেখায় আমি যে তোমার গোলগোল চশমার পেছনে কাজল ল্যাপ্টানো চোখের মায়ায় নাস্তানাবুধ, অথচ দেখো তুমি যে আমায় চেনোও না। তোমাকে প্রথম দেখি সেই কলেজের গেটে। সাদা কুর্তা, সাদা পায়জায়া পরিহিতা একজন যুবতী, বেনুনি পাশে ফেলে রেখে মাথা সাদা ওড়না দিয়ে ধীর পায়ে হানা দিলে আমার মনে। রোজ তোমাকে একনজর দেখবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতাম গেটে। বন্ধুদের দিয়ে তোমার বাড়ির ঠিকানা বের করলাম। রোজ বিকেলে আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতাম তোমাকে, ছাদের কর্ণিশে পা ঝুলিয়ে মনের সুখে আচার খেতে। একটি সতেরো বছরের যুবতীর মাঝেও একটি বাচ্চা আছে সেদিন জেনেছি। ফেয়ারওয়েলের সময় চাল চেলে তোমার হাত থেকে ফুলের তোড়াটি নিয়েছিলাম। আচ্ছা কাজললতা, তোমার কথা একদম মনে পড়ে না না? মনে আছে, তোমাকে একদিন একটি পিচ্ছি ছেলে একটি প্রেমপত্র দিয়েছিলো। কারোর ফাজলামি ভেবে খুব নিষ্ঠুরতার সাথে চিঠিটা ছিড়ে ফেলেছিলে। তোমার প্রেমিকটি যে আমি ই ছিলাম। কলেজ ছাড়ার আগে তোমাকে মনের কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম মাত্র। তোমার প্রেমিকটি যে বড্ড সেকেলে। তাই সামনে না এসে পত্র দিয়েছিলো। সেদিন থেকে প্রতীজ্ঞা করেছিলাম বিয়ে করলে তোমাকে করবো। তুমি যদি জিদী হও আমি ঢিট। কিন্তু তোমার যোগ্য হতে হতে বড্ড দেরি হয়ে গেলো কাজললতা। তোমায় দেখতে আসার দিন তোমাকে সব বলতেই তো চেয়েছিলাম কিন্তু আবার তুমি আমার কথ না শুনে নিজের মতোই কিছু ভেবে নিলে। রাগ হচ্ছিলো, রাগের বশেই কান্ডটা করে ফেললাম। কিন্তু তোমার মুখের দুশ্চিন্তা দেখে মনে হচ্ছিলো যাক একটু রক্ত বের হওয়া যে স্বার্থক। তোমাকে আজ আবার নিজের মনের কথা বলার জন্য চিঠিটি লিখেছি। আজ ছিড়ে ফেলো না কাজললতা। একটা কথা বিগত সাত বছর যাবৎ মনে নিয়ে বসে রয়েছি আজ বলবো,
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে....

ইতি
তোমার সে।

চিঠিটি হাতে নিয়ে বসে আসি, চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে, লোকটা সত্যি পাগল। আচ্ছা শুরু হোক না তবে একটা নতুন কাহিনী, একটা রুপকথা যেখানে রবে শুধু কাজললতা এবং সে।



***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন