ক্রোধ |
১!!
সুমনা ওর সো কল্ড ইতর টাইপ বয়ফ্রেন্ড আবিরকে শাস্তি দিতে আর তার উপর রাগ ঝারতে বিয়ে করল আবিরেরই বাবাকে। সুমনার থেকে গুনে গুনে পয়ত্রিশ বছরের বড় বুড়ো লোকটাকে বিয়ে করল মেয়েটা। সুমনা যতদূর শুনেছে লোকটার বয়স পঞ্চান্ন বছর। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি সবই আছে। সুমনা সবে কুড়িতে পা দিল। কুড়িতে এক বুড়োকে বিয়ে করে নিজেকে বুড়োর বুড়ি করে নিল।
সুমনার বন্ধু বান্ধব ভাবছে বুড়োরে সাথে ওকে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়েছে। নয়ত বুড়ো খুব মেয়ে লোভী যার কারণে ওকে বিয়ে করেছেন। ওর বান্ধবী রত্না তো বিয়ের কথা শুনে, সেদিন সুমনাকে জড়িয়ে ধরে মরা কান্না করতে করতে বলল,
_" সুমনা বোন আমার, তোর জীবনটা যে নষ্ট হয়ে যাবে। তোর মত সুন্দরী, অল্পবয়সী মেয়ে চাইলেই যে কোন ছেলেকে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু তুই কেন ঐ বুড়োকে বিয়ে করছিস? নিশ্চয়ই তোর চাচা-চাচি বুড়োর টাকার লোভে পড়ে তোকে বিয়ে দিচ্ছে। সুমনা বোন তুই আমার সাথে চল। আমি তোকে নিজ বোনের মত রাখব।
রত্নার কথায় প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল সুমনার। বিরক্ত হয়ে বলল,
_" ন্যাকামি করে ভ্যা ভ্যা করিস না তো রত্না। তোকে কে বলল জোর করে বিয়ে দিচ্ছে? বুড়োকে আমি কারো জোর করায় নয়, বরং স্ব-ইচ্ছায় বিয়ে করেছি। হ্যাঁ এটা সত্যি এখানে আমার স্বার্থ হিসাবে তার প্রচুর ধনসম্পদ ছিল, তবে মূল উদ্দেশ্য তার ছোট ছেলেকে শিক্ষা দেয়া!
রত্না অবাক হয়ে বলল,
_" কেন? তার ছেলে কি করছে?
_" তার ছোট ছেলে আর কেউ নয় বরং আবির।
রত্না চুড়ান্ত অবাক হয়ে বলল,
_" কী?
_" হুঁ। অবিরের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল আমার। বছর তিনের মত সম্পর্ক ছিল আমাদের। এত দিনের সম্পর্ক ভেঙে শালা আরেক মেয়েকে বিয়ে করল। হারামি প্রেম করবে আমার সাথে আর বিয়ে আরেকজনকে? ওর কপালে শনির দশা না লাগালে আমার নামও সুমনা নয়।
রত্না আরও অবাক হয়ে বলল,
_" কী বলছিস?
_" যা শুনছিস তাই। প্রেম করা কালীন লুচ্চা শালা প্রায়ই আমার সাথে উল্টা পাল্টা করতে চাইত। তবে আমিও এক কথার মেয়ে ছিলাম। বিয়ের আগে প্রেম করেছি মানে অলরেডি একটা ভুল করেছি, আর বিয়ের আগে অবৈধ সম্পর্ক করে মস্তবড় ভুল করব না। সম্পর্ক হবার পর থেকেই ওকে বলতাম আমাকে বিয়ে করতে কিন্তু বাচ্চা হারামি এড়িয়ে যেতো সবসময়। হারামির বাচ্চা বলা ঠিক হবে না। কারণ ওর বাপ এখন আমার স্বামী হবে। বাচ্চা হারামিটা আমাকে ঝুলিয়ে রেখে ধনীর লুচ্চা দুলালিকে বিয়ে করল। ওর বিয়ে করা বের করছি আমি।
_" কই আমাকে তো এত কিছু বলিসনি?
_" কী বলব বল? তোকে তো বলেছিলাম আবিরকে ভালোবাসি। তবে ওর বিয়ের কথাটা বলতে লজ্জা লাগছিল। নিজেকে খুব ছোট লাগছিল। সত্যি বলতে ওর বিয়ের পর খুব খুব ভেঙে পড়েছিলাম। নিজের জীবনটাকে কেমন অথর্হীন মনে হত। বার বার মরার কথা মাথায় আসত। কিন্তু তারপর ভাবলাম, ধোঁকা ও আমাকে দিয়েছে। আমি কেন মরব? মরার দিন শেষ, প্রতিশোধের বাংলাদেশ। ভাবতে থাকলাম কি করে ওকে শায়েস্তা করা যায়। সুযোগ খুঁজতে লাগলাম।
তারপর একদিন শোনা শোনা শুনলাম ওর বাবা নাকি আবার বিয়ে করতে চায়। প্রথম স্ত্রী গত হয়েছেন বছর তিন হবে। ছেলেরা যার যার মত ব্যস্ত। তার একাকি জীবনে সঙ্গী দরকার। সঙ্গীর খোঁজে বিয়ে করতে চায়। যেমনটা আর পাঁচটা বিধবা পুরষ চায়। একটা কথা বল, মেয়ের স্বামী মরলে বিধবা, ছেলেদের বউ মরলে কী বলে?
_" আমি জানি না।
_" যাই হোক ভাবলাম আবিরকে শায়েস্তা করবই করব। তাতে যদি ওর বাবার বউ হতে হয় তাও হব।
_" তোর চাচা চাচি সহজে রাজি হল?
_" সেটা তো আগেই জানতাম যে, বুড়োর সাথে বিয়ে দিতে কেউ রাজি হবে না। আমার বাবা-মা নেই। চাচা চাচি বড় করেছেন, পড়া লেখা করাচ্ছেন। নিজে সন্তানের মত স্নেহ করেন। তাদের বললেও সহজে রাজি হবে না। বিশেষ করে চাচা তো রাজি হবেই না সহজে। তাই প্রথমে চাচিকে ধরলাম। চাচিও প্রথমে রাজি হলনা। অনেক কষ্টে কৌশলে চাচিতে রাজি করালাম।
_" কী বলে রাজি করালি?
_" বললাম, চাচি শোনো বুড়ো বড়জোর আর কদিন বাঁচবে? জলদি টপকে যাবে। মরার আগে সম্পত্তির বড় একটা অংশ আমি নিজের নামে করে নিব। বুড়ো তো প্রচুর বড়লোক। আমাদের টানাটানির সংসারে তখন সুদিন আসবে। মরে গেলে তো আমি আবার ফ্রী। তুমি চাচাকে রাজি করাও। চাচা প্রথমে অনেক না না করলেও শেষে চাচি রাজি করালেন।
_" তারপর বুড়োকে কিভাবে রাজি করালি?
_" বার বার বুড়ো কেন বলছিস? তার নাম নুরুল আহমেদ। তোর দুলাভাই হয়। তাকে দুলাভাই ডাকবি।
রত্না মুখ ভেংচি কেটে বলল,
_" তোর মত ঢঙ করার শখ আমার নেই। বল লোকটাকে রাজি কিভাবে করালি?
_" ঘটককের মাধ্যমে সব কথা পাকা করলাম। কথায় আছে ছেলেরা যত বয়স্কই হোক কচি মেয়ে দেখলে তাদের তর সয় না। বুড়ো আমার ছবি দেখেই হ্যাঁ বলে দিলেন। যদিও আমি দেখতে আহা মরি সুন্দর না, শ্যামলা গায়ের রঙ। তবে তোরা সবাই তো বলিস আমার চেহারা আকর্ষণীয়। বুড়ো রাজি হয়ে গেল। শুক্রবার বিয়ে। এসে ভালো মন্দ খেয়ে যাস। দুলাভাইয়ের সাথে মজা টজা করিস!
সুমনার কথায় রত্নার গা জ্বলছে। রাগের মাথায় বলল,
_" তোর বুইড়া খাটাশ বরকে নিয়ে আদিখ্যেতা তুই কর। আমি তোর ঢঙ্গের বিয়ে দেখতে কেন, তোর কাছেও আর আসব না। যত্তসব ফাজিল মেয়ে। কারও উপর রাগ দেখাতে গিয়ে নিজের জীবন নষ্ট করছে। ফালতু লোভী মেয়ে।
রত্না সুমনাকে একগাদা বকা দিয়ে হনহন করতে করতে ওর বাড়ি থেকে চলে গেলো।
২!!
অবশেষে শক্রবার ঘরোয়া আয়োজনে সুমনা আর নুরুল আহমেদের বিয়ে হল। বিয়েতে নুরুল সাহেবের বড় ছেলে, মেঝ মেয়ে আর কিছু আত্মীয় ছিলেন। তার ছোট ছেলে আবির আর দুই মেয়ে আসেনি। তাদের বোধ হয় ঘর সামলাচ্ছে। আর ছোট ছেলে আবির তো বেশির ভাগ সময় শ্বশুর বাড়িতেই কাটায়।
বিয়ে সম্পান্ন হবার পর সুমনা নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য হেসে ভাবল,
_" যে ছেলের বউ হওয়ার কথা ছিল তার মা হয়ে গেলাম। হায়রে কপাল! তবে যার কারণে আমার কপাল এমন হল, তার জীবন বিষে বিষে বিষময় না করে দি, তবে আমার শান্তি নেই।
সুমনার বিদায়ে তেমন কেউ কাঁদল না। কারণ কেউই ওর সিদ্ধান্তে তেমন খুশি নয়। সুমনা নিজেও তেমন কাঁদল না। কেন জানি ওর কান্না পায় না। কঠিন প্রকৃতির মেয়ে সুমনা। সুমনাকে এক বৃদ্ধ মহিলা বরন করে ঘরে তুললেন। সম্পর্কে তিনি সুমনার ছোট ননদ। সুমনা মনে মনে হেসে বলল,
_" ননদ দেখছি নানির বয়সী। কপাল বটে আমার!
কতক্ষণ পর আবির আসল। তখন সুমনা বিশাল বড় ড্রায়িং রুমের রাজকীয় সোফায় রানীর ভঙ্গীতে বসা। আবির এসে সুমনাকে সালাম করল। কিন্তু সুমনার চেহারার দিকে তাকাতেই আবির হাজার ভোল্টের ঝটকা খেল। আবির সুমনাকে দেখে যতটা অবাক হল, ঠিক ততটাই শকট। সুমনার সামনে দাঁড়িয়ে তুতলাতে তুতলাতে বলল,
_" সুমনা তুমি?
সুমনা হেসে বলল,
_" তা বাবা আবির কেমন আছো? নতুন মাকে পছন্দ হয়েছে? আর শোনো বাবা, মাকে নাম ধরে ডাকতে নেই। তাতে যে পাপ হয়। মা বলো বাবা! নয়ত ছোট মা ডাকতে পারো!
আবির কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। মনে হয় এমনি মুখ থুবরে মাটিতে পড়ে যাবে।
আবিরের ছোট ফুপি বললেন,
_" কিরে আবির তুই ছোট ভাবীকে চিনিস নাকি?
সুমনা আবিরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। মনে মনে বলল,
_" জোর কা ঝটকা জোরসে লাগা।
—————
আবিরের ছোট ফুপি বললেন,
_" কিরে আবির তুই ছোট ভাবীকে চিনিস নাকি?
সুমনা আবিরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। মনে মনে বলল,
_" জোরকা ঝটকা জোরসে লাগা।
আবিরের নিজেকে সামলাতে সময় লাগল। টেবিলে থাকা এক গ্লাস শরবত পুরোটা খেয়ে হতাশ গলায় বলল,
_" না মানে ফুপু। আমি আর উনি একই ভার্সিটিতে পড়তাম। আমার জুনিয়র ছিল। সে হিসাবে একটু আধটু চিনি আরকি।
আবিরের ফুপু নাহার বেগম বললেন,
_" ওহ তাই বল। তা যাই হোক, এ কলেজে পড়িস আর যাই করিস এখন তো তোর ছোট মা। তুই এখন থেকে ছোট মা বা নতুন মা বলে ডাকিস।
আবির খানিক ঢোক গিলে বলল,
_" না না ঠিকাছে। হিসাবে আমার চেয়ে বয়স তিন চার বছরের ছোটো। নাম ধরেই ডাকি!
নাহার বেগম রেগে বললেন,
_" বেয়াদপ ছেলে চড় মেরে দাঁত ফেলে দিব। যখন কারও সাথে সম্পর্ক থাকে না, তখন তাকে বয়স হিসাবে সম্বোধন করে। সম্পর্ক হবার পর সে বয়সে হোক বড় বা ছোট তাকে সে সম্পর্কের নাম ধরে ডাকতে হয়। যেহেতু তোর বাবা তাকে বিয়ে করেছেন, সেহেতু তুই ছোটো মা ডাকবি। ডাক ছোটো মা।
আবির অসহায় চোখে সুমনার দিকে তাকাল। সুমনা তীক্ষ্ণ চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। আবির কোনো উপায় না পেয়ে বলল,
_" আমি মা ডাকতে পারব না ফুপু। তার চেয়ে বরং আন্টি ডাকব। আবির ওখান থেকে যেতে যেতে বলল, ফুপু আমার কিছু কাজ আছে রুমে যাচ্ছি, তা ছাড়া শরীরটাও হঠাৎ খারাপ লাগছে খুব। আবির কারও কথার অপেক্ষা না করে হনহন করে উপরে চলে গেলো। আবিরের পিছন পিছন ওর স্ত্রী রিমিও গেল। আবির রুমে গিয়ে ফুল স্পিডে ফ্যান, এসি দুটোই ছাড়ল। দরদর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে শরীর থেকে। রিমি রুমে ঢুকে বলল,
_" কী হলো তোমার? হঠাৎ এমন করলে কেন?
আবির রিমির দিকে তাকিয়ে বলল,
_" আমাকে বরফ কুচি দিয়ে ঠান্ডা পানি দাও খাব। কয়েক গ্লাস দিবে।
_" কী বলছ তুমি! এই শীতে ঠান্ডা পানি খাবে? তার মধ্যে ফ্যান, এসি ছেড়ে বসে আছ। সব ঠিকাছে তো? এত ঘামছ কেন?
_" যা বললাম তাই করো। তারপর বলছি।
রিমি পানি এনে দিতেই আবির পর পর তিন গ্লাস হিম শীতল, পানি পান করল। তারপর রিমির দিকে তাকিয়ে বলল,
_" তুমি জানো বাবা কাকে বিয়ে করছেন?
_" কাকে আবার তোমার মাকে!
_" গাধার মতো কথা বলবে না। বিয়ের আগে মেয়েটা কে ছিল জানো?
_" আমি কী করে জানব?
_" ও আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড সুমনা!
রিমি লাফ দিয়ে আবিরের পাশে এসে বলল,
_" কী!
_" হ্যাঁ। ওকে ছেড়েই তো, তোমাকে বিয়ে করেছি।
রিমি বিস্ফরিত চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
_" তার মানে তোমার এক্স এখন তোমার মা!
_" এই এক্স বাল শব্দটা ব্যবহার করো না তো? মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। সুমনা এমন কেন করল?
রিমি আবিরের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মনে মনে কিছু ভাবছে। হঠাৎ শব্দ করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে লাগল। রিমির হাসি দেখে আবিরের রাগে গা জ্বলছে। রাগে দাঁত দাঁত চেপে বলল,
_" বলদের মতো হাসছ কেন?
_" না মানে এমন আশ্চর্য ঘটনা জীবনে শুনেছ? হা হা হা। ছেলের প্রাক্তন, তার বাবার বউ। মানে অনেক বাংলা মুভির নাম শুনছি, বাবা কেন চাকর, মা কেন উমুক, ভাই কেন তমুক। আর তোমার বেলায় হবে, প্রাক্তন কেন মা! হি হি হি। আরেকটা মুভি দেখছিলাম কী যেন নাম ছিল, হ্যাঁ বাবা বড় না শ্বশুর বড়, তুমি বলবা প্রাক্তন বড় না বাবা বড়! আল্লাহ আমার হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করছে।
আবির রিমির হাসি আর কথাগুলো সহ্য করতে না পেরে ঠান্ডা পানি ওর গায়ে ঢেলে দিল। রিমি লাফ মেরে উঠে বলল,
_" খবরদার আবির তোমার বাবা আর প্রাক্তনের রাগ আমার উপর দেখাবে না। আমি তোমার রাগ দেখানোর মতো সস্তা নই।
আবির হালকা নরম হয়ে বলল,
_" সরি।
_" তোমার সমস্যা তোমার বাবা আর তার স্ত্রীকে নিয়ে। সো তাদের সাথে কথা বলো?
_" আচ্ছা বলব, কিন্তু তোমার কি আজব লাগবে না যে, আমার প্রাক্তন এখন তোমার সামনে সামনে ঘুরবে তাও তোমার শ্বাশুড়ি হয়ে।
_" একটু লাগবে। তবে বেশি না। তাছাড়া এমন নয় আমি তোমার আর সুমনার সস্পর্কের কথা জানতাম না। সব জেনেই তো বিয়ে করেছি। আমার তোমাকে ভালো লেগেছে সেটা বড় কথা। তোমার আগে কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিল কি, ছিল না ডাজেন্ট ম্যাটার!
_" কিন্তু বাবা কেন সুমনাকেই বিয়ে করলেন? আর সুমনা কেন রাজি হলেন?
_" দেখো আবির আমি হয়তো আগে সুমনাকে দেখিনি তবে বিয়ে ঠিক হবার পর তোমার ফুপুদের কাছ থেকে শুনেছি সুমনার বাবা-মা ছোট বেলায় গত হয়েছেন। চাচা-চাচির কাছে মানুষ ও। তাদেরও তিন সন্তান আছে। ওর চাচা-চাচি ওকে ভালোবাসলেও ভীষণ টানাটানির সংসার তাদের। ওর চাচার ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। সেখান থেকে এতগুলো মানুষ চলা তো মুখের কথা নয়! তাছাড়া আমার মনে হয় সুমনা ওর পরিবারের কথা ভেবে রাজি হয়েছে। ভেবেছে ওর জীবন একটু কষ্টে কাটলেও ওর পরিবার সুখে থাকবে। হয়তো তোমার বাবা ওর পরিবারকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছেন। অথবা ওর চাচা জোর করে বা ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে দিয়েছেন।
আমার মতে মূল দোষী কিন্তু সুমনা নয় বরং তোমার বাবা। তার বয়স অনুসারে তার এখন বিয়ের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না! তবুও যখন তিনি বিয়ের এত প্রয়োজন মনে করলেন, তখন তার উচিত ছিল কোনো বিধবা, ডিভোর্সী কিংবা বন্ধ্যা, মধ্যবয়ষ্ক মহিলাকে বিয়ে করা। কিন্তু তিনি তার মেয়ের বয়সি মেয়েকে বিয়ে করলেন। যা হোক এটা তো ছেলেদের নেচার। বয়স যতই হোক মেয়ে দেখলে বিড়ালের মত ছোকছুক করা অভ্যাস। অসম বয়সের বিয়ে তো আমাদের সমাজে নতুন না! সমাজ যে পুরুষ শাসন কয়েম।
হ্যাঁ সব পুরুষ এক না। আমার বাবাকে দেখো। আমার বয়স যখন দুবছর তখন মা মারা গেছেন। আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের সময় মা মারা যান, মায়ের গত হওয়ার কয়েকঘন্টা পর ভাইও মারা যায়। পৃথিবীতে বাবার আমি ছাড়া কেউ নেই। আমার বয়স এখন একুশ। গত ঊনিশ বছর যাবত বাবা মায়ের স্মৃতি আকড়ে ধরে রেখেছেন। অথচ আমার বাবা তোমার বাবার চেয়ে অনেক ছোট। তোমরা তিন ভাই, দুই বোন।
তোমার বড় ভাইয়ের বয়স ত্রিশ বছরের বেশি, মেজ ভাই ২৮, তোমার এক বোন ২৬, আর তুমি ২৪, তোমার ছোট বোন ১৯। সব বড় বড় ছেলে মেয়ে ঘরে। ঘরে কাজের লোকের অভাব নেই। তোমার বাবার এক ডাকে সবাই হাজির হয়। নাতি নাতনি আছে, তবুও নাকি তোমার বাবা একাকীত্ব বোধ করেন। তোমার মা গত হয়েছেন মাত্র তিন বছর অথচ তিনি বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেলেন। সত্যি ব্যাপারটা হাস্যকর!
_" তুমি এখন বাবার দোষ খুলে কেন বসছ?
_" আজব! সত্যি কথা বললাম।
_" সুমনার মুখ দেখে মনে হয়নি, আমাকে দেখে অবাক হয়েছে, বা ও জানত না আমার বাবার সাথে বিয়ে হচ্ছে! বরং ও সন্দেহজনক হাসির মাধ্যমে টিটকারি মারছিল আমাকে। আমার তো মনে হয় সুমনা কোনো প্ল্যান করে বাবাকে বিয়ে করছে।
_" তোমার বাবা কি সালমান খান যে তাকে বিয়ে করতে প্ল্যান করতে হবে? আর শোনো আবির তুমি এখন আমার বর, সো আমার সামনে বারবার অন্য মেয়ের নাম জব করবে না। তোমার অতীত কী ছিল আমার কাছে সেসব ব্যাপার নয়। তোমার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ আমি কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নিও! এখন নিচে চলো কতক্ষণ যাবত রুমে আসছ। লোকে কী বলবে?
_" তুমি যাও। আমার ইচ্ছা করছে না।
রিমি কাপড় বদলে নিচে চলে গেল। নিচে গিয়ে দেখল সুমনাকে খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। সুমনা এত খাবার একসাথে কখনো দেখেনি। মাথায় চক্কর দিচ্ছে ও। মনে মনে হেসে বলল,
_" ঘটক ব্যাটা ঠিক বলছে, রাজ বাড়িতে বিয়ে হয়েছে। বিশাল বাড়ি, এত সব সৌখিন জিনিস। তবে এসবে কেন জানি মন টানছে না। রাত যত বাড়ছে ভয়টা তত গাঢ় হচ্ছে। নিজের বাবার বয়সী লোকটা এখন স্বামী। তার সাথে সারা জীবন কী করে কাটাব! তাও মানা যেত যদি আবিরের বাবা না হতো। আবিরের কথা মনে হতেই সুমনা রাগ বেড়ে গেল। রাগের মাথায় বিড়বিড় করে বলল, বেশ করেছি বুইড়াটারে বিয়া করছি। এক বছরের মধ্যে বুইড়াটার বাচ্চার মা হয়ে আবিররে ছোট ভাই বা বোন উপহার দিব। ওকে আমি ছাড়ব না।
আবিরের ফুপু নাহার বেগম সুমনাকে হালকা নাড়া দিয়ে বলল,
_" কী হলো খাচ্ছো না কেন ভাবী?
_" হ্যাঁ খাচ্ছি। আপু আপনি উনার কেমন বোন?
_" আপন ছোট বোন।
_" আপনার বয়স?
_" চল্লিশের একটু বেশি হবে।
_" তাহলে চুল সব সাদা কেন?
নাহার বেগম হেসে বলল,
_" রোগের কারণে আমাকে দেখতে অনেক বয়স্ক লাগে। চুলও ঔষধ খেতে খেতে সাদা হয়ে গেছে।
_" ওহ।
_" ভাবী তুমি খাওয়া শেষ করো। ভাইজান বাগানে হাঁটতে গেছেন। তিনি ফেরার পূর্বে তোমাকে রুমে দিয়ে আসব। তারপর দুষ্টু হাসি হাসল নাহার।
৩!!
সুমনাকে উপরের যখন নিজের রুমে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আবির রুম থেকে বের হচ্ছিল। সুমনার চোখে চোখ পড়তেই সুমনা আবারও সন্দেহজনক হাসল। সুমনাকে রুমে রেখে নুরুল সাহেবের বোনরা চলে গেলেন। সুমনার ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভ করতেই চির চেনা গলায় বলে উঠল,
_" এসব কী সুমনা? আমার বাবাকে কেন বিয়ে করলে?
সুমনা হেসে বলল,
_" কেন আবির বাবা খুব জ্বলছে। আর আমাকে নাম ধরে কেন ডাকছ? ছোট মা ডাকো? নয়ত রিচ কিডদের মত ঢঙ করে মম, মাম্মিও ডাকতে পারো।
_" বাড়াবাড়ি হচ্ছে?
_" বাড়াবাড়ি তো এক বছর পর পর টের পাবা! যখন তোমার কোলে পিচ্চি একটা ভাই বা বোন তুলে দিব। নব দম্পত্তিকে বাসর রাতে বিরক্ত করতে লজ্জা করে না! বেহালাজ ছেলে। শোনো আবির তোমার জীবন থেকে সুখ খুব দ্রুত পালাবে। গুড নাইট। সুইট ড্রিমস। আমাকে আমার ফাস্ট নাইটের জন্য উইশ করবে না? কত বড় আফসুসের কথা যার সাথে তুমি বিয়ের আগে অবৈধ বাসর করতে চাইতে, তার সাথে তোমার বাবা বৈধ বাসর করবে। হাউ ইন্টারেস্টিং!
আবির খট করে ফোনটা কেটে দিল।
নুরুল ইসলাম দরজার সামনে এসে কাশলেন! সুমনা নড়েচড়ে বসল।
—————
নুরুল সাহেব দরজার সামনে এসে হালকা কাশলেন! সুমনা নড়েচড়ে বসল। প্রচন্ড ভয়ও পেল। বুইড়া ওর সাথে ঠিক কি কি করতে পারে সেটা ভেবে ভয় ক্রমে ক্রমে আরও বাড়ছে। মনে মনে ভাবল,
_" বুড়োকে ভয় দেখাতে হবে, এমন ভয় দেখাতে হবে যাতে হার্ট এ্যাটাক করে প্যারালাইজট হয়ে যায়। না থাকবে বুড়োর শক্তি না থাকবে আমার ভয়!
সুমনা যতক্ষণ ভাবছে ততক্ষণে নুরুল সাহেব রুমে ঢুকে সুমনাকে সালাম করলেন,
_" আসসালামু আলাইকুম।
সুমনা কিছু ভাবার আগেই লোকটা রুমে প্রবেশ করবে তা ও ভাবতে পারেনি। অনেকটা থতামতা খেয়ে সালামের উত্তর দিল।
_" ওয়ালাইকুম আসসালাম।
_" কেমন আছো?
সুমনার রাগে গা জ্বলছে। মনে মনে বলল,
_" বুড়ো লোকটার আদিখ্যেতা দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। বুড়ো বয়সে ভিমরতি। তবুও দাঁত কামড়ে বলল, জি আলহামদুলিল্লাহ আপনি?
_" আমিও আল্লাহর রহমতে খুব ভালো আছি।
নুরুল সাহেব রুমের আলমিরা খুলে একটা চেকবুক এনে তাতে সাইন করে বলল,
_" এটা দশ লক্ষ টাকার চেক।
সুমনা বেশ অবাক হয়ে বলল,
_" এটা কেন?
_" তোমার দেনমোহরের দশ লক্ষ টাকা। আমাদের ধর্মে দেনমোহর পরিশোধ না করে স্ত্রীকে স্পর্শ করা হারাম। আমার কাছে ক্যাশ নেই। বাড়িতে এত টাকা ক্যাশ থাকে না। চেকটা তুমি সময় করে ক্যাশ করিয়ে নিও। দেনমোহরের টাকার উপর শুধু তোমার অধিকার। তুমি এ টাকা নিজে রাখতে পারো বা তোমার চাচাকে দিতে পারো। নুরুল সাহেব কিছু গয়নার বাক্স দিয়ে বললেন, এগুলো আমার প্রথম স্ত্রীর গয়না। এখন থেকে তুমি এগুলো ব্যবহার করতে পারো। এ বাড়ির তুমি বউ। তাই সেরকম দায়িত্ব সামলে চলো। জানি তুমি বয়সে ছোট তবে ধীরে ধীরে সব শিখে যাবে।
সুমনা চেকটা হাতে নিয়ে বলল,
_" আপনি আমাকে কেন বিয়ে করলেন?
_" আমি জানি নিজের মেয়ের বয়সি মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করায় অনেকেই হাসছে আমার উপর, পিছন পিছন টিটকারি করছে, যা বলছে, তাতে আমার অবশ্য কিছু যায় অাসে না। আমি বরাবরই নিজ ভাবনার মানুষ। জানি তোমার নিজেরও আজব লাগছে। বুঝতে পারছি আমাকে নিজের স্বামী হিসাবে মানতে তোমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু আমার মতে হয়ত এটা সৃষ্টি কর্তারই মর্জি ছিল। কথায় বলে তার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। অবশ্য আমার তোমাকে বিয়ে করার কারণ আমার প্রথম স্ত্রী।
_" তিনি কী করেছেন?
_" তুমি হয়ত বিশ্বাস করবে না তুমি অবিকল আমার প্রথম স্ত্রীর মত দেখতে। ওয়েট তোমাকে শোভা মানে আমার প্রথম স্ত্রীর ছবি দেখাই। নুরুল সাহেব একটা এ্যালবাম বের করে কিছু ছবি দেখালেন, সুমনা সত্যি চমকালো। কারণ ও সত্যি অনেকটা আবিরের মায়ের মত দেখতে। দেখলে মনে হয় ঐ নিজেই শোভা। নয়ত তার জমজ বোন।
নুরুল সাহেব বললেন,
_" ঘটক যখন তোমার ছবি দেখালেন, আমি সত্যি চমকে গিয়েছিলাম। তখনই বিনা বাক্যে হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। শোভাও তোমার মত শ্যামলা দেখতে তবে, ওর চেহারাও তোমার মত বেশ আকর্ষণীয়। তোমাদের দুজনার চোখ, নাক হুবহু মিলে। এ কারণেই মূলত তোমাকে বিয়ে করা। তাছাড়া তোমার পরিবার সম্পর্কে জেনে মনে হল তোমাদের পাশে দাঁড়ানো দরকার! যা হোক আমি আমার কথা বললাম। তুমি তোমার কথা বলো?
সুমনা শুকনো গলায় বলল,
_" আমি তো আসলে------!
_" আমি জানি তুমি তোমার পরিবারের কথা ভেবে বিয়েতে রাজি হয়েছো তাই না?
সুমনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
_" তেমনই।
_" জানি। তোমার চাচা-চাচি সত্যি খুব ভালো মানুষ। তাদের মত মানুষের জন্য তোমার মত মেয়ের এমনটা করা স্বাভাবিক। দেখো সুমনা এখন যেহেতু তুমি আমার স্ত্রী সেহেতু তোমার পরিবার এখন থেকে আমার পরিবার। আর তোমার মতামতের প্রধান্য দেয়াও আমার কর্তব্য। তোমার পরিবারকে দেখার দায়িত্ব আমার। আর আমি জানি তোমার সময় লাগবে এ বিয়েটা মেনে নিতে। তুমি সময় নাও আমার সমস্যা নেই। তবে প্লিজ আমার দিকটা বিবেচনায় রেখ। মানে আমার পরিবারের সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করো। আমার ছেলেরা আমার বিয়েতে রাজি ছিল না প্রথমে কিন্তু তারা আমার কথার উপর কিছু বলতে পারে না কেন জানো?
_" কেন?
_" কারণ আমার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, টাকা এখনও সব আমার নামে। আমি তাদের সব প্রয়োজন পূরন করলেও এখন পর্যন্ত কাউকে কিছু ভাগ করে দেইনি। যার কারণে সবাই এখনও আমার কথা শুনতে বাধ্য। তারা নিজেরা নিজেদের জীবনে সফল। তবুও আমার নিজের সম্পত্তি আর টাকার কাছে তাদের আয় নগন্য। তাদের এখনকার মত বিলাসিতায় জীবন কাটাতে হলে আমার হেল্প লাগবে। হতে পারে তারা তোমার সাথে মাঝে মাঝে খারাপ বিহেব করবে। অন্যায় বা ভুল কিছু করলে তুমি অবশ্যই উত্তর দিবে, প্রতিবাদ করবে, তবে সবসময় ধৈর্য্য রাখার চেষ্টা করবে। যথাসম্ভব মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। সৃষ্টিকর্তা সদা ধৈর্য্যশীলদের সাথে থাকেন।
সুমনা মৃদু স্বরে বলল,
_" জি।
_" এখন অনেক রাত হয়েছে। তোমার ঘুমানো প্রয়োজন। সারা দিন তোমার শারিরীক মানসিক খুব পরিশ্রম গেছে এখন ঘুমানো দরকার। নুরুল সাহেব সুমনার গালে হাত রেখে কপালে চুমো খেয়ে বললেন,
_" গুড নাইট।
নুরুল সাহেব পাশে শুতেই ঘুমিয়ে গেলেন। সুমনা থ মেরে বসেই রইল। লোকটাকে ও যতটা খারাপ ভেবেছিল, লোকটা ততটা খারাপ নয়! এ লোকের ছেলে আবিরের মতো ফাজিল কি করে হলো সুমনা সেটা ভেবে পাচ্ছে না! সুমনা বসেই রইল নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে।
আবির বারান্দায় হেঁটে হেঁটে বার বার সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। রাগে অপমানে ওর অস্থির লাগছে। আবিরকে এমন হতাশ দেখে রিমি বলল,
_" কী ব্যাপার এত রাতে না ঘুমিয়ে তুমি এখানে কী করছ?
_" ভালো লাগছে না!
_" দেখো আবির সুমনাকে তুমি ছেড়েছিলে, সুমনা তোমাকে নয়! এখন ওকে নিয়ে খবরদার মাথা ঘামাবে না। আমি চাইনা আমার স্বামী আমি ব্যতিত অন্য মেয়েকে নিয়ে রাত দুপুরে ভাবুক। রাত অনেক হয়েছে। ঘুমাবে এসো। আমার মেজাজ খারাপ করবে না।
আবির সিগারেট ফেলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
৪!!
সকাল বেলা সুমনা ঘুম থেকে জেগে রুমে বসে রইল। কার কাছে কি যাবে ভেবে পাচ্ছে না। রাজ মহলের মত এ বাড়ির কিছুই চিনে না ও। তখন রুমে রিমি উঁকি দিয়ে বলল,
_" আসব?
সুমনা মুচকি হেসে বলল,
_" আসুন।
রিমি রুমে ঢুকে বলল,
_" দুঃখীত কাল রাতে আপনার সাথে আমার তেমন পরিচয় হয়নি। আমি রিমি। এ বাড়ির ছোট বউ। আবিরের স্ত্রী।
সুমনা মৃদু হেসে রিমির দিকে ভালো করে তাকাল। মনে মনে বলল,
_" সত্যি হিংসা করার মত সুন্দর মেয়েটা। আবির কেন অনেক ছেলেই এ মেয়ের প্রেমে পড়ে যাবে। দেখতে সুন্দর, বাবা প্রচুর বড়লোক, এর জন্য আবির পাগল হবে নাতো ওর জন্য হবে! রিমি সুমনার হাতে এক জোড়া বালা দিয়ে বলল,
_" গতকাল আপনার জন্য আমি উপহার এনেছিলাম কিন্তু আবিরের শরীরটা খারাপ হওয়ায় দিতে পারিনি।
সুমনা উপহারটা নিতে বেশ ইতস্তত বোধ করল। তারপর বলল,
_" এত দামি উপহার কী করে নিব?
_" উপহারের দাম নয়, যে উপহার দেয় তার স্নেহ দেখা হয়। প্লিজ নিন।
_" তুমি আমাকে আপনি করে না বলে তুমি ডাকো। আমরা মেবি সমবয়সী হব।
রিমি মুচকি হেসে বলল,
_" তোমার চেয়ে আমি বছর খানিকের বড়।
_" কিভাবে বুঝলে?
_" আবির বলেছে।
সুমনা হালকা অবাক হয়ে বলল,
_" কী বলেছে?
_" এই যে একসময় তোমার আর আবিরের মধ্যে রিলেশন ছিল।
কথাটা শুনে সুমনা বেশ ধাক্কা খেল। ও চিন্তাও করেনি, আবিরের বউ এসব জানে। তাছাড়া মেয়েটা সব জেনে এত স্বাভাবিক কিভাবে? সেটা ভেবেও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। ভাবল ওকে জিজ্ঞেস করব, ও কিভাবে জানে বা কী কী জানে? পরোক্ষণে ভাবল মেয়েটা কি কোনো পরিকল্পনা করে এসেছে?
—————
রিমির কথা শুনে সুমনা বেশ ধাক্কা খেল। ও চিন্তাও করেনি, আবিরের বউ এসব জানে! তাছাড়া মেয়েটা সব জেনেও এত স্বাভাবিক কিভাবে? কেমন স্বাভাবিক ভাবে ওর সাথে কথা বলছে, সেটা ভেবেও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে সুমনার! একবার ভাবল ওকে জিজ্ঞেস করবে, ও কিভাবে জানে বা কী কী জানে? পরোক্ষণে ভাবল মেয়েটা কি কোনো পরিকল্পনা করে এসেছে? হতেও পারে! নয়ত নিজের স্বামীর সম্পর্কে এমন ঘটনা জেনে একটা মেয়ে এতটা স্বাভাবিক কিভাবে? সুমনা তবুও বেশ সাহস করে বলল,
_" সব জেনেও তুমি স্বাভাবিক কিভাবে?
_" অস্বাভাবিক কেন হব ছোট মা? তোমাকে ছোট মা ডাকি কি বলো? যেহেতু শ্বাশুড়ি সেহেতু মায়ের মতই সম্বোধন করা উচিত।
_" হুঁ।
_" শোনো ছোট মা, আমি আবিরের সম্পর্কে বিয়ের আগেই সব খোঁজ নিয়েছি। আসলে আবিরকে আমি প্রথম একটা অনুষ্ঠানে দেখি। তখন ওকে আমার ভালো লেগে যায়। ভালো লেগে যায় বলতে আমার মনে হয়েছে আমার লাইফ পার্টনার ও হতে পারবে। ছোট বেলা থেকে আমি যা চেয়েছি বাবা তাই দিয়েছি। আবিরের কথা বাবাকে বলেছি, বাবা সব খোঁজ নিয়ে, তোমার কথাও জানতে পারলেন। আমাকে সব বললেন। আমি বললাম, আবির কাকে ভালোবাসে তা আমার দেখার বিষয় না। আমি ওকে ভালোবাসি বিয়ে করতে চাই সেটাই বড় কথা, ও কাকে ভালোবাসে সেটা বড় কথা না।
সুমনা হালকা গলায় বলল,
_" ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছি যে তোমাকে ভালোবাসে তাকেই আপন করো, যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে নয়!
রিমি মৃদু হেসে বলল,
_" আমি এসব লাভ ফিলোসফি মানি না। আমি অন্যের পছন্দকে নয়, বরং আমার নিজের পছন্দকে বেশি প্রধান্য দেই। সো আবিরকে আমার ভালো লেগেছে মানে আমার ওকে চাই। তারপর বাবা আবিরের বাবার সাথে সরাসরি কথা বললেন। তিনি প্রথম বারেই রাজি হলেন। আবির বলেছে, আবিরের বাবা ওর সাথে কথা বলে আমার ছবি দেখিয়েছিল। তা ছাড়া আমরা দুজন সরাসরি মিট করি কয়েকবার। আবিরেরও আমাকে পছন্দ হয়েছে, আমার তো ওকে প্রথম থেকেই ভালো লাগত। দুই পরিবারের সম্মতি ছিল, বিয়ে হয়ে গেছে। আমি অবশ্য বিয়ের আগে আবিরকে বলেছিলাম, তোমাকে সবটা বলে দিতে, আমি বিয়ের পরে অতীতের কোনো ঝামেলা চাইনি। কিন্তু আবির বলেনি সেটা আবিরের ব্যাপার। সে যাই হোক আমার মতে অতীতকে অতীতে রেখে দেয়াই বেটার। মানুষকে তার বর্তমান নিয়ে চিন্তা করা উচিত। অতীত নিয়ে চিন্তা করে বর্তমান নষ্ট করার কি কোনো মানে আছে?
সুমনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
_" সব কি এতটাই সহজ!
_" হয়তো না। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে অসম্ভব। দেখো তোমার বিয়ে যেভাবেই হোক আমার শ্বশুরের সাথে হয়েছে। এখন তোমার এই সত্যটাকেই মানা উচিত এবং এ মতেই নিজের জীবন সাজানো দরকার বলে অামি মনে করি। এখন আবিরের সাথে তোমার যে সম্পর্কটা ছিল সেটা কেবলই অতীত। আর অতীতকে ভেবে বর্তমানকে নষ্ট করার কোনো মানেই আমি দেখি না। কখনো কখনো অতীত আকড়ে থাকা বোকামি। আমি যতদূর জানি বিয়ে শাদি সৃষ্টিকর্তার হাতে, তিনি বোধ হয় আমার এবং তোমার বিয়ে এভাবেই লিখে রেখেছেন। তো আমাদের এটা মেনে নেয়া উচিত। আমি আমার জীবনে সবসময় সুখী থাকতে ভালোবাসি, তুমিও তেমন করো। অতীত ভুলে নতুন করে শুরু করো। তোমার বিয়ে যে ভাবেই হোক, বা যার সাথেই হোক এখন তুমি বিবাহিত। নিজের নতুন জীবনটা নতুন করে সাজাও।
সুমনা মৃদু হেসে বলল,
_" আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি ইনডায়রেকলী আমাকে শাসানোর চেষ্টা করছ বা আমাকে সাবধান করছ!
মৃদু হেসে রিমিও বলল,
_" তুমি সত্যি বুদ্ধিমতি মেয়ে। গভীর কথাও অল্পতে বুঝে যাও।
_" এবার তাহলে ক্লিয়ার ভাবে বুঝিয়ে বলো?
_" দেখো ছোট মা আমি এটা বোঝাতে চাইছি তুমি আমার আর আবিরের জীবনে কোনো ভাবে দখল দেয়ার চেষ্টা করো না। তুমি আমার শ্বাশুড়ি হিসাবে এ বাড়িতে এসেছো সে রকমই থাকো। তোমাকে তোমার প্রাপ্য সম্মান আমি দিব। আর হ্যাঁ আবিরকে আমি সামলে নিব। ওকে সামলানোর কৌশল জানি আমি। শুধু এটাই বোঝাতে চেয়েছি।
_" তোমার কেন মনে হল আমি তোমাদের জীবনে দখল দিব?
_" আমার চোখে তো ছানি পড়েনি ছোট মা। কাল থেকে তোমার মুভমেন্টগুলা আমি খুব ভালো করে খেয়াল করেছি। আবিরকে দেখলে তোমার মুখভঙ্গি, মুখের রহস্যময় হাসি দেখে আবির কিছু না বুঝলেও আমি একটু হলেও বুঝতে পেরেছি। আবির ভয় পাচ্ছে, খানিক হিংসায় জ্বলছে আর আবিরকে টর্চার করে তুমি কাল থেকে খুব মজা পাচ্ছো।
সুমনার মুখটা চুপসে গেলো। রিমি এতটা বুদ্ধিমতি মেয়ে তা সুমনা কল্পনা করতেও পারেনি। রিমি আবার বলল,
_" আমি আবিরকে ভালোবাসি। আর আমি যা ভালোবাসি তা নিজের কাছে রাখার জন্য সব করতে পারি সব।
_" তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
_" ভাবতে পারো। যাই হোক অনেক কথা বললাম। ফুপু আম্মা আমাকে পাঠিয়েছেন তোমাকে নিচে নিয়ে যেতে নাস্তা করতে। কাল তোমাদের বউভাত। তারপর আমি এমনিও আবিরকে নিয়ে আমার বাড়ি চলে যাব। আমি বা আবির কিন্তু এখানে থাকি না। আমার শ্বশুরের সম্পত্তির উপর কোনো লোভ আমার নেই। আমার বাবার তার চেয়ে কম নেই কোনো অংশে। বাবা তো শীঘ্রই সব সম্পত্তি আমার আর আবিরের নামে করে দিবেন। আমার বাবাও কিন্তু দেশে তেমন থাকেন না। আমার আর বাবার লন্ডনের সিটিজেনশীপ আছে, আবিরেরটাও কদিনের মাঝে হয়ে যাবে। বাবা তো লন্ডনই থাকেন। আবিরের সব কিছু ঠিক হলে তারপর আমি আর আবিরও চলে যাব। সো বুঝতেই পারছ আমাদের নাগাল পাবে না। তাই কোনো পরিকল্পনা করেও তেমন বিশেষ লাভ হবে না! চলো চলো নাস্তা করবে।
সুমনা 'থ' মেরে বসে রইল। যুদ্ধ শুরু হবার আগেই হেরে গেলে যেমন নিজেকে বিপর্যস্থ মনে হয় আজ ওর নিজেকে তেমন বিপর্যস্থ, পরাজিত মনে হচ্ছে। মনে মনে ভাবল, তবে কি শুরু করার আগেই শেষ হয়ে গেল সব? হেরে গেল ওর ক্রোধ?
৫!!
মনটা ভালো না সুমনার। সকাল বেলা রিমির বলা কথাগুলো শোনার পর থেকেই মন বড্ড ভার হয়ে আছে। কিছু যে চিন্তা করবে তার মত কোনো বুদ্ধি পাচ্ছে না। হুট করে ওর বুদ্ধি গুলো যেনো ওকে ধোকা দিয়ে রিমির কাছে চলে গেছে। বাড়ির সবাই আগামীকালকের বউ ভাত নিয়ে ব্যস্ত। নুরুল সাহেবও কিছু কাজে বাইরে গেছেন। সুমনা একা একা বসে আছে নিজের রুমে। তখন আবিরের বড় আর মেজ ভাই আবিদ, আহাদ, সাথে ওদের দুজনার স্ত্রী হিমি, আফিফা দরজার কাছে এসে দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
_" ছোট মা আসব?
সুমনা তাদের চিনে। তাই মৃদু হেসে বলল
_" আসুন।
তারা ভিতরে ঢুকে বসল। হিমি বলল,
_" আপনার কোনো কষ্ট হচ্ছে নাতো?
_" জি না।
_" কোনো কিছু লাগলে জাস্ট একটা ডাক দিবেন আমরা হাজির হয়ে যাব।
_" মৃদু হাসল সুমনা।
আফিফা বলল,
_" বয়সে আপনি আমাদের সবার চেয়ে ছোট। তাও আমরা আপনাকে মায়ের মতই সম্মান করব ভালোবাসবো। সন্তানদের কাছে কিছু চাইতে সংকোচ করবেন না।
আবিদ খানিক হেসে বলল,
_" ছেলেদের কাছে মায়ের কী লজ্জা? আসলে আপনার বয়স শুনে আমরা সবাই বিয়েতে ঘোর অমত করেছিলাম পরে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল সত্যি আমাদের মা ফিরে এসেছেন। তখন আর অমত করতে পারিনি। তবে আপনার জন্য আমাদের খারাপ লাগে। আপনার এখন পড়াশোনা করার বয়স, জীবনটাকে উপভোগ করার বয়স কিন্তু এ বয়সে এত বয়ষ্ক একজন লোকের স্ত্রী হয়ে তার সংসার সামলানো মুখের কথা না। সে যাই হোক আমরা আছি তো। আমরা আপনাকে সবসময় হেল্প করব। মা চলে যাবার পর বাড়িটা কেমন হয়ে গেছে। আমরা চাই আপনিও মায়ের মত বাড়িটাকে মুখরিত করে রাখুন।
সুমনা তাদের কথায় উত্তর না দিয়ে শুধু ম্লান হাসল।
আহাদ বলল,
_" ছোট মা বাবা খুব ভালো মানুষ। যদিও এ বয়সে এসে সে আপনার সাথে অন্যায় করেছেন। তবে আমাদের বাবা তো, তাকে খুব ভালোবাসি। তাই তার অন্যায়টা দেখে, ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মেনেনি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাবা বেশ সিনক্রিয়েট করতেন। বাবা কেন জানি ভাবেন আমরা তার সম্পত্তির লোভে এখানে পড়ে আছি, বা তার খেয়াল রাখছি, যেটা বলা যায় ভিত্তিহীন। এটা বললে মিথ্যা বলা হবে যে, বাবার সম্পত্তির উপর আমাদের আগ্রহ নেই। আগ্রহ অবশ্যই আছে, তবে সম্পত্তির আগে, আমরা বাবাকে ভালোবাসি তাই এখানে আছি। তাছাড়া বাবার সম্পত্তির লোভে এখানে থাকার কী দরকার? বাবার সম্পদ তো ছেলেরা এমনিই পায়। সম্পত্তির লোভে বাবাকে সম্মান করব ততটা নীচ আমরা নই। আমাদের মা বা বাবা আমাদের সে শিক্ষা দেননি। বাবা আমাদের প্রতি আমাদের অনেক ভালোবাসা সম্মান আছে বলেই আমরা বাবাকে ছেড়ে যাইনা। বাবা মায়ের চেয়ে পৃথিবীতে কে বড় বলুন তো!
কিন্তু বাবা নিজ মনে ভেবে নিয়েছেন আমরা তাকে ভালোবাসি না বরং তোষামদ করি, তার সম্পত্তির জন্য। সে বাবা যাই ভাবুক আমরা বাবার প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করব। বাবা যেহেতু আপনাকে বিয়ে করেছেন সেহেতু আপনি তার স্ত্রী এবং সে হিসাবে আপনি আমাদের ছোট মা। আপনাকে নিজের মায়ের থেকে কোনো অংশে কম দেখব না। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে নিঃসংকোচে আমাদের কাছে বলবেন।
তারপর তারা আরও কিছু কথা বলে সুমনার ঘর থেকে চলে গেল।
সুমনা ভাবতে থাকল,
_" ঘরের লোকগুলো খারাপ নয়! এখন তো ভালোই মনে হচ্ছে, পরেরটা পরে দেখব। একটা কথা ভেবে খুব হাসি পাচ্ছে এনারা দুই ভাই আমার চেহারায় তাদের মাকে খুঁজে পেয়েছেন, তবে আবির কেন কখনো বলেনি আমি দেখতে ওর মায়ের মত! এত বছরের সম্পর্ক ছিল আমাদের কই আবির তো তেমন কিছু বলেনি! নাকি আবিরের চোখ আমাকে ঠিকভাবে দেখেনি! ভালো কি আমায় বেসেছিল আবির!
৬!!
আজ বউ ভাত সুমনার। বউ ভাতের দিন সকাল বেলায়ই সুমনার চাচার দুই মেয়ে আর এক ছেলে সাথে সুমনার বান্ধবী রত্না আসল।
সুমনা রুমে বসে বসে ভাবছিল, গতকাল রাতের কথা। গতকাল রাত বাড়ার সাথে সাথে সুমনার ভয়ের মাত্রা বাড়ছিল ক্রমশ। আর নুরুল সাহেব রুমে আসার সাথে সাথে ভয় হাজার গুন বেড়ে গেল। কিন্তু নুরুল সাহেব রুমে এসে, পাঞ্জাবিটা বদলে, বুকের ব্যথার ঔষধ খেয়ে বলেছিলেন,
_" সুমনা বুকটা বড্ড ব্যথা করছে। বুকে একটু মালিশ করে দিবে?
সুমনার রাগে গা জ্বলছিল। মনে মনে বলেছিল, বুড়ো ভামটা বলে কি? শত অনিচ্ছ থাকা সত্ত্বেও তারপরও বুকে মালিশ করে দিচ্ছিল।
নুরুল সাহেব সুমনার দিকে তাকিয়ে বললেন,
_" বুঝলে সুমনা কিছু মানুষ যে বলে না, পুরুষ মানুষ শুধু মাত্র নিজের শরীরের চাহিদা মেটাতে বা বংশবৃদ্ধি করতে বিয়ে করে, সে হোক বুড়ো বা যুবক! কথাটা কিন্তু পুরোটা সত্যি নয়। এটা সত্যি পুরুষ মানুষের অনেক বয়স পর্যন্ত শারিরীক চাহিদা থাকে তবে, একজন পুরুষ নিজের চাহিদার থেকেও একজন পাশে থাকার সঙ্গীকে বেশি চায়। তুমি জানো কিনা জানি না, পুরুষরা উপরে যতটা শক্তভাব দেখাক না কেন, ভিতরে ভিতরে তারা ঠিক ততটাই নরম। ঠিক নারকেলের মত। এরা আসলে একাকিত্বকে ভীষণ পায়। সবসময় নিজের আশে পাশে কোলাহল নয়ত কারো উপস্থিতি কামনা করে। যে জন্যই একজন পুরুষের সঙ্গীর খুব প্রয়োজন।
একজন পুরুষ শুধু তার বংশ বৃদ্ধির জন্য বা তার শারিরীক চাহিদা পূরনের জন্য বিয়ে করে না! বরং সে সারা জীবনের জন্য একজন সঙ্গী পাবার তীব্র ইচ্ছায় বিয়ে করে। এমন একজন সঙ্গী যে তাকে মেন্টালী, ফিজিক্যাললী সবক্ষেত্রে সঙ্গ দেয়। গল্প বলার পরম সঙ্গী হয়, বিপদের ভরসা দেয়ার বন্ধু। তাকে একটা র্নিদিষ্ট বাঁধনে বেঁধে রাখার শক্ত হাত হয়। একজন নারীই পারে একজন পুরুষের জীবন সুন্দর থেকে সুন্দরতম করে তুলতে। সত্যি কথা বলতে সবাই বলে না পুরুষ ছাড়া নারী কিছু না, এগুলো আসলে দাম্ভিক অহংকারি পুরুষের কথা। আসলে উভয় একে অপরকে ছাড়া কিছু নয়।
ছোটবেলা থেকেই তো আমরা পুরুষরা নারীদের মাঝেই বেড়ে উঠি। একটা ছেলেকে জন্মদিয়ে পুরুষ করে তার মা, স্নেহ বকা দিয়ে শাসন করে বোন, মা বাবার বকুনী থেকে আঁচলে লুকিয়ে বাঁচায় দাদি-নানি। সারা জীবন সুখে দুঃখে পাশে থাকে, সব কিছুতে সাপোর্ট করে যে, অর্ধাঙ্গী হয়ে পাশে থাকে স্ত্রী। বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার রাজকুমারী কন্যা। এখন বলো আমরা পুরুষ হয়ে কিসের দম্ভ দেখাব? ছোট বেলা থেকে নারী ছাড়া দু পা চলতে পারি না। তবে কিসের জোরে নারীদের ছোট করব। নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারবে না। দম্ভ করার মত কিছুই মানুষের নেই। না আছে নারীর, না পুরুষের। দম্ভ তো একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই করতে পারেন। কারণ দম্ভ করার মত গুন তার আছে। কারণ তিনি সৃষ্টিকর্তা।
দেখো কোন কথা থেকে কোন কথায় গেলাম। মৃদু হেসে নুরুল সাহেব বললেন, তো যা বলছিলাম একজন পুরুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী সঙ্গ চাই। আমার স্ত্রী শোভা চলে যাবার পর আমার নিজেকে এতটা নিঃসঙ্গ মনে হত যা বলার বাইরে। সবসময় গল্প করার জন্য, নিজের মনের কথা বলার জন্য, নিজের দ্বন্দ সমাধানের জন্য পাশে একজনকে মন চাইত। ছেলে/মেয়ে বা ছেলের বউদের সাথে তো সব কথা শেয়ার করা যায় না। মূলত বৃদ্ধ বয়সে আমার একজন বন্ধুর মত সঙ্গীর দরকার ছিল। সে প্রয়োজনেই বিয়ে করা। আমি এটা বলছি না আমার অন্য কোনো চাহিদা নেই, কারণ আমার স্ত্রী মারা গেছেন বহুদিন হলো। তবে সেসব ইচ্ছা তোমার অনুমতির উপর বেশি র্নিভর করে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তো ছেলে খেলা নয়! একে অপরের মতামতকে প্রধান্য না দিলে সেটা একতরফা সম্পর্ক হবে! আমি সম্পর্কে একতরফা জিনিসটা পছন্দ করি না। এখন ঘুমাও। আমার বুকে ব্যথাটা কমছে অনেকটা।
নুরুল সাহেব চোখ বন্ধ করতেই সুমনা নিজ শরীরে নিজে চিমটি কেটে দেখল এতক্ষণ যা শুনেছিল, তা কল্পনা নাকি সত্যি। একজন ৫৫ বছরের বৃদ্ধের কথা বলার ধরনটা যেনো হুবহু ২৫ বছরের যুবকের মত। সুমনার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে মনে বলল,
_" রিমি কম টেনশন দিচ্ছিল যে এ বুড়ো ব্যাটাও যুক্ত হলো!
রত্মার ধাক্কায় বাস্তবে ফিরল সুমনা। রত্না বলল,
_" কীরে কী ভাবছিস?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুমনা বলল,
_" জীবনটা কেমন হয়ে গেল!
রত্না বেশ ক্ষোপ নিয়ে বলল,
_" কেউ সেধে নিজের জীবন নষ্ট করলে তাতে কে কী করতে পারে।
সুমনার এখন কিছু শুনতে ভালো লাগছে না। এমনি ওর মনে হচ্ছে ও হেরে গেছে। এখন রত্নার খোঁচা মারা কথা, হারটাকে যেনো বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে। রত্নার দিকে তাকিয়ে বলল,
_" তোর দুলাভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে?
_" দেখ সুমনা আমি এখানে তোর সাথে দেখা করতে এসেছি। তোর ঐ বুড়ো বরের সাথে ঢঙ্গের আলাপ করতে না।
সুমনা মৃদু হেসে বলল,
_" করনা আলাপ। দুলাভাই বলে কথা। গিয়ে গান গেয়ে বলবি,
দুলাভাই দুলাভাই,
ও আমার দুলাভাই,
চলো না সিনেমা দেখিতে আজ যাই।
সিনেমার নাম নাকি তোমাকে চাই দুলাভাই।
রত্না সুমনার মুখ চেপে ধরে বলল,
_" প্লিজ এসব হেয়ালী বন্ধ কর।
৭!!
নিচে একটা হট্টোগোলের মত শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো ঝামেলা হয়েছে। সুমনা বুঝতে পারছে না আসলে কী হচ্ছে! পার্লারের মেয়েরা ওকে সাজাচ্ছিল। সুমনা পার্লারের মেয়েটাকে বলেছে,
_" আপু আমাকে বেশি মেকাপ করবেন না। জাস্ট হালকা করে একটু সাজাবেন। আমার অতিরিক্ত মেকাপে গা গুলায়।
মেয়েটা তেমন করেই করল। চুলটা সুন্দর খোঁপা করে, হালকা মেকাপ করল। শাড়িটা পরিয়েছে, এখন শাড়ির সেফটিপিনগুলো কেবল লাগাবে কিন্তু তখনই নিচ থেকে হট্টোগোল শোনা গেল। সুমনা এখানে বসে বুঝতে পারছে না নিচে কি হচ্ছে! নিজে যেতেও পারছে না, নতুন বউ বলে কথা।
তখন সুমনার চাচাত ভাইটা এসে বলল,
_" আপু দুলাভাই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
সুমনার বুকটা কেমন ধক করে উঠল। সেফটিপিন ছাড়া শাড়িটা কোনমতে ধরে নিচে গেল। ততক্ষণে নুরুল সাহেবকে তার ছেলেরা গাড়িতে তুলে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। সুমনা, রিমি ওরা অন্য গাড়িতে তাদের গাড়ি ফলো করতে করতে হসপিটালে গেল। সুমনা রিমির কাছ থেকে শুনল, হঠাৎ নাকি নুরুল সাহেবের বুকের ব্যথা বাড়ে। কাউকে কিছু বলার আগেই মেবি হাঁটতে গিয়ে পড়ে যান। বাম পাশে আঘাত লেগেছে মেবি। মুখ নাকি বাঁকিয়ে গেছে। শুনে সুমনার খারাপ লাগছে খুব। কিন্তু স্বামীর এমন কথা শুনে স্ত্রীর যতটা কষ্ট হওয়া প্রয়োজন ততটা কষ্ট সুমনার হচ্ছে না। শুধু মানুষ হিসাবে মানুষের জন্য খারাপ লাগা কাজ করছে। সুমনা মনে মনে বলল, বিয়েটা সৃষ্টিকর্তা থেকে লেখা। মায়া আর মন তিনি তৈরী করলেও, সে মনে ভালোবাসার জন্ম নেয়টা বোধহয় এত সহজ নয়। যদি হতো তবে নুরুল সাহেবের জন্য স্বামী হিসাবে আমার মনে একটু তো ভালোবাসা তৈরী হত। হয়ত সময়ের ব্যবধানে হতো। সেটা তো সময় গেলে বুঝতে পারব।
ডাক্তাররা অনেক সময় নিয়ে নুরুল সাহেবের চিকিৎসা করে বললেন,
_" উনি তো এমনি হার্টের রোগী ছিলেন, আবার স্ট্রোক করায় ওনার শরীরের বাম পাশের কাজ করছে না। প্যারালাইসিস হয়ে গেছে শরীরের বাম পাশ। ঠিক হতে হয়ত সময় লাগবে। আবার কখনো ঠিক নাও হতে পারে! সময়ের সাথে সাথে বলা যাবে।
সুমনা দপ করে পাশের বেঞ্চে বসে পড়ল। মনে হল কলিজাটা ধরে কেউ খুব জোরে চাপ দিয়েছে। রাগের বশে কাউকে শাস্তি দিতে এসে, সে শাস্তি যে ওর বয়ে বেড়াতে হবে তা সুমনা কল্পনাও করেনি। সৃষ্টিকর্তা সবসময় তার মর্জিমত সব কিছু করেন। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। মানুষের পরিকল্পনা তো শুধু মস্তিষ্কের চিন্তা মাত্র। কিন্তু একজন আছেন যিনি মানুষ এবং তার মস্তিষ্ককে পরিচালনা করেন। তার হুকুমের বাইরে কিছু হয়না।
৮!!
দেখতে দেখতে কেটে গেল এক বছর তিন মাস। নুরুল সাহেব এখনও বিছানায় পরা। তার খেয়াল সুমনাই রাখে। নুরুল সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে সুমনার দিকে তাকিয়ে থাকেন, কিছু বলতে চান, কিন্তু তার জড়িয়ে যাওয়া কথা কেউ বুঝতে পারে না। হয়ত নিজের করা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সুমনার কাছে ক্ষমা চাইতে চান। শেষ বয়সে এসে তিনি যে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য হয়ত অনুতপ্ত। কিন্তু তার কথা কেউ বোঝে না। সুমনার অবশ্য তার জন্য খারাপ লাগে কষ্ট হয়, কিন্তু স্বামীর এ অবস্থায় স্ত্রীর বুক ভেঙে যে কষ্ট হবার কথা তেমন হয়না তার জন্য। মায়া তো এমনি এমনি হয় না। সাথে থেকে ভালোবাসার আদান প্রদানে মায়ার জন্ম হয়। জন্ম হয় সুন্দর ভালোবাসাময় সম্পর্কের। তেমন কিছু তো নুরুল সাহেব আর সুমনার মাঝে নেই। তবে মায়া, ভালোবাসা আসবে কি করে!
সুমনা যেনো পৃথিবীর সবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইছে। ওর রাগের বশে নেয়া একটা সিদ্ধান্ত ওর সারা জীবনের কষ্টের কারণ হলো। এ জন্যই বোধ হয় সব ধর্ম গ্রন্থে বলা হয়েছে "রাগ মানুষের ঈমান নষ্ট করে"। "সেই ব্যক্তি উত্তম যে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রন করে ধৈর্য্য ধারণ করে। সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে চিন্তে কাজ করে।"
নুরুল সাহেবের ছেলেরা সুমনাকে নিজের মায়ের মতই সম্মান করে, খেয়াল রাখে। ওর সকল প্রয়োজনের দিকে নজর রাখে। সুমনার চাচার অবস্থা এখন অনেক ভালো। এসব কিছুই নুরুল সাহেবের ছেলেরা করেছেন। সুমনার চাচাতো বোনের বিয়ে হয়েছে বেশ ভালো, উচ্চঘরে। সুখে আছে সে। ওর চাচাতো ভাইদুটো ভালো স্কুল, কলেজে পড়ছে, চাচা ভালো ব্যবসা করছে, চাচি ঘরে রানীর মত থাকছে। সুমনার পরিকল্পনা মত সব হলেও যেটা ওর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আবিরকে শাস্তি দেয়া, সেটা ও দিতে পারেনি। সে কাজে ও ব্যর্থ হয়েছে। নুরুল সাহেব অসুস্থ হবার মাস খানিক পরই আবির আর রিমি লন্ডন চলে যায়। গত এক বছর তিন মাসে ওরা মোট দুইবার বাংলাদেশে এসেছিল নুরুল সাহেবকে দেখতে। গত পাঁচ মাস যাবত শুধু ফোন করেই খোঁজ নেয়। কবে আসবে তা বলে না। মনে হয়না শীঘ্রই আসবে।
সুমনা প্রায় উপর দিকে তাকিয়ে বলে,
_" হে আল্লাহ আমার ক্রোধে নেয়া ভুল সিদ্ধান্তের শাস্তি তো তুমি আমায় দিলে কিন্তু আবির যে আমার সাথে অন্যায় করল তার কি শাস্তি হবে না? প্রকৃতির প্রতিশোধ নামেও তো কিছু আছে তা কি তুমি দিবে না!
সুমনা হয়ত জানে না। ভুল করে অন্যায় করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেউ পার পায় না। শাস্তি তাকে পেতেই হবে, হয় আজ নাহয় দুদিন পর। আবিরের ক্ষেত্রেও এ নিয়মের অন্যথা হবে না। সৃষ্টির নিয়ম সবার জন্য সমান।সৃষ্টি কর্তার কখনো ভুল হয়না।
বিয়ের কয়মাস পর থেকেই দুজনার সম্পর্ক ফিকে হতে শুরু করে। আসলে ওদের দুজনার মাঝে ভালোবাসা নয় শুধু মাত্র চোখের ভালো লাগা আর আকর্ষণ ছিল। আর চোখের ভালোলাগা, শরীরের আকর্ষণ বেশিদিন টিকে না। একটা সময় পর তা কমে যায়, না হয় শেষ হয়ে যায়। ওদের সম্পর্কটা এখন অনেকটা রংহীন। দুজন শুধু সম্পর্কটাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। হয় দায়বদ্ধতা থেকে, নাহয় লোক দেখান। আর সম্পর্কে দায়িত্ব পালনে ভালোবাসা বাড়ে, দায়বদ্ধতায় নয়। দায়বদ্ধতা ধীরে ধীরে সম্পর্কের গলা টিপে মেরে ফেলে।
সুমনা জানে না, আবির নিজ সিদ্ধান্তে নিজেই পস্তাতাচ্ছে। না জানুক সুমনা, তবুও আবির শাস্তি পাচ্ছে। প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয়না। যে ভালো তাকে প্রকৃতি দুহাত ভরে দেয়, আর যে অন্যায় করে তার কাছ থেকে সব কেড়ে নেয়। সেটা আজ হোক বা কাল, দ্রুত বা ধীর গতিতে। অন্যায় করার, ভুল সিদ্ধান্তের, ধৈর্য্য না ধরে ক্রোধ করার শাস্তি পেতে হবে সবাইকে। প্রকৃতির নজরের বাইরে কেউ নয়। সৃষ্টিকর্তার নজর সবস্থানে, তার নিয়ন্ত্রনের বাইরে কিছু নেই। অযথা রাগ করে নিজের ঈমান নষ্ট করবেন না। ধৈর্য্য ধারণ করুন, সময় নিন, বুঝুন, জানুন নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে।
***(সমাপ্ত)***