আড়ালে আবডালে - পর্ব ৪৩ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


নিহির ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজ দু'দিন হলো। পরীক্ষার আগে থেকে শুরু করে পরীক্ষা পর্যন্ত আমানই নিহিকে পড়িয়েছে। সবসময় ওর ছায়া হয়ে থেকেছে। যতক্ষণ পরীক্ষা হয়েছে ততক্ষণ কলেজের বাইরে অপেক্ষা করেছে। সর্বোপরি একদম আগলে রেখেছে। এর মাঝে ঐ নাম্বারে আর কোনো হুমকি বার্তা আসেনি। তবে সেই লোকগুলো আবারও উপমাকে হুমকি-ধামকি দিয়েছে। নিহিকে আমানের জীবন থেকে সরে যেতে বলেছে। হুমকির মাত্রা বাড়তেই থাকে। কখনো ফোনে, কখনো বা ম্যাসেজে। আমান চেষ্টা করেছিল সেই নাম্বারটাও ট্র্যাক করতে। কিন্তু ব্যর্থ হতে হয়েছে। হতাশায় ডুবে যায় উপমা। ওর নিরাপত্তার জন্য কিছু লোক সবসময় ওর আশেপাশে রাখে আমান। এর কিছুই নিহি জানে না। বলে রাখা ভালো আমান জানায়নি।

কাল ঢাকায় ব্যাক করবে ওরা। তখন তো উপমার সঙ্গে দেখা হবে। সবটা জেনে কি নিহি রাগ করবে?
"শুনছেন?"
নিহির ডাকে হুশ ফেরে আমানের। হাসি দিয়ে বলে,
"শুনছি। বলো।"
"চলেন কোথাও থেকে ঘুরে আসি।"
"কোথায় যাবে?"
"যেদিকে দু-চোখ যায়।"

আমান স্মিত হেসে বলে,
"চলো এমন এক জায়গায় যাই যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।"
"সেই জায়গাটা কোথায়?"
"জানা নেই৷ তবে খুঁজে নেব।"
"প্লিজ মজা করা বাদ দেন৷ চলেন যাই।"
"কোথায় যাবে সেটা তো বলো।"
"জায়গা আপনি ঠিক করেন। কাল তো ঢাকায় ফিরে যাব। যাওয়ার আগে কোথাও থেকে ঘুরে যেতে চাই।"
"নিরবের খালামনির বাসা থেকে ঘুরে আসি চলো।"
"সেখানে কী আছে?"
"তেমন কিছুই নেই। আবার অনেককিছুই আছে।"
"তাহলে তো অবশ্যই যাওয়া উচিত।"
"কিন্তু লিমনকে কী বলে ম্যানেজ করবে?"
"ভাইয়া তো বাসায় নেই। শ্বশুরবাড়ি গেছে। কালকে আসবে। আর মামা-মামিকে বলব ফ্রেন্ডের জন্মদিন আজ।"
"জন্মদিন কি কারো আসলেই আছে?"
"ধুর! না। মিথ্যা বলব।"
"মিথ্যা বলাও শিখে ফেলছ?"
"শেখার কী আছে? প্রেম করার জন্য একটু আধটু মিথ্যা বললে কিছু হয় না।"
আমান হেসে বলে,
"ঠিকাছে। কে কে যাচ্ছি আমরা?"
"আপনি, আমি, তরু আর শিশির। সঙ্গে ক্যাবলাকান্ত তো ফ্রি।"

নিরব পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিহির কথা শুনে অসহায়ের মতো মুখ করে বলে,
"আমাকে ফ্রি বানিয়ে দিলেন ম্যাম?"
নিহি হাত দিয়ে চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলে,
"আপনি দুধভাত।"
এবার নিরব হেসে ফেলল। সঙ্গে আমান আর নিহিও হাসলো।


আকাশ আজ পরিষ্কার। খুব বেশিই পরিষ্কার। রাশি রাশি তারা আকাশে জ্বলজ্বল করছে। একটি মাত্র চাঁদ থালার মতো পূর্ণাঙ্গ আকৃতির। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে মাটিতে। বড়ো বড়ো গাছপালার মাঝ বাগানে দাঁড়ালেও স্পষ্ট দেখা যাবে মুখাকৃতি। মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছে তিনজন কপোত-কপোতী। আমান-নিহি, শিশির-তরু এবং নিরব-জান্নাত। নিরব আর জান্নাতের ভাব-ভালোবাসাও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সাহায্য করেছে আমান এবং নিহি। বাড়িতেও জানানো হয়েছে। খুব শীঘ্রই বিয়ে করে ফেলবে বলে জানিয়েছে দুই পরিবার। তাদের সিদ্ধান্তে দুজনই ভীষণ খুশি। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ কার না থাকে?

চাঁদের আলোয় মাঠ-ঘাট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বলে আলাদা লাইটের কোনো প্রয়োজন হয়নি। বর্তমানে সবাই এখন আছে জান্নাতদের বাড়ির কাছাকাছি জায়গাতে। এসেছে বিকেলেই। তবে হাঁটতে বের হয়েছে এখন। সামনেই একটা নদী আছে। ঘাটে বাঁধা আছে সারি সারি নৌকা। নিহি নৌকায় চড়তে ভালোবাসে। আমান সেটা জানে এবং এজন্যই এই জায়গাতে নিয়ে আসে। খোলা আকাশের নিচে এক নৌকায় দুজনে বসে গল্প করবে। নিহিকে জানিয়ে দেবে অজানা কথাগুলো। ভাবতেই মনের মাঝে দোলা দিয়ে যায়৷ আবার ভয়ও লাগে। কী জানি কী না রিয়াক্ট করে বসে!

হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে চলে আসে সবাই। তিনটে নৌকায় দুজন করে উঠে বসে। নৌকার এক মাথায় আমান বৈঠা হাতে বসেছে। নিহি শেষ প্রান্তে বসতে গেলে আমান বলে,
"ওখানে নয়। মাঝখানে বসো। পড়ে যেতে পারো।"
"না, পড়ব না। এর আগেও আমি নৌকায় উঠেছি।"
"আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না নিহু!"

হালকা রাগ ও ধমক মিশ্রিত কণ্ঠে কথাটা শুনে নিহির আর সাহস হয়নি ওখানে বসার। নৌকার মাঝ বরাবর নারিকেল পাতার ছোটো পাটি বিছানো আছে। নিহি সেখানে গিয়ে বসল। পানিতে বৈঠা ফেলতেই গোলাকৃতির মতো পানি ছড়িয়ে পড়ল। চারপাশে থৈ থৈ করছে পানি। বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে চলেছে। পূর্ণাঙ্গ চাঁদটার প্রতিচ্ছবি পানির মাঝেও ভেসে উঠছে। তরু, শিশির, নিরব এবং জান্নাত ওদের নৌকা অনেকদূর চলে গিয়েছে দেখে নিহি বলল,
"ওরা সবাই কত দূরে চলে গেল! আর আমরা এখনো এখানেই পড়ে আছি।"
"ইচ্ছে করেই যাইনি।"
"কেন?"
"তোমার অপেক্ষার প্রহর আজ শেষ করব তাই।"

নিহি আৎকে উঠে বলে,
"ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিবেন নাকি?"
"নিহু!" মেকি ধমক দিলো আমান।
নিহি চুপসে গিয়ে বলল,
"ধমক দেন কেন? আমি তো মজা করে বলেছি।"
"এসব মজা একদম করবে না। অন্তত আমার সাথে তো নয়-ই!"
"হু।"

অভিমানে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় নিহি৷ বৈঠা নৌকার ওপর রেখে তার পাশে আমান বসে। নিহি চমকে গিয়ে বলে,
"একি! উঠে আসলেন কেন? নৌকা ডুবে যাবে তো!"
"ডুববে না। তুমিই না তখন বলেছিলে যেদিকে দু'চোখ যায় সেদিকেই যাবে? তাহলে এখন নৌকা আমাদের যেদিকে নিয়ে যাবে আমরাও সেদিকে যাব।"
"যদি ডুবে যায়?"
"আমায় বিশ্বাস করো?"

আমানের চোখের দিকে তাকালো নিহি। ঘোর লাগানো দৃষ্টি তার। চোখে চোখ রেখে বলল,
"অনেক বেশি!"
"ব্যাস! তাহলেই হবে। এতটুকু ভরসা রাখো শুধু, আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না।"
"আমি জানি সেটা। আচ্ছা কী যেন বলবেন বলেছিলেন?"
আমান চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।নিহির হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে রেখেছে।নিহি উত্তরের জন্য আমানের দিকে তাকিয়ে আছে। আমান ঘাড় বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে বলে,
"আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি!"

সঙ্গে সঙ্গে নিহির দুটো আলগা হয়ে যায়। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। আমান আবার বলে,
"শুধু তাই নয়। বিগত চার বছর ধরে ভালোবাসি। কিন্তু কখনোই তাকে ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি।"

নিহি নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। আমানের কথাগুলো মনে হচ্ছে প্রতিধ্বনি হয়ে কানে আসছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। অন্য কাউকে ভালোবাসে সে? তাহলে এতটা দিন এসব কী ছিল? নাটক! নাহ্, আর ভাবা যাচ্ছে না। এরচেয়ে গলায় কলসি বেঁধে নৌকায় ডুব দিলেও এতটা কষ্ট হতো না। চোখের পানি চাঁদের আলোয় চিকচিক করে ওঠে। গলা ধরে আসছে। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে। যেকোনো মুহূর্তে হুহু করে কেঁদে ফেলবে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল নিহি।

আমান আবার বলল,
"তখন সে ক্লাস এইটে পড়ত। মাঝে মাঝেই তাকে দেখতাম ছাঁদে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। সে আমায় দেখতো না। এরপর..."

নিহি বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমান হাত টেনে ধরে নিহির৷ পাছে আবার পানিতে ঝাপ দেয়! নিহি কোনোরকমভাবে বলে,
"আমি বাড়ি যাব!"
"বাড়িতে নিয়ে যাব। তার আগে আমি কথা শেষ করি।"
নিহি এবার কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে। দু'হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে বলে,
"আপনার এসব কথা শোনার সাহস হচ্ছে না আমার। বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছে। আমি পারব না আপনার পুরো কথা শুনতে।"

'যদি গো তোমায় বলি
আমি তার নাম;
তুমি কি বাসবে ভালো,
দেবে তার দাম?'

আমানের সুরেলা কণ্ঠে পরিচিত গানের লাইনগুলো শুনে নিহি চমকে তাকায়। আমানের ঠোঁটে মুচকি হাসি।

'কাজল কালো দুটি চোখে
সে যখনই আমায় দেখে,
পড়ে না চোখেতে পলক;
আর আসে না কথা মুখে।

তার চলে যাওয়া
ফিরে একটু চাওয়া
এই বুকেতে ঝড় তুলে যায়!

যার ছবি এই মন এঁকে যায়
যার কথা ভেবে দিন কেটে যায়,
সে কি জানে শুধু তাকে
ভালোবাসে আমার হৃদয়!'

ডাগর ডাগর অশ্রুশিক্ত চোখে নিহি এখনো নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে।

'তুমি সুন্দর। চাঁদের আলোয় ঠিকরে পড়া তোমার হাসির ধ্বনি, নদীর কলকলানিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। তোমার ঐ দুটো টানা টানা চোখে অশ্রু বেমানান। তুমি হাসবে। তোমার সঙ্গে হাসবে ঈর্ষান্বিত প্রকৃতি৷ হাসবে অপরূপ ধরণী। যে ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল এতটা সময় দীর্ঘকাল, আজ তার সবটাই করব প্রকাশ। আমি ভালোবাসি তোমায়। তুমি কি দেবে সেই ভালোবাসার দাম?'

"তার মানে! তার মানে আপনিই সেই নাম না জানা উড়োচিঠির মালিক?" কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে প্রশ্ন করে নিহি।

আমান দু'হাত প্রসারিত করে মুচকি হেসে গায়,
'কবে জানবে তুমি?
কবে বলব আমি?
কেউ আছে গো;
তোমার আশায়।'

নিহি সঙ্গে সঙ্গে আমানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
________________

উপমার বাবার শরীরটা বেশ কয়েকদিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না। ওষুধও শেষ। ওষুধের প্রেসক্রিপশন আর টাকা নিয়ে মাকে বলে বাসা থেকে বের হয় উপমা। রাত তখন সাড়ে দশটা। বাড়ির সামনেই রিক্সা পেয়ে যায়। দোকান থেকে ওষুধ কিনে আনার সময় খেয়াল করে কয়েকজন ওকে ফলো করছে। আসলেই ফলো করছে নাকি এটাও শিওর না। আন্দাজে কিছু বলাও যাচ্ছে না। দ্রুত পা চালিয়ে একটা রিক্সায় উঠে উপমা। মাঝ রাস্তায় এসে কয়েকজন ছেলে রিক্সা থামায়। এক প্রকার জোর করেই উপমাকে রিক্সা থেকে নামায়। বাড়ি এবং বাজারের মাঝ বরাবর এই রাস্তাটা নির্জনই বলা চলে। উপমা আৎকে ওঠে। নিয়ন বাতির আলোতে চেহারাগুলো ঝাপসা বোঝা যাচ্ছে। ওদের মধ্যে দুজন মেয়েও আছে। একজন মেয়ে ওর হাত ধরে বলল,
"চলো।"
"কে আপনারা? আমি কোথাও যাব না।" হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল উপমা।

ওরা আর কেউ কোনো কথা না বলে ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমালটা উপমার মুখে চেপে ধরে। উপমা অজ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে ওদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়।


ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দূরে কোথাও হুতুম পেঁচাও ডাকছে বলে মনে হচ্ছে। উপমা নড়াচড়া করতে গিয়ে বুঝতে পারল কিছুর সাথে শক্ত করে ওকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। মুখও বাঁধা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে না পারায় ফ্যাসফ্যাসে গোঙানোর শব্দ হচ্ছে। শক্ত রশি দিয়ে হাত বাঁধা আছে বোঝা যাচ্ছে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গেলেই অসহনীয় ব্যথা লাগছে।

হুট করেই মাথার ওপর সাদা লাইট জ্বলে ওঠে। আলো খুব বেশি নয়। তবে এতটুকু আলোতে বোঝা যাচ্ছে কেউ একজন ওর দিকে এগিয়ে আসছে৷ মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে সে একজন ছেলে!
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন