মিলন |
০১!!
ছাদের দরজাটা আলতো হাতে বন্ধ করে পা টিপেটিপে রেলিঙের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সায়ন। কাজটা যতোটুকু নিঃশব্দে করা সম্ভব তারচেয়েও বেশি চুপিসারে করছে ও। কোনমতেই চাইছে না ওর উপস্থিতিটা কাছাকাছি যাওয়ার আগেই আশফিয়া টের পেয়ে যাক। মেয়েটাকে একটু ঘাবড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আর তার সাথে আশফিয়ার আঁতকে উঠা মুখের ভঙ্গিটা দেখার লোভ তো সায়ন কিছুতেই সামলাতে পারছে না। ঘাবড়ে গেলে ভয়ে মেয়েটা নীল হয়ে যায় একেবারে।। তারপর মুখটা রক্তশূন্য হয়ে হয় ফ্যাকাশে।। আর সবচেয়ে মজার হল শেষ অংশটা। সায়নের পাগলামিটা ধরতে পারলে রেগে টকটকা লাল টমেটোর মতো হয় মুখটা।৷ তারপর শুরু হয় তুমুল কিল-ঘুষি বর্ষণ।৷ সাংঘাতিক এক অবস্থা!! তবু আশফিয়ার সবকটা ভঙ্গিই সায়নের ভিষণ পছন্দ।। তাই তো সুযোগের সব সময় সদব্যবহার করে ছেলেটা!!যেমনটা এখন করছে!!
নিঃশব্দে গিয়ে পিছন থেকে আশফিয়াকে জড়িয়ে ধরেছে সায়ন। ঘাবড়ে গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে যাবে তখনই জড়িয়ে ধরা মানুষটা আশফিয়ার মুখে আলতো করে হাত চেপে ধরে চিৎকার আটকালো। এই মুখ চেপে ধরা হাতটা আশফিয়ার পরিচিত। তাই আর শেষমেশ চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলল না। আর সায়ন যে ইচ্ছে করেই ওকে এতোটা ঘাবড়ে দিয়েছে সেটা ভেবেই ওর মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। ছেলেটা এতো বদ কেন!! বদমাইশের হাড্ডি একটা!! দুনিয়াতে এই একটাই ছেলে পেয়েছিল ও প্রেম করার জন্য!!! ভাবতে ভাবতেই সায়ন আশফিয়ার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের দিকে ফিরালো।।
-আমার আশফুমনিটা রাগ করেছে?
---------------
-মনে মনে গালি দেয়া শেষ হয়নি এখনো!!? এই??
-----------------
রাগের চোটে একটা শব্দও গলা দিয়ে বের হচ্ছে না আশফিয়ার। নাটক করে আবার আশফুমনি বলতে আসছে সে!! একটু আগেই তো আরেকটু হলে হার্টএ্যাটাক করিয়ে মারত ওকে পাজিটা!! আর এখন আসছে প্রেম দেখাইতে!! ফাজিল ব্যাটা!!!
আশফিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বেচারা সায়নের হাসতে হাসতে অবস্থা কাহিল।। কিল-ঘুষির তুফান এখনো শুরু হয় নি এখনো। মেয়েটা কিছুতেই রাগটা সামলাতে পারছে না দেখে আরো হাসি পাচ্ছে সায়নের। মুখটা টকটকে লাল হয়ে আছে।চোখ মুখ বলছে পারলে এখনই ধাক্কা মেরে সায়নকে ছাদ থেকে ফেলে দিতো মেয়েটা।। রাগে চোখ মুখ রক্তের মতো লাল হয়ে আছে দেখে আশফিয়ার কোমড় ধরে টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসলো সায়ন। আশফিয়া রাগ ভুলে চোখ বড় বড় করে সায়নের দিকে তাকাল। কি করছে ও!! একটু পরেই ঠোঁটে সায়নের ঠোঁটের স্পর্শ টের পেল আশফিয়া। সায়নের হাতটা শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে নিল আশফিয়া।
বেশ অনেকক্ষণ পর আশফিয়ার কাছ থেকে সরে ওর মুখের দিকে তাকাল সায়ন৷ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে বেচারি। ঠোঁট দুটো কাঁপছে আলতোভাবে৷ আর চোখ দুটো বন্ধ। সায়ন আলতো করে আশফিয়ার দুই চোখের পাতায় চুমো এঁকে দিয়ে কপালে চুমো খেয়ে একটু সরে দাঁড়ালো।।
-আশফু--। চোখ খোলো---??
---------------
-চোখ না খুললে কিন্তু আমি ধরে নিবো তুমি চাইছ যেটা একটু আগে করেছি সেটা আবার করি--।।
আশফিয়া চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে সায়নের দিকে তাকিয়ে আবার রেলিং ধরে রাতের অন্ধকার আকাশ দেখায় মন দিল।।
-তুমি কি করছো এখানে??
-তার আগে তুমি বলো তুমি কি করো এখানে!! বলেছিলাম না রাতের বেলা একা একা ছাদে আসবা না---।।
-বাসায় প্রচন্ড গরম---।।
-এতো গরম লাগলে প্রয়োজনে আরেকবার শাওয়ার নাও--। বারান্দায় বসে বাতাস খাও--। বলেছি না তোমাকে??
-উফ---। এতো এমন করো কেন! আজীব তো!!! এই সময় ছাদে কেউ আসে না জান না??
-ধরে দুইটা থাপ্পড় লাগাবো তোমাকে আর একটাও আজাইরা লজিক দেখাইতে আসলে। কেউ আসে না মানে যে কেউ আসবে না কখনো এটা তোমাকে কে বলসে হ্যাঁ???!!
-উহুম---।৷ তুমি বকতেস কেন আমাকে এভাবে??!!
-বকার আর কি দেখসো!? আর কখনো একলা একলা রাতের বেলা ছাদে আসবা ধরে থাপ্পড়ও লাগিয়ে দিব।একটা থাপ্পড়ও মিস হবে না।। দেখবা তো--।।
আশফিয়া বেশ ভালোই টের পাচ্ছে সায়নের রাগটা। ছেলেটা রেগে গেলে কি করে বসে তার ঠিক নেই। আশফিয়া আর কথা না বাড়িয়ে সায়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ ডুবালো।। সায়ন আলতো করে আশফিয়াকে জড়িয়ে নিল।
-আচ্ছা যাও সরি--।। আর একা একা আসবো না। তোমাকে কল করলে তুমি চলে এসো---।।
-এই কথাটা আগামীকাল রাত হওয়ার আগেই তুমি ভুলে যাবা--।।
-এই না--। সত্যি--। তোমাকে কল করলেই তুমি সামনের বিল্ডিং থেকে চলে আসবা----।।
-এই কথাটা তুমি গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন আমাকে শুনাচ্ছো--।
-এই না না--।। কি বলো!! ছি ছি!
-তোমার কথা কি রেকর্ড করে শুনালে তারপর মানবা তুমি!!?
-এই সরি তো!!? আর হবে না।। প্লিজ প্লিজ!!?? এই দেখো কান ধরছি---।।
আশফিয়া কান ধরার জন্য একটু সরে আসতেই সায়ন ওর মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো।।
-কেন বুঝতে পারো না!! তোমার উল্টাপাল্টা কিছু একটা হয়ে গেলে আমি বাঁচব কি করে!!!
-আচ্ছা সরি তো!! একটা গান শোনাও তো এখন---।
-আমি কি তোমার জন্য সারাদিন গিটার নিয়ে ঘুরছি সাথে করে!!??
-গিটার লাগবে না।। আমি জানি তুমি গিটার ছাড়াও অনেক ভালো গান করতে পারো---।। হুম!! কই শোনাও!!?
-পারবো না----।
-না শুনালে বুঝবো তুমি এখনো মাফ করো নি---।
-প্রতিদিন এক কাহিনী করে তুমি বিরক্ত হও না আশফু??
-ধুর--। যাও শোনাতে হবে না--। আমিও গেলাম-----।
-টিভি সিরিয়ালে জয়েন করলে যে অনেক শাইন করতে পারবা এটা কি তুমি জানো আশফিয়া??!!
-হি হি হি।। জানি তো--।৷
আশফিয়ার মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সায়ন। মেয়েটার জ্বালায় কোন দিন পাগল হয়ে যেতে হয় কে জানে!! সায়ন রাগ করলেই রাগ ভাঙাতে আশফিয়া গান শোনার বায়না ধরে। গান শোনাবার পর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুতেই আর সায়ন রাগ করে থাকতে পারে না।। এই পাগলীটাকে নিয়ে যে কি করবে সেটা কিছুতেই ভেবে পায়না সায়ন।
-কই!?? শোনাও না??
আশফিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরেই হালকা গলায় গান ধরল সায়ন। দরদ মাখা স্বরটা শুনতে বরাবরই আশফিয়ার অসম্ভব ভালো লাগে।।
-"তুমি আমার এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন
এক জনমের ভালোবাসা
এক জনমের কাছে আসা
একটি চোখের পলক
পড়তে লাগে যতক্ষণ
ভালোবাসার সাগর তুমি
বুকে অথৈ জল
তবু পিপাসাতে আঁখি
হয়রে ছলছল
তোমার মিলনে বুঝি গো জীবন
বিরহে মরন বিরহে মরন
প্রাণের প্রদীপ হয়ে তুমি
জ্বলছ নিশি দিন
কোন মোহরে শোধ
হবে গো এত বড় ঋণ
এত বড় ঋণ
আমার ভালোবাসার ফুলে
তোমার ভরাব চরণ
তুমি আমার এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন।"
আশফিয়া শক্ত করে সায়নের বুকে মুখ লুকিয়ে গান শুনছে আর মিটিমিটি হাসছে। জীবনের সবচেয়ে মধুর এই মূহুর্তটা কেন যে এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় কে জানে!!
০২!!
সকালে মোবাইলের ভাইব্রেশনে ঘুমঘুম চোখে কানে মোবাইল ধরল সায়ন। এতো সকালে কে কল করলো!! আর কয়টা বাজে!!
-সায়ন সাহেব বলছেন?
-জি।। কে বলছেন??
-আমি 'উৎকর্ষ' নামের একটা কালচারাল সেন্টারের ম্যানেজার বলছিলাম। আপনার সাথে কি ২ মিনিট কথা বলা যাবে এখন!?
-জি বলুন।।
-আসলে আসছে পরশু আমরা "সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা" নামে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করছিলাম। আপনি তো "উড্ডয়ন গানের আসরের" চ্যাম্পিয়ার আমাদের এলাকার।। তাই বলছিলাম যে---।
-গান গাইতে হবে!!??
-জি মানে--৷ যদি আপনি একটু আসেন আমাদের অনুষ্ঠানে--খুব ভালো হয়।। হয়তো তত বেশি দিতে পারবো না অন্য ফাংশনগুলোর মতো।।আসলে আমরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য আর সচেতনতা তৈরি করার জন্য একটা ছোটখাটো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছি----।।
-আপনাদের কাজের থিমটা আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছ--।। তা কবে আর কোথায় অনুষ্ঠান!!??
-আমরা এবার পার্বত্য রাঙামাটির একটা রিমোট এরিয়ায় অনুষ্ঠানটা আয়োজন করছি। আগামীকাল বিকেলেই রওনা হব। পরশু অনুষ্ঠান। এর পরের দিন ফিরবো। ভাই আপনি কি যাবেন??
-জি অবশ্যই---।।
-আচ্ছা সায়ন সাহেব। আগামীকাল দেখা হচ্ছে তাহলে। বায়।
-ওকে৷ বায়।
ঘড়িতে আটটা বাজতে এখনো ২ মিনিট বাকি। ঠিক আটটায় আশফিয়া ওকে কল করে ঘুম ভাঙাবে। তার আগেই সায়ন ওকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কল করল। এতো খুশির একটা খবর আশফিয়াকে সবার আগে না দিলে তো হয় না। একবার রিং হতেই কল রিসিভ করলো আশফিয়া।
-হ্যালো আশফুমনি?? ঘুম ভেঙেছে?
-হুম----। গুড নিউজটা তাড়াতাড়ি বলো--। শুনেই আবার ঘুমাবো--। রাতে গরমে ঘুম হয় নি----।
-কিসের গুড নিউজ!!??
-যেটা বলার জন্য কল করলে--। তাড়াতাড়ি বলো না???
-বেশি ঘুম পাচ্ছে আমার আশফুমনিটার??
-হুম---। অন্নেক---।
-তাহলে পরে বলি??
-না না--। এখনি বলবা---।
-একটা প্রোগ্রামে গাওয়ার জন্য ডেকেছে।। কালকে বিকেলে রওনা দিব। পরশু প্রোগ্রাম।।
-সত্যি!!!
-আরে!! তুমি এতো লাফিয়ে উঠছ কেন?? বাসার সবাইকে রুমে আনবা নাকি!?
-এই না না--।৷ বলো না কোথায় প্রোগ্রাম??
-রাঙামাটিতে-----।।
-ওমা!!! এতো দূরে??!!
-তাও তো!! একটা প্রোগ্রাম তো পেলাম!!??
-আরো প্রোগ্রাম থেকে ডাকবে দেখো?
-হুম---।। আচ্ছা এখন ঘুমাও তো তুমি--।৷ ভার্সিটিতে কিন্তু যাবা না আজকে।৷ ওকে??
-তোমাকে দেখব তো??
-এই গরমে বের হতে হবে না বাবা--। সন্ধ্যায় ছাদে আসবো।। তখন দেখো মন ভরে--। ওকে??
-উউউউউ--। আচ্ছা---।
-ওকে বায়---।।
-বায় বায়---।
দুদিন পরে রাঙামাটি থেকে ফিরেই আশফিয়াকে কল করে সায়ন।
-হ্যালো আশফু?? আমি ফিরেছি।
-আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করো।। রাতে ছাদে এসো কেমন??
-আচ্ছা।।
-আশফি?? কার সাথে কথা বলিস?
-এই এই রাখছি?? বাবা ডাকে---।
-ওকে মনি বায়----।।
রাতে ছাদে এসে সায়ন আশফিয়াকে দেখে হা করে তাকিয়ে রইলো। সায়নের দেয়া বেগুনি রঙা তাঁতের শাড়িটা পড়েছে ও। হাত ভর্তি বেগুনি রঙা চু্ড়ি। পাশের বিল্ডিংগুলোতে জ্বলা বাতির আধো আলোয় অসম্ভব রকমের মায়াবি লাগছে আশফিয়ার সাজহীন মুখটা। সায়ন একটু একটু করে এগিয়ে এসে আশফিয়াকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।।
-তোমাকে বড্ড ভালোবাসি আশফু।
-আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি----।।
-একটা গান শুনবে??
-হুম----।। বারে-গান শুনবো বলেই তো এতো যত্ন করে তোমার দেয়া শাড়িটা পড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি---।।
-পাগলীটা---।
সায়ন আশফিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরেই গান ধরলো।
-"হও যদি তুমি নীল আকাশ , আমি মেঘ হব আকাশে
হও যদি অথৈ সাগর , আমি ঢেউ হব সাগরে
হও যদি ওই হিমালয়, তোমাকে করব আমি জয়
তোমাকে চাই তোমাকে তুমি যে আর কারো নয়
বলতে পারি আমি নির্ভয়ে , তুমি আছ হৃদয়ে ।।
তুমি হলে ওই অরণ্য আমি হব সবুজ
ও তোমারি প্রেমে মন দুরুন্ত তোমার কাছেই অবুঝ
হও যদি ওই হিমালয়, তোমাকে করব আমি জয়
তোমাকে চাই তোমাকে তুমি যে আর কারো নয়
বলতে পারি আমি নির্ভয়ে , তুমি আছ হৃদয়ে ।।
আমারি দেহে প্রাণ গো তুমি, তুমি আমার নিঃশ্বাস
ও তোমাকে ছাড়া নিস্প্রান আমি এইত আমার বিশ্বাস
হও যদি ওই হিমালয়, তোমাকে করব আমি জয়
তোমাকে চাই তোমাকে তুমি যে আর কারো নয়
বলতে পারি আমি নির্ভয়ে , তুমি আছ হৃদয়ে ।।"
গান শেষ হওয়ার পরেও কতোক্ষণ এভাবে আশফিয়াকে জড়িয়ে ধরে আছে তার হুঁশ নেই সায়নের। কারো থমথমে গলার স্বরে ধ্যান ভাঙলো সায়ন আর আশফিয়ার।।
-আশফি কি বেহায়াপনা হচ্ছে এসব? আর এই ছেলে কে তুমি??! এতো রাতে আশফির সাথে কি করো তুমি??
-বাবা!!??
আশফিয়ার কথায় ঘোর কাটলো সায়নের। তবে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সামনে দরজার কাছে দাঁড়ানো মানুষটা আর কেউ নয়। আশফিয়ার বাবা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহতাব সাবের চৌধুরী।।
০৩!!
রাতে একটু ঘুম হয় নি সায়নের। চোখের সামনে রাতের ঘটনাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। আশফিয়ার বাবা ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিচে বাসায় নিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে সকালে ঠিক আটটায় বাসায় আসতে। যা কথা হবে সবার সামনেই হবে। কি কথা হবে সায়ন বুঝতে পারছে। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে ভয়ে। খুব ভয় হচ্ছে আশফিয়াকে হারানোর। কেন যেন মনে হচ্ছে আশফিয়ার পরিবার কিছুতেই রাজি হবে না ওদের সম্পর্কটার ব্যাপারে। অবশ্য রাজি না হওয়ারই কথা। কেবল গান দিয়ে তো আর সংসার চলে না-এটা হল সার্বজনীন যুক্তি। কিছু একটা চাকরি তো চাই। এদিকে সায়নও সবে সবে পাশ করে বেরিয়েছে। চাকরির চেষ্টাও করছে জোরেশোরে। ইচ্ছে ছিল একটা চাকরি হলেই বাসায় আশফিয়ার কথাটা বলবে। কিন্তু বিধি বাম। তা আর হলো কই!?
মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো সায়ন। সাতটা বেজে পনেরো মিনিট। বেশ অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নিল। তারপর ফরমাল ড্রেসআপ করলো। আশফিয়ার সবচেয়ে পছন্দের শার্ট-প্যান্ট পড়ে রেডি হল। এক হাতে একটা কাগজ। অন্য হাতে তার প্রিয় গিটার। কতো সুর বেঁধেছে সে এই গিটারে আশফিয়ার জন্য! আজকের দিনটার উপর নির্ভর করছে সেগুলো আশফিয়া ভবিষ্যতে শুনতে পারবে কি না।
পাঁচ মিনিট হাতে থাকতেই ঘর ছেড়ে বের হলো সায়ন। রুমের দরজার সামনে আসতেই আশফিয়ার কল এলো।
-সায়ন?? তুমি এসেছো?
-হুম--। দরজার বাইরে আমি।।
-আমি এক্ষুণি আসছি----।
আশফিয়া ছুটে এসে দরজা খুলে দিল। আর সায়ন রুমে ঢুকার সাথে সাথে ঘড়িতে ঢং ঢং করে আটটার ঘন্টা বাজলো। মাহতাব সাবের চৌধুরীর মুখটা কিছুটা শিথিল হলো। ছেলেটা একদম সময়মতো এসেছে। ব্যাপারটা হয়তো তার ভালো লেগেছে।
-আসসালামু আলাইকুম স্যার।
-কি নাম তোমার??
-আমার নাম সায়ন আহমেদ।
-তুমি কি করো??
-গান করি---।।
-গান করে সংসার চলবে তোমার? যত্তসব---।
-----------------------
-হাতে কাগজটা কিসের??
-স্যার এটা আমার গানের চ্যাম্পিয়ানশিপের-----।।
-একটা শো করে কত টাকা ইনকাম হয় তোমার??
-জি স্যার-। গতকাল একটা সো করে ফিরেছি-। ওখানে ২০০০০ টাকা পেমেন্ট করেছে----।।
-তা এমন কয়টা শো পাও মাসে??
-ঠিক নেই স্যার--।
-কোন মাসে একটাও শো না থাকলে কি হবে ভেবেছ??!!
-জি না স্যার--।
-একটা ভালো চাকরি না থাকলে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা কে দিবে তোমার???
----------------------
-শোনো ছেলে, একজন বাবা হিসেবে আমি আমার মেয়ের জন্য সিকিউর একটা লাইফ চাইব, ঠিক কিনা?!
-জি স্যার----।।
-তুমি কি ওর জন্য এসব শো প্রোগ্রাম ছেড়ে চাকরিতে যেতে পারবা??
-------------আশফিয়ার জন্য আমি সব করতে পারি----।।
-এটা তোমার গানের ইনস্ট্রুমেন্ট, রাইট??
-জি-?? জি স্যার---।।
-এটা এখন আমার সামনে ভেঙে টুকরো করো---। দেখি তুমি আশফিয়ার জন্য কি করতে পারো!?
-না বাবা---।প্লিজ---। সায়ন-??! কি করছ কি তুমি!!??
সায়ন এক সেকেন্ডও চিন্তা না করে নিজের গিটারটা ফ্লোরে আছড়ে আছড়ে কয়েক টুকরো করে ফেললো। তারপর সাবলীলভাবে মুখ তুলে মাহতাব সাহেবের দিকে তাকাল। আশফিয়াকে ওর মা বসার রুমের বাইরে থেকে টানতে টানতে অন্য একটা রুমে নিয়ে গেছে।
-আশফিয়ার জন্য আমি সব করতে পারি স্যার---।।
-যে ছেলে সামান্য একটা ভালোবাসার জন্য নিজের লাইফের গোল-নিজের লক্ষ্য কে এভাবে নষ্ট করে দিতে পারে তার ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে আমি মানতে পারি না। তোমার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে আমি দেব না---। নাও-গেট আউট---।।
-স্যার---?? আমি------।।
-নট এ্যা ওয়ার্ড--। আশফির সাথে ভুলেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবা না।। তাহলে বুঝতে পারবা মাহতাব সাবের চৌধুরী কি জিনিস--। আর আশফিও যেন তোমার সাথে যোগাযোগ না করতে পারে সে ব্যবস্থাও আমি করছি---।নাও আউট আই সেইড---।।
বাসায় ফিরে নিজেই নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছে সায়ন। কি হতে কি হয়ে গেল!? আশফিয়াটা এখন কি করছে? মেয়েটা একটু কিছুতেই কেঁদে কেটে দুনিয়া ভাসিয়ে ফেলে। আজকে কি করবে কে জানে!!? নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আশফিয়ার নাম্বারে কল দিল সায়ন। মোবাইলটা বন্ধ। বাসা থেকে মোবাইল নিয়ে নিয়েছে ওর!!? সায়ন বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আশফিয়ার রুমটা ওর সামনের বিল্ডিয়ে। একদম সামনাসামনি রুমটা। মেয়েটা বারান্দায় আসলে দেখা যেত।। কি করছে কে জানে! রুমেও আলো জ্বলছে এখনো।।
সায়ন একটু রিস্কই নিল। কখনো কাজটা করে নি জীবনে। আজই প্রথম। তিনতলার খোলা বারান্দার ধার ঘেঁষে হেঁটে পাশে একটা বিল্ডিং পাশ কাটিয়ে কোনমতে পা হড়কাতে হড়কাতে আশফিয়ার রুমের বারান্দায় এসে পৌঁছলো। একটু উঁকি দিয়ে দেখে নিল বারান্দায়।।তারপর এক লাফে বারান্দায় নেমে এলো একটু উঁকি দিল খোলা বারান্দার দরজাটা দিয়ে। খাটে উপুড় হয়ে সারা শরীর দুলিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। সায়ন রুমটা আরেকবার ভালো করে একটু দেখে নিয়ে পা টিপে টিপে আশফিয়ার বিছানার কাছে এসে আশফিয়ার মাথায় কাছে ফ্লোরে বসে পড়লো। মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিল কিছুক্ষণ।
-এই আশফুমনি?? মুখটা একটু দেখি তো??! ওই?? এতো কাঁদছে কেন আমার পাগলীটা?
০৪!!
আশফিয়া মুখ তুলে সায়নকে দেখে একেবারেই ভেঙে পড়লো৷ সায়নও খাটে বসে ওকে বুকে জড়িয়ে নিল।
-আরে পাগলী!! কাঁদছ কেন?? এই তো আমি!! কোথাও যাই নি তো--।
বেশ অনেকক্ষণ পর আশফিয়ার কান্না বন্ধ হল৷ তখন খেয়াল হল সায়ন ওর রুমে। ও এখানে এলো কি করে!! রুম তো বাবা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে!! সায়নের মুখের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সায়নের চোখে পানি। কোনমতে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে আশফিয়ার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল সায়ন।
-তুমি!! তুমি আমার রুমে এলে কি করে!!?
-আস্তে বলো না বাবা!! এতো চেঁচাও কেন!! সবাইকে রুমে আনবা নাকি!!
-তুমি!!? কেমন করে আসলে এখানে বলো??!
-ওই যে বারান্দা টপকে---।।
-তুমি পাগল!!?? যদি পড়ে---!!
-তোমার জন্য আমি সব করতে পারি আশফু--। এই দুটো বারান্দা টপকে তোমার কাছে আসা কোন ব্যাপারই না-----।।
আশফিয়া সায়নের বুকে মুখ লুকিয়ে আবার ফুঁপিয়ে উঠলো। সায়নও আলতো করে পিঠে চাপড় দিল।।
-এই মেয়ে?? আবার কেন কাঁদে!! বললাম না আমি আছি? কিচ্ছু ভেব না---।
-বাবা বলেছে তোমাকে ভুলতে না পারলে আর বাসার বাইরে পা ফেলতে দিবে না---।
-সেই জন্য কাঁদছো নাকি!!? আমি তো তোমার সামনে--। নাকি ঘর থেকে বের হতে পারবা বলে কেঁদে কেটে হয়রান হচ্ছো??-----।
আশফিয়া রাগ করে সায়নের বুকে হাত আছড়ালো। ইচ্ছে মতো কিল ঘুষি বসালো সায়নের বুকে।।
-অসভ্য, ফাজিল, বেয়াদ্দপ ছেলে---। আমি কতো ভয় পেয়েছি জানো তুমি!!? আমি তো ভেবেছি আর কখনো তোমাকে দেখতেই পাবো না----।।
-ওলে বাবুটা--। কাঁদে না--। প্লিজ??
-আমি তোমাকে ছাড়া মরে যাব সায়ন---।। তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না--। আমরা দুজনেই কাজ করবো নাহয়--। তুমি গান করবে- আমি নাহয় টিউশন পড়াবো। খুব সুন্দর করে দিন কাটবে আমাদের--। সত্যি বলছি----।।
-কিছু করা লাগবে না পাগলি--।
-না--। প্লিজ? আমাকে নিয়ে চলো না তোমার সাথে!!?
-এভাবে হাল ছেড়ে দিয়ে কি করে পালিয়ে যাব রে পাগলি?? উঁহু---। আগে তো বাবাকে রাজি করাই?? তারপর সবার সামনে দিয়ে ঘোড়ায় চেপে এসে তোমার নিয়ে যাব--।
-বাবা যদি কখনো রাজি না হয়??
এই প্রশ্নটার উত্তরটা সায়ন দিতে পারলো না। শক্ত করে আশফিয়াকে বুকে চেপে ধরে বসে রইলো। আশফিয়া তখনো কাঁদছে। সায়নের নিরবতা বলে দিচ্ছে ওর করার কিছু নেই। সায়নের উপর অভিমান হচ্ছে আশফিয়ার। আর বাবার উপরে হচ্ছে রাগ।। সন্তানের সুখ চাইতে গিয়ে বাবা মা ভুলেই যান তাদের সন্তানের সুখটা কিসে। এ সংসারে সবার সুখের সংজ্ঞাই তো আলাদা। কেউ দামি হিরের আংটি পেয়েও তার সাইজ নিয়ে নাখোশ হয়৷ আর কেউ ফুটপাতের পঞ্চাশ টাকা জোড়ায় কিনা নূপুর পেয়েও খুশিতে আত্মহারা হয়। কেউ দামি রেস্টুরেন্ট ভরপেট খেয়েও খাবার ভালো না বলে নাক সিটকায়। আর কেউ আলু-পটল-বেগুন তরকারি খেয়েও তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। কেউ হয়তো লাখ টাকা দামের শাড়ি পড়েও তাতে খুঁত গুনতে বসে। আর কেউ পাটভাঙা তাঁতের শাড়িটা পেয়ে আনন্দে বিমোহিত হয়ে যায়!! কারো খুশি থাকতে চাই লাখ লাখ টাকা, অলংকার, সাজপাতি!! আর কেউ প্রিয় মানুষটার বুকে মুখ গুঁজতে পেরে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে করে।। এতো কিছু হয়তো বাব মায়ের মনে থাকে না। তারা হয়তো ভেবেই নেয় সুখের অপর নাম সম্পদ, সুখের অপর নাম অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি।। এই সুখের থিউরিতে কয়জন সন্তান প্রকৃত সুখী হতে পারে কে জানে!!
এভাবে কাটছে সায়ন আর আশফিয়ার জীবন। সারাদিন এখানে সেখানে চাকরির জন্য ঘুরে সায়ন। কোথাও থেকে ডাক আসে ইন্টারভিউর জন্য। কোথাও থেকে মোটা টাকা চায় চাকরির জন্য। আর আশফিয়া ঘরে বন্দী। সময় করে মা ওকে খাবার দিয়ে যায়। সেটা দাঁতে কেটেও দেখে না আশফিয়া। রাতে অবশ্য খেতেই হয়। সায়ন নিজে হাতে তুলে খাইয়ে দেয় তার পাগলিটাকে।
মাস খানেক কাটলো এভাবে। আজও সায়ন এসেছে আশফিয়াকে খাইয়ে দিচ্ছে। একটা কথাও বলছে না। আশফিয়াও কিছু না বলে সায়নকে খাইয়ে দিচ্ছে। মানুষটার মন খারাপ কেন বুঝতে পারছে না আশফিয়া। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহসও হচ্ছে না। যদি এটা শুনতে হয় কাল থেকে সে আর আসবে না! সেটা কি মেনে নিতে পারবে আশফিয়া!! খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে আশফিয়ার হাত আর মুখটা ধুয়ে মুছিয়ে দিল। তারপর আশফিয়াকে বুকে টেনে নিলো।
-আশফু?? আজকে একটা গান শুনবে?? লাস্ট----।।
-লাস্ট কেন??!!
-এতো প্রশ্ন করো না--। লাস্ট একবার গান শুনাতে খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে---।
-তোমার কি-----???
-শুনবে না পাগলিটা??
-শুনবো তো।। আমি তো তোমার গান শুনতে বড্ড ভালোবাসি--।
-শুধু গান ভালোবাসো?? আমাকে না??
-তোমাকে তো আরো বেশি ভালোবাসি-----।।
-হুম----। আই লাভ ইউ পাগলি--।
-লাভ ইউ টু--------।
-"হৃদয়ের লেনাদেনা এ পারেতে আর হবে না ।
দেখা হবে দেখা হবে ঐ পারে
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে বন্ধু। ঐপারে
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে বন্ধু
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে বন্ধু
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে
আমি জনম জনম ঘুরিয়া তোমায় কাছে না পাইয়া ভালবাসা রাখিলাম যতন ও করে বন্ধু যতন ও করে
ও ও তোমার প্রেমে মজিয়া চোঁখের জলে ভাসিয়া কেউ জানে না কিসের আগুন আমার অন্তরে বন্ধু আমার অন্তরে
হৃদয়ের লেনাদেনা এ পারেতে আর হবে না
দেখা হবে দেখা হবে ঐ পারে
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে বন্ধু ঐপারে
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে বন্ধু
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে বন্ধু
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে
থাকিও থাকিও তুমি ঐ পারেতে গিয়া
আসিব আসিব আমি প্রেমের তরী নিয়া বন্ধু প্রেমের তরী নিয়া
ও ও তোমার আমার এই প্রণয়ে ভুল যদি না থাকে ঐ পারেতে আইসো তুমি প্রেম মালা হাতে বন্ধু প্রেম মালা হাতে
হৃদয়ের লেনাদেনা এ পারেতে আর হবে না
দেখা হবে দেখা হবে ঐ পারে
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে বন্ধু ঐপারে
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে বন্ধু
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে বন্ধু
তোমার আমার দেখা হবে ঐ পারে।"
আশফিয়াকে সায়ন শক্ত করে বুকে চেপে ধরে আছে। তার চোখে অশ্রুরা বন্যা বইয়ে যাচ্ছে সেটা আশফিয়া ভালোই বুঝতে পারছে। গানটা শুনেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আশফিয়ার। কি হয়েছে সায়নের!! সে কি একেবারেই আশা ছেড়ে দিয়েছে?? সায়নের শার্টের এক পাশে খামচে ধরে আছে আশফিয়া। যেন ছাড়লেই ও কোথায় হারিয়ে যাবে। চিরতরে হারিয়ে যাবে অজানায়।।
০৫!!
সকালে আলোর ঝলকানিতে আশফিয়ার ঘুম ছুটে গেল। সায়নের গান শুনে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছে টেরই পায় নি। আশফিয়া উঠে বসে রুমে সায়নে খুঁজলো। নেই। চলে গেছে হয়তো আশফিয়া ঘুমিয়ে গেছে দেখে। খাট থেকে নামতে যাবে এর মধ্যে দেখল একটা কাগজ ওর টেবিলের উপর পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া। আশফিয়া কাগজটা নিয়ে আবার বসে পড়লো খাটে। কাগজের ভাঁজটা খুলে পড়া শুরু করলো।
"আশফু,
জানি কথাটা শুনলে রাগ করবে। গতকাল একটা শো থেকে কল করেছে। আজকে প্রোগ্রাম ছিল। আর আজকেই একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পড়েছে। বহু ভেবে শো করব না ঠিক করেছি। মানাও করে দিয়েছি। বাবা তো বলেছিল তোমাকে পেতে হলে গান ছেড়ে ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে। সেটাই করছি। তোমার জন্য সব করতে পারি আশফু। গানটাও ছাড়তে পারি। শুধু তোমাকে পেলে সব কষ্টই ভুলে যাব। সরি।"
চিঠিটা পড়তে পড়তে আশফিয়ার চোখের জলেরা বাঁধ ভাঙলো যেন। যে মানুষটা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে তার থেকে তার বেঁচে থাকার, খুশি থাকার সম্বলটাই ছিনিয়ে নিয়েছে সে। আশফিয়া কথাটা ভাবতেই মরে যেতে ইচ্ছে হল। একটা কাগজে কয়েকটা লাইন লিখে বারান্দায় ফুলদানির নিচে রেখে এলো। বারান্দার দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে সায়নের ভাঙা গিটারটা নিয়ে বসলো আশফিয়া। গিটারের ভাঙা অংশগুলো অনেকক্ষণ ছুঁয়ে দেখলো। তারপর ঠিক করে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করলো। একবার একটা অংশ উল্টোপাল্টা হয়ে যায়। আশফিয়া সেটা আবার ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে কতক্ষণ কাটলো জানেই না আশফিয়া। সন্ধ্যার দিকে হুঁশ হলে দেখলো বারান্দার দরজাটা খোলা। ছুটে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে খাটে শুয়ে কাঁদতে লাগলো।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছে সায়ন। শরীরটা বড্ড টায়ার্ড। বিকেলে ইন্টারভিউটা খুব বাজে হয়েছে সায়নের৷ তাই মন খারাপ করে এদিক সেদিক ঘুরে বেরিয়েছে। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো আশফিয়ার বারান্দার দরজাটা বন্ধ করা। বন্ধ দরজাটা দেখামাত্র সায়নের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। আবার কি হলো!! রুম থেকে বের হতে যাবে এমন সময় দরজায় নক পড়লো। দরজাটা খুলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সায়ন। আশফিয়ার বাবা মা ওর সামনে দাঁড়ানো। কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না সায়ন।। মাহতাব সাবের চৌধুরী সায়নকে কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো।
-এই ছেলে?? এগুলো কি??
সায়ন কাগজগুলো হাতে নিয়ে দেখলো। গতকাল আশফিয়াকে দেয়া চিঠি, ওর গানের সার্টিফিকেট, আর সাথে আশফিয়ার লেখা একটা ছোট্ট কাগজ।
" গানটা তোমার জীবন সায়ন। সেটা কখনো ছেড় না৷ আমার জন্যও। আজকের পর থেকে আমাদের মধ্যে আর কিচ্ছু নেই। সব শেষ। তুমি ভালো থেকো।"
সায়ন কি করবে না বুঝতে পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মাহতাব সাহেবের দিকে৷ ওর জীবন থেকে গানটাও চলে গেছে। আর আশফিয়াও!!!
-কি ভেবেছ? প্রতিদিন আমার বারান্দা টপকে আশফির রুমে যাবা আর আমি টের পাব না??
---------------------------------
-প্রত্যেকটা বাবা মাই চায় তাদের সন্তান সুখে থাকুক। আজকাল ভালোবাসার নামে যে ভন্ডামি শুরু হয়েছে সেসব দেখে নিজের মেয়েকে একটা অচেনা অজানা ছেলের হাতে কি করে তুলে দিই বলো??
-------------------------------
-আমি দেখতে চেয়েছি তুমি আমার মেয়েকে সত্যিই ভালোবাসো নাকি দুই দিনের মোহে আটকা পড়েছ--। আর আমার রিজেকশনটা তুমি কিভাবে নাও সেটাও দেখলাম---। তুমি যদি রাতের বেলা আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে তাহলে সেখানেই তোমাকে---। যাক--৷ তুমি সেসব করো নি।। এই দুটো মাস অপেক্ষা করেছ। আর চেষ্টা করেছ একটা চাকরি জোগাড় করার---। আমি খুব খুশি হয়েছি----।।
-স্যার!!!?
-ওই ছেলে স্যার কি!! বাবা বলো!?
-বাবা!!!!
-তোমরা দুজন দুজনের সাথেই খুশি থাকবে বুঝতে পেরেছি। একজনকে ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ণ যেন তোমরা। গান ছাড়তে হবে না তোমার। পরীক্ষায় পাশ করেছ--। এখন ছোটখাটো একটা চাকরির ব্যবস্থা করো। যাতে গানটাও করতে পারো৷ সাথে সামান্য ইনকামও হয়। সাথে শো না থাকলেও নিশ্চয়তা থাকে ভালো থাকার--। আর বাড়িতে খবর পাঠাও---।।
------------------- আশফিয়া কি জানে এসব??
-ওহ ভালো কথা বলেছ--। ওকে একটু গিয়ে বলে এসো---। মেয়েটা সেই সকাল থেকে তোমার গিটারটা নিয়ে বসে আছে----। তোমার গিটারের জন্য সরি--। আমি বুঝতে পারি নি তুমি এভাবে ওটা ভেঙে ফেলবে-----।।
-না না---। আঙ্কেল---।
-যাও-- দেখা করে এসো---।
সায়ন এক ছুটে আশফিয়াদের বাসায় আশফিয়ার রুমে এলো। মেয়েটা খাটে উপুড় হয়ে শুয়েই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে। পাশেই সায়নের গিটারটা জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করা। সায়ন হেসে গিটারটা একটু ছুঁইয়ে দিয়ে নিচে নামিয়ে রাখলো। খুব সাবধানে আশফিয়ার পাশে শুয়ে বুকে টেনে নিল আশফিয়াকে। ঠোঁট দিয়ে আলতো করে আশফিয়ার কানটা ছুঁয়ে দিল।
-আশফুমনি?? চোখ খোলো???
---------------------------------
-এই পাগলীটা?? দেখো না?? আমি এসেছি তো???
চোখ খুলতেই সায়নকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো আশফিয়া।।
-তুমি কি করে এলে? আমি তো??!!
-হুম হুম--।বারান্দার দরজা আটকে কি আর আমাকে আটকাতে পারবে সুন্দরী?? আমি তো মেইন ডোর দিয়ে এলাম----।।
-মানে!! বাবা দেখে নি তোমায়!!!
সায়ন আশফিয়ার চোখ দুটো মুছিয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে চুমো খেল। তারপর মাহতাব সাহেবের বলা সব কথা বললো। আশফিয়ার ব্যাপারগুলো এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সায়নকে জাপটে ধরে রইলো অবাক বিস্ময়ে।।
-একটা গা-গান শুনাবে??
সায়নের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি ফুটে উঠলো। সেও গান ধরলো আলতো গলায়।
-"মিলন হবে কত দিনে,
আমার মনের মানুষের সনে||
চাতক প্রায় অহর্নিশি,
চেয়ে আছে কালো শশী|
হবো বলে চরণ দাসী,
তা হয়না কপাল গুণে||
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন,
লুকালে না পায় অন্বেষণ|
কালারে হারায়ে তেমন,
ও রুপ হেরিয়ে দর্পণে||
যখন ঐ রুপ স্মরণ হয়,
থাকেনা লোক লজ্জার ভয়|
লালন ফকির ভেবে বলে সদায়,
প্রেম যে করে সেই জানে||"
সায়নের গান শুনে আশফিয়া লজ্জা পেয়ে সায়নের বুকে মুখ লুকালো। আসলেই এখন কেবল ওদের মধুর মিলনের অপেক্ষা।।
***(সমাপ্ত)***