অবেলার অভিলাষ - পর্ব ১১ - শারমিন আক্তার সাথী - ধারাবাহিক গল্প


আয়াত আইসিইউ তে ঢু‌কে তনয়ার দি‌কে তাকা‌তেই ওর ক‌লিজা ফে‌টে যা‌চ্ছিলো। ম‌নে হ‌চ্ছে কেউ ছু‌ড়ি দি‌য়ে ক‌লিজাটা‌কে কে‌টে শত শত টুক‌রো ক‌রে দি‌চ্ছে। 
তনয়াকে বাম পা‌শে ঘু‌রি‌য়ে শু‌য়ে রাখা হ‌য়ে‌ছে। পিঠা করা আঘা‌তে বড় ব্যা‌ন্ডেজ করা। হয়‌তো পি‌ঠের আঘা‌তের কার‌নেই ওকে সোজা ক‌রে শোয়া‌নো যায়‌নি। মাথার পিছন‌দিকটা পুরো ব্যা‌ন্ডেজ করা। এ কার‌নেই হয়‌তো ভি‌ডিও কলে তানভী তনয়া‌কে ঠিক ক‌রে দেখায়‌নি। 

তনয়া কত সুন্দর নিশ্চি‌ন্তভা‌বে ঘু‌মি‌য়ে আছে। ঠোঁট নিচটা কে‌টে গে‌ছি‌লো, যেটা নীল বর্ণ ধারন ক‌রে‌ছে। তনয়ার মু‌খে অক্সি‌জেন মাস্ক আর পু‌রো শরী‌রে ব্যা‌ন্ডজ। আয়া‌তের কা‌ছে ম‌নে হয়, এর থেকে ভয়ানক দৃশ্য ও জীব‌নে দে‌খে‌নি।

আয়াত অপলক চো‌খে র্নি‌লিপ্ত ভ‌ঙ্গি‌তে তনয়ার দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইল। আয়াত চুপ ক‌রে তনয়ার দি‌কে তা‌কি‌য়ে ভাব‌ছে, এটা কী সেই চঞ্চল মে‌য়েটা, যার চাঞ্চল্য আমা‌কে পাগ‌লের মত মা‌তি‌য়ে রাখ‌তো।
‌যে ঘুমের মা‌ঝেও কথা বল‌তো। আজ দে‌খো কেমন চুপ ক‌রে ঘু‌মি‌য়ে আছে।

এর আগেও তনয়া বিড়াল ছানার মত আয়া‌তের বু‌কে গু‌টিসু‌টি মে‌রে ঘুমা‌তো। কিন্তু ঘু‌মের মা‌ঝে যখন কথা বল‌তো, আয়াত মুচকি হেসে নাক টি‌পে দি‌তো, না‌কে ভা‌লোবাসার পরশ দি‌তো।
লাস্ট কমাস আগে ওদের জীব‌নে অনেক বড় একটা ঝড় এসে‌ছি‌লো, যে ঝড়টায় ওদের সম্পর্ক নষ্ট হ‌য়ে গে‌ছি‌লো। তারপর______

আয়া‌তের খুব ইচ্ছে কর‌ছে, তনয়া‌কে বু‌কে নি‌য়ে রাখ‌তে, অথচ আজ তনয়ার শরী‌রে কোথায় স্পর্শ কর‌বে ভে‌বে পা‌চ্ছেনা। যেখানেই স্পর্শ কর‌বে সেখা‌নেই হয়‌তো তনয়া ব্যাথা পা‌বে। আয়াত চুপচাপ তনয়ার দি‌কে তা‌কি‌য়েই ছি‌লো।

‌বেশ খা‌নিক পর ডাক্তার এসে একরকম জোড় করেই আয়াত‌কে বা‌হি‌রে বের ক‌রে দেয়। আয়াত বাই‌রে গি‌য়ে দরজার উপ‌রে লাগা‌নো ছোট্ট কাঁচের অংশটা দি‌য়ে তনয়ার দিকে তা‌কি‌য়ে আছে। চো‌খের সাম‌নেটা ঝাপসা হ‌য়ে যায় বার বার। মাথাটাও খুব ব্যাথা কর‌ছে। কর‌বেনা কেন গত তিন দি‌নে খাওয়া দাওয়া ক‌রে নাই বল‌লেই চ‌লে। তানভী আয়া‌তের কাঁ‌ধে হাত দি‌য়ে বলল,
__ভাইয়া আমার ম‌তে আপনার বা‌ড়ি গি‌য়ে ফ্রেস হ‌য়ে খে‌য়ে, বিশ্রাম নি‌য়ে আসা উচিৎ?

