নদী ভাঙন দৃশ্য চোখে পড়লেই দৃশ্যমান হয় নদীর স্রোত, ঢেউ এসে স্থলভাগ নদীগর্ভে টেনে নিয়ে যাওয়ার। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই পানি শুধু থৈ থৈ করে। কৃষকের কৃষিজমি, সকলের বাড়ি-ঘর সবকিছু নদীতে তলিয়ে যায়। যারা হারায় তারা নিঃস্ব হয়। তাদের কষ্ট হয়। কিন্তু এই নিয়তিকেই তাদের মেনে নিতে হয়। মেনে নেওয়ার পরও বুকের ভেতর হারানোর যেই হাহাকার সেই হাহাকার কি কেউ কখনো টের পায় নাকি পেয়েছে কখনো? অনলের বুকে আজ নদী ভাঙন নয় পুরো মনটাই ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। এই সত্যকে অস্বীকার করার মতো সাহসও তার নেই। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই শুধু শূন্যতা। কানে ভেসে আসছে মিহির বলা কথাটা। নিহি তাহলে নিজেরই ভাইয়ের বউ! আল্লাহ্ এত কঠিন শাস্তি কী করে দিতে পারে?
অস্থিরতায় পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। বন্ধ চোখের পাতা পিটপিট করছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মৃদু চিৎকার দিয়ে চোখ মেলে তাকায় অনল। বিছানার পাশে অনামিকা রহমান এবং আজমল আহমেদ। শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে সাকিব আর মিলন। অনলের চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে নিহিকে, আমানকে। ওরা কোথায়?অনল চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে এটা আমানেরই বাড়ি। অনামিকা রহমানের চোখে পানি। অনলকে তাকাতে দেখে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
"আব্বু, আব্বু কেমন লাগছে এখন তোমার?"
অনল কোনো উত্তর দিলো না। উঠে বসল। বিছানা থেকে নামার সময় বাঁধা দেন আজমল আহমেদ।
বিছানার ঠিক মধ্যখানে এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে নিহি। এরমাঝে যে এতকিছু ঘটে গেছে তা কিছুই জানে না সে। আমান নিহির পাশেই কপালে হাত রেখে বসে আছে। চোখ বন্ধ করতেই অনলের কথা মনে পড়ে।
নিহির দিকে কাঁপা কাঁপা হাত তুলে কী করুণস্বরেই না নিহির নামটা বলল! অনলের আর্তনাদ, চোখের পানি বুকের ভেতর যন্ত্রণার বীজ বপন করে দিয়েছে। আমান তার দিকে এগিয়ে যেতেই অনল ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। বিড়বিড় করে বলছিল,
"আমায় তুমি ধরবে না। তুমি আমার ভাই না। কী করে পারলে আমার ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিতে?"
'কী করে পারলে আমার ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিতে' এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল আমানের বুকে যন্ত্রণার তীর ছুঁড়ে দিতে। অনলের ভালোবাসা! মানে নিজের ছোট ভাইয়ের ভালোবাসা? আমান আর কিছু ভাবতে পারেনি। চোখের সামনেই মাথায় হাত চেপে ধরা ছোট ভাইয়ের শরীর ফ্লোরে গড়িয়ে পড়ে। সকল ভাবনা-চিন্তা বাদ দিয়ে ভাইকে ধরে তোলে আমান। আবুল আর আমান মিলে অনলকে অন্য ঘরে নিয়ে যায়। বাবা-মাকে ফোন করে আসতে বলে। ফোন রেখে নিজের এক সুট শার্ট-প্যান্ট নিয়ে অনলের জামা-কাপড় পাল্টে দেয়। মাথার কাছে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখের পানি উপচে পড়ে। কত আদরের ছোট ভাই! ছোট থেকে যার কোনো চাহিদা, কোনো চাওয়া-পাওয়া বাবা-মা অপূরণ রাখেনি। এমনকি আমান নিজেও না। বাবা-মায়ের থেকে আমানের কাছেই ছিল অনলের সবচেয়ে বেশি আবদার। মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। যেদিন অনল প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিল। তখন আমানের বয়স পাঁচ বছর। হাসপাতালের করিডোরে বাবার সঙ্গে অপেক্ষা করছিল ছোট ভাইয়ের জন্য। অনলের কান্নার শব্দ শুনে ছোট আমান বাবার পাঞ্জাবি খামচে ধরে বলেছিল,
"ও আব্বু আমার ভাই কাঁদে কেন? ওরা কি আমার ভাইকে মেরেছে?"
বাবা সেদিন হেসেছিলেন। আমান দেখেছে, বাবার চোখে অশ্রু ছিল। সেদিন হয়তো এই অশ্রুর মানে বোঝেনি। কিন্তু বড় হওয়ার পর বুঝেছিল। আনন্দের অশ্রু! বাবা আমানকে কোলে নিয়ে আদর করে বলেছিল, "না আব্বু! তোমার ভাই যে দুনিয়াতে এসে পড়েছে তারই জানান দিলো।"
আমানের খুশিরা তখন বাগানের ফুল ফোঁটার মতো সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। নার্স যখন অনলকে তোয়ালে দিয়ে প্যাঁচিয়ে বাবার কোলে দিয়েছিল তখন আমান চোখ ভরে দেখেছে ওকে। মুখে একটা আঙুল পুরে চুষছিল। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আমানের কাছে সেদিন এটাই ছিল। আমানের এখনো মনে আছে, অনলের ছোট হাতখানা ধরতেই অনল আমানের একটা আঙুল ধরে রেখেছিল। খুশিতে আমান কেঁদেই ফেলেছিল সেদিন।
"ভাইজান, আপামুনি কেমন জানি করতাছে।"
আবুলের ডাকে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে আমান। গালে হাত দিয়ে দেখে, অতীত ভাবতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে বাস্তবেও। আবুলকে অনলের পাশে বসিয়ে সে নিহির কাছে যায়। ঘরে গিয়ে দেখে নিহি ছটফট করছে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর বেড়েছে অনেক। টুকটুকি আমানকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নিহির পাশে বসে তার এক হাত নিজের হাতে নিয়ে মৃদুস্বরে ডাকে,
"নিহু! নিহু! ঠিক আছো তুমি?"
ছটফট করতে করতে এক সময়ে শান্ত হয়ে যায় নিহি। চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দেয় আমান। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
তখন ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় আজমল আহমেদ এবং অনামিকা রহমান। বিছানায় নিহিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যান। বাকশক্তি হারিয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য। অনামিকা রহমান কোনোরকমে বলেন,
"নিহি এখানে? অনল কোথায়?"
টুকটুকি এসে তাদেরকে অনলের ঘরে নিয়ে যায়। অনলের এমন অবস্থা দেখে অনামিকা রহমান কেঁদে ফেলেন। আজমল আহমেদ ব্যথিত হন। নিহি এখানে, অনলের এই অবস্থা! তিনি হিসেব মেলাতে পারছেন না। ড্রয়িংরুমে আমানকে ডেকে পাঠান। আমান টুকটুকিকে নিহির কাছে রেখে ড্রয়িংরুমে যায়।
ড্রয়িংরুমে গিয়ে বাবার মুখোমুখি দাঁড়ায় মাথা নত করে। আজমল আহমেদ জিজ্ঞেস করেন,
"এসবের মানে কী আমান? ঐ মেয়ে তোমার বাসায় কেন? তাও তোমার বিছানায়!"
"নিহি আমার ওয়াইফ!" আমানের সোজাসাপ্টা উত্তর।
আজমল আহমেদ ভড়কে যান। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন,
"তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?"
"মজা নয় আব্বু। সত্যিই বলছি।"
"কীভাবে সম্ভব আমান? ঐ মেয়েকে তো অনল ভালোবাসে!"
আমান এবার চোখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। তিনি সব খুলে বলেন আমানকে। সব শুনে আমান ব্যথিত ও অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। নিহি কেন আগে এসব বলেনি? আমান এবার সোফায় বসে পড়ে। ঝাপসা দৃষ্টিতে এদিক, সেদিক তাকাচ্ছে। চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অনামিকা রহমান। অনল নিহিকে ভালোবাসে? কেন জানায়নি তাকে! আমানের সঙ্গে নিহির বিয়ের কথা সবটা খুলে বলে আমান। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। আজমল আহমেদের অজানা কারণে রাগ হলো। তিনি প্রায় চেঁচিয়েই আমানকে বললেন,
"মানলাম ঐ মেয়ে তোমার বিয়ে করা বউ। তাই বলে তুমি কেমন মানুষ আমান? অনল তোমার ভাই হয়। নিজের ভাই! এরকম অসুস্থ ভাইকে রেখে তুমি ঐ মেয়ের পাশে গিয়ে বসে আছো?"
আমান অবাক হয়। বাবা ঠিক কোন কারণে রাগ দেখাচ্ছেন তা সে বুঝতে পারছে না। তবুও উত্তরে বলে,
"আব্বু নিহিও অসুস্থ!"
"অসুস্থ? অনলের চেয়েও নিশ্চয়ই বেশি নয়! ঐ মেয়ের পরিবার কোথায়? তারা কি সব জানেন?"
"জানে।"
"বাহ্! একটাবারও ছেলের পরিবারকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি?"
"আব্বু এটা উত্তেজিত হওয়ার সময় নয়। মাথা ঠান্ডা করো।"
"তুমি কীভাবে এসব বলছো আমান? মানে আমি বুঝতে পারছি না! তুমি আমার ছেলে আমান তো? নাকি বিয়ে করে চেঞ্জ হয়ে গেছ?"
আমান কিছু বলার আগে টুকটুকি ড্রয়িংরুমে আসে। নিহি আবারও ছটফট করছে জানায়। আমান বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
"পরে কথা বলছি।"
তারপর ছুটে চলে যায় রুমে। আজমল আহমেদ অবাক হয়ে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকেন। এত পরিবর্তন!
_________________
নিহির এক হাত আমানের হাতের মুঠোয় ছিল। কেউ একজন হেঁচকা টানে নিহির হাত সরিয়ে নেয়। তখনই আমান চোখ মেলে তাকায়। সামনে অনল দাঁড়িয়ে। ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমানের দিকে।
"নিহি তোমার হতে পারে না ভাইয়া! নিহি আমার।"
অনলের পেছনে পেছনে বাকি সবাই এসেছে। আমান কী করবে বুঝতে পারছে না। অনল নিহির দিকে হাত বাড়ায়। আমান তার হাত ধরে ফেলে। বলে,
"নিহু অসুস্থ!"
"আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। আর সেটা এখনই।" চেঁচিয়ে বলল অনল।
চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে নিহির ঘুম ভেঙে যায়। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। ঘরে এত মানুষকে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। অনল আবারও পাগলের মতো শুরু করে। নিহির হাত শক্ত করে ধরে বলে,
"নিহি সবাই বলে তুমি নাকি আমার ভাইয়ের বউ। ওরা মিথ্যা বলছে তাই না? এই নিহি তুমি কী করে পারো আমায় এত কষ্ট দিতে? তুমি তো এত নিষ্ঠুর নও নিহি। কিছু বলো প্লিজ! চুপ করে থেকো না।"
নিহির বুকের ভেতর উথালপাতাল ঢেউ বয়ে চলেছে। যেটা বাহির থেকে দেখা যাচ্ছে না। অনলের এমন পরিণতি নিহিকে কেন পোড়াচ্ছে? এখনো কি তবে ওর জন্য মনের কোথাও কোনো অনুভূতি আছে? নাকি করুণা! অনল উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমান তাকিয়ে আছে নিহির দিকে। নিহি অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব শান্ত কণ্ঠে বলে,
"আমার হাত ছাড়ুন। আমার হাত ধরার কোনো অধিকার নেই আপনার।"
অনল স্তব্ধ হয়। এক পলকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু হাত ছাড়ে না। নিহি আবার বলে,
"কেউ কোনো মিথ্যে বলেনি। ঠিকই শুনেছেন আপনি। আমি মিসেস আমান। আপনার ভাইয়ের বউ!"
নিহির হাতটা বিছানার ওপর পড়ে যায়। অনল বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছিয়ে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে পারফিউমের বোতল নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারে আয়নার মধ্যে। আয়না ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। চেয়ার-টেবিল সব ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আজমল আহমেদ, সাকিব, মিলন অনলকে থামানোর চেষ্টা করে। অনলের গায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। সবাইকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
"এটা কেমন করে হতে পারে? কেন হবে আমার সাথে এমন? তুই কেন আমার হবি না? আমি তোকে সহ্য করতে পারব না। অন্য কারো সঙ্গে আমি তোকে সহ্য করতে পারব না। তোর আল্লাহ্ কি তোর একার? সে কেন আমার ডাক শুনলো না? বল কেন?" নিহির দিকে তেড়ে যেতে যেতে বলল অনল।
ওকে জড়িয়ে ধরে আটকে রেখেছে মিলন আর সাকিব। অনল নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আর বলছে,
"আমি নিজেকে শেষ করে দেবো রে নিহি। তুই যদি আমার না হস! আর নয়তো তোর আল্লাহ্কে বল আমায় মৃত্যু দিতে। প্রকৃতি এত কঠিন প্রতিশোধ কেন নিবে বল? কেন নিবে? এর চাইতে প্রকৃতি আমায় মৃত্যু দিতে পারল না?"
নিহি কাঁদছে। চোখ থেকে বিরতিহীন পানি পড়ছে। অনল নিজের বুকের ওপর চাপড় দিতে দিতে বলে,
"তুই কি আমার কষ্টটা বুঝতে পারছিস নিহি? বুঝতে পারছিস আমার বুকের ভেতর দহন? বুকটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে রে। তোর সঙ্গে আজ যখন দেখা হয়, তখন আমি ধরেই নিয়েছিলাম আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল করেছে। তোকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভুল! তুই তো তখনকার কথা না,এখনকার কথা মিন করেছিলি। তুই চেয়েছিল, ভাইয়ের সঙ্গেই আমি তোকে দেখি। তুই বলেছিলি, পরের আঘাতটা বুকে করবি। এটাই সেই আঘাত ছিল নারে? তুই তো আমায় জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলি!"
অনলের কান্নার পরিমাণ বেড়ে যায়। অনামিকা রহমান মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে কাঁদছেন। আবুল, আর টুকটুকির চোখেও পানি। শান্ত হয়ে আসে অনল। শরীরটা ছেড়ে দিচ্ছে। সাকিবের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলে,
"আল্লাহ্! আল্লাহ্ গো, এত কষ্টই যখন দেবে তখন কেন মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিল? মন ভাঙার এত করুণ শাস্তি কেন গো আল্লাহ্!"
এবার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে অনল। ঢলে পড়ে নিচের দিকে। সাকিব আর মিলন সামলে নেয়। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের হয়। আজমল আহমেদ আমানকে বলেন,
"তুই হাসপাতালে আসিস না। তোকে দেখলে আবারও পাগলামি শুরু করবে।"
"আমি ওর সামনে যাব না। বাইরে থাকব।"
"তবুও আমি চাই না তুই আসিস!"
আমান দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। অনলকে নিয়ে ওরা হাসপাতালে চলে গেল। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে কে সবচেয়ে বেশি অসহায়? অনল, নিহি নাকি নিজে! আমান বাড়ির ভেতর যায়। নিহি সেখানেই বসে আছে। গালে চোখের পানি শুকিয়ে লেগে আছে। শান্ত হয়ে বসে আছে। নিহির সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
"আমায় আগে কেন বলোনি এসব?"
নিহি মাথা তুলে তাকায় না। বিছানার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রাখে। আমান আবার বলে,
"আমার দিকে তাকাও। আর উত্তর দাও।"
টলমল অশ্রুশিক্ত নয়নে নিহি আমানের চোখের দিকে তাকায়।উত্তরে বলে,
"আজকের দিনটা দেখার জন্য। আমি দেখতে চেয়েছিলাম অতীতটা নিজ থেকে জানার পর আপনি কী করেন! আমায় ছেড়ে যান নাকি রেখে দেন।"
আমানের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। রুদ্ধশ্বাস স্বরে বলে,
"নিজেকে অনেক নিরুপায় মনে হচ্ছে আমার নিহু। এত অসহায় কি শুধু আমিই? একদিকে আমার ছোট ভাইয়ের ভালোবাসা তুমি, আর অন্যদিকে আমার ভালোবাসা তুমি। অনলের ভালোবাসাকে আমি নিতে পারি না, অন্যদিকে তোমাকেও আমি ছাড়তে পারব না। প্রকৃতি কি শুধু কঠিন প্রতিশোধই নিলো? নাকি তিনটে জীবনকে আটকে দিল এক গোলকধাঁধায়! অনলের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না নিহু। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত। কী করব আমি! আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতেও পারব না। ভাইকেও কষ্ট দিতে পারব না।"
"কষ্ট যেকোনো একজনকে পেতেই হবে। হোক সেটা আমাকে বা অনলকে! আপনি আমায় ছেড়ে দিলে হয়তো আমার কষ্ট হবে ঠিক! তাই বলে ভাববেন না, আমি অনলের কাছে কখনো ফিরে যাব। আপনার পথ থেকে আমি সরে দাঁড়াবো।"
আমান এক পলকে নিহির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নিহির দু'হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। হাতের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে বলে,
"বিয়ের দ্বিতীয় দিন বলেছিলাম, 'আপনি থেকে যান। আমি রেখে দেবো।' আপনি আমায় ছেড়ে যাননি। থেকে গেছেন। আমিও আপনাকে ছাড়ব না। সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেবো।"
.
.
.
চলবে......................................