গোয়ালঘরের কাছে আসতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো! চোখদুটো বিস্ফোরণের মতো স্থির হয়ে গেলো, বুকের ভেতরটা তুফানের মতো উত্থাল। দরজার দোরগোড়ায় ছোপ-ছোপ রক্ত দেখা যাচ্ছে, টিনের চাল ধুয়ে ঝর্নার মতো বৃষ্টির পানি পরছে। কাঠের বন্ধ দরজাটা এই মূহুর্তে একটুখানি ফাঁক হয়ে আছে। বড় করে ঢোক গিললো মেহনূর, আঁচলের নিচে এন্টিসেপটিক বোতল লুকানো, ডানহাতে দাদাভাইয়ের পুরোনো আমলের ছাতা ধরে আছে। ম্যাসেজটা যদি সত্যি হয়, তাহলে ভয়াবহ অঘটন ঘটেছে। মাহতিম অক্ষতশরীরে ফিরেনি, তাঁর নির্ঘাত কিছু একটা হয়েছে। রক্তের নিদর্শন বতর্মানে সেটাই জানান দিচ্ছে। মনে-মনে প্রচুর ভয় পেলেও নিজেকে শান্ত রাখলো সে। বৃষ্টির পানিতে থপ-থপ শব্দ তরঙ্গ তুলে এগিয়ে গেলো মেহনূর। দরজার কাছে এসে ছাতাটা বন্ধ করে দরজাটা ঠেলে দিলো, আস্তে করে দরজাটা খুলে যেতেই ভীতু চাহনিতে ভেতরে তাকালো। ডানপা বাড়িয়ে ঘরে ঢুকতেই ডানে তাকালো মেহনূর, তৎক্ষণাৎ চোখদুটো চুম্বকের মতো আঁটকে গেলো তার। সমস্ত শরীর-সহ প্রতিটি ইন্দ্রীয় যেনো কাঁটার মতো ফুটে উঠলো! একটা জোরালো আর্তনাদ করতে গিয়েও শেষ মূহুর্তে সামলে নিলো। চিৎকার করলো না মেহনূর, চোখদুটো বড় করে লম্বা-লম্বা প্রলম্বিত নিশ্বাস নিতে লাগলো। বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিতেই অজান্তেই হাতের বন্ধন থেকে ফসকে গেলো ছাতাটা।
কিছু পরার মতো বিদঘুটে আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকালো মাহতিম। পিঠের বাঁদিকের শার্টটা পাঁচ আঙ্গুলে খামচে ধরে আছে। ব্যথায় কাতর, তবুও কন্ঠে শীতলতা মাখিয়ে আস্তে করে ডাকতে নিলো। চিনচিনে ব্যথার কারনে কিচ্ছু বলতে পারলো না সে। চোখ খিঁচুনি দিয়ে ব্যথায় জব্দ হলো মাহতিম। মুখটা নত করে শক্ত হয়ে থাকলে হঠাৎ মাথায় আলতো স্পর্শ টের পেলো। চোখ খুলে মুখ তুলে উপরে তাকালো সে, তার মুখের দিকে সরাসরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনূর। স্থিরচোখ থেকে ফোঁটায়-ফোঁটায় অশ্রু ঝরছে ঠিকই, কিন্তু নরম ঠোঁটদুটো আজ একটুও কাঁপেনি, নিজেকে যেনো অনড় রাখতে বাধ্য। মেহনূরের শান্ত-স্বাভাবিক রূপ দেখে মাহতিম মারাত্মক আশ্চর্য হলো, পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেলো সে। অন্যদিন হলে মেহনূর বুঝি হাউমাউ করে ফুপিয়ে উঠতো, এমন করুণ দশা দেখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারতো না, কিন্তু আজ সবকিছু পালটে দিয়ে মেহনূর তাকিয়ে-তাকিয়ে শুধু দেখছে! কি দেখছে? ওমন লাল-লাল চোখ দিয়ে মাহতিমের আহত অবস্থা দেখছে? দেখছে মাহতিম কতটা ক্ষতবীক্ষত হয়ে এসেছে? নাকি মনের উচাটন অবস্থাটা ঠেলেঠুলে সহ্য করে আছে? মাহতিমকে ফের চমকে দিয়ে তার পিঠ খামচানো ডানহাতটা ধরলো মেহনূর, হাতটা পিঠ থেকে টেনে টলমল চোখে হালকা গলায় বললো,
- হাতটা সরান, আমি দেখছি। ব্যথাটা আরেকটু সহ্য করুন, আমি ঔষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।
মাহতিম বিনা বাক্য ব্যয়ে শুধু মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো মেহনূরের দিকে। মেহনূর কোনো সঙ্কোচ ছাড়াই তার সাদা শার্টে হাত দিলো, দ্বিধাহীন ভঙ্গিতে শার্টের প্রতিটি বোতাম দুহাতে খুলতে লাগলো। ধীরে-ধীরে চোখের সামনে বৃষ্টিস্নাত বুকটা উন্মুক্ত হতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ থামলো তার, এরপর দৃষ্টি নামিয়ে শেষ বোতামটা খুলে ফেললো মেহনূর। শার্টের দুই প্রান্ত ধরে কাধ ছাড়িয়ে খুলতে নিলে পিঠের ক্ষত জায়গাটায় চোখ পরলো। পিঠের ডানদিকটায় তেরছা ভাবে গভীর জখম হয়ে আছে, মেহনূর সেখানে থমথমে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মাহতিম আশ্বস্ত গলায় বললো,
- ভয় পেও না। সেরে যাবে।
চোখ ঘুরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর, ঢোক গিলে নিচু গলায় বললো,
- সারবে?
মাহতিম চোখ বন্ধ করে আশ্বস্ত করলো, আস্তে করে বললো,
- সারবে।
উত্তর পেয়ে নির্বিঘ্নে শার্ট খুলে আনলো মেহনূর। ক্ষতের দিকে তাকালেই গা শিরশির করছে তার, তবুও মুখের উপর ভয়ানাশনের মুখোশ এঁটে ক্ষত পরিষ্কার করলো। বুদ্ধি করে সঙ্গে লম্বা একফালি সাদা কাপড় এনেছিলো, সেটা দিয়ে মাহতিমের নির্দেশ মতো বুকে-পিঠে ড্রেসিং করে করলো মেহনূর। মাহতিমের রক্ত মাখা হাতদুটো গামছা ভিজিয়ে পরিষ্কার করে দিলো। বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরছে, উঠোনে জমেছে জলাবদ্ধ পানি। নাছোড়বান্দা মাহতিম কড়া গলায় বলে দিলো সে এই মূহুর্তে বাড়িতে ঢুকবেনা, এমন শরীর নিয়ে সকলের সামনে যাওয়া মানে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি। মেহনূরকে আপাতত বাড়ি ফিরতে বলে স্বাভাবিক আচরণ করতে বললো, সকলের কাছে তার আগমনের খবরটা চাপা রাখতে বুঝিয়ে দিলো। মেহনূর সবটা শোনার পর অন্যদিকে ভিড়লো না। কেনো মাহতিম লুকোচুরি খেলতে চাইছে আজ জেনেই ছাড়বে। সমস্ত কথা কাটায়-কাটায় জানা পযর্ন্ত হাল ছাড়বে না মেহনূর। মাহতিমকে একা ফেলে ভুলেও বাড়িতে যাবেনা, দরকার পরলে এখানেই আস্তানা গাড়তে প্রস্তুত। গোয়ালঘরটা বতর্মানে পরিত্যক্ত, সবকটা গরু-গাভীকে অন্যদিকে অন্য ঘরে রাখা হয়েছে। অবসর ও একাকী সময় কাটানোর জন্য এখনো এটাকে ব্যবহার করে মেহনূর, কাজেই ঘরের মেটো মেঝেটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আছে। মাহতিম যেই কঙ্কালসার চৌকির উপর শুয়ে পরতে নিবে ওমনেই বাধ সাধলো মেহনূর, তাকে চৌকি থেকে নামতে বলে ঘরের অন্যপাশ থেকে তোশক-বালিশ টেনে আনলো। চৌকিতে তোশক পাতার দৃশ্য দেখে বিষ্ময়ে প্রশ্ন করলো মাহতিম,
- এটা গোয়ালঘর না?
প্রশ্নের আসল মর্মটা বুঝলো মেহনূর, ভালো একটা চাদর বিছাতে-বিছাতে বললো,
- আগে ছিলো, এখন নেই। এখন গরুগুলোকে বাড়ির আমগাছের ওখানে রাখা হয়। ওখানেই নতুন গোয়ালঘর বানানো হয়েছে।
- এটা কি তাহলে গেষ্টরুম? তোশক কিসের জন্যে?
প্রশ্ন শুনে হাসলো মেহনূর। মাথাটা ' না ' সূচকে নাড়িয়ে মাহতিমের উদ্দেশ্যে বললো,
- আগে এ ঘরেই থাকতাম। এমনও হয়েছে রাতে আমি বাড়িতে না থেকে এখানে থেকেছি। এখানে আমি বই পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে যেতাম। আমার বদঅভ্যাস বলতে পারেন। এজন্য তোশক-বালিশ আম্মা রেখে দিয়েছে।
নিজের বাঁ কাধটা ধরে হাসলো মাহতিম। প্রসন্ন গলায় বললো,
- সাহস তো কম না। ক'দিনের জন্য একা ছেড়েছি দেখে সাহস একেবারে তুঙ্গে উঠেছে। একা-একা থাকতে ভয় করতো না?
মাথার কাছে তুলতুলে নরম বালিশটা রাখতে গিয়ে থমকালো মেহনূর। স্থির হয়ে কয়েক সেকেন্ড কি যেনো ভাবলো, বিছানা গুছানো বাদ দিয়ে মলিন দৃষ্টি তুলে বললো,
- আপনিতো সবসময় আমার কাছে থাকবেন না।আমার একা থাকার অভ্যাস তো করতেই হতো।
ডানহাতে মাথাটা ঝাড়ছিলো মাহতিম, হঠাৎ কথাটা শুনে হোঁচট খেলো সে। দৃষ্টি তুলে চৌকির দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো তাদের। টিনের চালে বৃষ্টির ঝুনঝুন শব্দ আবার বেড়েছে, টিনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঢুকছে আলো। মাহতিম প্রসঙ্গ পালটে অন্য দিকে ঘুরলো, চৌকির কাছে আসতে-আসতে ফাজলামি করে বললো,
- যদি কোনো চোর তোমাকে একা পেয়ে চুরি করে ফেলতো?
চোখে-চোখ রেখে আলতো ঠোঁটে প্রশ্নটা করলো মাহতিম। চৌকির আরামপূর্ণ শয়নে উঠে আসলো সে। প্রশ্নটা শুনেও কিছুক্ষণ চুপ রইলো মেহনূর। অনেকক্ষণ কোনো কারণ ছাড়াই নিরব রইলো সে। মাহতিম কিছুটা উজবুক চোখে সরু দৃষ্টিতে তাকালে অদ্ভুত আত্মগর্বের মতো নিশ্বাস ছাড়লো মেহনূর। চাপা তেজের সাথে সম্মোহন চাহনিতে বললো,
- এই তল্লাটে ওমন সাহস কারোর হবে না। শুধু --
কথাটা বলেই থামলো মেহনূর। অসম্পূর্ণ কথাটা কথাটা শোনার জন্য প্রচণ্ড উদগ্রীব হয়ে আছে মাহতিম। আনচান মনটা অস্থির হয়ে বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। মাহতিম ওমন উন্মুখ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে শেষমেশ কিন্ঞ্চিৎ হাসি দিলো মেহনূর, ' শুধু ' শব্দটার পরের বাক্য আর সম্পূর্ণ করলো না। মাহতিম প্রচণ্ড অধৈর্য হলেও তাকে ইচ্ছে করেই অগ্রাহ্য করলো মেহনূর। সম্পূর্ণ উল্টো ঘুরে বন্ধ জানালা খুলতে গেলো, কাঠের মোটা ডাসাটা ডানে টান দিতেই খট করে শব্দ হলো। জানালার দুই দ্বার ধরে যেই দুদিকে টান দিবে, সাথে-সাথে দুচোখ বন্ধ করে ঠান্ডা স্পর্শে শিউরে উঠলো মেহনূর। মাথা থেকে পায়ের নখ পযর্ন্ত শিরশির করে উঠলো। বুকের পিষ্টনে ধড়াস করে এক ঘা লাগতেই ধুকধুকনি বেড়ে গেলো। দাঁতে-দাঁত পিষে আড়ষ্ট হলো একটু, জানালাটা থেকে হাতদুটো আপনা-আপনি নেমে গেলো। চোখ খুলে মাথাটা নুইয়ে দেখলো পেটের উপর মাহতিমের ডানহাতের অস্তিত্ব। পাঁচটা আঙ্গুল যেনো খাপে-খাপ ফর্সা চামড়ার উপর ডেবে আছে। শক্ত করে পেছন থেকে ডানহাতেই জড়িয়ে ধরেছে। মেহনূর গলাটা ভিজিয়ে বড়-বড় নিশ্বাস নিতেই পিছু ঘুরতে চাইলো, তাকে বাধা দিয়ে খামচে ধরলো হাতটা। সামান্য ব্যথায় চোখ খিঁচে ফেললো মেহনূর, আস্তে করে সেই হাতের উপর হাত রাখলো সে। খোপাটা ইতিমধ্যে আলগা করে শেষ। এলোচুলগুলো পিঠের উপর থেকে সরিয়ে বামে ঠেলে দিলো, মেহনূরের ডান কাধটায় ঠোঁট ছুঁয়ে গাঢ় চাপ বসালো। চোখ বন্ধ রেখেই কাধে থুতনি রাখলো মাহতিম, তার ক্লিনশেভ গালটা আলতো করে নরম গালের গায়ে ঠেকিয়ে দিলো। নিচু গলায় প্রসন্ন কন্ঠে বললো,
- আমিতো জানিই আমার ফেলে আসা দামী মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। দিন হোক, রাত হোক সে আমার কথা একটা মূহুর্ত্তের জন্য ভোলেনি। মাসের-পর-মাস দূরে থাকছি, তার অসুস্থতা, তার অসুবিধা, তার হাসির নিচে দুঃখগুলো আমি ভুলবো? এতোগুলো দিন পাগলের মতো অপেক্ষা করেছো, আমি কি সেকথা জানি না? অপেক্ষা করার মতো অসহ্য কষ্ট মানুষের ভেতরটা কিভাবে কুড়েকুড়ে খায়, আমি কি ভুলে গিয়েছি? ওই সৌভিকের মুখে যখন তোমার অবস্থার কথা শুনতাম, আমি কি ঠিক থাকতাম? সবকিছু ফেলে চলে আসতে ইচ্ছে করতো মেহনূর, আমি পারতাম না। আমার জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই। যেদিন নিজের হাতে আমার সন্তানের মতো ভাইটাকে দাফন করে আসলাম, সেদিন থেকে মায়া চলে গেছে। আমি ফিরলে আমাকে নিয়ে এখন কেউ মাতামাতি করবে না মেহনূর। ওই বাড়িটার আসল আত্মা চলে গেছে। প্রথমে বাবা গেলো, একদম মানতে পারিনি। বিশ্বাসই করতে কষ্ট হচ্ছিলো। বাবার শোকটা কাটাতে গিয়ে জীবনের আসল বাস্তবতা চিনতে শুরু করলাম। ওই বাস্তবতা খুবই জঘন্য ছিলো মেহনূর, বাবার মতো অভিভাবক ছাড়া দুনিয়ায় টেকা যায় না। একসময় যার আঙ্গুল ধরে হাটিহাটি পা-পা করে বড় হয়েছি, আজ তার অনুপস্থিতিতে ভেতরটা ছিঁড়ে আসে মেহনূর। এর চেয়ে অসহ্য যন্ত্রনা আমি ট্রেনিংয়ের সময়ও পাইনি।
টালমাটাল বৃষ্টির ঝুমুঝুম আওয়াজ টিনের ঘরে মুখর। মাটি ভিজে শ্যাওলার সতেজ গন্ধ ছড়িয়ে পরেছে। গাছের পাতা ধুয়ে কচিপাতার মতো রঙ নিয়েছে, ঠান্ডা বাতাসে পুরো প্রকৃতি যেনো নৃত্যের ভঙ্গিমায় অটল। চোখের গরম পল্লবটা খুলে নাক টানলো মেহনূর, জানালাটা খুলতেই ঠান্ডা বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছাঁট ঢুকলো। পর্দাটা টেনে দিলো সে, ঘরটার ভেতর ঠান্ডা হাওয়ার সাথে ফালিফালি আলো আসুক। পেটের উপর থেকে থাবার মতো হাতটা সরালো মেহনূর। পুরোপুরি পিছনে ঘুরতেই মানুষটার কাছ ঘেঁষে মুখোমুখি হলো। কখনো যে দৃশ্য মানসপটে চিন্তা করেনি, ভাবতেও পারেনি দেখতে পাবে, আজ অকল্পনীয় দৃশ্যটা দেখে বুক নিংড়ে ব্যথা হলো মেহনূরের। তীক্ষ্মদৃষ্টির চোখজোড়া ঈষৎ লালে পরিণত, পাপড়ি গুলো ভেজার কারনে চকচক দেখাচ্ছে, গলার মাঝামাঝি উঁচু হাড়টা বারবার ঢোকের জন্য উঠা-নামা করছে, আজ মাহতিম আনসারী করুণভাবে অশ্রুসিক্ত। পরাজিত সৈন্যের মতো মাথা নত হয়ে আছে। আজ মেহনূরের পরিবর্তে তার লাল হয়ে আসা ঠোঁটদুটো কাঁপছে। নত মুখটা দুহাতে ধরে উপরে তুললো মেহনূর। মুখটা কাছে টেনে কপালে-গালে-নাকে চুমু খেলো। ভেজা পাপড়ির উপর ওষ্ঠযুগল ঠেকিয়ে নির্বাধ অশ্রুটা বাধা দিলো। গভীর করে দম নিলো মাহতিম, নিশ্বাসটা ছাড়তে-ছাড়তে ধাতস্থ হতে লাগলো। মেহনূর গাল ছেড়ে সরল গলায় বললো,
- আমার সাধ্য হয়তো এটুকুই। আমি কোনোভাবেই আপনার দুঃখ ঘুচাতে পারবো না। আপনি যেভাবে আমার সমস্যা বুঝতেন, সমাধান করতেন, আমার মধ্যে ওভাবে কিছু করার গুণ নেই। আমার বাবা থাকাও না থাকার সমান, দাদার কাছেই বড় হয়েছি। আপনি যেভাবে দুঃখ পেয়েছেন, আমি আজ পযর্ন্ত ওমন স্বজন হারানোর দুঃখ পাইনি। শুধু এটুকু জানি, মাহদিকে হারানোর শোক আজও আমি কাটাতে পারিনি। ও আমার চোখের সামনে ভাসে, আমি ওর মুখে ভাত তুলে খাইয়েছি।
দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, নিজের অবাধ অশ্রুকে শান্ত করতে পারছিলো না মাহতিম। যে ট্রেনিংয়ের ভূমিতে আবেগ নিয়ন্ত্রণের মন্ত্র মন্ঞ্চস্থ করা হয়েছিলো, আজ তা ভেস্তে যাচ্ছে। আঁচলের কোণাটা টেনে চোখ মুছলো মেহনূর, পায়ের কাছ থেকে পাতলা কাঁথাটা নিয়ে পুরোপুরি মেলে দিলো। জানালার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে পরলো মেহনূর। দুহাত দুদিকে মেলে কাছে আসার ইশারা দিয়ে বললো,
- জান্তব নি-ষ্ঠুরটাকে বুকে আসার ঘোর আহ্বান জানাচ্ছি। তাকে দুহাতের ভেতর জড়িয়ে ধরার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আসুন,
থমথমে শীর্ণ মূহুর্তে ফিক করে হেসে ফেললো মাহতিম। হাসতে-হাসতে বললো,
- তোমার মনে আছে?
মেহনূর ' হ্যাঁ ' সূচকে মাথা নাড়ালো। মুচকি হাসিতে বললো,
- আমি আবদারের কথা ভুলি না।
বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দের সাথে আরেকদফা হাসলো মাহতিম। চোখে শ্রান্ত মায়া, ঠোঁটে প্রসন্ন হাসি নিয়ে এগিয়ে গেলো সে, মেহনূরের বাড়িয়ে দেওয়া হাতযুগলে নিজেকে ছেড়ে দিলো। দেহের সমস্ত ভর, মনের সমস্ত ক্লান্তিগুলো মেহনূরের শয্যায় সমর্পণ করলো। চোখ বন্ধ করে পরম মায়ায় শান্তির নিশ্বাস নিলো মাহতিম, পিঠের ব্যথাটা ভুলে গিয়ে আতিশয্য কোমল উষ্ণতায় মন-প্রাণ ছেঁকে বিষণ্ণতা বেরিয়ে গেলো। মাহতিমের উদ্যম পিঠটা কাঁথার ছায়াতলে ঢেকে দিলো মেহনূর, ঠান্ডা পিঠের ক্ষতস্থান বাদে সর্বত্র ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দিলো। ভেজা ঝলমলে চুলগুলোতে বাঁহাত রাখলো সে, শক্ত করে মাথাটা বুকে চেপে ফিসফিস করে বললো,
- ঘুমিয়ে পরুন, লম্বা একটা ঘুম দিন। আমি কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবো না, এভাবেই আমার কাছে রেখে দিবো, এই বৃষ্টির মধ্যেই ওয়াদা করলাম।
.
.
.
চলবে.............................