আড়ালে আবডালে - পর্ব ৪৫ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


ফোনের লক খুলে দিয়েছে উপমা। খুলতে বাধ্য হয়েছে। যেই মেয়ে অন্য মেয়েকে কিডন্যাপ করাতে পারে সেই মেয়ে ঐ ছোট বাচ্চা দুটোর ক্ষতিও করতে পারবে অনায়াসে।

সামনের চেয়ারে বসে খুবই উত্তেজিত হয়ে কন্টাক্ট লিস্ট চেক করছে সামিয়া। সেখানে নিহির কোনো নাম্বার নেই। মানে নিহি নাম দিয়ে কোনো নাম্বার সেভ করা নেই। কল লিস্ট চেক করেও কোনো নাম্বার পাওয়া যায়নি। বিরক্তের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে দাঁত কটমট করে জিজ্ঞেস করে,
"নিহির নাম্বার কোথায়?"

উপমা সরল কণ্ঠে বলে,
"আমি জানি না। ওর সঙ্গে অনেক আগে থেকেই আমার কোনো যোগাযোগ নেই।"
"মিথ্যা বলবে না একদম আমার সঙ্গে।"
"মিথ্যা কেন বলব আমি? নিজেই তো ফোন চেক করলেন।"
স্বল্পক্ষণ চুপ থেকে সামিয়া হাসলো। তারপর পাশের ছেলেটিকে বলল,
"যতগুলো নাম্বার ফোনে আছে সবগুলোতে ফোন দিয়ে দেখো। অন্য কোনো নামে ওর নাম্বার সেভ করা থাকতে পারে। কাল সকালের মধ্যে নিহির নাম্বার চাই আমার।"
"জি, আচ্ছা।"

সামিয়া চলে যাওয়ার পর ছেলেটি চেয়ারে বসলো। আলস্য নিয়ে ফোন চেক করতে করতে উপমার দিকে তাকালো। তারপর ফোনের টর্চ অন করে উপমার মুখের ওপর তাক করতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে উপমা। চেঁচিয়ে বলে,
"কী সমস্যা? আমায় ছেড়ে দিন।"
ছেলেটি আহতস্বরে বলল,
"ফোনে যখন নাম্বার নেই তখন লকটা খুলে দিলে কী হতো? এই থাপ্পড়টা তো আর খেতে হতো না!"
"মায়া দেখাচ্ছেন?"
"মায়া হচ্ছে।"
ছেলেটি উপমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল,
"ভোরের আলো ফোঁটার আগেই পালিয়ে যাও।"
"হোয়াট? কী বললেন? পালিয়ে যেতে?" চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল উপমা।
বাঁধন খোলা হলে ছেলেটি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
"এখান থেকে বের হয়ে সোজা দৌঁড়াবে। বাগানের শেষ মাথায় দেখবে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কিছু না ভেবেই সেই গাড়িতে উঠে পড়বে। সে তোমায় তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে।"

সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে উপমার কাছে। কিডন্যাপ করে এনে এখন বলছে পালিয়ে যেতে! কী অদ্ভুত! লোকটার মাথায় কি কোনো সমস্যা আছে? উপমা তখনো ঠায় বসে আছে। এবার ছেলেটি মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
"কী হলো? বসেই থাকবে? নাকি পালাবে?"
"আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?"
"মজা করার মতো সময় এখন না। তুমি যাও।"

উপমা কী করবে না করবে ভেবে পেলো না ঠিকই৷ তবে মনস্থির করে নিলো সে পালাবে। ছেলেটি তখন বলল,
"যাওয়ার আগে তোমাকে যেভাবে বেঁধে রাখা হয়েছিল আমাকেও সেভাবেই বেঁধে রাখো।"
"কিন্তু কেন?"
"প্রশ্ন করবে না। বাঁধো।"

ছেলেটি চেয়ারে বসে পড়ল। উপমাও আর কিছু না ভেবে ওকে বেঁধে পালালো। বাহিরে ঘন জঙ্গল। তবে চাঁদের আলোয় সবটা পরিষ্কার। বাগানটা দেখে মনে হচ্ছে কেমন যেন ভূতুরে ভাব। শরীর শিউড়ে উঠে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এরপর প্রাণপণে ছুটে চলে সামনের দিকে। তবুও বাগান শেষ হয় না। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে দূর থেকে একটা গাড়ি দেখতে পায়। পা ব্যথা হয়ে গেছে। তবুও উপমা দৌঁড়ায়। গাড়ির সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁপায়। তারপর দরজা খুলে পিছনে বসে পড়ে। সামনে যিনি বসে আছে তিনি কোনো কথা না বলে গাড়ি চালানো শুরু করে।


খাঁ খাঁ দুপুরের তপ্ত রোদ মাথার ওপর। ভ্যাপসা গরমও পড়েছে। অস্থির অস্থির লাগছিল খুব। পাশাপাশি সিটে বসে আছে আমান এবং নিহি। গাড়ি ড্রাইভ করছিল নিরব। নিহির কান্নার বাঁধ মানছে না। হাউমাউ করে কান্না করছে বাচ্চাদের মতোন। আমানের নিজের চোখেও পানি। নিহিকে সামলানোর মতো শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে।

সকাল দশটার দিকে নীলমের ফোন এসেছিল। নিজাম ইসলাম এক্সিডেন্ট করেছেন। হাসপাতালে ভর্তি এখন। অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল। খবরটা শোনার পর থেকেই নিহির কান্না শুরু হয়েছে। কোনোভাবেই ওর কান্না থামানো যাচ্ছে না। তখনই ওরা রওনা দিয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। শিশির তরুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। নিহি এখনো বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। আমান ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
"শান্ত হও নিহু।"
কান্নার গতি বাড়ে আরও। হেঁচকি উঠে যায়। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
"আব্বুর কিছু হবে না তো? ভাইয়া কী বলেছে বলেন?"
আমান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল,
"তেমন কিছু হয়নি৷ তুমি শান্ত হও।"

মনে মনে ব্যথিত হলো আমান। নিহিকে মিথ্যে বলতে হলো। অবস্থা অনেক গুরুতর নিজাম ইসলামের। কিন্তু নিহিকে সেটা বলা যাবে না। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার।
_____________

জানালা দিয়ে রোদ ঘরে প্রবেশ করছে। জানালার পাশাপাশি বিছানা হওয়ায় রোদ বিছানাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে কিছুটা গরম অনুভব হয় বিছানায় বসলে। অনল বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছে। ইদানীং ওর নতুন সঙ্গী হচ্ছে সিগারেট। আগে সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য না হলেও এখন এটা খুব প্রিয়। বলা যায় ভালো থাকার টনিক। আগের অনলের মাঝে আর এখনকার অনলের মাঝে বিস্তর তফাৎ। কলেজেও যায় না। কারো সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাও বলে না।

'আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি॥
আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি॥
তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়–
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়।
গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দু: খসুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গান তো গাই নি॥'

ফোনে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছিল আর সিগারেট ফুঁকছিল। তখন দরজায় জোরে জোরে করাঘাতের শব্দ হয়। বিরক্ত হয় অনল। বারান্দা থেকে ঘরে যেতেই শুনতে পায় মিলন আর সাকিবের গলার স্বর। দরজা খুলে দিতেই মিলন স্থিরতা হারিয়ে বলে,
"দোস্ত তাড়াতাড়ি চল।"
চরম বিরক্ত হয়ে অনল জিজ্ঞেস করে,
"কোথায় যাব?"
"সুমাইয়ার বাসায়।"
"আমি এখন কোথাও যাব না। ভালো লাগছে না আমার। তোরা এখন যা।"
"দোস্ত সুমাইয়ার বোন সামিয়া মারা গেছে।"

এবার একটু সিরিয়াস হয় অনল। কপালে ভাঁজ টেনে বলে,
"সামিয়া না লন্ডনে পড়ত? দেশে ফিরেছে কবে?"
"অনেক আগেই। যখন নিহিকে নিয়ে তোদের ঝামেলা চলল। তখনই ফিরেছে।"
"কিন্তু মারা গেল কীভাবে?"
"কার এক্সিডেন্ট।"
"শীট!"
"দোস্ত চল যাই। বিপদে-আপদে সুমাইয়া সবসময় আমাদের পাশে থেকেছে। ওর খারাপ সময়ে এখন আমাদেরও ওর পাশে থাকা উচিত।"
"বস একটু। আমি ফ্রেশ হয়ে নিই।"

অনামিকা রহমান বাড়িতেই ছিলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে তিনি বললেন,
"আরে দাঁড়িয়ে কেন তোমরা? বসো।"
ওরা সালাম দিয়ে বলল,
"না ম্যাম। বসব না। সুমাইয়ার বোন যে এক্সিডেন্টে মারা গেছে শুনেছেন ম্যাম?"
"কী বলো?" অবাক হলেন তিনি৷ আবার বললেন,
"কবে হলো এক্সিডেন্ট?"
"আজই।"
"তোমরা কি ওর বাসাতেই যাচ্ছো?"
"জি ম্যাম।"
"আচ্ছা আমিও যাব।"


বাড়ির সামনে মানুষজন গিজগিজ করছে। সকল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশীরা ছুটে এসেছেন। সবাই আহারে আহারে করছেন। বাড়ির ভেতর ঢোকা মুশকিল প্রায়। ঢেলেঢুলে ভেতরে ঢুকে দেখে সুমাইয়া আর ওর বাবা-মা আহাজারি করে কান্না করছেন। সামিয়ার লাশটি সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। এক্সিডেন্টে পুরো শরীর থেঁতলে গেছে। পুলিশ এসেছিল। পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সামিয়ার পরিবার রাজি হয়নি। শরীরের যেটুকু অংশ বাকি আছে সেটুকু অংশ কাটাকাটি করতে চান না তারা। সুমাইয়ার পাশে বসে আছে লিসা। শান্তনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।

অনল, মিলন আর সাকিবও গিয়ে পাশে বসল। ওদেরকে পেয়ে সুমাইয়া আরো হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। কান্নার জন্য কথাই বোঝা যাচ্ছে না। আর্তনাদ করে বলে,
"কেন এমন হলো বল তো? কেন ওকে এভাবে আমাদের ছেড়ে যেতে হলো!"
কেউই পারছে না শান্তনা দিতে। এই সময়ে কি কারো কোনো শান্তনা কাজে লাগে?


দুপুর গড়িয়ে গেলে নিহি আর আমান বাড়িতে পৌঁছায়৷ এর মাঝে নীলম একবার ফোন করেছিল আমানকে। কী কথা হয়েছে তা নিহি জানে না। জিজ্ঞেস করলেও আমান এড়িয়ে গেছে। প্রথমে ওদের হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল। আমান যখন নিরবকে নিহির বাড়ির রাস্তা ধরতে বলল তখন নিহি জানতে চেয়েছিল কেন আমান হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়নি আমানের। সারা রাস্তা নিহি প্রশ্ন করে গেছে। এক পর্যায়ে আমান ধমক দিয়ে বলেছিল, "একটু শান্ত হয়ে বসো তো। পেইন দিও না। ভালো লাগছে না।"

নিহি চুপসে গিয়েছিল। ছলছল দৃষ্টিতে আমান নিহির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেছিল, "ক্ষমা করে দিও নিহু৷ তোমার সাথে এখন খারাপ ব্যবহার করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার। সত্যটা আমি বলতেও পারতাম না। তুমি সইতে পারবে না!"

বাড়ির মেইন দরজা খোলা। নিহি দৌঁড়ে ভেতরে যায়। আমান তার করা শপথ রাখতে পারেনি। নিহিকে একেবারে নিয়ে যাওয়ার আগেই এই বাড়ির ভেতরে আসতে হয়েছে। একটা কঠিন সত্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই শপথ অতি তুচ্ছ!

ড্রয়িংরুমে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় নিহি। সাদা কাপড়ে শরীর ঢাকা নিজাম ইসলামের। শুধু মুখটা বের করা। সাহেলা বেগম অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। কয়েকজন মহিলা তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছেন। তিতির তমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বলছে, 'মাম্মাম, দাদু উঠে না কেন? দাদুকে ডাকো? সবাই কাঁদছে কেন?' মিহি হাত-পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছে। সৈকত ওকে মানানোর চেষ্টা করছে। পাশের এক মহিলার কোলে মাহির। সেও কাঁদছে। এত মানুষ দেখে ভয়ে কাঁদছে নাকি মিহিকে কাঁদতে দেখে কাঁদছে তা বোঝা যাচ্ছে না।

নিহির মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভাসছে। অন্ধকার লাগছে সবকিছু। নীলম কাঁদতে কাঁদতে নিহির দিকে এগিয়ে এসে নিহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নিহি তখনও কিছু বুঝতে পারছে না। ওর মস্তিষ্ক কাজ করছে না। ঠোঁট কাঁপছে। ভাইকে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
"আব্বু! আব্বু এভাবে শুয়ে আছে কেন ভাইয়া?"

নীলম নিহিকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। শার্টের হাতায় চোখ মুছে। বুক ফেঁটে কান্না আসে নিহির। জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আমানও তখন ভেতরে চলে আসে। নিহিকে ধরতে গেলে ছিটকে সরিয়ে দিয়ে নিজাম ইসলামের পাশে বসে। তার বুকে মাথা রেখে বলে,
"ও আব্বু! আব্বু রে তুমি এভাবে কেন শুয়ে আছো আব্বু? কথা বলো আমার সাথে। তুমি এভাবে কেন চলে যাবে বলো?"

নীলম নিহির পাশে বসে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
"শান্ত হ বোন! শান্ত হ!"
চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিহি বলল,
"কীভাবে শান্ত হতে বলো? আমার আব্বু কেন কথা বলে না? আব্বুকে কথা বলতে বলো ভাইয়া প্লিজ!"
.
.
.
চলবে.............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন