সঙ্গী - মুশফিকা রহমান মৈথি - অনু গল্প

পড়ুন মুশফিকা রহমান মৈথি'র লেখা একটি অনু গল্প সঙ্গী
সঙ্গী
সঙ্গী by মুশফিকা রহমান মৈথি

- আমি বাবার বিয়ে দিতে চাই!

তনুর এমন ধারা কথায় খানিকটা হতচকিত হয়ে গেলেন তনুর চাচী নাসিমা বেগম। যেখানে কিছুদিন পর মেয়ের কিনা বাচ্চা হবে সেখানে মেয়ে কিনা তার পঞ্চান্ন বছরের বাপের বিয়ের মতো সাংঘাতিক কথা বলছে। এমন ও হয় নাকি? হিনহিনে কন্ঠে বললেন,
- পাগল হয়ে গেলি নাকি তনু? এই বয়সে তুই আবার সৎ মা আনতে চাচ্ছিস। মাথা কি তোর খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
- ব্যাপারটা সৎ মা আনার নয় ব্যাপারটা আমি বাবার জন্য একজন সঙ্গী খুঁজছি। 
- লোকে কি বলবে, তোর বাবার বয়স ও তো কম না, এখন মেয়ে কি পাওয়া সম্ভব নাকি??
- খুঁজবে, মেয়ে পাওয়া যাবে না কেন?? ডিভোর্সি, বিধবা, এমন অনেক মহিলাই আছেন যারা এখনো বিয়ে করেন নি।  ত্রিশ পয়ত্রিশ বছরের মহিলা খুঁজা এতোও কঠিন নয় চাচী আম্মা। 

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো তনু। এতক্ষণ যার সাথে কথা বলছিলো তারা তনুর চাচা,চাচী। তনুর বাবার নাম আশরাফ হুসেইন। তনু যখন খুব ছোট মাত্র আটবছর, আশরাফের স্ত্রী মায়া মারা যান। মায়া মারা যাবার পর আশরাফ যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে। ছোট মেয়েকে নিয়ে কি করবে না করবে। আশরাফ তার স্ত্রীকে প্রচুর ভালোবাসতেন, আর মেয়েটিও হয়েছিলো পুরো মায়ের মতো দেখতে। টানা টানা চোখ, খাড়া নাক, হলদেটে ফর্সা গায়ের রং যেন সাক্ষাত নূর। আশরাফ সাহেব ঠিক করলেন তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করবেন না। একে তিনি মায়ার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারবেন না দ্বিতীয়ত মেয়েকে সৎ মায়ের কাছে মানুষ হতে দিবেন না। একটাই তো সম্বল তার, মায়ার স্মৃতি তাকে অবহেলা করেন কিভাবে। প্রথম একমাস বোন, ভাবী, শালীরা দেখলেও তারা তো সারাজীবন দেখবেন না। ঠিক করলেন মেয়ের দেখভাল নিজেই করবেন। বিয়ের জন্য কম সম্মন্ধ আসে নি। তবে তিনি বিয়ে করবেন নাতো করবেন ই না। 

 এতো অঢেল টাকা পয়সাও ছিলো না যে আয়া রাখবেন। শুধু একটা কাজের মেয়ে ছিলো সে যাবতীয় কাজ গুলো করে দিতো। তনু প্রায় সকাল বেলা উঠে দেখতো তার বাবা অসতর্কতাবশত হাত পুড়িয়ে ফেলেছে, নয়তো দুধ কমে অর্ধেক গ্লাস হয়ে গেছে। আশরাফ তখন মাথা চুলকিয়ে বলতো সামনে থেকে হবে না। তনুর বন্ধুরা প্রায় ক্ষেপাতো কারণ দেখা যেতো ওর একটা ঝুটি উপরে তো আরেক ঝুটি খুলে পড়ে যাচ্ছে। মেয়ের দেখভাল করতে হলে চাকরি ঠিক রাখাটা সম্ভব হচ্ছিলো না। একদিন আনতে দেরী হওয়ায় তনু বিকেল পর্যন্ত স্কুলে বসেছিলো। সেদিন রাতে ধুম জ্বর। আশরাফ ঠিক পেরে উঠছিলেন না। মায়া যেভাবে সংসারটা সাজিয়ে রেখেছিলো, সেভাবে আবার সাজিয়ে রাখা আসলেই কঠিন। ঠিক করলেন চাকরিটা ছেড়ে দিবেন। কিন্তু চাকরি ছাড়লেই তো হবে না, মেয়ের খরচ বাসাভাড়া সবই চালাতে তো হবে। একবন্ধুর কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করে ছোট্ট একটা মুদি দোকান দিবেন। ভাই-ভাবীর কথার অন্ত থাকলো না। 

- পৃথিবীতে কি তোর একার বউ মরেছে নাকি তোর একার বাচ্চা আছে। বারবার বলছি একটা বিয়ে করেনে বয়স তো পরে আছে। এখন ভালো সম্মন্ধ পেতে সমস্যা হবে না। বউ বাচ্চা করে করে মাথা উঠিয়ে নাচছে। এতো ভালো বেতনের চাকরি ছেড়ে মুদি দোকান। পারবি মেয়ে সামলাতে, দোকান সামলাতে??  
- তোমরা দোয়া করো তাহলেই হবে।

আশরাফের কাছে তার মেয়েই সব, মায়া স্মৃতি তারা বললেই তো আর হবে না। আশরাফ দোকান শুরু করলো। তাতে যা ইনকাম হতো তাতে খুবই কষ্টে সংসার চলতে লাগলো। আশরাফ কিন্তু হাল ছেড়ে দিলেন না। কারণ সে জানেন এক না এক সময় এই দুর্দিন ঠিক কেটে যাবে। 

তনু বড় হতে লাগলো, আশরাফ আয় ও বাড়তে লাগলো। এখন আশরাফের খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠলো তনু। তনু ছাড়া যেন সে কিছুই বুঝে না। আর তনুর বাবা ছাড়া চলেই না। যত আবদার তার বাবা। মেয়ে বড় হওয়ার সাথেই যে চিন্তাটা গ্রাস করে তা হলো তার বিয়ে। সম্মন্ধ আসে কিন্তু আশরাফ ইনিয়ে বিনিয়ে মানা করে দিতে লাগে। একটা সময় মানুষ একা থাকতে পারে না, তার সঙ্গীর প্রয়োজন হয় আর আশরাফের সেই সঙ্গীটি ছিলো তার মেয়ে। মেয়ে বাদে সে কিভাবে চলবে তার চিন্তা করলেই মাথা থেমে যায় যায়। 

তনুর বয়স বাইশে পড়লে চাচা-চাচী যেন বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে, না আশরাফ রাজী না তনু রাজী। আশরাফ যেমন মেয়েকে চোখের আড়াল করতে চায় না তনুও তেমন। তনুর এক কথা বিয়ে করতে হলে আশেপাশে করবো। কিন্তু ভাগ্যের লিখন, বিয়ে যেখানে হবার যেখানে তো হবেই। চাইলেও বদলানো যাবে না। ভালো পাত্রের সন্ধান তো মিললো কিন্তু তার বাসা অন্য এক জেলায়। তনু অনেক মানা করা সত্ত্বেও বিয়েটা হয়। কারণ ছেলে, পরিবার সবই ভালো। আর আশরাফকে বুঝানো হল মেয়ে কি তুমি ঘরে বসিয়ে আইবুড়ো করবে নাকি!! 

মেয়েকে বিদেয় দেয়ার পর যেন ঘরটা ফাকা ফাকা হয়ে গেলো। মায়ার ছবির সাথে কথা বলে কি দিন পার করা যায়। ব্যবসার দিকে মন দিলেও ফাকা জায়গাটা পূরণের উপায় নেই। দিন যত যেতে থাকে আশরাফের খাওয়া দাওয়ার ঠিক থাকে না, ঔষধের পাতা পরে আছে খাওয়ার কথা মনে থাকছে না। সেদিন রাতে খুব জ্বর এলো। তনুকে খবর দিতেই সে ছুটে এলো। বাবার এই অবস্থা দেখে তনু যেন নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে। বাবাকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জিদ করলে আশরাফ স্পষ্ট বলে দেয় সে যাবে না। মেয়ের বাড়ি ঘুরতে যাওয়া যায় থাকতে নয়। মেয়ে জামাই এতোবার করে বললেও সে মায়ার স্মৃতি ছেড়ে কোথাও যেতে নারাজ। শেষমেষ তনু ঠিক করে সে তার বাবার বিয়ে দিবে। এতে তনুর হাসবেন্ডের সাপোর্ট ছিল প্রচুর। গোল বাধলো  তনুর চাচা,মামা,খালা। তাদের সাথেই হলো কথা কাটাকাটি। তনুর মামা বলে উঠলেন,
- আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি পাগল হয়ে গেছে নাকি!! কি যাতা কথা বলছিস
- আমি কোনো ভুল কথা বলিনি! বাবার কি অবস্থা দেখেছো?? এই অবস্থায় তাকে একা রেখে আমি ঢ্যাং ঢ্যাং করে সংসারটা করবো কেমনে বলো?
- আজিব আমরা তো আছি নাকি আর তোর বাবা তোকে পেলেছে। এমন কোনো কাজ নাই যে সে পারে না। 

তনুর চাচী নাসিমা বেগমের কথা শুনে ঠান্ডা কন্ঠে তনু বললো,
- আমি কাজের বুয়া খুজতেছি না চাচী, আমি বাবার একজন সঙ্গী খুজতেছি। সে বাবার সাথে থাকবে, যার সাথে বাবা কথা বলবে। যে বাবাকে দেখে রাখবে। বাবার যাতে একা একা না লাগে। আর তোমাদের সংসার আছে না?? কতটুকু সময় দেও তোমরা বা দিতে পারবা?? বিয়ে তো আমি করতে এইজন্যি চাইছিলাম না শুনছো কথা তখন!!  এবার অন্তত আমার কথাটা শুনো প্লিজ।

তনু ঠিক করলো আগে একজন বন্ধুর ন্যায় মহিলা খুজবেন তারপর যদি মনে হয় তিনি তার বাবার বন্ধু হতে পারবেন তাহলেই বাবাকে রাজি করাতে পারবে। 

অনেক খুঁজেও কোনো মহিলা খুঁজে পাওয়া যায় না। যাদেরই সম্মন্ধ আনা হচ্ছে তারাই হয় টাকা-পয়সার জন্যই বিয়েতে রাজি হচ্ছে। বাবার জন্য সঙ্গী খুঁজার ইচ্ছে তনুর ইচ্ছেই থেকে যাচ্ছে। তাই ঠিক করলো একজন নার্স রাখবে যে বাবার দেখভাল করবেন। একজন নার্স খুঁজে পাওয়া গেলো। মহিলার নাম দামিনী, ছোট বয়সে স্বামী মারা যাওয়ায় ভাইয়ের সংসারে থাকেন তিনি। ছেলেমেয়ে নেই বলে, নিজের খরচ নিজে চালান। তার ভাইয়ের সংসারে যাতে উটকো ঝামেলা তা হন, তাই চাকরীটা করা। তনুর উনাকে দেখেই মনে হলো, উনি হয়তো বাবার জন্য একদম সঠিক সঙ্গী হবেন। 

দিন যত যেতে থাকে আশরাফের সাথে দামিনীর বন্ধুত্বও ভালো হতে থাকে। একটা বয়স থাকে যখন মানুষ একজন সঙ্গী চায়। যা তার সাথে কথা বলবে, সঙ্গ দিবে। দামিনীর সাথে আশরাফের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। কিন্তু কিছু মানুষ এর মধ্যেও নোংরামি খুঁজে বেড়ায়। কথা উঠতে লাগলো, দামিনীকে রাখার দরকার নেই, আশরাফ যেহেতু সুস্থ। তনু অসম্মতি জানালেও চাচা,মামা জোর করতে থাকে। তাই তনু সিদ্ধান্ত নেয় তাদের বিয়ের কথা বলবে। 

আশরাফ এবং দামিনী কেউই বিয়েতে রাজি হয় নি। প্রথমত আশরাফের পক্ষে মায়ার জায়গা অন্য কাউকে দেয়াটা সম্ভব নয় আর দ্বিতীয়ত দামিনীর এই বিয়ের প্রস্তাবে তার ভাই প্রচুর অসম্মতি জানান। তনু যখন ঠিক করেছে সে তার বাবার বিয়ে দিবে তো দিবেই। আশরাফকে বিয়ের প্রস্তাবটা দিতেই সে মানা করে দেয় এবং বলে,
- দামিনী আমার বন্ধু, তাকে বিয়ে করার প্রশ্নই উঠে না তনু।
- বাবা বন্ধুই নাহয় থাকলো, মায়ের জায়গা দিতে তো বলিনি। তোমার জন্য আমি বন্ধুই তো আনতে চাচ্ছি তাই না?
- মানুষ কি বলবে?
- বাবা মানুষ কি বললো তাতে কি আদৌ যায় আসে? তুমি একা একা থাকতে পারবে না বাবা। আর সত্যি বলতে তোমার কি আদৌ একাকিত্ব লাগে না??
- এটা সম্ভব না আর দামিনী কি রাজি হবে?
- সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও।

অবশেষে খুব কাটখোড় পুড়িয়ে বিয়েটা দেয়। এইটা নিয়ে অবশ্য কম কথা শুনে নি। কারণ পঞ্চান্ন বছরের বাবার জন্য নতুন বউ আনা সমাজে টিটকারির সমতুল্য। মানুষ শুধু বাজে ভাবেই সম্পর্কগুলোকে নেয়। অনেকের এই কথাও শুনেছে যে বুড়োবয়সে নাকি তার বাবার ভীমরতি। তনুর এসব কিছুতেই কিছু যায় আসে না। কারণ সে জানে যা সে করেছে তাতে ভুল নেই। বাবার জন্য এই বয়সে একজন সঙ্গী আনা সমাজের কাছে দৃষ্টিকটু হলেও আদৌও কি অনুচিত! পঞ্চান্ন বছর বয়সে কি তার বাবা বিয়ে করতে পারবে না!!



***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন