রুপকথার খোঁজে - মুশফিকা রহমান মৈথি - অনু গল্প

পড়ুন মুশফিকা রহমান মৈথি'র লেখা একটি অনু গল্প রুপকথার খোঁজে
রুপকথার খোঁজে
রুপকথার খোঁজে by মুশফিকা রহমান মৈথি

১!!

নিজের প্রাক্তনকে ননদের হবু বরের স্থানে দেখে কিঞ্চিত চমকে উঠলো রুহামা। বুকের ভেতর এক অজানা উচাটন শুরু হলো। এই উচাটনের অনুভূতিটা বড্ড নতুন। পৃথিবীটা গোলাকার জানা ছিলো, তবে আনুমানিক সতেরো কোটি মানুষের মাঝে সাঈদকেই আদিবার হবু স্বামী হতে হবে এই আশ্চর্য কাকতালীয় ব্যাপারখানা কিছু্তেই হজম হচ্ছে না তার। সাঈদ রুহামার স্বামীর অফিসে কাজ করে। ভালো ছেলে বলে তার সুনাম আছে। তাই নিজের বোনের সাথে এই বিয়ের সম্বন্ধ করে সে। কিন্তু সেই ভালো ছেলেটি তার স্ত্রীর প্রাক্তন হবে সেটা কে জানতো। একরাশ বিস্ময়, আক্ষেপ, ভয় এবং কিঞ্চিত বেদনাপ্রবণ চোখে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রুহামা। সাঈদ এক পলক রুহামার দিকে চাইলো, বিস্ময়ের সূক্ষ্ণ ছাপ তার মুখে, হয়তো সেও রুহামাকে এখানে আশা করে নি। এর মাঝেই রুহামার শাশুড়ী সুমাইয়া বেগম মৃদু স্বরে বলে উঠলেন,
 “বউমা, যাও তো আদিবাকে নিইয়ে এসো”

পা জোড়া নিথর হয়ে আছে রুহামার। অতীতের পৃষ্ঠাটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। কেনো যেনো নড়তেই চাইছে না শরীর। শাশুড়ীর কথাটা শুনেও কেনো যেনো সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। রুহামাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার স্বামী আকরাম তার গায়ে আলতো করে ধাক্কা দেয়। আকরামের ধাক্কায় স্বম্বিত ফেরে রুহামার। আড়ষ্টতার সাথে সে জিজ্ঞেস করে,
 “জ্বী?”
 “মা, তোমাকে কিছু বলছে। শুনছো না কেনো?”
 
আকরামের কিঞ্চিত ঝাঁঝালো কন্ঠে বেশ বিব্রতবোধ করলো রুহামা। তারপর কোনো কথা না বলেই আদিবাকে আনতে পা বাড়ালো। তার সাথে আকরামের বিয়ে হয়েছে দু মাস হতে চললো, বর হিসেবে আকরামকে ঠিক কোনো ক্যাটাগরীতে ফেলা যায় বুঝে উঠতে পারে না রুহামা। সর্বদাই একটা গাম্ভীর্য তার মুখশ্রীতে আঠার ন্যায় লেগে থাকে। সামান্য কথাতেও ঝাঁঝালো আভাষ পাওয়া যায়। রুহামার সাথে বিয়েটা তার পারিবারিক ভাবেই হয়েছিলো। বাবা-মায়ের বাধ্য কন্যা হিসেবে এই গম্ভীর মানুষটাকে বিয়ে করার সময় কোনো আপত্তি জানায় নি রুহামা। কারণ সে প্রায় গল্পে পড়তো বর নামক মানুষগুলো গম্ভীর হয়। তারা বাহিরে যেমন নারিকেলের ন্যায় শক্ত ভেতরে শাঁসের ন্যায় নরম। কিন্তু আকরামের ক্ষেত্রে কথাটা প্রযোজ্য নয়, সে ভেতরেও বাহিরের ন্যায় ই কঠিন। তাই তো তার কথাগুলো শুরু টা হয়, “রুহামা তুমি এমন কেনো? কেনো কিছুই কি হয় না তোমার দ্বারা?” আর শেষ হয়, “আমার এগুলো একেবারেই সহ্য হয় না, এজন্য মাকে বলেছিলাম, বয়সে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিও না আমার সাথে”। হ্যা, আকরাম তার থেকে বেশ বড়। সরকারী চাকরীওয়ালা বিধায় বাবা তার বয়সটাকে অগ্রাহ্য ই করেছেন। রুহামাও তাই করেছে। বয়স দিয়ে কি হবে? মানুষটির মনের বয়সের মিল হলেই চলবে। 
 
আদিবা একটি সবুজ শাড়ী পড়েছে, লম্বা চুলগুলো খোঁপার বেঁধেছে। মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। হালকা সাজসজ্জায় একেবারে উপন্যাসের নায়িকাদের ন্যায় ঠেঁকছে রুহামার কাছে। মৃদু হেসে বললো,
 “চলো ননদিনী, মা ডাকছেন”
 “আমায় কেমন লাগছে গো ভাবী?”
 “খুব সুন্দর, পাত্রপক্ষ চোখ সড়াতেই পারবে না” 
 “তাকে দেখেছো?”

আদিবা ঈষৎ লাজুক স্বরে কথাটা বললো আদিবা। প্রশ্নটা খুব কঠিন নয়, কিন্তু কেনো যেনো রুহামার প্রচ্ছন্ন হৃদয়ে কৃষ্ণমেঘেরা হানা দিলো। হ্যা দেখেছে, সাঈদের প্রসন্ন মুখখানা নজর এড়ায় নি রুহামার। সাঈদের সাথে রুহামার বিচ্ছেদটা ঠিক কবে হয়েছিলো মনে পড়ছে না তার, তবে এটুকু মনে আছে সেদিন খুব কেঁদেছিলো রুহামা। কাঁদবেই না কেনো? প্রথম প্রেম বলে কথা। এখন সাঈদের স্মৃতি গুলো ঝাপসা হলেও তখন জীবন্ত ছিলো। মাংস কাটলেও এতোটা যন্ত্রণা হয় না, যতটা আশায় টুইটুম্বুর হৃদয় ভাঙ্গলে হয়। সূক্ষ্ণ চিনচিনে অসহ্য যন্ত্রণা। 
 “কি হলো ভাবী, বলো?”
 “হু, দেখেছি”
 “কেমন দেখতে? ছবির মতোই?”
 “ঠিক বলতে পারছি না, কারণ আমি ছবিটি দেখি নি”
 
মেকি হাসির প্রলেপ লেপ্টে কথাটা বললো রুহামা। আদিবা তখন একরাশ বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
 “কেনো?”
 “তোমার ভাই এর কাছে চাইতেই কড়া স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি জেনে কি করবে?’ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ছিলো না, তাই দ্বিতীয়বার আর চাই নি। আসলেই তো আমি দেখে কি করবো?”
 “বাহ রে! তোমার কোনো মতামত নেই?”
 “আছে, তবে প্রযোজ্য কি না বুঝতে পারছি না। বাদ দাও আমার কথা, মা ডাকছেন। চলো, নয়তো মহারাজের হুংকার শুরু হবে”
 “ভাইয়াকে খুব ভয় পাও তাই না?”

রুহামা উত্তর দিলো না, কারণ সে উত্তরটি নিজেই জানে না। আকরামকে সে ভয় পায় কি না তার জানা নেই। তবে বেশ শ্রদ্ধা করে সে। আকরামের ছোট তিন বোন, আদিবা ব্যাতীত বড় দুজনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। একজন থাকে ময়মনসিংহ, ছেলের পরীক্ষা বিধায় আসতে পারলো না। আর আরেকজন দেশের বাহিরে থাকে। প্রতিবছর দেশে আসার কথা থাকলেও এই মহামারীর জন্য সে আসতে পারছে না। বর্ডার এই খোলা তো এই বন্ধ। তাই এই মহামারীর অন্ত হলেই আফিয়া দেশে আসবে। বোনেদের বিয়ে দেবার জন্য নিজের সংসারের কথা সে চিন্তা করে নি, অবশেষে সুমাইয়া বেগমের জোরাজোরির কাছে নতমস্তক হতে হলো তার। বিয়ে করতে হলো নিজ থেকে ন বছরের ছোট রুহামাকে। রুহামার মাঝে মাঝে মনে হয়, লোকটি হয়তো বয়সের ব্যাবধানের জন্য রুহামাকে বুঝতে পারে না। এটা অবশ্য ভুল নয়, সময় পাল্টাচ্ছে। রুহামা নিজেই তার একাদশ শ্রেণীতে পড়া বোনের সাথে নিজের চিন্তাধারার কোনো মিল পায় না। 

আদিবাকে তার শাশুড়ী আংটি পড়িয়ে দিলো। রুহামা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাঈদের ঈষৎ বিব্রত মুখোপানে। রুহামাকে দেখবার পর ই তার প্রসন্নতা ঢাকা পড়েছে আড়ষ্টতার আড়ালে। এই ভাবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি একটা সময়ে রুহামাকে দিয়েছিলো সে। সম্পর্কের সময়ে প্রায়ই রুহামা তাকে শুধাতো, 
 “আমাদের বিয়ে হবে তো? আমাদের রুপকথার ইতি সুন্দর হবে তো?”

