পলকহীন চাহনীতে বিভোর হয়ে আছে অনল। নিহির পথ রোধ করা। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে নিজেও যেন কিছুটা থমকে গেছে। অনলের পেছনে কিছুটা দূর থেকে লিমনের ডাক আসে। নিহির উদ্দেশ্যে বলে,
"নিহি!"
ভাবনায় ছেদ পড়ে দুজনের। ভাবনার অতল গহীন থেকে নিহি নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত সে জায়গা প্রস্থান করে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে সমান তালে লিমনের সাথে হাঁটে। অনল পিছু ফিরে তাকায়। ঘোর কাটেনি তার এখনো। আস্তে আস্তে নিহি দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। সবকিছু আবছা আবছা লাগছে। অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সুমাইয়া ডাকে তখন।
"দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।"
অনল যায় না। একদৃষ্টে সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাকশক্তিও বোধ হয় লোপ পেয়েছে। সুমাইয়া এবার অনলের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলে,
"কী হলো?"
"নিহি! নিহিকে দেখেছি আমি।" অস্পষ্ট স্বরে বলে অনল।
সুমাইয়া অবাক হয়। সেই সঙ্গে অবাক বাকি বন্ধুরাও। ওরা সবাই কলেজে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি জানে। তবে নিহি এখানে? এটা কীভাবে সম্ভব? সুমাইয়া তখন হাসার চেষ্টা করে বলে,
"ধুর! মনের ভুল। ইদানীং তুই ওকে নিয়ে বেশিই ভাবছিস।"
"নাহ্। আমি সত্যিই নিহিকে দেখেছি।"
"কোথায় দেখলি?"
"এখানেই!"
হাতের দিকে লক্ষ্য হতেই পানির বোতলটা দেখিয়ে বলে,
"ওই এই পানির বোতলটা আমার হাতে তুলে দিয়েছে।"
সবাই দেখেছে বোরকা পরা একটা মেয়ে যে পানির বোতল তুলে দিয়েছে। কিন্তু সেটাই যে নিহি এতটা শিওর কী করে অনল? সবাই এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছে এই সবকিছু অনলের মনের ভুল। কিন্তু অনল মানতে নারাজ। এত কাছ থেকে নিহিকে চিনতে ভুল করেনি সে। করবেও না! তাছাড়া ঐ ছেলেটির মুখেও তো 'নিহি' ডাক শুনেছে। কিন্তু এই ছেলেটাই বা কে? তার সাথে নিহি কেন এখানে এসেছে? প্রশ্নটা জটলা বাঁধছে। নিহির কাছে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়ে। অনলের হঠাৎ এমন পরিবর্তনে ঘাবড়ে যায় সবাই। নিহির জন্য অনল কেন এমন করবে?
জাফলং-এ কারোরই ঘোরা হলো না। অনলের জন্য বাধ্য হয়ে সকলকে হোটেলে ফিরতে হলো। এত আশা নিয়ে ঘুরতে এসেও ঘোরা হলো না কারোরই। এজন্য মনে মনে অনেকেই ক্ষুব্ধ।
লিমন বাসের সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। কপালে হাত। চোখ বন্ধ। অন্যদিকে নিহি জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। অনলকে দেখে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। সে কেন এসেছে এখানে? আর এসেছেই যখন দেখা কেন হতে হবে! একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখল নিহির হাত-পা কাঁপছে। এমন হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। নিহির অস্থিরতা,নড়চড় দৃষ্টি এড়ায় না লিমনের। কতকক্ষণ নিহির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
"কী হয়েছে?"
নিহি থতমত খেয়ে যায়। হাসার চেষ্টা করে বলে,
"কিছু না।"
লিমন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর গম্ভীর হয়ে বলে,
"তুই ভয় পাস না। স্মৃতি তোর কিছুই করতে পারবে না।"
উত্তরে এবারও নিহি মেকি হাসে। স্মৃতিকে নিয়ে নিহির ভয় হচ্ছে না। ইভেন কোনো ভয়ই মনে কাজ করছে না। শুধু প্রচণ্ড পরিমাণে অস্থিরতা কাজ করছে। সেটা কি এতদিন পর অনলকে দেখার কারণেই নাকি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সামনে এসে যাওয়ায় তা স্পষ্ট নয় নিহির কাছে।
বাড়িতে পৌঁছে নিহি ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। তরু এখনো ফেরেনি বাসায়। ড্রয়িংরুম থেকে লিমনের চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসে। তরুর খোঁজ করে। মামী তখন জানায় তরু দোকানে গেছে। তিনিই পাঠিয়েছেন। লিমনের ক্ষুব্ধ মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছেন কিছু একটা হয়েছে। তরুর ওপর রাগ এড়িয়ে যেতে তিনি মিথ্যে বললেন। লিমন নিজের ঘরে চলে যায়।
নিহির এখন ইচ্ছে করছে আমানের সঙ্গে কথা বলতে। আমানের সঙ্গ পেতে। এক মনে ভাবলো ফোন করবে। আবার ভাবলো সারারাত না ঘুমিয়ে ঢাকায় গেছে। মিটিং করেছে। এখন নিশ্চয়ই একটু ঘুমাচ্ছে। কন্টাক্ট লিস্টে গিয়ে কিছুক্ষণ নাম্বার ঘাটাঘাটি করে উপমাকে ফোন করল। উপমা ফোন রিসিভ করে বলে,
"কীরে কী খবর? ফোন দিতে ইচ্ছে হলো?"
নিহি মৃদু হেসে বলে,
"তুইও তো ফোন দেস না।"
"ইশ! কেন দেবো? তোর রাগ আছে। আমার রাগ নেই?"
"খুব রাগ না? ঢাকায় আসি আগে। তারপর দেখব এত রাগ কোথায় থাকে।"
"সত্যিই? কবে আসবি?"
"পরীক্ষার পর।"
"ধুর! দেরি আছে।" মলিন মুখে বলে উপমা।
নিহি তখন বলে,
"অনলকে দেখেছি আজ।"
উপমা অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
"কোথায় দেখেছিস?"
"জাফলং।"
"পরে?"
"পরে আর কিছুই না।"
"তোকে দেখেছে? কথা হয়নি?"
"দেখেছে। তবে কথা হয়নি। দেখে মনে হলো ঘোরের মাঝে আছে।"
"হোক! এরকম আরো অনেকবার তার মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে। তুই নিজেকে শক্ত রাখবি।"
"আমি শক্ত আছি। শুধু একটু অস্থিরতা কাজ করছে।"
"দুলাভাইর সঙ্গে কথা বল। ঠিক হয়ে যাবে।"
"হুম। রাতে ফোন করব। দীপ্ত কেমন আছে?"
"ভালো আছে। আগের থেকে অনেক চালাকচতুর হয়েছে।" বলে উপমা হেসে ফেলে। সঙ্গে নিহিও হেসে ফেলে। আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ফোন রাখে। এর মাঝেই তরু এসে পড়ে। লিমনকে বাসায় দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। নিহি তাকে শান্ত থাকতে বলে।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফোন নিয়ে ছাদে যায় নিহি। প্লে লিস্ট থেকে গান ছেড়ে রেলিং এর সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। এই ছাদেই আমানের সঙ্গে খুনসুটির কত স্মৃতি রয়েছে। আমানের কথা মনে পড়ছে ঠিকই। তবে এটাও সত্য মনের এক কোণে অনলের বিষয়টাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যতই ভুলতে চাচ্ছে ততই আরো বেশি করে মনে পড়ছে। একটা সময়ে এই অনলের প্রতিও নিহির ভালোবাসার পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়েছিল। ভুল মানুষকে ভালোবাসাটাই ছিল চরম ভুল। সেই ভু্লটা নিহি সংশোধন করে নিয়েছে। অনলের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তবুও কোথায় যেন একটা কী!
গান বন্ধ হয়ে যায়। ফোনের স্ক্রিনে আমানের নাম্বার ভেসে ওঠে। মনের ওপর থেকে একটা ভার নেমে যায়। ফোন রিসিভ করে নিহি সালাম দেয়। আমান সালামের উত্তর নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"ভালো আছেন নিহুপাখি?"
'নিহুপাখি!' যতবার এই ডাকটা শোনে ততবার মনের ভেতর শীতল হাওয়ায় স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে মন। মনকাননে তখন হাজারও ভালোবাসার ছড়াছড়ি। রাশি রাশি সুখ সেখানে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। সলজ্জিত হেসে নিহি উত্তর করে,
"আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আপনি?"
"আলহামদুলিল্লাহ্। আমি খুবই দুঃখিত।"
"কেন?"
"সারাদিনেও আজ তেমন খোঁজ-খবর নিতে পারিনি আপনার তাই।"
ঠোঁটের হাসি আরও সুদীর্ঘ হয় নিহির। বলে,
"সামান্য কারণেও বুঝি দুঃখিত হওয়া লাগে?"
"নাহ্। সবার ক্ষেত্রে নয়। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য।"
"তা এই কিছু কিছু মানুষগুলো কারা?"
"যারা স্পেশাল।"
"আমিও স্পেশাল?"
"জানিনা। শুধু জানি, মায়ের পরে আপনার স্থান!"
বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। এত মোহাবিষ্ট কথা লোকটা কী করে বলতে পারে কে জানে! নিহির লজ্জামিশ্রিত মুখটি চোখ বুজে অনুভব করে আমান। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,
"মাঝে মাঝে আমার নিহুপাখিটা বোবা হয়ে যায় নাকি?"
"হু, যায়।"
"কেন? কেন?"
"আপনার ভালোবাসার মোহাবিষ্ট কথায় দগ্ধ হয়ে।"
"তাও ভালো! আগুনে নয়।"
"জানেন কিছুক্ষণ আগেও আমার মন খারাপ ছিল।"
"কেন? কী হয়েছে?"
"অযথাই। উল্টা-পাল্টা কথা মাথায় আসে।"
"অযথাই কারো মন খারাপ হয় না। আমরা নিজেরাই নিজেদের মন খারাপের কারণ।"
"কীভাবে?"
"এই ধরুন, একটা বিষয় নিয়ে আপনি খুবই আপসেট। আপনি জানেনও বিষয়টা যতবার আপনার মনে হবে ততবার আপনি কষ্টে জর্জরিত হবেন। এটা জানা সত্ত্বেও যখন আবারও সেই একই কথা ভাববেন আর কষ্ট পেয়ে মন খারাপ করবেন। তখন মন খারাপের জন্য নিজেকে দায়ী না করে কাকে দায়ী করবেন?"
"যদি ভুলতে চেয়েও ভুলতে না পারি তখন?"
"ভুলতে চাওয়াটাই হচ্ছে বড় ভুল।"
"মানে?"
"মানে এটাই। কাকে বা কী ভুলবেন আপনি? যেটাই ভুলতে যান না কেন আগে সেটা মনে করতে হবে। আর যতবার আপনি ভুলতে যাবেন ততবার মনে পড়বে। তাহলে ভুলবেন কী করে বলুন তো?"
"তাহলে কী করা উচিত?"
"ড্যাম কেয়ার ভাব নিন। এমন একটা ভাব নিন যাতে,যত বড়োই কষ্টের কথা মনে হোক না কেন তাতে আপনার কিচ্ছু যায় আসে না। কষ্টকে নিজের শত্রু নয় বন্ধু ভাবুন। যদি এগুলো আপনি করতে পারেন তাহলে ফিফটি পার্সেন্ট কষ্ট আপনার এমনিতেই লাঘব হয়ে যাবে। আর বাকি ফিফটি পার্সেন্ট আপনার নিয়ন্ত্রণে। আপনি নিজেই তার নিয়ন্ত্রক।"
প্রত্যেকটা কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে নিহি। উনি সাথে থাকলে কষ্টও ভয় পাবে কাছে আসতে। এমন একটা মানুষ দুনিয়ার সব প্রিয় মানুষের হোক।
সিঁড়িতে কারো পদশব্দ শুনে কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখে। পিছনে তাকিয়ে দেখে লিমন এসেছে। খাবার টেবিলেও লিমনকে আজ দেখেনি। মুখের অবস্থা করুণ। নিহির দিকে তাকিয়ে লিমন বলে,
"তোর ঘরে গিয়ে দেখলাম তুই নেই। তরু বলল ছাদে এসেছিস। তাই আমিও আসলাম। তোর শীত করছে না?"
"না।" নিহির নির্লিপ্ত উত্তর। সত্যি বলতে লিমনের করুণদশা মুখ দেখে বাকশক্তিও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
লিমন কিছুক্ষণ মৌন থাকে। নিহিও কিছু বলছে না। লিমন কিছু বলার জন্যই এসেছে এটা বুঝতে পারে। তাই বলার সুযোগ দিয়ে নিশ্চুপ থাকে। মৌনতার সংকীর্ণ দূর করে লিমন বলে,
"স্মৃতির বিষয়টা বাড়িতে কাউকে বলিস না। তরুকেও না।"
"তরু তো জানে তুমি রিলেশন করো।"
"হ্যাঁ। বিয়ে করেছি এটা জানে না। ও জানলে কখন মুখ ফস্কে বাবা-মাকে বলে দেবে ঠিক নেই। তখন তারা কষ্ট পাবে।"
"আচ্ছা। আর পরে যখন জানবে? তখন কষ্ট পাবে না?"
লিমন এবার দমে যায়। তার অস্বস্তি হচ্ছে বুঝে নিহি প্রশ্ন পাল্টে জিজ্ঞেস করে,
"না জানিয়ে বিয়ে করলে কেন ভাইয়া?"
"তোকে পরে সব বলব। তুই কাউকে বলিস না প্লিজ!"
"বলব না।"
লিমন সৌজন্যতার হাসি হেসে বলে,
"ঘরে যা। ঠান্ডা লাগবে।"
নিহিও আর কথা বাড়ায় না। লিমনের সঙ্গেই ঘরের ভেতর যায়। আমানের সঙ্গে বাকি কথা ঘরেই বলে।
_____________________
উদভ্রান্তের মতো নিহির খোঁজ করছে অনল। কেন করছে জানে না। শুধু জানে, নিহির সঙ্গে একবার কথা বলতেই হবে। উপমার ফেসবুক আইডি থেকে নিহির আইডি খুঁজে বের করে। সেখান থেকে ওর কলেজ ফ্রেন্ডের আইডির সঙ্গে এড হয়ে বিভিন্নরকম ছলচাতুরী করে সুমাইয়াকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিহির সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছে। সেটাও আবছা, আবছা! তবে বাড়ির এড্রেস পাওয়া গেছে। আর কলেজে যাওয়ার সময়টাও জেনে নিয়েছে। বাড়িতে তো আর যাওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলেজে যাওয়ার সময়ই নিহির সঙ্গে কথা বলবে।
অনলের এত বাড়াবাড়ি বিরক্ত লাগছে লিসার। হুট করেই এমন পরিবর্তনের কোনো মানে হয়? এই ছেলের মনের কোনো ঠিক নেই। কখন কী চায়, সেটা সে নিজেও জানে না। বিড়বিড় করে নিজের ঘরে চলে যায়। কিঞ্চিৎ বিরক্তবোধ সাকিব, মিলন এবং সুমাইয়াও হয়। এত বড় কেলেঙ্কারির পর আবার নিহির জন্য এমন উতলা হওয়াটা অন্তত অনলকে তো মানায় না। সুমাইয়া জিজ্ঞেস করে,
"তুই কেন এমন করছিস?"
"জানিনা আমি।"
"ওর সঙ্গে কথা বলে লাভ কী?"
"তাও জানিনা আমি।"
সুমাইয়া দাঁতমুখ খিঁচে বলে,
"তুই কি ওর লাইফে ব্যাক করতে চাচ্ছিস?"
অনল এবার যেন একটু হাসলো। হেসে হেসে বলল,
"ধ্যাত! না। শুধু একটু কথা বলব।"
ফাঁকা রাস্তায় নিহি আর তরু হাঁটছে। উদ্দেশ্য কলেজের গন্তব্য। রাতে আমানের সঙ্গে কথা বলার থেকে নিহির মন ফুরফুরে হয়ে আছে। তরুর সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে যাচ্ছে। তখন সামনে থেকে কয়েকজন ছেলে এগিয়ে এসে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। সবার মাঝ থেকে একজন নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
"আপনিই নিহি?"
একবার তরুর দিকে তাকিয়ে নিহি উত্তর করে,
"জি।"
"আপনাকে মেয়র সাহেব বাসায় যেতে বলেছেন।"
নিহি অবাক হয়। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করে,
"কেন? তাছাড়া তিনি আমাকে চেনেন কীভাবে?"
"স্মৃতি আপার মাধ্যমে।"
"স্মৃতি! উনি মেয়রের কী হয়?"
"মেয়ে।"
এবার পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয় নিহির কাছে। উত্তরে তখন নিহি বলে,
"আমি এখন যেতে পারব না।"
কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল অনল, সাকিব, মিলন আর সুমাইয়া। পথ রোধ দেখে ওরাও এগিয়ে আসে। অনলকে দেখে নিহি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ঐদিকে ঐ লোকগুলোও জোড়াজুড়ি করছে। নিহি তখন কাঠ কাঠ গলায় বলে,
"বললাম তো আমি যাব না! আমার কলেজ আছে এখন। তাছাড়া আমার তাদের কাছে কোনো দরকার নেই। তাদের যদি কোনো দরকার থাকে তাহলে তারা যেন আমার কাছে আসে।"
এইটুকু বলে নিহি তরুর হাত ধরে হাঁটা শুরু করে। ছেলেগুলো এগিয়ে যেতে ধরলে অনল বাঁধা দিয়ে বলে,
"কী সমস্যা? ওকে বিরক্ত করছেন কেন?"
উত্তর দেওয়ার আগে একজনের ফোন বাজে। সম্ভবত মেয়রের ফোন এসেছে। তিনি ছেলেটির মুখ থেকে সব শুনে ফিরে আসতে বলেন। অশান্তি তার পছন্দ নয়। তাছাড়া গ্রামে তার আলাদা একটা সন্মান আছে। তার কথামতো ছেলেগুলো চলে যায়। ততক্ষণে নিহি আর তরু বড় বড় কদমে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। তরু বারবার জিজ্ঞেস করছে 'ওরা কারা? মেয়র কেন তোকে যেতে বলেছে?' নিহি কোনো উত্তর করেনি।
অনল দৌঁড়ে এসে নিহির পথ আটকে দাঁড়ায়। হাঁটুতে হাত রেখে একটু ঝুঁকে হাঁপাতে থাকে। দম নিয়ে বলে,
"পালিয়ে যাচ্ছো?"
নিহি কাঠখোট্টাভাবে উত্তর দেয়,
"পালাবো কেন? আমি তো চোর নই।"
"তবে পালাচ্ছো কেন?"
"আমি পালাচ্ছি না! আপনি আমার পিছু কেন নিয়েছেন?"
"আমি জানিনা।"
"পাগলের প্রলাপ বকতে যদি পথ আটকে দাঁড়ান তাহলে বলব সরে যান।"
"একটু কথা বলতে আপত্তি কোথায়?"
"আমার রুচিতে বাঁধে।"
"এতটাই ঘৃণা করো?"
"ঘৃণা? আপনাকে? অসম্ভব! ঘৃণা করতে হলেও তো মানুষটিকে মনের মাঝে ঘৃণার ঘরে স্থান দিতে হয়। সেই স্থানও আপনার নেই। আপনি আমার ঘৃণারও যোগ্য নন!"
অপমানে চোখমুখ লাল হয়ে যায় অনলের। যেই দাম্ভিকতা মনের মাঝে পুষে রেখেছিল আজ যেন সব নিহির কঠিন কঠিন কথায় ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে তো ছুঁটে আসতে চায়নি সে। তবুও এসেছে। একটুখানি কথা বলতে। আর চাওয়াটাই হয়েছে কাল। তার দাম্ভিকতাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। অপমানিত থমথমা মুখ নিয়ে নিহির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঐ চোখের ভাষায় আজ ভালোবাসা নেই। আছে শুধু দগ্ধিত অনল! নিহি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। অনল পেছন থেকে বলে,
"এই কি তবে সেদিনের বলা বুকে আঘাত করার কথা?"
নিহি থমকে পেছনে তাকায়। অগ্নিবর্ধক নয় বরং শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনলের দিকে। এই দৃষ্টিতেও বিচলিত হতে হয় অনলকে। ঠোঁটে প্রশান্তি ও রহস্যের সেই হাসিটা বজায় রেখে নিহি বলে,
"না। অপেক্ষা করুন। সেই আঘাত সহ্য করা আপনার ক্ষমতার বাইরে। পারলে সেই আঘাত মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করুন। আর হ্যাঁ, এভাবে সেচ্ছায় আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। আমি কথা দিচ্ছি, একদিন আল্লাহ্-র ইচ্ছেতেই আমরা দুজন মুখোমুখি হবো। এবং সেটাও দুজনের অজান্তেই! সেই দিনটার প্রহর গুনুন। আল্লাহ্ হাফেজ।"
.
.
.
চলবে......................................