সবাইকে আরও বিস্মিত করে সে দীপাকে কঠিন গলায় বলল, "আর তোমার সাহস কি করে হয় ওর সাথে এমনভাবে কথা বলার? এখনই ওকে সরি বলবে তুমি।"
দীপা হতভম্ব। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় জোহানের দিকে, "তুমি এই মেয়ের জন্য আমার সাথে এভাবে কথা বলছ?"
"হ্যাঁ, বলছি। তুমি ভুল করলে আবার বলব। আমি হয়রান হয়ে গেছি তোমার এসব বাজে কথা সহ্য করতে করতে। আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে এতদিন এসব সহ্য করেছি। কিন্তু তুমি ওর সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না।"
দীপা এক ঝটকায় জোহানের হাত সরিয়ে নেয়। দাঁতে চেপে বলে , "হোয়াট দ্যা হেল। তুমি এই সামান্য এসিস্ট্যান্ট এর জন্য আমার উপর কথা বলেছ? ভালো করোনি তুমি জোহান। এই কান্ড নিয়ে তোমার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।"
দীপা রাগে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।
দীপা যাওয়ার পর জোহান ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, "ওর পক্ষ থেকে আমি সরি বলছি। ওর মেজাজ গরম থাকে। তাই কখন কি বলে নিজেও বুঝে না। তুমি কথাগুলো মনে নিও না।"
ইনারা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। গতকালের তার কথাগুলো মনে পড়ে। একদম কীভাবে সে পরিবর্তন হতে পারে?
হঠাৎ ঐশি এসে জোহানকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। সে হাসিমুখে বলে, "ভাইয়া তুমি এতদিন পর সঠিক কাজের পক্ষ নিলে। আমি অনেক খুশি। একদম ঠিক করেছ তুমি। দীপার ব্যবহার ইনারার প্রতি আজ অনেক বাজে ছিলো। আমি খুশি যে তুমি আগের মতো সঠিক এর পক্ষ নিচ্ছো।"
জোহানকে প্রথমে অবাক হয়। ঐশির এমন করে তাকে ধরে বলে। শেষ কবে তার বোন তার সাথে এমন সুন্দর করে কথা বলেছিলো মনে নেই। যখন সে ঐশিকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ঠিক ততটুকুর উওরই ঐশি দেয়। অথচ তারা ছোট থেকে সারাক্ষণ একসাথে থেকে, খেলাধুলা করে বড় হয়েছিলো। এতদিন পর জোহানের ঐশির আগের মতো ব্যবহার দেখে ঠোঁটের কোণে গাঢ় হাসি ফুটে ওঠে।
ইনারা কপাল কুঁচকে জোহানকে জিজ্ঞেস করে, "কিন্তু আপনি না উনার সাথে গতকাল তাল মিলাচ্ছিলেন? আজ হঠাৎ কি হলো আপনার?"
"কাল রাত জেগে আমি ভাবলাম দীপা আসলে যা বলেছিলো তা ভুল। ও আমার গার্লফ্রেন্ড বলে ভুল জিনিসেও ডিফেন্ড করাটা তো অনুচিত।"
ইনারাও খুশি হয়ে যায়। গতকাল থেকে সে বারবার ভাবছিলো জোহানকে নিয়ে। তার দুর্ব্যবহার নিয়ে। যাক তা ভুল প্রমাণিত হলো। জোহান একদম তেমন যেমন সে প্রথমে ভেবেছিলো। খুশিই হয় সে। এতদিনের মন খারাপটা দূর হয়ে যায়। তারপর সে সব ভুলে ঘুরতে থাকে, কাজ করতে থাকে।
সকলে ব্যস্ত হয়ে পরে। এ সাপ্তাহে অনেক ব্যস্ত সবাই। নতুন গান তৈরির কার্যক্রম, নাচের প্রাক্টিস, লাইভ পার্ফোর্মেন্সের প্রাক্টিস ইত্যাদি নিয়ে। দুপুরের খাবারের সময় সবাই একটু আরাম করে। সবাই একসাথে ক্যান্টিনে খেতে যায়। জোহান একটু কাজ ছিলো বলে সে থেকে যায়। তার জন্য সাথে থেকে যায় সামিও।
"তোর মাঝে হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে ভালো লাগলো।"
জোহান মোবাইলে একটু কাজ করছিলো। তার ভবিষ্যতে সিঙ্গেল এলবাম বের হবার কথা। এ নিয়েই। সামির কথা শুনে সে চোখ তুলে তাকায়। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, "কী নিয়ে বলছিস?"
"ইনারাকে নিয়ে। কিন্তু তোর হঠাৎ কি হলো তা বুঝলাম না। আই মিন ক'দিন আগেও তুই ইনারাকে নিয়ে বাজে বকছিলি।"
তাচ্ছিল্য হাসে জোহান, "ভাবলাম ইনারার মনে আমাকে নিয়ে যে অনুভূতি আছে তা একটু কাজে লাগাই। গতকাল তোর আর সভ্যের কথা শুনলাম। সভ্যের কারণে বাবার কাছে অনেক ছোট হয়েছি আমি। বারবার। সভ্য কি ভাবে সে যা চাইবে তাই তাকে স্বর্ণের থালায় পরিবেশন করা হবে? একদম না। ব্যান্ড শুরু হবার পর থেকে ওর সাথে কেবল তুলনা হচ্ছে আমার। ও সবকিছুতে আমার থেকে বেটার, এই কথাই শুনে আসছি। সবদিক থেকে ও আমার থেকে এগিয়ে আছে। এবার না। ও সব পাবে না। সব কিছুতে প্রথম হবার শখ তার। তার এই শখ মেটাচ্ছি আমি। সে ইনারাকে পাবে না। কিছুতেই পাবে না। আমি পেতে দিব না। ওকে ভেঙে ছাড়ব আমি। এমনটা না করলে আমার নামও জোহান না।"
জোহান কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াতেই অনুভব করে কেউ সজোরে তার গালে ঘুষি মেরেছে। আকস্মিকভাবে সে সামি। সে হতভম্ব। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সে সামির দিকে। বুঝে উঠার পূর্বেই সামি তার কলার ধরে সোফায় বসিয়ে আবারও ঘুষি মারে অন্য গালে। জোহান তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, "কি করছিস? পাগল হয়ে গেলি না'কি তুই?"
"তোর ভূত বের করছি। তোর মাঝে কীসের ভূত ঢুকেছে বুঝতে পারছি না।"
"সামি সর, নাহয় আমার হাত উঠে যাবে।" জোহান সামিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আবারও বলে, "তোর মাথা নষ্ট হয়েছে? কী আবল তাবল বকছিস তুই? ওই সভ্যের জন্য তুইও ভুলে গেলি আমি তোর ভাই হই?"
" ভাই? সভ্যও তো এককালে তোর ভাই হতো। তার সাথে আজ তোর দুশমনি চলে। এর কারণ কি কেউ জানে না। সভ্যও না। তোকে মাঝমধ্যে চিনতে পারি না আমি। তুই সে মানুষটা যে এককালে তার আপনদের জন্য প্রাণ দিতে দ্বিধাবোধ করতো না। অচেনা মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্যও কতটা কষ্ট করতি তুই। কারও জন্য কোনো খারাপ কথাও তোর মনে আসতো। আর আজ.....। আমাদের দলের সবচেয়ে ভালো মনের, নম্র মানুষটা তুই ছিলি। আর আজ কি করে নিলি তুই নিজেকে? আগে গান গাইতি তুই অন্যের ঠোঁটে হাসি ফুটানোর জন্য। তোর জন্য আমি গান গাওয়া শুরু করেছিলাম আর আজ এই গানটাকে তুই প্রতিযোগিতা করে নিলি। তোর অহংকার জয় করার জন্য, তোর ক্ষোভ মেটানোর জন্য এক পিচ্চি মেয়ের অনুভূতি নিয়ে খেলা করবি। তাও তোর ভাইয়ের মতো বন্ধুকে কষ্ট দেবার জন্য! এ কথা ভাবতে বুক কাঁপে নি তোর?"
জোহান কথাগুলো শুনে চোখ মেলাতে পারে না সামির সাথে। সে রাগে কটমট করতে করতে বেরিয়ে পরে। দরজায় সে দেখতে পারে সভ্য দাঁড়ানো। তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি তাকিয়ে বলে,"এখানে লুকিয়ে কথা শুনা হচ্ছে?"
সভ্য শান্ত গলায় উওর দেয়, "লুকিয়ে? আমার মনে তো খোঁট নেই। তাই আমার লুকিয়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই।"
"ভালোই হলো তুই জেনে গেলি। আমারও এসব লুকানোর ইচ্ছা নেই। আমি খোলাভাবে বললাম তোকে ইনারাকে কিছুতেই পেতে দিব না। ওকে আঙুলের ইশারায় নাচাবো আমি।"
"ওকে। যা করার কর। তোর ইচ্ছা। আমি কিছুই বলব।"
সামিও আসে সেই জায়গায়। সভ্যের কথা শুনে সে বলে, "এসব কি বলছিস তুই? ইনারার ফিলিংস নিয়ে খেলা করার কথা শুনেও তুই ওকে কিছু বলবি না? "
সভ্য হাতের ইশারায় থামায় সামিকে। আর জোহানকে উদ্দেশ্য করে বলে, "তোর যা ইচ্ছা তুই তাই করতে পারিস। আমিও দেখি ইনারাকে কীভাবে নিজের আঙুলের ইশারায় নাচাতে পারিস তুই।"
"চ্যালেঞ্জ করিস না। ও এমনিতেই আমার প্রতি দুর্বল মনে আছে তো?"
"ধর চ্যালেঞ্জই করলাম। দেখি তুই কি করিস।"
জোহান বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
সামি সভ্যের কথা শুনে না তাকেও রাগান্বিত সুরে বলে, "তুই কীভাবে ওর কথা মানতে পারিস? আর ইনারা কি কোনো জিনিস না'কি যে তোরা ওকে এমন করছিস। তুই এবং আমি দুজনই জানি যে ইনারার ওর প্রতি দুর্বলতা আছে। অনেক হয়েছে। আমি এখনি যেয়ে ইনারাকে বলে দিচ্ছি।"
সামি যেতে নিলেই সভ্য তাকে থামায়, "প্রয়োজন নেই।"
"প্রয়োজন নেই মানে? এখানে তোর ওকে প্রটেক্ট করা উচিত। আর তুই..."
"কারণ আমি জানি ইনারা জোহানের সাথে এমন কোনো সম্পর্কে জড়াবে না। জোহান এখন যতই ওর সামনে ভালো সাজুক না কেন ইনারা ওর দিকে এগোবে না। এতদিনে আমি ইনারাকে যতটুকু চিনতে পেরেছি ও কখনো এমন কারো সাথে সম্পর্কে জড়াবে না যে অন্যকারো সাথে সম্পর্কে জড়ানো।"
"কিন্তু জোহানের প্রতি দুর্বল ও। আমার তো মনে হয় ওর এই জব করার কারণও কেবল সে।"
"হোক। কিন্তু ও কখনো দুইজনের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে আসবে না এটা আমি নিশ্চিত।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামি, "তাই যেন হয়। ও কষ্ট না পেলেই হলো।"
.
.
রাত বারোটা বাজে। সভ্য তখন বারান্দায় বসে নতুন গান লেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার মন বসছে না। সারাক্ষণ
কেবল মনে পরছে ইনারার কথা। তাই না পেরে সে কল দেয় ইনারাকে।
ইনারা বসে বসে কেক খাচ্ছিলো এবং কার্টুন দেখছিল। হঠ্যাৎ এত রাতে তার কল দেখে সে অবাকই হয়। কপাল কুঁচকে বলে, "এই অসভ্য এত রাতে আমারে কল দেয়! নিশ্চয়ই তার মাথায় কোনো কুবুদ্ধি ঘুরে। রেডি হয়ে যা ইনারা বাঁশের জন্য।"
সে কল ধরে বলে, "কি মিঃ অসভ্য আজ আমাকে কেন মনে করলেন?"
"কেন মানে? তোমাকে মনে করতে দোষ না'কি?"
"আপনি মনে করলে দোষ। মনে করলেই বাঁশ খেতে হয়।"
"এবার তো একশত ভাগ দিব।"
"দিলেন তো আমার ব্লু-বেরি কেকের স্বাদ নষ্ট করে।"
"তুমি জানো রাতের খাবার আটটার আগে শেষ করা অনেক ভালো। দুপুর বারোটার পর মিষ্টি খেতে নেই। আর তুমি কেক খাচ্ছো?"
"ধ্যুর এইসব ফালতু কথা। যারা খেতে পারে না তারা এসব বানিয়েছে বুঝলেন। দেখে, জ্বলে, লুচির মতো ফুলে। হি হি। গোপাল ভাড় দেখতেছি তো। ডায়লগ একটা মেরে দিলাম।"
"তোমার সাথে কথা বলা আর নিজের মাথায় হাতুড়ি মারাটা একদম সেম।"
"তো কে বলল আপনাকে নিজের মাথায় হাতুড়ি মারতে? কি কাজ তা বলেন।"
সভ্য এবার পড়লো বিপদে। কি বলবে সে? সে তো বিনা কাজেই কল দিয়েছে। তার খুব করে ইনারার কন্ঠ শুনতে মন চেয়েছিলো তাই। কিন্তু এটা তো বলা যাবে না। তাই সে হঠাৎ করেই কিছু না পেয়ে বলল, "আমি একটা গান লিখেছিলাম। তা কেমন হয়েছে বুঝতে পারছি না। সবাই ব্যস্ত তাই কাওকে শোনাতে পারছি না। তাই তোমাকে শুনাচ্ছি। তুমি একটু বলো কেমন হয়েছে।"
লাফ দিয়ে উঠে ইনারা, "বলেন কী! আমি সবার আগে গান শুনবো। শুরু করেন। গান শুরু করেন।"
সভ্য পরলো আরেক বিপদে। কিছুই লেখে নি সে। কি শুনাবে? তার সামনের ডায়েরিতে এক খালি পৃষ্ঠা। তবুও সে চেষ্টা করল। গিটারটা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করল। সাথে সাথে তার চোখের সামনে ভেসে উঠে ইনারার হাসিমাখা চেহেরাটা, তার নীলাভ নয়ন, তার লজ্জায় ডুবে থাকা মুখখানা। গিটারের সুর ধরল সে। সাথে গানের তাল মেলালো,
ও প্রিয়তমা, শুনোনা, শুনোনা আমার এই বায়না
ও প্রিয়তমা, তোমার মাঝে আমার আয়না
এই অবেলায় মন যে হারায়,
এই অবেলায় তোমার সাথী হতে চায়,
এই নিঝুম রাতে তোমার আমার হবে প্রেমকথন....
.
.
.
চলবে.................................