লাল ছাতি by মুশফিকা রহমান মৈথি |
১!!
গভীর রাতে ফিসফিসানির আওয়াজে নূরের ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ঘুমঘুম চোখে আশেপাশে তাকালো সে। তার পাশটা খালি, ঘরেও কেউ নেই। ফিসফিসানিটা গাঢ় হচ্ছে। ধ্বনি অনুসরণ করে নূর দৃষ্টিপাত করলো বারান্দা সংলগ্ন জানালাটির দিকে। বারান্দায় রিদওয়ানকে দেখা যাচ্ছে। সে ফোনে ব্যাস্ত। ঘড়ি না দেখলেও এটা বলাটা খুব কঠিন নয় এখন গভীর রাত। এতো রাতে কখনোই রিদওয়ানকে ফোনে ব্যাস্ত দেখে নি নূর। কারোর কি বিপদ হল! বিপদ আপদের বাপ মা নেই, হুটহাট কখন কার হয় তা অনুমান করা কঠিন। নূর ধীর পায়ে উঠে বারান্দার দিকে এগোলো। বারান্দার কাছে যেতেই রিদওয়ানের ক্ষীণ উত্তেজিত কন্ঠ কানে এলো নূরের,
"রাগবো না মানে! আমার জায়গায় যে কেউ হলেই রাগতো! রাত তিনটা কি কোনো সময়? একটু হলেই তো নূরের ঘুমটা ভেঙ্গে যেতো। কি উত্তর দিতাম তখন?"
কারোর কথায় আড়িপাতা উচিত নয়, কিন্তু আজ কেনো যেনো নূরের ইচ্ছে হলো রিদওয়ানের কথা শুনতে। রিদওয়ানের কন্ঠের স্বর বাড়লো, সে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
"এই কাঁদবে না, আমি কাঁদার কোনো কথা বলি নি তোমাকে, পারমীতা। আর এখন ফোন রাখছি, নূরের ঘুম পাতলা। আমরা কাল দেখা করেই কথা বলবো। রাখছি "
পারমীতা নামটি শুনতেই থমকে যায় নূর। নামটি শুধু পরিচিত বললে ভুল হবে। কারণ পারমীতা তার খুব ভালো বান্ধবী। কিছুদিন হলো সে রিদওয়ানের যে কোম্পানিতে চাকরি করে সেখানেই জয়েন করেছে। নূরের মাথাটা ঝিম ধরে এসেছে। প্রথম সদ্য কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেছে, উপরন্তু পারমীতার নামটি। মেয়েটি কেনো এতো রাতে রিদওয়ানকে ফোন করবে! শুধু ফোন নয়; সে আবার কাঁদছিলো ও। কিন্তু কেনো!
ফোন কেটে পেছনে ফিরতেই চমকে উঠে রিদওয়ান। নূর তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে আশা করে নি সে। নূরকে দেখে রীতিমতো থতমত খেয়ে যায় রিদওয়ান। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,
"এ..একি তুমি এখানে?"
রিদওয়ানের আড়ষ্টতা নূরের মনে সন্দেহের ক্ষীন দাগ টানে। রীতিমতো ঘাবড়ে গেছে রিদওয়ান। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার বারান্দার হলুদ আলোতে চকচক করছে। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। সে কিছু একটা লুকাতে চেষ্টা করছে নূর থেকে। নূরের ভ্রুযুগল সরু হয়ে আসে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে সন্দীহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সে,
"পারমীতা এতো রাতে কেনো ফোন দিয়েছে?"
নূরের আচমকা প্রশ্নে একটু নড়ে চড়ে উঠে রিদওয়ান। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
"আসলে কাল একটা প্রেজেন্টেশন আছে তো, সেই বিষয়ে হেল্প চাই ওর"
রিদওয়ান মিথ্যে বলছে। নূর এতোও বোকা নয় এই সামান্য বিষয়টা বুঝবে না। সে আশাহত হলো, হৃদয়টা কিঞ্চিত আহত ও হলো। রিদওয়ান তাকে সত্যিটা বললো না। একটা মানুষ যখন নিক থেকে সত্যি না বলে, তাকে জোর করে লাভ হয় না। তাই নূর কথা বাড়ালো না। ঘুরে রুমে চলে গেলো। নূর চলে গেলে রিদওয়ান ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো, যেনো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে সে।
নূর এবং রিদওয়ানের বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক। তাদের প্রেমের বিয়ে নয়, যাকে বলা হয় সম্পূর্ণ ঘটা করে বিয়ে। পারিবারিক পছন্দে বিয়ে হয়েছে তাদের এবং সাবলীল, সুন্দরভাবেই সংসার করছে এই দম্পতি। একটা সুন্দর সম্পর্ক যাতে এক নিবিড় বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। যেদিন প্রথম রিদওয়ানকে দেখেছিলো নূর সেদিন ই তার মনে ধরে তাকে। লাল ছাতি হাতে নূরের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। পরণে নীল শার্ট, হাতা গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত উঠিয়ে রেখেছিলো। হাতে কালো ডায়ালের ঘড়ি। কাঁধে ছিলো ল্যাপটপের ব্যাগ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো সে এসেছে অফিস থেকে। বিয়ের পূর্বে নূরের সাথে একবার দেখা করতে চেয়েছিলো সে। লোকটিকে ছবিতে দেখে ভালো লাগলেও সামনাসামনি দেখে মনের আঙ্গিনায় বেশ প্রভাব ফেলেছিলো। মনে দাগ কেটে ছিলো লোকটি। ভালোলাগাটা সুগাঢ় হয়েছিলো। অবশ্য এতো ভদ্র, স্থির ব্যাক্তিকে যে কারোর ই মনে ধরবে। এক স্নিগ্ধ, শালীন ব্যাক্তিত্বের মানুষ রিদওয়ান। আজ অবধি তাকে কখনো উচ্চ স্বরে কথা বলতে দেখে নি নূর। অত্যন্ত দায়িত্বশীল একজন মানুষ রিদওয়ান। তার বাবা-মার প্রতি কোনো দায়িত্ব এড়ায় না সে। উপরন্তু নূরের প্রতি তার বন্ধুসুলভ এবং যত্নশীল আচারণে আরোও তার প্রতি আকৃষ্ট হয় নূর। ধীরে ধীরে এই আকর্ষণ ভালোবাসার স্নিগ্ধ অনুভূতি দেয় তাকে। কিন্তু রিদওয়ানের দিক থেকে সম্পর্কটা আগায় নি। এর কারণ নূরের জানা নেই। লোকটি নূরের ভালোমন্দের খেয়াল রাখলেও কখনো মুখ ফুটে বলে নি যে সে নূরকে ভালোবাসে। তাই এই ছয় মাসে সম্পর্কটা যেনো কোথাও একটা থেমে আছে। এতোদিন মাথা না ঘামালেও আজ কেনো জানে বিষয়টা ভাবাচ্ছে নূরকে। রিদওয়ানের সন্দেহজনক আচারণ তাকে বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে,
"সে কি আদৌ তাকে মনে ঠায় দিয়েছে?"
সকাল হতে না হতেই ব্যাস্ত শহরের ব্যস্ত কোলাহল শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, এ যেনো নিত্য দিনের সঙ্গী। ভাদ্র মাসের তীর্যক সোনালী কিরণ নূর এবং রিদওয়ানের ছোট রুমটিকে আলোকিত করে তুলেছে। আড়মোড়া দিয়ে উঠে নূর। আজ অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে উঠতে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা জানান দেয় রাতের অসম্পূর্ণ ঘুমের। চোখ খুলতেই নজর পড়ে রিদওয়ানের দিকে। সে তৈরি হচ্ছে। অফিসের জন্য বের হবে। হাই তুলে নূর বলে,
"তুমি রেডি হয়ে গিয়েছো, আমায় ডাকলে না যে?"
রিদওয়ান টাই বাঁধতে বাঁধতে মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
"তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে, তাই ডিসটার্ব করলাম না।"
"মা-বাবা খেয়ে নিয়েছেন?"
"সেই কখন, জানোই তো মার টাইমিং।"
নূর ছোট্ট করে "হু" বলে। সে কাতর চোখে দেখতে থাকে তার বরকে। আজ বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে। কালো শার্ট, কালো টাই এ বেশ মানাচ্ছে। বুকের বা পাশটা অস্থির হয়ে আছে। কেনো যেনো সূক্ষ্ণ ব্যাথা তার হৃদয়কে গ্রাস করছে। সূক্ষ্ণ সন্দেহ মস্তিষ্ককে ব্যাকুল করে তুলছে। মনের এক কোনে রিদওয়ানকে হারানোর সূক্ষ্ণ টলমলে ভয়টা উঁকি দিতে লাগলো। চোখের কোনে নোনা জল জমতে লাগলো নূরের। এর মাঝেই রিদওয়ানের সুন্দর কন্ঠটি কানে এলো,
"কি হলো? আজ অফিস যাবে না?"
"মাথা ব্যাথা করছে, আজ যাবো না।"
"খুব বেশি ব্যাথা করছে? জ্বরটর বাধালে?"
রিদওয়ানের কন্ঠে অস্থিরতার পরিচয় পেলো নূর। তার মুখ খানিকটা চিন্তিত হয়ে আছে। নূরের জন্য এখনো সে আগের মতোই রয়েছে। রিদওয়ান তার কাছে এসে বসলো, কপালে হাত দিয়ে বললো,
"জ্বর তো নেই, মাইগ্রেনের সমস্যা আছে নাকি তোমার?"
রিদওয়ানের চোখে নিজের প্রতি অস্থিরতা দেখে অস্থির ব্যাকুল মনটা শান্ত হয়ে যায় নূরের। মুচকি হেসে বলে,
"সামান্য মাথা ব্যাথা দেখি সাহেবকে ব্যাস্ত করে তুলেছে! চিন্তা করো না, আমি রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবো। "
"সত্যি তো তো?"
"হু, শুধু আসার সময় আমার জন্য সেলিমের হোটেলের সিঙ্গারা নিয়ে এসো।"
"পাগলী"
নূরের নাকটা টেনে উঠে দাঁড়ালো রিদওয়ান। রিদওয়ান অফিস যাবার পর কিছুক্ষণ বসে রইলো বিছানায়। কিভাবে পারলো সে রিদওয়ানকে সন্দেহ করতে। হতেই পারে সত্যি পারমীতা অফিসের কাজেই ফোন দিয়েছে। শুধু শুধু রাতের ঘুমটা হারাম করলো। নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মারলো সে। তারপর, বিছানা গুছিয়ে বের হয় নূর। শ্বাশুড়ি নাজমা বেগম ডাইনিং টেবিলে বসে চালকুমড়ো কাটছেন। নূরকে দেখেই তিনি বললেন,
"আজ অফিসে গেলে না যে নূর?"
"মাথা ব্যাথা করছিলো মা, আর আমার ছুটি আছে। একদিন কামাই এ কিছু হবে না।"
"খুব বেশি?"
"না মা, রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। চা খাবেন?"
"খেলে মন্দ হবে না।"
নাজমা বেগমের সাথে নূরের বেশ খাতির। মহিলা তার চাকরিকে খুব সাপোর্ট দেন, তার মতে মেয়েদের যদি দক্ষতা থাকে শুধু বাসায় বসে এই দক্ষতার উপর মরিচা পড়াবে কেনো! চা খেতে খেতে নাজমা বেগম বলে উঠলেন,
"কাল একটু ভালোমন্দ রান্না করো নূর।"
"কেনো মা, কেউ কি আসবে?"
"রিদওয়ান বললো, ওর কলিগেরা নাকি আসবে।"
"আমাকে তো বললো না এ ব্যাপারে কিছু!"
"হয়তো ভুলে গিয়েছে। আসলে কাজের যা চাপ। আমাকে বলেছে আজ বের হবার সময়।"
"ওহ"
নূর আর কথা বাড়ালো না। নাজমা সাহেবের সাথে ঘরের কাজে হাত লাগালো। সারাটা দিন টুকিটাকি কাজ করেই পার করলো নূর। শুক্রবার ব্যাতীত শ্বশুর শাশুড়ীকে তেমন সম্য দেওয়া হয় না নূরের। আজ বহুদিন বাদে তাদের সাথে আড্ডা দিয়েছে সে, নিজের একান্ত সময় কাটিয়েছে নূর। মাঝে মাঝে এমন ছুটি নেওয়া উচিত। পরিবারকে সময় দেওয়াটাও জরুরি। এতে পরিবারের সম্পর্কগুলো দৃঢ় হয়।
রিদওয়ান ফিরলো রাত নয়টায়, হাতে নীরের পছন্দের সিঙ্গারা। যদিও ঠান্ডা হয়্র গিয়েছে। তবুও নূরের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যথেষ্ট। রাতের খাওয়ার সময় নূর কথাটা পারলো,
"মা বললো, কাল নাকি তোমার কলিগরা আসবে। আমায় তো বললে না, হুট করে এই আয়োজন?"
"আসলে এবার প্রমোশনের পর রিজবি বেশ জিদ করছিলো, বিয়ে প্রমোশন দুটোই হলো। অথচ খাওয়ানো হয় নি। তাই ভাবলাম দাওয়াত করি। আগে তো তুমি ছিলে না, মাকেই বলতাম। তাই সে অভ্যাসটাই রয়ে গেলো।"
"সমস্যা নেই, আসলে হুট করে মা বললো তাই আর কি! তা কারা আসছে?"
"রিজবি, মনির, তানি, শুভ আর পারমীতা।"
"পারমীতাও আসছে?"
নূরের প্রশ্নে বিষম খায় রিদওয়ান। রিদওয়ানের বিষম লাগায় পানি এগিয়ে দেয় নূর। পানি খেতে খেতে রিদওয়ান বললো,
"আসলে ও তো জুনিয়র, উপরে তোমার বান্ধবী। তাই ওকে ও বলেছি৷"
নূর কিছু বললো না, তবে মনটা খচখচ করছে। পারমীতা নামটা যেনো গলার কাটার মতো বিধছে; না বের করতে পারছে, না গিলতে পারছে।
শুক্রবার,
সকল কলিগের সাথে পারমীতাও আসলো নূরের বাসায়। মেয়েটি সত্যি খুব অপরুপা, কিন্তু তার ভাগ্যটা আর পাঁচটা মানুষের মতো নয়। এতো সুন্দর মেয়েটিও প্রতারিত হয়েছে। প্রতারিত হয়েছে ভালোবাসায়। নূরকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো সে। বহুদিন বাদ দেখা হচ্ছে তাদের। খাওয়া শেষে সবাই যখন গল্পের আসর বসালো তখন নূর খেয়াল করলো রিদওয়ান এবং পারমীতা উভয়ই নেই। নূরের মনে কৌতুহল জন্মালো। তাদের খুজতে খুজতে নূর পৌছালো নিজের বেড রুমের বাহিরে। দরজাটা হালকা ভেজানো। বুকটা অহেতুক কারণেই ধরফর করছে নূরের। কেনো যেনো খুব কাঁপছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে দরজাটা খুললো নূর। দরজা খুলতেই যা দেখলো তাতে নূরের মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়। রিদওয়ান পারমীতাকে জড়িয়ে ধরে আছে...........
২!!
খাওয়া শেষে সবাই যখন গল্পের আসর বসালো তখন নূর খেয়াল করলো রিদওয়ান এবং পারমীতা উভয়ই নেই। নূরের মনে কৌতুহল জন্মালো। তাদের খুজতে খুজতে নূর পৌছালো নিজের বেড রুমের বাহিরে। দরজাটা হালকা ভেজানো। বুকটা অহেতুক কারণেই ধরফর করছে নূরের। কেনো যেনো খুব কাঁপছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে দরজাটা খুললো নূর। দরজা খুলতেই যা দেখলো তাতে নূরের মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়। রিদওয়ান পারমীতাকে জড়িয়ে ধরে আছে। নূরের হাত পা যেনো অসাড় হয়ে আসছে। রিদওয়ান এবং পারমীতাকে এমন অবস্থায় দেখবে কল্পনাতেও ভাবে নি সে। অজান্তেই মুখ ফসকে অস্ফুটস্বরে বেড়িয়ে এলো, "রিদওয়ান" নূরের কন্ঠে কানে আসতেই রিদওয়ান পেছনে তাকায়। পারমীতা এখনো তার বুকে লেপ্টে আছে। রিদওয়ানের কাতর দৃষ্টি এবং চিন্তিত মুখশ্রী নূরের চোখ এড়ালো না। রিদওয়ান ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
"নূর, তাড়াতাড়ি আসো। পারমীতা সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।"
নূরের মাথা কাজ করছে না। কি সত্যি কি মিথ্যে তার বিচার করাটা এতোটা কঠিন হবে জানা ছিলো না নূরের, তবুও মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পা চালিয়ে ভেতরে ভেতরে প্রবেশ করে সে। নিষ্প্রভ কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে পারমীতার?”
“জানা নেই, ওর শরীরটা নাকি ভালো লাগছিলো না। তুমি তখন রান্নাঘরে ছিলে, তাই আমি ওকে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিলাম। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। তুমি একটু হেল্প করো প্লিজ”
রিদওয়ান প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, তার আতঙ্কের কারণটি বুঝতে পারলো না নূর। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো সে। এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করলো রিদওয়ানকে। পারমীতা সত্যি সেন্সলেন্স হয়ে গিয়েছে। তাকে কোনোমতে বিছানায় শোয়ালো তারা। রিদওয়ানদের বিল্ডিং এ একজন ডাক্তার থাকেন। নাম নাজিম উদ্দিন। নাজিম সাহেব হার্টের ডাক্তার, রিদওয়ানদের বাসার তিনতালায় থাকে সে। রিদওয়ান ছুটে গিয়ে নাজিম সাহেবকে ডেকে আনে। নাজিম সাহেব পারমীতার পর্যবেক্ষণ করছেন। আর রুমের এক কোনে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। হুট করে এমন একটা ঘাটনা ঘটবে সেতা যেনো কেউ কল্পনা করে নি। সবার মাঝে নূর শুধু রিদওয়ানকেই দেখে যাচ্ছে। তাকে চিন্তিত লাগছে, সামান্য বেহুশ হবার জন্য এতো কিসের চিন্তা, সেই সূত্র ভেবে পাচ্ছে না নূর। মিনিট বিশেক পর্যবেক্ষনের পর নাজিম সাহেব খানিকটা প্রসন্নমুখে বলেন,
“আমার মনে হচ্ছে উনি প্রেগন্যান্ট। উনার গার্ডিয়ান কে আছেন?”
নাজিম সাহেবের কথাটা যেনো কারোর বিশ্বাস হচ্ছে না। অফিসের মানুষের মাঝে একটা কানাগোসা শুরু হলো। তাদের কাছে এই খবরটা যেনো অষ্টম আশচর্যের ব্যাপার। রিদওয়ান এগিয়ে গেলো নাজিম সাহেবের কাছে, বললো,
“এখানে ওর গার্ডিয়ান কেউ নেই, আমি ওর কলিগ আর আমার ওয়াইফ ওর ফ্রেন্ড। আপনি আমাদের বলতে পারেন।”
“দেখো রিদওয়ান, আমি তো হার্টের ডাক্তার কিন্তু আমার এযাম্পসন ভুল হবে না আশা করি। তবুও বলবো, তোমরা উনার গার্ডিয়ানকে বলবে একটা টেস্ট করে গাইনি ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করে নিতে। আমি আসি কেমন!”
“জ্বী আংকেল।”
নাজিম সাহেব চলে গেলে পরিবেশটা শান্ত হয়ে যায়। সবার থমথমে মুখে পরিবেশটা আরোও অস্বস্তিতে ভরে উঠলো। পারমিতা প্রেগন্যান্ট এই কথাটা একটা নীরবতা বাড়িয়ে দিলো। কারণ পারমীতার এখনো বিয়ে হয় নি। অফিসের মানুষ অন্তত তাই জানে। পারমীতা এখনো ঘুমে, নাজিম সাহেব একতা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছেন। তাই সে না উঠা অবধি এই ঘটনার কোনো সুরাহা হবে না। কেনো যেনো পারমীতার গর্ভবতী হবার খবরটা শুনতেই নূরের দৃষ্টি রিদওয়ানের উপর গেলো। এক অজানা ভয়ের উপস্থিতি মনে ত্রাশ তৈরি করলো, আহত মনটা প্রার্থনায় লেগে গেলো যেনো তার চিন্তা ভুল হয়। না চাইতেই সকল কুচিন্তার ঢেউ তার শান্ত মনকে বারেবারে উত্তেজিত করে তুলছে। ইচ্ছে হচ্ছে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে রিদওয়ানকে,
“পারমীতার সাথে তার কিসের লুকোচুরি”
কিন্তু সে থেমে যায় এই ভেবে যদি সে ভুল হয় তবে চিরটাকাল রিদওয়ানের সামনে ছোট হয়ে যাবে সে। ভালোবাসার মানুষের অনীহার পাত্র হতে চায় না নূর। দ্বিধার এক অসীম জালে জড়িয়ে যাচ্ছে সে, চাইলেও এই জাল কেটে বের হবার উপায় পাচ্ছে না। রিদওয়ান সবাইকে নিয়ে বসার ঘরে গেলো। সবার হতাবাক মুখশ্রীতে হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু করতে পারছে না। রিদওয়ান সবার উদ্দেশ্যে বলে,
“কেউ এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন পারমীতাকে করবে না, এ নিয়ে কোনো গসিপ ও হোক সেটা আমি চাই না। আমার মনে হয় আমি সবাইকে ক্লিয়ার করতে পেরেছি।”
রিদওয়ানের কন্ঠের কাঠিন্য সবার কৌতুহল একেবারেই দমন করে দিলো। রিজবি স্বর খাঁদে এনে বললো,
“কিন্তু রিদওয়ান ভাই, ওকে কে জানাবে এই নিউজ টা?”
“নূর জানাবে, ওর বান্ধবী সে। নূরের কাছ থেকে জানলে আমার মনে হয় না পারমীতা খুব একটা অস্বস্তিবোধ করবে।“
রিদওয়ানকে ঠিক কি বলা উচিত জানা নেই নূরের, লোকটার তল পাওয়া বড়ই ভার। যদি সাধারণ ভাবে দেখা হয় রিদওয়ান কেবল ই পারমীতাকে সাহায্য করছে একজন কলিগ হিসেবে। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, অথচ অপর দিকে গুটি মেলালে ঘোর রহস্যের চোরাবালিতে ঢুবে যাচ্ছে নূর। কেনো রাতে পারমীতা রিদওয়ানকে ফোন দিয়েছে, কেনো রিদওয়ান এতোটা ঘাবড়ে গিয়েছিলো রাতে, কেনো তাদের দরজা ভিজিয়ে রাখা ছিলো! অনেক প্রশ্ন, নূরের নিজেকে হিন্ন মনোভাবের একটা পোকা মনে হচ্ছে, যে কারণে অকারণে তার স্বামীকে সন্দেহ করছে। কিন্তু কোনোভাবেই এই সন্দেহের বীজটা উপড়ে ফেলতে পারছে না।
পারমীতার ঘুম ভাঙ্গলো দু ঘন্টা পর। শরীরটা খুব দূর্বল। পাশে নূর বসে আছে। নূরকে দেখেই ঝটপট উঠে বসে পারমীতা। তার মুখখানা শুকনো হয়ে আছে। লম্বা মুখখানা আরেকটু লম্বা লাগছে। নুর তার পেছনে একটা বালিশ দিলো। পারমীতা মাথা নত করেই বসে আছে। কোনো কথা নেই তার মুখে। নূর খানিকটা ইতস্তত করছে কিভাবে কথাটা শুরু করবে সেটা ভেবে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তারপর বললো,
“এটা কিভাবে হলো পারমীতা?”
নুরের প্রশ্নে হু হু করে কেঁদে উঠে পারমীতা। ফর্সা মেয়েটির গাল, নাক লাল হয়ে উঠে। সুগাঢ় নজর বিষাদসিন্ধুতে প্লাবিত হয়। এক পর্যায়ে নূর তাকে জড়িয়ে ধরে। নিঃশব্দে দুজন নারী একে অপরের কষ্ট ভাগ করে নেয়, শুধু অশ্রুজলের মাধ্যমে।
নূরের হাজারো জিজ্ঞাসার পরও উত্তর দেয় না পারমীতা। অবশেষে নিজের মাঝে সকল জিজ্ঞাসাকে দমিয়ে রাখতে হয় নূরের। পারমীতাকে সাবধানে বাড়ি যাবার ব্যাবস্থা করে দিলো রিদওয়ান। মেহমানেরা আস্তে ধীরে যে যার বাসার দিকে প্রস্থান করলো। সবাই চলে গেলে রিদওয়ান নিজের রুমে এসে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে, তবুও গরম লাগছে তার। বিকেলে চা খাওয়ার বাতিক আছে রিদওয়ানের। তাই এক কাপ চা হাতে রুমে আসে নূর। আসরের আযান শোনা যাচ্ছে কিন্তু রিদওয়ান এক দৃষ্টিতে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে সে। আযানের ধ্বনি কানে আসলেই রিদওয়ান নামাযে দাঁড়িয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে জামাতে তো মাঝে মাঝে ঘরে। কিন্তু সে সময় নষ্ট করে না। অথচ আজ আযান শেষ হয়ে যাবার পর ও সে শুয়ে আছে। কিছু একটা কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। চা টা বিছানার পাশের সাইড টেবিলে রেখে রিদওয়ানের পাশে বসলো নূর। তার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“কিছু নিয়ে কি চিন্তা করছো?”
নূরের স্পর্শ পেতেই চিন্তার সাগর থেকে বের হলো রিদওয়ান। মুচকি হাসি দিয়ে নূরের কোমড় জড়িয়ে ধরলো। এই প্রথম নূরের এতোটা কাছে এসেছে সে। এতোকাল পর রিদওয়ানের এমন আচারণে শিওরে উঠে নূর। শিরদাঁড়া বেয়ে যেনো একটা স্রোত বয়ে যায় নুরের। এক রাশ ভালোলাগা ঢেউ মনে বিস্তার করে। নূর পরম যত্নে চুল টেনে দিতে থাকে রিদওয়ানের। রিদওয়ানে উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে ঈষৎ কম্পিত হচ্ছে প্রতিটি রন্ধ্র। রিদওয়ান তখন প্রেমঘন কন্ঠে বলে,
“ধন্যবাদ, আমাকে বিশ্বাস করার জন্য।”
রিদওয়ানের এমন কথায় অবাক হয় নূর। রিদওয়ান মুখ তুলে বলে,
“আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম জানো? পারমীতা অজ্ঞান হবার জন্য নয়, ভয়টা ছিলো তুমি আমায় অবিশ্বাস করো কিনা। এক অন্যনারীকে নিজের স্বামীর বুকে লেপ্টে থাকতে দেখাটা কারোর ই ভালো লাগার কথা নয়”
নূরের মনটা মূহুর্তেই উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলো। কালো মেঘের পরদ সরে একরাশ সোনালি প্রভা উঁকি দিলো মনের ব্যালকনিতে। হাজারো প্রজাপতি উঁড়ে গেলো যেনো। নূর শান্ত গলায় বললো,
“নামায পড়বে, উঠো”
জায়নামাযে বসে মোনাজাতের সময় একটা প্রার্থনা করছিলো নূর,
“এই সন্দেহের বীজ যেনো তার মনে আর জায়গা না নেই”
এক সপ্তাহ পর,
খাওয়ার টেবিলে একসাথে রাতের খাবার খেতে বসেছিলো নুরেরা। অক্টোবর, নভেম্বর ঘুরার জন্য সবথেকে উপযোগী সময়। রিদওয়ানের কিছু ছুটি জমেও গিয়েছে। নূরের একই অবস্থা। এই উছিলায় তাদের হানিমুনটাও হয়ে যাবে। তাই ঘোরার প্রস্তাব তুললেন মিলন সাহেব। নাজমা বেগমের ও সম্মতি আছে তাতে। নূর লাজুক হাসি হাসে। সেও চায় তাদের সম্পর্কটা বন্ধত্বের সিড়ি পেড়িয়ে এগিয়ে যাক। এমন সময় রিদওয়ানের ফোনটা বেজে উঠে। সে অর্ধেক খাবারেই ফোনটা নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। নাজমা বেগম সরু দৃষ্টিতে রিদওয়ানের কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। মিনিট পাঁচেক বাদেও যখন রিদওয়ান আসে না। তখন তিনি নূরকে বলেন,
“যাও তো, রিদওয়ানকে বলো খেতে আসতে। ফোনে কথা পড়েও বলতে পারবে ও”
নুর মাথা নাড়িয়ে উঠে যায়। এটো হাতেই নিজের রুমে যায় সে। রিদওয়ান বারান্দায় কথা বলছে। স্বর খাঁদে নামালেও তার রাগান্বিত স্বর বোঝা যাচ্ছে। নূর বারান্দার কাছে যেতেই শুনতে পায়,
“এই বাচ্চা এবোর্ট করার কথা মাথাতেও আনবে না পারমীতা। বাচ্চাটা তোমার একার নয়............
৩!!
রিদওয়ান বারান্দায় কথা বলছে। স্বর খাঁদে নামালেও তার রাগান্বিত স্বর বোঝা যাচ্ছে। নূর বারান্দার কাছে যেতেই শুনতে পায়,
“এই বাচ্চা এবোর্ট করার কথা মাথাতেও আনবে না পারমীতা। বাচ্চাটা তোমার একার নয়, তার বাবা বেঁচে আছে। সুতরাং তুমি একা কোনো ডিসেশন নিতে পারো না”
রিদওয়ানের কন্ঠে দৃঢ়তা স্পষ্ট। সে এমনভাবে কথা বলছে যেনো সে খুব ভালো করেই জানে বাচ্চাটির বাবা কে! নূর ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, তার মস্তিষ্ক যেনো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। মাথায় আসছে না কি হচ্ছে? এর মাঝেই রিদওয়ানের কঠিন কন্ঠে বলা কথাটি কানে আসলো,
“যদি তোমার বাচ্চাটি নাই চাই তবে তাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করা লাগবে না, দরকার হলে আমি এবং নূর তাকে পালবো। আমরাই তাকে দত্তক নিবো। তবুও এই বাচ্চা তুমি এবোর্ট করবে না। আমি এ নিয়ে দ্বিতীয় কোনো কথা শুনতে চাইছি না পারমীতা, আমি রাখছি”
রিদওয়ানের কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় নূর। পারমীতার বাচ্চার প্রতি কেনো রিদওয়ানের এতো দরদ? একবারের জন্য ভেবে নেওয়া হোক, বাচ্চাটি রিদওয়ানের সাথে জড়িত নয়; তাহলে তার বাবা কে? কে সে ব্যক্তি যার কথা পারমীতা রিদওয়ানকে বলতে পারছে অথচ নূরকে নয়। যেখানে নূর তার বান্ধবী। সেদিন কতোবার বলেছিলো নূর,
“আমাকে নিশ্চিন্তে বল দোস্ত, আমি তোকে সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করবো”
নূরের মনটা হুট করেই বিষিয়ে উঠলো পারমীতার প্রতি। কেমন বান্ধবী সে, নিজের বান্ধবী এবং তার স্বামীর সুখের সংসারে আগুন লাগাচ্ছে। এতো ঝড় তুলছে। আরোও বেশি বিষিয়ে উঠলো রিদওয়ানের প্রতি। একটা অন্য মানুষের বাচ্চা নিয়ে কিসের আদিক্ষেতা, কিসের এতো ঢং। কেনো তাকে এবং রিদওয়ানকে ওই বাচ্চা দত্তক নিতে হবে। পারমীতা বাচ্চা রাখবে, না রাখবে তার ব্যাপার। এখানে তার এতো উৎসাহ কেনো? সন্দেহের সূক্ষ্ণ রেখাটা এবার গাঢ় হলো, তীক্ষ্ণ রূপ নিলো। বুকটা হাহাকা করে উঠলো। রিদওয়ানের কাছে ঠকছে না তো সে! নাহ, আর ধৈর্য ধরতে পারছে না নূর। আজ এর একটা বিহিত করবে সে। ঠিক তখনই বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসে রিদওয়ান। তার চোয়াল শক্ত, চোখ লাল হয়ে আছে যেনো অনেক কষ্টে রাগ দমিয়ে রেখেছে। নূরকে দেখে ঈষৎ চমকালেও তেমন কোনো কথা বলে না রিদওয়ান। পাশ কাটিয়ে ডাইনিং রুমে চলে যায়। নূর তাকে জেরা করতে চাচ্ছিলো কিন্তু রিদওয়ানের মুখশ্রী এবং চাহনী দেখে প্রশ্নগুলো দমিয়ে রাখলো। কিন্তু আজ রিদওয়ানকে উত্তর দিতেই হবে, উত্তর যে নূরের চাই ই চাই।
রিদওয়ান থমথমে মুখেই খাবারটা শেষ করলো। নাজমা বেগম ছলে বলে দুবার জিজ্ঞেস করেছেন কিন্তু রিদওয়ানের উত্তর ছিলো,
“কিছু না”
খাওয়া শেষে রিদওয়ান বিছানায় শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তার অভ্যাসের মধ্যে আরেকটি অভ্যাস বেশ উদ্ভট, তা হলো বিছানা হতে হবে টানটান। তাই রিদওয়ান ঘুমানোর পুর্বে বিছানা টানটান করে তারপর শোয়। তাই আজ ও সেটাই করছে সে। ঠিক তখন ই নূর শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“পারমীতার বাচ্চার বাবা কে?”
প্রশ্নটা শুনে সরু দৃষ্টিতে তাকালো রিদওয়ান। তার চাহনীতে বিষ্ময়ের ছাপ। যেনো নূরের প্রশ্নটা নিছক বেমানান এবং অহেতুক। নুরের চাহনী স্থির, তার কন্ঠে কোনো জড়তা নেই। সে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিদওয়ানের দিকে। রিদওয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবারো মন দিলো বিছানা গুছাতে। নুর মিনিট বাদে আবারো একই প্রশ্ন করলো,
“রিদওয়ান তোমাকে আমি কিছু করেছি, পারমীতার বাচ্চার বাবা কে?”
এবার রিদওয়ান আর থামলো না, বিছানা ঝাড় দিতে দিতে বললো,
“সময় হলে সব জানতে পারবে, এখন ও সেই সময়টা আসে নি। আর পারমীতা নিজ থেকে তোমাকে না জানাতে চাইলে আমি নিজ থেকে তো তোমাকে জানাতে পারি না। তবে একটা কথা বলবো, একটু ধৈর্য্য ধরো আর আমার উপর বিশ্বাসটা রেখো। আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি না”
রিদওয়ান এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো, কিন্তু একবারো নূরের দিকে তাকালো না। রিদওয়ানের স্পষ্ট বক্তব্যের পর সত্যি কিছুই বলার থাকে না নূরের। কি বলবে সে? যেখানে রিদওয়ান নিজ থেকে বলছে তার উপর বিশ্বাস রাখতে, তাহলে অবিশ্বাসটা করবে কি করে? আবার সন্দেহের যে গাঢ় বীজ মনের আঙ্গিনায় বাড়ছে তাকে কমানোর উপায় ও সে পাচ্ছে না। দ্বিধার মাঝে আরো জড়িয়ে যাচ্ছে নূর। উচাটনে মনটা অস্থির হয়ে গিয়ছে। কেউ ঠিক বলেছিলো,
“সন্দেহ এমন এক স্ফুলিঙ্গ যা নিবৃত্ত হৃদয়কে ব্যাকুল করে তার শান্তিকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়”
তার নিবৃত্ত হৃদয়ে ঝড় তুলছে এই সন্দেহ। সেদিন রিদওয়ান এবং নূর দুজনের কেউ ই ঘুমালো না। একই বিছানায় দুদিক মুখ ফিরে রাত্রিযাপন করেছে তারা। মনের মাঝে হাজারো কথা কিন্তু বলতে পারছে না। এক অদৃশ্য বাঁধায় আটকে আছে দুজন। প্রকৃতির ন্যায় মনেও যখন ঝড় উঠে তখন শান্তি নামক প্রসন্নতা ছাই হয়ে যায়। লন্ডফন্ড করে দেয় অন্তরাত্নাকে। যেমনটা করছে রিদওয়ান এবং নূরকে____________
পরদিন,
সকাল এগারোটা,
অফিসের কাজে মন লাগছে না নূরের। মাথায় কুচিন্তা আসছে, আসবে নাই আ কেনো পরকীয়া ব্যাপারটা এখন এমন ই ডালভাত হয়ে গেছে যে ২০ শতাংশ দম্পতির ছাড়াছাড়ি হচ্ছে। সেদিন ই তো একটা ক্রাইম পেট্রোলের এপিসোড দেখছিলেন নাজমা বেগম। সুখে থাকলে যে মানুষকে ভুতে কিলায়, কথাটা ওই এপিসোডের মূল চরিত্রকে দেখলেই বোঝা যায়। সুখী সংসার ছেড়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হলো। শেষমেশ স্ত্রীকে খুন করতেও সে দুবার ভাবে নি। এসব মানসিক বিকৃতি দেখলে যে কারোর ই বুক কাঁপবে। আর কিছুদিন যাবৎ রিদওয়ানের সাথে পারমীতার যা কান্ডগুলো লক্ষ্ করছে নূর তাতে যে কারোর সন্দেহ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। নূর কাউকে বলতেও পারছে না, কাকে বলবে? পারমীতাকে? রিদওয়ানকে? এদের জন্যই তো মনটা এলোমেলো হয়ে আছে। আর রইলো নাজমা বেগম এবং তার মা শিউলি বেগম। এদের বললে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হবে। অহেতুক তিল থেকে তাল হবে। নিজের ডেস্কে মুখে হাত দিয়ে বসে রইলো নূর। নূরকে অন্যমনস্ক দেখে সিথি দিদি তার পিঠে আলতো করে চাপড় দিলেন। সিথি দিদি তাদের প্রজেক্ট ইনচার্জ। নূরের সাথে বেশ ভালো খাতির ও তার। মহিলা নূর থেকে আট বছরের বড়। কিন্তু নূরকে নিজের বোনের মতো স্নেহ করেন। চাপড় খেয়ে চমকে উঠলো নূর। চিন্তার ঘোর থেকে বের হলো সে। এর মাঝেই সিথি বলে উঠলো,
“বরের চিন্তায় অফিসেও তারা গুনছো নাকি?”
“না...না, কি যে বলেন দিদি?”
আমতা আমতা করে বললো নূর। নূরের জোর পূর্বক হাসি এবং চিন্তাটা চোখ এড়ালো না সিথির। কিন্তু সকলের সামনে হুট করেই কিছু প্রশ্ন করে নূরকে অপ্রস্তুত করে দেওয়াটা ঠিক হবে না। তাই সিথি কিছু জিজ্ঞেস না করে বললো,
“লান্চ টাইমে বাহিরে যাবি?”
“সময় কুলাতে পারবো?”
“আরে কেনো পারবো না, এখানে পাশেই ভালো বিরিয়ানির রেস্টুরেন্ট খুলেছে। আমার বেশ মাটন বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। মানা করিস না। মাসের প্রথম, বেতনের গরমটা যায় নি। তুই তো জানিস মাসের প্রথমে আমি বড়লোক থাকি”
বলেই হেসে দিলো সিথি। সিথির কথা শুনে নূর ও হাসলো। মিহি কন্ঠে বললো,
“বেশ লাঞ্চ এ ফাইনাল”
দুপুরে অফিসের পাশের রেস্টুরেন্টে লান্স করতে যায় সিথি এবং নূর। খাওয়ার মাঝে নানা বিষয় নিয়ে তাদের জম্পেস আড্ডা হয়। এর মাঝেই সিথি সুযোগ বুঝে কথাতা পাড়ে,
“তোর আর রিদওয়ানের মাঝে কি সব ঠিকঠাক?”
সিথির প্রশ্নে বিষয় খেয়ে উঠে নূর। সিথি পানিটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“না বলতে চাইলে সেটা অবশ্যি তোর ব্যাপার। স্বামী স্ত্রীর পার্সোনাল ব্যাপার। আমি একজন তৃতীয় ব্যাক্তি, তাই অহেতুক ইন্টারফেয়ার অনুচিত। কিন্তু আজ তোকে কেমন মনমরা লাগলো, খুব চিন্তিত লাগলো। বিয়ের ছয় মাসে একটা মেয়ের হাসিখুশি থাকার কথা। অফিসেও এতো কাজ নেই যে তুই এতো অন্যমনস্ক থাকবি। শেয়ার করতে চাইলে করতে পারিস, একজন বড় বোনের মতো হেল্প করার ট্রাই করবো।“
সিথির আশ্বস্ত কথায় নূর খানিকটা স্বস্তি পায়। এতোকিছু মনের মাঝে চাপিয়ে রাখতে রাখতে সে সত্যি ই ক্লান্ত। তাই সিথিকে সব খুলে বলে সে। সব শুনে সিথি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীর গলায় বলে,
“এমন নয় তো, তোর সাথে বিয়ের পূর্বে রিদওয়ানের পারমীতার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো? মানে প্রেম জাতীয়। তুই নিজেই বললি পারমীতা প্রেমে কষ্ট পেয়েছে। এমন নয়তো সেই প্রেমিক রিদওয়ান?”
“কি যা তা বলছো সিথি দিদি? অসম্ভব। যদি এমনটাই হতো তবে আমাকে কেনো বিয়ে করলো রিদওয়ান?”
“দেখ আই এম যাস্ট সেয়িং। কারন কিছুদিন পূর্বে এমনটা আমার কাজিনের সাথে হয়েছে। তার হাসবেন্ড এবং তার ফ্রেন্ডের প্রণয় ছিলো বেশ কিছুদিন। কিন্তু বাবা-মায়ের মন রাখতে বিয়ে করলো আমার বোনকে। আর কি ছেলে অনেক চেষ্টা করলো সংসার করতে। কিন্তু মন তো তার প্রেমিকার কাছেই রয়ে গেলো। আমার বোকা বোনটা বুঝেই পায় না অরিন্দম কেনো তাকে ভালোবাসে না। সেই দুমাস হলো সব রহস্য সমাধান ঘলো। আমার কাজিন জানতে পেরে তার ফ্রেন্ডকে ইচ্ছেমতো গাল্লালো। গাল্লাবে না কেনো? জেনে বুঝে নিজের বান্ধবীর কাছে থেকে এতো বড়ো সত্যটা লুকালো বোঝ”
সিথির কথায় বুকে কামড় পড়ে নূরের। সন্দেহের দাগটা আরোও নিবিড় হয়। এর পর কেমন যেনো মিয়ে যায় নূর। গলা থেকে খাবারটাও ভেতরে যায় না তার। খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়ায় তারা। রেসটুরেন্ট থেকে বের হতে নূর থমকে যায়। রেস্টুরেন্টের ঠিক অপজিটে একটা হাসপাতাল রয়েছে। এবং সেই হাসপাতাল থেকেই বের হচ্ছে রিদওয়ান এবং পারমীতা। নুরের চক্ষু চড়াকগাছ। নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলো না সে। ছুটে গেলো রিদওয়ানের কাছে। রিদওয়ান বলেছিলো তার একটা ইম্পোর্টেন্ট মিটিং আছে, এই কি তবে তার মিটিং?
নূর উপস্থিত হলো রিদওয়ানের সামনে। তার চোখ জ্বলছে। নূরকে দেখেও রিদওয়ান শান্ত। নূর ক্রুদ্ধ কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“তোমার মিটিং কি এখানে হচ্ছে রিদওয়ান?”
“নূর শান্ত হও, এটা তো পাবলিক প্লেস”
“নিকুচি করেছে তোমার পাবলিক প্লেস আগে আমার উত্তর চাই, কিসের সম্পর্ক তোমাদের?.........
৪!!
নূর উপস্থিত হলো রিদওয়ানের সামনে। তার চোখ জ্বলছে। নূরকে দেখেও রিদওয়ান শান্ত। নূর ক্রুদ্ধ কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“তোমার মিটিং কি এখানে হচ্ছে রিদওয়ান?”
“নূর শান্ত হও, এটা তো পাবলিক প্লেস”
“নিকুচি করেছে তোমার পাবলিক প্লেস আগে আমার উত্তর চাই, কিসের সম্পর্ক তোমাদের? আমি জানতে চাই রিদওয়ান এবং সেটা এই মূহুর্তে"
নূরের কন্ঠে ক্ষোভ স্পষ্ট। পারমীতা খানিকটা ইতস্ততবোধ করছে। নূরের ক্ষোভ জায়েজ, কোনো স্ত্রী তার স্বামীর যত্ন অন্য কোনো নারীর সাথে ভাগ করে নিতে পারে না। সেকারণে সে বাঁধাও দিয়েছিলো রিদওয়ানকে কিন্তু সে শুনে নি। কিছু কিছু দায়িত্ব মানুষ চাইলেও এড়াতে পারে না। মানুষের জীবনে এমন পরিস্থিতি উৎপন্ন হয় যা সে চাইলেও এড়াতে পারে না। পারমীতা এগিয়ে এসে বললো,
“তুই ভুল বুঝছিস নূর, প্লিজ ভাইয়াকে ভুল বুঝিস না। আমার শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।“
পারমীতার দিকে শীতল কড়া চাহনী দিয়ে বললো,
“স্বামী স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হওয়াটা বন্ধ কর পারমীতা। আমি আমার হাসবেন্ডের সাথে কথা বলছি।“
নূরের কথা শুনে মিয়ে যায় পারমিতা। এদিকে সিঁথি দিদি নূরকে শান্ত করার চেষ্টা করলো,
“নূর ভুলে যাস না এতা রাস্তা, তোর অফিস এখানে। কেউ দেখলে শুধু শুধু গসিপ করবে।“
কিন্তু আজ যেনো নূরের ধৈর্য্য বাঁধ ভেঙ্গেছে। সত্য, মিথ্যা, ভুল, ঠিক সব কিছুর ভেদ সে ভুলতে বসেছে। রিদওয়ানের মুখোমুখি হয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করে,
"উত্তর দিচ্ছো না কেনো? আমার উত্তর রিদওয়ান"
"সবকিছুর একটা সঠিক সময় থাকে নূর। সময় এলে আমি নিজ থেকেই সব বলবো।"
রিদওয়ান শান্ত কন্ঠে কথাটা বলে। নূরকে শান্ত করাটা প্রয়োজন। অহেতুক রাস্তার মানুষের হাসির খোড়াক হতে চায় না সে। নূর ও দমে যাবার পাত্র নয়, শক্ত কন্ঠে বলে,
"আর সেটা কবে?"
নূরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে রিদওয়ান। নূরের চোখে তার প্রতি অবিশ্বাসের আস্তরণ স্পষ্ট। এখন সব বললেও নূরের কাছে তা অযৌক্তিক মনে হবে। রিদওয়ান তাই শান্ত স্বরে বললো,
"আমরা বাসায় যাই, তারপর কথা বলি?" "আগে তোমার কথা শুনবো, তারপর আমি ঠিক করবো আমি ও বাড়ি যাবো কি না!"
"নূর!"
নূর অবিচল, সে একচুল নড়লো না। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। রিদওয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। কাতর দৃষ্টিতে নূরের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে, তারপর বললো,
“আমি তো একবার বলেছি, বাড়ি না যেয়ে আমি কোনো কথা বলবো না। তুমি অহেতুক মানুষের সামনে সিন ক্রিয়েট করছো!”
রিদওয়ানের কথাটা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে নূরকে। হৃদয়ে বিষাক্ত ছুরি যেনো কেউ চালাচ্ছে, এতোটা কষ্ট লাগছে নূর। ক্ষোভ, বিষাদ তাকে যেনো অন্ধ করে দিয়েছে। তার রুদ্র দৃষ্টি তখন পারমীতার দিকে প্রয়োগ করলো মেয়েটা, নত মাথায় এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে, চোখের নিচে গাঢ় কালি, সৌন্দর্য যেনো মূর্ছা গিয়েছে। তার কিসের দুঃখ, সে তো আরো খুশি হবার কথা। নূর তার কাছে গিয়ে জোরে হাত চেপে ধরলো, ক্ষোভ জড়ানো কন্ঠে বললো,
“এখন এতো নাটকের প্রয়োজন নেই তো, যা চাই তো পেয়ে তো গেলি! খুশি হচ্ছিস না?”
“কি যা তা বলছিস তুই নূর?”
“ঠিক বলছি, তোর লজ্জা করলো না। কিসের সম্পর্ক রে তোর রিদওয়ানের সাথে? মাত্র তো কয়েকমাস হলো তার অফিসে চাকরি নিয়েছিস। তাতেই এতো দরদ জন্মেছে তোর জন্য? কি এমন কথা যে রাত তিনটায় বান্ধবীর হাসবেন্ডকে ফোন দিতে তোর একবার ও লজ্জা হয় না! কার সাথে শুয়ে বাচ্চার মা হয়েছিস তার দায়িত্ব আমার স্বামীর উপর দিতে চাচ্ছিস? কেমন মেয়ে মানুষ তুই”
নূরের কথাগুলো ঠোঁট কাঁমড়ে শুনলো পারমীতা। তার কান্না পাচ্ছে, কিন্তু কাঁদতে পারছে না। কোনোভাবে কাঁপা স্বরে বললো,
“তুই ভুল বুঝছিস নূর”
“আমি এতোও বোকা নই পারমীতা, যদি ভুল হয়েই থাকি। ঠিকটা বল! বলতে পারবি না, হয়তো নিজেও জানিস না এই বাচ্চার বাবা কে! হয়তো আমার গুনধর স্বামী ই তোর বাচ্চার বাবা! ভুল বলছি কি? নয়তো ছয়মাসেও আমাকে ছুতেও তার এতো উৎকন্ঠা কেনো হবে?”
এতোক্ষণ শান্ত থাকলেও কেনো আর চুপ করে থাকতে পারলো না রিদওয়ান, নূরের কথাগুলো অত্যন্ত বিশ্রি লাগছে কানে। নূরের হাতটা পারমীতা থেকে ছাড়ালো প্রথমে, তারপর বরফ শীতল কন্ঠে বললো,
“অনেক হয়েছে, দোষ আমার। আমি লুকিয়েছি। পারমীতাকে কেনো অকথ্য বুলি শুনাচ্ছো। তোমার যা বলার আমাকে বলো, জানো না ও প্রেগন্যান্ট”
রিদওয়ানের শীতল চাহনী ক্ষত বিক্ষত করলো নূরকে। চূর্ণবিচূর্ণ হলো নুরের কোমল হৃদয়। রিদওয়ানের কাছ থেকে এরুপ ব্যাবহার মোটেই কাম্য নয় তার। তবুও রিদওয়ান বাহিরের নারীর জন্য তাকে শীতল চাহনী দিচ্ছে। কঠিন স্বরে তার সাথে কথা বলছে। নুরের অজান্তেই চক্ষুজোড়া নোনা জল ছেড়ে দিলো, শ্যাম গাল বেয়ে নেমে এলো এক রাশ কষ্ট। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো নূর। চোখ মুছে বললো,
“আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি”
বলেই হাঁটা দিলো নূর। রিদওয়ান তাকে আটকালো না। কিছু কাঁতর চাহনীতে চেয়ে রইলো তার যাবার পানে। পারমীতা বললো,
“ভাইয়া ওকে আটকান। ও ভুল বুঝছে। ভুলটা তো ভাঙ্গাতে হবে”
“যে বুঝতে চায় না, তাকে বুঝিয়ে কি লাভ বলো তো। এর চেয়ে তুমি নিজেকে চিন্তা করো। পজিশন কিছু তোমার ভালো না।“
পারমিতা কোনো কথা বলে না। সেদিন রাতে নূর আর বাড়িতে ফিরে না। নাজমা বেগম জিজ্ঞেস করে বহুবার,
“নূর কোথায়? ও আসে নি কেনো?”
রিদওয়ান চুপ থাকে। কোনো কথা বলে না। নাজমা বেগম ও একটা সময় চুপ করে যান।
সময় পেরিয়ে যায়, এক সপ্তাহ, দু সপ্তাহ। রিদওয়ান বার পাঁচেক ফোন দেয়, কিন্তু নূর ফোন রিসিভ করে না। সে বাবার বাড়িতেই থাকে। নাজমা বেগম বাড়ি ফিরতে বলেন কিন্তু এড়িয়ে যায় সে। রিদওয়ানের কাজে মন বসে না, না খেতে পারে; না ঘুমোতে। পুরো ঘরময় নূরের হাসি, তার কথা, তার স্মৃতি যেনো তাড়া করে রিদওয়ানকে। অজান্তেই মেয়েটা মনের ঘরে জায়গা করে নিয়েছে। এখন তাকে ছাড়া বাড়িতে থাকতেও ভালো লাগে না রিদওয়ানের। চোখ বুঝলেই গোল গালের মেয়েটার প্রতিচ্ছবি চোখে ভাসে। সেই স্নিগ্ধ হাসি, সেই ভেজা চুলের গন্ধ। বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে এই মেয়েটিকে। কিন্তু দূর্ভাগ্য, বলাই হলো না, হয়তো তাদের সম্পর্কটা এতোটুকুর ই ছিলো________
কফি শপে মুখোমুখি বসে আছে পারমীতা এবং নূর। অনেক কষ্টে পারমীতা নিজের সাথে দেখা করতে রাজী করায় নূরকে। রিদওয়ানের অবস্থাটা কেমন খুব ভালো করেই জানে পারমীতা। ভালোবাসার মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিলে সত্যি কষ্ট লাগে। আর এই ভুলবোঝাবুঝির উৎস কেবল সে। তাই জেনেবুঝে একটা বিয়েতে ফাটল ধরাতে রাজি নয় সে। একটি বিয়ে ভাঙ্গা মসজিদ ভাঙ্গার মতোই ধরা হয়। নূর শক্ত মুখে বসে আছে। এবং বারবার মোবাইলের ঘড়ি দেখছে। তার অস্বস্তি লাগছে পারমীতার সাথে বসতে। শেষমেশ আর ধৈর্য না ধরে বিরক্তি নিয়ে বললো,
“যা বলার দ্রুত বল”
পারমীতার কথা শুনে পারমীতা ভনিতা ছেড়ে বললো,
“আমার আর রিদওয়ান ভাইয়ার সম্পর্কটা শুধু কলিগ কিংবা বন্ধুর স্বামী হিসেবে নয়। আমি রিদওয়ান ভাইয়াকে তোর বিয়ের অনেক অনেক আগ থেকে চিনি। ইভেন তোর আমার বন্ধুত্বেরও বহুআগ থেকে.........
৫!!
নূরের কথা শুনে পারমীতা ভনিতা ছেড়ে বললো,
“আমার আর রিদওয়ান ভাইয়ার সম্পর্কটা শুধু কলিগ কিংবা বন্ধুর স্বামী হিসেবে নয়। আমি রিদওয়ান ভাইয়াকে তোর বিয়ের অনেক অনেক আগ থেকে চিনি। ইভেন তোর আমার বন্ধুত্বেরও বহুআগ থেকে। আমাদের সম্পর্কটা তেমন নয়, যেমনটা তুই মনে করছিস”
নূরের ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। পারমীতা কফির মগের দিকে চেয়ে বলে,
“রাফিনকে মনে আছে তোর?”
“হ্যা, রিদওয়ানের ফ্রেন্ড। এখন মিশনে আছে। আমার সাথে ওর পরিচয় হয়েছে দু মাস আগে। দেশে এসেছিলো।”
“রিদওয়ান ভাইয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার হাসবেন্ড।আমার আর রিদওয়ান ভাইয়ার পরিচয় রাফিনের মাধ্যমে। ইভেন আমাদের বিয়ের সাক্ষী ও রিদওয়ান ভাই। রাফিনের খুব ভাল তিনজন বন্ধু, আশিক ভাই, মুকিত ভাই আর রিদওয়ান ভাই। তখন আমি মাত্র আঠারো পেরিয়েছে। রাফিন হারিয়ে যায় নি, পাগল মানুষ তো কখন কি করে তার ঠিক নেই। একদিন হুট করে আমাকে এসে বলেছিলো ও আমাকে বিয়ে করবে। প্রোপার বিয়ে, ওর নাকি ইচ্ছে পালিয়ে বিয়ে করার। আঠারো বছরের কিশোরীর আবেগ ও তখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। বাবাকে বললে হাত পা ভেঙে ফেলতো তাই আমরা লুকিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করি। কিন্তু সমস্যা একটাই ছিলো ও আর্মিতে ছিলো। ওদের একটা বয়স না হলে বিয়ের পার্মিশন পায় না। ওর আর আমার বিয়েটা শুধু রিদওয়ান ভাই, আশিক ভাই এবং মুকিত ভাই ই জানতো। রিদওয়ান ভাই আমার ভাই হিসেবে সাক্ষী দিয়েছিলেন। রাফিন প্রোমোশন পায়, ক্যাপ্টেন হয়। তখন আমি বলেছিলাম, এবার যেনো ও বিয়ের কথাটা বলে। কিন্তু তার সময় পায় না, তার আগেই ও মিশনে চলে যায়। ছয়মাস, একবছর পর আসতো। আজ আমাদের বিয়ের প্রায় সাত বছর হয়ে গিয়েছে অথচ এই ব্যাপারটা গোপন। লাস্ট দুমাস আগে রাফিন এসেছিলো। আমাদের মাঝে খুব বড় ঝামেলা হয়, ঝগড়া হয়। আর কতো লুকিয়ে রাখবো বলতো। বাবা-মা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তখন রাফিন আমাকে কথা দেয় এবার আসলেই সে আমার এবং তার বাসায় কথা বলবে। বিয়ের কথাটা বলতে পারবে না। কারণ এতে তার চাকরি সাসপেন্ড হতে পারে। কেউ জানলে খুব বাঝে একটা পরিস্থিতিতে পড়বে, তাই আমি কখনো কাউকে জানাই নি আমি বিবাহিত। ওই রিদওয়ান ভাইকে বলে যায় যেনো আমার দিকে খেয়াল রাখে। আমার চাকরিটাও ওর কথায় রিদওয়ান ভাই ম্যানেজ করে দেয়”
পারমীতা থামলো, তার কন্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছে, সে একটু পানি খেলো তারপর বললো,
