পরিণতি |
০১!!
হাসপাতালে বাবার কেবিনের বাইরে বসে আছি।পরশু রাতে হঠাৎ করেই বাবার বুকে ব্যথাটা বাড়ে খুব।হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অবস্থার উন্নতি না দেখে কাল দুপুরে বাবাকে নিয়ে আসি ঢাকায়। এখন বাবার অবস্থা মোটামুটি ভালোর দিকে।কয়েকদিন অবজারবেশনে রাখতে হবে শুনলাম।
কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। পরশু রাগ করে বিথিকে বলেছিলাম আর কথা বলব না।তারপর থেকে ও নিজেও আর কল দেয়নি। আমারও এতো টেনশনের মধ্যে কল করার কথা খেয়ালও ছিল না।
মেয়েটা যে কি করে বুঝি না।! বাড়ি গিয়েছিলাম কদিন আগে।তখন থেকেই কিছু একটা হয়েছে ওর। পরশু সকালে বিথি কল করেনি দেখে এগারোটার দিকে কল করলাম।
-হ্যালো-বিথি--। কি কর?
-ঘুমাচ্ছি---।
-কয়টা বাজে এখন-??ক্লাস নেই আজ?
-জানি না----।
-কি হয়েছে তোমার??
-কই?কিছু হয়নি তো----।
-তো এখনো ঘুমাচ্ছ মানে কি? আর তুমি না আমাকে সকালে আমাকে ডেকে দিচ্ছ??
- ---------
-কি হল চুপ করে আছো যে--??
-ঘুম পাচ্ছে আমার---।
-উঠে যাও না--। নাস্তা করে ফেল---।এগারোটা বাজে---।
-উঠব পরে---।
-বিথি----?
-রাখছি---। পরে কল দিব---।
-আচ্ছা---। তাড়াতাড়ি নাস্তা করে নিবা----।
কথাটা পুরো না শুনেই কলটা কেটে দিল। ভাবলাম হয়ত কেউ এসেছে তাই।
দুপুরে কল দিলাম--। একই অবস্থা-ঘুম।
রাতেও যখন বলল ঘুম পাচ্ছে তখন হঠাৎ রাগ হল কেন জানি!।
-তোমার কি হয়েছে বলো তো-।
-কোথায়??কি আর হবে--?
-তো আজ হঠাৎ এতো ঘুম কোত্থেকে আসছে--??
- জানি না---। ঘুম পাচ্ছে আমার---।
- যত ইচ্ছা ঘুমাও---যাও। কথাই বলব না তোমার সাথে আমি----।
বিথিকে যখন কল করেছিলাম তখন সাড়ে আটটা-কি নয়টা বাজে। দশটার দিকে বাবার বুকে ব্যথাটা বাড়লে আর ওকে কল করা হয়নি।
মেয়েটা সবসময় অবশ্য এমন করে না। কোন কিছু নিয়ে খুব চিন্তা করলেই হঠাৎ হঠাৎ এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করে।
অথচ- সচরাচর কি শান্ত বিথিটা!মুখে মিষ্টি একটা হাসি লেগে থাকে সবসময়।আর আমার সাথে বের হলেই যেন ওর চোখে-মুখে অন্যরকম একটা চাঞ্চল্য খেলা করে।একদম চুপ থাকতে পারে না বিথি। তবে সেটা বোধহয় শুধু আমার সামনেই।অন্তত ওর বান্ধবীগুলোর এসব নিয়েই আমাকে ক্ষ্যাপানো দেখে তো সেটাই মনে হয়।।
কিন্তু হঠাৎ করে কেন যে বদলে গেল মেয়েটা-কিছুই বুঝলাম না।।
বাড়ি যাওয়ার আগেরদিন বিকালে ওর সাথে বেরিয়ে ছিলাম। ঘন্টা দুয়েক ছিলাম ওর সাথে।অনেকক্ষণ আমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে ছিল।এর মধ্যে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করেছিল ও আমাকে।
ও মরে গেলে আমি কী করব???
এটা কোন কথা??!!!
বকে দিয়েছিলাম খুব করে।
বকব নাই বা কেন??
কিছু প্রশ্ন নিয়ে আমি কখনোই ভাবি না।অথবা ভাবতে চাই না।
তাই উত্তরটাও সেদিন দেয়া হয়নি বিথিকে।
ও বোধ হয় এখনো রাগ করে আছে সেজন্য।
বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরার আগে একবার বিথির সাথে দেখা করতে হবে। মোবাইলটা বের করলাম পকেট থেকে।বিথিকে কল করার আগেই একটা নম্বর থেকে কল এল।
মোবাইলের স্ক্রিনে নামটা ভেসে উঠতেই আমার বুকের ভিতরে ধ্বক করে উঠল।
ও কেন কল করেছে হঠাৎ????
০২!!
যে মানুষটা কল করেছে তাকে ভয়ের কিছু নেই।বিথির বান্ধবী নেহার নম্বর।বিথি নিজেই সেইভ করে দিয়েছিল আমার মোবাইলে।আঁতকে উঠার কারণ হল নামটা। নেহার নামটা মোবাইলে "রেড এ্যালার্ট"দিয়ে সেইভ করা।কারণটা জানতে চাইলে বিথি হেসে বলেছিল:-যদি এই নম্বর থেকে কখনো কল আসে--বুঝবে আমার কিছু একটা হয়ে গেছে।
বিথির মুখের ভঙ্গি আর কথায় সেদিন হেসে ফেলেছিলাম।ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগেরকার।
কিন্তু এতোদিন পরে সত্যিই যখন কলটা এল তখন কিভাবে রিঅ্যাক্ট করব বুঝলামই না অনেকক্ষণ।
কলটা বাজতে বাজতে একসময় থেমে গেল।সম্মোহিতের মত দেখছিলাম কি ঘটছে।মোবাইলটা আবার বেজে উঠল।সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে কলটা রিসিভ করলাম।
-আবির ভাই---?বিথি কোথায় কিছু জানেন?
-নাতো---!!কেন কি হয়েছে ওর?
-সপ্তাহ খানেক যাবৎ কলেজে আসছে না। আর তিন-চারদিন হল কারো কলই রিসিভ করছে না। ভাবলাম আপনি জানেন নাকি কিছু----।
-আমারও কাল থেকে কথা হয়নি---। বাবা হসপিটালাইজড---।তাই আমিও আর কল করতে পারিনি---।
-ও----।
-তোমরা একটু ওর বাসায় গিয়ে দেখ--।আমার সাথে কথা হলে জানাব।
-জ্বি আচ্ছা---।
-হুঁম---।
-ভাইয়া--।আপনাদের মধ্যে সব ঠিক আছে তো?
-নেহা---হঠাৎ এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছ?
-না ভাইয়া--। বিথিকে লাস্ট যেদিন দেখেছি কলেজে- চোখ মুখ ফ্যাকাশে-।এতোটা ভেঙে পড়তে আমি দেখিনি কখনো ওকে।
-আমি সত্যি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার সাথেও -----। তুমি প্লিজ একটু দেখো--।প্লিজ।কি হয়েছে আমাকে একটু জানাও--।
-জ্বি আচ্ছা--ভাইয়া।
কলটা কেটে দিয়ে বিথিকে কয়েকবার কল দিলাম। আসলে কয়েকবার না। মোটামুটি ২০-৩০ বার। কল গেল। কিন্তু কোন রেসপন্স নাই।
মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেল হঠাৎ।বিথি ঠিক আছে তো???
আমি যদি কোন কিছু নিয়ে বেশি চিন্তা করি-মেয়েটা কেমন করে যেন বুঝে যায়-।এবারও বুঝতে পেরে গেছে বিথি??কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব?? আমি তো কিছু বলিনি ওকে?
আর কেউ কি বলেছে?
কিন্তু কে???
আগের বারও ঠিক এমনই হয়েছিল।অনার্স ফাইনালের আগে।একটা সাবজেক্টের প্রিপারেশন খারাপ আমার।জ্বর ছিল কদিন।তাই পড়া হয়নি।।কথাটা আমি ছাড়া আর কারো জানার কথা না। এমনকি প্রিপারেশন খারাপের কথা বিথিরও জানার কথা না। চিন্তা করবে তাই অসুস্থতার কথাই আমি ওকে জানাই নি। অথচ কেমন করে জানি জেনে গেল মেয়েটা।জানা তো বড় কথা না। সমস্যা হল যখন দেখা করতে গেলাম। গাল ফুলিয়ে বসে আছে।চোখ মুখ ফোলা। ১০০% বাজি ধরে বলতে পারি-আসার আগেও ঘন্টা খানেক কেঁদেছে বিথি।
আর সেই যে গুম মেরে বসেছিল-যাবার আগে একটাও কথা বলেনি। অবস্থা দেখে আমি মুখ পাংসু করে যখন বললাম:- "আমার পরীক্ষাটা খারাপ হলে সব দোষ তোমার"--তখন বিথির মুখটা হয়েছিল দেখার মতন। তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা যাকে বলে আর কি!!!
প্রিপারেশন খারাপের জন্য রাগটা ছিল না। বিথি রাগ করেছিল ওকে আমার অসুস্থতার কথা না জানানোর কারণে।রাগটা ভাঙাতে পাক্কা এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল তখন।
কিন্তু এবারে তো তেমন কিছুই ঘটেনি।
তবে কেন?
যে মেয়েটা ঘন্টায় ঘন্টায় কল করে কথা না বলতে পারলে পাগল হওয়ার দশা হয়-সেই বিথিই আজ কদিন এমন অদ্ভুত হয়ে গেছে!!
বুঝতে পারছি-কথা না বলে থাকতে পারবে না বলেই বাহানা করে ঘুমাচ্ছে। আবার কি ঘুমের ওষুধ খেয়ে চোখ বুজেছে ও?
কিন্তু কেন???
০৩!!
আচমকা মনে হল দুনিয়াটা কেঁপে উঠল। নাহ্-তেমন কিছুই না-মোবাইলের ভাইব্রেশন।
স্ক্রিনে আবার রেড এ্যালার্ট ফুটে উঠল।
-হ্যাঁ-নেহা--বিথি কই---?
-ভাইয়া-আপনি একটু বিথির বাসায় আসতে পারবেন এখন?
-কি হয়েছে বিথির?
-আপনি একটু আসেন--প্লিজ--।
-আসছি----।
বাবার কেবিনের দিকে গেলাম।ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে বাবাকে।এখন ঘুমাচ্ছে।নার্সকে বলে বিথির বাসার দিকে রওনা হলাম।
বিথির বাসাটা হসপিটাল থেকে একটু দূরেই।তার উপরে ঢাকা শহরের জ্যাম তো আছেই।রাস্তার এতো কোলাহল কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছি না। পাঁচ-ছদিন আগে বাড়িতে এসেছি।অফিসের ৯টা-৫টার কাজ থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে।বাবাও বারবার করে যেতে বলছিল বাড়িতে। মা-বাবা-বোনের ছোট্ট এই পরিবারটা রেখে ঢাকায় থাকতে আসলেই খুব বিরক্ত লাগে। কিন্ত অফিস শেষে বিথির হাসিমাখা চেহারা আর দিনশেষে বাড়ির সকলের সাথে কথা বললেই সমস্ত বিরক্তি-ক্লান্তি বদলে যায় অন্যরকম ভালোলাগায়।
কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ছিল একেবারে আলাদা।কদিন ধরেই মা আর বোনের সাথেই কথা হচ্ছিল-বাবাকে কল করলে খুব একটা কথা হচ্ছিল না। বাবা নাকি খুব ব্যস্ত।কি নিয়ে এতো ব্যস্ত সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।এর মধ্যেই বাবা কল করে বলল বাড়ি যেতে। তাই চলে এলাম। তাছাড়া বাড়িতেও যাওয়া হয়নি অনেকদিন।
বাড়ি আসার পর বুঝতে পারলাম-বাবা কেমন একটা হয়ে গেছে। চোখ মুখ কেমন শুকনো শুকনো। আর্মিতে ছিলেন-রিটায়ার্ড করেছেন বছর দুয়েক হল। এই দুই বছরে বাবাকে এমন ভাবলেশহীন দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
আমার আর বাবার সর্ম্পকটা ভালোই। কিছু বলার হলে বাবাও খুব সাধারণভাবেই বলে দিতে পারেন। আর আমি বাবার যেকোন কঠিন কথা সহজেই হজমও করে ফেলতে পারি। সেটা বকাঝকাই হোক-বা লাইফ নিয়ে বিশাল কোন লেকচার। তাই অন্তত আমাকে না বলার কোন কারণ মাথায় আসছে না। অথচ মনে হচ্ছে-বাবা ব্যাপারটা আমার কাছেই এড়িয়ে যাচ্ছেন।
কথাটা বাবা যখন বলল মোটামুটি একটা ধাক্কার মতোই খেলাম। আসলে বলল বললে ভুল হবে। জিজ্ঞেস করল-বিথির কথা--। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল আমার বাবার প্রশ্নটা বুঝতে।
-মেয়েটা কে আবির?
-বা--বা---??
-বিথি মেয়েটা কে?
-বাবা--।বিথি-- আমাদের কলেজেই পড়ে। এবার থার্ড ইয়ারে----।
-আমি তোর আর বিথির ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞেস করছি----। এইসব করে বেড়াস শহরে গিয়ে??
- এইসব মানে কি? বাবা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না--।
-তোকে শহরে আমি পড়তে পাঠিয়েছি?? নাকি কোন মেয়ের পিছনে ঘুরতে??
-বাবা--। আসলে আমি বলব বলব করে তোমাকে বিথির কথাটা বলতে পারিনি।------।
-কি বলতি তুই??হ্যাঁ?? এই মেয়ের সাথে তুই প্রেম করিস সেটা???
-বাবা---। আমি----।
-চুপ থাক---। এইসব মেয়েরা কেমন হয় জানিস?? একেবারে সংসারটা তছনছ করে ছাড়বে---।
-বাবা--বিথি এমন মেয়েই না--। তুমি একবার ওর সাথে কথা বললেই----।
-এখনি এই মেয়েটা তোর মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছে--। এখনই ওর জন্য আমার মুখের উপর কথা বলছিস-;বিয়ে হলে তো আমাদের কোন বনে জঙ্গলে ফেলে আসবি----।
-বাবা-----।
চুপ করে গেলাম শেষমেষ। এখন আমি যাই বলব সবটার দোষ গিয়ে পড়বে বিথির ঘাড়ে। এর চাইতে চুপ থাকাই ভালো।।
যতদিন বাড়ি ছিলাম এসব নিয়ে বাবার সাথে কথা বলা হয়ে উঠেনি। বাবাও একসময় নরমাল হয়ে যায়। আর আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।।
ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম বিথির বাসার কাছেই চলে এসেছি।। হুঁটাহাট বিথিকে দেখতে বিথির বাসার নিচে অনেকবার এসেছি। তবে বিথির হাজার অনুরোধেও বাসায় যাওয়া হয়নি কখনো। যাওয়াটা এভাবে হবে ভাবিও নি। তবে হঠ্যাৎ একটু নারভাসও লাগছে।কি হয়েছে বিথির কে জানে!!!!!
০৪!!
বিথির বাবা-মা আমাকে দেখে একটুও অবাক হলেন না দেখে আমি নিজেই অসম্ভব অবাক হলাম। বিথির মা একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছেন। কান্না কাটি বোধ হয় অনেকক্ষণ ধরেই করছেন।তাই কথাও বলতে পারছেন না। উনার কান্না দেখে আমার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে উঠল। হঠ্যাৎ কেমন একটা ভয় ঢুকে গেল মনে।বিথি ঠিক আছে তো!!!
বিথির বাবা গুম মেরে বসে আছেন। আমাকে দেখে-বোধ হয় আমাকে একটু সাহস দেয়ার জন্য জোর করে একটু হাসলেন।
-তুমি তো আবির?? বিথি প্রায়ই তোমার কথা বলত--।
-জ্বি-- আংকেল---।
- কতবার বলেছি তোমাকে কখনো বাসায় নিয়ে আসতে---। কিন্তু এই মেয়েটা কি কারো কথা শোনে---!!?? তোমাকেও নিশ্চয়ই বলেনি যে আমি আসতে বলেছি--।
- কই না আংকেল--। ও আমাকে এসব কিছু তো---।
-জানি বাবা---। এই মেয়ের এই এক সমস্যা---।দুনিয়ার যত কথা তা বলবে-শুধু যেটা জরুরি সেটা বাদ দিবে---।
আমি আংকেলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। কি বলা উচিত-কি ভাবা উচিত সব তালঘোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বিথির মুখে ওর বাবা-মার কথা অনেক শুনেছি।উনাদের সাথে বিথির অসাধারণ বন্ডিয়ের কথাও শুনেছি।কিন্তু তাই বলে ও আমাকে ভালোবাসে জেনেও উনাদের রিঅ্যাকশান দেখে আমি নিজেই অভিভূত হয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু বিথিটা কোথায়? কাকে যে জিজ্ঞেস করব সেটাই বুঝতে পারছি না। নেহাকেও দেখছি না।বিথির আব্বু আবার গুম মেরে বসে আছেন।উনাকে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা বুঝতেও পারছি না।।
-বুঝলে বাবা আবির??আমার বিথিটা এরকমই। সারাদিনের যত দুষ্টুমি-যত অবাক হওয়া ঘটনা সব ওর মাকে এসে বলে। ওর মা একসময় বিরক্ত হয়ে যায়। আমি বাসায় ফিরলে ও আমাকেও একই ঘটনাগুলো প্রথম থেকে বলে যাবে--। তোমাকেও হয়তো বলে----।
বিথির বাবার গলাটা ধরে এসেছে তাই চুপ করে গেছেন।চোখ পানিতে টলমল করছে। আমিও ভাবছি বিথির সারাদিন শেষের গোছালো বা অগোছালো পাগলামির কথাগুলো।
-আঙ্কেল--।বিথির কি হয়েছে?
-কি হয়েছে বাবা সেটা আমি জানি না। খায় না--।কোথাও যায় না--। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমায়।প্রথমে ভেবেছি হয়ত তোমার সাথে কিছু হয়েছে-মিটমাট হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে---।কয়েকবার জিজ্ঞেস ও করেছি।ও কিছুই বলেনি। কাল থেকে শোয়া ছেড়েও উঠতে পারছে না।---। ডাক্তার ডাকলাম---। ডাক্তার এসে তো মাথায় হাত---। বিপি নাকি সাঙ্ঘাতিক ফল করেছে---।কাল সারাদিনে অনেক জোরাজুরি করে না কিছু খাওয়াতে পেরেছি---না স্যালাইন দিতে। নেহা যখন এসেছে বিকেলে তখন ডাক্তার একপ্রকার জোর করেই স্যালাইন দিয়েছে-----।তাই নেহাকে বললাম তোমাকে একবার আসতে বলতে---। তোমার বাবাও নাকি হসপিটালাইডজড---। তাই আর---।
-বাবা ভালো আছে এখন---। বিথি কি করছে এখন??
-কি করবে আর---? অনেকক্ষণ চিল্লাচিল্লি করেছে স্যালাইন দেয়া নিয়ে--। এখন বোধ হয় আবার-------।
-আঙ্কেল---। আমি একটু ওকে দেখতে-----।
-হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা--- যাও---।নেহা--মা---। আবিরকে একটু বিথির রুমে নিয়ে যাও---। আমি মেয়েটাকে আর এভাবে সহ্য করতে পারছি না----।
নেহা আমাকে বিথির রুমে নিয়ে গেল।পরে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।
এই প্রথমবার বিথিকে এতোটা অপরিচিত লাগছে আমার।বিথির মাথার কাছে ফ্লোরে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছি।
বিথিটা ঘুমোচ্ছে। ঘুমাচ্ছে বললে ভুল হবে। বোধহয় সেন্স হারিয়েছে।মুখটা একেবারে ফ্যাকাশে-রক্তশূন্য লাগছে।।
-এই বিথি----??? উঠো না প্লিজ-।প্লিইইজজ।
কখন আমার নিজের চোখ ভিজে গেছে বলতে পারব না।বিথিকে এই অবস্থায় দেখে আমার নিজের খুব অসহায় লাগছে।
কি করব এখন??আরো একবার ডাকব বিথিকে? ও কি শুনতে পাচ্ছে আমার ডাক???
০৫!!
-আবির ভাই----।
ডাকটা শুনে পিছনে ফিরলাম।নেহা কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি।
-হ্যাঁ নেহা--।বলো??
-এইটা বিথির ডায়েরি----।
-কি হয়েছে তোমার???
-কি-কিছু না----।আপনি এটা পড়েন--।কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিয়েন----।
নেহা আমার থেকে মুখ লুকালেও বুঝতে পারছিলাম এই মেয়েটাও বিথির জন্য কাঁদছে।
বিথির ডায়েরিটার দিকে তাকালাম।মাঝারি সাইজের একটা ডায়েরি।কালচে নীল রঙের খোলসে মোড়া ডায়রিটা বিথির সমস্ত ছেলেমানুষির সাক্ষী।সুন্দর-গোটা গোটা পরিষ্কার লেখা বিথির। আর প্রতিটা লেখার সাথে সাথে কাগজের খুঁটি নাটি জুড়ে দেওয়া।
এই যে সেদিনের ঘটনা---।
বিথি আর আমি নদীর ধারে বেড়িয়ে এসেছি। তার একদম চুলচেরা বিবরণ। সাথে একটা কাগজের নৌকা জুড়ে দেয়া আছে। রঙ করা নদীর নীল পানিতে কাগজে এঁকে সেখানে কাগজ কেটে বানানো মাছ ছেড়ে দিয়েছে। অসাধারণ লাগছে জিনিসটা।
আমার সাথে রাগের কথাগুলোও লিখা আছে। তবে আবছা আবছা। বুঝতে পারছি-চোখের জলে কাগজের লেখাগুলো ধুয়ে গেছে বারবার।
লিখা আছে ওর আর আমার প্রথম দেখার দিনটাও। সে প্রায় তিনবছর আগের ঘটনা। আমি তখন ফাইনাল ইয়ারে আর বিথি ফাস্ট ইয়ারে। প্রথমদিন আমাকে দেখেই মেয়েটা থমকে দাঁড়িয়েছিল। ব্যাপারটা পড়ে হেসে ফেললাম।ওকে দেখে আমার অবস্থাও হয়েছিল এমনই।কোন কারণ নেই-পরিচয় নেয়-অথচ একে অন্যকে দেখে অন্য একটা জগতে চলে যাই যেন।
যাই হোক--।
ডায়েরিতে লেখা আছে অনেক কিছুই। তবে লেখাগুলো কেবল আমাদেরকে কেন্দ্র করে। কবে কোথায় দেখা হয়েছে-কবে আমি বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে ছিলাম বলে ওর রাগ হয়েছে-কবে আমি অসুস্থ ছিলাম বলে ও আমার জন্য নফল রোজা রেখেছে-কবে আমার সাথে শাড়ি পড়ে বেরিয়েছে-কবে প্রথম আমার হাত ধরেছে।
ডায়েরিটা যেন সচরাচর লেখনি নয়-যেন এক একটা চিঠি;আমার কাছে লেখা চিঠি। শেষদিনের চিঠি যেটা সেটা পড়ে বুঝতে পারছিলাম না কি হয়েছে।
চিঠিটা এমন:-
আবির,
তুমি জানো আজ খুব মন খারাপ আমার।পাঁচটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছি।খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে।অথচ প্রতিবার মোবাইলটা কেঁপে উঠলে ঘুমটা কোথায় যে চলে যায়!খালি মনে হয় তুমি কল করেছ।তুমি কল করছও।কিন্তু মোবাইলটা হাতে নিতেই মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়।
আচ্ছা,বলো তো?আমি কি খুব বেশিই খারাপ?সত্যিই কি আমি তোমার আর বাবা-মার সর্ম্পকটা নষ্ট করে দিচ্ছি?উনাদেরকে বাবা-মা ডাকার অধিকারটা সত্যিই কি আমার নেই বলো?
তোমার বোনটা কেমন আছে? মেহের-কি সুন্দর নাম না?? জানো ও প্রায়ই আমাকে কল দেয়।আমরা কতো কথা বলি।একেবারে বন্ধুর মতো--।আমি কি ওকেও তোমার থেকে দূর করে দিচ্ছি?
ছোট্ট কিছু স্বপ্ন দেখেছি জানো তো-তোমাকে নিয়ে-বাবা-মা-আর মেহেরকে নিয়ে।শুধু তোমাকেই তো চাই নি বলো কখনো-সবাইকেই চেয়েছিলাম তো--!? আচ্ছা-তোমাকে ভালোবাসাটাই কি আমার একমাত্র অপরাধ বলো???
বাবা খুব চিন্তা করে এসব নিয়ে তাই না আবির?
তোমার থেকে দূরে থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব না আবির-কিন্তু যাদেরকে তোমার চাইতেও বেশি ভালোবাসি তাদের ঘৃণা নিয়েও বা বাঁচব কি করে?
বাবাকে প্লিজ বলে দিও-তোমাকে তাদের থেকে কখনো কেড়ে নিব না আমি-কক্খনো না---।বিশ্বাস করো-এর চাইতে আমি----------।
ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।বিথিকে কে কি বলেছে সেটাই বুঝতে পারছি না।এই মেয়ে যে গুরুতর পর্যায়ের পাগল জানা ছিল-কিন্তু এমন কিছু একটা করে বসবে ভাবি নি কখনো।
ভাবছি-ওকে বোঝানো উচিত-যে ওর চাইতে ভালো কেউ আমার জীবনে আসতেই পারে না।কথাটা বাবাকেও বুঝানো উচিত। এখন সমস্যা হল: বাবাকে বুঝাতে পারব কিনা জানি না। আর বিথি??ওকে যে কিভাবে বুঝাবো সেটা আমি নিজেও জানি না।
হালকা নড়ার আওয়াজে চোখ তুলে বিথিকে দেখলাম।অস্বস্তি নিয়ে এপাশ ওপাশ করছে।চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিলাম।
-এই বিথি?চোখ খোলো না প্লিজ----??
০৬!!
বিথিটা এতোক্ষণে কোনমতে চোখ খুলেছে।চোখে মুখে নিস্তেজ ভাব।আমাকে দেখছে কিনা সেটাই বুঝতে পারছি না। দৃষ্টিটা যেন অনেক দূরে কোথাও।
-বিথি----। এই??শুনছ???
-হুঁম---??
-কি হয়েছে বিথি??
-কিছু না--।
-তাহলে এমন করছ কেন?
-কোথায়??
-বিথি--।তুৃমি কি মনে করছ??তুমি চুপ করে থাকলেই আমি এখন এখান থেকে রাগ করে চলে যাব???
------------
-কি হল??কথা বলো??
-ভালো লাগছে না--। তুমি যাও---।
-ভালো লাগতে হবে না--। উঠো তো দেখি---??
-উহুঁম----।
-কি উহুঁম???? সারাদিন শুয়ে থেকে থেকে নিজের মাথাটাও খারাপ করছ-সাথে আমাদেরও---।
-আমি-----।
-চুপ---। উঠো-----??? ---নেহা--- বিথির জন্য খাবার কিছু আনো---।
-আমি-------।
-একটা কথাও বলবা তো-----।
- কি করবে??
-কি করব সেটা তোমার জেনে কাজ নেই।উঠো---।
বিথিটার গায়ে ছিটেফোঁটাও শক্তি অবশিষ্ট নেই। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ-চাহনি দুর্বল। মনে হচ্ছে উঠে বসতেও পারবে না। বসলেও কতোক্ষণ বসে থাকতে পারবে কে জানে!
তাই আমি নিজেই বিথিকে হালকা করে খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলাম।মেয়েটা এই অসুখের মধ্যেও কি ভেবে ছটফট করছে।
নেহাও জুস আর হালকা নাস্তা নিয়ে এল।অনেক বলেও কিছু মুখে দেওয়াতে পারলাম না।গায়ে শক্তি নেই-অথচ তবুও খাবে না পণ করেছে।
-প্লিজ বিথি--;খাও--। আমি খাইয়ে দিচ্ছি---।
অন্য সময় হলে বিথি ছেলেমানুষি করে পাগল করে তুলত।আর এখন ওর এমন নিরবতাতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।
-আচ্ছা যাও---। জুসটুকু খেয়ে নাও--।
-উহু----।
-খেতে বলছি না???
-খাব না---।
-কি করবে তবে বলো আমাকে??না খেয়ে মরার প্ল্যান আছে তোমার???
-------------
-বিথি??কিছু বলছি তোমাকে---।
-হুঁম---।
-হুঁম-উহু করে লাভ নেই---।যেটা বলছি সেটা শোনো--।
-খাব না---।
-বিথি---!!!!!
-অনেক দেরি হয়ে গেছে---।তুমি যাও এখন---।
-আমি এখানে থাকলে তোমার সমস্যা হচ্ছে??
-আমি ঘুমোবো---।
-খবরদার যদি আর একবার শুয়েছ তো---।জুসটা শেষ না করে শোয়ার কথা ভুলে যাও---।
-আমার ভালো লাগছে না----।
-তর্ক করে যে লাভ নেই ভালো করেই জানো সেটা।কি করবে সেটা এখন তোমার ইচ্ছা--।
-আমি----।
-খাও না??লক্ষী না???প্লিজ বিথি???
০৭!!
দুদিন পর;
বিথিটা এখন কিছুটা ভালোর দিকে।তবে মেয়েটার মুখ দেখেই বুঝা যায় সারাক্ষণ কিছু একটা ভাবছে। কি ভাবছে-কেন ভাবছে-কি হয়েছে বা কে কি বলেছে বা কেন বলেছে কিছুই বলছে না।
যা হোক। বাবাও এখন অনেকটা সুস্থ।রিলিজ করতে কোন সমস্যা নেই। বাবাকে বাড়িও দিয়ে আসতে হবে। অফিসের ছুটিও শেষ-সেটা অবশ্য ব্যাপার না। বড় সমস্যা হল বিথিকে নিয়ে। আবার কি করে বসে কখন ঠিক নেই।
হসপিটালে বসে বসে সেসবই ভাবছি। এমন সময় মেহেরের কল এল।
-ভাইয়া-তুই ভাবিকে কি বলেছিস?
-বিথিকে?? কই?? কি বললাম??!!
- ভাবিকে একয়দিন কল করে পাচ্ছি না---। কি হয়েছে বল---।
-আসলে বিথি একটু অসুস্থ----।
-একটু অসুস্থ নাকি বেশি??ঠিক করে বল---।
-কেন??
-ভাবি তো এমনি এমনি আমার কল রিসিভ না করার মতো মেয়ে না---।
-বললাম না তোকে----।
-তুই ভাবির বাসায় গেসিস??
-হুঁম-----।
-আজ গেলে আমার সাথে কথা বলিয়ে দিবি কিন্তু---।
-আচ্ছা বাবা--দিব। এখন রাখ।
-আর ভাবিকে বলবি আমি রাগ করেছি----।
-আর কিছু??
- না;রাখছি----।
-বায়--।
আজ বিথির বাসায় যেতে যেতে সন্ধ্যা হল।হসপিটালে একটু কাজ ছিল।বাসায় গিয়ে দেখি নেহা আর বিথির অন্য বান্ধবীরা বিথিকে ঘিরে বসে আছে।এর মধ্যেও বিথি চুপ করে বসে আছে।আমাকে দেখে সবাই উঠে যাচ্ছে দেখে হেসে বললাম:- আরে তোমরা কোথায় যাচ্ছ?? বসো বসো----।
-আমাদের সামনে তো আপনি বিথিকে বকা দিতে পারবেন না---।
-ওমা!!! বকা দিতে যাব কেন??!!
- আজকে আবার কি নাটক করছে দেখেন--।আবার খাচ্ছে না---।
-বিথি?????
বিথি দুর্বলভাবে একটু হাসার চেষ্টা করল।
-কি??
-কি বলছে আপনার বান্ধবীরা---??
- ওসব কিছু না।।------
-খাচ্ছো না কেন???
---------
-তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ওইদিকে একজন তোমার উপর রাগ করে বসে আছে--।
-কে???
-আগে খাও--। নইলে বলছি না---।
-বলো না প্লিজ--।
- জ্বি না----।
বিথিটা কোনমতে হালকা খেলে ওকে মেহেরের সাথে কথা বলিয়ে দিলাম। বিথি আমাকে রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে মেহেরের সাথে কথা বলল প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা। কি এতো কথা বলল কে জানে!!!
০৮!!
-এই বিথি---??তোমার মোবাইলটা দাও তো--?
-কেন??
-কেন কি??!!!দরকার আছে---। দাও না??
-হুঁম????কি দরকার???
-একটা কল করব---। মোবাইলের সব টাকাই তোমরা দুই ননদ-ভাবিতে মিলে শেষ করে দিলে---।
-ওওওওওও।।।সরি---।
-আরে ধুর পাগলি---। সরি কিসের?? এখন মোবাইলটা দাও----।
-মোবাইল?? মোবাইলটা কোথায় সেটা তো জানি না----।
-তো কে জানে???
-আমি কি জানি--।
-বিথি????
-হুঁম---???
-মোবাইলে কি সমস্যা!!??
-কোন-কোন সমস্যা নেই--। ম-মনে পড়ছে না কো-কোথায় রেখেছি---।
-আচ্ছা আমি নেহাকেই বলি---। ওই দেখুক খুঁজে---।
-তুমি ল্যান্ডলাইন থেকেও কল করতে পারবে তো-----।
-কেন??
বিথি চুপ করে গেল।আমি বিথির দিকে এবারে একটু অবাক হয়ে তাকালাম। এই মেয়েটা কিছু একটা লুকাচ্ছে--।কিন্তু সেটা কি?আর মোবাইলে কি আছে সেটা এখন দেখতেই হচ্ছে।
নেহাকে বলতেই ও মোবাইলটা খুঁজে বের করে আমাকে দিল।আমি হসপিটালে কল করে জানালাম আসতে একটু দেরি হবে। এবার মোবাইলের কললিস্টটা একটু ঘাটাঘাটি করলাম।সব সমস্যার গোঁড়া বোধ হচ্ছে এখানেই।
আমি ভেবেছিলাম আমার কোন বন্ধু বিথির সাথে বাঁদরামি করার জন্য-বা আমার সাথে ঝগড়া বাধিঁয়ে দেয়ার জন্য কল করেছে।এক-একটা যে হারে বদমাঈশ-একটারেও বিশ্বাস নাই। কিন্তু কল লিস্টে যে নামটা দেখলাম সেটা দেখব স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।
বাবা???!!!
বাবা বিথিকে কল করেছিল??!!
বাবা???!!!
কিন্তু কেন?? কি বলেছে?? কেনই বা বলেছে??? বিথি আমাকে সত্যিই সবার থেকে কেড়ে নিবে-এটা সত্যিই বাবা বিশ্বাস করেন????
বিথি আমকে সবার থেকে দূর করে দিচ্ছে-আলাদা করে নিচ্ছে- সংসারটা ছিন্নভিন্ন করে দিবে--- এসব বাবা বলেছে বিথিকে??!!
আর কি বলেছে???
বিথিটা তাই এমন পাগলের মতো বিভেইভ করছে????
কাকে জিজ্ঞেস করব কথাগুলো??
বিথিকে?? নাকি বাবাকে??
কল ডিউরেশনটা দেখলাম। ৩০ মিনিট। ৩০ মিনিটে বাবা বিথিকে কি এমন বলেছে যে মেয়েটা প্রায় মরতে বসেছিল???
আমাকে পাগলের মতো ভালোবেসে কি এতোই বড় অন্যায় করে ফেলেছে মেয়েটা???!!!
এতোই বড় অপরাধ যে-সেটা জীবন দিয়ে শোধ না করলেই নয়???
০৯!!
বিথিদের বাসা থেকে যখন বের হচ্ছি তখন ৯টা-১০টা বাজে।আজ বিথির বান্ধবীরা কেউ ওর সাথে থাকবে না শুনে আমার কেমন জানি ভয় ভয় লাগল।কিন্তু করার কিছু নেই।বিথি কোনমতে আর কাউকে ওর সাথে থাকতে দিবে না।ওর সাফ কথা-ও নাকি পুরোদমে সুস্থ এখন।
এই মেয়েটাকে যে কেমন করে বুঝাই!!!
হসপিটালে এসে দেখলাম বাবা খাবার খেয়ে সবে শুয়েছে।কোনরকম ভনিতা না করেই বাবার সামনে চেয়ারে বসলাম।বাবার চোখে মুখে কেমন রাগী ভাব।সেটা পাত্তা না দিয়ে বাবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম।কথা বলটা সত্যিই খুব জরুরি।
-বাবা---।কদিন আগে বিথির সাথে কথা হয়েছিল তোমার?
-হুঁম----।
-কি বলেছিলে তুমি ওকে??
-তার জবাব কি এখন তোকে দিতে হবে?
-জবাব দিতে হবে কেন? আমি জানতে চাচ্ছি তুমি ঠিক বিথিকে কি বলেছিলে---।
-কেন?? এই তিনদিনে ওই বজ্জাত মেয়েটা তোকে কিছু বলেনি সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
-তুমি বিথিকে কি বলেছ?
-বলেছি তোর মাথাটা যেন আর না খায়-আর আমাদের যেন একটু শান্তিতে মরতে দেয়----।
-বাবা!!!!!
-বাবা বলছিস কেন??খারাপ কিছু বলসি আমি!!!এই মেয়েটা দিনের পর দিন তোর মাথাটা বিগড়ে দিয়ে যাচ্ছে আর আমি সেটা মুখ বুজে মেনে নিব??তোর মা আর তোর বোন বোকা হতে পারে-আমি নই।।
প্রেম ভালোবাসা করা মেয়েগুলো একটা সংসারকে পুরাই দোজোখ বানাই দেয়----।
-বাবা-তুমি বিথিকে বলেছিলে আমাকে আর কল না দিতে???
-বলব না---?সেটা নিয়েও কোন নাটক করেছে নিশ্চয়ই।এই মেয়ে যখন চুপ করে আমার কথাগুলো শুনেছে তখনই বুঝতে পেরেছিলাম-কোন না কোন নাটক করবেই করবে---। হাতে নাতে প্রমাণিত হল---।দেখলি তো???
-বিথি মোটেও নাটক করেনি বাবা--। আমি সেদিন না গেলে হয়ত না খেয়েই মরে যেত----।
আমার কথা শুনে বাবা হো হো করে হেসে ফেলল।
-কি বললি? মরে যেত?? হা হা হা---। এতো নাটকও করতে পারে---। মেয়েটার বাপ-মা কতো বড় ছোটলোক---। সব দেখে শুনেও মেয়েকে সাপোর্ট দিচ্ছে---। হবে নাই বা কেন?? এই মেয়েদের ব্যবসাই এইটা---।
-বাবা----!!!!!তুমি এতোটা খারাপ কথা বলতে পারবে আমি ভাবতেও পারিনি কখনো--। তুমিও শুনে রাখো বাবা-বিথির যদি কিছু হয়- তবে আমিও বাঁচব না---। আর বিথির কাজটা তোমার নাটক মনে হতেই পারে--।কিন্তু তোমার ছেলে যে কোন নাটক করবে না সেটা তুমি ভালো করেই জানো---।
বাবার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।হসপিটালের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রাগে নাকি ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার এখন।বাবা-মানুষটাকে এখন কেমন অচেনা লাগছে।বাবা ঠিক কি কারণে এমন ব্যবহার করছে কে জানে। কিন্তু বিথির ব্যাপারে বাবার রাগের কারণটা বুঝতে পারছি। আমি বিথিকে খুব ভালোবাসি এটাই বিথির সবচেয়ে বড় দোষ।অথচ বাবা আমার জন্য যেরকম মিষ্টি একটা বউ চান-বিথিটা হুবহু তেমন। সবাইকে একসাথে ভালোবেসে আগলে রাখার মতো একটা মেয়ে। একবার মা অসুস্থ হয়েছিল যখন-ও নফল নামাজ পরে মায়ের জন্য দোয়া করেছিল। এটা অবশ্য ও আমাকে বলেনি। ওর ডায়েরিটা না পড়লে কখনো জানতেই পারতাম না। অথচ বাবার ধারণা--বিথি আমাকে সরিয়ে নিচ্ছে উনাদের থেকে। মেহের হয়ত বিথির কথা মাকে বলেছে--আর মা হয়ত বাবাকে।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানিও না। ছাড়া ছাড়া ঘুম হল সারারাত।ঘুমটা ভাঙল সাতটা-সাড়ে সাতটার দিকে। মোবাইলের তোলপাড়ে।ঘুমটা কাটেনি তখনও।থেমে গিয়ে দু সেকেন্ড পর আাবার নড়ে উঠল।নামটা দেখে অবাক হলাম--।
এতো সকালে নেহার কল???!!!
আবার কি হয়েছে বিথির??!!
ভালো আছে তো মেয়েটা???!!!
১০!!
-হ্যালো নেহা--।বলো---?
-----------------
-হ্যালো?????
-ভাইয়া--- আপনি এখন প্লিজ একটু বিথির বাসায় আসেন----। প্লিজ প্লিজ?? আর্জেন্ট----।
কলটা কেটে গেল।ঘুমটা তখনো কাটেনি।তবু কেন জানি মনে হল নেহার গলাটা কেমন ভারি ভারি।
কোনমতে উঠে বিথির বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।বিথির বাড়ির দিকে রওনা দিয়ে রাতের ছাড়া ছাড়া আধো ঘুমের স্বপ্নগুলো মাথায় বার বার খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। কখনো দেখছি বিথি ভিষণভাবে কান্নাকাটি করছে। কি নিয়ে এতো কান্নাকাটি সেটা বুঝলাম না। কখনো দেখছি- বিথি কোথাও চলে যাচ্ছে-আমি কোনমতে ওকে আটকাতে পারছি না।আবার কখনো একটা জায়গায় বেড়াতে গেছি বিথিকে নিয়ে-কিন্তু ফেরার সময় আর বিথিকে পাচ্ছি না-আর আমিও পাগলের মতো খুঁজছি-এদিক ওদিক ছুটছি-কিন্তু বিথিকে কোথাও পাচ্ছি না।
এই মেয়েটার চিন্তায় কিসব উদ্ভট উদ্ভট খেয়াল আসছে মাথায়!!!পাগল হয়ে যাব মনে হচ্ছে!!!
বিথিদের বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে একটু যেমন অবাক হলাম-তেমনি ভয়ও পেলাম।সহজেই বুঝা যাচ্ছে-ভিতরে অনেক মানুষ।
এতো মানুষ কেন??
আশ্চর্য!!!বিথি সুস্থ হওয়ায় সবাই একসাথে দেখতে এসেছে নাকি!!!সবে মাত্র একটু সুস্থ হতে শুরু করেছে এতো মানুষ ভিড় করলে না হিতে বিপরীত হয়!! কথাটা আঙ্কেলকে বলব চিন্তা করে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম।যে যার মতো পানসে মুখে বসে আছে।কেউ কাঁদো কাঁদো মুখে পায়চারি করছে। কারো বাড়ি এসে এতো কান্না কাটি মুডে থাকার মানে কি!!??
এদিকে এতো ভিড়ে নেহাকে কোথাও দেখছি না। বিথির বাবা-মা তাঁরাও যে কোথায় কে জানে!!!
বিথির রুমের দিকে যাব কি যাব না সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।কি ভেবে রওনা দিলাম।মাঝপথেই নেহাকে পেয়ে গেলাম।
-এই যে নেহা--। এতো মানুষ কেন আজ এখানে??বিথিটাতো আরো অসুস্থ হয়ে যাবে-----।
কেন জানি নেহা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।মেয়েটার চোখ মুখ অসম্ভব রকমের ফুলে গেছে।
-কিরে ভাই??!! তোমার আবার কি হল?? বান্ধবীর চিন্তায় সারা রাত কান্নাকাটি করেছ মনে হচ্ছে---।আর চিন্তা করো না-সব ঠিক হয়ে যাবে----।
-আঙ্কেল-আন্টি আপনাকে কিছু---কিছু বলেনি??!!
-উনাদেরকে তো খুঁজছি--।এতো মানুষ---------কিভাবে একটা মানুষকে---একদিনে-------।
-ভাইয়া-----।আপনি একটু শান্ত হয়ে বসেন--।
-বিথিকে একটু দেখে আসি---।সেখানেও এতো ভিড় করে নাই তো----?
-এইটা পড়ে নিন---। তারপর যাইয়েন।
-হুঁম???এইটা কি??
-বিথি দিয়েছে------।
-আচ্ছা-একটু পরেই না হয় যাচ্ছি---। ওকে বলো আমি এসেছি----।
নেহা আরেকবার মুখ করুণ করে টলতে টলতে সরে গেল।এই মেয়েটাও একটু আজিব??!!
যা হোক-বিথি কি লিখেছে সেটা পড়ার জন্য একটু কৌতূহল হচ্ছে।মেয়েটা আমাকে কখনো কোন চিঠি লিখেনি আজ পর্যন্ত। অবশ্য লিখেনি বললে ভুল হবে। আমার হাতে এসে পৌঁছায়নি চিঠিগুলো।তার অবশ্য কারণ ও চায়নি লেখাগুলো আমি পাই।
ছোট খাটো একটা চিঠি।মুক্তার মতো গোটা গোটা হাতের লেখা।
"আবির,
তুমি জানো??এই পৃথিবীতে কাউকে ভালোবাসাটা সবচেয়ে বড় অপরাধ।যেই মানুষটাকে তুমি খুব ভালোবাসবে তাকে ছাড়া তুমি বাঁচতে পারবে না-আর তার সাথে কেউ তোমাকে বাঁচতে দিবে না।কি আশ্চর্য না?
বাবা যেদিন আামাকে বলেছিল-তোমার জীবন থেকে-তোমার ভাবনা-তোমার নিজস্ব গন্ডি থেকে যেন আমি অনেক দূরে চলে যাই-নয়ত উনি মরে যাবেন-সেদিন থেকে বেঁচে থাকার আর এক বিন্দু ইচ্ছে ছিল না।এক বোতল ঘুমের ওষুধের সবকটা একসাথে খেয়ে ফেলতে পারিনি-শেষবারের মতো তোমাকে একবার দেখার আশায়। অথচ তুমি যখন এলে-মরাটা আর হয়েই উঠল না--। তোমাকে না করতে পারি না যে-।
কিন্তু-তুমি যখন জেনে গেছ বাবা কল করেছিল-তখন থেকে মনে হচ্ছিল-বাবার কথাটাই সত্যি হতে যাচ্ছে-আমি আসলেই তোমাকে তাদের কাছ থেকে দূর করে দিচ্ছি---।এটা তো হতে পারে না আবির।কখনো না---।
শেষ বারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ।
আর তুমি ভালো থেকো।বাবার পছন্দ করা মিষ্টি একটা মেয়েকে বিয়ে করে জীবনটা শুরু করবে।একটুও কাঁদবে না কিন্তু---প্লিজ"
শেষের দিকে লেখাগুলো কেমন টেনে টেনে লেখা।পড়ে মাথাটা একটু ঘুরে উঠল।কি বলে মেয়ে!!
বিথির রুমের দিকে ছুটে গেলাম।বিথিটা কালকের মতো বিছানায় শুয়ে আছে।চারপাশে অনপক লোকজন।এর মধ্যেও বিথি যেন কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।মুখটা একেবারে হলদে-রক্তহীন হয়ে আছে।তবুও ঠিক পরীর মতো লাগছে বিথিকে। কোনমতে মাথার পাশে গিয়ে বসলাম।হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে কয়েকবার নাম ধরেও ডাকলাম।হাতটা একদম ঠান্ডা হয়ে আছে।পাগলের মতো হাতটা ঘসে একটু গরম করার চেষ্টাও করলাম।
-প্লিজ বিথি---।একবার তাকাও----।
আজকে আমার কাতর আবেদন আর বিথির কানে গেল না।আজ আর বিথি চোখ খুলে অবাক চোখে আমাকে দেখে লজ্জা পেল না।একটা নিষ্পাপ ভালোবাসার এমন পরিণতি মেনে নিতে পারছি না।সত্যিই কি বিথিকে ভালোবাসাটা আমার দোষের ছিল??
কতোক্ষণ বসেছিলাম এভাবে বিথির হাত ধরে জানি না। মোবাইলের ভাইব্রেশনে ফোনটা কানে লাগালাম।
-আবির...????তুই আবার ওই বদমাইশ মেয়ের সাথে দেখা করতে গেছিস----????
এবারে আর একটা কথাও গলা দিয়ে বের হল না।অনেকক্ষণের আটকে রাখা বৃষ্টির যেন বাঁধ ভাঙল।
***(সমাপ্ত)***