অলকানন্দা - পর্ব ২৬ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৭৬!!

একটা রাস্তা। আলো-আঁধারে নির্মিত। দেখতে অনেকটা কংক্রিটের রাস্তার মতোই। দুপাশে গাছগাছালির হিড়িক। মাথার উপরে আকাশের কোনো রং নেই। নেই মানে নেই। কিংবা থাকলেও সেটা কি রং মাহা ঠাউর করতে পারছেনা। মাহা হাঁটছে। কখনো কড়া রোদে তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কখনোবা অনেক অন্ধকারে মনে হচ্ছে মাহা তলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই চৈতির প্রতিচ্ছবি। কি সুন্দর মুখের গঠন! চুলগুলো ভিষণ সুন্দর। গাঁয়ে লালচে শাড়ি। উদাসীন হয়ে হাঁটছে রাস্তায়। মাহার চোখের কাছেই আবার মনে হয় যোজন যোজন দূরে। মাহা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। খুব জরুরি কথা আছে তার চৈতির সাথে। মাহা ডাকলো "চৈতি"। কিন্তু সে আওয়াজ শোনা গেলোনা। অতঃপর মাহা আবার ডাকার চেষ্টা করলো। গলায় মনে হচ্ছে কেউ দড়ি বেঁধে দিয়েছে। কোনো আওয়াজ বের হচ্ছেনা। বাকযন্ত্র শব্দ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ভুলে গিয়েছে। মাহা বহু চেষ্টা করেও মনে করতো পারলোনা কি করে শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। কি করে ভাষাকে প্রকাশ করতে হয়। কষ্ট হচ্ছে তার। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। কি আশ্চর্য! সে কথা বলা, শব্দ উচ্চারণ করা ভুলে গিয়েছে! আলোর তীব্রতা বেড়ে গেলো বহুগুণে। কানে বাজলো একটা সুর। মাউথ অর্গানের সুর। খুব পরিচিত মনে হলো সুরটা। কয়েকবার এই সুর শুনেছে সে। আবার অন্ধকার ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর একটা বালুচরে নিজেকে আবিষ্কার করলো মাহা। দূর-দূরান্তে কেবল বালু আর বালু। হালকা সোনালি রঙের বালুতে চিকচিক করছে চারদিক। এবারও চৈতি দাঁড়িয়ে। দূরে। মুখটা অস্পষ্ট। মাহা এগিয়ে গেলো তার দিকে। হাত বাড়াতে চাইলো। তবে চৈতি দূরে চলে গেলো আবার। হঠাৎ ক্ষীণ সুর ভেসে আসছে মাহার কানে। 
"মাহা? কেমন আছিস?"

মাহা কোনো কথা উচ্চারণ করতে পারলোনা। সে তো কি করে শব্দ উচ্চারণ করে বাক্য বলতে হয় তা ভুলে গিয়েছে। চৈতি মৃদু হাসলো। আবার জিজ্ঞেস করলো,
"কেমন আছিস?"

এবারে মাহা চুপ। এবার রেগে গেলো চৈতি। অদ্ভুতভাবে তার দেহ পরস্পর থেকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে মাথা, পরে হাত, পরে পা। ঐ যে মাহা যেমন ছিন্ন পা দেখেছিলো তেমন একটা পা মাহার দিকে ছুটে আসছে। চৈতির ছিন্ন মাথা হাসছে। মাহা ভয়ে চুপসে আছে। পা টা মাহার কাছাকাছি চলে এসেছে। মাহা দৌড় দিলো। পিছু ফিরে চাইলোনা আর। কিছুক্ষণের জন্য পা টা উধাও হয়ে গিয়েছে। মাহা থেমে একটু শ্বাস নিবে তখনই চতুর্দিক থেকে চৈতির পা গুলো তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। একেবারে কাছে আসতেই মাহা চিৎকার করার চেষ্টা করলো। এবার বাকযন্ত্র নিজের আগের রূপে ফিরে এসেছে। মাহার চিৎকার মাহা শুনতে পেলো। সেই সাথে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো মাহা। তড়তড় করে ঘামছে সে। পাশে চিন্তিত মুখে বসে আছে সার্থক। কিছু বলার চেষ্টা করছে। মাহা তো শুনতে পাচ্ছেনা! হঠাৎই সার্থক জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। মাহা নিজেকে ধাতস্থ করলো এবার। 

!!৭৭!!

আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো মাহা। পরিচিত ঘ্রাণটা নাকে যেতেই সজাগ হলো নিউরন। কেঁপে উঠলো বুক। মনে হচ্ছে তার আর কোনো ভয় নেই। মানুষটা আছেনা পাশে! যে মাহার মন, মস্তিষ্ক, হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছে ধীরেধীরে। মাহাও পরম নির্ভরতায় জড়িয়ে ধরলো সেই ব্যাক্তিটাকে। সার্থক চুমু খাচ্ছে মাহার এলোমেলো চুলে। গলার সুর নরম করে বললো,
"ভয় পেয়েছিলে?"
"ভিষণ।"
"কিসের ভয় মাহা? আমি আছি তো।"
"হুম।"

মাহার বাঁধন শক্ত হলো আরো। হঠাৎই নিভার শব্দে দুজন দুদিকে সরে বসলো। নিভা দরজার বাইরে থেকে প্রশ্ন করলো,
"ভাইয়া আসবো?"
"হুম, আসো।"

নিভা ভিতরে ঢুকে একনজর তাকালো মাহার পানে। সোনালী চুলগুলোকে কানে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
"তুমি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে ভাবি। এখন শরীর কেমন?"
"ভালো।"
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। রাস্তায় জ্বলে উঠছে সোডিয়াম লাইটগুলো। আবাসিক এলাকার আশপাশ নিরব। নিস্তব্ধ। নিভা সার্থক কে নিজের কাছে ডাকলো। 
"ভাইয়া, একটু শুনবে?"

মাহা খাটে হেলান দিয়ে বসে। সার্থক অবাক হলো খানিকটা। নিভার কাছে এসে বললো,
"কোনো জরুরি কথা আছে কি নিভা?"
"ভাইয়া, জিনিয়া আপু এসেছে।"
"জিনিয়া! মানে ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুম। আমার কলিগ?"
"হুম।"

সার্থক নিভার পানে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ এতরাতে এখানে কি ঐ মেয়ের। সার্থক মাহার দিকে তাকালো একবার। অতঃপর নিভাকে বললো,
"তুমি যাও।"
"ভাইয়া, উনি তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন।"
"হুম, যাও। আমি আসছি।"

গুরুগম্ভীর শোনালো সার্থকের গলা। মাহার খেয়ালে এসব নেই। ও খাটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। মাথাটা ভিষণ যন্ত্রণা করছে। সার্থক মাহার পাশে বসলো। মাহা নিজের মাথাটা হেলিয়ে দিলো সার্থকের কাঁধে। সার্থক মাহার হাতটা টেনে ধরে চুমু খেলো তাতে। 
"তুমি আরেকটু ঘুমাও। আমি একটু আসছি।"

মাহা অপর হাতে আঁকড়ে ধরলো সার্থকের বাদামি টি-শার্ট। এই অল্প সময়েই মাহার সকল নির্ভরতা সার্থক। মাহার চোখে মুখে ভয়। সার্থক মাহার সমস্ত মুখে আদর করলো। অতঃপর মুখে বললো,
"এই যাবো এই আসবো সোনা। একটু থাকো। আমি নিভাকে ডেকে দিচ্ছি।"

আলগা হয়ে এলো শার্টের আঁকড়ে ধরা বাঁধন। সার্থক বেরিয়ে যেতেই নিভা ঘরে প্রবেশ করলো হাসিমুখে। 

_________________

"কি প্রয়োজন?"
"তোমাকে।"

ভণিতা ছাড়াই বলে ফেললো জিনিয়া। সার্থক পাশের সোফায় বসে বললো,
"তাই নাকি!"

কন্ঠে কৌতুক তার। যেন জিনিয়ার কথায় খুব মজা পেয়েছে সে। পায়ের উপর পা তুলে তা নাচাচ্ছে সার্থক। জিনিয়াকে ভালো করেই চিনা তার। 
"ঝেড়ে কাশো। কি প্রয়োজনে এসেছো?"
"প্রয়োজন তো বললামই। তোমাকে চাই।"

সার্থক উঠে এসে জিনিয়ার সামনে দাঁড়ালো। ডানহাতটা চেপে ধরলো জিনিয়ার গালে। মুখে হাসি দিয়ে বললো,
"আবার বলো তো জিনিয়া।"

জিনিয়া বহুকষ্টে বললো,
"তোমাকে।"

সার্থকের হাত আরো শক্ত হলো এবার। জিনিয়ার অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ দিয়ে কয়েকফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। সার্থক হাত শক্ত অবস্থায় রেখেই বললো,
"এতটুকুতেই কষ্ট হচ্ছে জিনিয়া?"

জিনিয়া জবাব দিতে পারলোনা। সার্থক ছেড়ে দিলো জিনিয়ার গাল। এমিলিন দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সার্থক ডাকলো,
"এমিলিন।"

এমিলিন কাছে এলেন। সার্থক জিনিয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
"ম্যাডামের জন্য জুস নিয়ে এসো।"

এমিলিন কিছু না বলেই চলে যেতে নিলে সার্থক জিনিয়াকে প্রশ্ন করলো,
"তা কি খাবে সরি পান করবে জিনিয়া? রুহ আফজা নাকি কমলার জুস?"

জিনিয়ার কি হলো কে জানে উঠে দাঁড়ালো সে। পাশ থেকে ব্যাগটা নিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। 
"চলে যাচ্ছো যে?"

জিনিয়া কোনো প্রতুত্তর করেনি। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে হাসলো খানিকক্ষণ। অতঃপর গম্ভীর হয়ে তাকালো এমিলিনের দিকে। 

"ম্যাডামের জন্য স্যূপ করো এমিলিন।"

এমিলিন রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আর সার্থক চললো নিজের অলকানন্দার কাছে। 
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন