কৃষ্ণচূড়ার দিনে

পড়ুন আসফিয়া ইসলাম জান্নাত'এর লেখা একটি অনু গল্প কৃষ্ণচূড়ার দিনে
কৃষ্ণচূড়ার দিনে
কৃষ্ণচূড়ার দিনে

১!!

 ধূসর আকাশের বুকে কৃষ্ণমেঘের হাতছানি। রাশি ভারি মেঘের পাল্লায় পাল্লায় গর্জে উঠছে অলৌকিক আলোটি। দমকা হাওয়াগুলো তীব্র গতিতে আঁচড়ে পড়ছে গাছের আঁকাবাঁকা ডালে। ঝরে পড়ছে দূর্বল পাতাগুলো। রাস্তার ধারে উঁচু প্রাচীরে উপরপ্রান্তে থাকা কদম ফুলের গাছটি নেতিয়ে পড়েছে প্রায়, ঝুঁকে পড়েছে এইদিকটায়। একটু চেষ্টা করলেই হয়তো নাগাল পাওয়া যাবে তার। এমন সুযোগ সচরাচর আসে না বিধায় রুপ তা লুফে নিতে চাইলো। চটজলদি মুঠোফোনটা ব্যাগে পুড়ে নিয়ে হাত বাড়ালো ফুলগুলোর দিকে। বাতাসের গতি তখনও বেশ, বার বার ঝুঁকে পড়ছে ফুলগুলো নিচের দিকে। হয়তো কদমরাজ আজ নিজেও চাইছেন রুপের হাতে ধরা দিতে তাই তো রুপ কয়েক দফা লাফিয়ে উঠতেই তার হাতের এসে ঠেকলো কয়েক জোড়া কদমরাজ। ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থাকা বস্তু আজ তার হাতের মুঠোয় বন্দী,  ভাবতেই হাসি ফুটে উঠে তার মুখে। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে শূন্যে উড়িয়ে দেয় তার ওড়নার শেষ ভাগ, অবিন্যস্ত করে দেয় চুলগুলো। রুপ দ্রুত একহাতে সবটা সামলে উঠার বৃথার চেষ্টা করে। মিনিট দুই-এক যেতেই বিস্তৃত আকাশের বুক চিরে নেমে পড়ে এক পশলা বৃষ্টি। ক্ষণেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে খোলা আকাশের নিচে থাকা মানুষজন, ছুট দেয় ছাউনির উদ্দেশ্যে। রুপও দৌড়ে একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে উঠে,

-- শালার বৃষ্টি আর নামার সময় পেল না। বাসায় তো যেতে দিতি, তারপর না-হয় নিজের লীলাখেলা দেখাতি। 

কথাটা বলেই পায়ের ধারে থাকা ছোট ইটের টুকরাটা পায়ে ঠেলে ছুঁড়ে মারে পিচঢালা রাস্তার উপরে। মুহূর্তেই এক গাড়ি সেই ইটের উপর হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে যায়। রুপ সেইদিকে আর তোয়াক্কা না করে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে বৃষ্টি থামার।
আধা ঘন্টা এই আশাতেই অতিবাহিত করার পরও যখন বৃষ্টি থামার কোন নাম গন্ধ দেখা দিল না, তখন রুপ বিরক্তিতে 'চ' উচ্চারণ করার মত শব্দ করলো। তার বাসা এইখান থেকে পাঁচ মিনিটের দুরত্বেই, তাই সিদ্ধান্ত নিল এক দৌড়েই সেখানে গিয়ে উঠবে। অন্যথায় এইখানেই রাত পার করতে হবে। ফুলের মুঠোটা শক্ত করে ধরে এক দৌড় দেয় সে বাসার উদ্দেশ্যে। প্রায় এক দৌড়েই এসে সে পৌঁছায় বাসার মেইন গেটের সামনে। গেটের ভিতর ঢুকে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলো সে। তার গা বেয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। সিক্ত চুলগুলো এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে চেহেরায়। রুপ দ্বিতীয় বারের মত বিরক্তিতে 'চ' উচ্চারণ করার মত শব্দ করে উঠে, চুলগুলো আলতো হাতে টেনে কানের কাছে গুঁজে নিয়ে জামা-কাপড় হালকা ঝেড়ে নেয়। গায়ে জড়ানো সাদা এপ্রোণটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে একনজর বাহিরে তাকায়, সময়ে সাথে সাথে বৃষ্টির প্রকট বেড়েই চলেছে। যে অবস্থা, ভোর হওয়া অব্দি থামবে বলে মনে হচ্ছে না।
বাকি আট-দশটা মেয়ের মত, রুপ এতটা বৃষ্টি প্রিয় মানুষ নয়। বরাবরই তার বৃষ্টি অপ্রিয়। তার মতে বৃষ্টি খালি মানুষের জন্য মুসিবতই বয়ে আনে, এইটা কখনোই কারো জন্য সুখকর বস্তু হতে পারে। মানুষ যে কিভাবে বৃষ্টি পছন্দ করতে পারেই তাই বুঝে উঠতে পারে না সে। আরেক দফা বৃষ্টিকে গালমন্দ করে রুপ সিড়ি ভেঙে উপরে যেতে শুরু করে। 

দরজার সামনে এসে তাতে তালা ঝুলিয়ে থাকতে দেখে রুপের ভ্রু কুঁচকে আসে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকার পর তার মনে পড়ে, দুপুরের তার মা ফোন জানিয়েছিল সে তার ছোট ভাইকে নিয়ে তারা নানাবাড়ি যাচ্ছে। নানুমা নাকি খুব অসুস্থ, তাই বাসার চাবি পাশের বাসার নিপা আন্টির কাছে রেখে যাচ্ছে। রুপ তখন রওসান স্যারের ক্লাসে ছিল বিধায় কোনমতে হ্যাঁ, হু বলে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। তাই কথাটা একদমই তার মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে, ব্যাগ থেকে মুঠোফোনটা বের করে একবার টাইম দেখলো। ঘড়িতে নয়টা অধিক বাজে। আজ এক্সট্রা কিছু প্রেকটিক্যাল ক্লাস ছিল বিধায় তুলনামূলক বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছে। রুপ মুঠোফোনটা ব্যাগে পুড়ে নিয়ে হাঁটা দেয় পাশের বাসার দিকে৷ দ্রুত গতিতে পরপর তিনবার কলিংবেলটা চেপে ক্ষান্ত হয় সে। ভাব ভঙ্গি দেখে বুঝাই যাচ্ছে, তার তাড়া আছে বেশ। আর হবেই বা না কেন? তার শরীর যে ইতিমধ্যে শিথিল হতে শুরু করে গিয়েছে৷ দাঁড়িয়ে থাকাটাই তো দায় হয়ে এসেছে। 
 দরজা খুলছে না দেখে রুপ আবার কলিংবেলটা চাপলো। এইবার প্রায় সাথে সাথেই দরজাটা খুলে যায়। রুপ নজর তুলে তাকাতেই দরজার ওপাশে উদোম গায়ে দাঁড়ানো এক কৃষ্ণমানবকে দেখে থমকে দাঁড়ায়৷ গা-টা কেমন শিরশির করে উঠে। কৃষ্ণমানবটি পরিধানে আকাশি কালার শর্টস বাদে কিছুই নেই। গলার দুই ধার দিয়ে ঝুলছে ফিনফিনে এক কালো রঙের ইয়ারফোনটি। মুখে তার খেলা করছে অন্যরকম মাধুর্য। রুপ বার কয়েক পল্লব ফেলে, বিমূঢ় দৃষ্টিতে দেখতে থাকে মানবটিকে। একধ্যানে, একমনে। সামনে দাঁড়ানো এলোকেশী কন্যার এমন দৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে মানবটি একটু বিব্রতবোধ করলো। উপরন্তু,  মেয়েটিকে সে আদৌ চিনে বলে মনে করতেও পারছে না। এই বৃষ্টিমুখর দিনে তার দরজায় এসে কি চায় সে? ক্ষণে সে গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলো,

-- আপনার কি কিছু চাই মিস?

মানবটির অনুরাগহীন কন্ঠটি শুনে রুপের ধ্যান ভাঙ্গলো। সে জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁটযুগল ভিজিয়ে নিয়ে ইতস্তত সুরে বললো,

-- না মানে, আন্টি আছে কি?

মানবটি একটু সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো রুপের দিকে। উপর থেকে নিজ পর্যন্ত নজর বুলালো। ভিজে আসার ফলে রুপের কামিজটা প্রায় আঁটসাঁট হয়েই লেপ্টে আছে রুপের গায়ে, রুপ ওড়না দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে ঢেকে নিলেও বেশ কিছু স্থান এখনো স্পষ্ট। হঠাৎ নিষিদ্ধ এক জায়গায় মানবটির চোখ এসে স্থির হতেই দ্রুত সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,

-- মা, বাসায় নেই। পরে আসেন। 

কথাটা বলে দ্রুত দরজা দিতে নিলে রুপ চেঁচিয়ে উঠে,

-- আরেহ! আমি বাসায় যাব কিভাবে তাহলে?

কথাটা শুনে মানবটি থমকায়। ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতেই তাকায় রুপের পানে। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করে,

-- মানে?

-- আমার বাসার চাবি তো আন্টির কাছে। দুপুরে মা গ্রামে যাওয়ার আগে, তালার চাবিটা এইখানে রেখে গিয়েছিল। এখন চাবি ছাড়া আমি বাসায় ঢুকবো কি করে? 

এক নিঃশ্বাসেই কথাগুলো বলে দম নিলো রুপ। মানবটি দরজার ধারেই বিরাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। বুঝতে পারলো, মেয়েটি তাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। কিন্তু তারা এইখানে শিফট হলো কবে কে জানে? মানবটির থেকে কোন প্রকার টু শব্দ না পেয়ে রুপ এইবার তার নাম ধরে সম্মোধন করলো,

-- তনয় ভাইয়া! শুনছেন?

মানবটি এইবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-- মা বিকেলের পর পরই এক আত্মীয় বাসায় গিয়েছে। এশারের আযানের পরপর ফিরার কথা হলেও এখন পর্যন্ত ফিরে নি। কখন ফিরবে আমি জানি না। আর আমাকে সে কোন চাবি-টাবি দিয়ে যায়নি। 

রুপ মুখ ছোট করে, ইতস্তত সুরে বলে,

-- আন্টি তো মনে হয়-না চাবি নিয়ে গিয়েছে। বাসাতেই থাকার কথা। একবার একটু ফোন করে দেখবেন, চাবিটা সে কোথায় রেখে গিয়েছে। 

তনয় প্রত্যুত্তর করে না, আনমনে বলে, "যত মেয়েলীদোষ থেকে দূরে থাকতে চাই, ততই এইটা শনির মত কপালে চেপে বসে৷ মাইরি, কপাল আমার।"  বিরাগী নিঃশ্বাদ ফেলে পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে কল দেয় সে তার মায়ের নাম্বারে। কিন্তু ফোন অপরপাশ থেকে সুরেলা কন্ঠে বলা,  "আপনি যে নাম্বারে ডায়াল করেছেন তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে" উক্তিটি শুনে তনয়ের চেহেরার আবির্ভাব বদলে যায়। ফ্যাকাশে হয়ে আসে মুখটি। সে পরপর চারবার ফোন দেওয়ার পরও যখন একই ধ্বনি পুনরাবৃত্তি হলো তখন সে রুপের দিকে তাকিয়ে থমথমে মুখে বললো,

-- মায়ের ফোন বন্ধ বলছে?

রুপের ইতিমধ্যে কাঁপন ধরতে শুরু করে দিয়েছিল। সে দু'হাত দিয়ে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন অবস্থায়, তনয়ের কথা শুনে রুপ বিবর্ণমুখে তাকালো। বলল,

-- এখন?

তনয় কিছুটা গা-ছাড়া ভাব নিয়েই বললো,

-- আমি কি জানি? 

রুপ এতে একটু অসন্তুষ্ট হলো বটেই, কিন্তু প্রকাশ করলো না। অজানা এক মানবের নিকট কি বাই আশা রাখবে সে? রুপ কোন প্রকার দ্বিরুক্তি না করে, ঘুরে দাঁড়ালো। হাঁটা দিল নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। সেখানেই তাকে বসে অপেক্ষা করতে হবে, এছাড়া উপায় কি? এই বাসায় এসে উঠেছে একমাস হবে বোধহয়। তেমন কারো সাথেই সখ্যতা হয়ে উঠেনি তার, একবারের জন্য যায়ও নি অন্যকোন ফ্ল্যাটে। এক নিপা বেগম তাদের প্রতিবেশি বলেই বার দুয়েক যাওয়া-আসা হয়েছিল। তাই সে যেহেতু নেই, সেহেতু তার যাওয়ার মত কোন জায়গায়ও নেই।

 রুপকে এইভাবে যেতে দেখে তনয় কিছুটা সময় ভাবলো। অতঃপর কোন ভূমিকা ছাড়াই গলা উঁচিয়ে  বলে উঠে,

--  আপনি চাইলে ভিতরে এসে অপেক্ষা করতে পারেন, মিস। 

২!!

--  আপনি চাইলে ভিতরে এসে অপেক্ষা করতে পারেন, মিস।

কথাটা কর্ণগোচর হতেই রুপ থমকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় তনয়ের দিকে। তার ভাব-ভঙ্গি প্রায় স্বাভাবিকই, দৃষ্টিও শীতল। রুপ কিছু প্রহর চুপ থেকে অস্ফুটস্বরে বলে,

-- না, থাক। 

তনয় হয়তো রুপের সংশয়টা বুঝতে পারে। তাই বিষয়টা সহজ করতে সে নিজ থেকেই বলে উঠে, 

-- আপনি যেমনটা ভাবছেন, তেমন কিছুই না।
 পরিস্থিতি যা, বাহিরে থাকলে নির্ঘাত কোন অঘটন ঘটাবেন। তাই, ভিতরে আসতে বলেছি। 

রুপ কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকাতেই তনয় নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে গলা ঝেড়ে বলে,

-- বুঝদার মানুষের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। আশা করি, আমাকে ভেঙে কিছু বলতে হবে না। 

রুপ কথাটার ধাঁচ ধরতে পেরে একপলক নিজের দিকে তাকায়। পরক্ষণে নিজের ওড়নাটা গায়ে আরও ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে শীতল কন্ঠে বলে,

-- ভিতর যে বাহিরের মত বিপদজনক নয় তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? নিরাপদতা তো দুই জায়গাতেই বিলাসিতা। 

রুপের কথা শুনে তনয় থমকায়, নয়ন দু'টির অক্ষিকাচে অপার বিস্ময়তা নিয়ে তাকায় রুপের পানে। কতটা সাবলীলভাবেই মেয়েটা তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেললো। পরোক্ষভাবেই বুঝিয়ে দিল, সে বিশ্বাস করে না কাউকে। কথা বলার ধাঁচও কি সূঁচালো। নিজের ঊনত্রিশ বছরের জীবনে এমন ধাঁচের মেয়ে তনয় খুব কমই দেখেছে। কিন্তু, এই মুহূর্তে সে তার এই রুপে অভিভূত হতে পারছে না, উল্টো রাগে তার শরীর রি রি করছে। রাগ হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু না, অহেতুক নিজের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠলো যে কেউ রাগবেই। তনয় নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে নিজের রাগ সংযত করার ক্ষীণ চেষ্টা করে, তিক্ত কন্ঠে বলে,

-- নিউটন ব্যাটা ঠিকই বলেছে, 'For every action, there is an equal and opposite reaction.' কারো জন্য ভালো করো বা ভাবো দিনশেষে খারাপের ট্যাগটা নিজের ঘাড়ে এসেই চাপে। ধ্যাৎ!

রুপ থমথমে দৃষ্টিতে তনয়ের দিকে তাকায়, এক মুহূর্তের জন্য ভাবলো অতিরিক্ত করে ফেলেছে কি-না। না ভুল বলেনি সে, কিন্তু তাও কথাটা হয়তো সে একটু বেশি রুড হয়ে বলেছে, তাই পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করতে ইতস্তত সুরে বলে,

-- বিষয়টা তেমন নয়। আসলে, খালি বাসায়..

অর্ধেক কথাটা বলেই রুপ চুপ করে যায়, সম্পূর্ণ কথাটা শেষ করতে তার কেমন জড়তা কাজ করছে। তনয় অন্যদিকেই মুখ করে রেখেই বলে,

-- বিষয় এমন হোক আর তেমনই হোক। কারো বাহির দেখে কখনো কাউকে জার্জ করা ঠিক নয়। এই রাইট আপনাকে কেউ দেয়নি। 

রুপ কথা বাড়ালো না। এতক্ষণে মানবটি কথার ধাঁচেই রুপ বুঝে গিয়েছে, মানবটির আত্মাদর প্রচন্ড প্রখর। সে যেমনই হোক খারাপ না। উপরন্তু, পরিস্থিতি এখন যা এই মানুষটি বাদে তাকে সাহায্য করার মতও কেউ নেই৷ শরীর তো ইতিমধ্যে জবাব দিতেও শুরু করে দিয়েছে। এইভাবে বাহিরে থাকলে হয়তো ফিট-ফাট হয়ে লাশও হয়ে যেতে পারে। তাই সে কথা মিটমাট করার উদ্দেশ্যে মিনমিনে স্বরে বলে উঠে, "ওকে, সরি! "

তনয় একনজর রুপের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে দরজা বন্ধ করে দিতে নেয়, রুপ তা দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠে, 

-- আরেহ! 

তনয় আবার থমকায়। ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায় রুপের দিকে, "আবার কি?"

রুপ দুই হাত একত্রে করে ঘর্ষণ চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, দৃষ্টি অবিন্যস্ত রেখেই ইতস্তত করে বলে,

-- না মানে..

রুপের হাবভাব দেখেই বুঝা যাচ্ছে, সে তার মত পাল্টিয়েছে কিন্তু বলতে দ্বিধাবোধ করছে৷ তনয় এইবার ভালো করে তাকালো, রুপ একটু আঁটসাঁট হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। মুখ-চোখ  কেমন নীল বর্ণ ধারণ করেছে। শরীরও বোধহয় মৃদু পরিমানে কাঁপছে। বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক না। তনয়ের একটু মায়া হলো, রাগটা একধাপ নিভলো ঠিকই কিন্তু গেল না। আনমনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, " এই নারীজাতি, ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না।" পরক্ষণে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তীক্ষ্ণ কন্ঠেই বলে,
"আসেন!"

রুপ প্রথমে একটু সংকোচবোধ করলেও পরবর্তীতে এক-দুই পা এগিয়ে যায়। রুপকে আসতে দেখে তনয় আগে-ভাগেই দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। রুপ ভেজা জুতোজোড়া খুলে রেখে ঢুকে পড়ে ভিতরে। ড্রয়িংরুমের সামনে এসে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। তনয়ও দরজা ভিজিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসে, "দরজা লক করিনি, খোলাই আছে।" 

কথাটা শুনে রুপ চোখ তুলে তাকায় তনয়ের দিকে। তনয়ের কথার মাঝে কিছুটা তাচ্ছিল্য ভাব ছিল। আর সেটা কেন ছিল তা রুপ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে, কিন্তু তাও সে প্রত্যুত্তর করলো না। পুনরায় নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সেই একই জায়গায়। সারা শরীর ভেজা হওয়ায় কোথাও গিয়ে বসার ইচ্ছা হলো না তার। তনয় রুপের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল, টি-টেবিলের পুরোটা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্র কাগজ। তনয় সেগুলোই এখন গুছাচ্ছে। মৃদু গতিতে ফ্যানের পাখা ঘুরছে, কিছু কাগজ মাটিতেও গড়াগড়ি খাচ্ছে। রুপ নিষ্প্রভ চোখে সবটাই দেখছে। জামা থেকে এখন আর পানি পড়ছে না, সিক্ত ভাবটা শুষে নিচ্ছে শরীর। শিথিল হয়ে পড়ছে স্নায়ুগুলো, হিমশীতলতা চলাচল করছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফ্যানের মৃদু বাতাস কাঁপন ধরাচ্ছে শরীরে। শুধু দাঁতে দাঁত লেগে আসাটাই বাকি বোধহয়। রুপ থাকতে না পেরে বলল, "ফ্যানটা বন্ধ করা যাবে?"

তনয় একপলক রুপের দিকে তাকালো৷ রুপের বর্তমান অবস্থা আঁচ করতে পেরে দৃষ্টি নামিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, "তা না-হয় করা যাবে,মিস। কিন্তু আপনি কি এইভাবেই ঘন্টা খানিক থাকতে পারবেন? মা তো মনে হয় না বৃষ্টি থামার আগে আসবে।" 

রুপ মুখ ছোট করেই বলে, "জানি না।"

তনয় কাগজ গোছাতে গোছাতে বলে, 

-- চাইলে মায়ের রুমে গিয়ে চেঞ্জ করতে পারেন, মার কাপড় আছে সেখানে। 

-- না! না! থাক দরকার নেই৷ 

অকপটেই বলে উঠলো রুপ৷ তনয় পুনরায় একপলক রুপের দিকে তাকিয়ে বলে, " আর ইউ সিউর? ফরমালিটি করতে গিয়ে শহীদ হয়ে যেয়েন না আবার। অবশ্য, শহীদ হলেও এরপর আসামী আমাকেই হতে হবে।"

সরাসরি খোঁচা মেরেই কথাটা বলল তনয়। রুপ একটু ইতস্তত করলেও প্রত্যুত্তর দিল না। সেখানে দাঁড়িয়ে দু'হাত মুঠোয় পুরে ঘর্ষণ চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, অবস্থা যে শোচনীয় তা কিন্তু নয়। ইতিমধ্যে প্রবলবেগে হাঁচির দলেরা আক্রমণ করতে  শুরু করে দিয়েছে, একটু পর হয়তো সর্দি-জ্বরও সঙ্গ দিতে চলে আসবে অসুখ পরিবারের সদস্য হতে। তনয় বলল,

-- আমাকে আসামী বানানোর ফন্দী না এঁটে যান গিয়ে চেঞ্জ করে নিন। 

রুপ মিইয়ে যাওয়া স্বরে জিজ্ঞেস করে, "রুমটা কোনদিকে?"

-- বা দিকের রুমটা মার, ওয়ারড্রব খুললে জামাকাপড় পেয়ে যাবেন। আর রুমেই ওয়াশরুম আছে। 

রুপ মাথা দুলিয়ে, হাতে থাকা কদম ফুলগুলো সোফার উপর রাখে। কাঁধের ব্যাগটা সোফার পাশেই মেঝেতে রেখে চলে যায় রুমটির দিকে। রুমে গিয়েই দরজা আঁটকে দিল রুপ, তা দেখে তনয় বিরবির করলো, "সেই তো ঘুরে ফিরে আমার কথাই শুনলো, হুদ্দাই এতক্ষণ ঢঙ করলো।"

ক্ষণে কদম ফুলের দিকে নজর যেতেই তার ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে, সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় সেদিকে। অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে টেবিলের উপর থেকে কাগজপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে চলে যায় রুমে। 

অর্ধাংশ প্রহর গড়াতেই রুপ ছোট ছোট পায়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। গায়ে তার কুচি বিহীন শাড়ি, কোনমতে তিন-চার প্যাঁচ দিয়ে পড়েছে সে। সাথে বেমানান রঙের ব্লাউজ, যা কি-না মিনিট দুই-এক যেতেই কাঁধ থেকে গড়িয়ে পড়ছে নিম্নের দিকে। তিন-চারটে সেফটিপিন মারার পরও ঢিলে রয়েই গিয়েছে। নিপা বেগমের স্বাস্থ্য বেশি নাহলেও রুপ তুলনামূলক একটু রোগা-সোগা, তাই এই অবস্থা। উপরন্তু, নিপা বেগম সর্বদা শাড়িই পরিধান করেন বলে, রুপ বাধ্য হয়ে শাড়িই পড়লো। রুপ পিছন থেকে আঁচলটা টেনে সামনে আনলো, ভালোভাবে জড়িয়ে নিল গায়ে। ড্রয়িংরুমে আসতে দেখা মিললো তনয়ের, ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে সে। রুপ একটু এগিয়ে যেতে তনয় ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে তাকায়, রুপের বেহাল অবস্থা দেখে পেট ফেটে হাসি পেলেও তা চেপে বসে রইলো। ঠোঁটের কোনে দেখা দিল সরু এক হাসি রেখা। কার্টুন লাগছে মেয়েটিকে। মেয়েটি হয়তো শাড়ি পড়তে জানে না বা কুচি করতে। 
 রুপ এদিক-সেদিক বেশি না তাকিয়ে চুপচাপ গিয়ে বসে তনয়ের বিপরীতমুখী সোফায়। একপলক তাকালো তার দিকে, উদোম গা এখন ঢাকা পড়েছে বাদামী টি-শার্টের অন্তরালে। দৃষ্টি নামালো রুপ, সোফার কিনার থেকে ব্যাগটা টেনে এনে ফোনটা বের করলো। ব্যাগটা ওয়াটারপ্রুফ হওয়ায় বই আর ফোন দু'টোয় শুষ্ক আছে। একবার সময় দেখলো, দশটা বাজে প্রায়। ড্রয়িংরুমের উত্তর দিকে থাকা বারান্দার দিকে তাকালো সে, সামনে থাইগ্লাস থাকায় নিজের প্রতিবিম্ব বাদে দেখা গেল না কিছুই৷ বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দ  আর অকস্মাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর ফলে শুধু আঁচ করা গেল, বর্ষণের লীলাখেলা এখনো চলছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুপ, রাতটা আজ কত দীর্ঘ হয় কে জানে?

বৈঠকখানা জুড়ে পিনপতন নীরবতা। দুই পৃথক সত্তার মানুষ মগ্ন আপন কর্মে। কেউ কাজে ব্যস্ত তো, কেউ কাউকে দেখতে। কিন্তু শব্দ নেই কারো মুখেই।  তনয় কাজ শেষে ল্যাপটপ অফ করে পাশে রাখলো, তাকালো রুপের দিকে। মুহূর্তেই দুইজনের দৃষ্টি এক সুতোয় এসে মিলিত হতে, রুপ দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তনয় বিষয়টা আমলে না নিয়ে বলে, 

-- আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে মিস?

রুপ না-সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে, "না।"

তনয় কোন ভূমিকা ছাড়াই বলে উঠে, "তাহলে এতক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছিলেন? এম আই টু হ্যান্ডসাম?"

রুপ এইবার খানিকটা থমথম খেয়ে যায়। তনয় যে সরাসরি এমন কিছু বলে বসবে তা ভাবনারও বাহিরে ছিল তার। কান গরম হয়ে আসলো রুপের, সে কোনমতে বলে উঠলো, 

-- তেমন কিছুই না। আমি তো..তো..  এমনি। 

তনয় এইবার শব্দ করে হেসে উঠে। ঠোঁটের কোনে সেই হাসিটুকু বুজিয়ে রেখেই বলে,

-- স্বাভাবিক হন, মজা করছিলাম। 

  তার চুরি যে ধরা পড়েনি তা ভেবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। অতঃপর বলল,

-- আন্টির ফোন কি এখনো অফ তনয় ভাইয়া?

-- আপনি আসার আগে দিয়েছিলাম, তখনও অফই ছিল৷ 

-- অহ আচ্ছা। 

-- আপনি এইখানে নতুন?

-- হ্যাঁ,  একমাস হলো আমরা এইখানে শিফট করেছি।

তনয় রুপের দিকে তাকিয়ে বলে,

-- তাই আমি প্রথমে চিনতে পারি নি আপনাকে। তা আপনি কি আমায় আগে থেকে চিনতেন? সে সময় নাম ধরেই তো সম্মোধন করলেন। 

রুপ মাথা নিচু করে বলে,

-- চিনি বলতে, এক দু'বার দেখেছিলাম আপনাকে। আর আন্টির মুখে আপনার নাম শুনেছিলাম। 

-- আপনি আমার নাম জানলেও, আপনার নাম কিন্তু এখনো আমার অজানা মিস?

-- রুপকথা! আপনি এই নামেই ডাকতে পারেন। 

তনয় ঠোঁট নাড়িয়ে নামটা উচ্চারণ করলো,

-- রুপকথা! তা আপনি কি কাল্পনিক নাকি বাস্তবিক রুপকথা?

রুপ হেসে বলে, 

-- কাল্পনিক কিছুর বাস বাস্তবে না হলেও, মানুষ কিন্তু বাস্তবিকই হয়। 

তনয় প্রত্যুত্তর না করে কিঞ্চিৎ হাসে। কৃষ্ণবর্ণের অক্ষিকাচে খেলা করে যায় অন্যরকম মাধুর্য। যা সাধারণের মাঝেই ছড়িয়ে দেয়, কিঞ্চিৎ অসাধারণের ছোঁয়া। রুপ দ্রুত দৃষ্টি নামালো। এই দৃষ্টির মাধুর্যে সে বহু আগেই আহত হয়েছে, আজ পুনরায় হলো।  নীরবতা ভেঙে তনয় আবার বলে,

-- আপনি মনে হয় মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, রাইট?

-- হ্যাঁ, তৃতীয় বর্ষে পড়ছি। 

-- অহ!

এরপর আবার নীরবতা। প্রতিবারের মত এইবারও তনয় এই নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠলো,

-- চা খাবেন মিস রুপকথা?

রুপ চোখ তুলে তাকায়। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঘটলো এক অঘটন। রুপের কাঁধ থেকে ব্লাউজের কাঁধটা গড়িয়ে পড়লো নিম্নের দিকে। তনয় দ্রুত অন্যদিকে ঘুরে নিজের দৃষ্টি সরালো, কিছু না বলে উঠে সোজা হাটা দিল রান্নাঘরের দিকে। কথার বলার সময় কখন যে হাত থেকে আঁচল ছুটে গিয়েছিল তা রুপ বুঝতেই পারেনি। বুঝতে পারলে হয়তো এই অপ্রীতিকর পরিবেশে সৃষ্টি হতো না। রুপ ব্যস্ত হলো নিজেকে ঠিক করতে। তখনই উচ্চস্বরে ট্রান্সমিটার ব্লাস্ট হওয়ার শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো, মুহূর্তেই কারেন্ট গেল চলে। পুরো নগরী ডুব দিল আঁধারের গহীনে। রুপ বিরবির করলো,

-- শালা কারেন্টের বাচ্চা, আমার সাথে মীরজাফর গিরি করলি? আরেকটু আগে গেলে কি হতো? আমার মান-ইজ্জত সব ডুবাইয়া গেলি তুই। বেদ্দব একটা!

৩!!

আঁধার রাত্রিতে ডুবিত নগরী, বর্ষনের ধারা তখনও বইছে।  পিনপতন নীরবতার মাঝে অকস্মাৎ অকস্মাৎ গর্জে উঠছে মেঘ, আকাশে ভাসমান পুঞ্জমেঘের ফাঁকে ফাঁকে দেখা মিলছে ক্ষণপ্রভার আলো৷ কিঞ্চিৎ পরিমাণ আলো বারান্দার তীর সীমানায় এসে গড়াগড়ি খেয়ে পুনরায় ফেরত যাচ্ছে। ড্রয়িংরুমের এক কোনে টিমটিম করে জ্বলছে চার্জার লাইটটি, যেকোন সময় হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘসময় অযত্নে ফেলে রাখার দরুন এই দোষা। সোফার ধার ঘেষে আঁটসাঁট হয়ে বসে আছে রুপ, বার বার হাঁচি দিয়ে উঠছে সে। আবছা আলোয় ফুটে উঠেছে তার রক্তিমা মুখটি। জড়তা ও সংশয়ে কুঁকড়ে মরছে সে, তার বাইশ বছরের জীবনে এতটা অপ্রীতিকর ও লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পূর্বকালে কি ইহকালেও পড়েনি কখনো। রুপ পারছে না তো মাটি দুইভাগ করে তাতে লুকিয়ে পড়তে।
রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে, তনয় ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় চা বানাচ্ছে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই চা তৈরি হয়ে যায়। তনয় চায়ের ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখে একটা কাপ তুলে এগিয়ে দেয় রুপের দিকে, "নেন!"

 রুপ কোন রকম ভণিতা না করে নিঃশব্দে চায়ের কাপটা নিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ নীরব বসে থেকে আনমনে কিছু ভাবতে থাকে সে। আনমনা হয়েই ছোট এক চুমুক বসায় পেয়ালাতে, তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় পরমুহূর্তেই জিহ্বা পুড়ে যায় তার। দহনযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চাপা চিৎকার করে উঠে রুপ। দ্রুত চায়ের কাপটা কাছ থেকে সরাতে নিলে নড়বড়ে যায় খানিকটা, একাংশ চা ছিঁটকে পড়ে ধবধবে সাদা মেঝেতে। তনয় তৎক্ষনাৎ বলে উঠল, 

-- আরেহ আস্তে!

রুপ এইবার সম্পূর্ণই মিইয়ে যায়, একের পর এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলার দায়ে লজ্জায় নাক কাটা যাচ্ছে তার। যার নিকট সে নিজের প্রতিচ্ছবি মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করতে চেয়েছিল, তার সামনেই নিজের ইজ্জত একদন ফালুদা করে বসে আছে। এরচেয়ে বেদনাদায়ক অনুভূতি কি পৃথিবীতে আর দুটো আছে? রুপ দুই হাতের মুঠোর মাঝে শাড়ির আঁচলটা মোচড়াতে মোচড়াতে বলে, "সরি!"

তনয় শান্ত কন্ঠেই বলে, " শান্ত হন মিস রুপকথা। মাঝে মধ্যে হয় এমন, ব্যাপার না।" 

রুপ প্রত্যুত্তর না করে গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। এমন সময়, চার্জার লাইটটি ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে একবারের জন্য ঘুমিয়েই পরে। ফেলে দেয় দুইটি মানব ও মানবীকে আঁধারের রাজ্যে। রুপ ও তনয় দুইজনই হতবিহ্বল দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো, অবশেষে এইটাই হওয়া বোধহয় বাকি ছিল। তনয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-- আমি ফ্ল্যাশলাইট চালাচ্ছি দাঁড়ান। 

রুপ চটজলদি বলে উঠলো,

-- না থাক, অন্ধকারই থাকুক। আলো ভালো লাগছে না। 

রুপ চাইছিল না, তার অস্বস্তি ভাবটা তনয় ধরে ফেলুক। উপরন্তু, তার এখন যেই অবস্থা চোখ তুলে তাকানোটাই দায় সমান তাই সে ইচ্ছে করেই বললো আলো না জ্বালাতে। তনয়ও কথা না বাড়িয়ে ছোট করে বলল, "আচ্ছা।"

সময়ের সাথে সাথে অন্ধকারাচ্ছন্নটা খানিকটা কেটে গেল, অন্ধকারের নিজস্ব আলোয় ফুটে উঠলো দুটো মানুষ অবয়ব। মাঝে মধ্যে ক্ষণপ্রভার কিঞ্চিৎ আলো রুমে বিচরণ করে যেতেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে দুইজনের ভাবভঙ্গি। তনয় চায়ের কাপে ছোট একটা চুমুক  দিয়ে  বললো, 

-- বললেন না তো চা কেমন হয়েছে?

কথাটা শুনে খানিকটা ভড়কালো রুপ, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "জি, ভালোই।" 

-- শুধু ভালো?

রুপ এইবার হেসে বললো, "না, অনেক ভালো।"

তনয় প্রত্যুত্তর না করে কিঞ্চিৎ হাসলো। মূলত এই গুমোট পরিবেশকে স্বাভাবিক করতেই চায়ের প্রসঙ্গটা তুলা। রুপও বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছিল বিধায় অন্য কিছু ভাবলো না। অন্যথায় যে কেউ ভাবতো, "এই মানুষটা কেমন? যেচেই নিজের প্রশংসা শুনতে চাইছে?" 
চা খাওয়া শেষে রুপ একটু ভালোবোধ করলো, এতক্ষণ প্রচন্ড শীত করছিল তার। রুপ বারান্দার দিকে তাকালো। থাইগ্লাসটা স্বচ্ছ এখন, ওপাশের দৃশ্য স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত আকাশটি। মিনিট দুই-এক গড়াতেই ডেকে উঠছে মেঘ, ক্ষণপ্রভার আলোয় দেখা যাচ্ছে দূরে অবস্থিত কৃষ্ণচূড়া গাছটি। আগুনের রক্তিমায় রঞ্জিত কয়েকটা কৃষ্ণচূড়ার গোছা বাতাসের দোল খেয়ে এসে পড়লো তাদের তীর সীমানায়। রুপ উঠে দাঁড়ালো, কোন দিক খেয়াল না করে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। তনয় পিছন থেকে বেশ কয়েকবার রুপকে জিজ্ঞেস করলো সে কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু রুপ প্রত্যুত্তর করলো না। অগত্যা, তনয়ও উঠে দাঁড়ালো, পিছু নিল রুপের। রুপ থাইগ্লাসের দরজাটা খুলে বারান্দায় প্রবেশ করলো, রেলিং না থাকায় বৃষ্টির ছাঁটা আসছে বেশ। ভিজিয়ে দিচ্ছে রুপকে। রুপ সেদিকে তোয়াক্কা না করে চট করে সাদা মেঝের উপর ছড়ানো রক্তিমা ফুলের একটি গোছা হাতে তুলে নিল। সে আরও একটা গোছা তুলতে যাবে তার আগেই তার বা হাতে টান পড়ে। নিজেকে সামলাতে না পেরে পিছিয়ে আসে সে, তখনই এক শক্তপোক্ত হাতের মালিক তাকে আগলে নেয়। রুপ কিছু বুঝে উঠার আগেই মানবটি তাকে টেনে নিয়ে আসে বারান্দা থেকে,লাগিয়ে দেয় দরজটা। পরক্ষণেই মানবটি সরে দাঁড়ায়। অতঃপর গলা খেঁকিয়ে বলে,

-- আপনি পাগল মিস রুপকথা? একবার বৃষ্টিতে ভিজে কি মন ভরে নি আবার চলে গিয়েছেন বৃষ্টিতে ভিজতে? এতক্ষন যে শীতে মৃগী রোগীর মত কাঁপছিলেন তা কি ভুলে গেলেন?

শেষের কথায় রুপ একটু অপমানিতবোধ করলেও কিছু বলল না। নিম্ন স্বরে বলল,

-- বৃষ্টিতে ভিজতে না, ফুল আনতে গিয়েছিলাম। 

কথাটা বলেই ডান হাতটা উঁচু করে ফুলটা দেখালো রুপ। অন্ধকারে তা স্পষ্ট বুঝা না গেলেও তনয় বেশ  অবাকই হলো। সে ঠিক শুনেছে কি-না তা নিশ্চিত করতে আবার জিজ্ঞেস করলো, "ফুলের জন্য?"

রুপ মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল, "হ্যাঁ!"

তনয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো, এই মেয়ে যে আস্ত ফুল পাগল তা বুঝা হয়ে গিয়েছে তার। আগে হাতে ছিল কদম, এখন কৃষ্ণচূড়া। তনয় কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল,  "ফুল বুঝি আপনার বেশি প্রিয়?"

রুপ উৎফুল্ল কন্ঠেই উত্তর দিল," অনেক! "

-- কদম ফুলগুলো কে দিয়েছে? বিএফ?

রুপ এক মূহুর্তের জন্য থমকালেও, পরমুহূর্তে চট করে বলে উঠল,

-- আমার কোন বিএফ নাই, কদমগুলো আমি নিজেই পেরেছি। 

কথাটা শুনে নিজের অজান্তেই তনয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোনে সরু হাসি। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে আবার জিজ্ঞেস করলো,

-- পেরেছি বলতে গাছ থেকে?

-- হু! ওই যে চৌরাস্তার মোরে একটা কদম গাছ আছে না, সেখান থেকে। 

তনয় এইবার হেসে বলে, "তার মানে চুরি করেছেন?" 

কথাটা শুনে রুপ থতমত খেয়ে যায়, সাথে ভড়কেও যায়। তনয় যে তাকে এমন কিছু বলবে তা সে কল্পনায়ও ভাবে নি। উপরন্তু, এইটা প্রশ্নের উত্তর কি দিবে তাই তো ভেবে পাচ্ছে না রুপ। সে ইতস্তত করে বলল,

-- না মানে.. এইটা চুরি না। 

তনয় ঠোঁট চেপে হেসে বলে, "তাহলে কি? ফুলগুলো নিশ্চয়ই বলে নেন নি। আর না বলে কোন কিছু নেওয়া তো চুরিই তাই না?"

তনয় যে এমন কথার প্যাঁচ জানে তা রুপ আগে জানলে কখনও এর সাথে কথা বাড়াতো না। সে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তনয়ের দিকে। কিন্তু অন্ধকার হওয়ায় না বুঝতে পারলো তনয়ের ভাবভঙ্গি, না দেখতে পেলো  ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা হাসিটুকু। দেখলে হয়তো বুঝতো সবটাই দুরন্তপনা। রুপকে জ্বালানোর কলাকৌশল। অবশ্য, তনয় নিজেও রুপের প্রতিক্রিয়া উপভোগ করতে পারছে না। রুপ ইতস্তত করেই বললো, "জানি না।"

তনয় নিঃশব্দে হেসে বলে, "তাহলে আপনি মানছেন আপনি চুরি করেছেন?"

রুপ কিছু বললো না, চুপচাপ নিজের শাড়ির আঁচলটা মুঠোয় পুরে তার উপর অত্যাচার চালাতে লাগলো। কিছুটা সময় নীরবে কাটতেই কর্কশ শব্দে তনয়ের মুঠোফোনটা বেজে উঠে। চমকে উঠে দুইজনই। তনয় তৎক্ষনাৎ পকেট থেকে ফোনটা বের করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো মুঠোফোনে পর্দায়, সেখানে ভাসছে ইংরেজিতে লেখা "মা" নামটি। 

৪!!

 নিপা বেগমের ফোন আসতেই তনয় দ্রুত কলটা রিসিভ করলো, তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, "ফোন অফ কেন তোমার? কতবার ফোন করেছি জানো?" 

অপরপাশ থেকে নিপা বেগম বলে উঠলেন, "আরেহ চার্জ ছিল না,বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মোবাইল। তার উপর, তোর ফুপুর বাসায় কারেন্টও ছিল না,পাঁচ মিনিট আগেই এসেছে।"

-- অন্য কারো ফোন দিয়ে ফোন দিতা? ওই বাড়িতে নিশ্চয়ই ফোনের আকাল পড়েনি। 

নিপা বেগম গলা খেঁকিয়ে বললেন,

-- নিয়েছিস তো নতুন নাম্বার, আমি বাদে কারো কাছেই তোর নাম্বার নেই। তো ফোন দিব কেমনে? 

তনয় কিছু না বলে চুপ বনে যায়। আগের সিম লকড হয়ে যাওয়ায়, দু'দিন আগেই সে নতুন সিম নিয়েছে। নিপা বেগম বাদে কাউকে নাম্বার দেওয়াও হয়নি। উপরন্ত, অফিসের কিছু কলিগ বাদে কারো নাম্বার সেভও করা হয়নি। 
নিপা বেগম আবার বললেন, 

-- আচ্ছা শোন, পাশের বাসার রিপা ভাবীর মেয়ে রুপের আসার কথা ছিল। সে কি এসেছে? তাদের বাসার চাবি আবার আমার কাছে। 

তনয় ভাবলো, এখন এই  প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াই শ্রেয়। অন্যথায় তার মা দূরে বসেই তাল থেকে যে কি আইটেম তৈরি করে ফেলবে তা আল্লাহ মালুম। বাসায় আসলে নাহয় ঘটনা খুলে বলা যাবে, তাই সে প্রশ্নটা সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, "চাবি কোথায় রেখেছ তুমি?" 

-- তোর বাবার যে ঔষধের ড্রয়ারটা আছে না? তারই মধ্যে বা-সাইডে রেখেছি। কিন্তু মেয়েটা কি...

নিপা বেগম কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই তনয় ফোন কাটলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "চাবির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে মিস, আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি নিয়ে আসছি।" 

কথাটা শুনে রুপের চোখে-মুখে ম্লানভাব ছড়িয়ে গেল,আবহাওয়ার মতই এক ঝাঁক কৃষ্ণমেঘ ভর করলো মনের আঙ্গিনায়। সে যে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি চাওয়া পুষে বসে ছিল৷ 
অন্ধকার হওয়ায় তনয় উপলব্ধি করতে পারলো না কিছুই। সে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে চলে গেল নিপা বেগমের রুমের দিকে, মুঠোফোনের কৃত্রিম আলোয় খুঁজতে শুরু করলো চাবিটি। তা দেখে রুপ ভাবল, মানুষটার হয়তো তাকে বিদায় করার বড্ড তাড়া। বিষাদিত হলো মন। 
এমন সময় কারেন্ট মহাশয়ও চলে এলো, কৃত্রিমতায় ছেঁয়ে গেল পরিবেশ। রুপ খিঁচে নয়ন দু'টির কপাট বন্ধ করে নিল, আঁধারে থাকায় কৃত্রিম দ্যুতির স্পর্শ সূঁচের মত বিঁধছে অক্ষিকাচে। বার কয়েক অবিশ্রান্ত পল্লব ফেলার পর সইলো সবটা, স্বাভাবিক হলো সে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সোফার দিকে। হাতের মুঠোয় সযত্নে রাখা কৃষ্ণচূড়াটি অযত্নে ফেলে দিল টি-টেবিলের উপর, নির্জীব ভঙ্গিতে গুছিয়ে নিল ব্যাগ। তনয় ততক্ষণে চাবি নিয়ে ফেরত এসেছে, রুপ একপলক তনয়কে দেখে নিল। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল, "একটি পলিথিন দেওয়া যাবে? আমার জামাগুলো ভেজা।"

তনয় মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো, চাবিটা রুপের হাতের দিয়ে রান্নাঘর থেকে পলিথিন নিয়ে এলো।  রুপ সবটা গুছিয়ে সবটার জন্য তনয়কে কৃত্রিম হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে কদমগুলো হাতের মুঠোয় পুরে চলে এলো নিজ ফ্ল্যাটে। দরজার তালা খোলার সময় রুপ উপলব্ধি করতে পারলো তনয় পিছন থেকেই তাকে দেখছে। রুপ পিছনে ঘুরলো, দুইজনের দৃষ্টি গাঁথিত হলো একই মুক্ত মালায়। দৃষ্টির প্রখরতা সইতে না পেরে রুপ দ্রুত দৃষ্টি সরালো, বিচলিত হলো মন। হৃদস্পন্দনের গতি যেন অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো।  কিন্তু তনয়! সে বড্ড স্বাভাবিক, দৃষ্টি তখনও ঠাওর। ঠোঁটের কোনে ঝুলানো ক্ষীন উপহাস। ভাব এমন,  রুপকে দেখাটাই যেন তার একান্ত কর্ম। রুপ বুঝলো না সেই দৃষ্টির মানে। তাই অপ্রতিভ হলো, দৃষ্টি নত রেখেই ঘুরে দাঁড়ালো। ধীর গতিতে তালাটা খুলে ঢুকে পড়লো ভিতরে। তনয় তা দেখে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো, কিঞ্চিৎ শব্দ করেই লাগালো দরজাটা। পকেটে হাত গুঁজে এগিয়ে গেল ড্রয়িংরুমের দিকে, নজর গিয়ে আটকালো অযত্নে পড়ে থাকা রক্তিমায় মোড়ানো পুষ্পে। তনয় ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিক, খুবই সপ্তপর্ণে হাতে উঠিয়ে নিল পুষ্পটি,

-- উপকথা রাজ্যের রাণী কি জানে, তার কৃষ্ণচূড়ার আগুন রঙ্গে পুড়ছে সন্ন্যাসী রাজার হৃদয়?
__________________

রুপ দাঁড়িয়ে আছে বদ্ধ জানালার এপ্রান্তে, নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখছে বৃষ্টি। আজ এই বৃষ্টি তার কাছে তিক্ততায় নয় বরং প্রণয়ভোজনে আবৃত ঠেকছে। প্রগাঢ়তা পাচ্ছে অবিদিত অনুভূতি। প্রণয়ের জোয়ার হানা দিচ্ছে অন্তঃকরণের পাড়ে। রুপ গায়ে থাকা শাড়িটা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, মানুষটির স্পর্শ লেগে আছে এতে। 

এক আঁধারে নিমজ্জিত রাত্রিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রুপ, কৃষ্ণমানবটি দেখেছিল বহুদিন আগেই। সেদিন রাস্তার ধারে হরিদ্রাভ আলোর ছটা মানুষটিকে ছুঁয়ে দিতেই তার মাধুর্যতা বেড়ে গিয়েছিল শতগুণ, তার সেই রূপেই মুগ্ধ হয়েছিল সে। চাহনির তেজে পুড়েছিল মন ও হৃদয় দু'টোই। ক্রাশ খেয়েছিল কি-না নিশ্চিত নয়, তবে অনুভূতির যাত্রার সেখান থেকেই। কৌতূহলী মনের তৃষ্ণা মিটাতেই আড়ালে-আবডালে খোঁজ খবর নেওয়ার পর্ব চলেছিল দীর্ঘদিন, কিন্তু অল্পসংখ্যক তথ্য ব্যতীত জানতে পারেনি কিছুই। এমনকি, হাতে গনা দুই-একবার ব্যতীত দেখাও মিলেনি কৃষ্ণমানবটির। রুপ ধরেই নিয়েছিল, মানবটি তার ধরার ছোঁয়ার বাহিরে। দমিয়ে ফেলেছিল নিজের অনুভূতি। অথচ, আজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ-এ সবকিছুরই যেন নব্য সূচনা হলো। অবিদিত অনুভূতি রূপ নিল প্রণয়ের। প্রথম দিকে মানবটির নিকট ধরা দিতে না চাইলেও পরবর্তীতে দিয়েই ফেলল। কিন্তু মানবটির ব্যবহার যে তার মনকে অশান্ত করে তুলেছে, না চাইতেও ভাবাচ্ছে বার বার। আদৌ তার প্রণয়ের ঢেউ পার পাবে তো, নাকি লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে স্রোতেই?

আর ভাবতে পারলো না রুপ, মাথায় অবোধ যন্ত্রণারা বাসা বেঁধেছে, শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বর আসবে বোধহয়। রুপ হালকা কিছু মুখে দিয়ে এন্টিবায়োটিক খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল, মুহূর্তেই পারি জমালো নিদ্রাতুর রাজ্যে।
__________

সেদিন, মধ্য রাতেই রুপের প্রচন্ড জ্বর হলো। উত্তপ্ত হলো বালিশ,বিছানা। মাথা চাড়া দিল সুপ্ত অনুভূতির দল। জ্বরটা আদৌ অসুখের ছিল, নাকি প্রণয়ের তা বলা দায়। তবে জ্বরের প্রকট চললো টানা তিন দিন। মেয়ের অসুখের কথা শুনে রিপা বেগম ঢাকায় ছুটে এলেন পরের দিনই। আদর-যত্নে সুস্থ করে তুলতেন মেয়েকে। শারিরীক অসুখ ভালো হলেও, ভালো হলো না মনের অসুখ। যে প্রেমের বাতিক একবার ফুটেছে, তা কি আর সহজে যাওয়ার? 
রুপের তো এখন প্রায় মরি মরি অবস্থা, মন তৃষ্ণাতুর কাঙ্ক্ষিত মানুষটির ঝলক পেতে। কত-শত ছুতো দিয়ে যে ঘুরে এসেছে সেই বাসা থেকে, কৃষ্ণমানবটির সামান্য ঝলক পেতে৷ কিন্তু হাহ্! মানুষটি যেন আসলেই তার ধরার ছোঁয়ার বাহিরে। 
কেটে গেল আরেক সপ্তাহ।  রুপ মুখ ভার করে বসে আছে সোফার এক কোনায়, দৃষ্টি নিবদ্ধ মুঠোফোনের পর্দায়। মনের কাঠগড়ায় জমেছে অভিমানী মেঘ। কোন ভাবেই দেখা মিলছে না, কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। রুপ আনমনেই আওড়ালো, 

-- মানুষটা কি হেরি পটারের ইনভিজিবল ক্লথের ভিতরে ঘাপটি মেরে বসেছে নাকি? নাহলে একটা মানুষ হুট করে এইভাবে অদৃশ্য হয় কিভাবে? অসহ্য! 

বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ছেড়ে আনমনেই রুপ প্রতিজ্ঞা করলো আর নিবে না মানুষটির খোঁজ৷ কিশোরী বয়সের প্রেম ভেবে ভুলে যাবে তাকে, অযথা বেদনাদায়ক অনুভূতি পুষে রাখার মানেই হয় না। যার মনে তার অস্তিত্ব নেই, তার জন্য বেহায়া হওয়াও বেমানান। কিন্তু কে জানতো, পরবর্তী প্রহরে ভাঙতে চলেছে এই প্রতিজ্ঞা।
রুপের ভাবনার মাঝেই রিপা বেগম এসে তার পার্শ্বে বসেন, 

-- কি করছিস?

রিপা বেগমের কথায় রুপ একান্ত ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে, " তেমন কিছু না মা, নিউজফিড ঘাটছিলাম। কেন কিছু বলবে?"

-- হ্যাঁ! কিছু কথা ছিল তোর সাথে। 

রুপ ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলে,

-- বল, কি কথা। 

রিপা বেগম কথা এদিক সেদিক না করে মূল কথাটাই বললেন, " তোর জন্য একটা খুব ভালো সম্মন্ধ এসেছে। ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। একমাত্র ছেলে বাবা-মায়ের।দেখতেও মোটামুটি খারাপ না, আচার-ব্যবহারও ভালো। শুধু গায়ের রঙ একটু চাপা। বাদ বাকি, পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ডও অনেক ভালো।  পাত্র হিসাবে ছেলেটাকে আমার মনে ধরেছে।"

রুপ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

-- এতই যখন মনে ধরেছে, নিজে বিয়ে করে ফেলো না। আমাকে কেন কুরবানির গরু বানাচ্ছো?

রিপা বেগম রুপের পিঠে চাপড় মেরে বলেন,

-- ফাজলামো করিস আমার সাথে?বেদ্দব মেয়ে একটা! 

রুপ দ্রুত রিপা বেগমের কাছ থেকেই একহাত সরে গিয়ে বলে,

-- আমি এখন বিয়ে করতে চাই না আম্মু, তা তুমি ভালো করেই জানো। তাহলে কেন বার বার বিয়ে নিয়ে প্রসঙ্গ তুলো? 

-- পাত্র আমার জানা-শোনা না হলে, আমি এইবার বলতাম না। ছেলের তোকে পছন্দ, সাথে তার মায়েরও। পরিবারটাও ভালো, তুই চিনিস তাদের। ওই যে প..

রুপ কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলে,

-- চেনা হোক আর অচেনা হোক আমি এখন বিয়ে করছি না। আর দুইদিন পর পর এইসব ভালো সম্মোধন কোথাকে উদয় হয় শুনি? পরবর্তীতে যদি আরেকটা বিয়ের সম্মোধন এসেছে না, দেইখো তুমি। 

-- হয়েছিস একদম বাপের মত জেদি। নিজে যা বুঝিস তাই ঠিক, অন্যের কথার গুরুত্বই নেই।

রুপ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

-- বাবার মত হয়েছি বলেই, আমার ছুতো দিয়ে বার বার বাবাকে মনে করতে পারো। নাহলে কি পারতে?

রিপা বেগম কিছু বললেন না, নীরব রইলেন। আজ বছর খানেক হলো তার স্বামী মারা গিয়েছেন। এরপর থেকে তিনিই  পরিবারের কর্তা, কত টানপোড়ানের মাঝে যে ছেলে-মেয়ে দুইজনকে বড় করেছেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। তাই তো চাইছিলেন, সুস্থ সবল থাকতেই সৎ পাত্রে মেয়েটিকে দান করতে আর ছেলেটাকে একটা লাইন করে দিতে। কিন্তু মেয়ে তো তার বুঝতে নারাজ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রিপা বেগম, স্বগোতক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

-- তার মানে, এই সম্মন্ধে তোর মত নেই?

রুপ নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে,

-- একদম না। 

রিপা বেগম হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,

-- আচ্ছা, তাহলে নিপা ভাবীকে আমি না করে দিচ্ছি।  

নিপা বেগমের নাম শুনেই রুপ থমকে দাঁড়ায়, চটজলদি ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, 

-- কাকে মানা করবা?

-- পাশের বাসার নিপা ভাবীকে। 

রুপ বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-- তাকে না করবা কেন? 

রিপা বেগম এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,

-- তাকে মানা করবো না তো কাকে করবো? তিনিই তো তার ছেলে জন্য এই সম্মন্ধ এনেছিলেন। 

কথাটা শুনে রুপের মাথায় বাজ পড়লো। কানে বাজতে থাকলো রিপা বেগমের একটি কথা, "ছেলের তোকে পছন্দ।" তার মানে, তনয় তাকে পছন্দ করে? কিন্তু কিভাবে? হাও? রুপের হাত-পা মৃদু পরিমানে কাঁপছে, সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছে। তার হৃদয় হরণকারী মানবটি যে আড়ালে-আবডালে রয়েই এমন কান্ড বসিয়ে ফেলবে তা তো তার ভাবনারও শত মাইল  দূরেও অবস্থান করে না। সবটা আদৌ সত্য তো?বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা আর ভাবনায় অতিবাহিত হয়ে যেতেই হঠাৎ রুপ লাজ-শরম ভুলে চেঁচিয়ে উঠল,

-- মা, আমি বিয়েতে রাজি।

৫!!

-- মা, আমি বিয়েতে রাজি।

কথাটা শ্রবণ হওয়া মাত্র রিপা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকান মেয়ের দিকে। কাঠ কাঠ গলায় বলেন, "রাজি মানে? এতক্ষন না তুই 'বিয়ে করবো না, বিয়ে করবো না' বলে দুনিয়া উল্টিয়ে ফেললি। হুট করে কোন জ্বীন ভর করলো তোর উপর?"

রুপ থমথম মুখে বলে, "বিয়ের জন্য রাজি না হলেও দোষ, হলেও দোষ। মানে, মানুষের মন কি চেঞ্জ হতে পারে না? আজিব!"

রিপা বেগম সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠেন,"তো এইটার কি গ্যারান্টি আছে যে, আবার মিনিট দুই-এক না যেতে তোর মন চেঞ্জ হবে না?"

রুপ দ্রুত পায়ে রিপা বেগমের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, "হবে না! আই প্রমিস। আমি সত্যি সত্যি এইবার বিয়েতে রাজি।"

"কাহিনী বুঝলাম না, নদীর স্রোত উল্টাদিকে কিভাবে বইছে? এতক্ষন তো বলছিলি অন্য কথা, এখন আবার অন্য। তোর মতিগতি তো আমার ভালো ঠেকছে না।" 

রিপা বেগমের কন্ঠে তীক্ষ্ণতা৷ রুপ ভাবলো, সে হয়তো একটু বেশি বেহায়াপনা করে ফেলেছে। তার নিজেকে একটু সংযত রেখে, টেকনিকালি তার মাকে সামলানো উচিৎ। রুপ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট দু'টো ভিজিয়ে নিয়ে মিনমিনে স্বরে বলে, 

-আমি তোমাকে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছি।  এখন তোমার মত যদি পরিবর্তন হয়ে থাকে তাহলে বিয়ে দিলে, না-হলে না দাও। তোমার ব্যাপার। তবে, পরবর্তীতে আমার থেকে 'হ্যাঁ' আশা করবা না। এই 'হ্যাঁ' শুধুমাত্র এইবারের জন্যই। 

কথাটা বলেই রুপ উল্টা ঘুরে নিজের রুমের দিকে হাটা দিল। রুপ জানে, এই কথাতেই তার কাজ হয়ে যাবে। রিপা বেগম রুপের যাওয়ার দিকে বিভ্রান্তি দৃষ্টিতে তাকান, পিছন থেকেই বলেন, "তুই কি সত্যি রাজি? আমি কি তাহলে বিয়ের কথা আগে বাড়াব?"

রুপ পিছনে না ঘুরেই উত্তর দিল, "হ্যাঁ!"
অতঃপর আর এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে গটগট করে চলে যায় রুমে। দরজা দিয়ে, বালিশের মাঝে মুখ গুঁজে। ইতিমধ্যে তার মেদহীন গালে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তিমার ছটা, প্রণয়িনী মনে জেগেছে তার কৃষ্ণমানটিকে ঘিরে অকথিত স্বপ্ন। যে মানুষটি  কয়েক প্রহর পূর্বেও বিরল বস্তু ছিল, সে মানুষটাই এখন সম্পূর্ণ তার? আজ থেকে একান্ত মানুষের খাতায় তার নাম সবার উপরে, কথাটা ভাবতেই রুপ লজ্জায় মিইয়ে যায়।
______________

শ্রাবণের মধ্যভাগ। নীলাভ আসমান ঢাকা পড়েছে বিষন্নতায়। বাতাসের প্রখরতায় দোল খাচ্ছে জানালার ধারে শুভ্র রঙের পর্দাগুলো। দক্ষিণানিল গায়ে হিম পরশ বুলাচ্ছে, মোহনীয় ঘ্রাণের অবাধ্য বিচরণ চলছে রুমের কোনায় কোনায়। রুপ একপলক তাকালো ফুল দিয়ে সজ্জিত রুমটির চারদিকে। আজ রুপ ও তনয়ের বাসররাত। ঘন্টাখানিক পূর্বেই তারা বিবাহ নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। এই দিনটা নিয়েই কত স্বপ্নই না বুনেছে রুপ। অবশেষে দিনটি পূর্ণতা পেতে চলেছে। তবে, রুপের মধ্যে খুশিভাবটা এতটা পরোক্ষ করা যাচ্ছে না। মুখটা বিষন্নতায় ঘেরা, উদ্বিগ্ন ভাব স্পষ্ট মানুষটিকে দেখার।
রুপ পা ভাঁজ করে বসলো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো রুমটি। অকস্মাৎ তনয়ের একটি ছবির উপর গিয়ে স্থির হলো তার দৃষ্টি। পরক্ষনেই উদ্বিগ্নতা  আরও দৃঢ় হলো। সেই রাতের পর আজ দেড় মাস হতে চললো, তনয় তখনও ধরা দেয়নি রুপের নিকট৷ বিয়েটা তাদের ঘরোয়া ভাবেই হয়েছে। যার দরুন, কোন অনুষ্ঠানের ছুতো দিয়েও সে দেখতে পারেনি তার কৃষ্ণমানবটিকে। কবুল বলার সময়ও তাদের অবস্থান পৃথক পৃথক ছিল৷ রুপ ছিল ভিতরের রুমে বসা আর তনয় ছিল ড্রয়িংরুমে। কিঞ্চিৎ পরিমাণও দেখা মিলেনি তার। উপরন্তু, মানুষটিও কোন প্রকার যোগাযোগ বা দেখা করার চেষ্টা করেনি, যা রুপের মন বারংবার বিষিয়ে তুলছে। প্রশ্ন জাগছে মনে, "আদৌ মানুষটা তাকে পছন্দ করে তো?" 
কিঞ্চিৎ প্রহর গড়াতেই রুমের দরজা খুললো, প্রবেশ করলো কৃষ্ণমানব। রুপ সে প্রান্তে একনজর তাকিয়ে মাথা নুয়ে নিল, মন ভর্তি অভিমানিনী মেঘ নিয়ে। তনয় ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো রুপের দিকে, রুপ তখনও স্থির। তনয় রুপের সামনে এসে বসতেই রুপ অভিমানে পিছনের দিকে কিছুটা পিছিয়ে যায়। তনয় তা দেখে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায়,

-- কোন সমস্যা মিস রুপকথা?

রুপ অভিমানী সুরে বলে, "আপনি পুরো মানুষটাই তো সমস্যা।"

তনয় কিঞ্চিৎ হেসে বলে, "তাহলে তো দেখছি বিরাট সমস্যা।" 

তনয়ের হাসি আর কথা শুনে রুপের মাথায় আগুন ধরে গেল। সে সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে, "আমি মজার মুডে নই।"

তনয় রুপের দিকে হালকা ঝুঁকে দুরন্তপনা সুরে বলে, "তাহলে কোন মুডে আছেন বলুন, আমি মুড সুইচ করে নিচ্ছি।" 

রুপ দ্রুত পিছনের দিকে মাথা এগিয়ে নিয়ে বলে, "আপনাকে যতটা ভদ্র ভেবেছিলাম ততটা আপনি নন।"

তনয় সটান হয়ে বসে বলে, "সেটা আপনার ভাবনার দোষ, আমার না।"

 "একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো, আপনি কি সত্যি আমাকে পছন্দ করে বিয়েটা করেছেন?"

তনয় ভ্রু কুটি কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, "কেন বলুন তো?"

"বিয়ের ঠিক হওয়ার পর একবারও আমার সাথে দেখা বা যোগাযোগ করা চেষ্টা করেছেন? সেই রাতের পর, আজ আমাদের দেখা, কথা বলা।"

তনয় ঠোঁট নাড়িয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,"অহ আচ্ছা।"

তনয়ের এমন ভাব দেখে রুপ তেতে উঠল, "অহ আচ্ছা মানে কি? উত্তর দিন!"

"পছন্দ হলে যে দেখা বা যোগাযোগ করা বাধ্যতামূলক তা তো জানতাম না। "

"মজা নিচ্ছেন?" 

তনয় হেসে বললো, "কিছু মূহুর্তের মধুরতা দ্বিগুণ করতে, বিরহের বড্ড প্রয়োজন পড়ে মিস রুপকথা।" 

"মানে?"

তনয় রুপের দিকে হালকা ঝুঁকে মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে এসে বলে,"শুনেছি, দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়। তাই, বিয়ের আগে নিজের জন্য ভালোবাসাটা বাড়িয়ে নিলাম। কারণ, এরপর এর কোন সুযোগ নেই।"

রুপের শরীর কাঁপছে, অভিমানি মেঘ সরে যাচ্ছে আপন গতিতে। অনুভূতিরা সাড়া দিচ্ছে প্রখরভাবে। তনয় সরে এসে বসলো, বলল, 

-- ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে, যান ফ্রেশ হয়ে নিন। 

রুপ কথা বাড়ালো না, সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার রাগ এখন পুরোই পরে গিয়েছে। তনয়ও উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। আলমারি খুলে ভিতর থেকে একটা প্যাকেট  বের করলো, অতঃপর সেটা নিয়েই এগিয়ে আসলো রুপের দিকে। রুপের হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, "ফ্রেশ হয়ে এইটা পড়বেন।"

রুপ একবার প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে পুনরায় তনয়ের দিকে তাকালো। এই নিমিত্তে, দৃষ্টি নত করে চুপচাপ এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। 

রুপ ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতে তনয়ও চেঞ্জ করে নিল। রুপ ফ্রেশ হয়ে আসতেই তনয় নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো রুপের দিকে। রুপের পড়নে তখন তনয়ের দেওয়া শুভ্র রঙের পোশাকটি। তনয় তা দেখে মিষ্টি হেসে বলল, "মাশাআল্লাহ!"

কথাটা শোনামাত্র রুপের গাল দু'টিতে ছেঁয়ে গেল রক্তিমার প্রলেপ। তনয় কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলে, "লজ্জা পড়ে পেয়েন, এখন চলেন।"

রুপ মাথা তুলে তাকায়, প্রশ্নবোধক চাহনি তার চোখে মুখে। অস্ফুটস্বরে সে জিজ্ঞেস করলো, "কোথায়?"

"আঁধার রাত্রি বিলাস করবো আপনার।"

রুপ একবার জানালার বাহিরে তাকিয়ে বলে, "কিন্তু আকাশের অবস্থা ভালো না। যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে।"

" নামুক! আজ না-হয় প্রেমবর্ষনে মাতাক শহর।" 
________________

নিস্তব্ধ রাস্তার ধারে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলেছে দু'জন মানব ও মানবী। একে অপরের হাত মুঠোয় বন্দী। বাতাসের বেগে উড়ছে মানবীর ওড়নার শেষপ্রান্ত। সামনেই একটি টং দোকান পড়তে তনয় বলল, 

-- চা খাবেন?

রুপ সম্মতি দিয়ে বলল, "খাওয়া যায়।"

"আচ্ছা,দাঁড়ান। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।"

কথাটা বলেই তনয় এগিয়ে গেল দোকানটির দিকে। মিনিট দুই-একের মাঝেই দু-হাতে দু'টি চায়ের কাপ নিয়ে ফিরলো সে। এককাপ রুপের দিকে এগিয়ে বললো, "সাবধানে খাবেন।"

রুপ লাজুক হেসে বলে, "আচ্ছা।"

দুইজনের এক কিনারা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর নিরলস আকাশ দেখছে। মাঝে সুর তুলছে কথার। হঠাৎ, নৈঃশব্দ্যে নেমে পড়লো এক পশলা বৃষ্টি। তনয় দ্রুত চায়ের কাপটি পাশের বেঞ্চিতে রেখে দিল, পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের দোকানির হাতে ধরিয়ে দিল। ভাঙতি টাকা দোকানিকে রাখতে বলে, রুপের হাত ধরে দৌড়ে ঢুকে পড়লো সামনে অবস্থিত পার্কে। তনয় রুপের হাত ধরেই এগিয়ে গেল পার্কটির ভিতরে, একটি গাছে নিচে এসে আশ্রয় নেওয়ার পূর্বে রুপ কিছু একটার সাথে বেজে পড়ে যেতে নেয়। তনয় ওর হাত ধরে থাকায় টেনে ধরে কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে দুইজন একসাথেই সিক্ত ঘাসের উপর পড়ে যায়। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতে তারা একসাথেই হেসে উঠে। রুপ বলে, 

-- তখন হাতটা ছেড়ে দিলেই পারতেন, আমার সাথে আপনিও এখন ব্যথা পেলেন।

তনয় রুপের চোখের দিকেই তাকিয়ে বলে, "হাতটা তো ছাড়ার জন্য ধরিনি।"

রুপ তখন কিছু না বলে লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলে। মিনমিনে স্বরে বলে, "উঠুন! ভিজে যাচ্ছি দু'জনেই।"

তনয় বলল, "ভিজে যখন গিয়েছি তখন উঠে লাভ কি? এর চেয়ে বরং বৃষ্টিস্নাত উপভোগ করুন।"

রুপ আর কথা বাড়ালো না, চোখ বন্ধ করে উপভোগ করতে থাকলো পরিবেশটা। এই প্রথম বৃষ্টি বিদ্বেষী কন্যা, প্রেমে পড়লো বৃষ্টি মায়ায়। জীবনের একুশটি বর্ষা তিক্ততা মনে হলেও, বাইশ তম বর্ষাটি যে তার নিকট সবচেয়ে প্রিয়তম আর সুখকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কলধ্বনিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে পরিবেশ। মেঘের মৃদু মৃদু ডাক ঝংকার তুলছে কর্ণকুহরে।  ভেজা মাটি ও বুনোঘাসের সুবাস তীব্রতর হতেই রুপ লম্বা নিঃশ্বাসে তা ভরে নেয় অন্তরে। তনয় খুব সপ্তপর্ণে রুপকে নিজের বাহুতে ভরে নিল, তার কপালের আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। শীতল হাতটি গলিয়ে দিল রুপের মেদহীন গালে। ধীর কন্ঠে বলল,

-- কৃষ্ণচূড়ার আগুন রঙ্গে,
পুড়ছে প্রেমিকের মন। 
পুড়বে জেনেই অনল পানে,
পতঙ্গের আস্ফালন।
                          [সংগ্রহীত]

রুপ লজ্জায় মুখ লুকায় তনয়ে বুকে। বৃষ্টিস্নাত যুগলের প্রণয় প্রহর দেখে বিস্তৃত কৃষ্ণচূড়া গাছটি বোধহয় বিমুগ্ধ হলো। নিভৃতেই ছায়া রূপক খানিকটা হেলে পড়লো তাদের উপর। নব্য সূচনার অভ্যর্থনা জানালো তাদের ঝরা রক্তিমা পুষ্পে। 



***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন