অলকানন্দা - পর্ব ২৮ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৮১!!

আজ বহুদিন পর রেজওয়ান মাহার সাথে দেখা করতে এসেছে। এভাবে না বলে আসাটা হয়তো ঠিক হয়নি। সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বেল বাজাতে শঙ্কিত রেজওয়ান। এতটা দিন পর মেয়েটার সাথে দেখা করবে। সাথে মিস তাজও রয়েছেন। মূলত একটা অফিসিয়াল জবানবন্দির জন্যই এখানে আসা। চাইলেই মাহাকে পুলিশ স্টেশনে ডাকা যেত। কিন্তু রেজওয়ান যে চায়না তার প্রিয় মানুষটা কষ্ট পাক। তাই সাথে করে মিস তাজকে নিয়ে এসেছে রেজওয়ান। কলিং বেল বাজানোর আগে কতক্ষণ বেলটার পানে তাকিয়ে রইলো রেজওয়ান। মিস তাজ অবাক হলেন। এই কয়েকদিনের পরিচয়ে এতটা আনমনা রেজওয়ান কে কখনো দেখেননি তিনি। সাথে করে দুইটা ক্যাটবেরি চকলেট নিয়ে এসেছে রেজওয়ান। মিস তাজ এমন কখনো দেখেন নি। অফিসিয়াল জবানবন্দিতেও কেউ কারো জন্য উপহার নিয়ে যায় জানা ছিলোনা তার। 
"হোয়াট আর ইউ থিংকিং, রেজওয়ান?"

তাজের প্রশ্নে খানিক থতমত খেলো রেজওয়ান। কলিং বেল চেপে বললো,
"নাথিং, মিস তাজ।"

তাজ খুশি হতে পারলেন না। তার চৌকস মস্তিষ্ক বলছে,"সিউরলি দেয়ার ইস এ মাইস্ট্রি হেয়ার। ইস ইট এ মেটার অফ লাভ?" মুখে কিছুই বললেন না তিনি। কাঠের দরজা খুলে দিলো মেরি। পুলিশের পোশাক পরিহিত দুজন ব্যাক্তিকে দেখে প্রথমে খানিক বিচলিত হয়েছিলো তার চোখ। বিষয়টা চোখ এড়ায়নি তাজের। পরক্ষণেই হাসি ফুটে উঠলো মেরির মুখে। পরিচারিকা মেরি পরিচিত মুখের সন্ধান পেয়ে স্মিত হাসলো। স্মিত হাসলো বাইরে দাঁড়ানো দুজন ব্যাক্তিও। মেরি নিজের ইংরেজি বুলিতে আপ্যায়নের সুরে বললো,
"প্লিজ, আপনারা ঘরে আসুন।"

সোফায় বসতে বলে মেরি দাঁড়ালো পাশে। 
"কি নিবেন স্যার,ম্যাম? চা, কফি না জুস?"
"বিচলিত হবেন না মিস মেরি। আপনি একটু মাহাকে ডেকে দিন।"

রেজওয়ান আলতো সুরে বললো।
"জ্বি, স্যার ডেকে দিচ্ছি। ম্যাম আর ডক্টর স্যার উপরেই আছে।"

সার্থকও তবে বাড়িতে আছে? রেজওয়ান ভেবেছিলো এসময় সার্থক হয়তো হাসপাতালে থাকবে। রেজওয়ানের যে সার্থক আর মাহাকে একসাথে দেখলে কষ্ট হয়! মাহা নিচে নেমে এলো পিছনে সার্থক। মাহার গাঁয়ে হালকা বেগুনি রঙের বাটিক থ্রি-পিস। হলদে ফর্সা গাঁয়ে ভিষণ মানিয়েছে। রেজওয়ান জানে মাহার বাটিক থ্রি-পিস খুব পছন্দের। গত ইদেও মাহাকে দুটো থ্রি-পিস উপহার দিয়েছিলো রেজওয়ান। যদিও নিজে দেয়নি। মাকে দিয়ে মাহার হাতে দিয়েছিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। এ ব্যাপারটাও চোখ এড়ায়নি তাজের। চার জোড়া চোখ একে অপরের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হলো একে অপরের সাথে। বহুদিনের পরিচিত মানুষের দেখা হলো আবার। সার্থক, মাহা এসে বসলো সোফায়। একদম পাশাপাশি। 
"কেমন আছেন রেজওয়ান ভাইয়া? আপনি একটাবারের জন্যও কল দেননি আমায়?"

 অনুযোগ মাহার কন্ঠে। রেজওয়ান স্মিত হাসলো। 
 "চৈতির কেসটায় অনেক ব্যস্ত সময় পার করছি মাহা।"

চৈতি। কর্ণকুহরে নামটা যেতেই সার্থকের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহা। চোখমুখে অদ্ভুত ভয়। সার্থক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
"মিঃ রেজওয়ান সেই যে আপনি এসেছিলেন আমাদের বিয়ের দিন। এরপর তো আপনার আর দেখাই নেই। বোনের খবরটাতো অন্তত নিতে পারতেন?"

!!৮২!!

বিরক্ত হলো রেজওয়ান। এমনিতেই অদ্ভুত কারণে সার্থক কে পছন্দ না তার। তারউপর কথায় কথায় বোন, বোন আর বোন। রেজওয়ান জবাব দেওয়ার আগেই সার্থক আবার আওড়ালো,
"কি পান করবেন বলুন? চা, কফি না জুস?"

কিছু একটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই বিচলিত হলো একজোড়া চোখ। উঁহু, একজোড়া নয় দুইজোড়া বোধহয়। 
"কি হলো বলুন?"

সার্থকের বিচলিত কন্ঠস্বর। মিস তাজ জবাবে বললেন,
"কফি। কফি খেতে পারি?"
"সিউর।"

বলেই রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো সার্থক। গলা উঁচিয়ে ডাক লাগালো এমিলিন কে। এমিলিন চিরচেনা গম্ভীর রূপে বেরিয়ে এলেন। 
"চারকাপ কফি।"

এমিলিন শুনলেন। অতঃপর আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। 
"ডক্টর সার্থক আমরা আজ একটা বিশেষ কাজে এখানে এসেছি।"

রেজওয়ানের সুরটা গম্ভীর শোনালো। সার্থক চিরচেনা ঠোঁট বাঁকানো হাসি দিয়ে বললো,
"জ্বি, কি সাহায্য করতে পারি মিঃ রেজওয়ান?"

এবারে মাহার দিকে তাকালো রেজওয়ান। নিজের হাত দুটো সামনে এনে একসাথে মুঠোয় ভরে বললো,
"মাহা আমরা আজ তোমার একটা অফিসিয়াল জবানবন্দি নিবো।"
"আমার!"

অবাক কন্ঠে বিস্মিত সুরে আওড়ালো মাহা। সার্থক মাহার ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে বললো,
"অবশ্যই, মিঃ রেজওয়ান। জিজ্ঞেস করুন।"
"ভাইয়া, সেদিন তো আমি আপনাকে সবকিছু খুলে বলেছি একবার।"
"মাহা, সেদিনের ব্যাপারটা অফিসিয়াল ছিলোনা। তাছাড়া ডিএনএ ম্যাচ হয়েছে। পায়ের খন্ডাংশটা চৈতিরই।"

কথাটা শোনার সাথে সাথেই মাহার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। খানিকক্ষণ নিষ্কলুষ স্তব্ধ নয়নে মাহা তাকিয়ে রইলো রেজওয়ানের পানে। নিজের কি অভিব্যাক্তি প্রকাশ করবে ভেবে পেলোনা। সার্থক আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো মাহার মাথায়। কানের কাছে গিয়ে আলতো করে বললো,
"শান্ত হও, সোনা। আমি আছিতো।"

ভরসা পেলো মাহা। চৈতি নামক মেয়েটা মাহার জীবনে অনেকাংশ জুড়ে ছিলো। তার মৃত্যুর খবর আজ চূড়ান্ত ভাবে পেলো মাহা। মন কাঁদছে তার। বাঁধ ভাঙা কান্না। মাহার কিছু মনে নেই। তবে মাঝেমাঝেই অবচেতন মস্তিষ্কে প্রশ্ন উঠে,
"সে কি দায়ী?"

সেই চিন্তা মাহাকে ঘুমাতে দেয়না। সার্থকের বুকে মাথা দিয়ে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে মাহা। হঠাৎ হঠাৎ তার ভয় হয়। মনে হয় চৈতির দেহের খন্ডগুলো আছে। আশেপাশে আছে। শূন্যে ভাসছে। তাকে ডাকছে। মাহা তখন ভয় পায়। বিচলিত হয়ে যায়। কামড়ে জখম করে দেয় সার্থকের বুক। সার্থক সব মাথা পেতে নেয়। ঘুমঘুম চোখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাহাকে। মাথায়, চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। কখনোবা চূড়ান্ত ভালোবাসা দেয়। তখনই পাগলামি থামে মাহার। শান্ত, তৃপ্ত, ক্লান্ত মাহা ঘুমিয়ে পড়ে সার্থকের বুকে। সার্থক আর ঘুমায় না। চেয়ে থাকে নিজের অলকানন্দার দিকে। ভাগ্যের কাছে প্রশ্ন করে, "কেন এতো অদ্ভুত তার জীবন?" সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী ছিলোনা সার্থক। হঠাৎ করেই মনের একটা অংশ সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করে, 
"হে রক্ষাকর্তা। আমার মাহাকে তুমি ভালো রেখো।"

!!৮৩!!

"মাহা, তুমি ঠিক আছো?"
"জ্বি, ভাইয়া।"
"তুমি যতটুকু জানো ততটুকু আবার খুলে বলো আমাদের।"

সার্থকের হাত আঁকড়ে ধরে আবার সেই পুরানো স্মৃতি একে একে তুলে ধরলো মাহা। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো সেই স্মৃতির পাতা। শেষটুকু বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাহা। কয়েক ফোঁটা অশ্রু নেমে গেলো কপোল বেয়ে। মাত্র আড়াই-তিন মাসের ব্যবধানে বিপুল পরিবর্তন এসেছে তার জীবনে। সার্থক নামক মানুষটা তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখিয়েছে। একসময় মরণ চাওয়া মাহা এখন বাঁচতে চায়। নিজের একান্ত মানুষটার সাথে বাঁচতে চায়। কফি নিয়ে এলো এমিলিন। টি-টেবিলে রেখে স্থান ত্যাগ করলো নিজের। সার্থক আবার পরিস্থিতি হালকা করতে রেজওয়ানের হাতে কফি তুলে দিতে দিতে বললো,
"আপনারা কফিটা একটু টেস্ট করে দেখুন। এমলিন খুব ভালো কফি বানায়।"

বুকে রক্তক্ষরণ নিয়ে কফি হাতে নিলো রেজওয়ান। চোখ শুধু বারেবারে যাচ্ছে ডানহাতে মাহার হাত আঁকড়ে ধরা সার্থকের হাতের দিকে। তখন মুইংচিনের ঘর থেকে গান ভেসে এলো,

"You come out at night
That's when the energy comes
And the dark side's light
And the vampires roam
You strut your rasta wear
And your s/u/i/c/i/d/e poem
And a cross from a faith that died
Before Jesus came
You're building a mystery
You live in a church
Where you sleep with voodoo dolls
And you won't give up the search
For the ghosts in the halls
You wear sandals in the snow
And a smile that won't wash away
Can you look out the window
Without your shadow getting in the way?
You're so beautiful
With an edge and charm
But so careful
When I'm in your arms
'Cause you're working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Yeah you're working
Building a mystery
And choosing so carefully
You woke up screaming aloud
A prayer from your secret God
You feed off our fears
And hold back your tears, oh
Give us a tantrum
And a know-it-all grin
Just when we need one
When the evening's thin
You're a beautiful
A beautiful ..... up man
You're setting up your
Razor wire shrine
'Cause you're working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Yeah, you're working
Building a mystery
And choosing so carefully
Ooh, you're working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Yeah you're working
Building a mystery
And choosing so carefully
Yeah, you're working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Oh, yeah, you're working
Building a mystery
And choosing so carefully
You're building a mystery"

কানাডিয়ান শিল্পী (Sarah McLachlan) এর গানটায় হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটালো সকলের সকল ভাবনার। সার্থক গলা উঁচিয়ে বললো,
"মুইংচিন জরুরি মিটিং হচ্ছে এখানে গান বন্ধ করো।"

থেমে গেলো গান। শুরু হলো আবার ভাবনা। ভয়, ঈর্ষা, কাতরতা, ভালোবাসা, রুক্ষতা, নিষ্ঠুরতা একই ছাদের নিচে কত অনুভূতির সমাহার! 
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন