"আমি জিজ্ঞেস করছি কে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?"
উচ্চ স্বরে বলায় কিছুটা ঘাবড়ে উঠে ইনারা। ভয়ও পেয়ে যায় সে সভ্যের এমন রাগ দেখে। সভ্যের রাগ সে আগে দেখেছে কিন্তু এমন রাগান্বিত মুখ আগে সে দেখে নি।
ইনারা এখন সত্যিটা তো বলতে পারে না। কিন্তু সভ্যের রাগ দেখে কথা ঘুরানোর সাহসও তার হয় না। তাই সে মিথ্যাটাই বলে, "ওই আ...আমার ভুলেই হয়েছে?"
"তোমার ভুলে? আর তা কীভাবে?"
"আহা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে দেখি ব্রেসলেটটা ভেঙে গেল।"
সভ্য গম্ভীরমুখে এগিয়ে এসে ইনারার চোখে চোখ মিলিয়েই বলল, "কেবলমাত্র আমার পরিবারের পরিচয় অজানা থাকায় মেয়েরা আমাকে মিসট্রিরিয়াস প্রিন্স বলে অভিহিত করে। বাট গেস হোয়াট? তোমার মতো রহস্যের খনি আমি আগে দেখি নি। তুমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তবুও ডিজাইনার গাউন পরেছ ! আচ্ছা তোমার কাছে এত দামী পাথর লাগানো ব্রেসলেট কীভাবে এলো? চাপ না দিলে হঠাৎ করেই ব্রেসলেট ভেঙে তোমার হাতে ঢুকে যায়? অবুঝ পেয়েছ আমাকে? তুমি জানো আমি মিথ্যা বচন অপছন্দ করি কিন্তু তুমি মিথ্যা ছাড়া কিছুই বলো না।"
বলে থামলো সভ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। তারপর পকেট থেকে তার রুমাল বের করে ইনারার হাতে বাঁধতে বাঁধতে শান্ত গলায় বলে, "তুমি কি লুকাচ্ছ আমি জানি না। তবে জানো আমি চাইলে পাঁচ মিনিটে তোমার বংশের ইতিহাস বের করতে পারি। কিন্তু তা আমি করব না। তোমার জীবন নিয়ে আমার হস্তক্ষেপ করাটা অনুচিত হবে। যেদিন তোমার মনে হবে আমি তোমার সত্যিটা জানার যোগ্য, সেদিন আমাকে বলো। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকবো।"
ইনারার কপালে শঙ্কার রেখা আঁকে। সে জিজ্ঞেস করে, "একটু বাড়িয়ে বললেন না? পাঁচ মিনিটে আমার বংশের পরিচয় বের করতে পারবেন? ব্যাপারটা যে কারও জন্যই অসাধ্য।"
সভ্য বাঁকা হাসে,"এ ব্যাপারে তোমার না ভাবলেও চলবে। আমি তোমার ব্যক্তিগত জীবনে কখনোই ঘাটাঘাটি করব না।"
"আপনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কী?"
সভ্য এবার চোখ তুলে তাকায় ইনারার দিকে, "কেন? তোমার হঠাৎ আমার সম্পর্কে এত জানার ইচ্ছা জাগলো কেন? আমার বউ হবার শখ জেগেছে না'কি?"
সভ্যের কথায় থতমত খেয়ে যায় ইনারা, "না এ-কি বলছেন? আপনার কথা শুনে আগ্রহ জাগে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।"
"তাই? আচ্ছা যাও তোমার কথাই মেনে নিলাম। আর উওর সঠিক সময় হলে আপনা-আপনি পেয়ে যাবে। বেশি ব্যাথা করছে? ডাক্তারের কাছে যাবে?"
"ইশশ এতও লাগে নি। আপনি অকারণে চিন্তা করছেন।"
"তুমি অকারণে বিপদ ডেকে আনো তাহলে আমি অকারণে চিন্তা করবো না।"
"এহ আসছে, কে বলল আপনাকে আমার চিন্তা করতে?"
সভ্য তার পকেটে হাত দিয়ে ইনারার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ায় এবং বলে, "তো কে করবে শুনি?"
সভ্যের হঠাৎ এত কাছে আসাটা ইনারাকে অপ্রস্তুত করে দেয়। সভ্যকে এতটা কাছে দেখে তার আকর্ষণ থেকে রেহাই পায় না সে। নীল স্যুটে তার আকর্ষণীয়তা আরও বেড়ে গেছে। তার আকর্ষণীয়তা ইনারার কিশোরী মনের ভেতর উথাল-পাথাল করে দেয়। সে নিজ অজান্তেই সভ্যকে বলে ফেলে, "স্যুটে আপনার হ্যান্ডসামনেস হাজারোগুণ বেশি বেড়ে যায়।"
বলে নিজেই জিহ্বায় কামড় দেয়। এ কি বলে ফেলল সে? পাগল হয়ে গেল না'কি!
সভ্যেরও চোখ দুটো বড় বড় হয়ে পড়ে। আজ প্রথম ইনারা সরাসরি তার প্রশংসা করল। তাকে এই প্রথমবার হ্যান্ডসাম বলল। তার নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। সে অবিশ্বাস্য সুরে জিজ্ঞেস করে, "কি বললে তুমি? আমি মনে হয় ভুল শুনেছি। আবার বলো তো।"
"ওখানে তো পার্টি চলছে। ওদিকে যাওয়া উচিত এইবার। সকলে হয়তো অপেক্ষা করছে আমাদের। না পেয়ে খুঁজতেও পারে।"
ইনারা সামনে যেতে নিলেই সভ্য তার বাহু ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে এবং বলে, "আমার উওর দেওয়া ছাড়া কোথাও যাচ্ছ না তুমি। তুমি কি মাত্র আমাকে হ্যান্ডসাম বলেছ? তোমার কাছে আমাকে হ্যান্ডসাম লাগে?"
"এই সামান্য কথাটা এত বড় করার কি আছে? সকলেই তো আপনাকে হ্যান্ডসাম বলে।"
"কিন্তু তুমি তো আলাদা।"
মৃদু স্বরে বলে সভ্য। ইনারা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। পরক্ষণেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়।
সভ্য ইনারার হাত ধরে বলে, "তবে একটা কথা বলি?"
"হঁ"
"তোমাকে যে আঘাত দিয়েছে সে তোমাকে ভালোবাসে না। আমাদের ভালোবাসার মানুষকে কখনো আমরা এভাবে আঘাত দিয়ে ছেড়ে যেতে পারি না।"
কথাটায় ইনারার হৃদয়েও আঘাত লাগে। সভ্য এমনটা বলতে পারে কিভাবে? ঠিকাছে তার বাবা নারাজ হতে পারে কিন্তু তাকে ভালোবাসে না এমনটা হতেই পারে না। সকল মা বাবাই তো তাদের ভালোবাসে। নারাজ হলে মানুষ ভুল কতকিছুই তো করে ফেলে বা বলে থাকে তাই বলে কি তার বাবা তাকে ভালোবাসে না? কথাটা ভাবতে তার যত রাগ উঠে তার থেকে বেশি কষ্ট হয়।
ইনারার রাগ ও কষ্ট তার মুখে স্পষ্ট ভেসে উঠে। সে সভ্যের বুকে হাত রেখে তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলে, "আপনি ডিসাইড করার কে? কে আমাকে ভালোবাসে আর কে না তা আমার বিষয়, আপনার না।
ইনারা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে সেখান থেকে চলে যায়। সভ্য বিব্রত হয়ে যায়। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। সে কি ভুল কিছু বলে ফেলেছে? সে ছুটে গেল ইনারার পিছনে।
ইনারা পার্টিতে ফিরে এসে রাগে হেঁটে যাচ্ছিল। এমন সময় কেউ এসে তার হাত ধরে নেয়। ইনারা ভাবে মানুষটা হয়তো সভ্য। তাই সে গলায় বলে, "বলেছি আপনার সাথে আমি কথা বলব না। যান তো।"
"আমি কী করেছি তোমার সাথে?"
কন্ঠটা শুনে ইনারা অবাক হয়। পিছনে ফিরে দেখে জোহান দাঁড়ানো। সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে আশা করেছিল সভ্যকে। সে বলে, "আপনি?"
"কেন অন্য কারো আশায় ছিলে না'কি?"
"না তো। আমি অন্য কার আশা থাকব!"
"আচ্ছা এসব কথা বাদ দেও। আমার সাথে আসো।"
"কোথায়?"
"আহা আসো না। স্যারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।"
জোহান ইনারার হাত ধরে তার সাথে নিয়ে যায়। ইনারা বিরক্ত হয় ভীষণ। এভাবে তাকে কোথাও নেওয়ার মানে হয় না। সে জিজ্ঞেস করে, "কোথায় নিচ্ছেন তা তো বলবেন।"
"দেখলেই বুঝতে পারবে।"
জোহান ইনারাকে দরজার বাহিরে নিয়ে গেল। ইনারা বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করে, "এবার বলবেন কি কারণে এখানে এনেছেন আপনি?"
"কেউ তোমার সাথে দেখা করার জন্য খুব ব্যাকুল। তার সাথে দেখা করানোর জন্য এনেছি।"
"কে?"
জোহান ইনারার কাঁধ ঘুরিয়ে তাকে পিছনে ফেরায়। ইনারা দেখে সৌমিতা আন্টি সেখানে দাঁড়ানো। তাকে দেখে ইনারা কিছু মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখে জল ভেসে উঠে। সে দৌঁড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে সৌমিতা আন্টিকে। কান্না করে উঠে। কেন যেন সৌমিতা আন্টির মাঝে তার মা'য়ের ছোঁয়া পায় ইনারা। তাই আবেগি হয়ে উঠে। অঝোরে কান্না করতে শুরু করে।
সৌমিতা আন্টিও ইনারাকে দেখে অবিশ্বাস্য ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইলো। তাকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, "ইনু মামনি কেমন আছিস তুই? কতদিন পর দেখলাম তোকে। এতদিন বুঝি আন্টির কথা একটিবার মনে পড়ে নি?"
ইনারাও কাঁদোকাঁদো গলায় উওর দেয়, "আন্টি আপনিই বলেছিলেন আমাকে কল দিবেন। আর দিলেন না।"
"বলছ কি? আমি কতবার কল দিয়েছি তোমার বাসায়। তোমার ফুপি বলল তুমি আমার সাথে কোনো কথা বলতে চাও না।"
চমকে উঠে ইনারা। সে সৌমিতা আন্টিকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়।
"ফুপি বলেছে?" বিস্মিত সুরে বলে ইনারা, "কিন্তু উনি মিথ্যা কেন বলবে? আমি তো আরও শ্রীমঙ্গল থেকে আসার পর অনেকবার ঘরের সকলকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কল করেছিলেন কি-না! প্রতিবার উওর না এ পেয়েছি।"
ইনারা এবং সৌমিতা আন্টি দুইজনকেই বিব্রত দেখাল।
.
.
.
চলবে..............................