অলকানন্দা - পর্ব ২৭ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৭৮!!

মুইংচিন খুবই ব্যস্ত। চাইনিজ হওয়ার সুবাদে চীনের প্রতি দুর্বলতাটা তার বেশি। সুদূর চীন থেকে কিছু উপহার এসেছে তার জন্য। সেগুলো ড্রয়িং রুমে মাটিতে বসে খুলছে সে। পাথরের কয়েকটা মূর্তি এসেছে। একটা কাঙ্ক্ষিত মূর্তি হাতে পেতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। মূর্তির পায়ের কাছটায় নিজের হাত বুলিয়ে অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করলো মুইংচিন। হাসলো কতক্ষণ আপনমনে। হাসলে তার চোখের দুপাশে ভাঁজ পড়ে। চোখ দুটি ছোট হয়ে আসে। তখনই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো মাহা। গত দুদিন যাবত সার্থক হাসপাতাল যায়না। ছুটি নিয়েছে। মাহাকে আদরে আদরে ভুলিয়ে দিয়েছে সকল যন্ত্রণা। মাহার হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় এতটা সুখও কি তার কপালে ছিলো! সার্থক কাজ করছে ঘরে। তাই মাহা ভাবলো সার্থকের জন্য কফি করবে। যে ভাবা সে কাজ। নিচে নেমে এলো সে। মুইংচিন কে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো তার পানে। কাকের মতো সরু মুখ, মাথায় গজানো অনেকগুলো হরিণের ন্যায় শিং। সাদাকালো ছবিটায় অদ্ভুত মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট একটা প্রাণী। নখগুলো বড় বড়। নখগুলো লাল, ঠোঁটও লাল। এমন উদ্ভট একটা মূর্তি মুইংচিনের হাতে দেখে খানিক অবাক হলো মাহা। মনে করার চেষ্টা করলো এমন মূর্তি কিংবা ছবি কোথায় যেন দেখেছে সে। মাহাকে সামনে দেখতে পেয়ে থতমত খেলো মুইংচিন। মাহার পিছন থেকে কেউ একজন চোখ রাঙাচ্ছে তাকে। তাই তৎক্ষনাৎ বাক্সের ভিতরে ভরে ফেললো সে মূর্তিটা। ভয়ে হাত কাঁপছে তার। 
"আপনার হাতে কি মুইংচিন?"
"কিছুনা।"

মাহা বিষয়টা আর ঘাটালোনা। কেউ যদি প্রশ্ন করলে কিছু বলতে না চায় বারবার তাকে একই কথা জিজ্ঞেস করা মাহার অপছন্দ। কি মনে করে পিছনে ফিরলো মাহা। এমিলিন দাঁড়িয়ে। মাহা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। এমলিন আজো তার কাছে রহস্য। কফি বানানো কালে হঠাৎই পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। মাহার অবচেতন মন সায় দিয়ে উঠলো "এটা তোর একান্ত আপনজন"। মুচকি হাসলো মাহা। এবারে আরো সাহসী হলো জড়িয়ে ধরা হাত। তীব্র দুষ্টুমি করার আগেই মাহা ধরে ফেললো সে হাত। 
"উফ্! কি শুরু করেছেন আপনি? বাড়ি ভর্তি মানুষ। দেখে ফেলবে কেউ।"
"কেউ দেখবেনা।"

সার্থকের মায়াময় নেশা জড়ানো কন্ঠ। এবারে চরম অবাধ্য হলো সার্থক। মাহাকে সামনে ফিরিয়ে অধর টেনে নিলো নিজ দখলে। ঘটনার আকস্মিকতায় মাহা হতভম্ব। কারো পায়ের শব্দে মাহাকে ছেড়ে দিলো সার্থক। মাহা চোখ রাঙিয়ে তাকালো সার্থকের পানে। হাঁপানো স্বরে বললো,
"আপনি চরম অসভ্য।"
"বউয়ের কাছে এই পৃথিবীর সব পুরুষ অসভ্য। নয়তো....

তাড়াতাড়ি সার্থকের মুখ চেপে ধরলো মাহা। এই লোক যা পাঁজি। নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা কিছু বলে লজ্জায় ফেলবে তাকে। সার্থক হাসলো। মাহা অভিভূত হয়ে দেখছে সে হাসি। হাসলে কি সুন্দর লাগে লোকটাকে। সার্থক আবারো টুপ করে আদর দিলো মাহার হলদেটে ফর্সা গালে। মাহা লজ্জা পেয়ে মুখ লুকালো সার্থকের বুকেই। হা হা করে হেসে উঠলো সার্থক। 

এত আনন্দ! এত খুশি! সহ্য করা দায়। বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে কারো। 

!!৭৯!!

"ভাইয়া এটা পাবলিক প্লেস।"

নিভার কন্ঠ পেয়ে মাহাকে নিজের থেকে মুক্ত করতে বাধ্য হলো সার্থক। রবার্ট কে নিভার পাশে দেখে লজ্জা পেয়েছে মাহা। সার্থক হাসছে। মাহা কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে। 
"নিজের বাড়ি আবার পাবলিক প্লেস নাকি, নিভা! আমার বউ আমি রোমান্স..

মাহা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সার্থকের টি-শার্ট। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে বললো,
"থাক, তোমার ভাবি লজ্জা পাচ্ছে। বাকিটা আর বললাম না।"

সবাই হেসে উঠলো একসাথে। রবার্টের মতো মুখচোরা লোকের মুখে হাসি। রবার্টের চোখগুলো কেমন যেন চেনা চেনা। 

________________

প্রলয় ঠাস করে ফাইলটা টেবিলে রাখলেন। তার সামনে তাজ, মোবারক আর রেজওয়ান দাঁড়িয়ে। তাদের দেওয়া একমাস সময় পার হয়ে গিয়েছে। এখনো কেস যেমন ছিলো তেমনি। সময়ের ব্যবধানে মিডিয়াতেও ধামাচাপা পড়েছে ছিন্ন পায়ের খবর। প্রলয় কঠিন কন্ঠে বললেন,
"তোমাদের মতো এতো বাহাদুর অফিসারদের কাছে আমি এমনটা আশা করিনি। ফাইলটাতে বারবার তোমরা মাতব্বর শরীফকে কেন টেনে আনছো! তিনি তো সেলে আছেন। ডিএনএ রিপোর্ট বলছে এটা চৈতি নামক মেয়েটার পায়ের খন্ড। মাহা হোসেনের অফিসিয়াল কোনো জবানবন্দি নেই ফাইলে। ভিক্টিম যে বাসায় উঠেছিলো সিলেট। সে বাসায় খোঁজ করা আগেই উচিত ছিলো তোমাদের। এতটা ইরিসপন্সিবল কি করে হলে তোমরা। স্পেশালি রেজওয়ান তোমার কাছে তো আমি এটা আশা করিনি। আসল অপরাধীদের কোনো চিহ্নই তোমরা খুঁজে পেলেনা! স্ট্রেঞ্জ!" 

রেজওয়ান মাথা নত করে বললো,
"স্যার, আর কিছুদিন সময় প্রয়োজন। মাতব্বর শরীফের সাথে আমি আরেকবার দেখা করতে চাই। তিনি এ ব্যাপারে জানেন। আমার মনে হচ্ছে।"
"মনে হয়, মনে হচ্ছে এসব কথা পুলিশের মুখে মানায় না। উপর মহল থেকে চাপ আসছে। ২০১২ আমরা ফিরে পেতে চাইনা। আমি তোমাদের উপর থেকে দায়িত্ব উঠিয়ে গোয়েন্দা বিভাগ কে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। এভাবে তো হয়না। আর মাহা হোসেনের একটা অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট প্রয়োজন।"

রেজওয়ান বলে উঠলো, 
"স্যার, আমি মাহা হোসেনের স্টেটমেন্ট নিয়েছি। ও এখন অসুস্থ। ওকে চাপ না দিলে....
"স্টেটমেন্ট কি অফিসিয়াল ছিলো মিঃ রেজওয়ান?"

রেজওয়ান মাথা নত করে বললো,
"নো স্যার।"
"মাহা হোসেন কি আপনার ব্যাক্তিগত পরিচিত মিঃ রেজওয়ান?"
"জ্বী।"
"মাহার আরেকটা অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট নিতে হবে।"
"স্যার, আমাদের আর কিছুদিন সময় দিন।"

 তাজ এবং মোবারকও সেই অনুরোধ করলেন। প্রলয় খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন,
"ওয়েল, এক সপ্তাহ সময় পাবেন আপনারা। তারপর কেসটা গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করবো আমি।"
"ওকে স্যার।"

!!৮০!!

একযোগে বলে উঠলো তিনজনে। রেজওয়ান চাচ্ছে সে নিজে থেকে এই ঘটনার একটা বিহিত করতে। নয়তো মাহাকে প্রচুর হয়রানির শিকার হতে হবে। রেজওয়ান কেসটায় ছিল বলে মাহা রক্ষা পেয়েছে। নয়তো মাহার রিমান্ড হতে পারতো। রেজওয়ান চায়না তার প্রিয় মানুষটা কষ্ট পাক। হোক বিয়ে। রেজওয়ানের প্রিয় মানুষ তো মাহা। এতগুলো বছরের ভালোবাসা কি আর দু-তিন মাসের ব্যবধানে কমে যাবে! 
_____________

"ব্যবসায় বিরাট লোকসান দেখা দিচ্ছে। এমন করলে তো হবেনা। আমরা বিপদের মুখে পড়তে পারি।"
"রাজার এমন উদাসীন মনোভাব সবাইকে ভাবাচ্ছে। কি ব্যবস্থা করা যায়!"
"পথের কাঁটা উপড়ে ফেলা যায়।"
"উঁহু, ক্ষতি আমাদের।"
"হুম। রাগের কথা আর নাই বা বলি। সবকিছু ধ্বংস করে দিবে।"
"তার কাছে সেই কাঁটাই ফুল।"
"ফুলটা আমাদের গিনিপিগ।"

একযোগে হেসে উঠলো চারজন ব্যাক্তি। কথোপকথন হয়েছে ইংলিশ ব্রিটিশ এক্সেন্টে।
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন