বেলীফুলের সুভাস - নাবিলা ইষ্ক - অনু গল্প


!!১!!

তৃষ্ণার সামনে ইলেকশন। এই ইলেকশনের আগ দিয়ে এমন মাত্রাতিরিক্ত জ্বর বাধিয়েছে। সাথে সর্দিকাশি বিনামূল্যে ফ্রি সংযোগ হয়েছে। অতঃপর আমিদ চৌধুরী ছেলেকে দুদিন বেড রেস্ট করতে বলেছেন। কিন্তু ছেলে কথা শুনছে না। গরম কপাল এবং টকটকে লাল নাক নিয়ে তৈরি হয়ে নিচে নেমে এসেছে। যেমন এখনই বেরোবে। আমিদ সাহেব সোফায় বসে নিউজপেপার পড়ছেন। সামনে দাঁড়ানো তার ছেলেকে সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করলেন। তৃষ্ণার ভারী গলার স্বর অসুস্থতায় আরও ভারী শোনালো। 
- বাবা গাড়ির চাবি কোথায়? 
- হবে কোথাও। 
- আমার এক্ষুনি বেরোতে হবে। ইট'স আর্জেন্ট। 
- কতটা আর্জেন্ট তা আমার জানা আছে। 
- আশ্চর্য! 
জয়া বেগম আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন। ছেলের মুখশ্রী দেখে চিন্তিত সুরে বললেন, 
- আব্বা জ্বরে শরীর তোর পুড়ে যাইতেছে। ঠান্ডা কাশি তো আছেই! কি দরকার যাওয়ার। রেস্ট নে একটা দিন। 
- আমি দুবাই যাচ্ছি না মা! দু ঘন্টার রাস্তা। গাড়ি করে যাবো। বাংলোতে একটা মিটিং করবো। ব্যস এতটুকু। চাবি দিতে বলো! 
আমিদ সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিউজপেপার সরালেন। পকেট থেকে চাবি বের করে ড্রাইভার সুমনকে দিলেন। তারপর শব্দ করে ডাকলেন নিজের ছোট পুত্রবধূকে।
- বেলী আম্মা! 
কোমল কন্ঠের স্বর ভেসে এলো, 
- আসছি বাবা। 
বেলী দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুমে এসেছে। মাথায় ঘোমটা টেনেছে। রান্নাঘরে থেকে কপালে বিন্দু ঘাম জমেছে। নাকের ডগায়ও ঘামের চিহ্ন। আমিদ সাহেব বললেন, 
- এই হতচ্ছাড়ার সাথে ঢাকা যাও। ওর মিটিং শেষ হলে সঙ্গে সঙ্গে টেনে ফিরিয়ে আনবে।
বেলী আড়চোখে তৃষ্ণার দিক তাকাল। টেনে ফিরিয়ে আনবে? তাও দু ইঞ্চিখানেক বেলী? লম্বাচওড়া সুঠাম দেহের তৃষ্ণার হাত উঠাতে পারবে সে? ভয়ে গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে গেল। কাল থেকে তৃষ্ণা তার সাথে কথা বলছে না। কারণ সে বারো দিন বাপেরবাড়ি বেড়িয়ে কাল সকালেই ফিরেছে। তাও তৃষ্ণার অসুস্থতার কথা শুনে। নাহলে একমাস বেড়াতো। একমাস বেড়ানোর পারমিশন সে আমিদ সাহেব থেকে পেয়েছে। তৃষ্ণা তো জীবনেও রাজি হতো না। গিয়েছেও বেলী তৃষ্ণার অগোচরে। তবে এখন বেলী হাড়েহাড়ে পস্তাচ্ছে। সারারাত কেঁদেকেটে গলা ভেঙে ফেলেছে। রেগে তৃষ্ণা একটা থাপ্পড় দিলে এতো কষ্ট পায়না যতটা কষ্ট সে তৃষ্ণার এড়িয়ে যাওয়ায় পায়। এইযে কাল থেকে কথা বলছে না। বেলীকে ডাকছে না। তাকাচ্ছে না! এটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা শুধু বেলী জানে। এখন ভেবে রেখেছে তৃষ্ণা না করে দিবে। তাকে সঙ্গে নিবে না। মুখটাই দেখতে চায়না, সাথে নিবে তো দূরের বিষয়। অথচ তৃষ্ণা হ্যাঁ, না কিছুই বললো না। চলে গেল। অবুঝ বেলীকে অঞ্জলি হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বলল, 
- বোকা মেয়ে। তোমাকে নিবে সঙ্গে। 
- কই কিছু তো বলল না৷ 
- সবকিছু শুনে নয় দেখেও বুঝতে হয়।

গাড়িতে বেলী চুপচাপ বসে। পরনে নীল শাড়ি। শাড়িটি খুব তাড়াহুড়ো করে অঞ্জলি পরিয়ে দিয়েছে। এখন সে ঢাকায় যাচ্ছে তৃষ্ণার সাথে। তৃষ্ণা তার পাশেই বসে। চোখজোড়া বন্ধ। মাথা পেছনে এলিয়ে রেখেছে। বেলীর কান্না পাচ্ছে। বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে। এইযে এখনো কথা বলছে না। বেলীকে মাফ চাওয়ার বা কথা বলার সুযোগটুকু দিচ্ছে না। চোখের পানি আড়াল করতে অন্যপাশে ফিরে রইলো। রাস্তায় মনোযোগ দিলো। দুজনের মধ্যে নিরবতা। নিরবতার মাঝে বেলীর হুটহাট নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সুমন আঁড়চোখে গ্লাসে তাকিয়ে সবটাই দেখছে। শুকনো গলা ভিজিয়ে টিস্যু এগিয়ে ধরলো বেলীর দিক। বেলী নিয়ে চোখ নাক মুছে, আবারো কাঁদতে বসলো। কান্নার কোনো শব্দ নেই। নিঃশব্দে কান্না করছে। কান্নার কারণ ধরেও তো তৃষ্ণা তাকে ধমকে উঠতে পারে? এখন কী ধমক ও দিবেনা? নিস্তব্ধতার মাঝে তৃষ্ণার সেলফোন বাজার আওয়াজ শোনা গেল। তৃষ্ণা সময় নিয়ে সেভাবেই রিসিভ করল। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে স্পিকার লাউড করে দিয়েছে। বেলী কান পেতে শুনছে একজন নারীর কন্ঠ। সে বলছে, 
- তোমার আমার বিয়েটা খুব বেনেফিট দিবে। আজকাল দ্বিতীয় বিয়ে কোনো ব্যাপারই না। আমি মেয়ে হয়ে তোমার একটামাত্র বিয়ে মেনে নিলে, তুমি কেন সংকোচবোধ করছ? বাবা বলেছে রাজনীতির জন্য হলেও আমাদের বিয়েটা হওয়া দরকার। 
- ভেবে দেখবো। 
- সত্যি? আম সো হ্যাপি। প্লিজ রিকন্সিডার ইট। 
বেলীর চোখমুখ চোখের পানিতে ভিজে গিয়েছে। লাল হয়ে আছে চোখজোড়া। এবার ধীর কান্নার গলার স্বরও শোনা গেল। তার তৃষ্ণা আবার বিয়ে করবে? তাকে নিশ্চয়ই ডিভোর্স দিয়ে দিবে? বেলীকে এভাবে দেখে ড্রাইভার সুমনের বেশ মায়া হলো। এই ছোট, প্রিটি মেয়েটাকে তার সাহেব এভাবে কাঁদিয়ে কি মজা পাচ্ছে? 

