আয়াত অনেকক্ষন যাবত অফিসার নাহিদের সাথে কথা বললো। নাহিদ হা হয়ে তাকিয়ে বলল,
__আপনি যা বললেন এসব কী সত্যি সত্যি হয়েছিলো?
__বিশ্বাস না করলে আপনি ভালো করে তদন্ত করে দেখতে পারেন। এক চিলতেও পরিমানও মিথ্যা না।
__হুমম আপনার কথা বুঝলাম, মানলাম। কিন্তু আপনার স্ত্রীর কী কারো সাথে কোন শত্রুতা ছিলো? মানে আপনার কারো উপর সন্দেহ হয়?
__তনয়ার কোন শত্রু থাকতে পারেনা। কারন ও পুরোটাই ভালোবাসায় মোড়ানো। সবাইকে ভালো রাখতেই ও ভালোবাসতো।
__তারপরও ভেবে দেখুন কিছু মনে পরে কিনা?
বেশ কিছুক্ষন ভেবে আয়াত বলল,
__সঠিক না তবে একটা ঘটনার সাথে সম্পর্ক থাকতে পারে।
__আচ্ছা কী ঘটনা?
__আমার বোন মেঘাকে কিছু নোংড়া ছেলের কবল থেকে বাঁচিয়েছিলো। মেঘার সাথে হওয়া পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। সেই ছেলেগুলো নাকি তখন তনয়াকে হুমকি দিয়েছিলো। আর তাছাড়া খবর পেয়েছি তারা নাকি মাস দুই আগে জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছে।
__ওহ। দেখছি তাদের বিষয়টা। আরেকটা জিনিস জানতে চাই। এটা কেসের সাথে রিলেটেড না। আসলে আপনাদের দুজনার গল্প শুনে মনে হাজারো প্রশ্ন জাগছে। প্লিজ বলবেন?
__জি বলুন?
__আপনি তখন বললেন, তনয়া আপনাকে একবার বলেছিলো, সে নাকি আপনাকে আপনাদের পরিচয় হবারও তিন মাস আগে থেকে আপনাকে চিনতো কিন্তু কিভাবে?
__তনয়া যতটা বলেছিলো ততটাই বলছি। মেঘাকে কিডনাপ করার মাস দু আগে নাকি তনয়া আমাকে পার্কে দেখেছিলো।
__শুধু পার্কে দেখায় আপনাকে মনে রাখলো কারন পার্কে তো শত শত লোক থাকে। সবাইকে মনে রাখা কি সম্ভব!
__আসলে সেদিন পার্কে ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটছিলো। পার্কের বাইরে বাচ্চা একটা ছেলে বাদাম বিক্রি করছিলো, তো বাচ্চাটাকে একটা লোক কোন কারনে চড় মেরে বাচ্চাটার বাদামগুলো ফেলে দেয়। আমি তখন লোকটাকে অনেক কথা শুনিয়ে বাচ্চাকে ওর পরিচয় জিজ্ঞেস করি। পরে জানলাম বাচ্চাটা অনাথ। দিনে বাদাম বিক্রি করে রাতে পার্কের পাশেই ঘুমায়। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই আমি বাচ্চাটাকে ওখান থেকে নিয়ে গিয়ে, স্কুলে ভর্তি করিয়ে দি এবং স্কুলের বোডিং এ থাকার ব্যবস্থা করে সমস্ত ব্যয় নিজেই বহন করি। বাচ্চাটার নাম সাজু। তনয়া সেদিন পার্ক থেকে শুরু করে স্কুল পর্যন্ত আমাকে ফলো করে এমনকি ছেলেটাকে সেদিন যেখানে যেখানে নিয়ে গেছিলাম সব জায়গায় তনয়া আমায় ফলো করছিলো।
তো বুঝতেই পারছেন এসব ট্যাচিং ঘটনায় বিষয়ে মেয়েরা ইমোশোনালী কতটা সেন্সসিটিভ থাকে। আমার করা এ সামান্য কাজটা ওর মনে অনেক দাগ কেটেছিলো। সেই থেকেই তনয়া আমায় পছন্দ করতে শুরু করে। অবশ্য তারপর আর তনয়া আমায় দেখেনি। তারপর আমাদের দেখা হয়, তনয়ার বিয়ে থেকে পালিয়ে আসার দিন।
__ওহ। ধন্যবাদ বলার জন্য। দেখুন আপনাকে এখন গ্রেফতার করবো না, কিন্তু আপনার জামিন কে নিবে? যদি পালিয়ে যান। তাই তনয়ার পরিবার থেকে কাউকে আপনার সুপারিশ করতে হবে।
আয়াত দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, দেখেন তাদের সাথে কথা বলে তারা কী বলে?
নাহিদ তামিম আর তনয়ার বড় ভাই তানভিরের সাথে কথা বলল, তানভির কিছু বলার আগেই তামিম বলল,
__আমি নিবো আয়াতের জামিন। আমি জানি আয়াত পালাবেনা। আর এও জানি আয়াত তনয়াকে খুন করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা।
তামিমের কথা শুনে আয়াত যেনো আকাশ থেকে পরলো। কারন যে তামিম, আয়াতকে এত ঘৃণা করতো, তনয়ার শত চেষ্টার পরও যে, আয়াতের সাথে কথা বলতে নারাজ ছিলো সে আজ আয়াতের পক্ষ হয়ে কথা বলছে। বিষয়টা আয়াতের কাছে পৃথিবীর নবম আশ্চর্য্যের মত লাগছে।
যাই হোক পুলিশ সব কিছু বিস্তারিত জেনে চলে গেলো।
৩১!!
রাতে আয়াত তনয়ার কেবিনেই থাকতো। ঘুম তো আয়াতের চোখ থেকে কবেই চলে গেছে। তনয়ার দিকে তাকিয়ে তনয়ার দুরন্তপানার কথা ভেবে কখনো হাসে আবার কখনো তনয়া এমন অবস্থা দেখে কাঁদে।
৩২!!
প্রথবার যেদিন আয়াতের মায়ের সাথে তনয়ার দেখা হয়েছিলো, তনয়া ভয়ে যা তা অবস্থা করছিলো। অবশ্য তখন আয়াতের মা তনয়া আর আয়াতের রিলেশনের কথা জানতো না।
তনয়া শাড়ি পরে গুটি গুটি পায়ে আয়াতের সাথে হাঁটছিলো। তানভী তনয়ার নার্ভাসনেস দেখে কানে কানে বলল,
__বোন! শুনলাম তোর শ্বাশুড়ি নাকি ভয়ংকর রাগী। দেখবি তোকে কি পরিমান ধমকায়।
তনয়া ভয়ে ঢোক গিলে বলল,
__আয়াত পরে একদিন আপনার মায়ের সাথে কথা হবে। এখন আমি যাই।
তনয়ার কাচুমাচু মুখ দেখে আয়াত আর তানভী অট্টোহাসিতে ফেটে ফেরলো। দুজন মিলে জোড় করেই তনয়াকে ভিতরে নিয়ে যায়। তনয়া চুপচাপ সোফায় বসে রইলো।
লু্বনা বেগম আসতেই তনয়া, স্কুলের বাচ্চাদের মত তাকে দাড়িয়ে সালাম করলো। লুবনা সালামের জবাব দিয়ে বলল,
__তোমাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। আগে কোথায় দেখেছি বলো তো?
তনয়া চুপ করে আছে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। কী বলবে ও, আমি আপনার ছেলের পিএ + জিএফ। মান ইজ্জত তবে প্ল্যাস্টিক হয়ে যাবে।
তনয়াকে চুপ থাকতে দেখে আয়াত বলল,
__মা চিনলে না? ও তো তনয়া। যে আমাদের মেঘাকে বাঁচিয়েছিলো। আর তাছাড়া বাবার পিএ তো ওই।
__আরে হ্যাঁ ভুলে গেছিলাম। এ মেয়ে তো সেদিন তেমন কিছু না বলেই চলে গেছিলো। আল্লাহ্ মেয়েটা কি সুন্দর একদম পরীর মত। বসো মা বসো। তা তোমার নাম কি মা?
__জি জি আন্টি তনয়া।
__বাহ্ বেশ সুন্দর নাম। থাক আরে বসা লাগবেনা চলো, তোমাকে আমাদের ঘর দেখাকে দেখাতে পরিচিতো হই। তিনি তানভীকে দেখিয়ে বলল,
ওনি কি হয় তোমার?
__আন্টি তানভী আমার ভাই।
__বড় না ছোট?
__জমজ!
__বাহ্ তোমরা দু ভাই বোনই দেখতে অনেক সুন্দর। তানভী তুমি আয়াতের সাথে থাকো। আমি তনয়াকে নিয়ে যাচ্ছি।
আয়াত এখনও ভয়ে আছে। কারন লুবনা বেগম সব দিক দিয়ে ভালো হলেও। সে সেকেলে মানুষের মত কালো, বা প্রতিবন্ধী মানুষ একদম পছন্দ করেনা। তনয়ার আঙুল না থাকার বিষয়টা দেখলে কি রকম কি করবে সেটা নিয়ে বেশ চিন্তিত আয়াত।
লুবনা তনয়াকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। আর আয়াত তানভী এর সাথে কথা বলছে। তানভী মনে মনে মেঘাকে খুঁজছে। কিন্তু আয়াতের কাছ থেকে উঠার কোন চান্স পাচ্ছেনা। কিছুক্ষন পর বললো,
__ভাইয়া আমি আপনাদের বাড়িটা ঘুরে দেখি? বেশ সুন্দর?
__আচ্ছা ঠিক আছে। তানভী আয়াতের কাছ থেকে কৌশলে মেঘার রুম কোন সাইডে সেটা জেনে নিলো।
তানভী মেঘার দরজার সামনে গিয়ে নক করে। মেঘা ভাবছে, ওদের বাসার কাজের মেয়ে শীলা। তাই বললো,
__ভিতরে আসো।
তানভী ভিতরে ঢুকে দেখে মেঘা, জামার পিছনের ফিতা বাঁধার চেষ্টা করছে। কিন্তু ফিতাটা প্যাচ লেগে গিট্টু পরে গেছে। মেঘা রুমে কে ঢুকেছে সেটা খেয়াল না করে বলল,
__শীলা আমার ফিতাটা খুলে দে তো। দেখ ফিতাটা প্যাচ লেগে গেছে।
তানভী শয়তানি হাসি দিয়ে ফিতাটা খুলতে লাগলো।প্যাচ খুলে ফিতাটা বেঁধে তানভী বললো,
__হয়ে গেছে মেঘের টুকরো!
মেঘা পিছনে ঘুরে তানভীকে দেখে চোখ বড় বড় করে চিৎকার করতে যাবে এর মধ্যে তানভী মুখ চেপে ধরে বলল,
__প্লিজ চিৎকার দিওনা। তোমার ভাই কিনা আমায় রেপ কেসে পুলিশে দিয়ে দেয়।
__তো এভাবে নক না করে মেয়েদের রুমে কেন ঢুকছেন?
__আমি নক করছিলাম আর মেয়েটাই আমায় ঢুকতে বলছে। তো?
__আমি তো আমাদের বাসার কাজের মেয়ে শীলাকে ভেবেছিলাম।
__সেটা তোমার দোষ! আমার কী? আর আমার উত্তরটা তো এখনও দিলা না?
__বললাম তো ভেবে জানাবো!
__ওহ। তা ভাবতে বুঝি আমার ছবি দেখা লাগে।
__মানে আমি আপনার ছবি কখন দেখছি?
__ওহ্ রিয়েলি তো ল্যাপটপে ওটা কার ছবি? আমার জমজ ভাইয়ের?
মেঘা ভাবতে পারেনি এভাবে ও তানভী এর কাছে ধরা খেয়ে যাবে। মাথা চুলকে মেঘা বললো,
__আমি তো ল্যাপটপে কাজ করছিলাম, ওটা বোধয় ভুল এসে গেছে।
__তানভী মেঘার হাত ধরে বলল, মেঘা আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো। প্লিজ এভাবে আমায় কষ্ট দিওনা। তুমি চাইলে এখন এই মুহূর্তে আমি তোমার মা, আর ভাইকে এটা বলবো আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই। মেঘা তার আগে তোমার উত্তরটা জরুরি। বিয়ে করবে আমায় মেঘা?
__মেঘা মুখে বলছে না অথচ মাথায় নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি দিচ্ছে।
তানভী মৃদু হেসে মেঘাকে বুকে নিয়ে বলল,
__ভয় পেয়োনা তোমার বিশ্বাস ভাঙবো না।
__ প্রমিজ বলো!
__একশবার প্রমিজ। আচ্ছা তোমার জ্বরতো এখনও কমেনি। গা বেশ গরম। ঔষধ খেয়েছো?
__হুম। মেঘা, তানভী এর বুকে মুখ লুকিয়েই কথা গুলো বলছে।
__শরীর কী বেশি খারাপ লাগছে?
__এতক্ষন ছিলো, এখন ভালো লাগছে।
__কেন?
__তোমার বুকে ঠাঁই পেয়ে গেছি যে! সব রোগ পালিয়েছে তাই।
__তা জড়িয়ে ধরলে যদি রোগ পালায়, তাহলে তো বেচারা ডাক্তারদের পথে বসতে হবে। সবাই নিজের কাছের মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে রোগ তাড়াবে।
মেঘা তানভীর বুকে একটা ঘুষি মারলো। তানভী বলল,
মেঘের টুকরো আমরা বিয়ে কবে করবো?
__প্রেম হলো মাত্র কয়েকমিনিট আগে এর মধ্যেই বিয়ের কথা কেন বলছো? এত ফাস্ট কেন?
__নয়তো পরে যদি হারিয়ে ফেলি। বলো না কবে?
__তোমার আমার লেখা পড়া শেষ হবে তখন।
__হায় আল্লাহ্ এখনও চার বছর? এতদিন কি করে থাকবো।
__আমায় ভালোবেসে।
__হুমম ভালোবাসি মেঘা। তোমায় খুব ভালোবাসি।
তনয়া মেঘার রুমে ঢুকতে গিয়ে দরজা খুলে দেখে, মেঘা আর তানভী দুজন দুজনকে জড়িয়ে আছে। তনয়া মৃদু হেসে দরজা ধীরে করে আটকে আয়াতদের বাড়িটা চারপাশ দেখছে। লুবনা দশ পনেরো মিনিটের জন্য পাশের বাসায় গেছে। তাকে জরুরি কাজে পাশের বাসার আন্টি ডেকেছেন। তনয়া একা একা বোর হচ্ছে খুব। হাঁটছে আর ঘুরে ঘুরে ঘর দেখছে। তখন আয়াত তনয়ার কাছে এসে হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে বলল,
__কী ম্যাডাম? খালি শ্বশুর বাড়ি দেখলে হবে? হাজবেন্ড এর দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে।
__না হবেনা।
__মিস তনয়া রুমটা ভালো করে দেখে নিন। কিছুদিন পর আপনাকে এই রুমেই, আর এই আয়াতের বুকে থাকতে হবে।
__যাহ্ (লজ্জা পেয়ে)
আয়াত তনয়ার হাতটা নিজের বুকের বাম পাশটায় রেখে তনয়াকে কাছে টেনে কবিতা বলা শুরু করলো,
অনন্ত-যৌবনা ওগো তুমি আমার মানসী প্রিয়া,
কোথায় লুকালে বন্ধু তুমি আমার হদয় কারিয়া ;
ভেবেছিলাম তোমায় নিয়ে বাঁধবো ছোট্ট নীড়,
সংঘাত থাকবে না সেথা থাকবে প্রেম সুনীবিড়।
এসো প্রিয়া কাছে এসো ভালবাসবো তোমায়
মনের দুয়ারে শুধু তোমারই ছবি ভেসে বেড়ায়
কতকাল আর থাকবো বলো তোমার অপেক্ষায়
দ্বিধা দ্বন্ধ ভূলে প্রিয়া আপন করে নাও আমায়।
মান অভিমান আর চাওয়া পাওয়ার দ্বন্ধে পড়ে,
হারাতে চাইনা তোমায় পেতে চাই আপন করে ;
কথায় কথায় ভূল বুঝে আর অভিমান করোনা ,
দূরে কিংবা কাছে থাক আমায় ছেড়ে যেওনা।
কবিতাটা শুনে তনয়া লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। আয়াতের কবিতা বলার ধরনটা কেমন যেনো হৃদয় স্পর্শি। তার ভিতর আজ আয়াতের চোখে, ঠোঁটে দুষ্টমি খেলা করছে। নিজের সমস্ত আবেগ দিয়ে যেনো কবিতাটা বলছে। তনয়া লজ্জায় নিজের হাত মুচরাচ্ছিলো।
আয়াত সেটা দেখে বলল, কবিতা শুনে এত লজ্জা। পাচ্ছো নাম শুনলে কি করবে? জানো কবিতাটার নাম কি? তনয়া উৎসুক চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াত কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, কবিতাটার নাম ***প্রেম বাসনা***। এ
বার লজ্জায় তনয়া হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। তারপর চোখ বন্ধ করেই বললো, এমন নাম দিয়ে কোন লেখক কবিতাটা লিখছে?
__লেখকের নামটা মনে নেই। তবে তুমি কি চোখটা খুলবে।
__পারবো না।
আয়াত সেটা দেখে মৃদু হেসে তনয়ার তনয়ার চুলে বিলি কেটে বলল,
__ম্যাডাম শাড়ির নিচের অংশে ধূল কি করে লাগলো।
তনয়া চোখ মেলে শাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
__ওপস, খেয়াল করিনি।
আয়াত নিচে ঝুকে শাড়ির কুচির নিচে অংশে লেগে থাকা ধূল গুলো পরিষ্কার করে দিয়ে দাড়ানোর সময় তনয়ার কোমরে একটা চিমটি কেটে দিলো। তনয়া উহ করে রাগি চোখে আয়াতের দিকে তাকালো।
—————
__আপনি আমায় চিমটি কাটলেন কেন?
__কোথায় দেখি বলে তনয়ার কোমরে হাত দিতে গেলে তনয়া, আয়াতের হাতে চিমটি কেটে বলে,
__আজ মাথায় এত দুষ্টমি ভর করছে কেন?
__সত্যি বলছো আজ মাথায় চরম দুষ্টমি ভর করছে।
__আপনি দুষ্টমি নিয়ে থাকেন! আমি আন্টির কাছে গেলাম।
__তনয়া শোন!
__হুমম
__তনয়ার কপালে চুমো এঁকে দিয়ে বলল, আই----- না থাক কিছু না।
__এবার তো আই এর পরের ম্যাজিক ওয়ার্ড দুটো বলেন!
__নাহ্! ম্যাজিক ওয়ার্ড ম্যাজিক মোমেন্ট এ বলবো। তুমিও তো বলোনি।
__হুহ। আমিও ম্যাজিক মোমেন্ট এ বলবো! ভেংচি কেটে তনয়া চলে গেলো।
রান্না ঘরের টুকটাক শব্দ অনুসরন করে তনয়া রান্না গিয়ে দেখে লুবনা নাস্তা বানাচ্ছে। তনয়া তার কাছে গিয়ে বলল,
__আন্টি আমি হেল্প করি?
__আরে না না। তুমি অতিথী তুমি কেন কাজ করবে!
__আন্টি প্লিজ না করবেন না। আমি রান্না করতে অনেক ভালোবাসি।
__সত্যি। বাহ্ বেশ ভালো। আজকালকার মেয়েরা তো রান্না ঘরে আসতেই চায়না।
__আন্টি নানান রকম রান্না করা আমার হবি। তা আন্টি কি রান্না করছেন?
__বেশি কিছু না। সবজি পিঠা, আর হালিম বানাচ্ছি।
__আন্টি আপনি আমাকে আধাঘন্টা সময় দিন আমি বানিয়ে ফেলছি।
__আমিও সাহায্য করি।
__আচ্ছা আন্টি।
দুজন মিলে বেশ ভালোভাবেই রান্না করছে। লুবনা হালিমটা বসিয়ে দিলো, তনয়া সবজি পিঠাগুলো ভাজছে। লুবনার ফোন আসায় লুবনা, রুমে গেলো। তনয়া পিঠা ভাজছে, এই ফাকে আয়াত এসে তনয়াকে পিছন দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
__বাহ্ গৃহিনীর মত শ্বশুর বাড়ির কাজ করা শুরু করে দিয়েছো যে। বাহ্ বেশ ভালো, জলদি তোমার হবু শ্বাশুড়িকে পটিয়ে নাও। আর জলদি আমায় বিয়ে করো। আর যে, দূরে থাকতে পারছি না।
__সেটা নাহয় করলাম কিন্তু বস আজ আপনার মধ্যে এত দুষ্টমিতা কোথা থেকে আসলো?
__আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা। তোমার ঘ্রানটা আজ পাগল করে দিচ্ছে। নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে। বড্ড কাছে পেতে ইচ্ছা করছে।
__কন্ট্রোল ইউর ইমোশোন মি: আয়াত।
__হুম জানি।
__এবার দূরে গিয়ে দাড়ান নয়ত আন্টি এসে পড়বে।
আয়াত তনয়ার গালে একটা ভালোবাসা দিয়ে রান্নাঘর থেকে চলে গেলো। তনয়া মৃদু হাসতে হাসতে পিঠা ভাজছে। পিঠাগুলো যখন প্লেটে তুলে রাখছিলো, তখন লুবনা তনয়ার হাতের দিকে খেয়াল করলো। ভালো করে তনয়ার ডান হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই জিজ্ঞেস করে বসলো,
__তনয়া তোমার হাতে কী হয়েছে?
তনয়া প্রশ্নের উত্তর দিতে অনেকটা ইতস্তবোধ করছে তবুও বলল,
__আন্টি আমার ডান হাতের দুটো আঙুল নেই।
__কেন? মানে কোন একসিডেন্ট নাকি?
__না আন্টি জন্ম থেকেই।
__ওহ।
হঠাৎ করেই লুবনা বেগমের হাসি হাসি মুখটা মেঘেলা আকাশের মত কালো হয়ে গেলো। কিছুক্ষন অাগে যখন আয়াত তনয়াকে জড়িয়ে ধরে ছিলো, সেটা তিনি দেখছিলেন। তার বেশ ভালো লেগেছিলো এটা ভেবে যে, তনয়ার মত সুন্দর একটা মেয়েকে তার ছেলে পছন্দ করেছে। মাত্র কয়েকমুহূর্ত আগে তিনি তনয়াকে নিজের ছেলের বৌ হিসাবে মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু তনয়া প্রতিবন্ধীতার কথা জেনে নিমিষেই তার সিদ্ধান্ত বদলে গেলো। তার এখন মনে হচ্ছে, তনয়ার সাথে তার ছেলের বিয়ে হলে, তাকে সবার নিকট হাসির পাত্র হতে হবে। কিন্তু আয়াতের সাথে সরাসরি কথা না বলে তো কিছু করতেও পারবে না। তারপর ভাবলো, দেখি মেয়েটার পরিবার কেমন?
তিনি তনয়াকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তনয়ার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। এও জিজ্ঞেস করলো এত বড় পরিবারের মেয়ে অন্যের অফিসে জব কেন করে? তনয়া সরল মনে ওর বিয়ে আর বিয়ে থেকে পালানোর সব কথা বলে দিলো। লুবনা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো, তনয়াকে আয়াতের বৌ হিসাবে জীবনেও মানবে না।
তিনি আর তেমন কথা বাড়ালো না। তানভী তনয়া নাস্তা করে চলে আসলো। আয়াত রাতের ডিনার করতে বলছিলো, কিন্তু তানভী সময় পাবেনা, তাই ওরা থাকলো না।
৩২!!
রাতের বেলা আয়াতরা খাবার সময় আয়াতের মা বলল,
__তুই তনয়াকে বিয়ে করতে চাস?
__মায়ের এমন কথায় আয়াতের গলায় খাবার আটকে গেলো। পানি খেয়ে আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ।
__তাহলে বলবো তনয়াকে ভুলে যাও। কারন আমি মরে গেলোও কোন প্রতিবন্ধী মেয়েকে ঘরের বৌ করে আনবো না।
__মা তুমি এগুলো কী বলছো? সামান্য দুটো আঙুল না থাকায় তুমি তাকে প্রতিবন্ধী বলতে পারোনা। কোন মানুষই নিখুদ না। তার কোন কোন ত্রুটি থাকেই। তুমি তনয়ার দুটো আঙুল নেই দেখলে অথচ ওর ভালো গুন গুলো দেখলে না মা?
__দেখ আয়াত আমি অত কথা শুনতে চাইনা। ঐ মেয়ে তোর বৌ হবে না বাস হবেনা। ঐ মেয়েকে তোর বৌ করে এনে আমি সবার কাছে হাসির পাত্র হতে পারবো না।
এবার আয়াতের বাবা আমজাদ হোসেন বলল,
__লুবনা তুমি ভুলে যাচ্ছো মেয়ে তোমার ঘরেও আছে। সেও দেখতে কালো। তুমি অন্যের মেয়ের সাথে যা করবে, আল্লাহ্ না করুক তোমার মেয়ের সাথেও না সেটা হয়।
__আমার মেয়ে কালো হলেও দুশ্চরিত্র নয়।
__আয়াত রাগ করে বলল, মা এসব তুমি কী বলছো? তনয়ার বিষয়ে একদম উল্টা পাল্টা কিছু বলবা না বলে দিলাম। আর তুমি তনয়ার বিষয়ে কতটুকো জানো যে, ওকে নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করছো,
__যে, মেয়ে বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করবেনা বলে, বিয়ের দিন বাবার মান সম্মান ডুবিয়ে পালিয়ে আসে তাকে ভালো কোন উপাধি দিতে পারলাম না।
__মা এসব কথা তোমায় কে? বলছে?
__তনয়া নিজে বলছে। বিকেলে ওর পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করতে ও সব বলে দিলো। একে তো প্রতিবন্ধী তার ওপর বিয়ে পালানো। এমন মেয়েকে ঘরের বৌ করে এনে আমি লোক হাসাতে চাইনা।
লুবনার কথা আয়াতের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, যতটা ওর মায়ের উপর ততটাই তনয়ার উপর। কী দরকার ছিলো মাকে বিয়ে থেকে পালানোর ব্যাপারটা বলার? ও সরল দেখে সবাইকে এত সরল কেন ভাবে? ও কি জানেনা সরল উক্তি সবসময় সবার সাথে খাটে না। সবসময় আগ বাড়িয়ে পাকামো করা তনয়ার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। মন চাইছে মেয়েটার দু গালে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতে। ফাজিল মেয়ে সবসময় এক লাইন বেশি বোঝে। সত্য বাদী যুধিষ্টী হয়েছে। কাল দেখা হোক তারপর ওর খবর নিচ্ছি। আয়াতের মা আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
__কিরে কিছু বল? দেখ তোদের বয়সে প্রেম হওয়াটা স্বাভাবিক। তেমনি আজকালকার যুগে ভুলে যাওয়াটাও কঠিন কিছুনা। মেয়েটাকে অফিস থেকে বের করে দে। ওসব থার্ড ক্লাস মেয়েদের পাত্তা না দিলেই হয়।
আয়াত দুম করে খাবার প্লেট জোড়ে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাড়ালো। খাবার প্লেটটা লেগে পানির গ্লাসটা কাত হয়ে পরে গেছে। আর আয়াতের উঠার সময় চেয়ারটা নিচে পরে গেলো। আয়াত দাড়িয়ে বলল
__মা যাকে তুমি থার্ড ক্লাস দুশ্চরিত্রা বলছো তার কারনেই তোমার মেয়ে ধর্ষিতা বদনাম পাবার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আর একটা কথা কান খুলে শুনে মা, জীবনে বিয়ে যদি কাউকে করি, তবে তনয়াকেই করবো। আল্লাহর কসম কেটে বলছি মা তনয়াকে না পেলে এমন তান্ডব করবো যে, তার চিন্তাও করতে পারবা না। তখন দেখবো কোথায় থাকে তোমার সমাজ আর কোথায় থাকে তোমার স্টাটাচ।
আয়াত না খেয়েই হনহন করে ওখান থেকে রুমে চলে গেলো।
লুবনা বেগম, আমজাদ হোসেন, মেঘা আর আয়াজ হা করে তাকিয়ে রইল। কারন আয়াত রাগ করে প্রায়ই কিন্তু এমন ভাবে কথা খুব কমই বলে।
রুমে গিয়ে দেখে ফোনটা বাজছে, ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো তনয়া ফোন করেছে। কিন্তু রাগে আয়াতের পুরো শরীর জ্বলছে। যেমন রাগ তনয়ার উপর হচ্ছে তেমন ওর মায়ের উপর। ফোনটা হাতে নিয়ে বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
আয়াতের ফোন কয়েকবার ট্রাই করে তনয়া বন্ধ পেয়ে মেঘাকে কল দিলো। মেঘা ফোন ধরতেই তনয়া বলল,
__মেঘা তোমার ভাইয়া কী বাসায়? না মানে ওর ফোন বন্ধ।
মেঘা ভাবলো, ঘরে যা হয়েছে তা তনয়াকে বলা উচিত হবেনা। বেচারি শুধু শুধু টেনশন করবে। তাই বললো,
__ভাবি ভাইয়া বোধয় ব্যস্ত তাই ধরছেনা। তুমি টেনশন না করে ঘুমিয়ে পড়ো, সকালে তো দেখা হচ্ছেই।
__হ্যাঁ তাও ঠিক। তবুও প্লিজ তাকে একটু দাওনা? ওর সাথে কথা না বললে ঘুম হয়না। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
মেঘা কোন উপায় না পেয়ে ফোনটা নিয়ে ভয়ে ভয়ে আয়াতের রুমে গেলো। রুমে গিয়ে বলল,
__ভাইয়া ভাবি তোর সাথে কথা বলবে।
আয়াত দাতে দাত চেপে ফোনটা কানে ধরলো। মেঘা ভাবলো ওদের স্পেস দেয়া উচিত তাই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। কানে ফোন নিয়ে রাগে গম্ভীর বলায় বলল,
__হ্যাঁ বলো?
__ডিনার করছেন?
__হু
__বিজি নাকি?
__হু
__ফোন বন্ধ কেন?
__হু
__কি হু হু করছো? ঠিকভাবে কথা বলো।
আয়াত কোন কথা না বলে ফোনটা কেটে মেঘাকে ডাক দিয়ে ফোনটা দিয়ে বলল। এরপর ও ফোন করলে আমায় দিবিনা। আমায় একদম ডিসট্রাব করবি না। আমি একা থাকতে চাই।
তনয়া নিজের ফোনটার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ঠিক কী হলো? তারপর অনেকবার আয়াতের ফোন ট্রাই করেও ব্যার্থ হলো।
৩৩!!
সকালে অফিসে ঢোকার টাইমে আয়াত রাস্তার অপর পাশে তাকিয়ে দেখলো, তনয়া দীপুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর দীপুর সাথে হাতও মেলাচ্ছে। এমনিতেই কাল রাতের রাগটা পড়েনি তারপর আবার দীপুকে তনয়ার সাথে দেখে রাগে মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে ভিতরে গিয়ে, একজন স্টাফকে বললো,
__তনয়া আসলে ওকে ইমিডিয়েট আমার রুমে পাঠিয়ে দিবে।
__জি স্যার।
বেশ কিছুক্ষন পর তনয়া অফিসে এসে শুনলো আয়াত নিজের কেবিনে ডাকছে। তনয়া দরজায় নক করতে আয়াত দরজা খুলে তনয়াকে ভিতরে ঢুকিয়ে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিলো। তনয়া ভয়ে কেপে উঠলো। আয়াতের দিকে তাকিয়ে যেনো আরো বেশি ভয় পেলো। আয়াতের চোখ থেকে রাগে যেনো আগুন ঝরছে। তনয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
__ককক কী হয়েছে?
আয়াত তনয়াকে দুম করে চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের সাথে চেপে ধরে বলল,
__তুমি মাকে তোমার বিয়ের বিষয়ে সব সত্যি কেন বলছো?
__আমি তো ভাবছি আন্টির সব জানা উচিত তাই।
__সহজ সরল সাজার নাটক করছো? আর তুমি দীপুর সাথে কী করছিলে?
__কি কিছুনা আয়াত। জাস্ট কথা বলছিলাম।
__তো কথা বললে হেসে হেসে হাত মিলান লাগবে কেন?
__আয়াত ওটাতো এমনি! দীপু------
__চুপ। তোমাকে না ঐ কুকুরটার সাথে কথা বলতে নিষেধ করছিলাম! এত হাসাহাসি কিসের ওর সাথে ? এসব কি নতুন চলছে, নাকি ওদের বাড়ি থাকতেই চলছে!।
__আয়াত কি সব আজেবাজে কথা বলছেন?
__এখন আজে বাজে কথা হয়ে গেলো আর ওর সাথে ঢলাঢলি করার সময় মনে ছিলো না।
__ছি আয়াত। এসব কী বলছেন?
আয়াত নিজের রাগটা কিছুতেই কমাতে পারছেনা। আয়াত এমনি যতই ভালো হোক তনয়াকে নিয়ে ভিষন পজেসিভ। তনয়াকে অন্য ছেলের সাথে দেখলেই মাথায় রক্ত উঠে যায়। আর দীপুকে তো আয়াত সহ্য করতেই পারে না।