“সবটা আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু ও মিশোন এ যাওয়ার পর থেকেই আমি ওর খোজ পাচ্ছি না। না ফোন, না ইন্টারনেট, না সোস্যাল নেটওয়ার্ক। আমি কোনো ভাবেই ওর সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারছি না। এর মাঝেই আমি জানতে পারি আমি প্রেগ্ন্যান্ট। আমার বাচ্চা অবৈধ নয়। আমি কি করবো, কাকে বলবো, কোথায় যাব কিচ্ছু বুঝছি না। মুকিত ভাই, আশিক ভাই ও দেশে নেই। রিদওয়ান ভাইকে জানানো বাদে আমার কাছে কোনো উপায় ছিলো না। সেই রাতে আমি পাগল হয়ে গেছিলাম, আমার যেনো জ্ঞান শুন্য হয়ে গিয়েছিলো। তাই তো রাত তিনটার সময় রিদওয়ান ভাইকে ফোন করেছি যেনো কোনো ভাবে রাফিনের সাথে যোগাযোগ করেন। রাফিনের সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ হচ্ছিলো না , আমি আর এই স্ট্রেস নিতে পারছিলাম না। কোথায় যাবো কি করবো, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাচ্চাটাকে এবোর্ট করবো। কিন্তু রিদওয়ান ভাই সেটা হতে দিলেন না। কারণ বাচ্চাটা নাকি আমার একার নয়; আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছি, আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হবে বাচ্চার বাবা কে আমি কি বলবো? উনি তখন বলেছিলেন সে আর তুই নাকি আমার বাচ্চাকে দত্তক নিবেন। বিশ্বাস কর নূর, আমার কোনো ইচ্ছে নেই তোদের সম্পর্কে তৃতীয় পার্সন হবার। আমি হয়তো তোকে বলতে পারতাম। রিদওয়ান ভাই ও তোকে বলতে পারতো। কিন্তু শুধুমাত্র রাফিনের জন্য রিদওয়ান ভাই কখনো কাউকে বলেও নি সে আমাকে চিনে। কারণ কিভাবে চিনে সেটার ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না। সে রাফিনকে কথা দিয়েছে। ইভেন আমাদের বিয়ের কথাটা এই তিনজন কাউকেই বলে নি, নিজেদের পরিবারের কাউকেও না। কারণ এটা একবার কেউ জানতে পারলে রাফিনের চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। তুই যখন রিদওয়ান ভাইকে বারবার আমাদের সম্পর্কের কথা বলছিলি, তখন আমি বলেছি সে যেনো তোকে সব বলে দেয়, সে আমাকে একটা কথাই বলেছে রাফিনের সাথে একবার যোগাযোগ হলেই সে তোকে সব বলে দিবে। রিদওয়ান ভাই এর কোনো দোষ নেই নূর। আমি আর পারছিলাম না, চোখের সামনে তোর আর ভাইয়ার সম্পর্কটা ভাঙতে দেখতে পারছিলাম না। তাই আমি তোকে সব খুলে বললাম। রিদওয়ান ভাইয়া সত্যি তোকে ছাড়া কষ্ট পাচ্ছে। নারী মানেই যেমন অর্থলোভী নয়, অনুরূপ পুরুষ মানেই প্রতারক নয়”
পারমীতা কন্ঠ কাঁপছে। শব্দগুলো আটকে আসছে গলায়। দলা পাঁকিয়ে কান্না পাচ্ছে, চোখ ছলছল করছে। কান্না খুব ছোয়াছুয়ি রোগ, তাইতো নুরের ও চোখ জ্বলছে। পারমিতার জন্য তার কষ্ট লাগছে। লাগবে, এটা খুব স্বাভাবিক। মেয়েটির তো দোষ নেই, সে শুধু ভরসা করেছে। ভালোবেসেছে। ভালোবাসা ব্যাধিটাই সাংঘাতিক। একবার এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে জীবনের দিক বদলে যায়। মানুষ পাগলামি করে, তার প্রমাণ পারমীতা। নুর নিপুন ভাবে তার চোখ মুছে নিলো। জড়তা ঝেড়ে বললো,
“বুঝলাম, তোদের কোনো দোষ নেই। পরিস্থিতি তোদের একটা কঠিন খেলার সামনে এনে দিয়েছে। কিন্তু আমাকে ও বাড়ি যাবার জন্য রিকুয়েস্টটা করবি না পারমীতা। আমার আবদার এটা। আমি ও বাড়ি ফিরছি না”
“কিন্তু”
“কোনো কিন্তু না, পারমীতা আমি একটা মেয়ে হয়তো তোর জায়গায় থাকলে আমিও একই কাজ করতাম। নিজের স্বামীর কথা ভেবে আমি হয়তো লুকিয়ে যেতাম। কিন্তু রিদওয়ান আর আমি স্বামী স্ত্রী। হ্যা, হয়তো ওর বন্ধু ওর বহু পুরোনো বন্ধু। ওদের বন্ধুত্ব আঠারো বছরের। মানছি। কিন্তু সম্পর্কগুলো না খুব নমনীয়। প্রতিটা সম্পর্কের একটা আলাদা জায়গা আছে। আমি কি করতাম বলতো, মানছি আমি সন্দেহপ্রবণ, কিন্তু আমি তো তাই বিশ্বাস করবো যা দেখবো। আমি খুব বাজে বিহেভ করেছি তোর সাথে মানছি। কিন্তু কেনো করেছি? কারণ আমার ভয় হচ্ছিলো। রিদওয়ানকে হারানোর ভয়। আমি ওকে জিজ্ঞেস ও করেছি। কিন্তু ও সময়ের কথা বলেছে। কিন্তু আমি তো আমার মস্তিষ্ককে শান্ত করতে পারছিলাম না। পুড়ছিলাম ভেতর থেকে। আজ যদি তোর ভাই আমার সামনে এসে এই কথা গুলো বলতো তাহলে হয়তো আমার অভিমানটা ভেঙ্গে যেতো। ওকে বুঝতে হবে কোন সম্পর্কটা কেমন। এতোকাল ব্যাচেলর ছিলো তাই সেভাবেই এখনো জীবন কাটাবে এটা তো সম্ভব না। সম্পর্কের মূল্য ওকে বুঝতে হবে। বিশ্বাস ভালো কিন্তু আমি অন্ধবিশ্বাস করতে পারবো না। আমি তো মানুষ, আমার ও সন্দেহ হয়। ও আমাকে ঠকাইয় নি কিন্তু কথাতো লুকিয়েছে। তাই ওকে শাস্তি পেতে হবে। তাই ও বাড়ি আমি যাচ্ছি না। হারানোর ভয়টা কি, সেটা ওরও একটু বোঝা উচিত। একটা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হবে স্বচ্ছ, এখানে কোনো লুকোচুরির জায়গা নেই”
পারমীতা চুপ করে থাকলো। তার হাতে যা ছিলো সে করেছে। এখন রিদওয়ানের পালা নূরের মান ভাঙ্গানোর। নূর উঠে দাঁড়ালো। পারমীতাকে উবারে উঠিয়ে দিলো সে। আকাশে মেঘ করেছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। ভিজে যাবে পিচের রাস্তা, ধূলোগুলো ধুয়ে যাবে। এমন যদি উপায় থাকতো, মনের আক্ষেপ, রাগ, অভিমান, কষ্ট, বিষাদগুলো ধুয়ে যেতো। কতই না ভাল হতো। ইট পাথরের শহরের মতো মনের শহরেও শীতল পরশ বয়ে যেতো__________
পারমীতা বাসায় পৌছায় সন্ধ্যায়। উবারের মধ্যে শরীর গুলিয়ে এসেছিলো তার। মা হওয়াটা কতোটা কষ্টের হারে হারে টের পাচ্ছে পারমীতা। বাচ্চাটার অবস্থা ভালো নয়। চিন্তা, উত্তেজনা তার বাচ্চার উপর ও প্রভাব ফেলছে। ডাক্তার বলেছেন হাসিখুশি থাকতে। কিন্তু হাসিখুশি কি সত্যি থাকা যায় এই সময়? যে পরিস্থিতিতে সে রয়েছে তাতে কি সত্যি খুশি থাকাটা সম্ভব, উত্তর জানা নেই পারমীতার। মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু ওই যে আত্নহত্যা মহাপাপ। তাই আটকে যায় বারবার। নূর তো রিদওয়ানকে প্রশ্ন করতে পারছে, সে তো সেটাও করার উপায় পাচ্ছে না। আচ্ছা, ভালোবাসা বা বিশ্বাস করাটা কি অপরাধ?
ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাসায় ঢোকে পারমীতা। ঢুকতেই পা আটকে যায় তার। বসার ঘরে তিনটে মানুষ বসে আছে। একজন উনত্রিশ বছরের পুরুষ এবং পঞ্চাশোর্ধ এক দম্পতি। পারমীতা সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার নড়ার শক্তিটুকু নেই, পারমীতাকে দেখেই পুরুষটি এগিয়ে এলো তার দিকে। সেই সুদর্শন পুরুষ, যার প্রেমে একটি আঠারো বছরের কিশোরী ভেসেছিলো আবেগে। বিয়ে নামক সত্যিটা গোপন করে রেখেছিলো এই সাতটি বছর। মিহি কন্ঠে পুরুষটি বললো,
“পারমীতা”
এই নামটি বিগত দেড়মাস যাবৎ শুনে নি পারমীতা। একরাশ অভিমান ভর করলো, কালো নয়নে। বাক্যবিহীন চলে গেলো নিজ রুমে। রাফিনও পেছন পেছন ছুটলো। কোনোমতে ঠেলে ঢুকে পারমীতার ঘরে। পারমীতা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার দম আটকে আসছে। দু মাস পর রাফিন ফিরেছে। এই কদিন কতোটা মানসিক যন্ত্রনাতে ছিলো পারমীতা সেটা শুধু সেই জানে। রাফিন কাতর কন্ঠে বললো,
“পারমীতা আমার কথাটা শুনো?”
“শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না”
ঠান্ডা কন্ঠে কথাটা বলে পারমীতা, রাফিন তবুও এগিয়ে যায়। নিজের বউ এর মান যে তার ভাঙ্গাতে হবে। পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। জোর করে তার দিকে ফেরায় পারমীতাকে। আবেগপ্রবন কন্ঠে বলে,
“প্লিজ, পারমীতা। জানি তোমার অভিমান হয়েছে। কিন্তু আমি সত্যি অপারগ ছিলাম। গত পরশু আমার সাথে রিদওয়ান যোগাযোগ করে। আমি তখন ই টিকিট কাটি। এই দেড়টা মাস আমার কাছে ফোনটাও ছিলো না। আমি সত্যি জানতাম না। পারো, লক্ষিটি আমার দিকে একটু তাকাও”
পারমীতার চোখ আজ বাঁধ মানছে না। হু হু করে উঠে সে। জড়ানো স্বরে বলে,
“কোথায় ছিলে তুমি? জানো কতোটা অসহায় হয়ে গিয়েছিলাম। কেউ ছিলো না আমার পাশে। শুধু রিদওয়ান ভাই। আমাকে সাহায্য করতে যেয়ে তার সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু তোমার কথা রাখতে। আর এদিকে তুমি নিরুদ্দেশ”
“সরি, সরি পারমীতা। আমি নিজেই যাবো ভাবীর কাছে ক্ষমা চাইতে। আমার জন্য তোমরা এতো কষ্ট পেয়েছো। সরি”
পারমীতা কাঁদছে, ভিজে যাচ্ছে রাফিনের সাদা শার্ট। কিন্তু সে আকড়ে রয়েছে তার বউ কে। তার জীবনের সেই নারীকে যাকে সাতবছর বাদে আরোও একবার বিয়ে করবে সে। এখন আর লুকোচুরি নেই; না নিজেদের মাঝে, না সমাজের সামনে____________
পরদিন,
পড়ন্ত বিকেলে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে নূর। কিন্তু রিক্সার যেকোনো আকাল পড়েছে ঢাকা শহরে। এর মাঝেই ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি নামলো পিচের রাস্তায়। এক পশলা বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে গেলো নূর। এখন হুট হাট এক পশলা বৃষ্টি হয় তাও প্রবল ধারায়। নূর বের হবার সময় ছাতা নিতে ভুলে গিয়েছিলো। হাতের ব্যাগটা দিয়ে মাথা ঢাকতে যাবে, খেয়াল করলো বৃষ্টি থেমে গেছে। অবাক নয়নে তাকাতেই দেখলো কেউ একটা লাল ছাতিও তার মাথায় ধরে আছে। লাল ছাতি দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো। রিদওয়ানের সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো সেদিন এমন ই একটা ছাতি হাতে সে অপেক্ষা করছিলো নূরের। নূর পাশে তাকাতেই দেখলো রিদওয়ান ছাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিনের দৃশ্যটা যেনো জীবন্ত মনে হলো। রিদওয়ান বিগত দুদিন বহুবার ফোন দিয়েছে, কিন্তু নূর ধরে নি। অভিমানে তাকে ব্লক করে দিয়েছিলো। দু সপ্তাহে যে লোক মাত্র পাঁচবার ফোন দেয় তার হুট করে আদিক্ষেতা ভালো লাগে নি নূরের। লোক তাও থেমে থাকে নি, তার মাকে বুহুবার ফোন দিয়েছে। যেনো একটিবার নূর তার সাথে কথা বলে। কিন্তু নূর কথা বলে নি। ভেবেছিলো হয়তো তার অভিমানে ভাঙ্গাতে রিদওয়ান নিজে আসবে। এবং আজ সত্যি রিদওয়ান এসেছে। মনে মনে তো ঠিক করে রেখেছে রিদওয়ান এলেও সে ফিরে যাবে না। কিছুদিন তাকেও কষ্ট দিবে। কষ্ট পেতে কেমন লাগে সেটা তো জানা উচিত। হারানোর ভয়টা কেমন তা তো জানা উচিত। নিজের বোকামীর জন্য সে নূর এবং তার উভয়কে কতোটা কষ্ট দিয়েছে। রিদওয়ানকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে, বৃষ্টির মধ্যে হাটা শুরু করলে হাত টেনে ধরে রিদওয়ান। আকুল কন্ঠে বলে,
“আমার এক্সপ্লেনেশনটা তো শুনো, এরপর যদি তোমার মনে হয় আমার দোষ তাহলে চলে যেও।“
“কেনো সময় চলে এসেছে নাকি?”
ঘুরেই শান্ত কন্ঠে কথাটা বলে নূর। রিদওয়ান এগিয়ে বলে,
“বিশ্বাস করো আমি কখনো তোমাকে ঠকাই নি”
“লুকিয়েছো তো? সেটা কি ঠকানো নয়?”
“তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নিবো, কিন্তু তবুও আমার কথাটা তো শুনো।“
“শুনে কি হবে বলো তো রিদওয়ান? আমাকে পারমীতা সব বলেছে। তুমি রাফিনকে কথা দিয়েছো তাই আমাকে বলোনি, আচ্ছা আমি কি এতো ইনসেন্সিটিভ? আমাকে বন্ধু ভেবেই তুমি বলতে। রিদওয়ান, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা স্বচ্ছ হতে হয়। এতে লুকোচুরি মানেই সন্দেহের বীজ বোনা। আজ একই জিনিসটা আমি করলে তুমি কি করতে? সন্দেহ করতে না? হ্যা আমি মানছি আমার তোমার কথা শোনার পর তোমার উপর বিশ্বাস রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু বিশ্বাস তো মুখের কথা নয়, আমাদের সম্পর্কটা যেভাবে থেমে ছিলো তাতে কি আমার মনে সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক নয়? বলো”
“নূর, সেই মূহুর্তে তোমার কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার মতো কোনো ওয়ে আমার কাছে ছিলো না। আমি ভেবেছিলাম রাফিনের সাথে যোগাযোগ হলেই আমি তোমাকে সব জানিয়ে দিবো। এখন রাফিন দেশে এসেছে, আমি চাইলেই তোমার সাথে তার কথা বলিয়ে দিতে পারবো। আমার আর পারমীতার মাঝে যে কোনো সম্পর্ক নেই সেটার প্রমাণ বা সাক্ষী যাই বলো না কেনো তাই রাফিন। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমি কিভাবে তোমাকে সত্যিটা বলবো, তুমি আদৌ বুঝবে কিনা, তুমি বিশ্বাস করবে কি না। যেখানে রাফিনকে আমার অবিবাহিত বন্ধু হিসেবে আমি দু মাস আগেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সেখানে এই সত্যিটা আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। একেই আমাদের সম্পর্কটা একটা এমন জায়গায় ছিলো যেখানে আমরা একসাথে তো ছিলাম কিন্তু একে অপরের ছিলাম না। অবশ্য এখানে দোষটা আমার। আমি সময় নিতে চাচ্ছিলাম। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে আমি নিজেদের মাঝে একটা বন্ধুত্ব, বিশ্বাস তৈরি করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু দেখো, আমার বোকামির জন্য সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।“
রিদওয়ানের কথা যৌক্তিক, সন্দেহ জিনিসটা এতোটাই জটিল যে তা মানুষের বিশ্বাসকে কাঁচের মতো পাতলা করে দেয়। তাই তো সেদিন মাথা গরম করে রাস্তায় যা তা বলে দিয়েছিলো সে পারমীতাকে। রিদওয়ান নূরের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
“আমি জানি, আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি। তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিবো। শুধু এবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কখনো আমি তোমার থেকে কিচ্ছু লুকাবো না। কোনো লুকোচুরি রাখবো না আমাদের ভেতর। প্লিজ আমাকে ক্ষমা দাও। তুমি যদি বলো আমি কান ধরে উঠবস করতেও রাজি। প্লিজ বাড়ি চলো। তুমি বাদে বাড়িটা খা খা করে। খুব কষ্ট হয়, অজান্তেই যে ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়।”
রিদওয়ানের কথায় হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় নূরের। এতোদিনের অপেক্ষার প্রহর যেনো আজ শেষ হলো। এতোদিনের ক্লান্ত কানজোড়া যেনো মধুর কথাটা শুনতে পেলো। হাজারো অনুভূত মনের কোনায় রংধনু আকে৷ বরফ শীতল অভিমান গলতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিহি স্বরে বলে,
“বেশ, ক্ষমা করলাম। কিন্তু এটাই প্রথম, এটাই শেষ। এর পর কিন্তু আর ক্ষমা হবে না”
নূরের কথাটা শুনেই জড়িয়ে ধরলো তাকে রিদওয়ান। এতদিন বাদে তৃষ্ণার্ত বুকটা যেনো তৃপ্তি পেলো। খরা বুকে একপশলা বৃষ্টি নামলো শান্তি রুপে। নূরের অভিমানের বরফকুন্ড যেনো গলে গেলো রিদওয়ানের উষ্ণ পরশে। মাঝে মাঝে আমরা সত্যি বুঝিনা সামনের মানুষটিকে। আশেপাশের বিরুপ পরিবেশ আমাদের নিবৃত্ত হৃদইয়ে নানা সন্দেহের বীজ বুনে। সন্দেহটা প্রবল হয় যখন সামনের মানুষটি কথা লুকিয়ে যায়। যেমনটা হয়েছিলো রিদওয়ান এবং নূরের ক্ষেত্রে। রিদওয়ানের লুকোচুরি এবং নূরের সন্দেহ তাদের সম্পর্কের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যেকোনো সম্পর্কই খুব নমনীয় হয়, লুকোচুরি সে নমনীয় সম্পর্কে ফাটল তৈরি করে। সন্দেহ সেই ফাটলকে দৃঢ় করে। এই প্রতিকূলতাকে হার মানাবার একটাই উপায় তা হলো, স্বচ্ছতা। সম্পর্ক যত স্বচ্ছ হয় সেই সম্পর্ক ততো মজবুত হয়। কারন স্বচ্ছতাই সম্পর্কের লাল ছাতি_______।
***(সমাপ্ত)***