সম্পুর্ন জার্নি বেলী কান্না করে পাড় করেছে। বাংলোর সামনে গাড়ি থামতেই তৃষ্ণা বেরিয়ে গেল। ফিরে বেলীকে একটিবার দেখল না অবদি। করুণ বেলী এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। মাধবী গাড়ির দরজা খুলেছে। সে মধ্যবয়সী মহিলা। বাংলোর কেয়ারটেকার। আজ দশ বছর যাবত সেই বাড়ির দেখাশোনা করে। বেলীকে এভাবে কাঁদতে দেখে হকচকিয়ে গেল, 
- কি হইছে? 
বেলী চোখজোড়া মুছে ফেললো। মাথা দুলিয়ে জানালো কিছুই হয়নি। গাড়ি থেকে নেমে মাধবীর সাথে ভেতরে চলল। তৃষ্ণা গার্ডেনে বসে। সেখানে মিটিং বসেছে। অলরেডি দুজন স্যুট-কোট পরা বৃদ্ধ এবং পুরুষ বসে। বেলী মাথা নিচু করে মাধবীর সাথে চলে এলো৷ ভেতরে ঢুকতেই তাকে ঝেঁকে ধরল তিনজন লোক। 
- ম্যাডাম আমি সখি। 
- ম্যাডাম আমি খোকন। 
- ম্যাডাম আমি রুপা। 
বেলী মিষ্টি হেসে পরিচয় হলো। মাধবী তাদের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে চাইল, 
- ম্যাডামের শরীর ভালা না। ডিস্টার্ব করিস না। 
সখি প্রশ্ন করলো, 
- কি হইছে ম্যাডামের! 
বেলী বলল, 
- তেমন কিছু না। 
- তাইলে একটু কথা কন। আপনেরে আমার মেলা ভাল লাগে। কি সুন্দর পুতুলের মতো দেখতে। আপনের কথা প্রায়ই শুনি সাহেবের থেইকা। 
রুপা বলল, 
- আপনেরে সাহেব মেলা ভালবাসে। রাজ কপাল আইন্নের। এমন ভালো মনের আমাগো সাহেব পাইছেন৷ 
খোকন বলল, 
- ম্যাডামরে পাইয়া আমাগো সাহেবও লেকি। 
মাধবী তাদের জোরপূর্বক সামনে থেকে সরিয়ে বেলীকে উপরের একটি কক্ষে এনেছে। সাদা রঙের গোছানো কক্ষ। তাকে রেস্ট করতে বলে চলে গেল। বেলী বিছানার কোণায় বসে রইলো। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। ব্যাগে রাখা সেলফোন বেজে উঠল। শীলা কল করছে। বেলী নিজেকে সামলে কল রিসিভ করলো। 
- হ্যাঁ শীলা! 
ওপাশ থেকে শীলার চিন্তিত কন্ঠ শোনা গেল, 
- খাইছেড়ে৷ তুই কি কানতেছোস জান আমার? 
বেলী কেঁদে ফেললো শব্দ করে। বেলীর কান্না শুনে শীলা অস্থির হয়ে পড়লো। বিচলিত কন্ঠে শুধালো, 
- কী হইছে? 
- তিনি আমার সাথে আর কথা বলে না। আমার দিক তাকায় না। আরেকটা বিয়ে করবে শীলা। আমাকে ছেড়ে দিবে। 
শীলার বিচলিত কন্ঠ মুহুর্তেই বিরক্ত শোনালো, 
- বোকার বাচ্চা! আমি আজ পর্যন্ত তোকে কারণে কান্না করতে দেখলাম না। তুই বরং কেঁদে পৃথিবী ভস্ম করে দে। 
শীলা কল কেটে দিল৷ স্ক্রিনের দিক তাকিয়ে বেলী কেঁদেই চললো। শীলা তাকে বিশ্বাস করছে না? করবে কীভাবে! ওরা সবাই তৃষ্ণার পাগল। তৃষ্ণা তাকে ছেড়ে দিলেও ওদের মাথা ব্যথা নেই। 

!!২!!

 মিটিং শেষ করে তৃষ্ণা ফেরেনি। সেখান থেকেই বেরিয়ে গিয়েছে। উদাসীন, বিষন্ন বেলী রান্নাঘরে এলো। আজ রান্না সে করবে জানালো। তৃষ্ণার প্রিয় খাবার গুলো রান্না করলে কি লোকটার রাগ সামান্য কমবে? মাফ করবে বেলীকে? আশায় বেলী তৃষ্ণার পছন্দের সবকিছু রান্না করেছে। রান্না শেষ হতে হতে দুটো বাজলো। তৃষ্ণা এসেছে তিনটা বিশে। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে বসতে বসতে ঘড়ির কাঁটা চারটায় প্রায়। বেলী খাবার সার্ভ করছে। তৃষ্ণা নিঃশব্দে খাবার শেষ করলো। টু-শব্দও করলো না। বেলী খেয়েছে নাকি জিজ্ঞেস করলো না। পাশে বসতেও বললো না। চোখে অশ্রু নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেলী। তৃষ্ণা যেতে যেতে বলে 
গেল, 
- চুপচাপ খেয়ে নে। নাহলে এই ডাইনিং টেবিল তোর বাপের বাড়ির সামনে গিয়ে ভাংব। আর রাতে আমি বাইরে খাব। ভদ্রভাবে খেয়ে শুয়ে পড়বি৷
বেলী অশ্রুসিক্ত নয়ন এবং ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে খেতে বসলো। তৃষ্ণা কথা তো বলেছে। হোক, সেটা ধমক। খেতে নেওয়া বেলীর সামনে সখি এসে দাঁড়ালো। ধীর গলায় বলল, 
- ম্যাডাম কিছু কই? না কইলে বুকটা আনচান করবো। 
- আচ্ছা। 
- সাহেব কী আপনার লগে রাইগা আছে? 
বেলী মাথা দোলাল। সখি ফিসফিসিয়ে বলল, 
- সাহেবের আপনে রাগ ভাঙানোর লাইজ্ঞা কি ভাবছেন? 
- কী ভাবব? 
রুপা বলল, 
- ম্যাডাম! সাহেবের রাগ ভাঙাইবেন না? ব্যাডাগো রাগ ভাঙানো চুটকির ব্যাপার। রাইতে সাহেব যখন ফিরবো। তার আগে আপনে একটা সেইক্সি ড্রেস পরবেন। দেখবেন সাহেবের রাগ, অভিমান সবকিছু আসমানে উড়াল মারছে। 
অবুঝ বেলী বলল, 
- সেইক্সি ড্রেস? 
- আরে ওইযে টিভিতে পরে দেহেন না। ছোট ছোট ড্রেস। 
- না না এগুলো আমি পরিনা। 
- তাইলে শাড়ি? সাদা শাড়ি? আমি এক খান ড্রেমা দেখছিলাম। সেই হানে নায়িকা জর্জেটের সাদা শাড়ি পইরা নায়কের সামনে আহে। নায়ক গইলা সবকিছু ভুইলা যায়। নায়িকার প্রেমে হাবুডুবু খায়। আপনে একটা শাড়ি পরেন। দেখবেন সাহেবের রাগ গেছে গা। 
- শাড়ি পরলে তার রাগ চলে যাবে? সত্যি? 
- একদম পাক্কা! 
- কিন্তু এখন আমার কাছে তো সাদা শাড়ি নেই। 
- আমি মার্কেট তে আইনা দেই? 
- আমি টাকা নিয়ে আসি। 
বেলী রুমে এসে পার্স থেকে টাকা বের করলো। তার সন্দেহ হচ্ছে। একটা শাড়ি পরলে তৃষ্ণার রাগ চলে যাবে? কই সে তো এখনো শাড়ি পরে। তৃষ্ণার রাগ তো কমল না। তবুও বেলী টাকা দিল। রুপা তখনই বেরিয়ে গেল। 

রুমে বসে বেলী কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখল। মন বসছে না দেখে উঠে হাঁটাহাঁটি করলো। বাইরে বেরিয়ে এলো। সম্পুর্ন গার্ডেন ঘুরলো। বাড়ির আনাচকানাচে ঘুরেফিরে সময় পাড় করছে। শাড়ি নিয়ে রুপা ফিরেছে সন্ধ্যা সাতটায়। বেলীকে সেটা ধরিয়ে বলল, 
- ম্যাডাম ব্লাউজ বানাই আনছি লগে। ব্লাউজের লগে এই শাড়ি পইরা সাহেবের সামনে যদি আইজকা যান। সাহেবের রাগ সব উধাও হইবো দেইখেন। এখন আমি যাই তাইলে!
বেলী তাদের বিদায় জানিয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বিছানায় বসে প্যাকেট খুলল। জর্জেটের সাদা পাতলা শাড়ি। এটা সে কীভাবে পরবে? এটা পরলে সব তো দেখাই যাবে। লজ্জায় বেলীর গাল জ্বলছে। ব্লাউজ হাতে নিতেই গলাটা শুকিয়ে গেল। হাতা কাটা সাদা ব্লাউজ। এগুলো বেলী একদম পরবে না! কখনোই না! বিছানায় শাড়ি ব্লাউজ সেভাবেই রেখে দিল। আঁড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে। সত্যি এগুলো পরলে তৃষ্ণার রাগ মিটে যাবে? দোটানায় ভুগতে থাকা বেলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। অন্ধকার বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির ফোটা ভেসে এসে চোখমুখে পড়ছে। ধুম বৃষ্টি নামতেই ভেতরে চলে এলো। ঘড়ির কাঁটায় রাত এগারোটা বিশ। তৃষ্ণা এখনো ফিরেনি। বেলী তাড়াতাড়ি শাড়ি ব্লাউজ নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকলো। খুব সামলে সেটা পরে বেরোলো। নিজের দিক তাকাতেই কপাল কুঁচকে আসছে। তার সাদা ফকফকা পেট দৃশ্যমান। কাঁধ থেকে ধরে সম্পুর্ন হাত দৃশ্যমান৷ এসব পরে কীভাবে তৃষ্ণার সামনে দাঁড়াবে? সে তো এখনই লজ্জায় মরে যাচ্ছে। বুকের তোলপাড় দমিয়ে বসে রইলো তৃষ্ণার অপেক্ষায়। ভয়ে রীতিমতো কপালে বিন্দু ঘাম জমেছে এই ঠান্ডা ওয়েদারের মধ্যেও। অপেক্ষাকৃত সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে হদিস নেই।

দরজা ধাক্কানোর শব্দে বেলী তড়িৎগতিতে উঠে বসলো। ঘড়ির কাঁটায় নজর দিলো। রাত দুটো! দ্রুত দরজা খুলতে গিয়ে মনে পড়লো পরনের শাড়ির কথা। এই শাড়ি পরে কীভাবে সামনে দাঁড়াবে! বেলী ভাবছে দৌড়ে গিয়ে শাড়ি পরিবর্তন করবে। কিন্তু সময় কই? তৃষ্ণা দরজা পেটাচ্ছে যেমন দরজা ভেঙে ফেলবে। বেলী লম্বা শ্বাস নিয়ে দরজা খুলে দিলো। তৃষ্ণা হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। বেলীর দিক তাকাল না। এ সুযোগে কি বেলী ওয়াশরুম ঢুকে শাড়িটা পরিবর্তন করে ফেলবে? যেই ভাবনা সেই কাজ! লুকিয়ে ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়ালো। ঢুকবে তার পূর্বেই, তৃষ্ণা হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে হুট করে বেলীর দিক তাকাল। মুহুর্তেই হাত ঘড়িটা শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গেল। সেই শব্দে বেলী ভয়ে কেঁপে উঠলো। নিস্তব্ধতা সম্পুর্ন কক্ষ জুড়ে। বারান্দার দরজা খোলা। স্পষ্ট বৃষ্টির শব্দ ভেসে আসছে। তুমুল বৃষ্টি! বেলীর বুকের উঠানামার গতি বেড়েছে। পা জোড়ায় শক্তি হারিয়ে ফেলছে। দু'হাতে দৃশ্যমান পেট ঢেকে রাখল। বছর হয়ে গিয়েছে তাদের বিয়ের। এখনো সে তৃষ্ণার তাকিয়ে থাকা হজম করতে পারেনা। তৃষ্ণাকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে বেলী দ্রুত ওয়াশরুম ঢুকতে নিয়েছিল। পূর্বেই তৃষ্ণা তার হাত টেনে ধরেছে। টেনে নিজের সামনে দাঁড় করালো। 
- কার বুদ্ধিতে এগুলো পরেছিস? 
- ক..কারোও বুদ্ধিতে না। 
- মিথ্যে বলা শিখে গেছিস?  
- আর এমন হবেনা। 
তৃষ্ণা বেলীর হাত ছেড়ে দিল। কর্নারে রাখা সোফায় দু'পা দুপাশে মেলে বসলো। বলল, 
- কী আর হবেনা? 
- আমি আপনাকে না বলে কোথাও যাবো না। 
- ওহ! 
বেলীর চোখজোড়া ভিজে উঠছে। 
- আপনি কী সত্যি ওই আপুকে বিয়ে করবেন? 
- হু করবো। আমি পৃথিবীর সব আপুকে বিয়ে করবো। প্রত্যেকদিন তাদের একেকজনের সাথে রাত কাটাবো। তাদের আদর করবো। ঠিক যেমন তোকে করেছি। সেই সবখানে তাদের ছুঁব যেভাবে তোকে ছুঁয়েছি। 
বেলী ডুকরে কেঁদে উঠলো। তৃষ্ণা উঠে পুনরায় তার সামনে দাঁড়ালো। বেলীর সমানতালে মাথা নামিয়ে বলল, 
- তোকে ছুটি দিয়ে দিব। তুই তোর বাবার বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকিস। বারো দিন কেন! সম্পুর্ন বছর থাকবি। না বছর না। সারাজীবন থাকিস। 
বেলী কেঁদেই চলেছে। কান্নার এক ফাঁকে বলল, 
- আর হবেনা এমন! 
- কেন হবেনা? বল কেন হবেনা! স্পিক আপ বেলী! রাগাবি না আমাকে। 
ধমক খেয়ে বেলীর কান্নার গতি বেড়ে গেল। দু'পা পেছনে নিতেই তৃষ্ণা তাকে নিজের সাথে চেপে ধরলো। তৃষ্ণার হাত শাড়ির নিচ দিয়ে তার কোমর চেপে ধরেছে। ধবধবে সাদা কোমর লালচে হয়ে গিয়েছে মুহুর্তেই। তৃষ্ণার নেওয়া ঘনঘন নিশ্বাস ঠিক বেলীর মুখের উপর পড়ছে। বেলী মুখটা ঘুরিয়ে ফেলল। তৃষ্ণার ঠোঁট এসে লেগেছে তার কানে। খুব ধীর গলা শোনা গেল তার, 
- মেরে ফেলতে চাস আমাকে? কতটা যন্ত্রণায় রেখেছিস জানিস? বারোটা দিন আমি কীভাবে থেকেছি তোর আইডিয়া আছে? 
বেলীর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। থরথর করে কাঁপতে থাকা সে মুচড়ে উঠলো তৃষ্ণার বাহুতে। পরপর পিঠে হাতের ছোঁয়া অনুভব করলো। ঘাড়ে ঠোঁটের স্পর্শ। কোনোমতে বেলী বলতে চাইল, 
- আর হবে...
কথার মাঝেই বেলীর ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁট দ্বারা চেপে ধরলো তৃষ্ণা। আকস্মিক শক্ত চুমুতে বেলীর অসম্পূর্ণ কথা গুলো আটকে গেল। ঠোঁট ছেড়ে তৃষ্ণা বলল, 
- আইডিয়া পাবি। আমি পাওয়াবো তোকে। 
বলেই বেলীকে দু-হাতে কোলে তুলে বিছানায় ছুড়ে মারল। 

!!৩!!

বেলীর ঘুম ভেঙেছে খুব বেলা করে। পিটপিট করে চোখজোড়া খুলেছে সবে। অনুভব করছে সর্বাঙ্গ জুড়ে চিনচিন ব্যথা। হাত নড়ানোর শক্তি টুকু নেই। তার বুকের উপর তৃষ্ণার মাথা৷ বেলী ধীরে মাথায় হাত রাখল। চুলের ভেতর আঙুল চালাল কিছুক্ষণ। তারপর আলগোছে তৃষ্ণার মাথা বালিশে রেখে উঠে বসলো। সাবধানতা অবলম্বন করে ওয়াশরুম ঢুকে গেল। আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জায় হতভম্ব হয়ে গেল। কীভাবে নিচে যাবে? মানুষ দেখলে কি ভাববে? মুখ, ঘাড়, হাত সব যায়গায় ছোপ ছোপ লাল হয়ে আছে।

গোসল সেরে বেলী ঘাড় ঢাকা কলার আর ফুল হাতা সহ কামিজ পরেছে। বেরিয়ে এসে বিছানায় শোয়া তৃষ্ণার দিক তাকাল। গভীর ঘুমে মহারাজ আচ্ছন্ন। তখনো উবুড় হয়ে শুয়ে।
বেলী পা টিপে টিপে তৃষ্ণার পাশে বসলো। তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে। বুকে সাহস জুগিয়ে মাথাটা নিচু করে তৃষ্ণার উঁচু নাকে ঠোঁট ছোয়াল। পরপর দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। তৃষ্ণা উঠেনি। বুকে আটকানো শেষ ছেড়ে বারান্দায় পা বাড়ালো। গতকাল তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল। এখনো ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। গতকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। বর্ষাকাল বলে কথা। এসময় দু-তিনদিন বৃষ্টি থাকলেও বা কী! বেলী বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। এই ভেজা ভেজা গাছপালা, ঠান্ডা আবহাওয়া তার বেশ পছন্দের। ঘন্টার পর ঘন্টা এই দৃশ্য দেখে কাটিয়ে দেওয়া যায়। হাত বাড়িয়ে দিলো বৃষ্টিতে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি এসে হাতে জমা হচ্ছে। বেলী একমুঠ বৃষ্টির পানি নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। দুষ্টু হেসে তৃষ্ণা মুখের সামনে মুঠো ধরলো। মুঠো থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি তৃষ্ণার মুখে পড়ছে। তৃষ্ণা ভ্রু জোড়া কুঁচকে মাথাটা ঘুরিয়ে ' উম ' শব্দ করলো। বেলী নিঃশব্দে হাসছে। পরপর শোনা গেল তৃষ্ণার ঘুমন্ত কন্ঠ, 
- বেলী! 
সাথে সাথে সরে গেল বেলী। নাহলে দেখা যাবে তাকে আবারো নিজের সাথে চেপে ধরবে তৃষ্ণা। ওড়না মাথা থেকে ধরে পেঁচিয়ে নিলো। পারলে একটা বোরখা পরে নিতো। সে যাইহোক! তৃষ্ণা ঘুম থেকে উঠলেই ব্রেকফাস্ট করে তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোবে। বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই চিন্তায়। ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলো। উপর থেকেই দেখছে রুপা, সখি বারবার এদিকটায় তাকাচ্ছে। যেমন তার প্রত্যাশায়৷ বেলীর ভীষণ লজ্জা লাগছে। নিশ্চয়ই বাজে কিছু ভেবে বসবে তারা? যথা সম্ভব নিজেকে সাধারণ ভাবে উপস্থিত করবে। বেলী নামতেই রুপা আর সখি তাকে ঘিরে ধরলো। কিন্তু কিছু বলার আগেই লক্ষ্য করলো বেলীর মুখশ্রী। দুজন কেশে চুপচাপ আবারো রান্নাঘরে চলে গেল। এখানে জিজ্ঞেস করার কিছু বাকি নেই। বেলী যেমন বেঁচে গেল৷ 

তৃষ্ণা নিচে নেমেছে বেলা এগারোটায়। বেলী তখন সোফায় বসে ছিলো। ব্রেকফাস্ট রেডি। কিন্তু সে তৃষ্ণার জন্য বসে। খিদে পেয়েছে কিন্তু একা খাচ্ছে না। তৃষ্ণাকে খেতে দিয়ে পড়ে খাবে ভেবে রেখেছিল। তৃষ্ণাকে দেখতেউ উঠে দাঁড়ালো। লজ্জায় মাথা তুলে দ্বিতীয় বার আর তাকাল না। তৃষ্ণা এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। বেলীর মুখ উঁচু করে ধরে পর্যবেক্ষণ করছে। লাল দাগ গুলোতে আঙুল ছুঁয়ে প্রশ্ন করলো, 
- মলমটা এনেছিস? 
লজ্জায় বেলীর ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে। পাশে যে তিন চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে তা কি দেখছে না লোকটা? এতটা নির্লজ্জ একজন মানুষ কীভাবে হয়। 
- বেশি জ্বলছে? 
বেলী কোনোরকমে মাথা দোলাল। বলল, 
- খেতে বসুন। 
তৃষ্ণা চেয়ার টেনে বসে পাশের চেয়ার টেনে দিল। বেলী বসলো। আগের মতো তৃষ্ণা খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। যেমন গতকাল তাকে সারাদিন এভোয়েড করতে থাকা লোকটা ইনি নন। অভিমান বুকে পুষে রেখে বেলী খেতে লাগলো। খিদে পেয়েছে তার। 

ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়েছে তারা কৃষ্ণপুরের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে বসা তৃষ্ণার মাথা বেলীর ঘাড়ে। বলা যায় বেলী সম্পুর্ন ভাবে তৃষ্ণার বাহুতে আটকে। সামনে যে ড্রাইভার তার ধ্যানজ্ঞান কিছুই নেই লোকটার মধ্যে। কিছুক্ষণ পর তৃষ্ণার গলা শোনা গেল, 
- তোকে কিন্তু আমি একদম মাফ করিনি। বুঝেছিস? 
- কেন? 
- বারোদিন যাক আগে। আর এই বারোদিন আমি যা বলবো তুই তাই করবি! মনে থাকবে? 
- কিন্তু.. 
- বারোদিন পর ভেবে দেখবো তোকে মাফ করা যায় কি-না! 
অসহায় ভাবে বেলী মাথা দোলাল৷ তৃষ্ণা যতই কষ্ট দেক তাকে সে মেনে নিবে! শুধু তার সাথে কথা বলা বন্ধ কখনোই না করুক। এটা বেলী একদম নিতে পারেনা। সম্পুর্ন রাস্তা তৃষ্ণা ঘুমিয়ে পাড় করলো। আর বেলী জেগে! সে ঘুরেফিরে তৃষ্ণাকেই দেখছে। এই মুহুর্তে সে কতটা শান্তি অনুভব করছে বোঝানো মুশকিল।

ড্রাইভার সিটে থাকা সুমনও মিষ্টি মিষ্টি হাসছে।
ভালোবাসা দেখতে কার না ভালো লাগে? ভালোবাসা দেখতে খুব সুন্দর। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল ভালোবাসা। 
.
.
.
সমাপ্ত........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন