নীল লাল ভালোবাসা by মুশফিকা রহমান মৈথি |
সকালে চা দেবার সময় দেবজানির হাতটা টেনে ধরলো স্বর্ণ। স্বর্ণের আকস্মিক কাজে খানিকটা বিস্মিত হয় সে। তার মুর্ছানো মুখখানি দেখেই হাতটি ছেড়ে দেয় স্বর্ণ। একটি কাগজে মোড়ানো প্যাকেট এগিয়ে বললো,
"বেশি দাম দিয়ে শাড়ি কেনার টাকা ছিলো না। তোমার যদি পছন্দ না হয় তবে রেখে দিও"
দেবজানির হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে স্বর্ণ বেরিয়ে গেলো। দেবজানি প্যাকেট খুলে দেখলো লাল পাড়ের একটা সাদা সুতির শাড়ি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শাড়িটি বড় জোর আশি থেকে একশত টাকা হবে। সালটি ১৯৮৮, এই সময় আশি-নব্বই টাকা অনেক কিছু, যেখানে বাস ভাড়াই মাত্র পাঁচ টাকা। দেবজানি মুচকি একটা হাসি দিয়ে শাড়িটা আলমারিতে তুলে রাখলো। বিয়ের পর এই প্রথম কিছু কিনে এনেছে স্বর্ণ। ভাবতেই ভালো লাগছে তার। কিশোরী মনে এক অন্যরকম শিহরণ জাগছে। সে নিজেও জানে না এই অনুভূতির নাম কি!দেবজানি জানে অভাবের সংসারে বিলাসিতা করার সুযোগ নেই; মধ্যবিত্তদের এই এক সমস্যা। কিন্তু এই অভাবের মাঝেও ছোট ছোট সুখ গুলো খুঁজে নিতে জানে তারা।
দেবজানি এবং স্বর্ণের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছিলো। তখন দেবজানি কেবল মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে, বাবা অবসর গ্রহণ করবেন তাই তাড়াতাড়ি বিয়েটা দেওয়াই উপযুক্ত ভাবলেন। মানুষের একটা বদ্ধ ধারণা আছে, বাবা অবসর গ্রহণ করলে নাকি মেয়ের ভালো বিয়ে হয় না। তাই দেবজানির অমতেই বিয়েটা ঠিক হয়। দেবজানি কলেজে পড়তে চেয়েছিলো, কিন্তু বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে যেতে পারে নি। স্বর্ণ মাস চারেক হয়েছে ছোট একটা চাকরিতে ঢুকেছে। তার ছোট দুই বোনের পড়াশোনা চলেছে। একজন ক্লাস টেনে তো আরেকজন ক্লাস এইটে পড়ে। বাবা মারা যাবার কারণে পরিবারে আয়ক্ষম ব্যাক্তি শুধুই স্বর্ণ। তার মারও বয়স হয়েছে, তাই ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ আনলে তারও সুবিধা।
দেবজানি যখন বউ হয়ে আসে তখন তার বয়স কেবল সতেরো। সংসারের 'স'ও তার বুঝা হয় নি। অথচ তার মা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সে এখন সংসারের বড় বউ; শাশুড়ী, ননদের যত্ন করা, বরের মন জয় করাই তার ধর্ম কর্ম। নিজের স্বপ্নের বিসর্জন যে সব নারীকেই দিতে হয়। এটা তো নতুন নয়; নারীদের স্বপ্ন তার সংসারের চার দেয়ালে আটকে থাকবে। নিজের সবটুকু দিয়ে সেই সংসারকে সে আগলে রাখবে, সংসারের কোণায় কোণায় আনন্দের জাদুমন্ত্র ছড়িয়ে দেয়। অথচ তার ঝুলিতে কিছুই থাকে না।
বিয়ের প্রথম রাতেই দেবজানির স্বর্ণের সাথে প্রথম দেখা। স্বর্ণকে দেখে মিনিট কয়েক অপলক নজরে তাকিয়ে ছিলো দেবজানি। একটা পুরুষও বুঝি এতটা সুদর্শন হয়! পুরুষেরও বুঝি রুপ হয়! তাকে হা করিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখ চেপে হাসে স্বর্ণ। তারপর ঈষৎ গলা খাকারি দেয় সে। স্বর্ণের এরুপ কাজে ধ্যান ভাঙলো দেবজানির, অনেকটা লজ্জায়ও পড়ে গেলো সে। স্বর্ণ তাকে স্বাভাবিক করতে পাশে বসতে নিলে খানিকটা গুটিয়ে যায় সে। স্বর্ণ তখন প্রগাঢ় কন্ঠে বলে,
"তাড়া নেই, পুরুষ বলেই যে শুধু শরীরে আধিপত্য করবো এরুপ পুরুষ আমি নই, যেহেতু একসাথেই থাকবো তাই আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব থাকাটাই বেশি দরকার। তুমি সময় নাও"
বলেই সে বিয়ের জামাকাপড় ছেড়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে। দেবজানির মনে যে ভয় ছিলো সেটা যেনো কর্পুরের ন্যায় উড়ে গেলো। সকল পুরুষ যে শুধু পুরুষত্ব খাটায় সেই ধারণাটা ভুল। কিছু পুরুষ ভালো বন্ধুও হয়।
দেবজানির সংসার জীবন শুরু হয়। শাশুড়ী, বর, ননদদের নিয়ে বেশ চলছিলো। তবে কোথায় যেন একটা চাপা কষ্ট রয়েই গেলো। খুব সাহস করেও স্বর্ণকে কথাটা বলা হয় না। সে তো ব্যস্ত তার সংসারের প্রয়োজন মেটাতে। সারাদিন খেটে রাতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরে বাসায় ফিরে। একদিন ননদদের পড়াতে যেয়ে শাশুড়ী মা খেয়াল করলেন, দেবজানির পড়ার প্রতি অদ্ভুত আগ্রহ। সকলের আড়ালে শুধু ঘাটাঘাটি করে বই পত্র। তখনি তিনি ঠিক করলেন ছেলের সাথে কথা বলবেন।
পরদিন সকালে স্বর্ণকে খাবার সময় বলে উঠেন,
"বাবা কি দপ্তর যাচ্ছিস?"
"হ্যা, মা কিছু বলবে?"
"বলছি, বউ মার পড়ালেখাটা আবার শুরু করলে হয় না?"
মার মুখে এমন কথা শুনে খানিকক্ষন অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে রইলো, আশি দশকের শ্বাশুড়ি কিনা বউ মাকে লেখাপড়া করাবে? স্বর্ণ স্মিত হেসে বললো,
"আমিও অনেকবার ভেবেছিলাম মা, তুমি আপত্তি করবে বলে বলা হয় নি। আসলে বাড়ির বউ এর পড়ালেখা ব্যাপারটা অতিরঞ্জিত শোনায় কিনা!"
"পাগল ছেলে আমার, ওরে সেও তো আমার মেয়ে। দুই মেয়ে পড়বে আর এক মেয়ে হেসেল টানবে এটা অবিচার নয়? একটু কষ্ট হবে প্রথমে; তবে ঠিক পেরে উঠবো দেখিস"
নিজের মায়ের প্রতি সম্মান খানা যেনো দ্বিগুন হয়ে যায় স্বর্ণের। মার সাথে কথা বলেই অফিসের জন্য বেড়িয়ে পড়ে সে। রাতে বাড়ি ফিরলো সাথে কিছু বই নিয়ে। দেবজানিকে চমকে দেবার জন্য তখনও কিছুই বলে নি স্বর্ণ। রাতে ঘুমাবার সময় বই গুলি বের করে দিয়ে বলে,
"সংসার চালালেই তো হবে না, পড়াশুনাটাও করতে হবে নাকি! বই গুলো রাখো, কালকে কলেজে ভর্তি করবো তোমাকে"
"এগুলো আমার?"
"এই বুড়ো বয়সে কি তবে আমি পড়বো? একটু কষ্ট হবে কিন্তু আমি জানি তুমি পারবে"
কি বলে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত সেই ভাষাটুকুই নেই দেবজানির। যে স্বপ্ন সে বিসর্জন দিয়ে সংসার সামলাতে এসেছে তবে সেই স্বপ্ন কি পূরণ হবে! নিজেকে সামলাতে পারলো না সে, স্বর্ণকে জরিয়ে ধরেই কেঁদে দিলো। এভাবে কাঁদতে দেখে স্বর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। অস্থির কন্ঠে শুধালো,
"কাঁদছো কেন?"
"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমি যে আবারো পরতে পারবো এটা কল্পনাও করতে পারি নি"
"ধুর পাগলী! এখনো অনেক পথ চলা বাকি"
এভাবে স্বর্ণের হাত ধরেই স্বপ্নের দিকে পা বাড়ায় দেবজানি। পড়াশুনোর চাপ, সংসার সব মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার। সারাদিন ঘরের কাজ তারপর রাত জেগে পড়া; এভাবেই দিন কাটতে লাগে দেবজানিরর। অবশ্য তার শাশুড়ি, ননদেরাও কম সাহায্য করে নি। আর স্বর্ণ তো ছিলোই। যতরাত বসে সে পরতো স্বর্ণও তার সাথে জেগে বসে থাকতো। সারাদিন পরিবারের মানুষের জন্য উপার্জন করে রাতে না ঘুমিয়ে বউয়ের পাশে বসে থেকে তার পড়ায় সাহায্য করা পুরুষদের নজির পাওয়া ভার। লোকটাকে যত দেখে ততই সম্মান যেন বেড়ে যায় দেবজানির মনে। সংসারে অভাব যে ছিলো না তা নয়, কিন্তু সুখ ছিলো অফুরন্ত।
অবশেষে ইন্টার শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় পা রাখে দেবজানি। নব্বই এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়ারে মেয়েদের সংখ্যাটি ছিলো খুব কম। কিন্তু এই সংখ্যালঘুদের মাঝে সেও একজন। দেবজানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হয়। ঘরের কাজ সামলে পড়াশুনা করতে অনেকটাই হাপিয়ে উঠতো সে। এর মাঝে তার শাশুড়ী মা মারা যান। স্বামী, ননদ সবাই যেন ভেঙে পড়ে৷ সুখের সংসারটার ভিটটাই যেনো নড়ে যায়। দেবিজানিকে তখন এক হাতে সব সামলাতে হয়। সে ঠিক করলো পড়াশুনাটা ছেড়ে দিবে৷ সংসারে মন দিবে। স্বর্ণকে বলতেই সে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
"তোমার পড়াশুনো যাতে নষ্ট না হয় তাই আমি তোমাকে বাচ্চার জোরও কখনো দেই নি, আর তুমি কিনা সেটাই ছাড়তে চাচ্ছো। আমার যে খুব ইচ্ছা, তুমি খুব বড় সরকারি চাকরি করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। দেবু, আমি যখন থাকবো না তখন যাতে তোমার কোনো কিছুর কমতি না হয়; তার জন্য আমি তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চাই"
দেবজানির হারানো মনোবল সেদিন আবার ফিরে পেয়েছিলো সে৷ স্বর্ণের সাহায্য ব্যতীত এই সময়টা পার করা হয়তো তার পক্ষে সম্ভব হত না। মানুষটির নাম শুধু স্বর্ণ নয়, মানুষটি সত্যিই স্বর্ণ।
নিকষকৃষ্ণ রাত্রির পর যেমন পূবের আকাশে কুসুম প্রভাতের দেখা মেলে, ঠিক তেমনই দুঃখের দিনগুলোর পর সুখেরা হাতছানি দেয়। কিছুদিনের মাঝেই স্বর্ণের প্রমোশনের পর প্রমোশন হয়। একে একে দুই বোনের ভালো পরিবারে বিয়ে দেয় দেবজানি এবং স্বর্ণ। দেবজানিরও পড়াশুনা শেষ হয়। চার বারের বেলায় সে বিসিএস ক্যাডার হয়। চাকরির পোস্টিং পড়ে চিটাগং। নতুন চাকরি, নতুন জায়গা। দেবজানি একা কি পারবে!! ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যায় স্বর্ণের। তাও অনেক কষ্টে দেবজানিকে রাজি করায়; যাতে সে চাকরিটা করে। শুরু হয় দেবজানির চাকরি জীবন। একবছর পর স্বর্ণও পোস্টিং নেয় চিটাগং। নিজেদের ছোট্ট সংসার শুরু হয় সে। নীল-লাল ভালোবাসায় মোড়ানো ছোট্ট সংসার।
দিন কারোর জন্য থেমে থাকে না, আজ একুশটি বছর কেটে গেছে। দেবজানির চাকরিও শেষের দিকে। এখন তার সংসারে অভাব নেই, নেই কোনো কিছুর কমতি। অফুরন্ত বিলাসিতা। এখন আর দেবিজানির একশত-দেড়শত টাকার শাড়ি পড়তে হয় না। তার আলমারি ভর্তি দামি দামি শাড়ি। তবে আজও তার এসবে কোনো আগ্রহ নেই। তার অলংকার দুইটি মেয়ে; যারা এখন একজন ডাক্তারি পড়ছে আর একজন ইংলিশে অনার্স পড়ছে। আজ দেবজানি যা তার পেছনে অবদান শুধুমাত্র একজন মানুষের; তা হলো তার স্বামীর। যে না থাকলে হয়তো আজ সংসারের চার দেয়ালের মধ্যেই তাকে আটকা পরে থাকতে হত। অথচ এই বিলাসবহুল, অভাবহীন জীবনে তার অভাবটি বড্ড তাড়া করে বেড়ায় দেবজানিকে। স্বর্ণ নামক মানুষটি গত হয়েছে একটি বছর কেটে গেছে। আলমারি খুলে সেই লাল পাড়ের শাড়িটা বের করলো দেবজানি। তার স্বামীর দেয়া প্রথম উপহার আজ অবধি পরম যত্নে রেখে দিয়েছে সে। শাড়িটিকে দেখলে কেউ বলতে পারবে না শাড়িটি কত বছর পুরোনো; শাড়িটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো স্বর্ণ তাকে বলছে,
"কাজলটা দেও তো। টিপ দিয়ে দেই; যাতে কারোর নজর না লাগে।"
ভাবতেই চোখ ভিজে আসলো দেবজানির। দম বন্ধ যন্ত্রণা করছে ভেতরটায়। দেবজানি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নীলাম্বরীর কোনে সাদা তুলোর ন্যায় মেঘগুলো উড়ছে। ঝিরিঝিরি বাতাস মুখশ্রীতে আছড়ে পড়ছে, আর বাতাসের সাথে বাধাহীন ভাবে উড়ছে তার কাঁচাপাকা চুলগুলো। আমের মুকুলের টক গন্ধ নাকে লাগছে। বসন্ত এসে গেছে। আজকালের প্রজন্মে এই ফাগুন মানেই হলুদ শাড়ি আর ফুলের সজ্জা। কিন্তু তাদের সময়ে এসব কিছুই ছিলো না। এমন ই এক পহেলা ফাগুনে, স্বর্ণ তাকে টাকা জমিয়ে শাড়িটি কিনে দিয়েছিলো প্রথম উপহার রুপে। এই সামান্য সুতির শাড়িতে ছিলো স্বর্ণের নীল-লাল ভালোবাসা। দেবজানি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ মানুষটা নেই। তবুও সে আছে। স্মৃতিতে, মনের অন্দরমহলে, সর্বত্রে। তার সেই নীল-লাল ভালোবাসাগুলো দেবজানিকে আগলে রেখেছে এই একটা বছর। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি আরো একবার বলা যেত "ভালোবাসি" তবে মন্দ হতো না। দেবজানি চোখটা মুছলো, মৃদু কন্ঠে আওড়ালো,
"ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি" _______
***(সমাপ্ত)***