প্রাক্তন by মুশফিকা রহমান মৈথি |
প্রাক্তনের সাথে দেড় বছর পর দেখা হলো, মজার ব্যাপার সে এখন শুধু যে আমার প্রাক্তন নয় আমার এক কলিগ বন্ধুর বাগদত্তা। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে এতো স্বাভাবিক ভংগিমায় হাসলো যেন কিছুই হয় নি সব স্বাভাবিক। আমার রাগে গা রি রি করছে। কয়েকটা থাপ্পড় মারতে পারলে রাগটা কমতো। এই তিন মাস আগেও আমাকে মেসেজ দিয়েছিলো। আর এখন অন্য কারোর সাথে ঘুরছে। কিছুই করার নেই। আর বসে থাকতে না পেরে হাটা শুরু করলাম।
আমি ঢাকার প্রসস্থ রাস্তায় হাটছি, এতোদিন প্রাক্তনের কথা ছিটাফুটাও মনে ছিলো না। আজ এতো দিন পর সামনে এসে আমাকে সেই আগের স্মৃতি গুলা মনে করিয়ে দিয়েছে। মেয়েটার নাম মায়া। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা কলেজের গেটে। মায়া এমন মেয়ে যার দিকে ভুলেও কারোর নজর পরতো না, আর নজর পরলেও লাভ হতো না কারণ সে কারোর সাথেই কথা বলতো না। আমরা এটা নিয়ে হাসাহাসি কম করতাম না। আমার গ্রুপটা অনেক বড় ছিলো, আমার বন্ধুদের সংখ্যা বেশি ছিল এবং সবচেয়ে ধুরন্ধর টাইপ, যাদের এক কথায় বাদর উপাধি দিতে হয় তারাই আমার গ্রুপে ছিলো। আমাদের কাজই ছিলো অন্যদের নিয়ে মক করা। বিশেষ করে মায়ার মত মানুষদের। মায়া দেখতে আহামরি সুন্দর ছিলো না, লম্বাটে মুখ, টানা টানা চোখ, সেই চোখের উপরে একটা চশমা। হিজাব পড়তো, খুবই ব্যাকডেটেড পোশাক পড়তো। বোরখা না কিন্তু এক কথায় আলখাল্লাহ। লম্বা বেশি না পাচ ফুট এক হবে। ওর স্টাইল নিয়ে ক্লাসের সবাই খিল্লি উরাতো। কিন্তু মেয়েটার নামের মতো কেন জানি ওকে দেখলেই মায়া লাগতো।
আমার সাথে ওর মতো মেয়ের রিলেশনটা অনেকটা নাটকীয় ভাবেই হয়েছে, প্রথমে একই সাথে প্রাকটিক্যাল ক্লাসে একই গ্রুপে পড়া, সেই সুবাদে ওর সাথে বন্ধুত্ব তারপর বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। যদিও আমি রিলেশনে ততটা সিরিয়াস ছিলাম না। কারণ ওর সাথে রিলেশন হবার পর ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে অনেক টিটকারি শুনেছি। ও অনেক সিরিয়াস ছিলো রিলেশনে। রাত রাত ফোনে কথা বলা, ঘন্টায় ঘন্টায় মেসেজ। বুঝাই যাচ্ছিলো আমি ওর প্রথম বয়ফ্রেন্ড ছিলাম।
মায়া বড্ড ছেলেমানুষী করতো, ওর ছেলেমানুষী খুব ইরিটেট করতো আমাকে। আবার ব্রেকাপ ও করতে পারছিলাম না কারণ মেয়েটা কান্নাকাটি করতো। ওর কান্নাকাটি ভালো লাগতো না৷ ওর ছেলেমানুষীর উদাহরণ দেই, আমার জন্মদিনে সবার আগে উইশ করেছে বলে ওর জন্মদিনে চাবে যাতে আমি সবার আগে উইশ করি। আমার ফোনের অপেক্ষায় মোবাইল নিয়ে সারারাত বসে থাকবে। কিন্তু আমার তো মনে থাকে না তাই আমি হয়তো বেঘোরে ঘুম। আর ও সারারাত কান্নাকাটি করবে। আমার অবশ্য এসব অনেক বিরক্ত লাগতো। যখন কাউকে পেতাম না তখনই ওকে ফোন দিতাম। এমন ও দিন গেছে দেখেও ওর ফোন ধরতাম না, ফোন বাজতো বাজুক। এদিকে ও ভয়ে একসার। আমার সব বন্ধুকে ফোন দিয়ে খোঁজ দিবে। পরে এটা শুনে আচ্ছা মত ধমকাতাম। বন্ধুদের সামনেও ওকে অপমান করতে আমার গায়ে বাধতো না। আমার সব অপমান গুলোও হাসিমুখে মেনে নিতো কিভাবে মেনে নিতো কে জানে! আমি যে ওকে ভালোবাসতাম না তা নয়, খুব ভালোবাসতাম কিন্তু আগের রিলেশনগুলো থেকে শিক্ষা নেয়া মেয়েদের বেশি ভাউ দিতে নেই। নয়তো মাথায় উঠে নাচানাচি করবে। তাই ওকে এমন দায়ছাড়া ভাব দেখাতাম।
রিলেশনের ৩ বছরের মাথায় আমার চাকরি হয়, চাকরির সুবাদে প্রথমে চিটাগং এ পোস্টিং হয়। ধীরে ধীরে ওর সাথে যোগাযোগ কমে যায়। ও ফোন দেয় ব্যস্ততার কারনে ধরা হয় না। আমার জন্য রাত পর্যন্ত সজাগ থাকত এই ভেবে যে আমি ফোন দিব। প্রথম প্রথম হুট হাট করে চিটাগাং চলেও আসতো বিভিন্ন বাহানায়। আমার ভালো লাগতো বেপার গুলো, এটেনশন পেতে কার না ভালো লাগে। এর পর শুরু করলো বিয়ে নিয়ে পেতর পেতর। আরে ভাই মাত্র চাকরি পেলাম, একটু স্যাটেল হই তারপর। ফোন করলেই বলতো,
- বাসায় তো চাপ দিচ্ছে, বিয়ের কথা বলছে, বিয়ের প্রস্তাব আসছে, কি করবো?
- আমি তো বলেছি এখন বিয়ে করতে পারবো না।
- কিন্তু বাসায় চাপ দিচ্ছে, আমি কি বলবো?
- তাহলে বিয়ে করে নেও, আমাকে জ্বালিয়ো না প্লিজ।
ও কিছু বলতো না, নিঃশব্দে কাঁদতো। কাঁদুক, আমার কি! আমার লাইফ আছে, ক্যারিয়ার আছে। ওর জন্য সেগুলো তো বাদ দিতে পারবো না। ধীরে যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম, ইগনোর করতাম। ফোন ধরতাম না, একপর্যায়ে রিলেশনটা বিরক্তিকর মনে হতে লাগলো। আমি ওকে ফেসবুক, ফোন সব কিছু থেকে ব্লক করা স্টার্ট করলাম। আমাকে মেসেজ করতো, কথা বলতে চাইতো। আমি ইগনোর করতাম। তারপর ঢাকায় পোস্টিং হয়। একদিন চিটাগং এর এক কলিগ ফ্রেন্ড বললো, ও নাকি ওখানে আমার খোঁজে এসেছিল। আমি তাতেও মাথা ঘামালাম না। আসি তো ওকে বাদে সুখে। তিন মাস আগেও রোজ মেসেজ করতো,
- প্লিজ একটা বার কথা বলো, কি করেছি আমি যে এভাবে আমাকে ইগনোর করছো। প্লিজ আমার সাথে কথা বলো।
এরপর আর মেসেজ আসতো না, আমার কৌতুহল হতো। কিন্তু আমি খোঁজ নেই নি, ও ঘুরুক না আমার পেছনে ক্ষতি কি। আজ তিন মাস পর অন্য কারোর সাথে দেখে কেন জানি খুব মেজাজ খারাপ হতে লাগলো নাহ ওর সাথে কথা বলতেই হবে।
আমি আর মায়া পার্কে বসে আছি। আশেপাশের মানুষ খুব কম। বিকেল বেলা অথচ মানুষ এতো কম কেন বুঝতে পারছি না। অনেক কষ্টে মায়াকে খুঁজে বের করলাম, নাম্বার টা এখনো আগেরটাই আছে, কিন্তু ব্লক লিষ্ট থেকে বের করতে মেলা ঝামেলা ভোগ করতে হয়েছে। কি দিয়ে কথাটা শুরু করবো বুঝতে পারছি না। তখন ওই বলে উঠলো,
- কেমন আছো? অনেক দিন পর তোমাকে দেখছি, এক বছর পাঁচ মাস একুশ দিন। অনেক দিন।
- তুমি গুনেও রেখেছো।
- তুমি তো জানোই আমি দিন তারিখ ভালোই মনে রাখি। তো বললে না যে কেমন আছো?
- তুমি রকিবকে বিয়ে কেন করছো?
- মা বাবার পছন্দ তাই আমিও মানা করি নি। ওরা খুশি থাকলে আমিও হ্যাপি।
- সত্যি? সেই তো তিন মাস আগেও আমার জন্য পাগল ছিলে। এতো তারাতাড়ি অন্যের প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেলো?
- হ্যা ছিলাম, কিন্তু পরে ভাবলাম যার কাছে আমার ফিলিংসের দাম নেই অহেতুক তার জন্য আমার কাছের মানুষগুলোকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয় না। আর তাড়াতাড়ি কোথায়? এক বছর পাঁচ মাস এটাকে তুমি তাড়াতাড়ি বলছো? এই এতোদিনে তুমি একবার ও আমার খোঁজ তো দূরে থাক, আমার মেসেজ এর একটা রিপ্লাই ও দেও নাই। উল্টো আমাকে ব্লক করে রেখেছিলা। তোমার খোঁজ করতে আমি চিটাগং ও গিয়েছিলাম জানো নিশ্চয়ই। এরপর ও বলবে তাড়াতাড়ি? একটা কথা কি জানো তুমি যদি আমাকে বলতা মায়া আমার কিছু সমস্যা আছে, প্লিজ আমার জন্য ওয়েট করো। আমি সারাজীবন ওয়েট করতেও রাজি ছিলাম। কিন্তু তোমার কাছে আমার কোনো দাম ছিলো না। আর রকিবের প্রতি ভালোবাসার কথা বলছো, জানি না ভালোবাসতে পারবো কিনা তবে আমি সুখে থাকা শিখে গেছি। এখন আর আমি তোমার জন্য কাঁদি না। এখন আর আমার কারোর অবহেলাতে কিছু যায় আসে না। আচ্ছা আমি উঠি, রকিব ফোন করেছিলো আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে নাকি৷ আর একটা কথা রকিব আমাদের বেপারে জানে তাই সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। আসি কেমন, ভালো থেকো আর ভালো রেখো।
মায়া চলে যাচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আটকানোর সাহস নেই। কি দিয়ে আটকাবো। ওর শান্ত গলায় কথাগুলো আমার কলিজায় যেয়ে লাগছে, খুব কষ্ট হচ্ছে জানি না কেন। যাকে অবহেলায় হারিয়েছি, তাকে না পাওয়ার কষ্ট। একটা কথা আছে না, না পেলে কষ্ট যত হয়, পেয়ে হারিয়ে ফেললে আরোও বেশি কষ্ট হয়। আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না। বসে আছি সেই বেঞ্চিতে। চোখ থেকে নোনাজল পড়বে পড়বে ভাব, পড়ুক সমস্যা কি!
***(সমাপ্ত)***