আকাশ মেঘলা। ঘনকালো অন্ধকার আকাশের অনেকটা জুড়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তেই শুরু হবে ঘন বর্ষণ। ওরা মিহির বাসায় এসেছে মাত্র। মিহি ব্যস্ত হয়ে সবাইকে খাবার দিচ্ছে। তমা নিজেও মিহিকে কাজে সাহায্য করছে। সৈকতও টুকটাক কাজ করে দিচ্ছে। মাহির নিজাম ইসলামের কোলে বসে খেলছে। তরু সোফার এক কোণে বসে ফোন চাপছে। হয়তো শিশিরের সাথে চ্যাটিং করছে। নিহি দাঁড়িয়ে আছে মিহির রুমের বারান্দায়। এখান থেকে সরাসরি আমানের ঘরের বারান্দা দেখা যায়। বারান্দার দরজা আটকানো। আমান বাড়িতে নেই ফোন করে জানিয়েছে। তবে অফিস থেকে বের হয়েছে। গাড়িতে আছে এখন। নিহির মন পড়ে আছে অন্যদিকে। কোনোদিকেই হিসাব মিলাতে পারছে না।
প্রবলবেগে বাতাসও বইতে শুরু করেছে। নিহির মন ঘুরে যায় এবার। ব্যস্ত হয়ে পড়ে আমানের জন্য। মানুষটা বৃষ্টিতে ভিজেই আসবে নাকি কে জানে!
"আরে নিহিমনি যে! বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমানের অপেক্ষা করছো নাকি?"
নিহি পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে সৈকত দাঁড়িয়ে আছে। মুখে চাপা হাসি। নিহি নিজেও হেসে বলে,
"না দুলাভাই।"
"বুঝি, বুঝি। হয়, হয় এমন হয়। আগে অফিস থেকে আসার সময় হলে তোমার আপাও আমার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতো।"
"কিন্তু আমি করছি না।"
"মিথ্যা বলে লাভ নেই শালীকা। আর ভয় নেই। কথা হয়েছে মাত্রই। এসে পড়বে প্রায়। তুমি খাবে চলো।"
"উনি আসুক!"
সৈকত বুকের ওপর হাত রেখে বলে,
"আহা! উনি আসুক। কী ভালোবাসা।"
"দুলাভাই!" লজ্জা পেয়ে নিহি সৈকতের পিঠে কিল বসায়। সৈকত শব্দ করে হেসে ফেলে। তারপর বলে,
"আচ্ছা অপেক্ষা করো। কিন্তু সবার সাথে বসে কথা তো বলবে।"
"আচ্ছা চলেন।"
ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসতেই ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামা শুরু করে। নিহির মনটা আনচান করছে। নিশ্চয়ই ভিজে আসবে আজ। আমান আসলো বৃষ্টি আসারও ১০ মিনিট পর। মাথা ভিজেছে। আর শার্টে অল্প অল্প পানির ছাঁট। বাম হাতে চুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে নিজাম ইসলাম ও সালেহা বেগমকে সালাম দিয়ে সৈকতের পাশে বসে। সালেহা বেগম ব্যস্ত হয়ে বলেন,
"তুমি তো ভিজে গেছ বাবা।"
"গাড়ি থেকে নামার সময় একটু বৃষ্টির পানি পড়েছে।"
"তাড়াতাড়ি মাথা মুছে নাও। নয়তো ঠান্ডা লাগবে।"
এরপর মিহিকে ডেকে বলেন,
"মিহি রে আমানকে তোয়ালে দিয়ে যা।"
মিহি রান্নাঘরে ছিল। সৈকত বলে,
"ও তো রান্না করছে মা। নিহি যাক।"
নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
"যাও তো নিহি।"
নিহি একবার বাবা-মায়ের দিকে তাকালো। তারা নিজেদের মাঝে কথা বলছেন। সৈকতের দিকে তাকাতেই সৈকত চোখ টিপ দেয়। নিহি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সৈকত মুচকি মুচকি হেসে বলে,
"যাও, যাও।"
নিহি কিছু না বলে সৈকত আর মিহির ঘরে যায়। পেছন পেছন আমানও আসে। ওয়ারড্রব থেকে একটা নতুন তোয়ালে বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
"গাড়ি থেকে নামার সময় ছাতা নিয়ে বের হওয়া যায় না? নাকি ছাতাও নেই? এত এত টাকা ইনকাম করে কী করেন? একটা ছাতা কিনতে পারেন না?"
একদমে কথাগুলো বলল সে। তোয়ালে ধরে দাঁড়িয়ে রইল আমান। এরপর ফিক করে হেসে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলে,
"আরে পাগলী গাড়ি থেকে তো বাড়ির সামনেই নেমেছি। এইটুকুতেও ছাতা লাগে নাকি?"
"না। ঘেচু লাগে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসেন। আমি যাই।"
নিহি চলে যাওয়ার জন্য পেছনে ফিরে দাঁড়ায়। এক কদম এগোতেই তোয়ালে দিয়ে পেছন থেকে নিহিকে আটকে ধরে আমান। নিহিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"এত রাগ কেন হয়েছে?"
"জ্বর আসলে তখন?"
"আসবে না।"
"মিথ্যা বলবেন না। আমি জানি আপনি বৃষ্টিতে ভিজতে পারেন না।"
"তাই? তা কে বলল শুনি?"
"টুকটুকি আর আবুল ভাই।"
"একটু ভিজলে কিছু হয় না।"
"মানে কী? আপনি কি চান জ্বর আসুক?"
"উম! আগে চাইতাম না। কিন্তু এখন চাই।"
"কেন?" অবাক হয়ে জানতে চায় নিহি।
"আগে তো তুমি ছিলে না। এখন তুমি আছো।"
"আমার সঙ্গে জ্বরের কী সম্পর্ক?"
"বোকা মেয়ে! বোঝে না।"
"না বুঝি না। বুঝান।"
"জ্বর আসলে তুমি সেবা করবে। কাছে কাছে থাকবে। তাই চাই জ্বর আসুক।"
"ইশ! ঠেকা আমার। করব না সেবা।"
"সত্যিই করবে না?"
"না।"
"তাহলে যাই বৃষ্টিতে ভিজি। তারপর জ্বর আসুক। দেখি কেউ আমার সেবা করে কি না!"
"মেরে ফেলব একদম।"
তিতির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তখন জিজ্ঞেস করে,
"তোমরা কী করো?"
সঙ্গে সঙ্গে দুজন তখন দু'দিকে ছিটকে সরে যায়। আমান কী করবে না করবে বুঝতে না পেরে ওয়াশরুমে চলে যায়। নিহি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জোরপূর্বক হেসে বলে,
"কিছু না আম্মু। তুমি এখানে কেন? কিছু লাগবে?"
"ফুপি মনি খেতে ডাকে।"
"আচ্ছা চলো।"
যাওয়ার আগে ওয়াশরুমের দরজায় নক করে বলে,
"আমি ডাইনিং রুমে গেলাম। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।"
ভেতর থেকে আমান উত্তর করে,
"যাও।"
তিতির ডেকেই চলে গেছে। মিহি টেবিলে খাবার গুছাতে গুছাতে জিজ্ঞেস করে,
"কী হলো? আসেনি?"
"আসতেছে!"
"কী যে করে! আমান অফিস থেকে আসছে। আগে খেয়ে নিবে। তা না!" বিরক্তির স্বরে বিড়বিড় করে বলে মিহি। তিতিরের কানে কথাটা যায়। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,
"আমি গিয়ে দেখি আঙ্কেল ফুপিকে তোয়ালে দিয়ে বেঁধে রেখেছে!"
নিহি ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই তিতিরের কথাটা কানে আসে। উপস্থিত সকলেই অবাক হয়। মিহি জিজ্ঞেস করে,
"তোয়ালে দিয়ে বেঁধে রেখেছে মানে?"
নিহির কান দিয়ে মনে হচ্ছে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবাই ওর দিকে তাকাচ্ছে। ইচ্ছে করছে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে। আল্লাহ্ গো! এমন পাকনা মেয়ে কাউরে দিও না। সৈকত নিচে গিয়েছিল নীলমকে আনতে। ভেতরে এসে মিহির কথা শুনে নিহির দিকে তাকায়। নিহির লজ্জায় লাল হওয়া মুখটা দেখেই সৈকত আন্দাজ করতে পেরে বলে,
"আরে ধুর! তুমিও ওর কথায় নাচা বন্ধ করো। খাবার দাও তাড়াতাড়ি।"
এরপর চোখের ইশারায় বিড়বিড় করে। মিহি বুঝল কী না জানা নেই। তবে এটা নিয়ে আর কথা বাড়ালো না। এর মাঝে আমানও চলে আসে। নিহির কাছে এসে বলে,
"দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো।"
নিহি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,
"চলো।"
নিজাম ইসলাম আমানকে নিজের পাশের চেয়ারে বসতে বলেন। আমান চেয়ার টেনে বসতে যাবে তখন তিতির চেঁচিয়ে বলে,
"ফুপা তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না, না? আমান আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করো। আঙ্কেল ফুপিকে তোয়ালে দিয়ে বেঁধেছিল নাকি!"
আমানের আর বসা হলো না। সোজা দাঁড়িয়ে পড়ে। সবার দিকে তাকিয়ে নিহির দিকে তাকায়। নিহির ইচ্ছে করছে লজ্জায় মরে যেতে এখন। তিতির দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। আবার বলে,
"বলো আমান আঙ্কেল বলো তুমি। আমি ঠিক বলছি না?"
আমানের এখন পড়ি কী মরি অবস্থা! এইটুকুন বাচ্চা কাকে কী বোঝাচ্ছে। আল্লাহ্ দড়ি ফেলো, উপরে উঠে যাই আমি। পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে এখন। সৈকতও বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। পুরো বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে সাহায্য করে তমা। নীলমকে জিজ্ঞেস করে,
"তুমি কি আবার অফিসে যাবে?"
"হ্যাঁ। দু'ঘণ্টার ছুটি নিয়ে এসেছি।" নীলমের উত্তর।
সালেহা বেগম এবার তাড়া দিয়ে মিহিকে বলেন,
"মিহি দেড়ি করিস না আর। খাবার বাড়।"
"দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো তুমি।" আমানকে বলেন নিজাম ইসলাম।
আমানের মুখের অবস্থা লজ্জামিশ্রিত ফ্যাকাসে। এমন লজ্জার মুখে পড়তে হবে ভাবেনি। কিছু না বলে পাশের চেয়ারে বসে। নিহি বসে নীলমের পাশের চেয়ারে। খেতে বসে মনে মনে একশোটা গালি দিচ্ছে আমানকে। সবসময় এত কীসের রোমান্স! এখন কী একটা লজ্জাকর কাহিনী হয়ে গেল। মাবুদ!
_________________
খাওয়ার পর্ব শেষ করে সকলে মিলে গল্পগুজব করে কিছুক্ষণ । নিহি আর তরু বাদে বাকি সবাই নীলমের সঙ্গে চলে যায়। সবাইকে এগিয়ে দিয়ে আমান যায় নিজের বাড়িতে। নিহি কোমরে ওড়না বেঁধে আমানের ফ্ল্যাটে আসে। দরজা খুলে দেয় আবুল। নিহিকে দেখে একগাল হেসে সালাম দিয়ে বলে,
"কেমন আছেন আপামুনি?"
"আলহামদুলিল্লাহ্ ভাই। পরে কথা বলি।" সালামের উত্তর নিয়ে এইটুকু বলেই আমানের রুমে যায়। দরজা লক করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আমান বিছানায় পা ঝুলিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।
নিহির উপস্থিতি টের পেয়ে আমান বলে,
"সাপের মতো হিসহিস করছো কেন?"
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে নিহি বিছানার উপর উঠে আমানের গলা চেপে ধরে বলে,
"কী বললেন? কী বললেন আপনি? আমি সাপের মতো হিসহিস করি?"
আমান নিহির হাত ধরে হাসতে হাসতে বলে,
"যেভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলে ওমনই মনে হচ্ছিল।"
"আমি সাপ হলে আপনি কী হ্যাঁ?"