__কী বল‌ছিস তানভী! তুই দেখ‌ছিস তনয়ার এখ‌নো চোখ খু‌লে নি। আমি কি ক‌রে আমার তনয়াটা‌কে ছে‌ড়ে যাই বল?

__ভাইয়া তনয়ার খেয়াল রাখ‌তে হ‌লে আগে আপনার নি‌জের খেয়াল রাখ‌তে হ‌বে। আপনা‌কে দে‌খে বেশ বোঝা যা‌চ্ছে গত ক‌য়েক‌দি‌নে খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ ক‌রে রে‌খে‌ছেন। ভাইয়া আপ‌নি যদি এভা‌বে ভে‌ঙে প‌ড়েন, অসুস্থ হ‌য়ে প‌ড়েন, ত‌বে তনয়া‌কে কে সামলা‌বে? তাই প্লিজ ভাইয়া তনয়ার জন্য হ‌লেও নি‌জের খেয়াল রা‌খেন। আপ‌নি এখন যান খে‌য়ে ঘুুমিয়ে পড়ুন কাল সকা‌লে আস‌বেন। কেমন

তানভীর কথা আয়াত শুন‌লেও অতটা গুরুত্ব দি‌লোনা। শুধু জি‌জ্ঞেস কর‌লো,
__ডাক্তার কী বল‌ছেন? তনয়ার জ্ঞান ক‌বে ফির‌বে?

__ডাক্তার বল‌ছে তনয়া ইমপ্রুভ কর‌ছে। শিঘ্রই সুস্থ হ‌য়ে উঠ‌বে।

__তানভী ভাই তুই স‌ত্যি বল‌ছিস তো?

__হ্যাঁ (কাপা কাপা গলায়) আর মনে ম‌নে বল‌ছে, এর থে‌কে বড় মিথ্যা কথা আমি বোধয় কখ‌নো ব‌লি‌নি। যেখা‌নে ওর বাঁচাটাই দায় সেখা‌নে সুস্থতা-----? বা‌কিটা‌ তো কেবল আল্লাহই জা‌নে। তানভী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছে‌ড়ে বলল, আপ‌নি বা‌ড়ি গি‌য়ে রেস্ট নেন, আমি তনয়ার কা‌ছে থাক‌ছি। আর তাছাড়া এখন তনয়া আইসিইউ এর ভিত‌রে চাই‌লেও আজ আর ওর কা‌ছে যে‌তে পার‌বেন না। আরো বেশ ক‌দিন ওকে অবজার‌বেশ‌নে রাখা লাগ‌বে। তাই এখা‌নেও থে‌কেও লাভ হ‌বেনা। তার থেকে বা‌ড়ি গি‌য়ে রেস্ট নি‌য়ে কাল‌কে আসুন।

তানভী অনেক জোড় দি‌য়ে বলার পর আয়াত বা‌ড়ি ফির‌লো। বা‌ড়ি ফি‌রি‌য়ে অকেক্ষন যাবত গোসল কর‌লো। মাথাটা প্রচন্ড ভার হ‌য়ে আছে। শরীর মন দু‌টোই হাল ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছে। মেঘ‌া খাবার নি‌য়ে রু‌মে আস‌তেই কোন কথা না ব‌লে চুপচাপ পু‌রো খাবারটা খে‌য়ে ফেল‌লো। কা‌রো সা‌থে কোন কথাই বলল না। মেঘা খাবার প্লেট গু‌লো নি‌য়ে যে‌তেই আয়াত বিছানায় গা এলি‌য়ে দি‌লো। 

‌তিন দি‌নের টেনশন, ক্লা‌ন্তি, অবসাদ, সব মি‌লি‌য়ে পু‌রো শরীটা হাল ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছে। বিছ‌ানায় শোবার সা‌থে সা‌থে ঘুম দে‌শে তলি‌য়ে গে‌লো। 

তনয়া সুন্দর একটা শা‌ড়ি পরা, ওকে দেখ‌তে ঠিক পরীর মত লাগ‌ছে। চুলগু‌লো হাওয়ায় উড়‌ছে, ছোট ছোট কিছু চুল বারবার চে‌া‌খের চার পা‌শে ছ‌ড়ি‌য়ে যাচ্ছে। আয়াত মনমুগ্ধ হয়ে তনয়ার এমন স্নিগ্ধ রূপ দেখ‌ছে। তনয়া আয়া‌তের কা‌ছে এসে, ওর পা‌য়ের উপর পা তু‌লে দাড়া‌লো, তনয়া নি‌জেই আয়া‌তের হাতটা নি‌য়ে নি‌জের কোম‌রে রাখ‌লো। অার আয়া‌তের চো‌খের দিকে তা‌কি‌য়ে বল‌লো,
খুব ভা‌লোবা‌সি, ভা‌লোবা‌সি, ভা‌লোবা‌সি, আয়াত।
হঠাৎ পিছন থে‌কে কোন কা‌লো ছায়া তনয়া‌কে স‌জো‌ড়ে আঘাত কর‌লো, তনয়ার পর‌নের সাদা ধবধ‌বে জর‌জেট শা‌ড়ি লাল র‌ক্তে র‌ঞ্জিত হ‌য়ে গে‌লো। বহু ক‌ষ্টে তনয়া মাথাটা আয়াতের বু‌কে ঠে‌কি‌য়ে বলল, ভা‌লোবা‌সি।

ধরপ‌রি‌য়ে বিছানা থে‌কে উঠে বস‌লো আয়াত। পু‌রো শরীর থরথর ক‌রে কাঁপ‌ছে। এত শী‌তেও ঘা‌মে শরীর ভি‌জে গে‌ছে। ঘ‌ড়ির দি‌কে তা‌কি‌য়ে দে‌খে, রাত সা‌ড়েই  এগা‌রোটা। আয়াত সেই সন্ধ্যায় ঘু‌মি‌য়ে‌ছি‌লো। আয়াত আর এক মুহূর্তও বস‌লোনা। চো‌খে মু‌খে পা‌নি দি‌য়ে, ওযু ক‌রে, এশার নামাজ প‌ড়ে নি‌লো। তারপর ড্রেস বদ‌লে, বাই‌কের চা‌বিটা নি‌য়ে ড্রইং রু‌মে এসে দে‌খে ওর বাবা মা, মেঘা আয়াজ নি‌চে ব‌সে কি যে‌নো বল‌ছে। আয়াত ওর মা‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বলল,
__মা আমি বের হ‌চ্ছি। 

__‌কোথায় যা‌চ্ছিস?

__হসপিটা‌লে!

__আয়াত খুব বাড়াবা‌ড়ি কর‌ছিস কিন্তু। যে যাবার সে যা‌বেই আদি‌ক্ষেত্যা ক‌রে তা‌কে ফিরা‌তে পার‌বিনা। সবাই জানে তনয়া বাঁচা অসম্ভব। কী আছে ওর মা‌ঝে যে, তুই ঐ প্র‌তিবন্ধী মে‌য়েটার পিছ‌নে পাগল।

__আয়াত কিছু না ব‌লে তা‌চ্ছিল্য হা‌সি দি‌য়ে হাঁটা ধর‌লো। লুবনা বেগম চে‌ঁচি‌য়ে বলল, 
মানুষ হ‌য়ে মানুষের মৃত্যু প্রার্থনা করা ঠিক না। কিন্তু আমি তো এটাই চাই‌বো ও মে‌য়ে যে‌নো তো‌কে মুক্ত করে দেয়।

__আয়াত লুবনা বেগ‌মের দিকে তা‌কি‌য়ে বলল, তাহলে মা তু‌মি তার সা‌থে এই দোয়াটাও ক‌রো যা‌তে তোমার কোলও খা‌লি হয়। তনয়ার সা‌থে সা‌থে যে‌নো আয়াত নামটাও পৃ‌থিবীর বুক থে‌কে বিলীন হ‌য়ে যায়। আর কোন কথা বললনা আয়াত। হস‌পিটা‌লে চ‌লে গে‌লো। 

অ‌নেক ক‌ষ্টে দা‌রোয়ান‌কে টাকা খাই‌য়ে ভিত‌রে ঢুক‌তে পার‌লো। অনেকক্ষন আইসিইউ এর কা‌চের জানালা দি‌য়ে তনয়ার দি‌কে তা‌কি‌য়ে ছি‌লো। তারপর হস‌পিটা‌লের মস‌জি‌দে গি‌য়ে তাহাজ্জু‌দের সালাত আদায় ক‌রে উপরওয়ালার কা‌ছে অনেক কান্নাকা‌টি করলো। নামাজ শেষ ক‌রে এসে আইসিইউ এর পা‌শে রাখা লম্বা বেঞ্চটায় শু‌য়ে পড়‌লো। তনয়া মা পা‌শের কে‌বি‌নে ছি‌লো। আয়াত‌কে ওভা‌বে শু‌য়ে থাক‌তে দে‌খে, একটা চাদড় আয়া‌তের গা‌য়ে জ‌ড়ি‌য়ে দি‌য়ে আয়া‌তের মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে দি‌য়ে নি‌জে‌ নি‌জে বলল, 
__‌কোন পু‌ণ্যের ফ‌লে আমার মে‌য়েটা‌কে এই ছে‌লেটা‌কে পে‌লো আল্লাহ্ জা‌নে। আর কোন জা‌নোয়া‌রের কা‌লো নিঃশ্বাস আমার সোনার টুক‌রো মে‌য়ে আর আয়া‌তের জীব‌নে কাল হ‌য়ে দা‌ড়ি‌য়ে‌ছে কে জা‌নে। আল্লাহ যে‌নো তার বিচার ক‌রে।

৩০!!

দশ দিন পর।
              তনয়া‌কে কে‌বি‌নে দেয়া হ‌য়ে‌ছে। একটু ইমপ্রুভ কর‌ছে কিন্তু এখ‌নো কোমায় আছে। এই দশদিন আয়া‌তের প্র‌তিটা রাত আইসিইউ এর সাম‌নে বে‌ঞ্চেটায় শু‌য়েই আর হস‌পিটা‌লের মস‌জি‌দে নামাজ প‌ড়ে আল্লাহর দরবা‌রে কান্না ক‌রেই কাটা‌তো।

‌কে‌বি‌নে দেয়ার পর,
আয়াত তনয়ার পা‌শে একটা চেয়ার টে‌নে বস‌লো। তনয়ার হাতটা‌কে নি‌জের হা‌তের মু‌ঠোয় নি‌লো।
একটা দীর্ঘ‌নিঃশ্বাস ছে‌ড়ে তনয়ার হা‌তে চু‌মো খে‌লো। তারপর হাতটা নি‌জের বু‌কের বাম পাশটায় রে‌খে বলল,
__অ‌নেক ঘু‌মি‌য়ে‌ছো তনয়া। এবার তো উঠে প‌ড়ো! দে‌খো আমি তোমার কা‌ছে এসে গে‌ছি। তনয়া তু‌মি ভু‌লে গে‌লে আর নয় দিন পর না আমাদের ধুমধাম ক‌রে বি‌য়ে হবার কথা? আর তুুমি এভা‌বে ঘু‌মি‌য়ে আছো? দে‌খো ন‌য় দি‌নে কত কত কাজ।

‌তোমার পছ‌ন্দের ডিজাই‌না‌রের কা‌ছে যেতে হ‌বে, তোমার বি‌য়ের শা‌ড়ি ডিজাইন কর‌বে। আর তু‌মি না বল‌ছি‌লে আমার জন্য বিয়ের শেরওয়া‌নি তু‌মি নি‌জে পছন্দ ক‌রে কিন‌বে? কত কত প্ল্যান কর‌ছি‌লে তু‌মি? আমার তো সব ম‌নেও নেই। তু‌মি না থাক‌লে সেগু‌লো কি আদৌ সম্ভব ব‌লো? তারাতা‌রি ওঠে প‌ড়ো তো। দে‌খো তোমার আয়াতটা কিন্তু এসব মে‌য়ে‌দের কাজ কর‌তে পা‌রেনা। সব তোমা‌কেই সামলা‌তে হ‌বে। 

‌শোন তু‌মি দুহাত ভ‌রে মে‌হেদী পড়‌বে। আর মে‌হেদীর ডিজাই‌নের ভিতর আমার নাম লিখবে। তু‌মিই তো এসব ব‌লে‌ছি‌লে। বল‌ছি‌লে য‌দি নাম খুঁজে পাই ত‌বে তু‌মি আমার পছন্দমত সাত‌দিন চল‌বে। আর য‌দি খুঁ‌জে না পাই তবে তোমার পছন্দমত আমি সাত‌দিন চল‌বো। 

আচ্ছা তু‌মি সে‌দিন বল‌ছি‌লে বি‌য়ের পরই আমা‌দের গ্রা‌মের বা‌ড়ি যা‌বে। বিশাল বড় দিঘী‌তে গলা সমান পা‌নি‌তে নে‌মে আমায় ভা‌লোবাস‌বে। জোৎস্না রা‌তে সেই দিঘীর পা‌শে ব‌সে দুজন চন্দ্র‌বিলাশ কর‌বো। আমি কবিতা বল‌বো আর তু‌মি সেই ক‌বিতায় সুর দি‌য়ে আমায় গানশুনা‌বে ব‌লে‌ছি‌লে। 
আচ্ছা সে‌দিন দুষ্ট‌মি ক‌রে বল‌ছি‌লে, আমায় নেশা ক‌রি‌য়ে আমার ম‌নের সব স‌ত্যি বের কর‌বে। আরো কতকত প্ল্যান ক‌রে‌ছি। সব প্ল্যা‌নে যে তুমি দুজন ছিলাম। ত‌বে কেন আজ তু‌মি নিশ্চুপ আর আমি কথা বল‌ছি। 

‌আমি কথা কম বলতাম দে‌খে আমার প্র‌তি তোমার কত অভি‌যোগ ছি‌লো। সে‌দিন হুট ক‌রে কথা কম বলার কার‌নে ঠোঁ‌টে কুট ক‌রে কামর ব‌সি‌য়ে দি‌লে। ত‌বে আজ তু‌মি চুপ কেন তনয়া? আমি এত কথা বল‌ছি তোমার কি একটা কথাও বল‌তে মন চ‌ায়না?

তামিম পা‌সে দরজায় দা‌ড়ি‌য়ে আয়া‌তের কথা শুন‌ছে আর চোখ মুছ‌ছে। 

আর আয়াত ভাব‌ছে সে‌দিন, বা‌ড়ি বদলানোর সময়ের কথা।

—————

       সে‌দিন বেলা এগা‌রোটার দি‌কে আয়াত তনয়ার কা‌ছে যায়। গি‌য়ে দে‌খে তানভী আর তনয়া জি‌নিসপত্র প্যা‌কিং কর‌ছে। আয়াত‌কে দে‌খে তনয়া বলল,
__স্যা‌রের আসার সময় হ‌লো বু‌ঝি? স্যার তো আটটার ভিতর চ‌লে আসার কথা ছি‌লো। ব‌লি আমা‌দের শহ‌রে  তো এত ট্রা‌ফিক নেই যে, তাহ‌লে আপ‌নার এত লেট হ‌লো যে?

__আরে রাগ ক‌রোনা, আস‌লে মেঘা‌কে নি‌য়ে ডাক্তা‌রের কা‌ছে গে‌ছিলাম।

তনয়া কিছু জি‌জ্ঞেস কর‌তে যা‌বে এর ম‌ধ্যেই তানভী জি‌জ্ঞেস কর‌লো,
__‌কেন কী হ‌য়ে‌ছে মেঘার? ঠিক আছে তো সে?

__আর ব‌লোনা, কাল রাত থে‌কে জ্বর বাঁ‌ধি‌য়ে বস‌ছে। সকাল থে‌কে হাঁ‌চি হাঁ‌চি দি‌তে দিতে পু‌রো ঘর মাথায় তু‌লে ফেল‌ছি‌লো। তাই ডাক্তার দে‌খি‌য়ে বা‌ড়ি দি‌য়ে দিয়ে এলাম।

__তনয়া বলল, এখন কী অবস্থা? এখা‌নে নি‌য়ে আস‌তেন, আমা‌দের সা‌থে থাক‌লে মন ভা‌লো হ‌য়ে যে‌তো। 

__আ‌রে চিন্ত‌া করো না, স‌র্দি জ্বর শুধু, ডাক্তার ঔষধ দি‌ছে। দু এক‌দি‌নে সে‌রে যা‌বে।

__আ‌মি কী একব‌ার দেখ‌তে যা‌বো মেঘা‌কে?

__বাহ্ ম্যাডা‌মের দেখ‌ছি নন‌দের প্র‌তি খুব টান। তা ক‌বে যা‌বেন হবু শ্বশুর বা‌ড়ি?

__‌যে‌দিন অাপ‌নি নি‌য়ে যাবেন!

__ও‌কে তাহ‌লে কাল নি‌য়ে যা‌বো। 

তানভী মাঝখা‌নে ওদের থা‌মি‌য়ে বলল,
__টাইম প্লিজ! আপনারা ভু‌লে যাচ্ছেন আমিও এখা‌নে আছি। বাই দ্যা ওয়ে, আমার বে‌ান যখন তার হবু শ্বশুরবা‌ড়ি যা‌বে তখন আমিও যা‌বো, নয়‌তো বোন আর বো‌নের স্বামীর পাপ হ‌বে। আমারও বো‌নের শ্বশুরবা‌ড়ি দেখার অধিকার আছে।

__ও‌কে শালা, আর সমন্ধি বাবু।

‌যে‌হেতু তনয়া তানভী জমজ তাই আয়াত তানভী‌কে দুষ্ট‌মি করে শা‌লা সম‌ন্ধি দু‌টোই ডা‌কে।
তনয়া তানভীর কা‌নে কা‌ছে মুখ নি‌য়ে চু‌পি চু‌পি বল‌ল,
__আমার শ্বশুরবা‌ড়ি দেখ‌তে যা‌বি? না‌কি মেঘা‌কে দেখ‌তে যা‌বি?

__দু‌টোই। ত‌বে এখন চুপ থাক। মেঘার ভাই এ বিষ‌য়ে কিছু জানেনা।

__‌ঠিক আছে। (মৃদু হে‌সে)

__আয়াত কাঁশি দি‌য়ে বলল, দু ভাই বোন মি‌লে কি ফুসুর ফুসুর কি কর‌ছে‌া?

__‌কিছু না ভাইয়া।

তারপর তিনজন মিলে সব কিছু প্যা‌কিং ক‌রে দুপু‌রের পর ট্রা‌কে তু‌লে দি‌লো। তানভী, ট্রাকওয়ালার সা‌থে আগে গি‌য়ে জি‌নিসপত্র নামা‌বে আর আয়াত তনয়া টু‌কিটা‌কি জি‌নিস নি‌য়ে গা‌ড়ি‌তে আস‌বে। তনয়া দিলরুব‌া আন্টির কা‌ছে ঘ‌রের চা‌বি দি‌য়ে ফেরার সময় দীপু তনয়ার দি‌কে হাত বা‌ড়ি‌য়ে বলল ভা‌লো থাক‌বেন। তনয়া আয়া‌তের দি‌কে তাকা‌লো। আয়াত নি‌জের হাতটা বা‌ড়ি‌য়ে দীপুর সাথে হাত মি‌লি‌য়ে বলল, আপ‌নিও ভা‌লো থাক‌বেন। দিলরুবা আন্টি তনয়ার আসা‌তে বেশ আফসুস কর‌লো। ক‌দি‌নে তনয়ার সাথে তার বেশ আন্ত‌রিকতা জমে উঠ‌ছি‌লো। তনয়ারও খুব খারাপ লাগ‌ছি‌লো কারন এই কমা‌সেই বা‌ড়িটার প্র‌তি একট‌া আলাদ‌া মায়া জ‌মে গে‌ছি‌লো। কিন্তু আয়াত যখন কিছু ক‌রে‌ছে তখন সেটা ভা‌লো ভে‌বেই ক‌রে‌ছে বিষয়টা তনয়া বেশ ভা‌লো ক‌রে জানে। 

তনয়া নতুন ফ্ল্যা‌টে গি‌য়ে হা হ‌য়ে গে‌লো। বিশাল বড় ফ্ল্যাট। তনয়া ভাব‌ছে এত বড় ফ্ল্যা‌টের তো অনেক টাকা ভাড়া, ওর বেতন তো ভাড়া দি‌তে দি‌তেই যা‌বে। নি‌জের খাওয়া, পড়ার খরচ কি ক‌রে চালা‌বে! তনয়ার মাথায় চিন্তার ছাপ দে‌খে আয়াত‌ জি‌জ্ঞেস কর‌লে‌া,

__কী ভাব‌ছো?

__আয়াত এত বড় ফ্ল্যা‌টের ভাড়া তো‌ অনেক। আমি কিভা‌বে দি‌বো?

__আ‌মি ছয়মা‌সের ভাড়া পে ক‌রে দি‌য়ে‌ছি।

__‌হোয়াট? আয়াত দিস ইজ টু মাচ। আমি এসব পছন্দ ক‌রিনা।

__‌কেন আমি বু‌ঝি তোমা‌কে হেল্প কর‌তে পা‌রিনা?

__পারেন বাট এমন না। আমার এগু‌লো একদম ভা‌লো লা‌গেনা। কতটাকা লাগ‌ছে সেট‌া বলেন, আমি ধী‌রে ধী‌রে শোধ ক‌রে দি‌বো।

__আচ্ছ‌া আচ্ছা প্র‌তি মা‌সে অল্প অল্প ক‌রে দি‌য়ো। এখন রাগ করা বন্ধ ক‌রো।

তনয়া যে, রাগ কর‌বে সেটা আয়াত আগেই জান‌তো। তাই মিথ্যা বল‌ছে, ফ্ল্যাট ভাড়া নি‌ছে আস‌লে ফ্ল্যাটটা আয়াত তনয়ার না‌মে কি‌নে‌ছে। কিন্তু তনয়া এটা শুন‌লে তুলকালাম বাঁ‌ধি‌য়ে ফেল‌বে। কারন তনয়ার আত্মসম্মানবোধ প্রচুর। তাই আয়াত মিথ্যা বল‌লো।

আয়াত তনয়া, তানভী মি‌লে রা‌তের ম‌ধ্যে পু‌রো ঘর সা‌জি‌য়ে ফেল‌লো। রা‌তের খাবার খে‌য়ে তানভী আর আয়াত চ‌লে গে‌লো। ওরা দুজন যে‌তেই তনয়া‌কে একা‌কিত্ব পু‌রো ঘি‌রে ধর‌লো। একটা চাপা কষ্ট অনুভব হ‌চ্ছে। ভিষন ভয়ও ক‌রছে। এত বড় ঘ‌রে একা। তনয়া ভাব‌ছে য‌দি ভূত আসে ত‌বে তনয়া কী কর‌বে?

‌তনয়া এসব ভাব‌ছে আর আনম‌নে টুকটাক কাজ কর‌ছে। বেশ কিছুক্ষন পর কেউ দরজায় নক কর‌লো। তনয়ার ভিষন ভয় করছি‌লো, এত রা‌তে কে আস‌তে পা‌রে ভে‌বে। তাই টে‌বি‌লের ফল কাটা ছু‌ড়িটা হা‌তে নি‌য়ে দরজার ছিদ্র দি‌য়ে দেখ‌লো বাইরে কে? দে‌খে আয়াত প‌কে‌টে হাত দি‌য়ে দা‌ড়ি‌য়ে আছে। আয়াত‌কে দে‌খে তনয়া যে‌নো প্রাণ ফি‌রে পে‌লো। কিন্তু ভাব‌ছে এত রা‌তে আয়াত আবার কেন আস‌লো? ঘন্টা দু আগেই তো গে‌ছি‌লো। তনয়া ম‌নে ম‌নে ভাব‌ছে আয়া‌তের রূপ ধ‌রে কোন ভূত আসলো না‌তো। এ কথাটা ভাব‌তেই তনয়ার গা‌য়ে কাঁটা দি‌য়ে উঠ‌লো। ক‌য়েকব‌ার আয়াতুল কুর‌সী প‌রে বু‌কে ফুঁ দি‌লো। দরজা খুল‌বে কি খুল‌বে না সেটা নি‌য়ে দ্বিধায় আছে। দরজার ফু‌টোয় চোখ রে‌খে আয়াত‌কে ফোন দি‌লো, দেখ‌লো আয়াত ফোনটা রি‌সিভ কর‌ছে। আর বলল,
__‌কি হলো দরজা কেন খুল‌ছো না?

__হ্যাঁ খুল‌ছি। 

দরজা খু‌লে ভিতরে ঢুক‌তেই তনয়া আয়াত‌কে বলল,
__এত রা‌তে আবার এলেন যে?

__আয়াত তনয়ার গা‌লে হাত দি‌য়ে বলল, ভয় পে‌য়ে‌ছি‌লে?

__তনয়া ভাব দে‌খি‌য়ে বলল, ভয় আর আমি হুহ। আমি ব্রেভ গার্ল।

__গুড। তা ব্রেভ গার্ল হা‌তে চাকু নি‌য়েছেন কেন আমা‌কে মারার জন্য? ম্যাডাম আমা‌কে মারার জন্য চাকু না আপনার ভা‌লোবাসাই য‌থেষ্ট। তনয়া কি বল‌বে ভে‌বে পা‌চ্ছেনা। তাই বলল, 
__টে‌বি‌লে ফল কাট‌তে নি‌ছিলাম তাই হা‌তে ক‌রেই দরজা খুলতে আসলাম। 

__ওহ। (মুখ টি‌পে হে‌সে)
যাও রু‌মে গি‌য়ে শু‌য়ে প‌রো। আমি ঐ রু‌মে ঘুমোচ্ছি।

__মা‌নে? আপ‌নি রাতে এখা‌নে থাক‌বেন?

__হ্যাঁ কোন আপ‌ত্তি আছে? 

__না মা‌নে? 

__‌দে‌খো আমি জা‌নি, রা‌তে তোমার এত বড় ব‌াসায় ভয় লাগ‌বে। তাই চ‌লে আস‌ছি। ভয় না লাগ‌লে ব‌লো চ‌লে যা‌চ্ছি। 
তনয়া আয়াতের হাত ধ‌রে বলল, 
__নাহ্ প্লিজ যা‌বেননা। স‌ত্যি ভয় কর‌ছে।

__অ‌ট্টো হা‌সি দিয়ে জানতাম। বা‌ড়ি গে‌ছিলাম কারন মেঘা‌র খবর জান‌তে। মেঘা যেমন আমার দা‌য়িত্ব  তুমিও তেমন। আর আমি সে দায়িত্ব ভা‌লো‌বে‌সে পূরণ কর‌তে চাই।

আয়া‌তের এমন কথা শুন‌লে তনয়ার ম‌নে চায়, নি‌জের সব‌কিছু র্নিভ‌য়ে আয়া‌তের হা‌তে তু‌লে দি‌তে। আয়া‌তের ভা‌লোবাসায় প্র‌তি মুহূ‌র্তে নি‌জে‌কে রাঙা‌তে ম‌নে চায়। কিন্তু এখনও দুজনার মা‌ঝে বি‌য়ে নামক সু‌তো‌তে বাঁধা পরা বা‌কি অাছে। তনয়া অপলক চো‌খে আয়া‌তের দিকে তা‌কিয়ে আছে। আয়াত তনয়ার চু‌লে বি‌লি কে‌টে বলল,
__চুল বেঁ‌ধে দি‌বো? আজ ইউটিউ‌বে চুল ব‌াঁধা শি‌খে‌ছি। হা হা হা

তনয়া কোন কথা না ব‌লে আয়াত‌কে জ‌ড়িয়ে ধ‌রে আয়া‌তের বু‌কের বাম পাশটায় চু‌মো খে‌য়ে বলল,
__এখানটায় কী শুধু আমার বসবাস আয়াত?

__না আমার তনয়াটার বসবাস। 

৩১!!

        আয়া‌তের কাঁধে কেউ হাত রাখ‌লো। আয়াত পিছ‌নে ফি‌রে তা‌কি‌য়ে দেখে পু‌লিশ অফিসার না‌হিদ দা‌ড়ি‌য়ে আছে। তি‌নি ইশারায় আয়াত‌কে বাই‌রে আস‌তে বলল। আয়াত তনয়ার হাতটা ছে‌ড়ে, তনয়ার মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে না‌হিদের সা‌থে বাই‌রে গে‌লো।
না‌হিদ বলল,
__‌মিঃ আয়াত আমা‌দের তদ‌ন্তের ভি‌ত্তি‌তে তনয়া‌কে খুন কর‌তে চাওয়ার দায়টা‌ কিন্তু এখনও আপনার ঘা‌রেই। তার য‌থেষ্ট প্রমানও আছে। 
‌যেমন, মি‌সেস তনয়ার সা‌থে আপনার বি‌য়েটা কোন আইনি ম‌তে হয়‌নি। মা‌নে রে‌জি‌ট্রেশন হয়‌নি। মস‌জি‌দের হুযু‌রের মাধ্য‌মে হ‌য়ে‌ছি‌লো। সকা‌লে বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছি‌লো, বি‌য়ে হবার আধাঘন্টা পর মা‌নে দুপু‌রে তনয়া কোন এক কা‌জে বান্ধবীর বাসায় যায়। আর ঠিক ছয় দিন পর আপনা‌দের দেখা হয়। এবং তনয়া সব সম্পর্ক ছিন্ন ক‌রে দি‌য়ে আপনার কাছ থে‌কে মু‌ক্তি চায়‌ছি‌লো। এর কারন কী? কোথাও রা‌গের ব‌সে আপ‌নিই মিসেস তনয়া‌কে----------?

আয়াত একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছে‌ড়ে বলল, চলুন পু‌রোটা বল‌ছি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন