অজানা আমি by মুশফিকা রহমান মৈথি |
উনার হাতে যখন প্রথম থাপ্পড় খেলাম তখন মনে হলো মাথাটা এক মিনিটের জন্য ফাঁকা হয়ে গেছে। মাথা যেন কাজ ই করছিলো না এটা ভেবে যে হলো টা কি। এর আগে কোনোদিন থাপ্পড় তো দূরে থাক আমাকে কেউ টোকাটা অবধি মারে নি। ব্যাথা অনুভব তখন করলাম যখন উনি আমার মুখ চেপে ধরলেন। আমার ঠোঁট ফেটে যে রক্ত পরছে তা বুঝতে বাকি নেই। আমি হতভম্বের মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, আমার দোষটা কই ছিল?? আমাকে মারার কারণ কি??
আমি আঁখি, যখন ক্লাস টেনে পরি তখন বাবা মারা যায়। আমার মা অন্ধ, চোখে ছানি পরাতে কিছুই দেখতে পান না। আমি একা ভাই বোন বলতে চাচাতো মামাতো ভাই বোন আছে। ছোট বেলা থেকে আমি চাচা-ফুফুদের কাছেই মানুষ। আমি হবার পর মার জরায়ুতে কিছু সমস্যা হয় তাই আর কন্সিভ করতে পারেন নি। আর কিছুদিন পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, উনার মাথায় ব্লাড জমে আছে ধরা পড়ায় তিনি পাঁচ বছর পর্যন্ত আমার খোঁজটি ও নিতে পারেন নি। আমার ৪ চাচা এবং দুই ফুপি আমাকে মানুষ করেন। আমি পরিবারের প্রথম মেয়ে ছিলাম, চাচা-ফুফুরা ভালোবাসা ও অঢেল দিয়েছেন। অর্থের অভাব থাকলেও ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না। আমি ছোট থেকেই একটু মোটা ছিলাম। বড় হতে হতে যেন একটু বেশিই মোটা হয়ে যাই। বাবা মারা যাওয়ার পর চাচারাই আমার বিয়ের দায়িত্ব নিয়ে নেন। কত ভালো ভালো সম্বোন্ধ আনেন কিন্তু মোটার জন্য সব সম্পর্ক ভেংগে যায়। যখন বয়স আঠাশ মার যেন চিন্তার শেষ নেই। আমার কি হবে এটা ভেবে তিনি চিন্তায় চিন্তায় নাজেহাল। জন্ম,মৃত্যু আর বিয়ে তো আল্লাহর হাতে আপনি চাইলেও কিছু করতে পারবেন না। একদিন তাকে খুব কান্না করতে দেখে কাছে গেলাম।
- মা, কাঁদতেছো কেন?
- তোর বয়স যে আঠাশ পাড় হলো খেয়াল আছে?? তাও কোনো বিয়ে হচ্ছে না। আমি বুড়া হইছি।
- মা আমি তো শিক্ষিত তোমার এটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। বিয়েই কি সব মা??
তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে আমার উত্তরে সে খুশি নন। আমি আর ঘাটলাম না। হুট করে এক সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে আবার শ্বাশুড়ি আর ননদ এসে আমাকে দেখে গেলেন। আমার বোঝার আগেই সামনের শুক্রবার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। নাটকীয়তা মনে হলেও এটাই হয়েছে। পাশের বাড়ির আন্টির পরিচিত হবেন। আমি উনার ছবিটা পর্যন্ত দেখি নি। শুধু নাম টুকু জেনেছি রাফিন। মা ও দেখে নি। আমার মতো মোটা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে শুনেই মা খুশি হয়ে গেছেন। উপরে ছেলে নাকি কাতারে থাকে। আমার চাচা-ফুপিরা খুবই রেগে যান। কারণ এভাবে হুট করে কারোর সাথে কথা না বলে বিয়ে ঠিক করে ফেলাটা তাদের পছন্দ হয় নি৷ আমাকে তারা নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন তাই একটা ক্ষোভ ও কাজ করছে।
বিয়ে হয়ে গেলো, বাসর রাতেই তার সাথে প্রথম দেখা। মনে অনেক ভয় সংকা নিয়ে বসেছিলাম। অনেক স্বপ্ন ও ছিলো কিন্তু সব কেমন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো শারীরিক চাহিদার নিচে চাপা পরে। বুঝলাম তার কাছে আমি তার শারীরিক চাহিদা মেটাবার খোরাক মাত্র।
বিয়ে হবার ২ বছর আমাদের কোনো সমস্যা ছিলো না। কারন আমি মায়ের কাছে থাকতাম। মায়ের কেউ না থাকায় আমি ও বাড়িতে যেতে চাই নি। সমস্যাটা বাধলো উনি যখন বাংলাদেশে আসলেন। এক কথায় দুই কথায় শুধু কাটাকাটি লাগতো। উনি যখন দেশের বাইরে থাকতেন তখন যেন আমার বেশ শান্তি লাগতো। উনার কথাবার্তা খুব আগোছালো। মাঝে মাঝে এমন একটা কথা বলবেন যে তখন ঘৃণা বাদে আর কিছু আছে না। একদিন চাচাতো ভাইকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তাকে ফোনে এটা বলতেই তার ভাষ্য ছিলো, আমি নাকি ওর সাথে ফস্টি নস্টি করছি। ভাই আমার থেকে ৫ বছরের ছোট উপরে আমার ভাই, তার সাথে আমাকে জরানোর মতো ঘৃণ্য চিন্তা এই লোক কিভাবে করে। চার পাঁচ বার ডিভোর্সের জন্য আমি বলেছি, কিন্তু ওই যে মা। মা আমার ডিভোর্সের বিরুদ্ধে, তার কথা ডিভোর্স হলে তিনি আমার মুখ দেখবেন না। চাচা- ফুফুরা বুঝায় কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছুই হয় নি।
বেশ কিছুদিন পর জানতে পারি আমি একা নই আমার সাথে আরেকটা জান বড় হচ্ছে। রাফিনকে এটা বলাতে উনি খুশি হলেন কিনা জানি না। ফোনে তো মানুষের মুখের ভাব বোঝা যায় না। প্রেগ্ন্যাসির অনেক আগেই আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, যার কারণে বাচ্চাটা রাখা একটু দুষ্কর হয়ে গেলো। উপরে আমার ওভার ওয়েট। তাও আমি জোর করেই বাচ্চাটা রাখলাম। কারণ ও যে আমার নিতান্ত নিজের। আমাদের সংসার মায়ের ব্যাংকের টাকা দিয়েই চলতো। লাখ লাখ ইনকাম করলেও আমার বর আমাকে ২ হাজার টাকা হাত খরচা দিতেন। তাই দিয়ে আমি টুকটাক ফল কিনতাম,মায়ের ঔষধ কিনতাম। সমস্যাটা হয় ডিলেভারির সময়। আমার অভার ওয়েটের কারণে ডিলেভারি অনেক লেট হয় আর এটার ফল আমার বাচ্চাকে পেতে হয় অনেকক্ষন ভেতরে থাকায় ও নিজের মল নিজে খেয়ে ফেলে আর তার শ্বাসনালীতে ঢুকে যায়৷ ওর বাঁচার সম্ভাবনা না এর সমান ছিলো। আল্লাহর রহমতে ১০ দিন আই.সি.উ তে থাকার পর আমার ছেলে সুস্থ হয়ে উঠে। ওকে যখন প্রথম কোলে নেই আমারর৷ সব কষ্ট গুলো উবে গিয়েছিলো৷ কিন্তু এর মাঝেও উনার একটা চিন্তা ছিলো প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। আমি নাকি ইচ্ছে করে সিজার করিয়েছি যআতে টাকা বেশি লাগে। আর ওয়েটের খোটাতো শুনতে শুনতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
বাবু যখন বড় হতে থাকে ভেবেছিলাম লোকটা হয়তো বদলাবে, কিন্তু না তার চিন্তা ভাবনা আগের মতই রয়ে গেলো। বাবু হওয়ার আড়াই বছর পর লোকটা দেশে আসে। ততদিনে আমি আমার মাকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি চলে আসি। রাফিন একটা শ্বশুরের ভিটা একটা নতুন বিল্ডিং করেছে। আমার শ্বাশুড়ি ও বললেন মাকে নিয়ে যাতে নতুন বাড়িতে উঠি। দুই ইউনিট হওয়ায় আমাদের আলাদা ঘর দেওয়া হলো। সব ভালোই চলছিলো। কিন্তু লোকটা আসার পর শুধু ঝগড়া বাধতো। তার কথাবার্তাই খুব বিরক্তিকর। একদিন আমি তাকে বলেছিলাম,
- বাবু বড় হচ্ছে, মার টাকায় আমাদের তিন জনের সংসার হিমসিম খাচ্ছি, টাকাটা বাড়িয়ে দিলে হয় না।
- আমি তো তোমাকে ১৪ হাজার টাকা দেই আর কত লাগবে?
- ১৪ হাজার মানে?
- এই ইউনিটের ভাড়া ১২ হাজার আর ২ হাজার খরচ। তুমি যদি এই ইউনিটে ভাড়া না থাকতা এটার ভাড়া বাবদ তো ১২ হাজার ই পেতাম। আর তুমি তো বাড়ি ভাড়া দিচ্ছো না।মাকে নিয়ে আমার বাড়িতে পড়ে আছো আবার কথা।
লোকটার কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না, এতো মেজাজ খারাপ হলো বলার মতো না। তারপর ঝগড়া, ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমার গায়ে হাত তুলতেও সে পিছ পা হলো না। মুখ চেপে বললেন,
- এখনি ঘর ছেড়ে চলে যা, মাকে নিয়ে বিদেয় হো। আমার ছেলেকে রেখে যাবি।
একবার ও না ভেবে আমি এক কাপড়ে মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ফুপু বাড়ি উঠায় ফুপি তো অবাক। ফুপি সব শুনে একটা কথাই বললো,
- আমাদের ছেলে আমরা নিয়ে আসবো। ও আড়াই বছর পর এসে ছেলের দাবি করবে আর আমরা মেনে নিব তা হবে না।
বিকেলে চাচারা মিলে সভা বসালেন। রাফিনের পরিবার, পাড়ার কিছু গণ্য মাণ্য ব্যক্তি। আমার এক কথা এই জানোয়ারের সাথে আমি ঘর করবো না। যার কাছে আমার প্রয়োজন কেবল ই শারীরিক চাহিদা মেটাবার জন্য, তার সাথে আমি থাকতে পারবো না। আর তার এক কথা আমার অন্ধপ্রায় মাকে সে রাখবে না। মার প্রতি ক্ষোভের কারণ অবশ্য আমার জানা। মার ব্যাংকের টাকাগুলো একবার চেয়েছিলো কারণ সে দেশে একেবারেই চলে আসবে এবং ব্যবসা করবে। মা মানা করাতেই তার এই ক্ষোভ। মার কাছে শেষ সম্বল বলতে এই কিছু টাকা। তাই মা তাকে এই টাকাটুকু দিতে চান নি। আমিও খুব জেদী আমার মাকে আমি একা ছাড়বো না। শেষমেষ কোনো সমাধান না হওয়ায় কোর্টে কেস উঠতে বাধ্য হয়। আমাদের ডিভোর্স মঞ্জুর করা হলেও ঝামেলা বাধে আমার ছেলের কাস্টেডি। ভাগ্যক্রমে কাস্টেডিটা আমরা পেয়ে যাই। কারণ ছেলে আমার আমাকে বাদে কারোর কাছেই থাকবে না। শুরু হলো এক নতুন জীবন।
মা যদিও ডিভোর্সে খুব একটা খুশি হন নি, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তাকে ছাড়তে পারবো না। একটা ছোট চাকরি অনেক কষ্টে খুজে পাই। দশ হাজার টাকা বেতন। মা যতটুকু টাকা পেতেন আর আমার টাকা মিলিয়ে আমাদের ছোট সংসার বেশ ভালো যাচ্ছিলো। আজ আমার ননদের সাথে হুট করে দেখা হলো। ছেলে আমার বড় হয়েছে, এখন বারো বছর বয়স। ছেলেকে দেখে বেশ কিছুক্ষণ আদর করলো। আর যাই হোক আমার শ্বশুর বাড়ি নিয়ে আমার কোনোই ক্ষোভ নেই। লোকটা খারাপ তার পরিবারের কেউ তো আর আমার প্রতি অন্যায় করে নি। ডিভোর্সের পর তারা ছেলেকে দেখতে আসতো মাঝে মাঝে। কথায় কথায় জানতে পারলাম রাফিন নাকি অসুস্থ। একদিন স্ট্রোক করে এখন প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। শুধু নাকি আমাকে দেখতে চাইতেন। বাসায় এসে মাকে বলাতে আমাকে দেখে আসতে বললেন। আমিও দেখে আসলাম। আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। ডিভোর্সের পর আজ তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। অসার শরীরটি পড়ে রয়েছে বিছানায়। কি করুণ লাগছে মুখখানা। কে বলবে! এই লোকটাই এক সময় আমার উপর দাপট দেখাতো।
বাসায় এসেছি কিন্তু মনটা ভালো লাগছে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আজকে আবহাওয়াটা কেমন যেন রুখে আছে। কোনো বাতাস নেই। আকাশে মেঘ করেছে কিন্তু বৃষ্টি হবে না। উনাকে দেখে আসার পর সত্যি বলতে উনার প্রতি করুণা হচ্ছে কিন্তু কষ্ট হচ্ছে না। কেনো আমার জানা নেই। মনের মাঝে কিছু অজানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা তার সাথে হয়তো চাইলে আমি ডিভোর্সটা আটকাতে পারতাম কেনো আটকাই নি, জানা নেই,, তার সাথে আমার থাকার মূল কারণটাই আমাদের বাচ্চা ছিলো। তবুও কেনো একটা বার ভাববার ইচ্ছে হলো? কেনো, জানা নেই। আজ ও আমি চাইলে তার কাছে যেতে পারি, তাকে সেবা করতে পারি! কিন্তু কেনো যেনো ইচ্ছে হচ্ছে না! তাকে কোনোভাবে সাহায্য করার ইচ্ছেটুকু আমার হচ্ছে না। কেনো? জানা নেই। আমার খারাপ লাগছে ঠিকই কিন্তু কাদতে ইচ্ছে করছে না। কেনো? জানা নেই। এই অজানা আমিকে আজ সত্যি বুঝতে পারছি না, ইচ্ছেও করছে না। কেনো? জানা নেই
***(সমাপ্ত)***