৪১!!
আয়মন আর তানভির পার্কের একটা বেঞ্চে নিশ্চুপ বসে আছে। দুজনই শব্দহীন। কথাগুলো কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। এত বছর পর দেখা। কী বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছেনা।
আজ সকালে আয়মন এসেছে। বিকালে তনয়া তারভিরকে পার্কে নিয়ে গিয়ে আয়মনের সাথে দেখা করিয়ে দেয়। দেখা হবার পর থেকেই দুজন নীরব।
নীরবতা ভেঙে আয়মন বলল,
__কেমন আছো?
__যেমনটা তুমি রেখে গিয়েছিলে তার থেকে অনেক ভালো।
__ওহ। লাবিবাকে কেন মেনে নিচ্ছো না?
__একেবারে সরাসরি লাবিবার কথায় কেন গেলে?
__তুমি জানো আমি বরাবরই কাজের কথা আগে বলতে পছন্দ করি। তা বলো লাবিবাকে কেন এখনও মেনে নিচ্ছো না?
__কে বলছে মেনে নেয়নি? পাঁচ বছর ধরে সংসার কী তবে এমনি এমনি করছি।
__হ্যাঁ পাঁচ বছর ধরে মেয়েটাকে শুধু নিজের প্রয়োজন মেটানোর পুতুল হিসাবে ব্যবহার করছো। তুমি কী লাবিবাবে ভালোবাসো?
আয়মনের কথায় চমকে উঠলো তানভির। কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা!
আয়মন আবার বলতে শুরু করলো, কীল হলো বলো?
তানভির নিশ্চুপ।
__লাবিবা বলল, কখনো কী লাবিবাকে ঐ স্নিগ্ধ ভালোবাসার চোখে দেখছো, যে চোখে আমায় দেখতে? কখনো
কী ভালোবাসে তার চোখে মুগ্ধতার সন্ধান করেছো? বা তোমার চোখের মুগ্ধতায় তাকে মহীত করেছো? কখন রাতের বেলা নিজের প্রয়োজন মেটানো মেশিন না ভালোবাসার মানুষ ভেবে বুকে নিয়েছো? তার শাড়ির ভাজ খোলার আগে মনের দুয়ারটা খুলতে পেরেছো? তানভির চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।
আয়মন বলল, আমি জানি তুমি এমন কিছুই করোনি। নিজের পৌরষত্ব দেখিয়ে একটা মেয়েকে মা বানানো মানে ভালোবাসা নয়। নিজের হৃদয় দিয়ে তার হৃদয় স্পর্শ করাকে ভালোবাসা বলে।
তোমার তো একটা মেয়েও আছে, হয়ত সে মায়ায় লাবিবাকে ছাড়তে পারছো না। তুমি জানো তানভির লাবিবা তোমার আমার ভাবনার থেকে অনেক ভালো। আর তোমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসো। যদি তা না হতো তবে তুমি তাকে ভালোবাসো না জেনেও এতবছর যাবত তোমার সংসারে থেকে তোমার সকল চাহিদা পূরন করে পরে থাকতো না। লাবিবাতো দেখতে আমার থেকে অনেক সুন্দর, শিক্ষিতা, স্মার্ট আর বাবা যথেষ্ট স্বচ্ছল। যে মেয়ে সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ সে কেন তোমার কাছে বছরের পর বছর অবহেলা পেয়ে পরে আছে? চাইলে সে তোমার জীবন থেকে চলে গিয়ে নিজের মত করে সুন্দর ভাবে নিজের জীবন সাজাতে করে পারে। কেন যায়নি জানো? কারন সে তোমায় ভালোবাসে। পাগলের মত ভালোবাসে।
একটা কথা বলি তানভির লাবিরার শাড়ির খোলার আগে ওর বন্ধ হওয়া মনটা খোলার চেষ্টা করো। দেখবে ও তোমায় এত ভালোবাসবে যে, তুমি তোমার অতীত ভুলে যাবে।
তানভির অতীত সবার জীবনেই থাকে। আমার মতে দুঃখময় অতীতকে অতীতে রেখে বর্তমানের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই বোধয় শ্রেয়। যে অতীত জীবনকে বিষাদময় করে দেয় তাকে অতীতে ফেলে নতুন ভাবে চলাই কী উত্তম নয়? কী হলো কিছু বলো?
আয়মন এতগুলো কথা বলল, অথচ তানভির একটাও উত্তর দিতে পারলো না। কী উত্তর দিবে? আয়মন তো সব ঠিক কথা বলছে। আসলেই তো লাবিবার সাথে এত বছর শুধু অন্যায় করছে ও। যখন তখন নিজের প্রয়োজনে লাবিবাকে কাছে টেনেছে কখনো লাবিবার মতামত চয়নি। হাঠাৎ করেই নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে খুব তানভিরের। কারন এত বছর যাবত কেউ ওর চোখে আঙুল দিয়ে ওর ভুল গুলো ধরিয়ে দেয়নি। আজ আয়মনের উপর যে রাগ ছিলো তা যেনো নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো।
আয়মন বলল,
__তনভির আমি তোমার অতীত ছিলাম আর লাবিবা আর তৃপ্তি তোমার বর্তমান। ওরা দুটো পরী। প্লিজ তানভির আমাদের পিছনের অতীতের জন্য এই পরীদুটোকে কষ্ট দিওনা। আমি হাত জোড় করে আমার ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায়না তানভির। কিছু ভালোবাসার সম্পর্ক অপূর্ণতার মাধ্যমেও সুখী হয়।
আর সত্যি বলতে তুমিও কিন্তু আমাকে নয়, বরং লাবিবাকে ভালোবাসো। আমি তোমার জেদ মাত্র। জেদ করে আমাকে মনে চেপে ধরে আছো। যদি জেদটা ছেড়ে দিতে তবে কবেই লাবিবাকে নিয়ে সুখী হতে। যাই হোক আমি পিছনের সবটা ভুলে নতুন করে সামনে এগিয়েছি। তোমারও লাবিবা আর তৃপ্তিকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করা উচিৎ। জানি জোড় করে ভালোবাসা যায়না। কিন্তু মায়া বলতেও একটা কথা আছে, যে মায়া তোমাকে আর লাবিবাকে বেঁধে রেখেছে। আর এ মায়া থেকেই ভালোবাসার জন্ম হয়।
যাই হোক তোমার ভালোবাসহীন সংসারের কারন আমি ছিলাম। তাই তোমার ভুলটা ধরিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। আমাদের দুজনার স্মৃতিগুলোকে পাঁচ বছর আগে ফেলে রাখলেই বোধয় ভালো হয়। আমার মতে অতীতের প্রভাব বর্তমানে পড়তে না দেয়াই উত্তম। আমি আর কিছু বলবো না। চললাম ভালো থেকো। আর হ্যাঁ বাড়ি গিয়ে লাবিবার চোখে মুগ্ধতার সন্ধান করার চেষ্টা করো।
আয়মন আর এক মুহূর্তও ওখানে দাড়ালো না, একটা বার পিছনেও তাকালো না। চোখের জলটা বড্ড বেহায়া তাই ঝরে পড়ছে। এ জল তানভির কে দেখালে হয়ত ওর দুনিয়াটা আবার ওলোট পালট হয়ে যাবে। তানভিরের পৃথিবীতে থাকতে চায়না আয়মন। সবার জন্য সব স্থান না। সৃষ্টিকর্তা এ জন্যই বোধয় জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করছে কিন্তু আমরা মানুষই ভালোবাসা, আকর্ষন নামক মায়ায় আটকে একে অপরের সাথে জড়িয়ে পড়ি। আয়মন ব্যাগ এ টিস্যু খুঁজছে চোখ মুছবে কিন্তু পাচ্ছেনা। তখন সামনে থেকে একজন রুমাল এগিয়ে দিলো, সে হিমেল। হিমেল মুুচকি হেসে আয়মনকে বলল,
__কান্নাটা বড্ড অবাধ্য আমাদের কারো কথা শোনেনা।
আয়মন চোখ মুছে কান্না ভেজা গলায় বলল,
__হুমম।
__আয়মন শোনো!
__হ্যাঁ বলো!
__ভালোবাসি তোমায়।
আয়মন শুকনো হাসি দিলো। হিমেল আয়মনের হাত ধরে বলল,
__কবি একটা কবিতা শুনাবা?
__আয়মন মুচকি হেসে রবিঠাকুরের গীতাঞ্জলী কাব্য এর ***শেষের মধ্যে অশেষ আছে*** কবিতাটি বলা শুরু করলো,
শেষের মধ্যে অশেষ আছে,
এই কথাটি মনে
আজকে আমার গানের শেষে
জাগছে ক্ষণে ক্ষণে।
সুর গিয়েছে থেমে তবু
থামতে যেন চায় না কভু,
নীরবতায় বাজছে বীণা
বিনা প্রয়োজনে।
তারে যখন আঘাত লাগে,
বাজে যখন সুরে--
সবার চেয়ে বড়ো যে গান
সে রয় বহুদূরে।
সকল আলাপ গেলে থেমে
শান্ত বীণায় আসে নেমে,
সন্ধ্যা যেমন দিনের শেষে
বাজে গভীর স্বনে।
আয়াত আর তনয়ার সাথে দেখা করে আয়মন,হিমেল বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
তানভির এখনও পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। তনয়া আয়াতকে বলল,
__চলো না দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলি?
__নাহ তাকে একা থাকতে দাও। এখন তার নিজের সাথে সময় কাটানোটা বড্ড প্রয়োজন।
__তাহলে অামার কী করবো?
__পার্কেন ঝোপের মধ্যে বসে প্রেম করবো। (শয়তানি হাসি দিয়ে)
__ছি আয়াত কী খারাপ তুুমি। চলো আমি বাসায় যাবো এখানের পরিবেশ কেমন যেনো। সব জায়গায় কেমন ছেলেমেয়ে একসাথে বসে আছে।
__আয়াত উচ্চস্বরে হেসে বলল, চলো আমারও বসি।
__আয়াত মারবো কিন্তু।
__ওপস স্যরি। একটা জিনিস খেয়াল করছো এখানে যেসব ছেলে মেয়ে বসা সবাই টিনেজ। এসব বাচ্চারা পার্কে এসে নোংড়ামিতে মাতে। মনে চায় ভিডিও করে এদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দি। এখনও দুধের দাত পড়েনি অথচ দেখো প্রেম করছে। থাপরে দাত ফেলে দিতে হয়।
__তনয়া হেসে বলল, তুমি টিনেজ বয়সে কটা প্রেম করছো?
__দশটা। আর তুমি এগারো নাম্বার । বাসায় চলো। খালি উল্টা পাল্টা কথা। (রাগ করে)
__সিরিয়াসলি আয়াত বলোনা এর আগে কারো সাথে প্রেম হয়নি তোমার?
আয়াত তনয়ার হাত ধরে বলল,
__তনয়া তোমার কাছে তো আমি কিছু লুকইনি। হ্যাঁ ভার্সিটি লাইফে আমার একটা রিলেশন ছিলো রিয়ার সাথে। যেটা পনেরো দিনও টিকেনি। কারন আমার তখন প্রচন্ড রাগ ছিলো, আর তাছাড়া আমাকে শুধু তুমিই সামলাতে পারো বাকি সবাই কেন জানি আমার সাথে বেশিক্ষন থাকতে পারেনা। আমার কথায় কথায় মানুষের মুখে উচিৎ কথা বলার রোগ আছে। যেটার কারনে অনেক বন্ধু আর আত্মীয় স্বজনও আমার সাথে মিশতে চায়না।
আর রিয়ার সাথে রিলেশনে তো মাত্র পনেরো দিনের মাথায় মানে সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যয়ি। আর তার জন্য সব চেয়ে বড় কারন ছিলো, আমি মেয়েদের রুপ দেখে কখনোই পছন্দ করিনা, মানুষের ব্যক্তিত্ব্য পছন্দ করি। আর রিয়া সবসময় মানুষের রূপকে প্রধান্য দিতো যেটা আমার কাছে বিরক্ত লাগতো। ওর ভিতর ব্যক্তিত্বহীনতার অভাব ছিলো যেটা আমার কাছে চরম বিরক্তিকর ছিলো। তবে সত্যি বলছি ঐ পনেরো ওকে জড়িয়ে ধরাতো দূরের কথা হাত ধরতেও ভয় লাগতো। আর তাছাড়া তোমাকে নিয়ে যেটা অনুভব করি রিয়াকে সেটা কখনো করিনি। তুমি তো আমার জান। আর রিয়াকে তো আমার মনেই পড়েনা। আমি রিয়াকে কখনোই মন থেকে ভালোবাসতে পারিনি, যেটা ছিলো সেটাকে ভালো বন্ধুত্ব বলা চলে। কিন্তু কিন্তু তোমাকে তো আমার হৃদয় থেকেও বেশি ভা____ নাহ থাক।
__আজ তো বাক্যটা পুরো করোনা আয়াত প্লিজ।
__বললাম না বিশেষ মুহূর্তে করবো।
তনয়া আয়াতের বুকে কয়েকটা ঘুষি দিয়ে বলল,
__সবসময় খালি বিশেষ মুহূর্ত বলি সেটা কবে আসবে?
__যখন সময় হবে।
তনয়া ভেংচি কেটে অভিমান করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। আর আয়াত মুচকি হেসে পড়ন্ত বিকেলে তনয়ার অভিমানী স্নিগ্ধতা উপভোগ করছে।
—————
৪২!!
রাত এগারোটা পয়তাল্লিশ
তানভির কেবল বাসায় ফিরলো।
আজ লাবিবা আর তানভিরের পঞ্চমতম বিবাহ বার্ষিকী ছিলো। কিন্তু তানভির সেটা একদম ভুলে গেছে। বাসায় ফিরে দেখে লাবিবা ডায়নিং টেবিলে বসে বসে ঝিমুচ্ছে।
তানভির টেবিলের কাছে এসে কতক্ষন লাবিবার তন্দ্রাভাব মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পাঁচটা বছর এই মায়াবী মেয়েটার সাথে কাটিয়েও কখনো মেয়েটার চেহারার দিকে মুগ্ধতায় তাকায়নি ও। বুক চিরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলো তানভিরের।
লাবিবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই লাবিবা ধরপরিয়ে উঠে বলল, বসো খেতে দিচ্ছি। তানভির লাবিবার মাথায় হাত রেখে বলল, এত তারাহুরো করার কিছু নেই। চুপ করে বসো আমি ফ্রেস হয়ে আসছি বলে, তানভির রুমে চলে গেলো। লাবিবা যেনো আজ কোন নতুন এক তানভিরকে দেখছে। যার চোখে শুধু মুগ্ধতা নয় দেখছে অনেক ভালোবাসাও।
যাক অতদিক খেয়াল না দিলে লাবিবা খাবার সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
পনেরো মিনিট পর তানভির আসলো। টেবিলের উপর এত খাবারের সমারোহ দেখে তানভির জিজ্ঞেস করলো,
__আজ মেনুতে এত আইটেম? কেউ আসছিলো নাকি?
__তাহলে এত খাবার? আর সব দেখছি আমার পছন্দের।
__আজ আমাদের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকি ছিলো তানভির।
কথাটা শুনে লাবিবার দিকে তাকালো তানভির! লাবিবার চোখ টলমল করছে। কচুর পাতার উপর পানি যেমন নড়বড়ে হয়ে থাকে, সামান্য নাড়া লাগলেই টুপ করে পড়ে যায় ঠিক তেমন। প্রতি বছরই লাবিবা তানভিরের জন্য কিছুনা কিছু করে কিন্তু তানভির প্রতি বছরই ভুলে যায়। আজ তানভিরের নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। তানভির আস্তে করে বলল,
__শুভ বিবাহ বার্ষিকী।
__নয় মিনিট আগে শেষ হয়ে গেছে। কারন এখন বারোটা নয় বাজে।
তানভির লাবিবার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে বলল,
__খেয়েছো?
__লাবিবা নিশ্চুপ
__ওহ তুমি তো সবসময়ই আমার জন্য বসে থাকো। আচ্ছা বসো একসাথে খাই। থাক আমি তোমায় খাইয়ে দিচ্ছি।
তানভিরের কথায় আজ লাবিবা বিস্ময়ের সপ্ত আসমানে উঠে গেছে। তানভির লাবিবাকে খাইয়ে দিচ্ছে। লাবিবার খাবারটা আজ গলায় বারবার আটকে যাচ্ছে। হয় অতি খুশিতে নাহয় এত কছরের কষ্ট অবহেলাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে।
খাবার শেষে লাবিবা সব গুছিয়ে তৃপ্তির পাশে শুয়ে পড়লো। তানভির কি যেনো একটা বই পড়ছিলো। লাবিবা শুতেই তানভির লাবিবার কাছে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো। লাবিবা কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। তানভিরের চোখের দিকে তাকিয়ে আজব ঘোরে আটকে গেলো। তানভির লাবিবাকে নিয়ে সোজা ছাঁদে চলে গেলো। ফাগুনের শুরুর দিকের চাঁদটা তার পূর্ণ রূপে জোৎস্না দিচ্ছে। তানভির লাবিবাকে দাড় করিয়ে হাতটা ধরে বলল,
__তোমার কাছে মাফ চাইবার মুখ আমার নেই। কারন অন্যায়টাই এমন যেখানে ক্ষমা চাওয়াটাও অন্যায় হয়ে যাবে। তাই ক্ষমা চাইবো না। শুধু বলবো, লাবিবা আমার স্ত্রী নয় প্রেমিকা হবে? ভালোবাসবে আমায় প্রেমিকার মত? অামি এতদিন তোমার স্বামী হয়ে ছিলাম আজ থেকে প্রেমিক হতে চাই সুযোগ দিবে? এত বছর বিবাহ বার্ষিকীর দিনটাও মনে রাখিনি, আজ উইশ করলাম তাও দিন শেষ হবার নয় মিনিট লেটে। এত বছর তোমার সাথে যে অন্যায় করেছি, তার প্রাশ্চিত্য করার একটা সুযোগ দিবে?
তানভির হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে লাবিবার পা জড়িয়ে ধরলে লাবিবা দ্রুত তানভিরের মুখোমুখি বসে বলে,
__কী করছো কী? আমায় জাহান্নামে পাঠাবে নাকি?
__তানভির শুকনা হাসি দিয়ে বলল, তোমরা বাঙালী মেয়েরা সত্যি পারো বটে, স্বামী গুরুতর অন্যায় করতে পারবে অথচ সে ক্ষমা চাইলে তোমরা ভাবো তোমাদের পাপ হবে।
__তানভির এত বছর তোমার অবহেলা পেয়েও কেন পড়ে ছিলাম জানো?
__কেনো?
__কারন জানতাম একদিন তুমি তোমার ভালোবাসার দাবি নিয়ে আমার কাছে আসবে। পাঁচ বছর আল্লাহর কাছে কেঁদেছি ধৈর্য্য ধরেছি জানি ধৈর্য্যের ফল আল্লাহ দিবেন। যতটা কাঁদিয়েছেন তার তিনগুন বেশি সুখ দিবে। আমি জানতাম তোমার অতীতের কথা, তুমি তো লুকাওনি কিছুই আমার কাছে। তোমার পিছুটান ছিলো জানতাম আমি সেটা। সব জেনেই তো বিয়ে করেছি, ভালোবেসেছি তোমায়। তাই তোমার প্রতি কোন অভিযোগ নেই আমার। হ্যাঁ ভেবেছিলাম বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি তোমার পিছুটানেই পরে রইলে। সেটা হয়ত আমার ব্যার্থতা।
__তোমার ব্যর্থতা নয় লাবিবা। ব্যর্থতা আমার। আমি নিজেই ফিরতে চাইনি। আমি এখন ফিরতে চাই লাবিবা। আমাকে ফিরতে সাহায্য করবে! টেনে নিবে আমায় তোমার কাছে। ভালোবাসবে আমায়। আমার___
বাকিটা বলার আগেই লাবিবা তানভিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তানভির লাবিবার হাত ধরে চুমো খেয়ে বলল,
__উইল ইউ বি মাই গার্লফ্রেন্ড?
__হুমম তবে শর্ত আছে একটা!
__কী?
__তোমাকে সারাজীবন আসার প্রেমিক হয়ে থাকতে হবে। স্বামীগিরি করতে পারবে না কিন্তু।
__প্রমিজ করবো না। সবসময় বয়ফ্রেন্ড হয়ে থাকবো। তবে হ্যাজবেন্ড এর মত নিজের বৌকে আদর করতে পারবো? (দুষ্টমি করে)
__হুমম তবে আই নিড টাইম।
__ওকে! জাস্ট টেইক ইউর টাইম জান। লাবিবা শোন?
__হ্যাঁ
__আই লাভ ইউ।
লাবিবা কিছু বললো না, শুধু তানভিরকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে স্থান করে নিলো।
ফাগুনের শুরুতে নিস্তব্ধ চাঁদনী রাতে দুটো প্রাণ ভালোবাসার গভীর অতলে হারিয়ে যাচ্ছে।
৪৩!!
দেখতে দেখতে তনয়ার পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। আজ তনয়ার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। গতদুদিন যাবত অফিসে আসছে ঠিকভাবে। আয়াতও বেজায় খুশি।
দুজন বসে আছে নদীর ধারে।
শহর থেকে ঘন্টা খানিকের দূরে গ্রামের ভিতরের দিকে নদীর পাশে ঘুরতে আসছে। দুজন চুপচাপ পানির দিকে তাকিয়ে আছে। কিভাবে পানি গুলো ঢেউ তুলে আবার ভেঙে যাচ্ছে। জীবনটাও ঢেউএর মত ভাঙা গড়ার উপরে থাকে। মাঝ নদীতে দু একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে।
তনয়া আয়াত একজন মাঝিকে ডাক দিয়ে নৌকায় উঠে বসলো। নৌকায় উপরে ছই নেই। বাতাসটা প্রবলভাবে গায়ে লেগে হিমশীতল ভাবে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। তনয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে ঢেকে নিলো। তনয়া আয়াত দুজনেই স্থির ভাবে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে তনয়া বললো,
__আয়াত চলো এখন বিয়ে করে নি!
__কী? (চোখ বড় বড় করে)
__হ্যাঁ । আগামী এক ঘন্টার মধ্যে যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারো! দ্যান আই এ্যাম ইউর'স। যদি না পারো তবে আগামী এক বছরে বিয়ে করতে পারবে না।
__হোয়াট! তনয়া কী বলছো আসব? নৌকা থেকে নেমে শহরে যেতে কম হলেও এক ঘন্টা লাগবে। তারপর বাসার সবাইকে না জানিয়েও যদি রেজিট্রি করে বিয়ে করি তবে সব গোছাতে গোছাতে তিন চার ঘন্টা লাগবে? তবে বিয়ে কবে হবে?
__আমি অতকিছু জানিনা। বিয়ে করলে করো নয়ত একবছর দূরে থাকো।
আয়াত ভ্রু কুচকে তনয়ার দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভেবে মাঝিকে বলল,
__পাড়ে নামিয়ে দিতে।
মাঝি পাড়ে নামিয়ে দিতেই আয়াত তনয়াকে এক জায়গায় বসিয়ে কি যেনো করতে গেলো। বেশ খানিক পর তনয়ার কাছে এসে বললো এখনো ২৫ মিনিট বাকি চলো।
আয়াত তনয়াকে মসজিদের ইমামের বাসায় নিয়ে গেলো। স্থানীয় দু চার জন লোককে সাক্ষী রেখে সম্পূর্ণ ঘরোয়া পদ্ধতিতে ওদের বিয়ে হয়ে গেলো। আয়াত তনয়াকে কানে কানে বলল,
__বৌ রেজিট্রি পরে শহরে গিয়ে করে নিবো।
আয়াতের মুখ থেকে বৌ ডাক শুনে তনয়ার ভিতরে কাঁপন ধরে গেলো। ও তো আয়াতের সাথে দুষ্টমি করছিলো কিন্তু আয়াত বিষয়টাকে এভাবে সত্যি সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলবে তা কল্পনাও করতে পারেনি। তনয়া মনে মনে বলছে এবারের আসার দুষ্টমিটা বড্ড বেশি হয়ে গেছে। পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ার করাটা মোটেও উচিৎ হয়নি। ভিতর থেকে কেমন যেনো একটা অপরাধ বোধ হচ্ছে তনয়ার। চুপ বরে বসে রই। বেশ খানিক সময় পর আয়াত স্থানীয় সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে, বিরিয়ানি খাবার টাকা দিয়ে তনয়াকে নিয়ে চলে গেলো।
আজ তনয়ার দূরন্তপনা মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেলো। এর অদ্ভুদ লজ্জা শিহরন তনয়াকে ঘিরে ধরছে।
লোকায়ে থেকে একটু আড়াল হতেই আয়াত তনয়াকে কাছে টেনে কোমরে আলত চাপ দিয়ে বলল,
__কী ম্যাডাম নিজের পাতা জালে নিজেই ভেসে গেলা? অবশ্য ভালোই হয়েছে কতদিন যাবত বিয়ে করতে চাইছি তুমি রাজি হচ্ছিলে না। কিন্তু আজ থেকে তুমি পুরো বৈধভাবে আমার।
তনয়া কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। খালি বললো,
__এতসব এতদ্রুত কিভাবে হলো?
__বলবো তবে এখন না, রাতে যখন তুমি সম্পূর্ণ আমার হবে। (আয়াতের ঠোঁটে দুষ্টমি হাসি আর তীক্ষ্ণ চোখে তনয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।)
রাতের কথা শুনতেই লজ্জায় ভয়ে তনয়া কুকরে যেতে লাগলো। চোখ নিচু করে নিলো।
আয়াত তনয়াকে আরো কিছু বলতে যাবে এর মধ্যে রশ্মির ফোন করলো তনয়াকে। রশ্মির মা স্টোক করছে, হাসপাতালে ভর্তি। তনয়া আয়াতকে পুরোটা বললে দুজনেই শহরের পথে রওনা দিলো।
কিন্তু পথে আয়াতের ফোন আসে অফিসে কিছু অতি জরুরি কাজ পড়ে যায়। তাই তনয়াকে ট্যাক্সি করে উঠিয়ে দিয়ে আয়াত অফিস চলে গেলো।
৪৪!!
সাতদিন পর আয়াত তনয়ার দেখা পেলো। এতদিন চেষ্টা করেও তনয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি আয়াত। কেন জানি আয়াতকে ইগনোর করছে তনয়া। তবে আয়াত ভাবছে আজকের পর তনয়া তাকে আর ইগরোর করতে পারবে না। আজ তনয়াকে প্রপোজ করবে, নিজের বিয়ের রেজিট্রে করবে। তনয়াকে বরাবরের মত নিজের করে নিবে। তনয়া আসতেই আয়াত তনয়ার হাতটা ধরে বলল,
__তানু পাখি উইল ইউ বি মাই লাভলি ওয়াইফ ফরএভার?
__নো। আই হেট ইউ। কেন আয়াত কেন আমার বিশ্বাস ভেঙে দিলা? ভালোবাসতাম তো তোমায় পাগলের মত। নিজের সবটা দিতে চেয়েছিলাম। তবে তুমি কেন ঠকালে?
__কি যাতা বলছো?
__যা তা তাই তো? রিয়ার সাথে ফিজিক্যাললি ইনভলবট হয়ে তার পেটে বাচ্চা দেয়াকে বুঝি যাতা বলে?