__তনয়ার জ্ঞান ফিরছে। ও সেই ব্যক্তির নাম বলতে চাচ্ছে যে ওকে মারতে চেয়েছিলো। আমি থানায় ছিলাম সেখান থেকে পুলিশ অফিসার সহ বের হয়েছি। কিন্তু রাস্তায় খুব ঝামেলা হচ্ছে, জ্যামে আটকে গেছি। তুই জলদি হসপিটালে তনয়ার কাছে যা। শোন সবাইকে নিয়ে আসিস।
__আচ্ছা ভাইয়া যাচ্ছি।
মেঘা ওর বাবা মাকে নিয়ে হসপিটালে রওনা দিলো। আর আয়াজকে আয়াত আগেই ফোন করে বলে দিয়েছে। তনয়া এখনো অাক্সজেন মাস্ক পরে ঘুমিয়ে আছে। ওর রুমে কেউ নেই।
তখন রুমে কে যেনো প্রবেশ করলো, সে তনয়ার পাশে বসে তনয়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
__তনয়া তোমার যখন জ্ঞান ফিরছে তখন তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনতে পারছো। আর এখন সবাইকে আমার কথা বলে দিবে তাই না? এতে আমার কোন সমস্যা নেই। তুমিও জানো আমি তোমায় মারতে চাইনি যা হয়েছে সেটা একটা একসিডেন্ট মাত্র। তোমায় পাগলের মত ভালোবাসি সেটা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওরকম দূর্ঘটনা ঘটে যাবে কল্পনাও করতে পারিনি।
তুমি আমায় মাফ করো বা না করো সেটা তোমার ব্যাপার। কারন মাফ করার মত অন্যায় করিনি আমি। তবে আমার নামটা এখন বলো না প্লিজ, আমাকে একটু সময় দাও আমি নিজে ভাইয়াকে বলবো যে তুমি আমার কারনে মৃত্যুর মুখে চলে গেছিলে। প্লিজ তনয়া এতটুকো দয়া করো। আমার বাবার অবস্থা ভালো না। কদিন যাবত তার হার্টে প্রবলেম হচ্ছে। বাবা যদি শোনে তার ছোট ছেলে অমানুষের মত তার বড় ছেলের স্ত্রীর দিকে নজড় দিয়েছে তবে বাবা নিতে পারবে না। প্লিজ তনয়া এতটুকো দয়া করো। তারপর তুমি আমায় যে, শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিবো। প্লিজ তনয়া কিছু তো বলো?
আড়াল থেকে বের হয়ে আয়াত বলল,
__তনয়ার জ্ঞান ফেরেনি আয়াজ। ও এখনো কোমায় আছে। তোর মুখ থেকে সত্যিটা বের করতে একটা মিথ্যা বলেছিলাম।
আয়াজ বিস্ফরিত চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াত আয়াজের পাশে বসে ঠান্ডা গলায় বলল,
__কেন আয়াজ? কেনো করলি এমন? কী ক্ষতি করেছিলো তনয়া তোর?
আয়াজ বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
__আই লাভ হার ভাই।
__তনয়াও কী তোকে ভালোবাসতো?
__না!
__তবে কেন?
আবারও বেশ কিছুক্ষন নীরবতা। তারপর আয়াজ বলতে শুরু করলো।
__আমি ওকে যেদিন প্রথম আমাদের অফিসে দেখি সেদিন থেকে ভালোবাসতে শুরু করি। তোর মত আমারও ওর ত্রুটিতে কোন সমস্যা ছিলো না। আমিও শুধু ওকেই ভালোবেসেছিলাম। তনয়ার জন্মদিনের দিন তনয়াকে প্রপোজ করবো ভাবছিলাম। অনেকক্ষন তনয়াকে না দেখে ওকে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম তুই আর তনয়া একে অপরকে জড়িয়ে আছিস। আমি বুঝতে পারছিলাম তোরা দুজন দুজনকে ভালোবাসিস। বিশ্বাস কর তারপর তনয়াকে ভুলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখনই তনয়াকে দেখতাম নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না। তাই তো প্রায় লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে ফলো করতাম। কিন্তু কখনো সামনে যাইনি। তনয়ার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো, তাই জানতাম তনয়া তোকে পাগলের মত ভালোবাসে। তাই চেয়েও ওকে নিজের মনের কথা বলতে পারতাম না।
__ও তোকে নিজের ভাইয়ের মত দেখতো। তোদের দুজনার বয়স প্রায় সেম হওয়ায় তোকে বন্ধুর মত নিজের মনের কথা বলতো। আর তুই?
__কী করবো ভাইয়া আমি তো ওকে পাগলের মত ভালোবাসতাম। জানিস যখন দীপুকে নিয়ে তোদের ভিতর ঝামেলা হলো, আমি তখন তনয়াকে ইনডায়রেকলি এটা বুঝাতাম তুই ওকে সন্দেহ করিস, ও যাতে তোকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তনয়া ভাবতো দোষ ওর নিজের। আর তারপরও তুই কী করলি তোদের সম্পর্ক আগের থেকেও ভালো হয়ে গেলো।
তারপর রিয়া তোদের সম্পর্ক ভাঙতে চাইছিলো কেন জানি আমি চেয়েছিলাম তোদের সম্পর্কটা ভেঙে যাক। কিন্তু তবুও তোদের সম্পর্ক ভাঙলো না উল্টো বিয়ে করে সবসময়ের জন্য এক হয়ে গেলি। তনয়ার ভালোবাসায় আমি এতটা অন্ধ হয়ে আছি যে, ভালো খারাপ বোঝার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। তবুও তোদের সংসার ভাঙতে চাইনি। কিন্তু যখনই তনয়াকে তোর কাছে দেখতাম, তুই ওকে স্পর্শ করতি আমার ভিষন রাগ হতো। মনে হতো কেন তুই ওকে স্পর্শ করবি!
সেদিন যখন সবাই তোদের সম্পর্ক মেনে নিলো, আর তুই রুমে গিয়ে তনয়াকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মাঝে রেখে চোখ বন্ধ করে বলছিলি, তনয়া বুকে আসলে নাকি তোর সবথেকে বেশি শান্তি লাগে। তখন খুব রাগ লেগেছিলো কারন আমিও তনয়াকে বুকে নিতে চেয়েছিলাম, আমিও তোর মত ওকে বুকে নিয়ে শান্তি পেতে চেয়েছিলাম। সেদিন এত রাগ হলো যে, তারপর তোদের মেসেস করা শুরু করি। আর হ্যাঁ আমি সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে তনয়াকে দেখতাম।
তনয়াদের বাড়ি বসে রাতে তনয়াকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো। কারন তুই একবার বলেছিলি তনয়া ঘুমালে সবথেকে বেশি সুন্দর লাগে। তাই ওকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। সেদিন জানালা দিয়ে চুপি চুপি ঢুকে অনেক্ষন তনয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস কর খারাপ কিছু করিনি। শুধু ওর মায়াবী মুখটার দিকে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু তখনও ও তোর বুকে ছিলো। রাগ হতো খুব এগুলো দেখলে। তাই তোকে বারবার মেসেস করতাম। ভিডিওটাও আমি পাঠিয়েছিলাম। তোকে ভয় দেখাতাম যাতে তুই ভয় পেয়ে তনয়াকে ছেড়ে দিস। কিন্তু যখন তুই মেসেস এর ব্যাপারটা পুলিশকে জানালি তাই মেসেস করা কমিয়ে দিয়েছিলাম। আমি যা করেছি তনয়াকে ভালোবেসে ওকে পেতে করেছি।
__ভালোবাসলে বুঝি তাকে এভাবে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়?
__বিশ্বাস কর ভাইয়া সেদিন যা হয়েছিলো সেটা একটা একসিডেন্ট ছিলো।
রাতে তুই ঝগরা করে যখন বাড়ি চলে আসলি। তখন তনয়াকে ফোন দিয়েছিলাম ও খুব কান্নাকাটি করছিলো। আমি তখন তনয়াকে ফোনে শান্তনা দেই। ভাবছিলাম সকালে গিয়ে তনয়াকে বোঝাবো। আর ও যাতে তোকে ছেড়ে দেয় এমন ভাবে ইনডায়রেকলি ইঙ্গিত দিবো। কিন্তু সেদিন রাতেই তুই তনয়ার কাছে গিয়ে নিজের সব মিটমাট করে ফেলছিস সেটা আমি জানতাম না।
পরের দিন সকালে গিয়ে দেখি তনয়া কেক বানাচ্ছে। আমাকে চা দিয়ে বলল, তুই কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবি, আর তোদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে। আমার ভিষন রাগ হচ্ছিলো,
রাগ করেই বললাম, যে তোমায় রাগ করে বার বার ছেড়ে চলে যায়, কারনে অকারনে বকে, সামান্য ছেলেদের সাথে কথা বললে ধমক দেয় বকা দেয় তার প্রতি তোমার এত ভালোবাসা কেন?
তনয়া বলল, এসব কী বলছেন ভাইয়া? আয়াত আমার স্বামী। আর প্রতিটা স্বামী স্ত্রীর মাঝে রাগ ঝগরা হবেই। যে ভালোবাসে সে রাগও করে।
আমার এত হিংসা রাগ উঠে গেলো যে, আমি মুখ ফসকে তনয়াকে বলে ফেললাম, ভালো তো আমিও তোমাকে বাসি, তোমাকে পাবার জন্য কী করিনি? তোমাকে ফলো করেছি, নিজের ভাইকে হুমকি দিয়ে মেসেস করেছি, তোমার জন্য নিজের ভাইকে পর্যন্ত ঘৃনা করছি। তবে আয়াতের থেকে আমার ভালোবাসা বেশি হলো না? সেই শুরু থেকে তোমায় ভালোবাসি। তবে তুমি কেন আমার ভালোবাসা বুঝতে পারো না।
তনয়া তখন বিস্ময়ের সপ্ত আসমানে ছিলো। হয়ত ভাবতে পারেনি আমার মুখ থেকে এমন কিছু শুনবে। তাই বিম্ময়ে বলল,
এসব কী বলছেন আয়াজ ভাইয়া? আমি আপনাকে আমার একজন ভালো বন্ধুর মত দেখি। আর আপনি আয়াতের ছোট ভাই তাই আপনাকে আমিও ভাইয়ের মত দেখি। আমি বয়সে আপনার থেকে ছোট হলেও সম্পর্কে আপনার বড় ভাবি।
ভাইয়া, বড়ভাবি ডাকগুলো শুনে রাগে হিতাহিত জ্ঞান ছিলো না। তাই তনয়াকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললাম, কিসের ভাই কিসের ভাবি? আজ পর্যন্ত কখনো তোমাকে আমি বড় ভাবি বলে ডেকেছি কী? তাহলে! আমি তোমায় ভালোবাসি আর তোমাকেও আমায় ভালোবাসতে হবে। দরকার হলে আজ একদিনের জন্যও হলেও আমাকে তোমার ভালোবাসতে হবে।
হয়ত নিজের ভিতরের অমানুষ পশুটা জেগে উঠছিলো। তাই ভুলে গেছিলাম কী করতে যাচ্ছি। তনয়া আমায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চর মেরে বসলো। তখন পাশে থাকা কাঁচের ফুলদানিটা নিচে পরে ভেঙে যায়। আমি ওকে আবার ধরতে গেলে ও পালাতে চাইলো, কিন্তু ফ্লোরে হয়ত পানি ছিলো, তাতে স্লিপ কেটে পিছনের দেয়ালে ওর মাথায় আঘাত লাগে। আর ও কোন মতে মাথা দাড় করিয়ে দাড়াতে চাইলে হয়ত মাথা ঘুরে নিচে পরে যায়, সেখানে ফুলদানির কাঁচগুলো ছিলো, যেগুলো তনয়ার পিঠে ঢুকে যায়। ঘটনা এত দ্রুত ঘটলো যে আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। তনয়া কষ্টে ছটফট করছিলো। ওর কষ্টটা আমি অনুভব করছিলাম কিন্তু কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না! ভাবলাম হসপিটালে নিয়ে যাবো, কিন্তু তখন জানালার বাইরে চোখ যেতে দেখলাম তুই বাইক পার্ক করছিস। তাই তোর বিল্ডিং এ ঢোকার আগেই ভয়ে পালিয়ে গেছিলাম। আর তারপর বাকিটা তো তুই জানিস!
এতক্ষন আয়াজের কথা শুনে আয়াতের যেনো নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। কষ্টে মনে হয় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নিজের ভাইয়ের এমন জানোয়ারের মত রূপ যা ও কল্পনাও করতে পারেনি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলল,
__আমি আগেই জানতাম তনয়ার অবস্থার জন্য তুই দায়ী। আয়াজ চোখ বড় বড় করে আয়াতের দিকে তাকালো।
আয়াত বলল, হ্যাঁ তনয়াকে হাসপাতালে আনার সময় তনয়া বলেছিলো এটা একটা একসিডেন্ট কিন্তু আয়াজ ভাইয়ার কারনে হয়েছে। পুরোটা বলতে পারেনি। ওর কষ্ট হচ্ছিলো খুব। তারপরও ভাবছিলাম হয়ত তুই করিস নি তনয়া হয়ত অন্য কিছু বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু পাশের বাসার আন্টির কাছ থেকে জানতে পারি সে নাকি আমার মত কাউকে ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখছে। কিন্তু সে যে সময় বলছে তখন আমি সেখানে ছিলাম না। আন্টি দূর থেকে তোকে দেখে আমি ভাবছে কারন আমরা দু ভাই দেখতে অনেকটা এক রকম। তখন আমার সন্দেহটা অনেকটা দূর হলো। তারপর ওখানের একটা বাচ্চাও তোকে দেখছে। তাই কনর্ফম হলাম তনয়ার এমন ঘটনার সাথে তুই জড়িত।
আমি শুধু এতদিন এটা ভাবছিলাম হয়ত তুই সত্যিটা নিজের মুখে স্বীকার করবি। কিন্তু করলি না। তাই তনয়ার জ্ঞান ফেরার মিথ্যা কথাটা সবাইকে বললাম।
আমি ভাবছিলাম তুই হয়ত নিজের নাম সামনে আসার ভয়ে তনয়ার উপর এ্যাটাক করবি। কিন্তু তুই উল্টো অনুতপ্ত হলি।
আয়াজ কিছু না ভেবে আয়াতের পা দুটো জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে,
__আমায় মাফ করে দে ভাই। আমি আর এ চাপ নিতে পারছি না। কতদিন যাবত আমি শান্তিতে নিশ্বাস নিতে পারছি না। ভালোবাসার মোহে আমি অমানুষ হয়ে গেছিলাম। তুই আমায় শাস্তি দে ভাইয়া। আমায় যা খুশি শাস্তি দে।
আয়াত চোখ মুছে বলল,
__শাস্তি! হুমম। তুই তো আমায় বেঁচে থাকতেও মরে যাবার শাস্তি দিচ্ছিস। একদিকে নিজের আপন ভাই অন্য দিকে নিজের স্ত্রী আর অনাগত সন্তান। তুই তো ভুল হয়েছে বলে মাফ চাইছিস আমি কী করবো?
জানিস তনয়াকে যখন হসপিটালে নিয়ে আসছিলাম তখন ও বেঁচে থাকার জন্য কেমন আঁকুতি করছিলো। বারবার বলছিলো ওর বাঁচতে ইচ্ছে করে। কখনো নিজের হৃদয়টাকে নিজের চোখের সামনে ছটফট করতে দেখছিস? আমি দেখছি। কিন্তু কিছু করতে পারিনি তখন। আমার সাজানো সংসারটা ভেঙে দিয়ে এখন মাফ চাইছিস তুই? তনয়াকে কষ্টে ছটফট করতে আমি দেখছি। তুই না।
__তুই আমায় মেরে ফেল নয়ত পুলিশে দিয়ে দে। তবুও আমায় শাস্তি দে।
__না তোকে আমি মারবো না, পুলিশেও দিবো না। এমন কী কাউকে বলবোও না তনয়ার অবস্থার জন্য তুই দায়ী। যখন নিজের ভিতরে রোজ তুই গুমরে গুমরে মরবি, অনুশোচনার আগুনে রোজ দগ্ধ হবি, তোর হৃদয়টা ততটা জ্বলবে যতটা আমার হৃদয় জ্বলছে তখন তুই এক মুহূর্তের জন্য শান্তি পাবি না, না মরতে পারবি না বাঁচতে আর সেটাই হবে তোর শাস্তি।
আয়াজ আয়াতের পা ধরে কান্না করতে লাগলো।
আর তোর সাথে কোন কথা আমি বলতে চাইনা। বেড়িয়ে যা। নিজের ভাই বলে ছেড়ে দিলাম, আমি আমার মায়ের বুক খালি করতে চাই না। যেমন করে তুই আমার স্ত্রী আর সন্তানকে মেরে আমার বুক খালি করলি। যদি কখনো তনয়া উঠে তোকে মাফ করে তবে তখন আমিও মাফ করবো। একটা কথা শোন আয়াজ,
কেড়ে নেয়াকে ভালোবাসা বলে না। ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসাকে অজর্ন করাকে ভালোবাসা বলে।
আর একটা কথাও বললো না আয়াত।
কিছুক্ষন পর বাড়ির সবাই আসতে আয়াত বলল, ডাক্তার ভুল করে অন্য এক মহিলার জ্ঞান ফেরার কথা ওকে বলে দিয়েছে আর আয়াত ভুল ভাবছে যে তনয়ার জ্ঞান ফিরছে। সবাই যতটা আশা, খুশি আর আনন্দ নিয়ে এসেছিলো নিমিষেই তা মিলিয়ে গেলো। হতাস হয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো সবাই। অার আয়াত তনয়ার হাত ধরে ওর পাশে বসে রইল।
৬৪!!
দু বছর তিন মাস পর।
মেঘা পড়া শুনা করছে। তানভীর সাথে এনগেজমেন্ট হয়ছে। দুজনার পড়া শেষ হলে বিয়ে হবে। তামিম রশ্মির বিয়ে হয়ে গেছে। রশ্মি বর্তমানে চার মাসের প্রেগনেন্ট। আয়াত তামিম রশ্মির সম্পর্ক ঠিক করে দিয়েছে। আর তানভির ,লাবিবার সম্পর্কতো আগেই ঠিক হয়ে গেছে।
সবাই নিজের জীবন সঙ্গী নিয়ে সুখে। কিন্তু আয়াত তনয়া?
আয়াত অফিস থেকে এসে বলল,
__স্যরি তনয়া।
মাফ করে দাও। আসলে আজ অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছিলো যার কারনে দুপুরে আসতে পারিনি। আয়াত এসে তনয়ার বিছানার পাশে বসে অবচেতন তনয়ার কপালে চুমো খেয়ে বলল, কেমন আছো আমার হৃদয়টা?
কিন্তু তনয়া কোন উত্তর দিতে পারবে না। সে নিস্তব্ধ, র্নিলিপ্ত সেই দু বছর পাঁচ মাস ধরে। এখনও তনয়া কোমায়ই আছে। আয়াত তনয়াকে নিজের বাড়ি নিয়ে এসেছে। যে, বাড়িতে তনয়া নববধূ বেশে আয়াতের কোলে চড়ে আসার কথা ছিলো সে বাড়িতে তনয়া হাসপাতালের স্টেচারে করে এসেছে। এর থেকে দুঃখের হয়ত কিছু নেই।
তনয়ার খেয়াল আয়াতই রাখে। একজন পারমানেন্ট নার্স রাখা আছে, সে কেবল দিনে তনয়ার খেয়াল রাখে। আয়াতের মায়ের তনয়ার উপর মাঝে মাঝে বড্ড রাগ হয়। কিন্তু আয়াতের জেদের কাছে কিছু বলতে পারেনা। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা করে তনয়াকে মেরে ফেলতে কিন্তু এতদিনে সে এটা বুঝে গেছে তনয়া মরে গেলে আয়াতের বাঁচা অসম্ভব। নিজের ছেলের ভালোর জন্যও হলেও তিনি চান তনয়া সুস্থ হয়ে উঠুক। মা তো তাই সবসময় নিজের সন্তানের সুখের কথা ভাবে। মায়েরা এমনই হয় সন্তানের সুখের কথা ভাবতে গিয়ে অনেকসময় বিবেগশূণ্য হয়ে পরে।
সবাই সুখী আর সবার মতে আয়াত তনয়া খুব দুঃখী। কিন্তু আয়াতের মতে ওরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। নার্সকে ডাক দিয়ে আয়াত বলল,
__তনয়ার ড্রেস কেন বদলে দেননি?
__রোজ তো আপনি বদলান তাই।
__কেন আপনি একদিন পারে না বদলাতে। দুপুর থেকে এক ড্রেস পরে আছে। তনয়া নোংড়া ভাবে থাকতে পারে না। আপনারা কেউ আমার তনয়ার খেয়াল রাখতে পারেন না। জাস্ট গেট লস্ট।
নার্স চলে যেতেই আয়াত তনয়াকে আলতো করে তুলে নিজের বুকের সাথে ঝাপটে ধরলো। তারপর খুব সাবধানে তনয়াকে ধরে ওর গায়ের জামাটা খুলতেই আয়াতের চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল তনয়ার কাঁধে পড়লো। তখন কিছু একটা চমৎকার হলো, তনয়া চোখের পাতা নাড়ালো, ওর চোখের কোন বেঁয়ে জল পড়ছে। তনয়া যতই অবচেতন থাকুক না কেন ওর আয়াতের হৃদয়ের ডাক ও ঠিক শুনতে পারে।
ডাক্তার বলছে তনয়ার শরীরের অবস্থা দিন দিন উন্নত হচ্ছে। এরকম রিকোভার করলে খুব শিঘ্রই তনয়া সুন্থ হয়ে উঠবে। আর বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
আয়াত তনায়ার শরীরটা মুছে দিয়ে ড্রেস বদলে বিছানায় শুয়ে দিলো। তনয়ার হাতদুটো ধরে হাতের পাতায় হাজারো চুমো একে দিয়ে বলল,
__আমি জানি তুমি খুব শিঘ্রই ঠিক হবে। আমার মনের তীব্র বিশ্বাস এটা।
দরজায় ছোট ছোট হাত দিয়ে টোকা দিলো। আয়াত দরজা খুলে দেখে অনন্দিতা মানে আয়াত তনয়ার দেড় বছর (প্লাস) মেয়ে। লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে রেখে যাকে সাত মাস বয়সে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলো। ডাক্তারদের জন্য এটা একটা বড় চ্যালেজ্ঞ ছিলো। কিন্তু ডাক্তাররা তাতে সফল হয়েছে।
দেড় বছরের অনন্দিতা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়ায়। আধো আধো ভাষায় কথা বলে। অন্দিতাকে কোলে নিয়ে আয়াত আদর করে তনয়ার পাশে বসলো। অনন্দিতা তনয়ার পাশে গিয়ে ওর বুকে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। বাচ্চারা আর কাউকে না চিনলেও মায়ের গন্ধ ঠিকভাবে চিনে।
আয়াত ভাবছে, তনয়া হয়ত জানেই না ওর আর আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেছে। আচ্ছা তনয়া কী নিজের সন্তানের জন্য একবার উঠতে পারেনা। উঠে একবারতো আমায় বলতে পারে মিঃ বস তুমি বড্ড পাজি। বড্ড জালাও আমায়।
একবারও বলোনা তনয়া।
আয়াতও অনন্দিতার দেখাদেখি তনয়ার পাশে শুয়ে পড়লো। তনয়ার হাতটা নিজের বুকের উপর নিয়ে বলল, খুব ইচ্ছা করে তোমার মাথাটা বুকে নিয়ে দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাটিয়ে দি। খুব ইচ্ছা করে তোমার পছন্দের জায়গাগুলোতে তোমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। খুব ইচ্ছা করে, ভরা পূর্ণিমার রাতে তোমায় কোলে নিয়ে পিছনের বাগানে হাঁটতে। তুমি অপলক চোখে তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে। আর আমি ঘোর লাগা চোখে তোমার নেশায় বুদ হবো। কিন্তু গত দু বছর পাঁচ মাস যাবত ইচ্ছা গুলো ইচ্ছাই রয়ে যায়। তোমার অভিলাষপানা তুমি আমার ভিতরেও ছড়িয়ে দিয়েছো। তুমি আজও অভিলাষী কিন্তু তোমার অভিলাষ গুলো অবেলার হয়েই রয়ে গেলো।
রাত এগারোটা,
অনন্দিতা রাতে ওর দাদির বুকে ঘুুমিয়ে পড়ছে। আয়াতের মায়ের পৃথিবী জুরে এখন শুধু অনন্দিতা। অনন্দিতা হবার কথা শোনার পর তিনি রোজ নামাজ পড়ে তনয়ার সুস্থতার জন্য দোয়া চায়। নামাজ পড়ে তনয়ার কপালে দোয়া পড়ে ফু দেয়। তিনি এখন মনে প্রাণে তনয়ার সুস্থতা চায়। হ্যাঁ মাঝে মাঝে আয়াতের কষ্ট দেখে রাগ হয় তনয়ার উপর। কিন্তু অনন্দিতার ফুটফুটে চেহারা দেখার পর রাগ নিমিষেই ভালোবাসায় পরিনত হয়।
আয়াজ নিজেকে সম্পূর্ণ রুম বন্ধী করে ফেলছে। অনুশোচনায় রোজ দগ্ধ হয়ে জ্বলছে আয়াজ। কেউ তার কারনটা জানে না। আয়াত গত দু বছর পাঁচ মাসে এক বারও আয়াজের সাথে কথা বলেনি।
৬৫!!
রাত একটা
আয়াত একটা গল্পের বই পড়ে তনয়াকে শুনাচ্ছে। তারপর তনয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
__বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তনয়া। তোমাকে খুব বুকে নিতে ইচ্ছে করছে।
আয়াত তনয়াকে আলতো করে তুলে নিজের বুকে তনয়ার মাথা ঠেকালো। তনয়া চোখের কোন বেয়ে জল পড়ছে। তনয়া এখন বুঝতে পারে সব, আয়াতের আর অনন্দিতার স্পর্শ পেলে হাত পা হালকা নাড়ার চেষ্টা করে। তনয়ার খুব ইচ্ছা করে বলতে আয়াত খুব ভালোবাসি তোমায়। আয়াত তনয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললো,
তোমায় বলতে হবে না আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো। আমিও তোমায় খুব ভালোবাসি অভিলাষী।
একটা কবিতা শুনবে তনয়া?
অবেলায় এসেছিলে বলে কি
এভাবে চলে যাবে?
প্রনয় তো হয়েছিলো,
তবে কেন দিলে বিচ্ছেদের ছোয়া?
ভালো তো তুমিও বেসেছিলে,
তবে কেন আজ নীরব হলে?
বুকে তো তুমিই ছিলে
তবে কেন আজ চলে যেতে চাইছো?
তবে কী ভালোবাসোনি আমায়!
মিথ্যা ছিলো তোমার প্রনয় কথা!
তবে কেন কাছে টেনেছিলে,
ভালোবাসার নতুন পৃথিবী দেখিছিলে
মানলাম তুমি অভিলাষী!
তাই বলে কী তোমার অভিলাষে আমায় কাঁদাবে।
কেন হলে অভিলাষী?
না হয় আমায় সাথে নিতে,
নাহয় তোমার প্রনয়ে আমি গা ভাসাতাম
তবে কেন হলে তুমি অবেলার অভিলাষী?
কেন করলে অবেলার অভিলাষ!
সাথী______
ভালোবাসার অনুভূতির কোন নাম, ভাষা, গন্ধ হয় না। শুধু একে অপরের অস্তিত্বে বিরাজিত থাকে। ভালোবাসা অভিলাষে অভিলাষী মানুষগুলো কখনো বেলা অবেলার খেয়াল করে না। ভালোবাসার কোন অভিলাষ অবেলার হতে পারে না। আর হোক না অবেলার অভিলাষ তাতে কি? ভালোবাসার অভিলাষ তো অবেলায়ও অনেক মধুর হয়।
——(সমাপ্ত)——