সাঈদ হেসে বলতো,
 “না হলে আমি তো আছি”

হ্যা সে ছিলো অবশ্য, কিন্তু এখন সব অতীত। এখন রুহামার ভবিষ্যত কেবল গম্ভীর আকরাম। 

পাত্রপক্ষ এবার উঠে দাঁড়ালো, তারা বাসার জন্য রওনা দিবে। সাঈদদের বাড়িটি পুরান ঢাকার কাছাকাছি, উত্তরা থেকে বেশ দূরে। তাই সন্ধ্যা নামার আগেই তারা রওনা দিবে। সুমাইয়া বেগমের বয়স হবার কারণে তিনি গেট অবধি এগিয়ে দিতে গেলেন না। তার বদলে আকরাম এবং রুহামাই পাত্রপক্ষকে গেট অবধি এগিয়ে দিতে নামলো। সিএনজি তে উঠার পর যেই সিএনজি চালক গাড়ি ছাড়বে তখনই তাকে থামতে বললো সাঈদ, সিএনজি থেকে নেমে পকেট হাতড়াতে থাকলো সে। আকরাম সাঈদের এরুপ কার্য দেখে জিজ্ঞেস করলো,
 “কি হয়েছে সাঈদ?”
 “ভাই, আমার মোবাইল টা বোধ হয় আপনাদের সোফায় রেখে এসেছি”
 “তুমি দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি”

আকরাম লিফটে উঠলো। রুহামা যাইতে চাইলে তাকে গম্ভীর গলায় বললো,
 “তুমি এখানে থাকো”

রুহামার অস্বস্তিতে গা গুলোচ্ছে, প্রাক্তনের সাথে দাঁড়িয়ে থাকাটা এতোটা বিশ্রী অনুভূতি আগে জানা ছিলো না তার। একটা সময় ছিলো যখন এই মানুষটার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতো, আড্ডা দিতো। অথচ আজ পাশাপাশি দাঁড়াতেই বিরক্ত লাগছে রুহামার। ঠিক তখনই সাঈদ জড়তা জড়ানো গলায় বলে উঠে,
 “কেমন আছো রুহামা?”

রুহামা সরু নজরে চাইলো সাঈদের দিকে, চোখে ক্রোধের ঝলকানি। ‘কেমন আছো?’ এই প্রশ্নটি কি আদোপি সাজে এই লোকটির মুখে। বছর কতক পড়ে কি দরদ উতলে উঠেছে? নাকি সে তলিয়ে দেখছে রুহামা কেমন আছে? এখন ও কি সেই রুহামা আছে যে কিনা তার অপেক্ষায় বিভোর থাকতো, তার কষ্ট হলে নিজে ঘুমড়ে মরতো। যখন নির্দয়ের মতো বলেছিলো, ‘রুহামা, তোমার প্রতি ভালোবাসাটা মরে গেছে। আমরা একই সাইকোলোজিক্যাল ফেজে নেই’ তখন তাকে হাতে পায়ে ধরে বলেছিলো ‘আমাকে ছেড়ে যেও না, কিভাবে নিজেকে বদলাবো বলে দাও’। এখন কথাগুলো ভাবতেই একরাশ ক্ষোভে ভেতরটা জ্বালা করতে লাগলো রুহামার। চোয়াল হয়ে গেলো কঠিন। স্বরে জড়তার বালাই না রেখে প্রচন্ড ক্ষোভে বলে উঠলো,
 “আমার কি খারাপ থাকার কথা সাঈদ?”
 “সেভাবে বলি নি”
 “কিভাবে বলেছো সেটা বুঝানোর প্রয়োজন নেই, আমি বুঝি। শোনো আমি খুব ভালো আছি, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার। তুমি তোমাকে নিয়ে ভাবো। আর একটা কথা, আদিবা আকরামের আদরের বোন, তার সাথে অন্তত সাইকোলোজিক্যাল ফেজটা মিলিয়ে নিয়ো। এবার যদি সেটা না মিলে, তবে কিন্তু আকরাম তোমাকে ছেড়ে দিবে না। সে দেখবে না তুমি তার জুনিয়র কি না”
 “তুমি আমায় ক্ষমা করো নি তাই না?”

সাঈদের মুখে এই প্রশ্নটি শুনে আবারো অবাক হয় রুহামা। সে সাঈদকে ক্ষমা করে নি বললে ভুল হবে, ক্ষমা সে বহু পূর্বেই করেছে। কিন্তু প্রাক্তনের সাথে এক অযাচিত তিক্ততা জড়িত থাকে। উপরন্তু লোকটি তার ননদের হবু স্বামী, তাই তিক্ততার সাথে কিঞ্চিত ভয়ও হচ্ছে। আদিবার পরিণতি যদি তার ন্যায় হয়, সাঈদ মানুষটিকে সে খারাপ বলবে না। তাদের সম্পর্কের দিনগুলোতে অনেক সুন্দর স্মৃতি আছে। শুধু হুট করেই সাঈদ একদিন বললো, 
 “রুহামা, তোমার প্রতি ভালোবাসাটা মরে গেছে। আমরা একই সাইকোলোজিক্যাল ফেজে নেই। আমাদের কোনো ভবিষ্যত নেই। তুমি আরোও ভালো ছেলে পাবে”

কথাগুলো বেশ উটকো লেগেছিলো রুহামার। সেদিন ভেঙ্গে গিয়েছিলো সে। রুহামা চায় না আদিবার সাথে এমন কিছু হোক। তাই সাঈদের প্রতি তার এমন বৈরী আচরণ। রুহামা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে বলল,
 “অতীতে মানুষ ভুল করে, তুমিও করেছো আমিও। সেই ভুল শুধরে নেওয়াই বুদ্ধিমানের। আমি আকরামের সাথে সুখে আছি। তুমি আদিবাকে সুখে রাখার চিন্তা করলেই ভালো। এখানে দুটো মানুষের জীবন নয়, দুটো পরিবার জড়িত। এটা বিয়ে, কোনো প্রেম নামক সস্তা রিলেশন নয়। আশাকরি বুঝেছো”

ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বললো রুহামা। রুহামার কথাগুলো শুনে ঈষৎ অবাক হয় সাঈদ। ছেলেমানুষ রুহামার ঝলক নেই আজ। এ যেনো পূর্ণাঙ্গ রমনী। সাঈদের মনে এক অজানা আক্ষেপ হাতছাতি দিলো। রুহামা কথাগুলো বলেই ঘুরে দাঁড়ালো। আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তখনই নজরে পড়লো আকরাম তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আকরামের চোখজোড়া রক্তিম হয়ে আছে। চোখজোড়ায় চোখ রাখতে ভেতরটা কেঁপে উঠলো রুহামার। কিছু বলবে তার আগেই………

২!!

রুহামা কথাগুলো বলেই ঘুরে দাঁড়ালো। আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তখনই নজরে পড়লো আকরাম তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আকরামের চোখজোড়া রক্তিম হয়ে আছে। চোখজোড়ায় চোখ রাখতে ভেতরটা কেঁপে উঠলো রুহামার। কিছু বলবে তার আগেই আকরাম হনহন করে এগিয়ে এলো তার এবং সাঈদের দিকে। আকরাম উপর থেকে কখন ফিরে এসেছে জানা নেই তার, কথা বলার সময় পারিপ্বার্শিক জ্ঞান ছিলো না রুহামার। এই কথোপকথনের ঠিক কতটুকু আকরাম শুনেছে তার জানা নেই, তবে আকরামের মুখভাবে ভালো কিছুর আভাস পেলো না রুহামা। বরং ঈষৎ ভয় তাকে নাড়া দিচ্ছে। ভয় পাবার কোনো কারণ অবশ্য নেই, সাঈদের সাথে তার কথোপকথন অমার্জিত বা সন্দেহজনক ছিলো না। কিন্তু ওই যে, একটা তিক্ত শব্দ ‘প্রাক্তন’ জড়িয়ে আছে সাঈদের সাথে। সুতরাং আকরাম ক্রোধিত হলেও অনুচিত হবে না। রুহামা একবার সাঈদের মুখের দিকে তাকালো, সে ঘেমে নেয়ে একসার হয়ে আছে। মাঘের প্রচন্ড শীতেও তার কপালে ঘামের পরদ। রুহামা মনে মনে আকাশকুসুম চিন্তা করতে ব্যাস্ত, ঠিক তখনই তাকে অবাক করে আকরাম একটা ফোন সাঈদের দিকে এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
 “এই যে তোমার জিনিস, সামলে রাখো। বলা যায় না কখন হাতছাড়া হয়ে যায়”

আকরামের ছন্নছাড়া কথার কি মানে বুঝলো সাঈদ জানা নেই, তবে সে একরকম সালাম দিয়েই ছুটে পালালো। সাঈদ চলে যাবার পর আকরাম এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়ালো না, হনহন করে লিফটে উঠে পড়লো। রুহামাও পিছু নিলো। আড়ষ্টতায় জবুথুবু হয়ে রয়েছে সে। আকরামের থমথমে মুখখানা আরো বেশি অস্বস্তিতে ফেলছে তাকে। তার মুখে একটা কথাও নেই, সে শুধু লিফটের নাম্বারপ্লেটের দিকে চেয়ে আছে, পূর্বের ন্যায় ই তার চোয়াল শক্ত। কিভাবে কথাটা পাড়া যায় বুঝে উঠতে পারছে না রুহামা। হুট করেই তো বলা যায় না ‘আপনি কি সব শুনে ফেলেছেন?’। তাহলে প্রমাণিত হবে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। কিন্তু রুহামা তো চোর নয়, সে চুরি করতে চাও না। লিফট থামলো গন্তব্যে। দরজা খুললো, রুহামা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেই আকরাম চাপা স্বরে বললো,
 “স্ত্রীদের কিছু জিনিস মস্তিষ্কে রাখা উচিত, যতই হোক তাদের স্বামীর সম্মান জড়িত থাকে তাদের কাজের সাথে”

আকরামের শীতল রোষাগ্নিতে মেশানো কথাটা শুনে রুহামা থমকে গেলো। সে অবাক নয়নে তাকালো আকরামের মুখশ্রীর দিকে। আকরাম কি তবে তার এবং সাঈদের কথোপকথন শুনে তাকে ভুল বুঝলো! রুহামা কিছু বলার আগেই আকরাম লিফট থেকে বেড়িয়ে গেলো। হনহন করে বাসায় প্রবেশ করলো সে। রুহামা একটা ছোট নিঃশ্বাস গোপন করে নিলো, মনে মনে স্থির করলো আকরামের সাথে আর লুকোচুরি নয় এবার সরাসরি ই কথাগুলো বলবে সে। 

রাতের খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ। আদিবা বারবার তার বা হাতের অনামিকার দিকে তাকিয়ে আছে। মনের মাঝে হাজারো প্রজাপ্রতি ডানা মেলেছে তার। সাঈদ নামক ব্যাক্তিটিকে বেশ মনে ধরে এই বাইশ বছরের মেয়েটির। রুহামা ননদের এরুপ কাজ দেখে কেবল ই হাসে। মেয়েটার প্রসন্ন মুখখানায় এক শীতল শান্তি আছে। বিয়ের পর থেকে এই মেয়েটির সাথেই বেশ ভালো বোঝাপড়া হয়েছে তার। সমবয়সী হবার দরুন তাদের চিন্তাধারাগুলোর বড্ড মিল। মন খুলে মেয়েটির সাথে কথা বলা যায়, হাসা যায়, আবার মন খারাপ হলে তার কাছে কাঁদাও যায়। আদিবা অজান্তেই রুহামা সখীতে পরিণত হয়েছে। নিজের ছোট বোনের ন্যায় তাকে সোহাগ করে রুহামা। সেইজন্য ভয়টা বেশি। যদিও এই বিয়েটা পারিবারিক সম্মতিতে, এখানে অনেক মানুষের পছন্দ, অপছন্দ জড়িত। তবুও ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। রুহামা মনে মনে ঠিক করলো সে আকরামের সাথে কথা বলবে। বিয়ে তো হাজার বার হবে না, একবার ই হবে তাই ভেবেচিন্তে আগানো বুদ্ধিমানের। আকরাম আদিবার অভিভাবক। তাই তাকে জানিয়ে রাখলে সে উচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

নিজ ঘরে আকরাম ফাইলপত্র নিয়ে বসেছে। মিরপুর তফসিল অফিসের রেজিস্টার সে। তার বন্ধুর একটা জমির কিছু কাগজে ঘাপলা হয়েছে। বন্ধু হিসেবে তাকে সাহায্য করা আকরামের দায়িত্ব কিন্তু তাকেও অনেককিছু মেপে কাজ করতে হয়। একটা ভুল সই জীবন দূর্বিষহ। এর মাঝেই রুহামা দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বিছানায় বসলো সে। আকরাম আড় চোখে এক নজর তার পানে চাইলো। তারপর আবার ফাইলের কাজ করতে লাগলো। রুহামা একটু রয়ে সয়ে বললো,
 “ঘুমোবে না?”
 “ঘুম আসলে ঘুমাবো”
 
আকরাম পুনরাম ঈষৎ ঝাঁঝ মিশিয়ে উত্তর দিলো। রুহামা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, শব্দগুলো কিভাবে উপস্থাপন করবে সাজিয়ে নিলো। তারপর বললো,
 “সাঈদ নামক ছেলেটিকে তুমি কবে থেকে চেনো?”

রুহামার প্রশ্নে ফাইল থেকে মাথা তুলে চাইলো আকরাম। তার ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে, সন্দিহান দৃষ্টি তাক করে আছে। অন্য সময় হলে রুহামা কথা এগোতো না, কিন্তু আজ না আগিয়ে পারছে না। আদিবার ভবিষ্যতের কথা। রুহামা থেমে থেমে বললো,
 “আসলে বিয়ে সাদীর ব্যাপার, একটু খতিয়ে না দেখলে পরে আফসোসের সীমা থাকে না। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম”
 “আদিবার কথা তুমি ভাবো?”
 “এ কেমন অবান্তর প্রশ্ন, না ভাবার কি রয়েছে? সে আমার ননদ। আমি ছোট বোনের মতো তাকে স্নেহ করি”

রুহামা খানিকটা অধৈর্য্য হয়েই উত্তর দিলো। আকরাম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তারপর ফাইল গুলো নামিয়ে বিদ্রুপের স্বরে বলল,
 “এতোই যখন ভালোবাসো তবে আমাদের কাছে ব্যাপারটা লুকালে কেনো?”
 “কি লুকোলাম?”
 “এই যে তুমি সাঈদকে চেনো, শুধু চেনো তাই নয় বেশ গভীরভাবে চেনো। কি জানে বলছিলে, অতীতের ভুল না কি যেনো। শোনো রুহামা, আমি অবুঝ নই। আমি ব্যাপারগুলো বুঝি। তবে তুমি এখনো অতীত নিয়েই হা হুতাশ করবে জানা ছিলো না। বসার ঘরে আংটি পড়াবার সময়ও তুমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলে। আমার এই কানের কাছের চুল এমনেই রোদে পাকে নি। আমি তোমাদের মতো ধুর্ত মানুষদের চড়িয়েই আয় করি। মানুষ কতোটা ধুরন্দর আমি জানি। তাই তোমাকে আবারো বলছি, আমার স্ত্রী হিসেবে আমার সাথে তোমার নামটা জড়িয়ে আছে। যা করবে ভেবে করবে। অবশ্য তোমার মতো বাচ্চা মেয়ের কাছে কি বা আশা করা যায়।”

আকরামের গম্ভীর কন্ঠের কথাগুলো কেনো যেনো অপমানের চেয়ে দুঃখ বেশি দিলো। বুকে বিষাদের জোয়ার বয়ে আনলো এই ক’টা কথা। আকাশ পাতাল ভেঙ্গে কান্না চোখের কাছে এসে ভিড় জমালো। অবশেষ কি না মানুষটা তাকে ভুল বুঝলো। রুহামার কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কন্ঠে দলা পাকানো কষ্ট এসে জানান দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেমানুষের মতো কাঁদবে না সে। আকরামের ভুল ভাঙ্গানো বেশি জরুরী এখন। বেশ কষ্টে কান্না রোধ করে বললো,
 “আপনি আমায় ভুল বুঝছেন, আমি এমন কোনো কাজ করি নি যা আপনার সম্মানে আঘাত হানে। হ্যা, সাঈদের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু তা বছর পেরিয়েছে। তার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই। যা আছে তা শুধু কিছু ক্ষত, কিছু আক্ষেপ, কিছু প্রিয় অপ্রিয় ঝাপসা স্মৃতি। যতই হোক অবুঝ মনটা ভালোবেসেছিলো একটা সময়। তবে এতোটা দূর্বল নই যে মরীচিকার পেছনে ছুটবো। আপনার সাথে আমার বিয়ের সত্যতাটাকে অস্বীকার করবো। আমি চিন্তিত আদিবাকে নিয়ে। মেয়েটি সাঈদকে পছন্দ করে। মানুষ একবার যা করে পুনরায় সেই কাজটা করার প্রবৃত্তি থাকে। সাঈদ আমাকে হুট করেই তার জীবন থেকে বিলীন করে দিয়েছিলো। তাই সে যে আদিবার সাথে এমন কিছু করবে না, সেই চিন্তাটাই আমার ভেতরে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। জানি আপনার পছন্দের উপর আংগুল তুলছি। কিন্তু এটা সারাটা জীবনের ব্যাপার। এখন বাকিটুকু আপনার ইচ্ছে।”

অনেকগুলো কথা বললো রুহামা। তার ভেতরটা তীব্র যন্ত্রণায় ছেয়ে গেছে। আকরাম নামক গম্ভীর মানুষটার চোখে নিজের প্রতি অবিশ্বাস সহ্য হলো না তার। সে তড়িৎ গতিতে বাথরুমের দিকে চলে গেলো। আকরামের সামনে কাঁদতে বড্ড লজ্জা লাগছে। আকরাম কিছু বললো না। শুধু একরাশ চিন্তা নিয়ে তাকিয়ে রইলো সে।

মুখ হাত ভালো করে ধুয়ে আকরামের পাশেই শুয়ে পড়লো রুহামা। আকরাম তার ফাইল দেখার কাজ চালিয়ে গেলো। রুহামা দ্বিতীয়বার তাকালো না আকরামের দিকে, মাথা ব্যাথা করছে। কান্না করলেই তার মাথা ব্যাথা করে। তখন বড্ড ঘুম পায়। তাই মিনিট বিশেকের মাঝেই তলিয়ে পড়লো সে ঘুমে। গভীর রাতে অনুভব করলো একজোড়া পুরুষালী হাত তাকে শক্ত করে বেষ্টনীবদ্ধ করে রেখেছে। রুহামা চোখ খুললো না, এই হাতজোড়া কার সেটা যে তার জানা__________

তিনদিন পর,
বিকালে, 
আদিবার মাথা আছড়ে দিচ্ছিলো রুহামা। মেয়েটা বড্ড আলসে, কিছুতেই চুল বাধতে চায় না। দু দিন পর বিয়ে হবে এখন এতো গা ছাড়া দিলে হয়। এই তো রুহামা দিব্বি একা হাতে সংসার সামলাচ্ছে, হ্যা সে নিপুন নয় তবে একেবারে আকাম্মা নয়। প্রতিদিন ভুল করে আবার শিখে। এভাবেই এই দু মাস কেটেছে তার। এর মাঝেই কলিংবেল বাজে। আদিবাকে বসতে বলে নিজেই উঠে যায় রুহামা। দরজা খুলতেই হনহন করে ঘরে ঢুকে আকরাম। আকরাম এতো তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে না। ফিরতে ফিরতে সাতটা বাজে। কিন্তু আজ ব্যাতিক্রম। উপরন্তু তার মুখ লাল হয়ে আছে। যেনো একদলা অগ্নিলাভা সে নিজের ভেতর আটকে রেখেছে। সুমাইয়া বেগম ছেলেকে দেখে রুহামাকে বললো,
 “বউ মা, ওকে পানি দাও। কেমন হাপাচ্ছে দেখো”

রুহামা বিলম্ব করলো না, পানি নিয়ে আসলো তখনি। আকরাম এবার মুখ খুললো, কিন্তু যা বললো তার জন্য সুমাইয়া বেগম প্রস্তুত ছিলেন না,
 “সাঈদের মাকে ফোন করে জানিয়ে দাও মা, এই বিয়ে হবে না………

৩!!

রুহামা বিলম্ব করলো না, পানি নিয়ে আসলো তখনি। আকরাম এবার মুখ খুললো, কিন্তু যা বললো তার জন্য সুমাইয়া বেগম প্রস্তুত ছিলেন না,
“সাঈদের মাকে ফোন করে জানিয়ে দাও মা, এই বিয়ে হবে না"

আকরামের কথা শুনে সুমাইয়া বেগম যেনো আকাশ থেকে পড়লেন, যেখানে আংটি পড়ানো হয়ে গিয়েছে, বিয়ের তারিখ অবধি ঠিক করার আলোচনা চলছে সেখানে এই কথাগুলো কি মানায়! এখন বিয়ে ভাঙ্গলে সমাজের শত কথার মুখোমুখি হতে হবে, শুধু তাই নয় এই সিদ্ধান্ত আদিবার মনের উপর ও বাজে প্রভাব ফেলবে। উপরন্তু এই সম্বন্ধের উৎস আকরাম নিজেই, সেখানে কি এমন ঘটলো যে আজ আকরাম ই বিয়ে ভাঙ্গার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সুমাইয়া বেগম অধৈর্য হয়ে উঠলেন। ব্যাতিব্যস্ত হয়ে শুধালেন,
 “বিয়ে ভেঙ্গে নিবো মানে? কি বলছিস বুঝে বলছিস?”
 “আমি ঠান্ডা মস্তিষ্কেই বলছি মা, সাঈদ আমার বোনের উপযুক্ত নয়। তাই এই বিয়ে ভাঙ্গার কথা বলছি” 

স্বাভাবিকা চিত্তে ঠান্ডা গলায় কথাটা বললো আকরাম। রুহামা পানির গ্লাস হাতে বিমূঢ় দৃষ্টিতে আকরামের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঝাকে ঝাকে নিজেদের রাজত্ব করছে। আকরামের সিদ্ধান্তের কারণটা জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু শ্বাশুড়ির সম্মুখে সেই কৌতুহলটা দেখাতে পারছে না সে। সুমাইয়া বেগম এবার কিঞ্চিত রেগে গেলেন। ছেলেকে বাজখাঁই কন্ঠে বললেন,
 “তুমি কি বিয়ে কে ছেলেমানুষী ভাবো? এতো সহজ নাকি সবকিছু? ছেলেটাকে তোমার পছন্দ বলে এতোদূর কথা এগোলো। আর যেই আমরা বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি অমনি তুমি বলছো বিয়ে হবে না? কেনো বিয়ে ভেঙ্গে দিবো? সাঈদ কি এমন করেছে যে ও আদিবার যোগ্য নয়?”

আকরাম চুপ করে রইলো, তার মুখশ্রীতে বিরক্তির গাঢ়ত্ব প্রকাশ পেলো। সে কারণটা সবাইকে বলতে নারাজ। সুমাইয়া বেগম তাকে চুপ থাকতে দেখে পুনরায় একই প্রশ্ন করে উঠলেন, কিন্তু এবার যুতসই উত্তর পেলেন না। বরং আকরাম একই কথাই আওড়ালো। সুমাইয়া বেগম আকরামের এমন উত্তরে বিরক্তির সাথে বললেন।
 “শোনো আকরাম, সে আদিবার যোগ্য নয় এই কথাটা আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর নয়। বরং তোমার উত্তরে আমি বিরক্তবোধ করছি। এই বিয়েটা তুমি এনেছো, তোমার পছন্দের উপর আমি প্রশ্ন তুলি নি। কিন্তু এখন আমার তোমার উপর প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে। মনে করো আমি সাঈদের আম্মুকে বললাম এই বিয়ে হবে না। সে আমাকে প্রথমেই যা প্রশ্ন করবেন তা হল, কেনো? এই কেনোর উত্তর কি দিবো? সবাই তোমার মতো নয়, দু কথায় আচ্ছা বলে রেখে দিবে। নানা প্রশ্ন করবে। আর এখানে মেয়েপক্ষ আমরা। সমাজ বাদ দাও আমাদের আত্নীয়রাই শত প্রশ্ন ছুড়ে দিবে”
 “আত্নীয়রা কি ওই ছেলের সাথে ঘর করবে? ঘর তো করবে আমার বোন”
 “সেই বোনকে কি বলবে? কেনো তার সাথে বিয়ে বিয়ে দিচ্ছো না?”

আকরামের চোখে ক্রোধের হাতছানি দেখলো রুহামা। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সংবরণ করছে। রুহামা আর পারলো না, ধীর স্বরে বললো,
 “সাঈদের সমস্যাটা কি বলে দিলেই কিন্তু সব ঝামেলা মিটে যায়”

রুহামার কথা কর্ণপাত হতেই ক্রুদ্ধ নজর তাক করলো আকরাম। তার রক্তিম চোখ রুহামার অন্তরের পানি শুষে নিলো। রুহামা কথা বাড়ালো না। নজর সরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো বসার ঘরের দরজা ঘেষে আদিবা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ থেকে অনবরত নোনাজল ঝরছে। রুহামা দেরি করলো না। সে পানির গ্লাসটি আকরামের সামনে রেখেই আদিবার কাছে চলে গেলো। আদিবা তার ভাবিকে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো। জড়ানো স্বরে বললো,
 “ভাবী, ভাইয়া এগুলো কি বলে? কেনো হবে না আমাদের বিয়ে? উনি তো বেশ ভালো”
 
রুহামা উত্তর খুঁজে পায় না, কি উত্তর দিবে? সে তো নিজেই জানে না এই উত্তরটা। এদিকে বসার ঘরের উত্তাপ, বাকবিতণ্ডা আদিবার ঘর অবধি শোনা যাচ্ছে। সুমাইয়া বেগম একই প্রশ্ন করছেন। কিন্তু আকরাম উত্তর দিচ্ছে না। তার কথা বিয়ে হবে। আদিবা রুহামাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আজ রুহামা আদিবার মাঝে নিজেকে দেখতে পারছে। সাঈদের সাথে সম্পর্কের বিচ্ছেদের পর সেও এভাবেই কেঁদেছিলো। রুহামার কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে আদিবার জন্য। সে চাইলেও কিচ্ছু করতে পারছে না। একটা সময় আদিবা বলে উঠে,
 “জানো ভাবি, আমি উনার মাঝে আমার মনের রাজকুমারকে খুঁজে পেয়েছি। যেমনটা আমার ভালো লাগতো। যেমন দেখতে, তেমন আচার ব্যাবহার। হুট করে কি হলো ভাবি? রুপকথাগুলো কেনো এলোমেলো হয়ে গেলো?”

রুহামা ম্লান হাসলো। তারপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
 “মানুষের একটা বিশ্রি স্বভাব আছে, স্বীকার করতে চায় না তবুও স্বভাবটি তাদের রক্তের কণায় মিশে আছে প্লাজমার ন্যায়। তারা রুপকথায় বাস্তবতা খুঁজে আর বাস্তব জীবনে খুঁজে রুপকথা। বাস্তব যে অনেক ভিন্ন আদিবা। বাস্তবের রাজকুমারেরা রুপকথার থেকে ভিন্ন হয়। সবকিছুতে যদি রুপকথা খোঁজো তবে রিক্তহস্তে ফিরতে হবে তোমায়”
 “তাহলে কি স্বপ্ন দেখবো না? তাহলে কেনো বলে আমাদের জন্য রাজকুমার আসবে ঘোঁড়ায় চড়ে?”
 “সেটা যে একেবারে ভুল না কিন্তু নয়, রুপকথা গুলো বাস্তবের আদলেই গড়ে উঠে। শুধু লেখকেরা বাস্তবের কাঠিন্য রুপকথায় রাখে না। পাঠকদের স্বপ্ন দেখাতে চায় তারা। একটা কথা বলি আদিবা। জীবনে এমন অনেককিছু হয় যা কল্পনা করি না। সাঈদকে আপেক্ষিকভাবে তোমার ভালো লাগলেও এমনটা হতেই পারে সে তোমার রুপকথার রাজকুমার নয়। বিয়ের পর হয়তো তোমার জীবন বিষিয়ে উঠতো। তাই তো আজ আকরাম বিয়েটা ভাঙ্গতে চাইছে। রুপকথা সবাই খোঁজে, কিন্তু সেই রুপকথার খোঁজটা যে খুব কঠিন। এই বাজে কঠিন পথটা যে সবাইকে পার করতে হয়। পরীক্ষা দিতে হয়, ধৈর্য্য ধরতে হয়, অনেক বিষাদ, দুঃখকে বরন করতে হয়। এভাবে ভেঙ্গে পড়লে যে সেই রুপকথার খোঁজ পাবে না তুমি, কান্না থামাও। আকরাম তোমার ভাই, সে চাইবে না তার আদরের বোন কষ্ট পাক”
 “তোমার রুপকথার খোঁজ সফল হয়েছে?”

চোখ মুছে কাঁপা স্বরে আদিবা প্রশ্নটি করে। রুহামা মৃদু হাসে। তারপর বলে,
 “হু, হয়েছে”

আদিবা কান্না থামায়। কিন্তু রুহামাকে ছাড়ে না। তার কোলেই মাথা রেখে শুয়ে থাকে সে। আর রুহামা তার মাথায় বিলি কেটে দেয়। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলো রুহামা। ছেলেমানুষ সত্তাকে ছেড়ে আজ নিজেকে বেশ ম্যাচিউর মনে হলো তার। যেনো অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে সে, অথচ আদিবা থেকে মাত্র দু বছর বড় সে। আচ্ছা, সেদিন যদি আদিবার মতো সে কাউকে পাশে পেতো তাহলে হয়তো তার এতোটা ভেঙ্গে পড়তে হতো না। রুহামা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে প্রভাত উঁকি দিচ্ছে তার।
_________

মাগরিবের নামাজ শেষে চা খাবার অভ্যেস আকরামের। নামাজ পড়ে উঠেই হাক দেয় সে রুহামাকে। কিন্তু আজ সেটা হলো না, নামাজ শেষে কিছুসময় জায়নামাজেই বসে রইলো সে। তার অস্বস্তি লাগছে। মা বারবার এক প্রশ্ন করছে, কিন্তু উত্তরটা সে দিতে পারছে না। সবকিছু বিরক্ত লাগছে। ওমন একটা অমানুষের সাথে বোনের বিয়ে কিছুতেই দিবে না আকরাম। কিন্তু বিয়েটা ভাঙ্গবে কি করে! এই সময় ঘরে রুহামার প্রবেশ ঘটে। রুহামা তার নিয়ম অনুযায়ী আকরামের জন্য চা নিয়ে এসেছে। আকরামকে জায়নামাজে গম্ভীর চিত্তে বসে থাকতে দেখে সে ধীর গলায় বললো,
 “চা খাবে না?”
 
রুহামা কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ধ্যান ভাঙ্গে আকরামের। জায়নামাজ গুছিয়ে চাটা হাতে নেয়। রুহামা মনে মনে সাজালো আকরামকে কিভাবে প্রশ্ন করবে। তার উপরে শ্বাশুড়ি গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি তো জানেন না, যে মানুষ তার মাকেই উত্তর দেয় নি রুহামা ছাই কিছু বলবে! তবুও চেষ্টা করবে রুহামা। আদিবার ও জানা উচিত ব্যাপারটা। নয়ত খামোখা ভাই এর উপর অভিমান করবে সে। রুহামা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, সাহস জুগিয়ে শুধালো,
 “সাঈদের সাথে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চাইছেন কেনো? একটা যুতসই কারণছাড়া মা তো এগোতে পারছেন না”
 “তুমি সত্যি শুনতে চাও?”

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গম্ভীর গলায় উলটো প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আকরাম। রুহামা কিছুটা ভড়কালেও পিছ পা হলো না, সাহস করে বললো,
 “হ্যা, শুনতে চাইছি আমি”
 “তবে শুনো, আমি আমার বোনের বিয়ে এমন কোনো ছেলের সাথে দিবো না যে আগে অন্য মেয়ের সাথে শারিরীক সম্পর্ক করার দাবি করে। আর সেই অন্য মেয়েটি যদি আমার স্ত্রী হয় তাহলে একজন স্বামী হিসেবে সেই ছেলেটিকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। বিয়ে তো অনেক দূরের কথা। এবার তুমি বলো, এই উত্তরটা মাকে কিভাবে দিবো?………

৪!!

“তবে শুনো, আমি আমার বোনের বিয়ে এমন কোনো ছেলের সাথে দিবো না যে আগে অন্য মেয়ের সাথে শারিরীক সম্পর্ক করার দাবি করে। আর সেই অন্য মেয়েটি যদি আমার স্ত্রী হয় তাহলে একজন স্বামী হিসেবে সেই ছেলেটিকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। বিয়ে তো অনেক দূরের কথা। এবার তুমি বলো, এই উত্তরটা মাকে কিভাবে দিবো?”

আকরাম চায়ের কাপটি পাশের টেবিলে রাখলো, তার মুখভাব বদলালো না। সে অপেক্ষা করছে রুহামার প্রতিক্রিয়ার। অপরদিকে আকরামের শীতল কন্ঠে বলা কথাগুলো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে পৌছাতে সময় লাগলো রুহামার। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। যখন কথাটা বুঝলো, তখন সে নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো, মাথাটা ফাকা লাগছে। মস্তিষ্কে কিছু সাজাতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। চেষ্টা করেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। গলার কাছে এসে সব কথাগুলো যেনো দলা পাকাচ্ছে। রুহামা অতিকষ্টে বললো,
 “মিথ্যে কথা, আমাকে এতোবড় একটা অপবাদ দিচ্ছেন কি করে আপনি? সাঈদের সাথে আমার একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আমি কোনো পাপ করি নি”

রুহামা বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো, নিজেকে শান্ত রাখা তার পক্ষে অসম্ভব। তার ভেতরটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এতোবড় অপবাদ সহ্য করা কোনো নারীর পক্ষেই হয়তো সম্ভব নয়। এমন অপবাদ কোনো স্বামী মেনে নিবে না। কিন্তু রুহামা করবেও বা কি? পুরুষশাসিত সমাজে নারীর আর্তনাদ কেউ কি শুনে? রুহামা কাঁদছে, ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তার। বারংবার একই কথা বলছে, ‘এটা মিথ্যে, এটা মিথ্যে’ হঠাৎ অনুভূত হলো একজোড়া পুরুষালী হাত তাকে বেষ্টনীবদ্ধ করলো। আলতো করে আগলে তাকে বক্ষস্থলে নিবিড় ভাবে লেপ্টে রাখলো আকরাম। গম্ভীর আকরামের এমন কাজ রুহামাকে চমকে দিলো। পাথরের বুকে ফুল ফুটে? ফুটে হয়তো, দূর্লভ হলেও ঘটনাটি অসম্ভব নয়। সেই ফুলগুলো স্নিগ্ধ হয় আকরামের সংস্পর্শের ন্যায়। শুভ্র, স্নিগ্ধ, পবিত্র, উষ্ণ অনুভূতি। আকরাম কন্ঠ নরম করলো, তারপর বললো,
 “আমি জানি এই অপবাদটি মিথ্যে”

আকরামের কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো, রুহামা মাথা তুলে বললো,
 “আপনি জানেন? তাহলে আপনি সেই কথাগুলো বললেন কেনো?”
 
আকরাম ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলো। তারপর রুহামাকে আজ দুপুরের সকল কথাগুলো খুলে বললো।

দুপুর বেলা,
লান্সের পর পর ই অফিস থেকে বেড়িয়েছে আকরাম। আজ কাজের চাপটা অনেক বেশি ছিলো। একের পর এক জমির রেজিস্ট্রির কাজ করেছে সে। কদিন ধরে ভেতরে ভেতরে খুব প্রেসারে রয়েছে সে। রুহামার কথাগুলো ফেলে দেবার মতো নয়। যতই হোক নিজের বোনের ভবিষ্যৎ, একটা ভূল সিদ্ধান্ত তার পুরো জীবনকে তছনছ করে দিবে। কিন্তু সে সাঈদের সাথে কথা বলার সাহস করে উঠতে পারছে না। তিক্ত ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি নাড়াচড়াও করতে পারছে না সে। সাঈদকে সরাসরি জিজ্ঞেস করাটা তার মতো মানুষকে মানায় না, আর বলবেও বা কি? ‘আমার বউ এর সাথে পূর্বের সম্পর্কের ভাঙ্গনের কারণ কি?’--- লোকে হাসবে, এই সব অযাচিত দ্বিধা আকরামের শান্তি কেড়ে নিয়েছে। সাঈদ এখানে সাবরেজিস্টার হিসেবে বছরখানেক হয়েছে জয়েন করেছে। কিন্তু ছেলেটা কাজে খুব পটু। তাই আকরামের সাথে তার সম্পর্কটা বেশ দৃঢ়। এক বছরের সম্পর্ক আজ কেমন যেনো এলোমেলো ঠেকছে আকরামের কাছে। নিজের স্ত্রীর প্রাক্তনের সাথে প্রতিনিয়ত দেখা হচ্ছে--- কথাটা যতটা সহজ উপায়ে বলা যায়, অনুভূতিটা এতোটা সরল নয়। এক অজানা ক্ষোভ, জ্বলণ, ঈর্ষা নিবৃত্ত মনকে দগ্ধ করতে থাকে। তাই অবশেষে নিজের বন্ধু রবিনের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছে আকরাম। রবিন একজন কাউন্সিলর, সে মানসিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মানুষকে কাউন্সিলিং করে। রবিন ই আকরামকে বুদ্ধি দিয়েছে যেনো, সাঈদকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে রিলেশন, হাবিজাবি নিয়ে প্রশ্ন করতে। আদিবাকে তার কেমন লাগে, সেই ব্যাপারগুলো খুতিয়ে দেখতে। আকরামও তার বুদ্ধিতে সম্মতি প্রকাশ করে, কিন্তু সাঈদ আজ অফিসেই আসে নি। তাই আজ তাড়াতাড়ি ই বেড়িয়ে পড়েছে আকরাম। বাসায় গিয়ে খানিকক্ষণ ভাবতে হবে কিভাবে সাঈদের সাথে কথা বলা যায়। এর মাঝেই একটা ফোন আসে আকরামের নিকট। আকরামের যে বন্ধুটি তার নিকট সাহায্য চেয়েছিলো জমির ব্যাপারে, সে তার সাথে দেখা করতে চায়। অনেক জোরাজুরির পর অবশেষে আকরাম তার সাথে দেখা করার জন্য রাজী হয়। 

রেস্টুরেন্টে বসে আছে আকরাম, তার বন্ধুটি আসতে একটু দেরি হবে। একেই বিরক্ত লাগছে, উপরন্তু একা একা বসে থাকতে থাকতে মেজাজ খানিকটা বিগড়ে গেল আকরামের। সে একটু পর পর ঘড়ি দেখছে এবং এদিক ওদিক নজর ঘোরাতে লাগলো আকরাম। হঠাৎ তার নজর আটকে গেলো একটা টেবিলের দিকে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে। ছাইচাপা বিগড়ানো মেজাজ যেনো আরোও বিগড়ে গেলো তার। সাঈদ একটা মেয়ের সাথে সেই টেবিলে বসে রয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের দুজনের ঘনিষ্ঠতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিলো আকরামের মনে। আকরামের ইচ্ছে হচ্ছিলো, এখনই সাঈদকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। কিন্তু পাবলিক প্লেসে সিন ক্রিয়েট করতে নারাজ সে। তাই মনে মনে একটা ফন্দি আটে সে। সাঈদদের পিছু নিবে সে। মেয়েটির সাথে তার সম্পর্কের রহস্য উদ্ভাবন করবে সে। তাই সাঈদরা উঠলেই আকরামও রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে পড়ে।

আকরামের পরিকল্পনা অনুযায়ী সে সাঈদদের পিছু নেয়। খুব ধৈর্য ধরে আকরাম তার পিছু পিছু যায়। একটা সময় তাদের একটা হোটেলে প্রবেশ করতে দেখে সে। তারা রিসেপশন থেকে একটা রুমের চাবি নিয়ে উপরে চলে যায়। সাঈদরা চলে যাবার পর আকরাম রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করে। প্রথমে না বলতে চাইলেও পড়ে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে আকরাম রুম নাম্বারটি নেয়। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে নি আকরাম। যেয়ে নক করে বসে সেই রুমে। বেশ কিছুসময় কড়া নাড়ার পর অবশেষে সাঈদ দরজা খুলে। আকরামকে দেখে ভুত দেখার মতো ভয় পেয়ে যায় সে। আমতা আমতা করে বলে,
 “ভাই, আআপনি?”

আকরাম নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। সাঈদের কলার চেপে ধরে সে, রাগ সামলাতে না পেরে তিন-চারেক কিল ঘুষি ও দিয়ে বসে।
 “আমি তোকে প্রশ্ন করছি, তুই এখানে কি করছিস? এই তোর অসুখ? তুই না জ্বরে মাথা তুলতে পারছিস না? তাহলে এগুলো কি?”
 “ভাই, আমার কথা শুনেন”
 “চুপ, হারামজাদা। কি শুনবো? কি করছিস এই মেয়েটার সাথে এই রুমে? ছিঃ আপনার ভাবতেই লজ্জা করছে এমন একটা ছেলেকে আমি ভদ্র ভাবতাম। শুনে রাখ, তোর সাথে আমার বোনের বিয়ে তো দিবোই না সাথে তোর চাকরি কিভাবে থাকে সেটাও আমি দেখে নিবো”

আকরাম তাকে ছুড়ে ফেলে। তারপর সাঈদ আকুতি করে বলে,
 “ভাই, এমন করবেন না। ভুল হয়ে গেছে আমার, আমার চাকরি খাবেন না। নতুন চাকরি। প্লিজ ভাই”
 “তোদের মত পুরুষদের জন্য আমাদের নাম খারাপ হয়। তোকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমি শান্ত হবো না”

আকরামের রাগ আসমান ছুয়েছে। তার আর এক মূহুর্তও দাঁড়াবে না। রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার জন্য উদ্যত হতেই সাঈদ বলে উঠলো,
 “আপনি আমার ক্ষতি করলে আমিও আপনাকে ছেড়ে দিবো না ভাই, কেমন লাগবে আপনার? যখন সবাই জানবে রেজিস্টর আকরাম আহমেদের বউ এর শরীরের সকল অংশ আমার চেনা। ভেবে দেখুন। সম্মান থাকবে তো আপনার? আমার চাকরি চলে গেলে আমার হয়তো খাবারের অভাব পড়বে। কিন্তু এই সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন তো। আমার সাথে তার কেমন সম্পর্ক ছিলো তা নিশ্চয়ই জানেন। সুতরাং আমাদের ঘনিষ্ঠতা কেমন তার প্রমাণ দেওয়া খুব কঠিন নয়”

সাঈদ কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই তাকে পাগলের মতো মারতে লাগতো আকরাম। ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হতে লাগলো সাঈদের। আকরাম দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
 “আমার রুহামার নামে একটা বাজে কথা বললে তোর লাশ যাবে বাসায়, লজ্জা করে না তোর? নিজের চাকরি বাঁচাতে ওর নামে বাজে কথা বলে আমাকে ব্লাকমেইল করছিস? তোর যদি মনে হয় আমাকে দমাতে পারবি। চেষ্টা করে দেখ। এই পৃথিবীর আলো তোকে দেখা লাগবে না। বলে দিলাম”

আকরামের মারের চোটে একটা সময় অচেতন হয়ে পড়লো সাঈদ। সাঈদের সাথের মেয়েটি ভয়ে কুকড়ে উঠলো। সে অনুরোধ করতে লাগলো, 
 “আর মারবেন না ওকে, ছেড়ে দিন প্লিজ”

মেয়েটির দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি প্রয়োগ করে ছেড়ে সাঈদকে ছেড়ে দিলো আকরাম। হাত জ্বলছে। কখনো কোনো মানুষকে পেটায় নি সে। কিন্তু কিছুতেই রাগ সংযত রাখতে পারে নি আজ। তারপর সাঈদকে হসপিটালে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে সে। সেখান থেকেই বাসায় আসে। 

আকরামের কথাগুলো শুনে রুহামা চাপা স্বরে বলে,
 “ও মিথ্যে বলেছিলো, বিশ্বাস করেন আমি কখনোই ওর সাথে শারিরীক ঘনিষ্ঠতায় যাই নি”
 “আমি জানি, দুমাস একটা নারীর সাথে থেকে সত্য কোনটা মিথ্যে কোনটা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে রুহামা। তোমাকে বলেছিলাম না, মানুষ চড়িয়ে আমি খাই। শুধু এই সাঈদটাকেই বুঝতে পারি নি। আমি ওকে ছাড়বো না। এমন জঘন্য শাস্তি দিবো, দেখে নিও। কিন্তু মাকে আমি এই কথাগুলো বলতে পারছি না। যতই হোক, তার চোখে তোমার সম্মানহানি আমি মানতে পারবো না”

রুহামা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে আকরামের দিকে। এ যেনো এক অন্য আকরামকে দেখছে সে। বিষাদে ভরা মনে এক কুসুম প্রভাত উঁকি দিলো। মনের মাঝের সকল জড়্তা এক নিমিষেই গলে গেলো যেন। রুহামা কৃতজ্ঞ কন্ঠে বললো,
 “আমাকে বিশ্বাস করেন আপনি?”
 “করি”

আকরামের ঠোঁটে মৃদু হাসি। গম্ভীর আকরামকে আজ খুজে পেলো না রুহামা। বরং এক অমায়িক মানুষকে নজরে পড়লো। এমন স্বামীর কল্পনাই তো করেছিলো সে। হঠাৎ ঘরের দরজায় টোকা পড়লো। রুহামা নিজেকে সামলে নিলো। আকরাম গাম্ভীর্যকে আবার বরণ করলো, জিজ্ঞেস করলো
 “কে?”
 “ভাই, পুলিশ এসেছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়………

৫!!

আকরামের ঠোঁটে মৃদু হাসি। গম্ভীর আকরামকে আজ খুজে পেলো না রুহামা। বরং এক অমায়িক মানুষকে নজরে পড়লো। এমন স্বামীর কল্পনাই তো করেছিলো সে। হঠাৎ ঘরের দরজায় টোকা পড়লো। রুহামা নিজেকে সামলে নিলো। আকরাম গাম্ভীর্যকে আবার বরণ করলো, জিজ্ঞেস করলো
 “কে?”
 “ভাই, পুলিশ এসেছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়” 

আদিবার কথাটি শোনার সাথে সাথেই ধক করে উঠে রুহামার ভেতরটা। সাঈদ কি তবে পুলিশ পাঠালো? দুপুরে আকরাম রাগের মাথায় সাঈদকে মেরেছিলো সেটার শোধ তুলতেই কি এই ব্যাবস্থা করেছে সাঈদ? রুহামা মুখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। এক নিগাঢ় কৃষ্ণ ভয় তাকে ভেতর থেকে দূর্বল করে তুললো। আকরাম মিনিট দুয়েক চুপ করে থাকলো তারপর বললো,
 “উনাদের বসতে বল আমি আসছি”

আদিবা চলে গেলো। রুহামার বিবর্ণ মুখের দিকে একপলক চেয়ে উঠে দাঁড়ালো আকরাম। মাথায় চিন্তা ঘুরপাক করছে না বললে ভুল হবে, কিন্তু ঘরের মধ্যে বসে থাকলে তো সমাস্যার সমাধান হবে না। সাঈদ যদি কোনো বলদামি করে তার সমাধান ও আকরামের কাছে আছে। বসার ঘরে মিরপুর থানার অসি বসে আছেন। আকরামকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে বললো,
 “স্যার, ভালো আছেন?”
 “জ্বী, তুমি কেমন আছো ইকবাল?”
 “আলহামদুলিল্লাহ। স্যার একটা কাজে আপনার নিকট এসেছি”
 “বলে ফেলো?”
 “সাঈদুর রহমানের ব্যাপারে কিছু জানতে চাইতাম। আপনি হয়তো তাকে চিনেন, মিরপুর তফসিল অফিসে সাবরেজিস্টার হিসেবে কাজ করেন”

সাঈদুর রহমান নামটি শোনামাত্র রুহামার ভয় বেড়ে যায়, তবে কি সাঈদ ই পুলিশ পাঠিয়েছে? অসি ইকবাল আকরামের বেশ পরিচিত। তাই সে ঘাবড়ালো না, বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললো,
 “হ্যা, চিনি। কেনো কি হয়েছে?”
 “আসলে তার নামে ভূমিদস্যুতার কেস রয়েছে। আমরা এতোকাল এই ব্যাপারে বেশ কটা রিপোর্ট পেয়েছি। আজ আমরা প্রমাণ ও পেয়েছি হাতে নাতে। সে বেশ কিছু টাকা খেয়ে এই কাজগুলো করে। বেশ কিছু জমি একই সাথে তিন-চারজনের সাথে বিক্রয় করা হয়েছে। খুব বড় একটা দল এর পেছনে আছে। সাঈদ তাদের ই সাহায্য করেছে। জাল দলিল এবং এই ভণ্ডামির কারণে আমরা তাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সাঈদুর রহমান আপাতত হসপিটালে ভর্তি বিধায় তাকে গ্রেফতার করতে পারছি না। তবে আমাদের নজর বন্দি সে। এই ব্যাপারেই আপনার কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছি”

রুহামা তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সকল কথাগুলো শুনলো। সাঈদের মতো জঘন্য মানুষের জন্য তার মনে স্বল্প পরিমাণ সমবেদনা কাজ করছে না। যে মানুষ কোনো নারীর অসম্মান করতে পারে, সেই মানুষ যেকোনো খারাপ কাজ করতে পারে বলে রুহামার ধারণা। সাঈদের চরিত্রের এরুপ বর্ণনা শুনে সুমাইয়া বেগমের মন বসে গেলো। সততা সবার আগে যদি একটা ছেলে সৎ ই না হয় তবে তাকে মেয়ে সপে দেওয়া সবচেয়ে বড় ভুল। আকরাম দীর্ঘসময় কথা বললো ইকবালের সাথে। ঘন্টা খানিক পর ইকবাল উঠে দাঁড়ালো। বিনয়ী কন্ঠে বললো,
 “স্যার, ধন্যবাদ। ইনশাআল্লাহ আপনি যেনো কোনো ঝামেলার ভেতর না পড়েন সেই দায়িত্ব আমার”

আকরাম মৃদু হেসে তাকে বিদায় দিলো। ইকবাল যাবার পর সুমাইয়া বেগম প্রশ্ন ছুড়লেন,
 “তুমি কি এই কারণে বিয়েটা ভাঙ্গতে চাচ্ছিলে?”
 “না, কারণ এটা নয়। এই ঘটনা তো আজ জানতে পারলাম আমি। আমি ভাঙ্গতে চেয়েছিলাম সাঈদের চরিত্র খারাপ তাই। তাকে আমি অন্য মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছি। দৃশ্যটি দৃষ্টিকটু। কথাটা তখন কিভাবে বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যাক গে, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। তুমি এখন নিশ্চিন্তে বিয়ে ভাঙ্গতে পারো। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলবে, তার ছেলে অসৎ”

কাঠ কাঠ উত্তর দিলো আকরাম। তারপর নিজ ঘরে প্রবেশ করলো। রুহামা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আকরাম তাকে বললো,
 “আরেক কাপ চা দিতে পারবে?”
 “হু, নিয়ে আনছি”

রুহামা রান্নাঘরে চলে গেলো। আকরাম নিজ ঘরে গিয়ে রুদ্ধশ্বাস ফেললো। যতই হোক সে মানুষ, মানুষের ভয় হয়। তার ও ভয় হয়েছিলো। ভেবেছিলো সাঈদ তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছে। ভয়টা থানায় যাওয়া কিংবা নিজের সাদা চাকরি জীবনে কালো দাগ পড়ার নয়। ব্যাপারটা তার বউ এর মান সম্মানের সাথেও জড়িত। সাঈদকে সে মেরেছে রাগের বসে, রাগটা কেনো হয়েছে? এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করলেই এক কথায় দু কথায় রুহামার কথা উঠলো। তখন হয়তো মিডিয়া সেটা নিয়ে একটা খবর চাপাতো, মিরপুর তফসিল অফিসের রেজিস্টার স্ত্রীর প্রাক্তনকে মারার কারণে জেলে আটক। দুপুরে গরম মাথায় এসব কিছুই আসে নি, তখন শুধু সাঈদকে মারতে ইচ্ছে করেছিলো। এখন বুঝতে পারছে কোথা থেকে কি হবার সম্ভাবনা ছিলো। ভাগ্যিস আল্লাহ তা’আলা সাঈদের ভণ্ডামি ফাঁস করে দিয়েছেন। নয়তো অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো আকরামকে। আকরাম বারান্দার দাঁড়ালো। আজ শীত তুলনামূলক বেশি পড়েছে। চাটা পেলে ভালো হতো। ঠিক তখন ই রুহামা এক কাপ চা হাতে উপস্থিত হয়। নরম গলায় বলে,
 “আপনার চা”
 “ধন্যবাদ”

রুহামার ঠান্ডা লাগছে বিধায় সে ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ায়। তখন আকরাম বলে উঠে,
 “কিছুক্ষণ দাঁড়াবে এখানে?”
 “জ্বী?”

আকরামের নরম গলার নিবেদনে থমকে যায় রুহামা। এই দুমাসে কখনো এমনভাবে অনুরোধ করে নি আকরাম। কিছুটা অবাক হলো সে। রুহামার উত্তর না পেয়ে আকরাম বললো,
 “সমস্যা নেই, তুমি যাও”
 “আমি শালটা নিয়ে আসছি, ঠান্ডা তো”
 “হু”

রুহামা একটা মোটা শাল ভালো করে পেঁচিয়ে দাঁড়ালো আকরামের পাশে। আজ আকাশে পূর্ণচন্দ্রমা, ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে রুহামার মুখশ্রী। সাপের ন্যায় চুলগুলো অবাধ্য হয়ে উড়ছে। মাঝে মাঝে আঁছড়ে পরছে মুখের উপর। কালো আকাশের মেঘের ফাঁকে শীতলের চাঁদের আলো গলে পড়ছে তাদের বারান্দায়। আজ রাতে জ্যোৎস্নাবিলাশের জন্য উপযুক্ত। রুহামার ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর বরের সাথে জ্যোৎস্নাবিলাস করবে। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা ইচ্ছেই রয়ে গেলো। কখনো সাহস করে আকরামকে বলা হয় নি। হয়তো বললেই বলতো, ‘তুমি এতো ছেলেমানুষ কেনো রুহামা?’

রুহামা অপলক দৃষ্টিতে চন্দ্রমাকে দেখছে, হঠাৎ আকরাম বলে উঠে,
 “জানো রুহামা, আমার কখনো বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না। মা কে সবসময় বলতাম, বাচ্চা মেয়ে আমার অপছন্দ। পারলে আমার সমবয়সী কাউকে খুজো। সেটার কারন ছিলো। আমার এক বন্ধু তার থেকে ছোট একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। তাদের মাঝে হাজারো অমত। একটা সময় তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। সময় পাল্টাচ্ছে, আমি বড্ড সেকেলে মানুষটা। এখনের জেনারেশনকে বুঝে উঠতে পারি না। তাদের পছন্দ, অপছন্দ সবকিছু কেমন এলোমেলো ঠেকে আমার কাছে। ফলে আমারো পরিণতি আমার বন্ধুর মতোই হবে। আমি বিচ্ছেদ খুব ভয় পাই। বিনা ছুরিঘাতে হত্যার মতো লাগে আমার কাছে। কিন্তু মা পছন্দ করলেন তোমাকে। নয় বছরের ছোট একটা মেয়েকে। যখন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম, না চাইতেও মন দিয়ে বসলাম। আসলে এই ভালোবাসা, ভালোলাগা ব্যাপারগুলো তো নতুন আমার কাছে। তোমার সেই লাজুক চাহনী, মৃদু হাসি, এতো স্নিগ্ধ লেগেছিলো। কিন্তু এই অনুভূতির সাথে গাঢ় ভয় ও আমাকে তাড়া করেছিলো। তোমার কি আমার মতো বুড়োকে ভালো লাগবে? আমি সুন্দর করে কথা বলতে পারি না। খ্যাটখ্যাট করি প্রচুর। আরোও ভয় পেলাম যখন তোমার আড়ষ্টতা আমার নজরে পড়লো। ভেবেই নিলাম তুমি আমাকে পছন্দ করো না। কিন্তু সেদিন যখন তুমি বিনা জড়তায় আমাকে সাঈদের কথাগুলো বললে, কেনো জানে মনে হলো তুমি আমাকে একটু হলেও মনে জায়গা দিয়েছো। আজ যখন সাঈদ তোমার নামে খারাপ কথা বলছিলো আমার একটু ভালো লাগছিলো না। বরং রাগ হয়েছিলো। আমি সেই সময়ে বুঝতে পেরেছি। শুধু তোমাকে ভালো লাগে না, অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। মনের ভেতরে কথাগুলো জমিয়ে রাখতে পারলাম না। বলে দিলাম। আমার মতো মানুষকে ভালোবাসতে তোমার আপত্তি থাকতেই পারে। বলে দিতে পারো। আমি জোর করার মানুষ নই”
 “আচ্ছা, আকরাম আমার বয়স হলে কি আপনার এই ভালোবাসাটা কমে যাবে?”

রুহামার প্রশ্নে মৃদু হাসে আকরাম। তারপর বলে,
 “এজন্যই তোমার সাথে কথা বলতে চাই না। এতো বোকা কেনো তুমি? ভালোবাসা কি সেভাবে হয় নাকি? তাহলে তো সবাই বুড়ো হলেই তার পার্টনারকে ছেড়ে দিতো। ভালোবাসা তো মন থেকে হয়।”
 “তাহলে আপনার কেনো মনে হলো, আপনি আমার থেকে বড় হওয়ার জন্য আমি আপনাকে ভালোবাসবো না। আপনাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি জানেন, আপনার সততাকে আমার ভালোলাগে। সকালে আপনার শান্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি। কল্পনা করি আপনার সাথে জ্যোৎস্নাবিলাসের। কিন্তু ঐ খ্যাটখ্যাটে স্বভাবের দরুন বলা হয় না। এই দু মাসে আপনার জন্যই আপনার পরিবারকে ভালোবেসেছি। আমার আপনাকে খুব ভালোলাগে আকরাম। শুধু আগাতে পারি নি, ভেবেছি আপনার হয়তো আপনার সর্বগুন সম্পন্ন মেয়ে পছন্দ। আমার মাঝে তো শুধুই ভুল। আশাকরি আমার উত্তরটা পেয়েছেন”

আকরাম আবারো মৃদু হাসলো। কি অমায়িক হাসি, তার চোখও যেনো হাসছে। রুহামার বাবা বলেছিলো, ‘যাদের চোখ হাসে, তারা স্বচ্ছমনের মানুষ’। কথাটা মিলে গেছে। আকরাম বা হাতটা বাড়িয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
 “আজ পূর্ণচন্দ্রিমা, জ্যোৎস্নাবিলাস করবে? হুমায়ুন স্যারের বই এ পড়েছিলাম। প্রিয়তমার সাথে জ্যোৎস্নাবিলাস নাকি খুব সুখময়। করবে আমার সাথে জ্যোৎস্নাবিলাস?”

রুহামা অজান্তে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। সে ভেবেছিলো তার রুপকথার খোঁজ হয়তো অপূর্ণই থাকবে। একটা সময় সাঈদের মাঝে রুপকথা খুজতো, ভবিষ্যতের সুখের হাতছানি খুজতো। কিন্তু সে সব কাঁচের মতো ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তারপর আকরাম তার জীবনে আসে। কিন্তু লোকটির গম্ভীরতা তাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলো। ভেবেছিলো, রুপকথা খোঁজার পথই হারিয়ে ফেলেছে রুহামা। অবশেষে আজ সকল দ্বিধার অন্ত হলো, আকারামের মাঝেই খুজে পেলো তার রাজকুমারকে। রুহামার রুপকথার খোঁজ অবশেষে পূর্ণ হলো। রুহামা আলতো ঘাতে আকড়ে ধরলো আকরামের হাত। চাপা স্বরে বললো,
 “করবো, আজ রাতটি শুধু আমাদের।”



***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন