নুপুর রহস্য

পড়ুন সুলতানা পারভীন'এর লেখা একটি গোয়েন্দা গল্প নুপুর রহস্য
নুপুর রহস্য
নুপুর রহস্য

০১!! 

সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই দিবা বিছানায় উঠে বসে আড়মোড় ভাঙলো। কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে পড়নের কোঁকড়ানো শাড়িটা টেনে ঠিক করে নিয়ে বুকের উপরে আঁচলটা ঠিক করে টেনে নিলো। ঘুমে চোখটা বুজে আসতে চাইছে ওর। তবুও আর একবার আড়মোড় ভেঙে অর্কের দিকে তাকালো। লোকটার ঘুমুঘুমু মুখটায় কিসের যে এতো মায়া সেটাই ভেবে পায় না দিবা। সকাল সকাল এই ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটার দিক থেকে অন্য কোনো দিকে চোখই ফেরাতে ইচ্ছে হয়না দিবার। কিন্তু মানুষটার তো অফিসে যেতে হবে। আর তার আগেই দিবার সব কাজকর্ম ঘুছিয়ে রাখতে হবে। 

দিবা বিছানায় পাশে আলনা থেকে একটা শাড়ি নিয়ে সরে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই হাতে হালকা একটা টান খেয়ে সোজা অর্কের বুকের উপরে এসে পড়লো। আর অর্কও চোখ বুজে থেকেই দিবার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। দিবা কিছু বলার চেষ্টা করতেই দিবার ঠোঁট জোড়া বন্দি হলো অর্কের উষ্ণ ঠোঁটের বাঁধনে। একটু পরে অর্কের উষ্ণ ঠোঁটের বাঁধন থেকে ছাড়া পেতেই দিবা নিজের লাজুক মুখটা অর্কের বুকে লুকিয়ে নিলো।

-এতো সকালে কই যাও বলো তো? সবে চোখ দুটো লেগে এসেছে--। আর তুমি তোমার ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছ? এটা কোনো কথা?

-তুমি ঘুমাও না? আমি ডেকে দেবো তো?

-তোমাকে ছাড়া ঘুম হয় না যে লাজুক লতা বউটা--।

-সবসময় এই এক কথা বলো কেন?

-নতুন কিছু বলবো? এই ধরো? সকাল সকাল তোমার উষ্ণ শরীরে যখন আমার হাত জোড়া খেলা করে, তুমি আলতো করে কেঁপে কেঁপে ওঠো সেই স্পর্শে----। তখন ইচ্ছে করে----।

-অসভ্য ছেলে--। মুখে কিছু আটকায় না তোমার?

-আটকাতে যাবে কেন? একটা মাত্র বউ আমার। জীবনের সবকটা আহ্লাদ জমিয়ে রেখেছি বউয়ের জন্য। সেসব ভালোবাসার অত্যাচার তো তোমাকেই ভোগ করতে হবে। তাই না বলো?

-ইশ! চুপ থাকো না একটু----।

-চুপ থাকলে তো তোমার এই মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে রাঙবে না গো বউটা---। আমার তো ভিষণ ভালো লাগে তোমার টুকটুকে লাল মুখটায়---।

-অর্ক?

-হ্যাঁ দিবাসোনা। বলো?

-তুমি??

-উফফ। ঘুমাতে দাও না? এতো সকালে ঘুমের ডিস্টার্ব করলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিচ্ছি----।

-ধ্যাত। ঘুমাও তো তুমি---। আর এখন আমাকে ছাড়ো---।

-এই দিবা??

-হুম?

-ও দিবা??

-হুমমম। বলো না?

-একটা কাজ করো। তাহলে এখনকার মতো ছাড়া পাবে। মিষ্টি করে একটা আদর দাও।

দিবা আর কথা না বাড়িয়ে মুখটা তুলে অর্কের গালে আলতো করে চুমো খেয়ে মুখ নামিয়ে নিলো। অর্ক দিবাকে না ছেড়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। 

-আরে? এটা আদর দেয়া হলো নাকি? মশাও তো আরো জোরে কামড় দেয়--। 

-অসভ্য ছেলে। মশার কামড়ই খাও যাও৷ আমি আর পারবো না কিছু করতে---।

-এই দিবা? শোনো না?

-কি??

-কাল রাতের মতো--। আবেশ ভরা চুমো চাই। ঠোঁটে তোমার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া চাই--। তাহলে আরো ঘন্টাখানেক খুব সুন্দর করে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকবো। একটুও জ্বালাবো না আজকে অফিসে যাওয়ার আগে--। প্রমিস---। দাও না প্লিজ??

-তুমি একটা-----।

-একটু সামলে বলো দিবাসোনা। নইলে জানোই তো--। পরে আমার ভালোবাসার অত্যাচারটাও তোমাকেই ভোগ করতে হবে---।

-উফফ।

-আরে! কি মুশকিল! দাও না??

-জি জনাব---।

দিবা মুখটা তুলে নিজের কাঁপা কাঁপা ঠোঁটটা অর্কের ঠোঁটে ডুবিয়ে দিতেই অর্কও দিবার ঠোঁট জোড়া কামড়ে ধরলো। অর্কের একটা হাত দিবার কোমড় ছাড়িয়ে এসে দিবার চুলের ভেতর দিয়ে দিবার মুখটা তুলে ধরে রেখেছে। দিবাও নিজের হাত দুটো ভাঁজ করে অর্কের বুকের উপরে রেখে অর্কের উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়ায় ভাসছে। একটু পরে অর্ক দিবাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। দিবা মুখ তুলেই দেখলো অর্কের ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির একটা বাঁকা হাসি ঝুলে আছে। লোকটার এই হাসিটার প্রেমে পড়ে ও রোজ সকালে। কেন যে প্রতিদিন সকালে দিবাকে এমন করে জব্দ করে লোকটা!

-ম্যাডাম? এভাবে নেশা ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে কিন্তু----।

অর্ক কথাটা শেষ করার আগেই দিবা তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠেই ওয়াশরুমের দিকে ছুট লাগালো। এই লোকটার বিশ্বাস নেই একদম। আবার হুট করে আক্রমণ করে বসতেও পারে। ভাবতেই দিবার মুখে লাজুক একটা হাসি ফুটে উঠে। তাড়াতাড়ি শাওয়ার শেষ করে শাড়িটা পড়ে নিয়ে, ভেজা চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছোটে দিবা। মানুষটার দুষ্টুমির চক্করে আজও আবার দেরি হয়ে গেছে দিবার। লোকটা সাড়ে ৯টা করে অফিসে যাবে। আর এখনই বাজে ৮ টা। এর মধ্যে দিবাকে নাস্তা বানাতে হবে, ৯ টায় ওকে ডেকে দিতে হবে, তার শাওয়ারে ঢোকার আগেই ড্রেস সিলেক্ট করে রাখতে হবে, সাথে মোবাইল, ঘড়ি, মানিব্যাগ, সানগ্লাস, রুমাল, গাড়ির চাবি, মোজা, জুতো সব গুছিয়ে রাখতে হবে তার হাতের কাছে। তবুও ঘর থেকে বের হওয়ার আগ মূহুর্তেও দিবাকে দরকার পড়বে অর্কের। দিবা মিটিমিটি হাসে। মজা পায় অর্কের এমন আচরণে। এক্কেবারে স্বামীসোহাগী সে। নাকি অর্ক বউ পাগল? এক্কেবারে চোখে হারায় ওকে অর্ক। 

রান্না করতে করতে এসব ভেবেই হাসছে দিবা। একটা মানুষ এতোটা কি করে ভালোবাসতে পারে? জানা নেই দিবার। তবে এই লোকটার এমন হুটহাট আক্রমণগুলো ভিষণ ভালো লাগে ওর। লোকটা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই দরজার কাছেই যখন ঘামে ভেজা শরীর নিয়েই ওকে জড়িয়ে ধরে, তখন অন্যরকম একটা শিহরণ জাগে দিবার সমস্ত দেহ মনে। কেমন একটা নেশার ঘোর ধরে যায় তার শরীরের ঘামের গন্ধটায়ও। এভাবে ঘামে ভেজা শরীরেও মানুষটা যখন দিবার ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়ায়, তখন দিবা অর্কের উপরে হাজার অভিমান করলেও সেই অভিমানের বরফটা গলে যায় এক নিমিষেই। ভাবতে ভাবতেই দিবা টের পেলো এক জোড়া হাত পিছন থেকেই শক্ত করে জাপটে ধরেছে। আর দিবার ঠোঁটের কোণের হাসিটা আরো বিস্তৃত হলো সেই মানুষটার স্পর্শে।

-কোনদিন তোমার এমন হুটহাট আক্রমণে আমি হার্টএ্যাটাক করেই মরে যাবো--। দেখো---।

-ইশ! বললেই হলো আর কি? তোমাকে আমি মরতে দিলে তো মরবে তুমি। আর এই? আমার কথা ভেবে ভেবে মিটিমিটি হাসবে, আবার আমাকেই এসব বলা না? তুমি মনে মনে আমাকে এভাবে ডাকলে আমি কি আর না এসে থাকতে পারি বলো?

-সবই তোমার আমাকে জব্দ করার বাহানা। জানি তো আমি।

-জানলে তো ভালোই। এখন চলো? আমার জামা কাপড় বের করে দিবে। শাওয়ার নিবো---।

-কাজ করছি দেখছো না?

-তো? আমি কি করবো? শাওয়ার তো নিতে হবে আমার নাকি? আমি যেন তোমাকে সারাদিন আটকে রাখবো এখন?? অবশ্য তোমার যদি তেমন ইচ্ছে হয় তাহলে রাখতেও পারি---।

-তুমি রুমে যাও তো--। আমি আসছি এক্ষুণি---। 

-তাড়াতাড়ি যেন পাই বলে দিলাম-।

-হুহ----। একটু পরেই কাজ করতে বুয়া আসবে--। আর উনার এখন--।

-কিছু কি বললে?

-কই না তো? তুমি যাও-- রুমে যাও--। আসছি আমি---।

অর্ক দিবার গালে টুপ করে একটা চুমো খেয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। দিবাও চুলোয় ভাজিটা নেড়ে দিয়ে একটু চুলোর জ্বালটা কমিয়ে দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে যাওয়ার পর কি দেখবে সেটা দিবা বেশ ভালো করেই জানে। এই কয়েকটা মিনিটেই আলমারির উপর দিয়ে নির্ঘাত একটা মিনি টর্নেডো বইয়ে দিয়েছে মানুষটা। আর এখন হয়তো আলমারির সামনে ভাবুক মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে অর্ক। দিবা রুমে আসতে দেখলোও তাই। অর্ক আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে একবার ছড়ানো জামা কাপড়গুলো দেখছে। আর একবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। আর সেটা দেখেই দিবা খিলখিল করেই হেসে ফেললো। এই লোকটাকে নিয়ে যে ওর কি হবে কে জানে!!

দিবার হাসি দেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দিবাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো অর্ক। দিবা তবুও খিলখিল করে হেসেই চলেছে। ওর হাসি থামতেই চাইছে না আজকে। অর্কও রাগ করতে পারলো না। দিবা হাসির মুখটার দিকে তাকিয়ে ওর নিজের ঠোঁটের কোণেও অজান্তেই একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে সবসময়ই। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

-খুব হাসি পাচ্ছে না তোমার? বললাম না তাড়াতাড়ি রুমে আসতে? এলে না কেন?

-তুমি যে রুমে এসেই টাওয়াল না নিয়ে আলমারির উপরে হামলা করবে তা কি আমি জানি?

-আমি হামলা করেছি?

-নয়তো কি? এটাকে আর কি বলবে? সব শার্ট প্যান্ট ফ্লোরে ছড়িয়ে ফেলে রেখেছ। এটাকে হামলা না বললে কি বলবে বলো?

-যাই বলো না কেন। এগুলো তোমাকেই গোছাতে হবে। এটাই শাস্তি দেরি করে আসার----। এখন কি পড়বো বের করে দাও তো তাড়াতাড়ি---।

-আচ্ছা--। দাঁড়াও তুমি---।

অর্কের কাছ থেকে সরে এসে দিবা অর্কের জন্য শার্ট প্যান্ট বের করে দিলো। অর্কও টাওয়াল কাঁধে ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকলো। দিবা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে শুনতে পেল অর্ক গুনগুন করে গান ধরেছে।

"রাখো রাখো রে জীবনে
 জীবন বল্লভে প্রাণমনে
ধরি রাখো নিবিড় আনন্দ বন্ধনে।।

রাখো রাখো রে জীবনে।

আলো জ্বালো হৃদয়দীপে
অতিনিভৃত অন্তরমাঝে
আকুলিয়া দাও প্রাণ গন্ধ চন্দনে।।

রাখো রাখো রে জীবনে।"

বেশ অনেকক্ষণ দিবার সাথে দুষ্টুমি করার পর অর্ক অফিসে গেছে৷ যাওয়ার সময়ও জাপটে ধরে নিজের পাওনাটা বুঝে নিতে ভোলে নি ছেলেটা। এসব ভেবেই বেডরুমের বিছানাটা ঝাড়তে ঝাড়তে হাসছিলো দিবা। বিছানাটা গোছানো প্রায় হয়ে গেছে তখন দিবার খেয়াল হলো এই চাদরটা দুদিন ধরে বিছানায় পাতা আছে। আজই বিছানার চাদরটা ধুয়ে দিতে হবে। অর্কের আবার দুদিন পরপর বিছানার চাদর বদলানো চাই। নইলে ওর গায়ে কেমন লাল লাল হয়ে র‍্যাশ বের হয়। কথাটা মনে পড়তেই দিবা তড়িঘড়ি করে চাদরটা তুলে ফেললো। আলমারি থেকে ধোয়া একটা চাদর বের করবে এমন সময় ছোট্ট প্যাকেটটার উপর নজর পড়লো দিবার। ভ্রু কুঁচকে প্যাকেটটা খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই দিবার হাতে ধরা প্যাকেটটা টুপ করে হাত ফসকে পড়ে গেল। আর ঝুমঝুম করে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো একপাটি রূপোর নূপুর।

০২!!

মাস খানেক পরের ঘটনা।
সকালে দিবা প্রতিদিনের মতো পা টিপে টিপে উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা বানাতে চলে গেছে। নাস্তা বানানো শেষ হলে অর্ককে ডেকে দিতে বেডরুমে এলো দিবা। আজ কেমন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায় অর্ক। দেখেই দিবার বুকের ভেতরে ধ্বক করে উঠলো। ছুটে বিছানার কাছে গিয়ে ফ্লোরে বসেই অর্কের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো দিবা। তারপর একটু ঝাড়া দিলো অর্কের বুকে। অর্কও একটু ক্লান্তি নিয়ে চোখ খুলে তাকালো। দিবার চোখেমুখে ভয়টা নজরে পড়ায় একটু কষ্ট করেই হাসার চেষ্টা করলো ছেলেটা।

-অর্ক? কি-কি হয়েছে তোমার? মুখটা এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন তোমার? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?

-না---। আসলে বুকের বা পাশটায় একটু ব্যথা করছে---।

-সে কি! কখন থেকে? 

-আরে! একটু আগে থেকেই-। এতো হাইপার হও কেন পাগলি? কিছুই না। গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা মে বি। এন্টাসিড খেলেই----।

-তুমি বেশি কথা বলবা না একদম। আজাইরা ডাক্তারি ফলাতে কে বলেছে তোমাকে? অসহ্য--। 

-আরে!! দিবা?

-উঠো? এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে যাবে--। না না। দাঁড়াও। এখন তো ডাক্তার সাহেবকে চেম্বারে পাওয়া যাবে না। উমমম। আমি না হয় ডাক্তার সাহেবকে কল করে আসতে বলছি বাসায়--। তুমি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে রেস্ট নাও---।

-আরে‌! দিবা? পাগল হলে? আমার অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাবে--। আগে একটা এন্টাসিড খেয়ে দেখি-। না কমলে অফিসের ডক্টর চেকআপ করে নিবে----।

-আজ তোমাকে অফিসেই বা যেতে হবে কেন হ্যাঁ? ফাইজলামি করো তুমি আমার সাথে? শরীর খারাপ নিয়েও তার অফিস যাওয়া লাগছে--। কি এমন রাজ্যের কাজ পড়ে আছে তোমার অফিসে যে আজও এই শরীর নিয়েও যেতে হবে তোমাকে?

-দিবা? এভাবে হুট করে তো অফিস কামাই দেয়া যাবে না গো সোনাবউটা। একটাবার শোনো আমার কথাটা প্লিজ? আজ অফিসে ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং আছে। এমডি স্যার আসবে, ক্লাইন্ট আসবে বাইরে থেকে-----।

-জানি তো। এখন আরো কতো কিছু গুরু দায়িত্ব সামলাতে হবে আপনার। শরীরের দিকে খেয়াল করার সময় কোথায় পাবেন আপনি??

-দিবাআআআ?? আরে? রাগো কেন বউ? এতো অবুঝ হলে চলে বলো?

-যাও তো যাও। কিছুই আর বলবো না আমি---। আমার কথা শোনার সময় কার আছে---??

-আরে দিবা? শার্ট-প্যান্ট তো বের করে দাও না? আমি অফিসে যাবো তো?

-পারবো না। পারবো না। পারবো না। নিজে খুঁজে নাও----।

দিবা রাগ দেখিয়ে ধুম করে বেডরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে সোজা চলে গেল রান্নাঘরে। অর্কের উপরে এতো রাগ হচ্ছে যে ইচ্ছে করছে মাথাটাই ফাটিয়ে দিতে। বেশ কিছুক্ষণ পর দিবা টের পেল শীতল বাঁধনে ওকে জড়িয়ে নিয়েছে অর্ক। রাগ করে ছোটার জন্য ছটফট করতে লাগলো দিবা। অর্ক হেসে দিবাকে এক হাতে জাপটে ধরে রেখে অন্য হাতে ঘাড়ের কাছের চুল সরিয়ে ঠোঁট বুলাতে লাগলো। অর্কের স্পর্শে দিবা থমকে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। অর্ক হেসে দিবার কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো একবার, আবার দুষ্টুমি করে দিবার ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। 

-এই দিবা? রাগ করো না প্লিজ? সত্যি বেশি করছে না তো ব্যথা---।

-সত্যি তো? নাকি আমাকে বুঝ দিচ্ছ?

-না গো। সত্যি বেশি না। একটুই ব্যথা। বাসায় তো এন্টাসিড নেই। যাওয়ার সময়ই কিনে নিবো। আর দেখবে সেরেও যাবে---।

-----------------------

-দিবা? এই? শোনো না?

-বলো---।

-রাগ করে থেকো না। এই? প্লিজ সোনাবউ? আর শোনো না? তুমি অনেকদিন পুডিং করো না আমার জন্য। আজ করবে? তোমার হাতের পুডিং একদম অসাধারণ----।

-দুপুরে----?

-নাহ--। রাতে। দুপুরে বাসায় ফিরতে পারবো না আজকে----।

-ওহ!

-দিবা?? এভাবে অভিমান করে মুখটা কালো করে থেকো না গো বউটা প্লিজ? শোনো না? খিদে লেগেছে তো? খাইয়ে দাও না?

-হুম----। এসো??

অর্ক খাওয়া দাওয়া করে অফিসে চলে গেছে৷ দিবাও নিজের টুকিটাকি কাজ সেরে নিয়েছে৷ দুপুরে লাঞ্চের সময় অর্ক নিজেই কল করেছে৷ জানে কলটা না করলে পাগলিটা না খেয়েই বসে থাকবে৷ নয়তো অভিমান করে গাল ফুলিয়ে কাঁদবে। দিবাও যেন কলটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। রিং বাজার সাথে সাথেই রিসিভ করলো কলটা।

-বউটা মোবাইলের পাশেই বসে ছিল? বাহ!

-ব্যথা সেরেছে তোমার?

-জি ম্যাডাম। বলেছিলাম না এন্টাসিড খেলেই সেরে যাবে----।

----------------------

-দিবা? আবার কি হলো বলো তো? 

-কিছু না----। রাখছি----।

-আরে বাবা! আচ্ছা। ঠিক আছে আমি ডাক্তার সাহেবকে কল করে বলবো বুকের ব্যথাটার কথা। আর কালই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তোমার সাথে গিয়েই ডাক্তার দেখিয়ে আসবো---। ওকে? হ্যাপি এবার?

-আমমম। সেটা তোমার ইচ্ছে---। আমি কি জানি--।

-বাহ!! আমি আরো ভাবলাম ছুটিটা একটু কাজে লাগাবো। বহুদিন পর এতোটা সময় বউকে কাছে পাবো--। কোথায় বউটা একটু খুশি হবে তা না---।

-এই রাখো তো? রাখছি আমি---।

-হা হা হা। পাগলিটা। খেয়ে নাও। আমি ক্লাইন্টের সাথেই লাঞ্চ করে নিয়েছি---।

-আচ্ছা। বায়---।

অর্কের বাসায় ফিরতে ফিরতে ১১ টা বেজে গেল। দিবা দরজাটা খুলতেই অর্ক শক্ত করে দিবাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। দিবা একবার কেঁপে উঠে নিজেও অর্ককে জড়িয়ে ধরলো। বেশ অনেকক্ষণ পর অর্ক দিবাকে ছেড়ে দিয়ে আলতো করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। দিবার সারা মুখের লাল আভা খেলা করে যেতেই অর্ক হেসে ফেললো। আলতো করে কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো দিবার।

-বাকিটা রাতের জন্য তোলা থাক? ভিষণ খিদে পেয়েছে এখন। তোমাকে আপাতত পরে দেখছি---।

-যাহ! অসভ্য লোকটা। ফ্রেশ হয়ে আসো যাও--। আমি খাবারটা একটু গরম করে নিই--।

-উঁহু। গরম করাও লাগবে না। ফ্রেশও হতে পারবো না। এতো খিদে লেগেছে যে তোমাকেই গোটা খেয়ে ফেলতে পারবো এখন---। তাড়াতাড়ি খাবার লাগাও--।

-মাইর লাগাবো বলে দিলাম-। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো? নয়তো তোমার পছন্দের পুডিংটা কিন্তু পাবে না খাওয়া শেষে--।

-ইশ!! এটা কিন্তু ঠিক না দিবা। একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে এভাবে কষ্ট দিতে পারো না তুমি--।

-আমি আরো অনেক কিছুই পারি। তুমি যাবে এখন?

-হুহ। এর শাস্তি রাতে পাবা ওয়েট করো--। ফ্রেশ হয়ে আসছি। 

-হুম-। দেখা যাবে জনাব কে পায় শাস্তি আজকে---।

-কেন? তুমি শাস্তি দিবা বুঝি? কি অন্যায়ের শাস্তি দিতে চাও বলো? অন্তত কি দোষ আমার জানি আগে --।

-তুমি কি যাবে??

-হুম? ওহ। হুম। যাচ্ছি যাচ্ছি----।

দিবার গালে আলতো করে চুমো খেয়েই অর্ক বেডরুমে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর অর্ক ফিরে এলে দিবা পুরো হা হয়ে গেল অর্ককে দেখে। ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পড়নে অর্কের। শাওয়ার নেয়ার পর এই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে এতো স্নিগ্ধ লাগছে ছেলেটাকে যে দিবার যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। অর্ক দিবার দিকে তাকিয়ে বাঁকা একটা হাসি ফুটিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। দিবাও ভ্রু কুঁচকে অর্ককে একবার দেখে প্লেটে খাবার তুলে দিতে শুরু করলো। তারপর চেয়ার টেনে বসতেই অর্ক নিজে খেতে খেতে দিবাকেও খাইয়ে দিতে শুরু করলো। 

-আজ হঠাৎ এমন সেজেগুজে খেতে বসলে কেন? 

-কেন গো? খারাপ লাগছে দেখতে? চেইঞ্জ করে আসবো গিয়ে?

-বলেছি আমি সে কথা একবারও? খাও---।

-দিবা?

-হুম??

-ভালোবাসি তোমাকে----।

-হুম? খেতে বসে ভালোবাসার কথা মনে পড়েছে তোমার?

-কি জানি! ইচ্ছে হলো তাই বললাম। তুমি তো জবাবও দিলে না--। হুহ।

-সব কথা কি মুখে বলে জবাব দিতে হয়??

-তবু--। যদি কখনো মনে হয়, উত্তরটা তখনই দিলে ভালো হতো। আর যদি কখনো----।

-দার্শনিক হতে ইচ্ছে করছে রাত বিরেতে?

-হাহা! আবার রাগ করছো লাজুক লতা? আর খাচ্ছ না কেন? হা করো?

-খিদে নেই আমার আর----।

-আচ্ছা বাবা। সরি--। আর কখনো বলবো না তো বউটা। সরি সরি? এই কান ধরছি দেখো? এখন খাও?

-হুম---।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে পুডিংয়ের বাটিটা হাতে নিয়ে আয়েশ করে খাটের মাঝখানে বসে পড়লো অর্ক। দিবা জানে অর্ক এটাই করবে৷ আয়েশ করে সময় নিয়ে একটু একটু করে পুডিংটা খাবে অর্ক। দিবা তাই আর কিছু না বলে রুমে পায়চারি করছে। অর্ক খাচ্ছে আর ভ্রু কুঁচকে দিবার পায়চারি দেখছে। 

-এই? কি হলো কি তোমার? 

-মনে হয় খাবারটা বেশি হয়ে গেছে। কেমন একটা লাগছে---।

-কি আর খেলে! ওই একটুকু খাবার-। ধ্যাত! চুপ করে এখানটায় বসো----।

-নাহ! দেখি ছাদ থেকে একটু ঘুরে আসি--। খোলা হাওয়ায় ভালো লাগবে হয়তো---।

-সেটাই বলো--। তোমার প্রতিরাতে খাওয়ার পরে একবার ছাদে যাওয়া চাই ই চাই। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় শালার দেখে আসি ছাদে আছেটা কি--।

-----------------------

-আরে বাবা! দুষ্টুমি করছিলাম তো। যাও তুমি--। আমি ততক্ষণ নাহয় পুডিংই খাই----। কি আর করা!

-হুম-----।

দিবা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছাদে রওনা হলো। ঘড়িতে ১১ টা বেজে ৪০ মিনিট। মোটামুটি ১০-১২ মিনিট হাঁটলেই চলবে। দিবা ছাদে এসে দেয়াল ধরে অন্ধকারের দিকে তাকালো। চোখ বেয়ে টুপটুপ করে অশ্রু বিন্দুগুলো ঝড়ছে দিবার। আর একহাতে শক্ত করে ধরে আছে একজোড়া রূপালী নূপুর। 

০৩!!

দিবার চোখের সামনে প্রায় দেড় বছর আগের একটা ঘটনা ভেসে উঠলো। রাত্রির এইচ এস সির রেজাল্ট বের হয়েছে। মেয়েটা রেজাল্ট আনতে গেছে। আর এদিকে দিবা ছোট বোনকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য বসার রুমটা সাজাচ্ছে। রাত্রির পছন্দের সব রান্না করেছে দিবা নিজেই। বাবা আর দিবা এখন অপেক্ষা করছে রাত্রির ফিরে আসার৷ একটু পরেই মুখ পাংশু করে রাত্রি বাড়িতে ফিরলো। রাত্রির পাংশু মুখটা দেখে বাবা আর দিবা দুজনেই ভয় পেল। দিবা ছুটে দরজাটা সামনে রাত্রির কাছে ছুটে গেল। দিবাকে সামনে দেখেই দিবা নাক ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো করে ফেললো মুখটা। রাত্রির এমন হঠাৎ কাঁদোকাঁদো মুখটা দেখে দিবা পুরোই থমকে গেল। তাড়াতাড়ি বোনের মুখটা তুলে ধরলো।

-কি হয়েছে সোনাপাখি? কাঁদছিস কেন? বল আপুই কে--। কে কি বলেছে বল?

-আপুই---। এ্যাঁ---। আমার রেজাল্ট---!

-কি হয়েছে বনু বল না? 

-আমার রে-রেজাল্ট---। আ--আ--আ---।

-রেজাল্ট খা-খারাপ -খারাপ হয়েছে তোর?

-এ্যাঁ--এ্যাঁ--। আমি এতো ভালো পরীক্ষা দিয়েছি---। 

-আচ্ছা বাবুসোনা কাঁদিস না পাখি। সব ঠিক হয়ে যাবে--। এবার হয়নি তো কি হয়েছে--? মন খারাপ করিস না--। সামনের বার---।

-ও বাবা!! দেখো না?

রাত্রি এবার দিবার সামনে থেকে সরে গিয়ে বাবার বুকে মুখ ডুবিয়ে ফোঁপাতে শুরু করলো। দিবা কি করবে ভেবেই পাচ্ছে না। দিবা আর রাত্রি দুজনেই ব্রাইট স্টুডেন্ট। পরীক্ষার সময়ে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েছিল মেয়েটা। কিন্তু রেজাল্টটা তাহলে খারাপ হলো কেন? কোন ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই রেজাল্টে। দিবা একবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রাত্রির চুলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

-সোনাপাখি শোন? বোর্ড চ্যালেঞ্জ করবো আমরা কেমন? আর তাতেও কিছু না হলে----।

-আআহহহা--। তুই একটা খারাপ আপুই----।

-সেকি! আমি কি করলাম!

-তোর কি মনে হয় আমি ফেইল করার স্টুডেন্ট! আআআআ--। ও বাবা? দেখো না? আপু কি বলে?

-আরে!! বাবা! আমি কখন বললাম ও ফেল করেছে বলো তো? এই মেয়ে তাহলে তুই কাঁদছিস কেন?

-আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না এখনো--।

-কেন? কি হয়েছে?

-দেখ তুই---।

দিবা একবার ভ্রু কুঁচকে রাত্রির দিকে তাকিয়ে রাত্রির মোবাইলটা হাতে নিলো। রেজাল্টের সাইটে গিয়ে রাত্রির রোল আর রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার দিতেই রেজাল্ট ভেসে উঠলো মোবাইলের স্ক্রিনে। দিবা নিজেও হা হয়ে গেল। সব কটা সাবজেক্টেই এ+ পেয়েছে রাত্রি। রাত্রি আবার নাক টানতে টানতে দিবাকে জড়িয়ে ধরলো।

-জানিস আপুই? কলেজের নোটিশ বোর্ডে দেখে আমি একদম বিশ্বাসই করতে পারি নি--। প্রিন্সিপাল স্যার সবার সামনে আমার এতো এতো প্রশংসা করেছে। আর জানিস? বোর্ডে আমার র‍্যাঙ্কিং ১৫। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না রে আপুই--।

-ওরে দুষ্টুপাখি। এই খুশিতে কাঁদছিস? আমি তো জানতাম আমার সোনাপাখিটা অনেক ভালো রেজাল্ট করবে---।

-ইশ! একটু আগেই ফেল বলছিল আমাকে--। হুহ---। এখন গিফ্ট দে। আমি এতো ভালো একটা রেজাল্ট করেছি--। দে দে। তাড়াতাড়ি দে---।

-আপনার গিফ্টও রেডি ম্যাডাম--।

-সত্যি! দে না আপুই। আমি দেখবো--। ও আপুই?

-আরে! দিচ্ছি রে বাবা দাঁড়া---।

দিবা একটা ছোট্ট বক্স রাত্রির হাতে ধরিয়ে দিতেই রাত্রি ভ্রু কুঁচকে সেটা খুললো। বক্সে এক জোড়া রূপার নূপুর দেখে খুশিতে বোনকে জড়িয়ে ধরলো রাত্রি। বাবা হেসে রাত্রির মাথায় আলতো হাত রাখলেন।

-দুটোই পাগল। এখন বাসায় ঢুকে উদ্ধার করো মা। সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করতে হবে তো?

-মিষ্টি কেনাও শেষ তোমাদের?!

-তো? আমরা তো জানতামই। আমাদের রাত্রি সোনামনি ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে--। তারজন্যই তো এতো রান্না করেছি বাপ বেটিতে মিলে---।

-এই বাবা! খবরদার ক্রেডিট নিবা না। আমার সোনাপাখিটার জন্য আমি কিন্তু আজকে একলাই রান্না করেছি---। 

-আমিও এতো একটু এগিয়ে দিয়েছি-। আচ্ছা চল বাবা। মিষ্টি খাই। আর খাওয়া দাওয়া করি একটু। 

-বাবা! তোমার না সুগার বেড়েছে-?

দুই মেয়ে ডাক্তারি ফলানোর আগেই বাবা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লেন। রাত্রিও সোফায় বসে নিজের দু পায়ে বোনের দেয়া নূপুর জোড়া পড়ে সানন্দে ছমছম রব তুললো। দিবা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে দেখে রাত্রি একছুটে নূপুরের রুনুঝুনু শব্দ তুলে এসে দিবাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।

-থ্যাংক ইউ আপুই---।

-পছন্দ হয়েছে ম্যাডামের?

-হুম---। ভিষণ। তবে আমি ভেবেছিলাম গিফ্টে একটা জিজু দিবি আমাকে---। রসায়নে অনার্স শেষ করে বসে আছিস। কি লাভ হলো বলো তো যদি জীবনে একটু রসকস না থাকে? 

-তবে রে দুষ্টু??

রাত্রি মুখ ভেংচি দিয়ে পালালো। আর দিবাও ওকে ধরার জন্য ছুটলো। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল ওদের বাবা মেয়ের সুখের দিনগুলো। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা দমকা হওয়া এসে ওদের সুখেট সংসারটা তছনছ করে দিয়ে চলে যায়। রেজাল্টের সপ্তাহ খানেক পরেই একদিন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও রাত্রি বাসায় ফিরে নি। দিবা আর ওর বাবা রাত্রির কোচিং, পরিচিত, বন্ধু বান্ধব সবার কাছে খোঁজখবর করলেও কোথাও মেয়েটাকে পায় নি। সারাটা রাত ওদের কেটেছে ভয়ে আর আতঙ্কে। ওদের ছোট্ট পাখিটার কি হলো, কোথায় আছে মেয়েটা কে জানে! সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি দিবা বা ওদের বাবা। ভোর হতেই একটা কল এলো। কলটা পেয়েই বাবাকে নিয়ে ছুটে হাসপাতালে যায় দিবা। সেখানে ওর আদরের ছোট বোনটা ছিল না। ছিল ওর রক্তাক্ত লাশ। হায়েনাদের দল কুঁড়ে কুঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে মেয়েটাকে। ছোট্ট শরীরটা এতোটা ধকল নিতে পারে নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা গেছে। 

হাসপাতালের একজন নার্স দিবার দিকে কয়েকটা জিনিস বাড়িয়ে দিলেন। দিবা ফ্যালফ্যাল করে নার্সের দিকে তাকিয়ে রইলো। 

-দেখুন--। উনি ভোররাতের দিকেই এক্সপায়ার করে গেছেন--। উনার সাথে এই কয়েকটা জিনিসই পাওয়া গেছিলো। 

-ওকে--ওকে এডমিট কে করেছিল?

-কে এডমিট করেছে জানি না। মাঝরাতের দিকে মেয়েটাকে একটা লোক নিয়ে আসে। লোকটার কোন তাড়া ছিল সম্ভবত---। বেশিক্ষণ ছিলেন না----। উনাকে এডমিট করিয়ে দিয়ে বিল পে করেই চলে যায় লোকটা---।

-ওহ----।

নার্সের দেয় জিনিসগুলো হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলো দিবা। দিবার দেয়া একপাটি রক্ত মাখানো নূপুর। একটা ঘড়ি আর রাত্রির ব্যাগ। দিবা একবার অবাক বিস্ময়ে জিনিসগুলো দেখে বুকে জাপটে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ওর ছোট্ট দুষ্টুপাখিটা সত্যিই রাতের কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। কি দোষ ছিল মেয়েটার যার কারণে ওকে এভাবে মরতে হলো? কেন এভাবে হায়েনাদের হাতে জীবন দিতে হলো এই ছোট্ট পরীটাকে?

দিবা চোখ মুছে হাতের নূপুর জোড়া বুকে শক্ত করে চেপে ধরলো। সেদিনের সেই তড়িঘড়ি করে রাত্রিকে হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে আসা লোকটা অর্ক ছিল সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই দিবার। সেই অর্ক যার সাথে বছর খানেক আগে দিবার বিয়ে হয়েছিল। সেই অর্ক যে এক সেকেন্ডের জন্যও দিবাকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। সেই অর্ক যে কিনা ওর নিজের ছোট্ট বোনের খুনী! তাই এই লোকটাকে যতই ভালোবাসুক না কেন কঠিন শাস্তি দিয়ে মৃত্যু দিবে দিবা। হয়তো লোকটাকে কষ্ট পেতে দেখে সহ্য হবে না ওর। তাই বাহানা দিয়ে পালিয়ে আসা দিবার। দিবা আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। নিজের সামনে নিজের ছোট্ট বোনটাকে কবরে শুয়ে থাকতে দেখা যতটা কষ্টের, ততটাই কষ্টের নিজের বিশ্বাসঘাতক স্বামীকে শাস্তি দেয়া। দিবা নূপুর জোড়া বুকে চেপে ধরে সময়টা কাটার চেষ্টা করছে। আজ কেন জানি সময়টাও কাটতেই চাইছে না। এক একটা সেকেন্ড মনে হচ্ছে এক একটা যুগের সমান লম্বা। 

০৪!!

বেশ অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলে দিবা ছাদ থেকে বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। হাতে ধরা নূপুর জোড়া এক্টা ছোট্ট থলেতে মুড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। এসেই দেখলো কেউ একজন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দিবা একটু ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলো লোকটার দিকে।

-কাকে চাই?

-ম্যাম? আমি একটা পার্সেল ডেলিভারি করতে এসেছি। অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজাচ্ছি। কেউ দরজা খুলছে না-।

-ওহ--৷ আমি একটু ছাদে গিয়েছিলাম---। আর অর্ক মানে আমার হাসবেন্ড সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে---। কিসের পার্সেল বলুন?

-এই তো ম্যাম---। এটা---।

লোকটা পার্সেলের বক্সটা দিবার হাতে দিতেই দিবা খানিকটা অবাক হলো। কিসের পার্সেল, কে পাঠিয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। লোকটা একটা কাগজে দিবার সাইন নিয়ে একটু হাসলো।

-হ্যাপি এ্যানিভার্সারি ম্যাম---। 

লোকটা কথাটা বলেই চলে গেল। কিন্তু দিবার পা জোড়া যেন ফ্লোরে আটকে গেছে। এ্যানিভার্সারি! আজ ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী? আজকের দিনেই ওরা দুজন একটা পবিত্র সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা পড়েছিল! আর আজকের দিনেই কিনা দিবা অর্ককে----! দিবা তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অজান্তেই চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দিবার। রাত ১২ টা বেজে ১০ মিনিট। এতোক্ষণে দিবার ল্যাবে তৈরি কেমিক্যালটা নিজের কাজটা করে ফেলেছে। দিবা গুটিগুটি পায়ে বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল। একটু ইতস্তত করেই রুমে ঢুকলো। বিছানার দিকে তাকাতেই অর্ককে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখলো। দিবা চুপচাপ ফ্লোরে বসে অর্কের পার্সেলটা খোলায় মন দিলো। চলে যাওয়ার আগে কি সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল লোকটা সেটা দেখতে ভিষণ ইচ্ছে করছে দিবার৷ 

পার্সেলের বক্সটা খুলে রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেল দিবা। বক্সটা খুলতেই এক জোড়া ঝলমলে রূপার নূপুর আর একটা চিঠি হাতে পেল দিবা। নূপুর জোড়া হুবহু রাত্রির নূপুর জোড়ার মতো। সামান্য পার্থক্যটুকু পর্যন্ত নেই। দিবা থমকে কিছুক্ষণ নূপুর জোড়া দেখলো। তারপর কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠিটা খুলে পড়তে আরম্ভ করলো। 

"হ্যাপি এ্যানিভার্সারি লাজুকলতা বউটা৷ তুমি আমার শূন্য জীবনটাতে এতোটা আনন্দের সমাগম নিয়ে এসেছ যে এই রূপালি নূপুরের ঝুমঝুমানি তার কাছে নিছকই বেমানান। তবু আজকে আমাদের এই আনন্দের দিনটাতে তোমাকে এই উপহারটাই দিলাম। অবশ্য এই নূপুর জোড়ার একটা গল্প আছে। বেশ অনেকদিন আগে রাতে এক বন্ধুর কল পেলাম। আর্জেন্ট ব্লাড লাগবে কারো। তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছি। হঠাৎ একটা অন্ধকার গলির ভিতরে মনে হলো কেউ পড়ে আছে। গাড়ির লাইটের আলোয় মানুষ বলেই মনে হলো। কারো এক্সিডেন্ট হয়েছে ভেবে নেমে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে পড়ে আছে। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। কি হয়েছে বুঝতে দেরি হলো না। মেয়েটা কথা বলতে পারছিল না, কিন্তু তখনো বেঁচেই ছিলো। পাশেই একটা হসপিটালে নিয়ে যাই ওকে নিজের গাড়িতে করেই। তারপর এডমিট করতে করতেই বন্ধুর কল পেলাম আবার৷ যার জন্য ব্লাড লাগবে তার অবস্থাও ক্রিটিকাল। এডমিট ফিস পে করে মেয়েটাকে ওই হসপিটালে রেখেই চলে আসতে হয় আমাকে। একজন পরিচিত বড় ভাইয়ের এক্সিডেন্টে সিরিয়াস ইনজুরি হয়। তাকেই ব্লাড দিয়ে ভেবেছিলাম আবার ফিরে আসবো মেয়েটাকে দেখতে। কিন্তু ভাইটারও অনেক ব্লাড লগবে। সেসব জোগাড় করতে করতেই অনেক দেরি হয়ে যায়। পরেরদিন অফিস শেষে হসপিটালে গেলেও আর মেয়েটার কোন খোঁজ পাই নি। শুধু নিজের গাড়ির ব্যাক সিটে এক পাটি নূপুর পড়েছিল। সুন্দর ঝিকিমিকি রূপালী নূপুর। এতোদিন আমার কাছেই রাখা ছিল। কি জানি হঠাৎ ইচ্ছে হলো এমন একজোড়া শব্দ তোলা নূপুর তোমার পায়েও দেখি। তাই আজকের দিনটায় এটা তোমায় দিলাম।

তোমার অর্ক।'

দিবা চিঠিটা পড়া শেষ হতেই পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলো। একটা ঘোরের মাঝেই উঠে অর্ক সামনে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর অর্কের গায়ে ঠেলা দিয়ে ডাকতে শুরু করলো। কিন্তু অর্ক ততক্ষণে দিবার ডাক শোনার জগৎ ফেরিয়ে গেছে। দিবার আর্ত হাহাকার আর অর্কের কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি। দিবা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পুলিশ স্টেশনের নাম্বার ডায়াল করলো। আর একটা কথা বললো। 

-আমি আমার স্বামীকে খুন করেছি। আপনারা শীগগির আসুন। আমি বাসায় আছি। 

ছয় মাস পর।
দিবার সেলের বাইরে দুজন মহিলা গার্ড কথা বলছে। দিবার সেদিকে হুঁশ নেই। সে পায়ে ঝুমঝুম শব্দ তুলে রুমটার ভিতরেই এদিক থেকে ওদিকে পায়চারি করছে। একটু পর পর আরেক জোড়া নূপুর বুকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে। পড়নে জরাজীর্ণ একটা ধূলিমাখা শাড়ি। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে জট পাকানো। আর চোখে উদ্ভ্রান্তের দৃষ্টি। 

-এই মেয়েটার কেইস কি গো আপা? তিনমাস হয়ে গেল এতো শর্ট থেরাপি দেয়া হয়। কিছুতেই কিছু কাজ হয় না কেন এর?

-আরে এ তো একটা বদ্ধ উন্মাদ। স্বামীটা বিবাহ বার্ষিকীর রাতেই হার্ট এ্যাটাক করে মরে গেছে। সেই ট্রমাটা দিতে পারে নি মেয়েটা---। নিজেই পুলিশে খবর দিয়ে বলেছে সে নাকি ওকে খুন করেছে। অথচ পরে ওদের ফ্যামেলি ডাক্তার, পুলিশের ফরেনসিক সবাই রিপোর্ট দিয়েছে যে নরমাল হার্ট ব্লকেজ থেকেই মাইনর একটা এ্যাটাক হয়েছিল। মেয়েটা বাসায় থাকলে হয়তো হসপিটালে নিয়ে বা কোনভাবে বাঁচানো যেত--। কিন্তু আফসোস মেয়েটা তখন ছাদে ছিল। অনেকেই দেখেছে ওকে---।

-তাহলে যে ও বলে ও খুন করেছে?

-হয়তো নিজের অপরাধবোধ থেকেই বলে। ও সেদিন বাসায় থাকলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে থাকতো আজ। 

-কিন্তু এই দু জোড়া নূপুরের রহস্যটা কি? 

-কি জানি! সেটাই কেউ বোঝে না জানো। প্রতি পূর্ণিমাতেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। সেলের তালা না খুলেই কি করে যেন মেয়েটা ছাদে চলে যায়---। আর হাজার চেষ্টা করেও সেখানে কেউ যেতে পারে না ভোরের আগে। 

-কেমন অদ্ভুত না ব্যাপারটা? কি এই নূপুর রহস্য কে জানে! আরে! আজও তো পূর্ণিমা!

-আরে! তাই তো?

-ওকে আজ তাহলে পাহারায় রাখি? কি বলো?

-দরকার নেই। কিছু রহস্য প্রকৃতির নিজের কাছেই থাক। আমাদের এসবে নাক গলিয়ে লাভ কি? যা যেমন চলছে চলতে দাও--। ক্ষতি তো আর কারো হচ্ছে না---।

-সেটাও ঠিক বলেছ----।

রাত ১২ টা। ছাদের উপরে ফকফকা চাঁদের আলোয় আশেপাশের বড় বড় বিল্ডিলগুলো বেশ ভালো লাগছে দেখতে দিবার। তবু কিছু একটার শূন্যতা অনুভব করছে৷ এখন তার বেশভূষা একদম পরিপাটি৷ চুলগুলো আগের মতো এলোমেলো নয়, বরং বাতাসে ওর দিঘল কালো রেশমের মতো চুলগুলো উড়ছে। পড়নে আধছেঁড়া জরাজীর্ণ ধূলিমাখা শাড়ির বদলে সুন্দর টুকটুকে লাল শাড়ি। আর পায়ে রূপালী নূপুর। দিবা ছাদের চারদিকে ত্রস্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে গাল ফুলালো।

-তুমি আগের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরো না কেন? আদরও করো না একটুও--। তোমার আদর গায়ে মেখে কতদিন জোছনা দেখি না--। 

-----------------------

-অর্ক? একটু জড়িয়ে ধরো না আগের মতো? এখন আর ভালোবাসো না তুমি--। হুহ----।

-আমি আর আসবো না দিবা---।

-হি হি---। সে তো তুমি সবসময় বলো আসবা না। কিন্তু আমি জানি আসবা---। তুমি আসবা বলেই পুরোটা মাস আমি অপেক্ষায় থাকি। 

-আর আসবো না---। 

-হি হি হি। হি হি হি। আচ্ছা? না এলে আমি মরে যাবো---। হি হি। 

----------------------

-অর্ক? একটু ধরো না? তোমাকে দেখতে পাই না কেন আমি?

-দিবা---। আমি মরে গেছি। আমি ছুঁলে তোমার কষ্ট হবে----।

-তুমি তো মরে যাও নি। আমি তোমাকে মেরে ফেলেছি। তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলে না? ওই ওষুধটা তোমার পুডিংয়ে মিশিয়েছিলাম বলে রাগ করেছ আমার উপরে? আমার না তখন কি হয়েছিল---। বারবার রাত্রির লাশটা----।

-দিবা। আমি যাই। তুমি ভালো থেকো---।

-অর্ক? অর্ক? আমাকে প্লিজ নিয়ে যাও---। প্লিজ? নিয়ে যাও তোমার সাথে? এই পচা নূপুরগুলো আমার চাই না--। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই----। প্লিজ নিয়ে যাও?

-সেটা সম্ভব নয় দিবা--। আর আমার আসাটাও সম্ভব নয়--। 

-তুমি না এলে আমিও মরে যাবো-। ওরা ওই পাগলিগুলো আমাকে কতো মারে---। আর পচা পচা ডাক্তারগুলো কত কত শর্ট দেয়। আমি কতো কষ্ট পাই--। তুমি প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে? আমি কখনো দুষ্টুমি করবো না। তোমার সব কথা শুনবো--। নিয়ে চলো না? অর্ক?

-সেটা আর হয় না লাজুক লতা--। হয় না--।

-অর্ক!

অর্কর কণ্ঠস্বরটা ততক্ষণে হারিয়ে গেছে। আর প্রতিবারের মতো পরের দিন সকালে মেন্টাল হসপিটালের গার্ডরা দিবাকে আবিষ্কার করে হসপিটালের ছাদে। পড়নে টুকটুকে লাল শাড়ি৷ আর পায়ে চিকচিক করছে রূপালী নূপুর৷ অদূরেই আরেক জোড়া রূপালী নূপুর পড়ে আছে অবহেলায়৷ কি এই নূপুর রহস্য সেটা হাসপাতালের কেউ আজও জানতো পারলো না। কেউ কোনদিন জানতে পারবে কিনা কে জানে!



***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন