অলকানন্দা - পর্ব ২৫ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৭৩!!

রেজওয়ান আজ এসেছে মাতব্বর শরীফের সাথে দেখা করতে। মাতব্বর কে সেলে রাখা হয়েছে। সাধারণত ফাঁসি প্রাপ্ত আসামিদের এই সেলে রাখা হয়। চারিদিকে অন্ধকার। ছোট একটা ঘর। আলো-বাতাসের বালাই নেই। রেজওয়ান ভিতরে প্রবেশ করবেনা। দাগী আসামি পাশাপাশি সিরিয়াল কিলার। রেজওয়ানের যথেষ্ট সাবধানী হয়ে কথা বলতে হবে। শিকের এপাড়ে রেজওয়ান ওপাড়ে মাতব্বর। তিনি আছেন কিংবা থেকেও নেই। নিঃশ্বাসের শব্দও আসছেনা। 
"মাতব্বর সাহেব।"

এপাড় থেকে ঢাকলো রেজওয়ান। জেলার সাহেব আসতে চেয়েছিলেন। রেজওয়ান মানা করে দিয়েছে। রেজওয়ান আবার ডাকলো। 

"আমি জানি, আপনি জেগে আছেন। সাড়া দিন মাতব্বর সাহেব।"

নিস্তব্ধতা। রেজওয়ান আরো দুবার ডাকলো। কাজ হয়নি। এবারে কৌশলী হলো রেজওয়ান। 

"মিসেস রুৎবা। মিসেস রুৎবা আপনার স্ত্রী না মাতব্বর সাহেব?"

এবার খানিকটা গোঙানির শব্দ ভেসে এলো কানে। রেজওয়ান আবার বললো,
"ফয়সাল। আপনার ছেলে। সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র ছিলোনা? চোরাবালি তে ডুবে মারা গেলো? মাতব্বর সাহেব? আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করেনা?"

অন্ধকার থেকে ভেসে এলো কুঁকড়ে যাওয়া, ভিতু একখানা সুর। আঁতকে উঠলো রেজওয়ান। কেমন অশরীরীর ন্যায় হৃদ কাঁপানো সুর।
"না।"
"কেন?"
"চাইনা।"

উঁচু গলার আওয়াজ। রেজওয়ান হাল ছাড়লোনা। আপাতত তার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই। মাহা, চৈতির মোবাইল, কল ট্রেক করেও কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন কখনো হয়নি রেজওয়ানের। এই অল্প দিনের ক্যারিয়ারে প্রতিটা কেস অল্প সময়ে খুবই দক্ষতার সাথে সমাধান করেছে সে। হাতে সময় আর মাত্র পাঁচদিন। প্রলয়ের কাছ থেকে একমাস সময় নিয়েছিলো রেজওয়ান। ছুটে গিয়েছিলো সিলেট। সেখানে মাতব্বর শরীফের এক চমকপ্রদ অতীত সামনে এসেছে তার। রুৎবা পাগলীর কথাও শুনে এসেছে। কিন্তু বিগত কয়েকদিন যাবত পাগলীকে পাওয়া যাচ্ছেনা! স্ট্রেঞ্জ! যে বা যারা এই ঘটনার পিছনে আছে তারা জানলো কি করে রেজওয়ান সিলেট যাবে? তার যাওয়ার একদিন আগে থেকেই রুৎবা গায়েব। রুমানার বাড়ি ভালো করে ইনভেস্টিগেশন করা হয়েছে। সন্দেহভাজন কোনো কিছুই পায়নি। একদিকে প্রেয়সী হারানোর শোক অপরদিকে দায়িত্ব। অথৈ সাগরে পড়েছে রেজওয়ান। টুকটাক সন্ধান চালাতে চালাতে হাতের একমাস প্রায় শেষের দিকে চলে এলো। শেষ সুযোগটা নিলো রেজওয়ান। গণমাধ্যমগুলোতে বারবার ছিন্ন পা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ২০১২ এর ন্যায় পরপর অনেক ছিন্ন অংশ না পাওয়া যাওয়ায় সাময়িক ধামাচাপা পড়েছে খবরটা। 
"চলে যান। চলে যান। কাউকে চাইনা আমার।"

মাতব্বর শরীফের ভয়ানক চিৎকারে ধ্যান ভাঙে রেজওয়ানের। দাগী আসামিদের ক্ষেপাতে নেই। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তারা ভয়াবহ হয়ে উঠে।
"আপনি শান্ত হোন। আমি আপনার বন্ধু।"

হা হা। হাসির জোয়ার বয়ে গেলো। গগন কাঁপানো, হৃদয়ে অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতির হাসি। হঠাৎ থেমে গেলো সে হাসি। গম্ভীর হলো সুর।
"চলে যান। আমি খারাপ। খুব খারাপ।"
"আমি জানি আপনি খারাপ নন মাতব্বর সাহেব।"
"চলে যান। চলে যান।"
"আজ যাচ্ছি। আবার কিন্তু ফিরবো আমি।"

রেজওয়ান কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলো। সে আবার আসবে। আর কোনো রাস্তা তো হাতে পাচ্ছেনা। মাতব্বর শরীফের মনে একটা ছাপ সৃষ্টি করেছে কেবল। ভিতরে ঢুকা বাকি!  

!!৭৪!!

আজ আবার এশার সাথে দেখা হলো রেজওয়ানের। মাহা চলে যাওয়ার পর থেকে তাদের বাড়িতে রেজওয়ান আর যায়নি। ইচ্ছে জাগেনা। যার জন্য যেতো সেই তো নেই। এশা মেয়েটা রাস্তায় বসে আছে। চোখ-মুখ বিধ্বস্ত তার। রেজওয়ান জরুরি ফোনে কথা বলবে বলে গাড়িটা থামিয়েছিলো। তখনই মেয়েটাকে দেখতে পেলো সে। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। এশা মাথা নিচু করে পায়ে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। 
"এই তুমি এশা না?"

এতদিন পর। এতটা দিন পর প্রিয় মানুষটার আওয়াজে হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ হারে। সেই সাথে জড়ো হচ্ছে একগুচ্ছ অভিমান। মাথা নুইয়েই রইলো এশা। রেজওয়ান বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো, 
"কথা বলছোনা কেন? তুমি এশা?"
"হু।"

আস্তে করে বলে এশা। চোখে, মুখে ব্যথার ছাপ।
"এখানে এভাবে বসে আছো কেন?"
"চোর আমার ব্যাগ নিয়ে গেছে। দৌড়াতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছি।"

এশার স্বীকারোক্তি। রেজওয়ান অবাক না হয়ে পারলোনা। দুনিয়ার সব চোর কি খালি এই মেয়েটার থেকে চুরি করে। স্ট্রেঞ্জ! এর আগেরবারেও এমন হয়েছিলো।
"হাঁটতে পারবে?"
"তাহলে কি এখানে বসে আছি?"

চিবিয়ে চিবিয়ে বললো এশা। রেজওয়ান অবাক না হয়ে পারলোনা। এতটুকু একটা মেয়ে আর তার সাথে তেজ দেখাচ্ছে! এএসপি রেজওয়ানের সাথে। আশ্চর্য! 
"পায়ে বেশি ব্যথা পেয়েছো? হসপিটাল নিতে হবে?"

এশা মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে। আচ্ছা লোকটা কি অবুঝ? বুঝেনা কিছু? এই লোক কি করে এতবড় পুলিশ অফিসার হলো বুঝে পায়না এশা। সে কি নিজে থেকে বলবে নাকি। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি অসুস্থ। আমাকে হসপিটাল নিয়ে যান! বেকুব! 

"এই মেয়ে কথা বলো।"
"হু"

রেজওয়ান আর কথা বাড়ালোনা। একটানে এশাকে দাঁড় করালো। কিন্তু ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো এশা। চোখ মুখ খিঁচে রইলো। 

"বেশি কষ্ট হচ্ছে?"
"হু।"

এই মেয়ে কি হু হা ছাড়া কথা জানেনা! অদ্ভুত! কথা না বাড়িয়ে এশাকে কোলে তুলে নিলো রেজওয়ান। মেয়েটা অসুস্থ। রেজওয়ানের কাছে দায়িত্ববোধ সবার আগে। এশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রেজওয়ানের পানে। চোখ বেয়ে এক ফোঁটা নোনতা জল গড়িয়ে পড়েছে তার। বিড়বিড় করে বললো,
"ভালো যদি নাই বাসেন তবে কেন মায়া বাড়াচ্ছেন?"

!!৭৫!!

নিজের ক্যাম্পাস, নিজের হল, নিজের ক্লাসরুম। আপন আপন ঘ্রাণ সর্বত্র। মাহা প্রাণভরে শ্বাস নিলো। দীর্ঘদিন পর প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরেছে সে। সাথে রুমানা আছে। কিন্তু নেই কেবল চৈতি। খানিকক্ষণ আগেই সার্থক মাহাকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। অনেক তো হলো বাড়িতে থাকা। আজ প্রায় দুমাস যাবত মাহা সার্থকের বাড়িতে আছে। ঘরে থাকতে আর ভালোলাগছিলোনা তার। তাই সার্থকই তাকে আবার ক্লাস শুরু করার কথা বলে। মাহাও দুরুক্তি করেনি। এভাবে বন্দি জীবন কাটাতে তারও ভালোলাগছেনা। রুমানা পাশে আছে। এটা সেটা বলছে। টুকটাক কথা বলছে। মাহার গানের গলা ভালো। তাই তাকে কোকিল বলে ডাকে রুমানা। চৈতিকে ডাকতো টুকি বলে। কিন্তু টুকি তো আর নেই। রুমানারও খুব খারাপ লাগছে। ক্লাস করার পর বুকটা ফাঁকা লাগছে মাহার। এই ভার্সিটিতে আসার পর থেকে চৈতি তার বেস্ট ফ্রেন্ড। আজ সেই ভালো বন্ধুটা সাথে নেই। যেদিকে তাকায় মাহা কেবল তারই স্মৃতি। মাহা দিশেহারা হয়ে উঠলো। দম বন্ধ লাগছে তার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে মর্গ, চৈতি, ছিন্ন পা। না, আর নিতে পারছেনা মাহা। রুমানা সব খেয়াল করে বললো,
"তোর কি খারাপ লাগছে কোকিল?"
"আমি, আমি বাড়ি ফিরবো রুমানা।"

বলেই নিজের মোবাইলটা রুমানার পানে বাড়িয়ে দিলো মাহা। কাতর কন্ঠে বললো,
"একটু সার্থককে কল করে আসতে বল। আমার কষ্ট হচ্ছে।"

ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে সার্থক। মাহা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। সার্থক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,
"কি হয়েছে তোমার? মাহা। বেশি কষ্ট হচ্ছে?"

মাহা সার্থক কে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
"আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে সার্থক।"

মাহা জ্ঞান হারালো। 
.
.
.
চলবে...............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন