০১!!
____আজ তনয়া জানলো যে সে মা হতে চলেছে। কথাটা একটা মেয়ের কাছে পৃথিবীর সব চেয়ে খুশির সংবাদ। তনয়ার কাছেও তেমন। কিন্তু তনয়ার কাছে এই খবরটা খুশির খবরের সাথে সাথে সব থেকে লজ্জ্বা জনক খবরও বটে।
তনয়া অবিবাহিতা। আর একটা অবিহিতা মেয়ের মা হওয়া আমাদের সমাজে লজ্জার সর্বসীমা পেড়িয়ে যায়।
তনয়া বরাবরই ওর মায়ের কাছে কিছু লুকায় না। মায়ের কাছে কথাটা বলা মাত্র মা সজোরে তনয়ার গালে একটা চড় মেরে বলল,
_তুই এরকম কাজ করবি তা আমি কল্পনা করিনি! তোর সাথে তো আয়াতের বিয়ে ঠিক হয়েই আছে, তাহলে কেন এরকম করলি বল? নিজের উপর একটু নিয়ন্ত্রন রাখতে পারলি না!
_মা আমার সাথে আয়াতের বিয়ে আরো ছয় মাস আগেই হয়ে গেছে। কিন্তু তোমরা কেউ জানো না।
_কী?
_ হ্যাঁ মা ছয় মাস আগে কাজি অফিসে গিয়ে আমাদের বিয়ে হয়। আর সাক্ষী হিসাবে আমার বান্ধবী অনু আর আয়াতের বন্ধু ইমরান ছিলো।
মা আমি অন্যায় করেছি কিন্তু আমার বাচ্চাটা অবৈধ নয়। আমরা ইসলামের পূর্ন রীতি অনুসারে বিয়ে করেছি। হ্যাঁ তোমাদের না জানিয়ে চূড়ান্ত অন্যায় করেছি। অন্যায় নয় বরং পাপ করেছি। কিন্তু মা ভুল তো করে ফেলেছি এখন সেটা তো শুধরাতে পারবো না। কিন্তু মা আমার সন্তান পাপ নয়।
_তোর সন্তান পাপ নয়, সেটা তুই জানিস, আমি নাহয় তোর কথা বিশ্বাস করলাম, কিন্তু সমাজের মানুষকে কিভাবে বিশ্বাস করাবি? আর আয়াত! ও যদি বাচ্চাটাকে অস্বীকার করে! তখন কী করবি? তুই কি আয়াতকে এ বিষয়ে বলেছিস?
_ না মা। আমার খুব ভয় লাগছিলো। তাই তোমার কাছে আগে বললাম।
_ এসব কথা মেয়েরা সবার আগে তার স্বামীকে জানায় আর তুই তা না করে----। এখনি আয়াতকে ফোন করে সব খুলে বল। আর আমি তোর বাবাকে বলে আয়াতের পরিবারের সবার সাথে কথা বলে বিয়ের ডেট যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব পাকাপাকি করছি।
এই বলে তনয়ার রুম থেকে চলে গেলেন।
তনয়া ফোনটা নিয়ে ভয়ে ভয়ে আয়াতকে ফোন করলো। রিং হচ্ছে কিন্তু কলটা রিসিভ করলো না। আবার দিলো পর পর কয়েকবার দিলো কিন্তু রিং হয়েই যাচ্ছে আয়াত ফোনটা ধরছে না। এদিকে ভয়ে তনয়ার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে কলিজাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। ঢক ঢক করে এক জগ পানি খেয়ে ফেললো। আয়াত নাতো ফোন রিসিভ করছে আর নাতো ব্যাক করছে। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। সময় যত যাচ্ছে টেনশন তত পরিমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার কিছুক্ষণ পর থেকে আয়াতের ফোনটা ফোন বন্ধ।
তনয়ার মাথাটা ঘুরছে। চোখেদুটো যেনো ঝাপসা হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতাটা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন তনয়ার চোখটা সোজা দেয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে গেলো। প্রায় চার ঘন্টা হয়ে গেছে। হাত দিয়ে বিছানার পাশে ফোনটা খুঁজছে। হঠাৎ মনে হলো কেউ তনয়ার মাথার কাছে বসে ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছে
মাথার পাশে তাকাতেই দেখলো আয়াত তনয়ার দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আয়াতকে দেখে যেনো তনয়া নিজের প্রাণ ফিরে পেলো। কিন্তু কিছু বলতে পারছিলো না। শুধু আয়াতের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে ছিলো।
আয়াত তনয়ার হাত ধরে উঠতে সাহায্য করতে করতে বলল,
_উঠে বসো।
আয়াত তনায়াকে বিছানায় বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে তনয়ার খুব কাছে গেলো তারপর তনয়ার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
_ এ বুকে কী কোন ছলনার শব্দ শুনতে পাও?
তনয়া আয়াতের বুকে মাথা রেখে তখনো কাঁদছে।
আয়াত তনয়ার চোখের জল মুছে দিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল,
_ হেই বিউটিফুল তুমি কী ভাবছো খবরটা শোনার পর আমিও অন্য ছেলেদের মতো তোমায় একা অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে যাবো!
তনয়া খুব ধীরে করে উত্তর দিলো,
_হু
আয়াত তনয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
_বোকা মেয়ে! এও কী সম্ভব!
_ তাহলে ফোন রিসিভ করছিলে না কেন?
_ তার জন্য সরি। আসলে তখন জরুরি মিটিং চলছিলো। আর ফোনটা সাইলেন্ট ছিলো । তাছাড়া ফোনে চার্জও ছিলো না। তাই হয়তো রিং হতে হতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। মিটিং শেষে ফোন চার্জ করে যখন অন করলাম তখন তোমার অনেক গুলো মিসকল দেখে কল দিখলাম। তোমার মা ই ফোনটা রিসিভ করে তিনি বলেন তুমি অসুস্থ। দেরি না করে সোজা তোমাদের বাসায় আসলাম। আন্টির কাছ থেকে সব শুনলাম। গত দের ঘন্টা ধরে তোমার পাশে বসে আছি। দেখেন অফিস ড্রেসই আছি।
তনয়া খানিকটা দুষ্টুমি করে বলল,
_এ জন্যই তোমার গা থেকে ঘামের গন্ধ আসছে। ছিহ।
আয়াত তনয়াকে আরো জোরে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে বলল,
_ এখন গন্ধ আসছে?
_ ছাড়ো। মা এসে পড়বে।
_ তো! আমি না আপনার বিয়ে করা স্বামী আর আপনি আমার বৌ। কয়েক দিন পর আবার বিয়ে করবো। দু দু বার যাকে বিয়ে করবো তাকে জড়িয়ে ধরলে কার বাপের কী?
_ হয়েছে আর ভালোবাসা দেখাতে হবে না। সব দোষ তোমার ?
_আমি কী করলাম?
_বিয়ের আগে তুমিই বলেছিলে যে যতদিন পারিবারিক ভাবে বিয়ে হবে না ততদিন আমরা একে অপরের কাছে আসবো না। কিন্তু___
_ হ্যাঁ কিন্তু সেদিন কী যে হয়েছিলো আমার বুঝতেই পারতেছিলাম না। দেখো আমরা ভুল করেছি কিন্তু পাপ না। কারন আমারা শরীয়াত মোতাবেক স্বামী-স্ত্রী । হ্যাঁ আমাদের বিয়ের কথা কয়েকজন লোক ছাড়া কেউ জানে না। কিন্তু তবুও তো আমরা স্বামী স্ত্রী।
_ হুমম সবতো বুঝলাম কিন্তু এখন কী করবা?
_ তুমি একদম চিন্তা করো না। এ মাসের মধ্যেই আমারা বিয়ে করে নিবো। বাবা মাকে আমি বুঝিয়ে বলবো।
_ তুমি কী জানো না ইসলামে গর্ভবতী মেয়েদের বিয়ে করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
_ হ্যাঁ জানি। তবে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানিয়ে তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো। এতে কারো কোন বাজে কথা বলার সাহস হবে না।
_ কিন্তু তোমার বাবা-মা, পরিবারকে কী করে রাজি করাবে?
_ সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আর এসময় টেনশন নেয়া মা ও বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। আর আমি আমার দুই রাজকুমারীর কারোর ক্ষতি সহ্য করবো না।
_ দুই রাজকুমারী? মানে?
_ হ্যা। যে আসছে সে আমার লিটেল প্রিন্সেস আর তুমি আমার বিগ প্রিন্সেস।
_ প্রিন্সেস না হয়ে প্রিন্সওতো হতে পারে?
_ তা দেখা যাবে?
_ জানো, তুমি যখন আমার ফোনটা রিসিভ করছিলে না। তখন মনে হচ্ছিল প্রাণ বুঝি বেরিয়ে------
আয়াত তনয়ার মুখে হাত দিয়ে বলল,
_ খবরদার এমন কথা কখনো বলবে না। হেই বিউটিফুল তোমার কিছু হলে তোমার আয়াতটাকে কে সামলাবে? (আয়াত কিছুটা কান্না করে দিলো)
_ জানো আয়াত মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তোমার মত ছিছকাঁদুনে ছেলেকে আমি কিভাবে ভালোবাসলাম? পাগল তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাবো? তোমাকে আগামী সাত জন্মের জন্য আমি বুকিং করে রেখেছি।
_ তার মানে সাত জন্ম পর্যন্ত আমি অন্য কোন মেয়ের সাথে চান্স মারতে পারবো না!
_ খুন করে ফেলবো তোমাকে!
_ তোমার ভালোবাসায় তো এমনিতেই খুন হয়ে আছি। আবার খুন করার কী দরকার?
_ মাঝে মাঝে তোমার উপর আমার খুব সন্দেহ হয়!
_ কেন?
_ তুমি কি সত্যিই আমাকে এতটা ভালোবাসো নাকি অন্যকিছু।
_ বিশ্বাস করো না আমায়?
_ নিজের থেকে বেশি।
_ তনয়া আমাকে একটা কথা বলো?
_ হ্যাঁ বলো।
_ মেয়েদের প্রেগনেন্সির খবর সবার আগে তার বরকে জানায় তুমি আমাকে না জানিয়ে তোমার মাকে কেন জানালে? কী ভেবেছিলে আমি তোমায় ধোকা দিবো নাকি তোমার কথা বিশ্বাস করবো না?
_ আসলে আয়াত তখন রেজাল্ট পজিটিভ দেখে এতটা ভয় পেয়েছিলাম যে মা ছাড়া কারো কথা মাথায় আসে নাই।
_ বোকা মেয়ে। তুমি না এই আয়াতের হৃদয়। আর কেউ কি হৃদয় ছাড়া বাঁচতে পারে?
_ সরি। আসলে তখন মাথাটা কাজ করতে ছিলো না।
_ আমি জানি। আমিও সরি।
_ কেন?
_ সেদিন আমি ভুল না করলে আজ তোমাকে এতটা নাজেহাল হতে হতো না। আমি সেদিন নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলে, আজ হয়তো এমন ঘটনা ঘটতো না। মা তোমাকে একটা চড় মারছে?
_ তোমাকে মা বলছে?
_ নাহ। তোমার গালে চড়ের দাগগুলো বলে দিচ্ছে। খুব ব্যাথা করছে তাই না?
আয়াত তনয়ার কালে গভীর ভালোবাসায় চুম্বন এঁকে বলল,
_ এখন ব্যথা চলে যাবে।
_ এটায় কী ব্যথার ঔষধ!
_হ্যাঁ।
_ পাগল।
_ পাগলের বৌ।
দুজনেই হাসিতে যোগ দিলো সুন্দর কিছু মুহূর্ত।
আয়াত তনয়ার হাত ধরে বলল,
_ এখন আমাকে বাড়ি যেতে হবে। বাবা মাকে বলে বিয়ের ডেট এ মাসের মধ্যে ঠিক করতে হবে। সব কাজ জলদি গোছাতে হবে। অনেক কাজ আছে।
_ আয়াত শোনো
_ হ্যাঁ বলো।
_ পাঁচ মিনিট বসো আমি আসতেছি।
_ তোমার উঠার কী দরকার? আমাকে বলো কী লাগবে?
_ চুপ করে বসো তো।
কিছুক্ষণ পর তনয়া খাবার নিয়ে আসলো। তা দেখে আয়াত বলল,
_ এগুলো দিয়ে কি হবে?
_ অফিস থেকে সোজা এখানে আসছো তারমানে এখনো কিছুই খাওনি। এগুলো খাবে তারপর উঠবে।
_ ঠিক আছে তবে খাইয়ে দিতে হবে।
তনয়া আর আয়াত একে অপরকে খাইয়ে দিলো। তারপর আয়াত চলে গেলো যাবার আগে তনয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা ভালোবাসার চিন্হ একে দিয়ে গেলো। আর বলল,
_ কাল তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে!
পরের দিন সকাল গড়িয়ে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল কিন্তু আয়াতের কোনো ফোন আসলো না। সন্ধ্যা বেলা শুধু একটা মেসেস আসলো।
মেসেসটা ছিলো,
"তনয়া তোমার কাছ থেকে যা পাবার তা আমি পেয়ে গেছি। এখন নাতো তোমাকে চাই না তোমার বাচ্চাকে।"
গুড বাই
তারপর থেকে আয়াতের ফোন বন্ধ।
মেসেসটা পড়ে তনয়া যেনো পাথর হয়ে গেলো। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
_তবে কী সব মিথ্যা। এতদিন থেকে কাল পর্যন্ত যা বলেছিলো প্রত্যেকটা কথা প্রত্যেকটা অনুভূতি সব মিথ্যা ছিলো?
০২!!
•••••তনয়া ভাবছে একটা মানুষ কী করে এতটা নিখুদ অভিনয় করতে পারে! এও কী সম্ভব! নাহ আমার আয়াত এমন করতে পারে না? আমি ওর নিজের মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত বিশ্বাস করবো না। তনয়া ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
_ মা আমি একটু বের হচ্ছি?
_ এই অসুস্থ অবস্থায় সন্ধ্যার সময় কোথায় যাচ্ছিস?
_ সত্যিটা জানতে?
_ কিসের সত্যি।
তনয়া ওর মাকে আয়াতের মেসেজটা দেখালো। ওর মাও যেনো হঠাৎ করে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। তনয়ার মা তনয়ার হাত ধরে বললেন,
_ এই সন্ধ্যা বেলা একা যেতে হবে না। আমিও তোর সাথে যাবো।
_ মা তুমি?
_ চুপ একদম চুপ। আমার মেয়ে বিপদে পড়ছে আর আমি তাকে এভাবে একা ছেড়ে দিবো। চল-----
তনয়া আর ওর মা মিলে আয়াতদের বাসায় গেলো। আয়াতের মা তাদের দেখে খুব খুশি হলো সাথে সাথে অবাকও হলো। তনয়া আয়াতের মা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
_ আন্টি আয়াত কোথায়?
আয়াতের মা তনয়ার গালে হাত দিয়ে বললেন,
_আন্টি কিরে? মা বলতে পারিস না! আগে তো ভাবতাম তোদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। গত কাল রাতে আয়াত বললো তোরা নাকি অনেকদিন আগেই বিয়ে করে নিয়েছিস। প্রথমে খুব রাগ হচ্ছিল তোদের দুজনার উপর। কিন্তু যখন শুনলাম আমাদের ঘরে নতুন অতীথি আসছে তখন আর রাগ করে থাকতে পারলাম আমি আর আয়াতের বাবা।
আয়াতের মায়ের কথা শুনে তনয়া আরো বেশি দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেলো। তারপর আয়াতের মাকে ওর ফোনের মেসেজটা দেখিয়ে বলল____
_ আয়াত কোথায়?
আয়াতের মাও মেসেসটা দেখে অনেক অবাক হলো। তারপর কিছু একটা ভেবে হেসে দিয়ে বলল,
| বোকা মেয়ে দেখ ভয় পেয়ে নিজের কি হাল করেছে? আয় আমার সাথে এদিকে আয়!
তনয়াকে আয়াতের মা আয়াতের রুমে নিয়ে গেলো।
তনয়া রুমের দরজা খুলে তো অবাক! পুরো রুমটায় বাচ্চাদের খেলনা দিয়ে ভর্তি করা। সুন্দর করে সাজানো রুমটা। মনে হয় কোন বাচ্চার জন্য খুব যত্ন করে সাজানো হয়েছে।
আয়াতের মা তনয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
_গতকাল রাতে আর আজ সকালে এই সব জিনিস কিনেছে আয়াত। আমাকে বলেছে মা আমার জীবনে সব চেয়ে প্রিয় মানুষটা কিছুদিন পর আমার ঘরে আসবে আর তার সাথে আসবে ছোট্ট সোনা। তাদের জন্য ঘরটাকে তো সুন্দর করে গোছাতে হবে।
আর দু সপ্তাহ পর তোমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করেছি আমরা। আয়াত সেটা জানানোর জন্যই তো তোমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল।
তনয়া কেমন যেনো সব ঘোলাটে লাগছে।
_ তাহলে মা আয়াত এমন মেসেজ কেন দিলো?
_ মনে হয় তোর সাথে মজা করছে।
_ কিন্তু ফোনটা অফ কেন?
_ আচ্ছা চিন্তা করিস না আমি দেখছি।
আয়াতের মা অনুকে ( অনু আয়াতের ছোট বোন, সাথে তনয়ার খুব ভালো বান্ধবী) বললো আয়াতকে ফোন দে তো।
অনু ফোনের পর পর ফোন দিতেছে। কিন্তু ফোন বন্ধ। পরিচিত বন্ধু বান্ধব অফিসে ফোন করলো কিন্তু কোথাও আয়াত নাই। এবার ঘরের সবার খুব টেনশন হচ্ছে। তনয়া রাতে আয়াদের বাড়িই থাকলো কিন্তু ওর মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।
সারারাত তনয়া আয়াতের রুমে ওর আর আয়াতের লাগানো ছবির দিকে তাকিয়ে কান্না করলো। মনে হাজারো প্রশ্ন? কিন্তু শত প্রশ্নের একটাই উত্তর আসতেছে যে আয়াত আমাকে ধোকা দিতে পারে না! কিন্তু মেসেজে লেখা প্রত্যেকটা কথা মাথার মধ্যে পোকার মত কিলবিল করছে।
নাহ তনয়া আর নিতে পারছে না। মনে হয় মাথাটা ছিড়ে যাবে। এদিকে পেটের ভেতর ছোট্ট একটা ভ্রুন যা হয়তো এখনো আকৃতি ধারন করেনি কিন্তু তার জীবন আছে। তার চলাচল তার অস্তিত্ব তনয়া প্রতি মূহুর্তে নিজের ভেতর অনুভব করছে। তার সাথে অনুভব করছে আয়াতের অস্তিত্বকেও। কারণ ভেতরে যে আছে সে যে আয়াতেরই অংশ।
সেদিন রাতে বাড়ির কেউই ঘুমায় নাই। খুব সকালে উঠে সোজা পুলিশ স্টেশনে গেলো।
অফিসার বললেন,
_ ২৪ ঘন্টা আগে আমরা রিপোর্ট নেই না।
তারপর কিছু প্রশ্ন করলো তারপর তনয়াকে দেয়া মেসেজটার কথা জানার পর বলল,
তাহলে আর কি? আপনার ছেলে পালিয়েছে? তাই ফোন অফ রেখেছে। ছোট বাচ্চাতো না। দেখুন আবার কার সাথে প্রেমলীলা শুরু করছে,
আয়াতের বাবা অনেকটা রাগ করে বলল,
_জাস্ট শাট আপ অফিসার। রিপোর্ট নিতে বলেছি রিপোর্ট নিন। বাজে কথা বলবেন না।
অফিসার চোখ রাঙিয়ে বলল,
_ রিপোর্ট নিয়ে নিচ্ছি কিন্তু ২৪ ঘন্টা না গেলে কোন তদন্ত শুরু করবো না।
থানায় রিপোর্ট করিয়ে তনয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারা বাড়ি গেলেন।
তনয়া বাড়ি গিয়ে খুব ভেঙে পড়লো। মনে হচ্ছে কোন গোলক ধাঁধায় পরে গেছে। কোনটা মিথ্যা কোনটা সত্যি তার মধ্যে কেন যেনো পার্থক্য করতে পারছে না। যদি আয়াতের মেসেজটা সত্যি হয় তাহলে বাড়িতে কেন বললো? আর বাড়িতে বললে মেসেজটা কেন পাঠালো?
খুব কান্না করছে তনয়া। চোখের সামনে যেনো আয়াতের সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো ভাসছে।
আয়াতের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো কলেজের একটা অনুষ্ঠানে। অনুর সাথে আয়াত কলেজে এসেছিলো। অনুই আয়াতের সাথে তনয়ার পরিচয় করিয়ে দেয়।
অনুঃ তনয়া এই হচ্ছে আমার ভাই আয়াত।
আয়াতঃ হাই!
তনয়াঃ হ্যালো!
আয়াতঃ বিউটিফুল!
তনয়াঃ হোয়াট?
আয়াতঃ আই মিন নাইস টু মিট ইউ।
তনয়াঃ ধন্যবাদ।
অনুঃ তনয়া তুই একটু ভাইয়ার সাথে থাক আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
তনয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনু চলে গেলো।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। নীরবতা ভেঙে আয়াত বললো-----
আয়াতঃ তো কোন ইয়ারে পড়েন? কোন বিষয়ে?
তনয়াঃ র্থাড ইয়ার ফাইনাল। হিসাববিজ্ঞান বিভাগ। আর আপনি?
আয়াতঃ গুড। পড়াশুনা শেষ করে কিছুদিন হলো বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করছি।
তনয়াঃ গুড।
আয়াতঃ আইসক্রিম খাবেন?
তনয়াঃ না না ঠিক আছে?
আয়াতঃ দেখুন মিথ্যা বলবেন না। মেয়েরা আইসক্রিম কখনো না বলে না।
তনয়াঃ মুচকি হেসে। ওকে।
দুজন আইসক্রিম খাচ্ছে এর মধ্যে অনু এসে দুজনার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। অনুষ্ঠানে থাকা কালীন পুরোটা সময় আয়াত বারবার শুধু তনয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তনয়ার চোখে চোখ পড়লেই আবার চোখ নামিয়ে নিতো।
রাতে আয়াত অনুর রুমে গিয়ে বললো।
_ বোন আইসক্রিম খাবি?
অনু ভ্রু কুচকে বলল,
_মাখন লাগান লাগবে না। কী চাই বল?
_ তনয়ার কি কোন বয়ফ্রেন্ড আছে?
_ না। প্রচন্ড ভালো মেয়ে তনয়া। দেখতে যেমন সুন্দর মনটা তার থেকে বেশি সুন্দর। প্রেম নামক ঝামেলায় জড়ানোর ইচ্ছা ওর নেই। বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। ওর বাবা মা যেখানে বলবে সেখানেই বিয়ে করবে। আর যদি ফোন নাম্বার বা ফেইসবুক আইডি চাস তাহলে কালকে শপিং এ নিয়ে যেতে হবে।
এক শ্বাসে কথা গুলো বলে দম ফেললো অনু।
_ তুই কিভাবে বুঝলি?
_ আমি তোর মত গাধা না। কলেজে থাকাকালীন সারাটা সময় তুই শুধু তনয়ার দিকেই উল্লুকের মত তাকিয়ে ছিলি। তোর লজ্জা লাগে না।
_ কিসের জন্য?
_তোর ছোট বোনের বান্ধবী। সেও তো ছোট বোনের মতই। তার দিকে নজর দেয়া পাপ!
আয়াত অনুকে ধমক দিয়ে বলল,
_ চুপ কর। ও আমার কোন জন্মের বোন রে? আর খবরদার তনয়াকে নিষেধ করে দিবি ও যেনো আমাকে কখনো ভাইয়া বলে না ডাকে। আজ যখন ভাইয়া বলে ডাকছে মনে হয়েছে যেনো কলিজায় গিয়ে তীর মারছে। এখন নাম্বারটা দে বোন বা ফেইসবুক আইডি!
_ আর আমার শপিং
_ ওকে ডান।
তারপর অনুর কাছ থেকে ফোন নাম্বারতো নেয় কিন্তু কল দেবার সাহস আয়াতের হয় না।
প্রায় তনয়াদের কলেজের সামনে যেতো। একদিন সময় সুযোগ বুঝে তনয়াকে প্রপোজ করলো। কিন্তু তনয়া বললেছিলো, আপনি যে আমাকে সত্যি ভালোবাসেন তার কী প্রমাণ আছে? পরের দিন বিকালে আয়াত তার পুরো পরিবারকে নিয়ে তনয়াদের বাসায় যায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তনয়ার বাবা বলে কয়েকমাস পর তনয়ারে ফাইনাল পরীক্ষা। বিয়েটা যদি পরীক্ষার পর হতো তাহলে ভালো হতো।
তারাও রাজি হয়ে যায়। ওদের বিয়ে তো ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তনয়া আয়াতের সাথে ঠিক ভাবে কথা বলে না। সবসময় এভোয়েট করে। আয়াতের এগুলোতে খুব কষ্ট লাগে কিন্তু কিছু বলেনা। কিন্তু এভাবে থাকতেও পারে না। তাই অনুকে দিয়ে তনায়াকে নিজের বাসায় আনলো। সেদিন আয়াতের বাবা মা বাড়ি ছিলো না। আর অনুও দুজনের কথা ভেবে বাইরে চলে যায়।
আয়াত এসে তনয়ার পাশে বসে আর তনয়া আরেকটু দূরে সরে যায়।
_ তনয়া তুমি কি এ বিয়েতে খুশি না?
_ আমি কি সেটা বলেছি?
_ তাহলে তুমি আমাকে এভাবে এভোয়েট কেন করো?
_ তনয়া নিশ্চুপ
_ কি হলো চুপ করে আছো যে, প্লিজ কিছু বলো?
_ আমি বাড়ি যাবো!
_ ঠিক আছে তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও?
তনয়া উঠে চলে যেতে চাইলে আয়াত তনয়ার হাতটা ধরে টান দিয়ে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসতেই তনয়া বলল,
_ কী হচ্ছে ছাড়ুন।
_ এই মেয়ে আমি কী তোমার সাথে কোন খারাপ কিছু করেছি? নাকি তোমাকে খারাপ কোন প্রস্তাব দিয়েছি?
তোমাকে সারা জীবন ভালোবাসতে চেয়েছি এটা কূ আমার অন্যায়?
_ আয়াত ছাড়ুন আমার হাতে লাগছে!
আয়াত তনায়াকে ছেড়ে দিয়ে সরি বলে নিজের রুমে চলে গেলো।
তনয়াও বাড়ি যাবার জন্য বাইরে নামতেই দেখলো ওর মোবাইলটা ভেতরে ফেলে এসেছে।
তাই আবার ভেতরে গেলো। হঠাৎ আয়াতের রুম থেকে কাচ ভাঙার শব্দ এলো। তনয়া ধিমী পায়ে আয়াতের রুমের সামনে গিয়ে আস্তে করে রেজাটা খুলে দেখে আয়াত হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে আর নিচে কিছু কাচের গ্লাসের ভাঙা টুকরো।
আর আয়াত ওর টেবিলে রাখা তনয়ার ছবির দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মত কাঁদছে। তনয়া জানে খুব বেশি কষ্ট না পেলে ছেলেরা কাঁদে না।
তনয়া আয়াতের রুমে ঢুকে আয়াতের হাতটা ধরে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। আয়াত শুধু তনয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
তনয়া কিছুটা শক্ত গলায় বলল,
_রাগটা কার ওপর দেখালেন?
_ নিজের ওপর।
_ কেন?
_ এ হাতটা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। তাই।
_ আপনি জানেন আমি একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসি।
কথাটা শুনে আয়াতের খুব কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও জিজ্ঞেস করলো,
_ কাকে?
_ জানেন এত দিন জানতাম সে আমাকে খু্ব ভালোবাসে। তাই তার ভালোবাসার সত্যতা যাচাই করতে এতদিন তাকে খুব এভোয়েট করেছি। খুব কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আজ জানলাম সে আমাকে একটুও ভালোবাসে না।
_ মানে?
_ যদি সে আমাকে ভালোবাসতো তাহলে নিজের হাত কেটে এভাবে আমাকে কষ্ট দিতে পারতো না!
আয়াত কিছু বলছে না শুধু তনয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
তনয়া আয়াতের কাটা হাতটায় আলতো করে একটা চুমো দেয়। তারপর বলল,
_ পাগল। আমার চোখ দেখে বোঝো না তোমাকে কতটা ভালোবাসি।
আয়াত নিজের বাহুডোরে তনয়াকে নিয়ে বলল,
_খুব ভালোবাসি তোমায়।
হঠাৎ তনয়ার ফোনটা বেজে উঠায় তনয়ার ভাবনায় ছেদ পরে।
ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিন এর দিকে তাকাতেই বুকটা কেঁপে ওঠে তনয়ার। কারন ফোনটা আয়াত করেছে।
তনয়া তাড়াহুড়ো করে ফোনটা তুললো।
তনয়াঃ হ্য হ্যা হ্য হ্যালো আয়াত ?
০৩!!
•••••তনয়া তাড়াহুড়ো করে ফোনটা রিসিভ করে বলল,
_হ্যালো আয়াত!
_ হ্যা বলো তনয়া।
_ তুমি কোথায় আয়াত? বাড়ির সবাই তোমাকে নিয়ে কতটা টেনশনে আছে। প্লিজ আয়াত চলে আসো।
_ তুমি কি কিছু বুঝো না নাকি? আমি তোমার জন্য বাড়ি আসছি না! আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি আর তাকে নিয়েই থাকতে চাই।
_ আয়াত একদম মিথ্যা বলবা না?
_আজব তোমার সাথে আমি মিথ্যা কেন বলবো? আজব!
_ কারণ আমি আমার আয়াতকে চিনি!
_ তাহলে তুমি ভুল চিনেছো! আমি বাবা মাকে বলে দিয়েছি যে তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর আমি শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কবে ফিরবো তা জানিনা। রাখছি!
_ আয়াত শোনো?
_ শোন তনয়া! নিজের খেয়াল রেখো। ভালো থেকো!
এই বলে আয়াত ফোনটা কেটে দিলো।
এক দৃষ্টিতে তনয়া ফোটার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর ওর কানে শুধু একটা কথাই বাজছে ভালো থেকো। নিজের কষ্টটা আটকাতে না পেরে জোড়ে একটা চিৎকার দিলো। তনয়ার চিৎকার শুনে ওর বাবা মা তাড়াতাড়ি ওর কাছে এলো। ওর মা তনয়াকে ধরে বলল,
_ কি হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন? বল মা?
_ মা আমার সব শেষ হয়ে গেছে । ও আমায় ভালো থাকতে বলেছে। কিভাবে ভালো থাকবো আমি মা? কিভাবে?
আর কোন কথা বলছে না তনয়া। শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। ওর বাবা মাও কান্না করছে। কোন বাবা মাই নিজের মেয়ের এমন অবস্থা দেখতে পারবে না। সারাটা দিন সারা রাত তনয়া নিজের রুমে বসে কান্না করলো। শত চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারছে না। মনের মাঝে কষ্টটা এমন ভাবে আটকে গেছে যে কিছু ভাবার মত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
পরের দিন সকালবেলা আয়াতের বাবা-মা এলো।
তনয়ার মা তাদের অনেক কথা শুনালেন। তনয়ার বাবা তনয়ার মাকে চুপ করতে বললেন। আর বললেন---
_ এতে তাদের কোন দোষ নাই। তারা তো আয়াতকে এসব করতে বলেনি!
তনয়ার মা কিছুটা হতাস হয়ে বললেন,
_ সেটা আমি বুঝি? কিন্তু আমাদের মেয়ের জীবনটা তো নষ্ট হয়ে গেলো। তনয়ার এখন কি হবে?
আয়াতের বাবা তাকে ভরসা দিয়ে বলল,
_দেখুন সে বিষয়েই আমরা কথা বলতে এসেছি! অনু তুই তনয়াকে ডেকে আনতো।
অনু তনয়ার রুমে গিয়ে দেখে তনয়া নিচে বসে বসে কান্না করছে। সরা ঘরময় শুধু আয়াতের ছবি ছড়ানো।অনু তনয়ার সামনে হাত জোড় করে বলল
_আমাকে মাফ করে দে তনয়া!
_ কেন? তুই কী করেছিস?
_ আমি যতি ভাইয়াকে কলেজে নিয়ে না যেতাম, তবে তোদের কাহীনি এতদূর পর্যন্ত গড়াতো। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আয়াত ভাইয়া আমার আয়াত ভাইয়া কোন মেয়ের সাথে এমন করেছে। যে, ভাইয়া সবসময় মেয়েদের সম্মান করতো সে এমটা করবে তা যেনো ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে!
_ নারে তোরা ভুল বুঝছিস আয়াতকে ? আমার মন এখনো এটা মানতে নারাজ যে আয়াত আমাকে ধোকা দিয়েছে!
_ তনয়া বিশ্বাস ভালো কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস ভালো না তনয়া।
_ এ বিশ্বাসেই তো সংসার চলে।
_ ভাইয়াকে বাবা বলেছে ও যেনো বাড়ির চারপাশেও না আসে। ওর মত ছেলে তার লাগবে না!
_ আমি জানি আয়াত আসবে!
_ পাগলামী করিসনা তনয়া? একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা কর?
_ পাগলামী না অনু বিশ্বাস আর ভরশা। জানিস তোর ভাইয়া কাল আমাকে শেষ কী কথা বলেছে?
_ কী?
_ নিজের খেয়াল রেখো। ভালো থেকো।
_ সেটা হয়তো এমনিতেই বলেছে।
_ জানিস আমাদের বিয়ের বয়স ছয় মাস কিন্তু রিলেশনের বয়স আট মাস। এই আট মাসে যখনই আমরা কথা বলতাম দেখা করতাম তখনই আয়াত আমাকে বলতো নিজের খেয়াল রেখো। আই লাভ ইউ। কিন্তু ভালো থেকো কথাটি কখনো বলেনি।
_ তাতে কী বুঝায় ?
_ জানিস তোর ভাইয়াকে আমি একবার বলেছিলাম ভালো থেকো। তখন ও আমার ওপর রাগ করেছিলো। যখন আমি রাগের কারণ জানতে চাইলাম তখন বললো যখন কেউ কারো থেকে অনেক দূরে যায় কিন্তু সে সবসময় তার মনের মধ্যে গেঁথে থাকে তখন বলে ভালো থেকো।
আর আমি তোমার কাছ থেকে কখনো দূরে যাবো না। আর যদি কোন কারনে যাওয়া লাগে তখন তোমায় বলবো ভালো থেকো। কারণ তখন তুমি আমার থেকে দূরে থাকবে, কিন্তু মন থেকে দূরে নয়।
তারমানে আয়াতের কোন বিপদ নয়তো কোন বিশেষ কারণে ও আমাদের কাছে আসতে পারেছে না।
_ সবটা তোর মনের ভুল ধারনা। ভাইয়ার জন্য তুই পাগল হয়ে গেছিস।
_ সে তো কবে থেকেই।
_ বাদ দে ওসব কথা। বাইরে সবাই তোকে ডাকছে। চল।
_ হুম।
তনয়া ঠিক ভাবে দাঁড়াতে পারছে না। দাঁড়াতে গিয়ে আবার দপ করে বসে পড়লো। কী করে দাড়াবে কাল থেকে ওকে যে কেউ কিছু খাওয়াতে পারেনি। তনয়ার এ অবস্থা দেখে অনু কান্না করে দিলো। অনু তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে তনয়ার জন্য কিছু খাবার আর জুস নিয়ে আসলো।
_ এগুলো আগে খেয়ে নে তারপর উঠবি।
_ নারে ইচ্ছা করছে না।
_ চুপ একদম চুপ। তনয়া তুই ভুলে যাচ্ছি যে তুই একা না। নিজের খেয়াল না রাখলেও তোর ভিতরে ছোট্ট প্রাণটা বেড়ে ওঠছে তার খেয়াল রাখতে তোকে হবে।
তুই না বললি আয়াত ভাইয়া ফিরে আসবে? সে যদি এসে তোর এ অবস্থা দেখে তাহলে তাকে তুই কী বলবি?
অনুর কথা শুনে তনয়া সামান্য কিছু খাবার খেলো। তারপর অনুর সাথে সামনের রুমে গেলো।
সেখানে ওর আর আয়াতের বাবা মা গম্ভির হয়ে বসে আছে। তনয়াকে দেখে আয়াতের মা তার নিজের পাশে বসালো। তারপর বলল,
_ দেখ মা তোর সাথে যে অন্যায় হয়েছে কিন্তু চাইলেও আমরা তার সমাধান খুঁজে বের করতে পারবো না।। এখন তুমি কী চাও বলো?
_ আয়াতের বাবা বলল, হ্যাঁ মা। আয়াত যাই বলুক তুমিই আমাদের ঘরের লক্ষি। আমাদের পুত্রবধূ। তুমি চাইলে এখন থেকে আমাদের বাসায় থাকতে পারো?
তনয়ার মা কিছুটা রেগে গিয়ে বললেন
_ তার দরকার নাই। তনয়ার প্রেগনেন্সির মাত্র ছয় সপ্তাহ চলছে। আমি ওর এবোরশন করাবো।
এবোনশন কথাটা শুনেই তনয়া চমকে উঠলো। মনে হলো ওর কলিজা কেউ টান দিয়েছে। সাথে সাথে বলল,
_ নাহ! আমি আমার বাচ্চাকে মারতে পারবো না।
_ কিন্তু তনু এ বাচ্চার কোন ভবিষ্যৎ নাই। কিন্তু তোর আছে। যে এখনো পৃথিবীতে আসে নাই। তার জন্য নিজের উজ্জল ভবিষ্যৎ টাকে এভাবে জলাঞ্জালী দিবি?
_ মা এটা সত্যি যে ও পৃথিবীতে এখনো আসে নাই। কিন্তু ওর প্রান আছে! ওর অস্তিত্ব আমি অনুভব করতে পারি। ও তো পাপ নয় মা।
_ কিন্তু------ লোকে তোর বাচ্চাকে অবৈধ বলবে? জারজ বলবে? তখন তুই তাদের কী বলবি?
_ থাক মা। সমাজের লোকে কথা এখন নাহয় থাক। সমাজ যাই বলুক। আমার বাচ্চাটা যে অবৈধ নয় তা আমি জানি। আর তোমাদের এখানে থাকলে তোমাদের যদি সমস্যা হয় তাহলে বলো আমি আয়াতের বাবার সাথে চলে যাবো। তিনিও যদি না নেন তাহলে আমি নিজের আর আমার নিজের বাচ্চার খেয়াল রাখতে পারবো। আমার কারো দরকার নেই।
_ তনয়ার বাবা বললেন, কী বলছিস এসব? তোর কোথাও যেতে হবে না। আমি জানি আমার মেয়ে কোন অন্যায় করেনি। তোর সিদ্ধান্তে আমি কখনো বাঁধা দিবো না।
_ আয়াতের বাবা বললেন, এখানে থাকলে সবাই আরো বেশি বাজে কথা বলবে তার থেকে বরং আমি ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই। সবাইকে বলবো যে আয়াতের স্ত্রী। আর আয়াত কয়েক বছরের জন্য বিদেশ গেছে।
তনয়ার বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
_ তনয়ার যা ইচ্ছা । আমি সবসময় আমার মেয়ের ইচ্ছাকে সম্মান করি।
আজ তনয়ার বিদায় । এমন মেয়ে বিদায় কেউ হয়তো জীবনে দেখেনি। মেয়ে বিদায়ে বর নেই। কনে বধূ সাজে নেই। সবার চোখে শুধু কান্না হতাশা আর সামনের দিনে কী হবে তা নিয়ে ভয়।
তনয়া আয়াতদের বাড়ি চলে আসলো। আয়াতের রুমে গিয়ে চারদিকটায় তাকিয়ে শুধু একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ছাড়লো।
কী সুন্দর করে সাজিয়েছে আয়াত রুমটাকে। বাচ্চাদের খেলনা ভর্তি রুমটায়। খেলনা গুলোতে হাত বুলিয়ে দেখছে তনয়া। আয়াতের রুমের টেবিলের উপর রাখা আয়াত আর তনয়ার ছবি। তনয়া ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলো।
ছবিটা ওদের বিয়ের। মনে পরে যাচ্ছে তনয়ার নিজের বিয়ের কথা গুলো। কোন সাজগোজ নাই। তনয়ার পড়নে বেগুনী রং এর একটা থ্রীপিচ আর আয়াত ছিলো অফিসের ড্রেসে। একটা ঘোরের মধ্যে হয়েছিলো বিয়েটা। কত সুন্দর ছিলো দিনগুলো। স্মৃতিগুলো যেনো চোখের সামনে ভাসছে।
ওদের সম্পর্ক তখন দু মাসের মত। কলেজের কিছু বাজে ছেলে তনয়াকে খুব বিরক্ত করতো। আয়াতকে বলা মাত্র আয়াত তনয়ার সাথে কলেজে গিয়ে ছেলেগুলোকে বললো-----
_ কী ছোট ভাই। ওকে বিরক্ত কেন করছেন?
একটা বাজে ছেলে বলল,
_ তাতে তোর কিরে? তোর কী বোন লাগে?
_ না বৌ লাগে। কিছুদিন পর বৌ হবে।
_তাহলে কিছুদিন পরই এখানে আসিস। যখন তোর বৌ হবে তখনই অধিকার খাটাতে আসিস? তার আগে মালটা আমাদের।
কথাটা শুনে আয়াতের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
_ আধাঘন্টা পর আসছি!
তারপর আয়াত তনয়ার হাত ধরে বলল, চলো!
_ কোথায় যাচ্ছি আমরা?
_ চলো তো তারপর বলছি?
পথে অনু আর আয়াতের বন্ধুকে ফোন করে কাজী অফিসে আসতে বললো। কিছুক্ষণের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলো। তনয়া যেনো এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। মনে হচ্ছে কোন স্বপ্ন দেখছে। তারপর আয়াত তনয়াকে নিয়ে আবার কলেজে গেলো। সেখানে গিয়ে বলল,
_ ছোট ভাই কাজী অফিস থেকে বিয়ে করে সোজা এখানে এলাম। এখন বলেন কেউ যদি আপনার বৌকে বাজে কথা বলে তখন তাকে কি করবেন?আমিও ঠিক তাই করবো!
আয়াত সাথে নিজের কয়েকটা বন্ধু নিয়ে এসেছিলো। সব গুলোকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়ে সোজা পুলিশে দিলো। ছেলে গুলো অনেক বাজে ছিলো। আর বলল,
_ বস দেখতে চকলেট বয় হলেও। এ্যাকশনের রিএ্যাকশনীকি করে দিতে হয় তা খুব ভালো করে জানি।
তনয়ার ঘোর যেনো এখনো কাটেনি।
আয়াত তনয়ার হাত ধরে বলল,
_চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দি।
গাড়িতে যাবার সময় তনয়া বলল,
_ সামান্য বিষটার জন্য আমাকে বিয়ে করার কী দরকার ছিলো?
_ এটা সামান্য বিষয়? আজকের পর থেকে কেউ তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। আর দোষটা ওদের না তোমার?
_ মানে?
_ তুমি দেখতে এত সুন্দর, যে কেউই তোমার জন্য পাগল হবে। যেমন আমি হয়েছি। আর এখন থেকে তোমাকে হারানোর ভয়টা আমার আর থাকবে না।
_ পাজি ছেলো।
অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেলো।
_তনয়া বলল,আচ্ছা আয়াত?
_ হ্যাঁ।
_ একটা কথা বলবো?
_ হ্যাঁ বলো?
_ আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে! তারমানে আমরা এখন হ্যাজবেন্ড ওয়াইফ।
_ হ্যাঁ তো?
_ তুমি আবার আমার সাথে সেরকম কিছু করবে নাতো?
আয়াত দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
_সে রকম কিছু মানে?
_ না মানে বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যা হয় আরকি!আয়াত বেশ দুষ্টুমি করে বলল,
_ কেন ইচ্ছা আছে নাকি?
তনয়া রাগ করে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
_ ঠাং ভেগে দিবো।
আয়াত জোরে হেসে বলল,
_ ম্যাডাম আপনাকে আমি সার জীবন নিজের করে রাখতে চাই। তাই যতদিননা পর্যন্ত পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়ে হয় ততদিন পর্যন্ত এরকম ওরকম সেরকম কিছু করার ইচ্ছা তো নেই। ভরশা রাখতে পারেন।
তার দুমাস পর তনয়ার পরীক্ষা শেষ হলো। কিন্তু হঠাৎ করে আয়াতের দাদি মারা যায়। যার কারনে বিয়েটাকে আরো কয়েকমাস পিছিয়ে দেয়া হয়। আর------
তনয়া তনয়া
কেউ তনয়াকে ধাক্কা দিলো। ঘোর কাটলো তনয়ার।
_ কে কে?
অনু তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
_ কতক্ষন ধরে ডাকছি কী ভাবছিস?
অনুর চোখ যায় তনয়ার হাতের ছবিটা দিকে। অনু বুঝে গেলো তনয়া ঠিক কি ভাবতে ছিলো।
তনয়া সর্বনাশ হয়ে গেছে। বাইরে চল তাড়াতাড়ি---------
০৪!!
••••তনয়া কিছুটা বিচলিত হয়ে বলল,
_কী সর্বনাশ হয়েছে অনু?
অনু তাড়াহুড়ো করেই বলল,
_বাইরে পাড়া প্রতিবেশিরা সবাই এসে নানা রকম কথা বলছে? বুঝতে পারছি না তারা এ খবর কোথা থেকে পেলো?
তনয়া রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
_এই তোর সর্বনাশ হয়েছে। এখন কয়েকদিন এসব শুনতে হবে। এমন পরিস্তিতি সামলাতে হবে। হতে পারে পরিস্থিতি এর থেকেও বাজে হতে পারে। তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নে অনু।
জানিস অনু, ভালো কথা ভালো কাজ লোকসমাজে ছড়াতে সময় লাগে খুব। কিন্তু কারো দোষ ত্রুটি বা এ ধরনের নেগেটিভ কথা বাতাসের আগে ছড়ায়। চল দেখি এরা আবার কী বলে?
অনু আর তনয়া সামনের রুমে গিয়ে দেখে কয়েকজন মহিলা সেখানে আসছে আর তাদের মুখ থেকে কথা নামক বিষ বাক্য শোনা যাচ্ছে,
কথাগুলো কিছুটা এমন,
---ছিঃ ছিঃ ভাবি আপনাদের কাছে থেকে এমনটা আশা করেনি।
আরেকজন বলল,
---ঠিক বলছেন ভাবি বিয়ে হয়নি অথচো মা হচ্ছে আর এমন মেয়েকে আবার ছেলের বৌ হিসাবে ঘরে তোলা তো দূরের কথা, এমন মেয়ের মুখ দর্শণ করাও উচিত নয়।
আয়াতের মা কিছুটা কড়া করে বললেন,
_প্রথমত ভুলটা তনয়ার না। আমার ছেলের। আর দ্বিতীয়ত ওদের বিয়ে অনেক আগেই হয়েছে তার প্রমাণও আছে। আর প্রমাণ না থাকলেও আমরা তনয়াকে মেনে নিতাম।
আমরা তনয়াকে বিশ্বাস করি। আর অন্যায়টা যেহেতু আমাদের ছেলে করেছে তো সে অন্যায়ের সমাধান করা বাবা মা হিসাবে আমাদের প্রধান কর্তব্য। আর ভাবি আপনি কোন মুখে বলছেন এমন, মেয়ের মুখ দেখাও পাপ? আরে আপনার ছেলেতো গত বছর এর থেকেও খারাপ কান্ড করলো আর আপনারা মেয়েটাকে মেনে পর্যন্ত নেননি।
---তো ছেলে মানুষ একটু আকটু দোষ করতেই পারে।
আয়াতের মা কিছুটা বিকৃত ভঙ্গিতে বললেন,
_ আপনারে ছেলে দোষ করলে সেটা দোষ না কিন্তু মেয়েটা কিছু না করেই সব দোষ তার ঘাড়ে। এসব নিচু মানসিকতা বদলান।
আর আপনারা সবাই শুনুন এটা আমাদের পারিবারিক বিষয়। আপনাদের নাক না গলালেও চলবে?
----তাহলে পরিবার সমাজের বাইরে গিয়ে বসান। এই মেয়েটি কোন পরিচয়ে আপনাদের বাড়ি থাকবে?
এবার আয়াতের বাবা বললেন,
_তনয়া আয়াতের স্ত্রী হিসাবে এখানে থাকবে। আর তাতে যদি আপনাদের সমস্যা হয় তাহলে তনয়া আমাদের মেয়ের পরিচয়ে থাকবে। আজ থেকে আমার দুই মেয়ে তনয়া আর অনু। আপনাদের আর কিছু বলার আছে?
-----কিন্তু?
আয়াতের বাবা কিছুটা শান্ত গলায় বললেন,
_দেখুন তনয়ার সাথে যেটা হয়েছে সেটা যদি আপনাদের কারো মেয়ের সাথে হতো তাহলে কী আপনারা এমনটা বলতেন?
হ্যাঁ তনয়া আর আয়াত ভুল করেছে কিন্তু পাপ না। আমি আয়াতের বাবা। আর আমি যদি তনয়াকে মেনে নিতে পারি তাহলে আপনাদের সমস্যা কোথায়?
তারপর আর কেউ কিছু বললো না। সবাই চুপচাপ চলে গেলো।
প্রায় একমাস হয়ে গেছে কিন্তু আয়াতের কোন খবর নাই। ফোনও দেয় নাই। আয়াতের বাবা মা, অনু সবাই তনয়ার খুব খেয়াল রাখছে। আয়াতের বাবা তনয়াকে কড়া করে বলে দিয়েছে লেখা পড়া যেনো ঠিক ভাবে করে।
তনয়া ভাবে এরকম একটা পরিবার পেলে যে কেউই খুব ভাগ্যবতী হবে। কিন্তু আয়াত-----?
মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন এসে ভীড় করছে? আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের পেটে হাত দেয় তনয়া। ছোট্ট একটা ভ্রুন কিভাবে দিনে দিনে বড় হচ্ছে ওর মাঝে। পেটে হাত দিয়ে নিজের অজান্তেই তনয়ার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো
_মিস ইউ আয়াত।
আজ বাইরে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। তনয়া জানালার সামনে দাড়িয়ে আছে। বাতাসে ঝাপটায় বৃষ্টির কনাগুলো ওর গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে।
তনয়া ভাবছে এরকমই এক রাতে আয়াত আমার কাছে এসেছিলো। অনেকটা কাছে। এতটা কাছে যে ওর শ্বাস প্রশ্বাসের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। মিশে গিয়েছিলো আমার নিশ্বাসে
ওদের বিয়ের বয়স তখন চার মাস বোধ হয়। সেদিন তনয়ার বাবা মা ওর নানুকে দেখতে শহরের বাইরে গিয়েছিলো। কথা ছিলো সন্ধ্যার মধ্যে আবার বাড়ি ফিরে আসবে। তাই তনয়া সালেহা (ওদের বাসায় কাজ করে) তাকেও বাসায় থাকতে বলল না।
সালেহা সন্ধ্যার আগে চলে যায়। তনয়া ভাবছে ওর বাবা মা সন্ধ্যার পরই হয়তো চলে আসবে। রাত আটটার দিকে তনয়ার বাবা ফোন করে বললো ঝড়ের কারনে শহরে ঢোকার রাস্তা বন্ধ কালকের আগে বাড়ি যেতে পারবে না। তনয়া যেনো পাশের বাসার আন্টিকে ঘরে এনে রাখে।
কিন্তু তনয়া জানে তাদের বাসার সবাই বিকালে কোথায় যেনো গেছে। কিন্তু ওর বাবার যাতে চিন্তা না করে তাই বললো ঠিক আছে টেনশন করো না।
এদিকে ঝড়ের মাত্রা বাড়ছে। তনয়া ঝড় প্রচন্ড ভয় পায়। কিছু না বুঝে অনুকে ফোন দিলো।
_ হ্যালো অনু তুই কোথায়?
_আর বলিস না কাজিনের বাসায় আসছিলাম। কিন্তু যে ঝড় তাতে কালকের আগে যেতে পারবো বলে মনে হয়না। কেন কিছু বলবি ?
_না এমনিতেই। রাখি।
এদিকে ভয়ে তনয়ার দম বন্ধ হয়ে আসতেছিলো। তাই কিছু বুঝতে না পেরে আয়াতকে ফোন দিলো।
_হ্যালো আয়াত! তুমি কোথায়?
_অফিস থেকে বাড়ি যাচ্ছি। কিন্তু তনয়া তুমি ঠিক আছো তো এভাবে কথা বলছো কেন?
_আয়াত আমি ঘরে একা বাইরে খুব ঝড় হচ্ছে আমার ভীষণ ভয় করছে।
_ কেন আঙ্কেল আন্টি আসে নি এখনো?
_বন্যার কারণে রাস্তা বন্ধ। কালকের আগে রাস্তা ক্লিয়ার হবে না। আয়াত প্লিজ তুমি একটু আসবে?
_তুমি ভয় পেয়ো না, আমি আসছি।
তনয়া ফোনটা রেখে চুপচাপ বসে রইলো। ঝড়ের কারণে বিদ্যুৎও নেই। পুরো ঘর অন্ধকার শুধু একটা চার্জার জ্বালিয়ে নিজের রুমে বসে আছে।
কিছুক্ষণ পর দরজায় কেউ নক করলো। ভয়ে তনয়ার বুক ধুকপুক করছে। ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে গিয়ে বলল,
_কে?
আয়াত উত্তর দিলো,
_তনয়া আমি?
আয়াতের কথা শুনে তনয়ার যেনো দেহে প্রাণ এলো। তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে আয়াতকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত কান্না করতে লাগলো।
আয়াত তনয়ার মাথায় হাত দিয়ে বলল,
_এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন? দেখো আমি এসে গেছি। এখন আর কোন ভয় নাই। চুপ করো। আর এখন ভেতরে চলো।
_হুমম চলো।
তনয়া ভেতরে গিয়ে দেখে আয়াত পুরো কাক ভেজা হয়ে গেছে। তা দেখে তনয়া বলল,
_একি অবস্থা তোমার দাড়াও আমি টাওয়াল নিয়ে আসছি।
তনয়া আয়াতকে টাওয়ালটা দিয়ে বলল, নাও তাড়াতাড়ি গা মুছে কাপড় পাল্টে নাও। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।
আয়াত তনয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভেংচানো করে বলল,
_ ম্যাডাম আমিতো জানতাম না যে আজকে আপনাদের বাসায় আসবো তাই এক্সট্রা কাপড় নিয়ে আসিনি।
_ দাড়াও ব্যবস্থা করছি।
তনয়া ওর বাবার একটা ড্রেস আয়াকে দিয়ে বলল,। আপাতত এটা দিয়ে ম্যানেজ করে নাও।
আয়াত ড্রেসটা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তা দেখে তনয়া বলল,
_ কী হলো দাড়িয়ে আছো যে, চেঞ্জ করে নাও।
_তুমি তাকিয়ে থাকলে কিভাবে করি? নাকি দেখার ইচ্ছা আছে?
তনয়া লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ঘুরে রান্না ঘরে দিকে চলো গেলো।
আয়াত ড্রেসটা পরে বলল,
_ তনয়া শ্বশুর আব্বাকে ডায়েটিং করতে বলবা?
_কেন?
_পান্জাবিটার মধ্যে দুটো আয়াত ফিট হতে পারবে।
তনয়া রাগি চোখে আয়াতের দিকে তাকালো।
_ওকে সরি। কিন্তু ম্যাডাম খুব খিদে পেয়েছে!
_ এইতো খাবার রেডি। চলো খাবে।
তারপর দুজন মিলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে গল্প করতে লাগলো। এদিকে বাইরে ঝড়ের মাত্রা আরো বেড়েছে। খুব জোড়ে জোড়ে বজ্রপাত হচ্ছে।
তনয়া এরকম শব্দ ভীষণ ভয় পায়। আয়াতকে সেটা বুঝতে দিচ্ছে না। কিন্তু চোখে মুখে সে ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠছে। তনয়া বলল,
_আয়াত তুমি গেস্ট রুমে শুয়ে পরো। আমি আমার রুমে আছি কিছু লাগলে বলো।
_ ঠিক আছে। কি আর করা। নিজের বিয়ে করা বৌ কাছে থাকতেও বৃষ্টির দিনের রোমান্টিক মুহূর্তে কাছে পাবো না। কপাল খারাপ থাকলে কী আর করা?
তনয়া কপোট রাগ দেখিয়ে বলল,
_বেশি কথা না বলে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পরো।
আয়াত রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো । কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো যে ওর ফোনটা খাবার টেবিলে রেখে এসেছে। তাই উঠে খাবার রুমে যাওয়ার সময় তনয়ার রুমে চোখ যায়। দেখে এখনো চার্জার জ্বলছে।
তনয়ার রুমে উকি দিয়ে দেখলো, তনয়া বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ করে কানে হাত দিয়ে রেখেছে। বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তনয়ার এমন অবস্থা দেখে আয়াত নিজের হাসি চেপে রাখতে পারলো না।
তনয়া চোখ খুলে বলল,
_ তুমি এখানে কেন? আর হাসছো কেন?
_ একটা কিউট বিউটিফুলকে দেখছি। যে কথায় কথায় মানুষকে বলে ঠ্যাং ভেঙে দিবো, নাক ফাটিয়ে দিবো, পিটাবো বলে। কিন্তু দেখো সে কেমন সামান্য ঝড়কে ভয় পায়!
_মজা নিচ্ছ?
আয়াত তনয়ার পাশে বসে বলল,
_তো কি করবো?
এর মধ্যে খুব জোরে একটা বাজ পড়লো। তনয়া ভয়ে চিৎকার দিয়ে আয়াতকে জড়িয়ে ধরলো।
আয়াতও যেনো আজ তনায়াকে নিজের থেকে দূর করতে পারছে না। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তনয়াকে।
চুম্বকের দুই মেরু যে ভাবে একে অপরকে আকর্ষন করে ঠিক তেমনি আজ ওরা একে অপরকে আর্কষন করছে।
আয়াত তনয়ার কপালে একটা ভালোবাসার চিন্হ একে দেয়। তনয়া কিছু বলতে চেয়েও যেনো বলতে পারছে না। এর মধ্যে আয়াতের গরম নিশ্বান তনয়ার ঠোঁট দুটোকে দখল করে নেয়।
দুজনেই বুঝতে পারছে যা হচ্ছে তা ঠিক না কিন্তু তবুও কেউ কাউকে আটকাতে পারছে না। ভালোবাসার এক মোহীত আবেশে হারিয়ে যায় দুজন।
সকাল বেলা তনয়া নিজেকে আয়াতের বুকে আবিষ্কার করলো। আয়াতের দিকে কতক্ষন বেঘোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু কাল রাতের কথা মনে পড়তেই তনয়া শিউরে ওঠল।
তনয়া খুব কান্না করছিলো। আয়াতের নিজেরও খুব খারাপ লাগতে ছিলো। আয়াতই তনয়াকে বলেছিলো পারিবারিক ভাবে বিয়ের আগে এমন কিছু হবে না। ভরসা রাখতে বলেছিলো ওর উপর। আর আজ ওই কিনা তনয়ার ভরসাটা ভেঙে দিলো।
আয়াত তনয়াকে শান্তনা দিয়ে বলল,
_প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও তনয়া। আমি জানিনা কাল রাতে কেন আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি? প্লিজ মাফ করে দাও।
তনয়া কাঁদছে আর ভাবেছে এতে তো আয়াতের একার দোষ নয়। আমিও তো ওকে বাঁধা দিকে পারতাম? কেন করলাম আমি এটা?
আয়াত আবার বলল,
_প্লিজ তনয়া কান্না করো না। আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।
তনয়া আয়াতের হাতদুটো ধরে বলল,
_ ভুল তোমার একার না আয়াত। আমারও তোমাকে বাঁধা দেয়া উচিৎ ছিলো। তোমার নিজেকে অপরাধী ভাবার কোন কারণ নেই। কিন্তু আজ আমরা একে অপরকে কথা দেই পারিবারিক ভাবে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমরা এমন ভুল দ্বিতীয়বার আর করবো না।
_ হুমমম।
তারপর এ ভুল ওরা আর করেনি। কিন্তু একটা কথা আছে না ভুল সবসময় ভুলই হয়। সেটা একবার হোক আর বহুবার। তার মাসুলতো গুনতেই হয়।
কিছুদিন পর থেকে তনয়া নিজের মাঝে পরিবর্তন দেখতে পায়। তার পরের ঘটনাতো সবাই জানেন। কে রাতের ভুলের ফল বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন।
তনয়া ভাবছে সেই রাতে যদি ঝড়টা না হতো তাহলে হয়তো আমার জীবনেও আজ এমন ঝড় আসতো না। এ এমন ঝড় যা বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন। বুক ভরা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দিবে না এ ঝড়।
এরকম ভাবেই দেখতে দেখতে কেটে যায় ছয় মাস।
তনয়া এখন আট মাসের গর্ভবতী। এই আট মাসে আয়াত দুবার ফোন করেছিলো ওর মায়ের কাছে। কিন্তু আয়াতের মা আয়াতের সাথে তেমন ভালোকরে কথা বলেনি।
সকাল ১০ টা
তনয়া ঘরে একা। অনু কলেজে, আয়াতের মা কিছু কেনা কাটা করতে গিয়েছেন আর আয়াতের বাবা ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে গিয়েছেন।
তখন তনয়ার ফোনে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো।
_ আসসালামু আলাইকুম কে?
_তনয়া আমি।
কন্ঠটা শুনে তনয়া যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। মুখ থেকে যেনো কথা বের হচ্ছে না। তবুও খুব কষ্ট করে বলল,
_ ফোন করতে এতটা সময় নিলে আয়াত?
আয়াত খুব ধীরে ধীরে বলল,
_তনয়া আমার সাথে একটু দেখা করবে প্লিজ।
_ তুমি বাড়ি এসো। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।
_ সেটা পারছি না তনয়া। তুমি প্লিজ এই ঠিকানায় চলে এসো।
_ ঠিক আছে?
আট মাসের প্রেগনেন্ট একটা মেয়ের হাঁটতে চলতে ঠিক কতটা কষ্ট তা শুধু সেই জানে! তবুও তনয়া কাউকে কিছু না বলে আয়াতের দেয়া ঠিকানায় চলে গেলো।
তনয়া! বলে কেউ পিছন থেকে ডাক দিলো।
তনয়া পিছনে তাকিয়ে দেখে আয়াত দাড়িয়ে আছে। কিন্তু একি?----------
০৫!!
•••আয়াতের দিকে তাকাতেই তনয়ার হৃদয়টা যেনো কেঁপে উঠলো। চোখ দুটো দিয়ে নিজের অজান্তেই টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো।
সেই হার্টথ্রব আয়াত। যাকে প্রথম দেখলে যে কোন মেয়ে প্রেমে পড়ে যেতো। দেখতে সুদর্শন সে আয়াত আর আগের মত সুন্দর নেই। আয়াতের ফর্সা মুখটা আগের থেকে অনেকটা কালো হয়ে গেছে। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। চোখের নিচে অনেক কালী জমে গেছে। আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে প্রচন্ড দুর্বল।
তনয়া আয়াতের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আয়াত তনয়ার কাছে আসল। তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
_ ক্যান আই হাগ ইউ?
তনয়া কিছু বলতে পারছে না। চুপ করে শুধু কান্না করছে। আয়াত তনয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, আই ওলায়েজ লাভ ইউ এভার এন্ড ফরএভার।
ধীরে ধীরে আয়াত তার শরীরের সব ভার যেনো তনয়ার ওপর ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু তনয়া ওকে সামলাতে পারে না। আয়াতকে কোন মতে নিচে বসায়।
আয়াতের দিকে তাকিয়ে দেখে আয়াতের মুখ নীল বর্ন ধারণ করেছে। মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছে মনে হচ্ছে কোন বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছে আয়াত।
তনয়া আয়াত বলে একটা চিৎকার দিলো। আশে পাশের লোকজনের সাহায্যে আয়াতকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। হাসপাতালে আয়াতের ডাক্তার বন্ধু ছিলো। যার ফলে চিকিৎসা করতে বেশি সময় নেয়নি।
তনয়া বাড়িতে ফোন করে সব বলল। তারাও শিঘ্রই হাসপাতালে চলে আসলো। কিছুক্ষন পর ডাক্তারা অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হলে, তনয়া তাদের জিজ্ঞেস করল,
_কী অবস্থা আয়াতের?
রাফি আয়াতের ডাক্তার বন্ধু। সে তনয়াকে অভয় দিয়ে বললেন,
_ভাবি মনে হচ্ছে আল্লাহ নিজে নিচে নেমে আয়াতকে বাঁচিয়েছে।
_ কী হয়েছিলো ওর?
_ভাবি আমি পুলিশকে ফোন দিয়েছি।
তনয়া কিছুুটা অবাক হয়ে বলল,
_পুলিশ কেন?
_ ভাবি কেউ ওকে বিষ দিয়েছিলো। আর সব থেকে হতভম্বের বিষয় কি জানেন? আয়াতের শরীরের ভিটামিন ডি এর অভাবে ওর স্কিনে আজব ধরনের রোগ ছড়িয়েছিলো। এটা সাধারনত তখন হয় যখন একটা মানুষ দীর্ঘদিন যাবত সূর্যের রশ্মি ও বাইরের হাওয়া বাতাস থেকে দূরে থাকে।
আয়াতকে দেখে মনে হয়। অনেক দিন পর্যন্ত ওকে কেউ কোন বদ্ধ রুমে আটকে রেখেছিলো। ওর শরীরের ভিটামিন ডি এর অভাব, শরীরের আয়রন এবং সাথে সাথে ভিটামিন সি এর ও অনেক ঘাটতি হয়েছে। হাত পায়ে দড়ি দিয়ে অনেকদিন বেধেঁ রাখলে যেমন দাগ হয়ে যায়, তেমন দাগ করে ঘা হয়ে গিয়েছে। মনে হয় অনেকদিন যাবত বাঁধা অবস্থায় ছিলো।
তনয়া রাফির কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো। এক রাশ বিস্ময় নিয়ে বলল,
_কী বলছেন এসব?
_ আমি যা দেখেছি তাই বলেছি। বাট চিন্তা করবেন না। কয়েকদিন রেস্ট নিলে, খোলা পরিবেশে থাকলে আর ঠিকমত খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর বাকিটা আপনাকে না দেখালে বুঝতে পারবেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে ওর জ্ঞান ফিরবে।
ডাক্তারের কথা শুনে বাড়ির সবাইও হতভম্ব হয়ে গেলো। সবার মনে হাজারো প্রশ্ন? কিন্তু যে উত্তর দিবে সে এখনো অজ্ঞান।
ডাক্তার এসে বলল, আয়াতের জ্ঞান ফিরেছে। আর শুধু তনয়ার সাথে দেখা করতে চায়।
তনয়া আয়াতের কাছে গেলো।
রাফি বলল,
_ভাবি বললাম না আপনাকে না দেখলে বুঝাতে পারবেন না। এই বলে আয়াতের গায়ের চাদরটা ফেলে হসপিটালের পরানো এপ্রোনটা খুলে তনয়াকে দেখালো।
আয়াতের শরীরের দিকে তাকিয়ে তনয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো । আয়াতের শরীরে অসংখ্য মারের দাগ। কিছু দাগ কালো হয়ে গেছে। কিছু নীল বর্ন ধারন করেছে।
তনয়া কাঁপা কাঁপা হাতে আয়াতের শরীরে স্পর্শ করতে গেলে, আয়াত তনয়ার হাতটা ধরে বলল,
_আমি ঠিক আছি তনয়া।
কিন্তু তনয়া আয়াতকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। আয়াত তনয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
_এই পাগলি আমি ঠিক আছি। প্লিজ কান্না করো না। আমি বেঁচে আছি আর তোমার কাছেই আছি। জানো তনয়া----
আয়াত কিছু বলতে যাবে এর মধ্যেই পুলিশ আয়াতের জবানবন্দি নেয়ার জন্য আয়াতের কাছে এলো।
আয়াত শুধু তনয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু হঠাৎ কাউকে দেখে আয়াতের চোখে যেনো ভয় নেমে এলো।
আয়াতের চোখের ভাষা হয়তো তনয়া বুঝতে পেরেছে। তাই আয়াতের পাশে গিয়ে বসে আয়াতের হাতে হাত রাখলো। তারপর চোখ দিয়ে ভরসা দিয়ে পরম ভালোবাসায় নিজের হাতের মুঠোয় আয়াতের হাত বন্দী করে রাখলো।
পুলিশ আয়াতকে জিজ্ঞেস করল,
_বলুন মিঃ আয়াত। এত দিন কোথায় ছিলেন আপনি? আর আপনাকে বিষ দিয়েছিলো কারা?
আয়াত লম্বা একটা দম নিয়ে বলতে লাগলো,
_প্রায় সাত মাস আগে আমি তনয়ার সাথে দেখা করতে তনয়াদের বাসায় যাচ্ছিলাম। পথে একটা মেয়ে আমার কাছে লিফট চায়। মেয়েটা বোরকা পরা ছিলো মুখ বাঁধা ছিলো। আমি মেয়েটিকে লিফট দিলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতেই মেয়েটি আমার মুখে কিছু একটা স্প্রে করে। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই,
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে একটা বদ্ধ রুমে চেয়ারের সাথে বাঁধা পেলাম। তারপর কিছু লোক আসলো আমার কাছে। তাদের কাছে জানতে চাইলাম আমাকে কেন কিডন্যাপ করা হয়েছে? কিন্তু তারা কোন জবাব দেয়নি।
তাদের মধ্যে একজন লোক বলল,
_এখন থেকে আমরা যা বলবো তাই করবি না করলে তোর মা বাবা, বোন ,আর তোর প্রেমিকা সবাইকে মেরে ফেলবো।
ওদের কাছে আমার ফ্যামিলির পুরো ডিটেইল'স ছিলো। তাই বাধ্য হয়ে ওদের কথা মতো তনয়াকে ফোন করে বলি যে আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি আর তাকে নিয়ে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আরো অনেক কিছু। এরপর কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। ওরা আমাকে প্রায় মারতো। আর ওদের কথা মতো বাড়িতে দুবার কথা বলেছিলাম।
সাত মাস ধরে ওরা আমাকে একটা রুমে আটকে রেখেছিলো। এই সাত মাস ঠিক কিভাবে কেটেছে তা শুধু আমি আর আল্লাহ জানে।
তারপর গতকাল অনেক কষ্টে পালাতে সক্ষম হই। কিন্তু ওরা আমার পিছু নেয়। তাদের থেকে কোন মতে বেঁচে বাড়ি আসি কিন্তু আমাদের বাড়ির চারপাশে ঐ লোকগুলোকে দেখলাম। তাই তনয়াকে ফোন করে দেখা করতে বললাম।
কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আরকি। ওরা আমাকে আবার ধরে ফেললো। কিন্তু এবার ওরা আমাকে একবারে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। তাই আমার শরীরে বিষাক্ত ইনজেকসন দিয়েছিলো।
কিছুটা সময় আমি ওদের সামনে মরার মত পরে থাকি। তারপর ওরা আমায় মৃত ভেবে চলে যায়। তারপর তনয়ার সাথে দেখা হয়। আর আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে গেলাম।
আয়াতের কথা শুনে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলো। একটা মানুষকে সাত মাস আটকে কেউ কিভাবে রাখতে পারে!
আয়াতের বাবা মা, অনু, তনয়া, ওর বাবা মা সবার চোখে জল। আজকের চোখের জলে তাদের মন থেকে মুছে গেলো আয়াতের উপর জমে থাকা সকল রাগ, ঘৃণা আর অভিমান।
তনয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
_আমি তোমাদের বলেছিলাম আমাদের আয়াত এমন করতে পারে না? ওর নিশ্চয় কোন বিপদ হয়েছে। কিন্তু তোমরা কেউ আমার কথা তখন বিশ্বাস করোনি।
আয়াতের বাবা তনয়ার তাকিয়ে বলল,
_হ্যাঁ মা তুই ঠিক বলেছিলি। তিনি আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাফ করে দে আয়াত। সেদিন তনয়ার কথা মেনে আমাদের তোকে খোঁজা উচিৎ ছিলো। তাহলে তোকে এতটা কষ্ট পেতে হতো না।
আয়াত বলল,
_ না বাবা এতে তোমাদের কোন দোষ নেই। আমি তোমাদের যেভাবে বলেছি তাতে তোমরা কেন সবাই আমার কথা বিশ্বা করতো।
পুলিশ আয়াতকে জিজ্ঞেস করল,
_আচ্ছা আপনি কী ঐ লোক গুলোকে চেনেন?
_একজনকে চিনি?
_ কে?
_বছর খানিকের বেশি সময় আগে, তনয়াকে ওর কলেজের কিছু ছেলে বিরক্ত করতো বলে সেসব ছেলেদের আমি পুলিশে দিয়েছিলাম তাদের লিডার।
_তনয়া বলল, কে সাদাফ?
_আয়াত বলল, হুমমম। কিন্তু ও নিজেও এসব করতো না। ওদের কেউ ফোনে এসব করতে বলতো।
_পুলিশ বলল, আপনি কী জানেন সে কে?
আয়াত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
_নাহ।
পুলিশ আয়াতের কাছ থেকে আরো কিছু বিষয় জিজ্ঞেস করে করে চলে গেলো।
রাফি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
_সবাই শুনুন আয়াতের এখন বিশ্রাম করা দরকার। আপনারা যেকোন একজন এখানে থাকুন। বাকি সবাই বাইরে যান। বেটার হয় বাড়ি চলে যান।
অনু তখন বলল,
_তনয়া থাকুক।
অনু তনয়ার দিকে তাকিয়ে দুষ্টমি একটা হাসি দিয়ে অনু চলে গেলো।
সবাই চলে যাবার পর তনয়া আয়াতের পাশে থেকে উঠে যেতে চাইলে আয়াত তনয়ার হাত ধরে ফেলে।
এত দিন পর দুজনার দেখা হলো। মনের ভিতর জমে আছে হাজারো কথা। কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নাই। কথা গুলো যেনো কোথায় হারিয়ে গেছে। লজ্জা, ভয় আর ভালোবাসার শিহরন মিলে আজ একাকার।
আয়াত তনয়ার হাত ধরে বলল,
_তনয়া! একটা কথা বলবো?
_হ্যাঁ বলো?
_can i toch your womb?
তনয়া মৃদ্যু হাসি দিয়ে আয়াতের হাতটা ধরে নিজের পেটের উপর রাখলো।
আয়াত চোখ বন্ধ করে তনয়ার ভিতর বেড়ে উঠতে থাকা ওর অংশটাকে অনুভব করছে,
_জানো তনয়া আমি ভেবেছিলাম লোকের কথায় তুমি হয়তো ওকে পৃথিবীতে আসতে দিবে না। তখন আমি নিজেও চাইতাম যে তুমি আমাকে ভুলে নিজের জীবনে সামনের দিক এগিয়ে যাও। কারল আমি যে বেঁচে ফিরবো তার আশা ছিলো না আমার।
আর তাছাড়া যখন একটা মেয়ে বিয়ের আগে প্রেগনেন্ট হয় তখন আমাদের সমাজ তার কি অবস্থা করে তা ভেবেই কষ্ট হচ্ছিল। আর আমাদের বিয়ের কথাতো কেউ জানতোই না।
আই এ্যাম সরি।
তনয়া আয়াতের হাতটা ধরে বলল,
_প্লিজ আয়াত এভাবে বলো না। তুমি কী করে ভাবলে আমি আমার আয়াতের ভালোবাসাটাকে মেরে ফেলবো! আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো তুমি কখনো আমাকে ধোকা দিতে পারো না। আর সারা পৃথিবীর লোক ওকে অবৈধ ভাবলেও আমি জানি তুমি জানো ও আমাদের ভালোবাসার পবিত্র চিন্হ।
সরি বলে তুমি আমাকে আর দোষী করো না। এই সাত মাস তুমি যে কষ্ট পেয়েছো তার তুলনায় আমার কষ্ট নগণ্য।
_হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছো ও আমাদের ভালোবাসার পবিত্র চিন্হ। কষ্ট আমরা দুজনেই সমান পেয়েছি।আমরা শরীর দুটো হলেও আত্মাতো একটাই। তাই না বিউটিফুল।
তনয়া চোখ বন্ধ করে বলল,
_কত দিন পর তোমার মুখ থেকে এই ডাকটা শুনলাম।
জানো তনয়া খুব ইচ্ছা ছিলো আমাদের বেবি তোমার ভিতরে ঠিক কিভাবে বেড়ে ওঠে তা তোমার পাশে থেকে অনুভব করবো। অনুভব করবো ওর একটু একটু করে বেড়ে ওঠা হৃদস্পন্দন।
কিন্তু নিয়তির সাথে কে বা পেরে ওঠে বলো? যে সময়টা আমার তোমার কাছে থাকা সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো সেই সময়টাই।
_ যা হয়েছে তা ভুলে যাও।
আয়াত আবার তনয়ার পেটে হাত রেখে বলল,
_ কত দিন পর আসবে প্রিন্সেস?
_ এক মাস নেই।
_ ওয়েটিং ফর ইউ বেবি।
_ আয়াত?
_ হু?
_ একটা কথা বলবো? সঠিক উত্তর দিবা?
_ তোমার সাথে কখনো মিথ্যা বলেছি?
_ আয়াত তোমাকে কে এতদিন আটকে রেখেছিলো? এমন কে যে তোমাকে এতটা ঘৃণা করে? যে তোমাকে সাত মাস এভাবে আটকে রেখেছে?
আয়াত কিছুটা তুতলিয়ে বলল,
_আমি তো বললাম জানি না।
_ আয়াত তোমার মুখ আমার থেকে কথা লুকালেও তোমার চোখদুটো তা পারবে না।
_আয়াত নিশ্চুপ
তনয়া আয়াতের হাতটা নিজের পেটের উপর চেপে ধরে বলল,
_এখন বলো তুমি তাকে চেনো না?
আয়াত ঝট করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল,
_সে আমার নয় তোমার শত্রু। তার উদ্দেশ্য আমাকে নয় তোমাকে কষ্ট দেয়া ছিলো। আর সে তাতে সফল হয়েছে।
তনয়া উৎসুক চোখে তাকিয়ে বলল,
_কে? কলেজের ছেলেগুলো।
_ না বাইরের কেউ নয়। আমাদের ঘরেরও কেউ নয়। তোমার খুব কাছের সে।
_ কে সে?
০৬!!
•••আয়াত, তনয়ার হাত ধরে বলল,
_সে আর কেউ নয়। তোমার নিজের "মা"
তনয়া "মা" কথাটি শুনে ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না। তাই আবার জিজ্ঞেস করল,
_কার নাম বললা আয়াত?
_ জানি আমার কথাটা তুমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছো না। কিন্তু এটা সত্যি যে আমাকে কিডন্যাপ তোমার মা ই করিয়েছেন।
_ আয়াত! তুমি কী বলছো এসব? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?
_ তনয়া আমি জানতাম আমার কথা তোমার বিশ্বাস হবে না। হবার কথাও না। কারণ পৃথিবীতে তুমি তোমার মাকে সব থেকে বেশি ভরসা করো। কিন্তু আমি যেটা বলছি সেটা সত্যি। আমাদের অনাগত সন্তানকে ছুঁয়ে বলছি (তনয়ার পেটে হাত রেখে) আমি সত্যি বলছি।
_দেখো আয়াত আমি জানি তুমি সত্যি বলছো। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি হয়তো ভুল দেখেছো বা জেনেছো? মা তোমার সাথে এমনটা কেন করবে?
_ সে প্রশ্নতো আমার মনেও?
_ কিন্তু তুমি কী করে বুঝলে, যে তোমাকে মা কিডনাপ করেছে?
_ তনয়া এর আগেও মানে তিন চার মাস আগে আমি একবার পালাতে সক্ষম হয়েছিলাম। পালিয়ে সোজা মেইন রোডে আসলাম। ভাবলাম কোন গাড়িতে লিফট নিয়ে শহরে চলে আসবো।
আমাকে দেখে একটা গাড়ি থামলো। গাড়ি থেকে তোমার মা বের হলেন। আমি ভাবলাম হয়তো আল্লাহ আমার উপর রহমত করেছেন।
তিনি আমার সাথে খুব ভালো করে কথা বলছিলেন। গাড়িতে উঠে কিছু দূর যাবার পর আমার মাথায় কেউ ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করলো। আমি আবার বেহুশ হয়ে গেলাম।
জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবার বন্ধ ঘরে বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। কিন্তু সামনে তাকিয়ে দেখলাম আন্টি আমার সামনে একটা চেয়ারে বসা। আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি আন্টির এমন রূপ দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর বলেছিলাম।
আয়াত: আন্টি আপনি এমন করছেন কেন? আর আমাকে কে এখানে বেঁধে রেখেছে?
আন্টি খানিক সময় হেসে বললেন,
আন্টি: আয়াত তুমি তো খুব বোকা? এখনো বুঝতে পারোনি?
আয়াত: কিন্তু আন্টি আপনি আমার সাথে এমন কেন করছেন? কী ক্ষতি করেছি আমি আপনার?
আন্টি: তুমি আমার কোন ক্ষতি করো নি? কিন্তু তোমার তনয়া করেছে।
আয়াত: মানে? ও তো আপনার মেয়ে!
আন্টি: মানেটা না হয় পরে একদিন জানলে?
আয়াত: প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন আন্টি। এখন আমার তনয়ার পাশে থাকা জরুরি।
আন্টি: সেজন্যই তো তোমাকে কিডন্যাপ করলাম! দেখো আয়াত তোমার সাথে আমার কোন শত্রুতা নাই। কিন্তু তনয়াকে আমি ঘৃণা করি! প্রচন্ড ঘৃণা! তনয়াকে কষ্ট দেবার জন্যই তোমাকে আটকে রেখেছি। কাজ শেষ হলে তোমাকে ছেড়ে দিবো। তার আগে চালাকি করলে বেঁচে ফিরতে পারবে না।
আয়াতের কথা শুনে তনয়া যেনো নিজেকে সামলাতে পারলো। মাথাটা ঘুরছে। আয়াত তনয়ার হাত ধরে। নিজেকে প্লিজ সামলাও তনয়া। এই জন্যই তোমাকে আমি বলতে চাইনি। তনয়া কান্না করতে করতে বলল,
_কিন্তু আয়াত মা কেন আমাকে ঘৃণা করে? আর তুমি কেন পুলিশকে এ ব্যাপারে বললে না?
_আমি চাইনি আমাদের পরিবারের মধ্যে পুলিশ আসুক।
_কিন্তু মা এমনটা কেন করল? তনয়া খুব কান্না করতে ছিলো। তনয়া শত চেষ্টা করেও নিজেকে যেনো সামলাতে পারছে না।
আয়াত তনয়াকে ঠিক কী দিয়ে শান্তনা দিবে তা ভেবে পাচ্ছে না। তনয়া খানিকটা ক্ষোপ প্রকাশ করে বলল,
_ আমি এখনই মাকে সবটা জিজ্ঞেস করবো? কেন সে এমন করল?
_ প্লিজ তনয়া এমনটা করো না। আর হাসপাতালে বসে নিজেদের ঘরের কথা বলা ঠিক না। হ্যাঁ জিজ্ঞেস করবে, অবশ্যই তার কাছে জানতে চাইবে আমাদের দোষ কী যে, সে এমন করল! কিন্তু প্রতিটা কাজ করার নির্দিষ্ট সময় আছে।
_ কিন্তু আয়াত যতক্ষণ না জানতে পারছি আমি শান্তি পাবো না।
_তোমাকে শান্তি দেয়ার উপায় আমার কাছে আছে!
_ কী উপায়?
আয়াত মৃদু হেসে বলল,
_আমার কাছে আসো!
_ আসলাম তো?
তনয়া কাছে আসতেই, আয়াত তনয়াকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরলো। খুব শক্ত করে।
তারপর আয়াত বলল,
_এখন শান্তি খুঁজে পেয়েছো?
_ পৃথিবীর সব থেকে বেশি সুখ তো এখানেই লুকিয়ে থাকে। জানো একটার মেয়ের জন্য পৃথিবীতে সব থেকে শান্তির এবং সুরক্ষিত জায়গা হচ্ছে তার স্বামীর বুক।
দুজনার মৃদু হাসি, পরম শান্তিময় গভীর প্রনয়ে ছেঁয়ে গেলো দুজনার পুরো সত্ত্বায়। এটা কী ভালোবাসা! নাহ ভালোবাসা না, গভীর প্রনয়ে গড়া হৃদস্পর্শী ভালোবাসা।
পাঁচদিন হয়ে গেলো।
আয়াত এখন একটু সুস্থ। কিন্তু শরীর খুব ক্লান্ত। পুরো পুরী সুস্থ হতে বেশ কিছু দিন সময় লাগবে।
এই ক'দিনে তনয়া ওর মায়ের সাথে একটা কথাও বলেনি। তাকে আয়াতের কাছে যেতে দেয়নি। তনয়া সবসময় আয়াতের পাশে থেকেছে।
আজ আয়াতকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। তনয়া আয়াতকে বলেছে বাড়ি যাবার সাথে সাথে সব কিছু ফয়সালা করবে।
আয়াতকে নিয়ে সবাই আয়াতদের বাড়ি গেলো। তনয়ার বাবা মা ও ওদের সাথে গিয়েছে।
বাড়ি গিয়ে বসার সাথে সাথে আয়াতদের বাসায় পুলিশ আসলো। তা দেখে আয়াতের বাবা বলল,
আয়াতের বাবা: কী খবর অফিসার?
অফিসার: মিঃ আয়াত যে ছেলেটার কথা বলেছিলো তাকে খুঁজে পেয়েছি। আর সে সেই লোকের নাম বলেছে যে আয়াতকে এতদিন আটকে রেখেছিলো।
আয়াতের মা প্রচন্ড রাগী গলায় বলল,
আয়াতের মা: কে সেই পাপি শয়তান?
অফিসার: মিসেস তনয়ার মা!
পুলিশের মুখ থেকে এমন কারো নাম শোনার জন্য কেউই মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলো না। সবাআ যেনো খুব বেশি অবাক হলো।
আয়াতের বাবা: কী বলছেন এসব? বেয়ান এসব কাজ কেন করবে? আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।
অফিসার: জি না। আমরা সব কিছু জেনে শুনে, তদন্ত করে তবেই এসেছি। আর আমরা সাদাফকে এ্যারেস্ট করেছি। সেই আমাদের সব কথা বলেছে।
আয়াতের বাবাঃ কিন্তু-----
তখন তনয়া বলল,
তনয়া: বাবা ওনারা সত্যি কথা বলেছেন! এসব কিছু আমার মা ই করেছে।
আয়াতের বাবা: তার মানে তুমি সব জানতে তনয়া?
তনয়া: হ্যাঁ বাবা জানতাম। আয়াত হাসপাতালে থাকা কালীন আমাকে সব বলেছে। কিন্তু আয়াতের অনুরোধে আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু আর না।
এবার তনয়ার মা মুখ খুললেন?
তনয়ার মা: কী বলছিস তনয়া? আমি কেন এমটা করবো?
তনয়া: সে প্রশ্নতো আমার মনেও মা? কেন?
তনয়ার মা: আয়াত মিথ্যা বলছে।
তনয়া: আর লুকিয়ে লাভ নেই মা। আমি সব জেনে গিয়েছি। তোমাকে মা বলতেও নিজের লজ্জা হয়। মা সে তো সন্তানের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়। কিন্তু তুমি মা হয়ে নিজের সন্তানের জীবন নষ্ট করতে চাইছো? কেন? বলো ম?
তনয়ার বাবা এতক্ষণ চুপ ছিলো কিন্তু এখন আর চুপ থাকতে পারলে না। তিনি বললেন,
তনয়ার বাবা: ও তোর নিজের মা না!
কথাটা শুনে সবাই অনেক অবাক হলো।
তনয়া: কী? (অনেক অবাক হয়ে)
তনয়ার বাবা: হ্যাঁ। তোর জন্মের পর তোর মা মারা যায়। আর তারপর আমি ওকে বিয়ে করি। আমি তোকে তোর মায়ের কথা জানাই নি কারণ আমি চাইনি তুই ওকে সৎ মা ভাবিস। আর ও যে এমন করবে তা আমিও ভাবতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা করে দে মা!
তনয়া: না বাবা তুমি কোন ভুল করোনি। কিন্তু মা তোমাকে তো আমি ছোট বেলা থেকে মা জেনেছি মেনেছি তোমার ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু কী এমন হলো যে তুমি আমার সাথে এমনটা করলে?
তনয়ার মা: কারন আমি তোকে ঘৃণা করি প্রচন্ড ঘৃণা।
তনয়া: কেন মা?
তনয়ার মা: খবরদার আমাকে একদম মা ডাকবি না। তোর কারণে আমি আজ মা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত।
তনয়া: কী বলছো এসব মা? আমি কী করেছি?
তনয়ার মা; বিয়ের পর তোকে আমি নিজের মেয়ের মতই দেখতাম, ভালোবাসতাম। কিন্তু তোর যখন তিন বছর বয়স তখন আমি পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট। তখন তুই খেলতে গিয়ে ম্যান হোলের পাশে চলে যাস।
তখন দৌড়ে তোকে বাঁচাতে গিয়ে আমি পড়ে যাই। আমার বাচ্চাটও নষ্ট হয়ে যায় আর সাথে সাথে আমি মা হবার ক্ষমাতাও হারাই।
তখন থেকেই ভেবে নিয়েছি তুই আমাকে ঠিক যে পরিমান কষ্ট দিয়েছিস, তার তিনগুন তোকে আমি ফিরিয়ে দিবো। তোকে আমি একবারে মারতে পারতাম। কিন্তু তোকে আমি রোজ রোজ কষ্ট পেয়ে তিলে তিলে মারতে চেয়েছিলাম।
আর তার সুযোগটা তুই আয়াত সামান্য একটা ভুল করে দিয়ে দিলি। ভেবেছিলাম আয়াত হয়তো তোকে কাছে পাবার পর ছেড়ে দিবে কিন্তু ও তো তোকে পাগলের মত ভালোবাসে। তাই আমি আয়াতকে অপহরন করাই।
এলাকায় তোর প্রেগনেন্সির খবর আমিই রটিয়েছিলাম। যাতে সবাই তোকে নষ্টা বলে।
আমি তোর বাচ্চাটাকে কখনো মারতে চাইনি। সবসময় চেয়েছি বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসুক আর সবাই তাকে অবৈধ বলুক। অবৈধ!
যখন লোকজন তোকে নষ্টা আর তোর বাচ্চাকে অবৈধ বলে তখন আমার খুব শান্তি লাগে। বিশ্বাস কর মনে হয় ২২ বছর অপেক্ষার ফল পাচ্ছি।
প্রথমে আয়াতকে মারতে চাইনি পরে ভাবলাম ওকে মেরে ফেললে সারা জীবন তোকে অবৈধ নামক বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। আর আমি এটাই চেয়ে ছিলাম।
তনয়া ওর মায়ের কথা শুনে যেনো স্তব্ধ হয়ে রইল। বলার মত শব্দ পাচ্ছে না। কী বা বলার থাকে তখন, যখন সব থেকে কাছের মানুষ, নিজের মা ধোকা দেয়। তখন কথা বলার অনুভুতি গুলো ভোতা হয়ে যায়।
অফিসার তনয়ার মাকে এ্যারেস্ট করতে চাইলে আয়াত বাঁধা দেয়।
আয়াত: অফিসার ওনার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই।
সবাই অবাক দৃষ্টিতে আয়াতের দিকে তাকালো।
আয়াত সবাইকে বলল, হ্যাঁ আমি জানি ওনি অন্যায় করেছে। কিন্তু তবুও ওনি তনয়ার মা। তাই ওনার উপর আমার কোন রাগ নাই।
তনয়ার বাবা: কিন্তু আমার আছে! তুমি হয়তো ওকে মাফ করতে পারো কিন্তু আমি না। কারণ আমি আমার মেয়েকে এতগুলো দিন অসহ্য যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে কাটাতে দেখেছি। তা তোমরা ভুললেও আমি ভুলবো না।
তনয়া: কিন্তু বাবা?
তনয়ার বাবা: কোন কিন্তু নাই। আজ আমি তোর কোন কথা শুনবো না। ওকে আমি তোর জীবনে ভালোবাসার পরশ দিতে এনেছিলাম। কিন্তু ও তো তোর জীবনটাকে বিষের থেকে বিষময় করে দিয়েছে।
অফিসার ওকে নিয়ে যেতে পারেন।
পুলিশ তনয়ার মাকে নিয়ে চলে গেলেন। সারা দিন সবাই প্রচন্ড অস্বস্তির মধ্যে ছিলো। সবাই ভাবছে এটা হয়তো কোন দুঃস্বপ্ন। যেটা ঘুম ভাঙার সাথে সাথে কেটে যাবে। কিন্তু আফসুস তা হবার নয়!
রাতে তনয়া জানাল দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আয়াত রুমে ঢুকে তনয়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
_হেই বিউটিফুল। সব ভুলে যাও। চলো নতুন করে শুরু করি আবার!
_সব পিছনে ফেলে নতুন করে শুরু করতে পারবো কী?
_ পারবে না কেন? আমি আছি না তোমার কাছে, তোমার পাশে, তোমার হৃদয়ে, তোমার অনুভুতিতে, তোমার সারাটা জুড়ে। যেমনটা তুমি আছো আমার সারাটা জুড়ে! তাহলে কেনো পারবো না?
_ হুম ঠিক বলছো। তুমি থাকলে সব পারবো।
_ তনয়া!
_ হুমমম
_ আই লাভ ইউ লাইক এ ম্যাড।
_ আই নো। এখন ভালোবাসা অনেক হইছে যাও ঘুমাও। রাত কম হয়নি। আমি অনুর কাছে যাচ্ছি।
_ অনুর কাছে কেন?
_ঘুমাতে!
_ কেন? আমার খাটে কি জায়গা নাই?
_ বেহায়া! বেশরম!
_ যাহ এমন কী বললাম?
_ কী বলেছিলে মনে নাই? যতদিন না পারিবারিক ভাবে বিয়ে হবে ততদিন একদম ভুল করবে না।
_ তো আমি কি ভুল করতে বলেছি নাকি? (দুষ্টমি করে)
_একদম অসভ্যর মত তাকাবে না। যাও ঘুমাও।
_ উত্তরটা তো দিয়ে যাও।
_ আই ডোন্ট লাভ ইউ।
_ বাট আই লাভ ইউ টু বিউটিফুল।
পরের দিন সকালে তনয়ার বাবা বলছে আজ তনয়াকে তার বাড়ি নিয়ে যাবে! তা শুনে আয়াতের বাবা বলল,
আয়াত: কেন, আমাদের বাড়িতে কী জায়গা নেই ?
আয়াতের বাবা: ওরে গাঁধা। বাড়ি না নিলে বৌমাকে একবারে ঘরে নিয়ে আসবি কী করে?
আয়াত: ওওহহ হ্যাঁ। তা কবে নিয়ে আসবো?
আয়াতের বাবা: বেহায়া! বাবা শ্বশুর বসা তাদের সামনে তো একটু লজ্জা পা। আগামী পরশু শুক্রবার। আমি চাই আমার নাতি পৃথিবীতে আসার আগে ওর মাথা থেকে অবৈধ নামক কলঙ্কটা মুছে যাক। ধর্ম মতে তোদের বিয়ে হয়েই গিয়েছে আমরা শুধু একটু দোয়া কালাম পড়ে তনয়াকে বরাবরের মত নিয়ে আসবো।
আয়াত: হ্যাঁ বাবা। একদম ঠিক বলছো। তাড়াতাড়ি করো।
তারপর মোটামুটি ঘরোয়া আনুষ্ঠানিকভাবে তনয়াকে আয়াতের বাড়ি আনা হলো। তনয়া অসুস্থ বলে বেশি জাকজমক করেননি তারা।
অনু তনয়াকে আয়াতের রুমে দিয়ে আসলো। রুমটা খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। আয়াত তনয়াকে দেখে বলল,
_তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে বিউটিফুল!
তনয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। তা দেখে আয়াত বলল,
_লজ্জা পেলে কাজ হবে না। আমার উত্তরটা চাই।
_ দিবো না!
_ তাহলে কিন্তু আবার চলে যাবো।
তনয়া আয়াতের মুখটা চেপে ধরে বলল,
_ ঠ্যাং ভেঙে খোড়া করে ঘরে কাছে রেখে দিবো। তারপর আয়াতকে জড়িয়ে ধরে বলল, আই লাভ ইউ টু।
সারারাত গল্প কথায়, খুনসুটি অভিমানে কেটে গেলো দুজনার। এত দিন পর দুজনার ভালোবাসা সত্যিকারের পূর্ণতা পেলো। সমাজের কাছে বৈধতা পেলো।
পরশিষ্ট্য: তার বেশ কয়েকদিন পর ওদের কোল জুড়ে আসলো ছোট্ট একটা পরী আসলো। পরীটার নাম দিলো আলো। কারণ পরীটা যে দুজনার জীবনের অন্ধকার কাটিয়ে আলোর সকাল নিয়ে এসে। তবে পরীটাকে এখন কেউ অবৈধ বলতে পারবে না। কারণ পরীটা আয়াত আর তনয়ার ভালোবাসাকে বৈধতার ঢোরে বেঁধে ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিয়েছে।
***(সমাপ্ত)***