"সাপুড়ে। আমি বীণ বাজাবো। তুমি নাচবে আর গান গাইবে,'মে তেরি দুশমন, দুশমন তু মেরি। মে নাগিন তু সাপুড়ে.. মে নাগিন তু সাপুড়ে!"
নিহি আরো রেগে গিয়ে বলে,
"এখানে আমি নাগিন নাগিন খেলতে আসিনি কুত্তা!"
"ছিঃ! পঁচা মেয়ে। জামাইকে কেউ কুত্তা বলে? জান ডাকবা।"
"হ্যাঁ, ঐ আশাতেই থাকেন। আসছি জান কবজ করতে।"
নিহিকে এবার বালিশে শুইয়ে দিয়ে নিজে নিহির পাশে উপুড় হয়ে শোয় আমান। একহাতে নিহির দু'হাত ধরে রেখেছে। রাগে নিহি জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। আমান জিজ্ঞেস করে,
"হয়েছে কী? এত রেগে কেন আছো বলো।"
"আবার জিজ্ঞেস করেন! আপনার জন্য আজ সবার সামনে লজ্জা পেতে হলো আমার।"
"আমার কী দোষ? আমি কি জানতাম নাকি তিতির তখন চলে আসবে!"
"জানা উচিত ছিল। আচ্ছা জানেন না ভালো কথা। আপনার অত রোমান্টিক হওয়া লাগবে কেন তখন? দরজা খোলা ছিল দেখেননি?"
"ওহ! তাইতো। আচ্ছা স্যরি। এরপর থেকে দরজা লাগিয়ে নেব।"
আমানের পিঞ্চ মেরে বলা কথায় নিহি আরো রেগে যায়। উঠে বসার চেষ্টা করে বলে,
"এই সরেন তো আপনি। অসহ্য!"
"ওমা! এখন রাগ করো কেন? আমি তো তোমার কথাই মেনে নিলাম। এই ওয়েট, দরজা লাগিয়ে আসি।"
এরপর পেছনে তাকিয়ে আবার নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
"ওলে বাবা! তুমি দরজা লাগিয়েই এসেছো দেখি। মানে প্রিপারেশন নিয়েই এসেছো।"
নিহিকে ক্ষেপাতে আমানের ভালো লাগছে। নিহি যত রাগ করছে আমানের তত ভালো লাগছে আর হাসছে। ঐদিকে রাগে ইচ্ছে করছে আমানকে মেরে ফেলতে। দাঁত কটমট করে নিহি বলে,
"একবার শুধু হাত দুটো ছেড়ে দেখেন কী করি!"
"জানি তো আদর করবে।"
"আদর? মেরে ফেলব আমি আপনাকে। সত্যিই মেরে ফেলব।"
আমান এবার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
"মারো তো দেখি!"
নিহি বিছানা থেকে নামতে যাবে তখন আমান আবার টেনে নিহিকে শুইয়ে দেয়। হাত চেপে ধরে বলে,
"আমায় মেরে ফেলার কথা ছিল। চলে যাওয়ার কথা নয়।"
"ধুর! মারবই তো। অস্ত্র নিয়ে আসি।"
"আমায় মারার জন্য তোমার আবার অস্ত্র লাগবে নাকি? তুমি নিজেই তো যথেষ্ট। একটা চুমু দিয়ে দাও। আমি মরে যাই।"
"ধ্যাত!"
"বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখো..." বলে নিহির ওষ্ঠদ্বয় নিজের ওষ্ঠাগত অধীনে নিয়ে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় নিহি। নিহিকে ছেড়ে দিয়ে আমান হাত ছড়িয়ে বালিশে শুয়ে পড়ে বলে,
"এই দেখো আমি মরে গেলাম।"
নিহি ক্ষেপে বলে,
"ইউ রাবিশ!"
আমান এবার একহাতের ওপর মাথায় ভর দিয়ে শুয়ে নিহির গাল টেনে দিয়ে বলে,
"একটা চুমুর বিনিময়ে যদি রাবিশ ডাক শুনতে হয়, তাহলে আমি হাজারবার রাবিশ ডাক শুনতে চাই।"
আমানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিহি দরজা খুলে বাইরে চলে যায়। আমান হাসতে থাকে অনবরত।
.
.
.
চলবে.......................................