অবেলার অভিলাষ - পর্ব ১৩ - শারমিন আক্তার সাথী - ধারাবাহিক গল্প


তনয়া কিছু না ব‌লে চুপচাপ আয়া‌তের কে‌বিন থে‌কে বাই‌রে চ‌লে আস‌লো। ভিষন কান্না পা‌চ্ছে। আয়াত ওকে সন্দেহ কর‌তে পার‌লো? সেটা ভে‌বেই কষ্ট লাগ‌ছে। ভিতর থে‌কে ঠে‌লে কান্না আস‌ছে। 

তনয়া কে‌বিন থে‌কে বের হ‌তেই অফি‌সের দু‌টো মে‌য়ে ম‌নি আর লিজা তনয়া‌কে শু‌নি‌য়ে শু‌নি‌য়ে বল‌ছে,

__জা‌নিস ম‌নি আমি তিন বছর যাবত এ অফি‌সে আছি অথচ বস আমায় এক‌দিনও তার গা‌ড়ি‌তে লিফট দি‌লো না। আমি তার পার‌মিশন ছাড়া এক‌দিন কে‌বি‌নে ঢোকায় কী রাগটাই না কর‌ছি‌লো! আর আমা‌কে যখন তখন কে‌বি‌নেও ডা‌কেনা। কিন্তু কিছু মানুষ জ‌য়েন করার ক‌য়েক মা‌সের ম‌ধ্যেই ব‌সের এত ক্লোজ হ‌য়ে গে‌ছে যে, বস তা‌কে গা‌ড়ি‌তে লিফট দেয়, যখন তখন কে‌বি‌নে ডে‌কে নেয় রহস্য কী‌রে ম‌নি? আমরা কেন ব‌সের ক্লোজ হ‌তে পা‌রিনা?

__আ‌রে বু‌ঝিস না লিজা, আমরা তো বস‌কে বিছানায় স্যা‌টিসফ্যাইড কর‌তে পা‌রিনা। য‌দি পারতাম ত‌বে আমরাও ক্ল‌োজ থাকতাম। সবার তো সম্মান বোধ নেই তাই না লিজা।

তারপর তনয়া‌কে শুনি‌য়ে শু‌নি‌য়ে আরো ক‌য়েকটা বা‌জে কথা বলল। তনয়া ওদের দি‌কে একবার তা‌কি‌য়ে কে‌বি‌নে এসে চুপচাপ ব‌সে রইল। এত কান্না প‌াচ্ছে যে, চেষ্টা ক‌রেও চো‌খের জল আটকা‌তে পার‌ছেনা। তনয়া সারা দি‌নে আয়া‌তের কে‌বি‌নে গে‌লোনা। আয়াত কোন কা‌জে ডাক‌লে তা পিয়‌নের মাধ্য‌মে ক‌রে দি‌ছে। আয়া‌তের রাগটা এখনও ক‌মে‌নি তাই বুঝ‌তে পার‌ছেনা  আস‌লে ভুলটা তনয়ার না। 

সন্ধ্যাবেলা অফিস থে‌কে বের হ‌তেই আয়াত গা‌ড়ির দড়জা খু‌লে দি‌লো। তনয়া দড়জাটা বন্ধ ক‌রে সিএন‌জি ডে‌কে তা‌তে উঠে চ‌লে গে‌লো। আয়া‌তের রাগটা আরো বে‌ড়ে গে‌লো। নি‌জের রাগটা দ‌মি‌য়ে বা‌ড়ি চ‌লে গে‌লো। রা‌তে খাবার পর তনয়া‌কে ফোন দি‌লে তনয়া ফোন বারবার কে‌টে দেয়। তনয়ার ফোনটা আছাড় মে‌রে ‌ভে‌ঙে ফেল‌তে নি‌য়েও ভাঙ‌লোনা। ভাব‌লো এখন ফোন ভাঙার মত বিলা‌সিতা ওর শোভা পায়না। নি‌জের জ‌বের টাকায় কোন ম‌তে চ‌লে যায়। বা‌ড়ি থে‌কে পালা‌নোর সময় বাবার লকার থে‌কে যে টাকা আন‌ছি‌লো তা তনয়া ফি‌রি‌য়ে দি‌য়ে‌ছে। তনয়া এ পর্যন্ত পাঁচবার ওর বাবার পা ধ‌রে ক্ষমা চে‌য়ে‌ছে কিন্তু সে তনয়া‌কে মাফ ক‌রে‌নি। বাবারা এত পাষান হয় তনয়ান জানা ছি‌লো না। তাই তনয়া ওর বাবার সব টাকা পা‌ঠি‌য়ে দেয়। সা‌থে ওর গা‌য়ে যে, গয়না ছি‌লো সেগু‌লোও। ওর দাদাভাই, মেজদাভাই বা তানভী কা‌রো থে‌কেই কোন হেল্প নেয়না। আয়াত হেল্প কর‌তে চায় কিন্তু তনয়ার আত্মসম্মান বোধ দে‌খে সাহস পায়না। তারপরও তনয়ার অগোচ‌রে আয়াত তনয়া‌কে অনেক হেল্প ক‌রে।

এত বড় ফ্ল্যাটটা যে‌নো তনয়াকে চে‌পে ধর‌ছে। তনয়া দুপু‌রেও কিছু খায়‌নি, রা‌তে শুধু দুটো টোস্ট চা‌য়ে ডুবি‌য়ে খে‌য়ে‌ছে। তনয়া কান্না কর‌ছে আর বল‌ছে,
__আয়াতও আমায় বুঝ‌লো না। সবাই কেন আমার থে‌কে দূ‌রে চ‌লে যায়? আমি কী এতটাই খারাপ? নাহ্ থাক‌বোনা কা‌রো কা‌ছে। চ‌লে যা‌বো সবার থে‌কে দূ‌রে। অনেক দূ‌রে।

তনয়া সকা‌লের নিউজ পেপারটা হা‌তে নি‌লো, সি‌লে‌ট আর ঢাকায় দু‌টো জ‌বের বিস্তারিত দেয়া ছি‌লো। রা‌তেই সেখানে ফোন ক‌রে সব কিছুর বিষ‌য়ে জে‌নে নি‌লো। সকা‌লে সেখা‌নে জ‌বের জন্য অনলাই‌নে আবেদন কর‌বে। কেউ যখন ওকে দেখ‌তে পা‌রেনা তখন ও কেন সবার মা‌ঝে থাক‌বে?
সারা রাত এমন সাত পাঁচ অভিমানী চিন্তা কর‌তে কর‌তেই চ‌লে গে‌লো। 

সকা‌লে উঠে, আবার এককাপ চা আর দু‌টো বি‌স্কেট খে‌য়ে বে‌রি‌য়ে পড়লো অ‌ফি‌সের উদ্দে‌শ্যে। অফিস যাবার আগে ক‌ম্পিউটা‌রের দোকা‌নে গি‌য়ে ঢাকা আর সি‌লেট দু জায়গার ফরমই পূরন কর‌লো। অফি‌সে এসে নি‌জের রে‌জিগ‌নেশন লেটার টাইপ কর‌লো। আয়াত বারবার দরজার দি‌কে তাকা‌চ্ছে তনয়া‌ আস‌ছে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু তনয়া আজ‌কেও সব কাজ পিওন‌কে দিয়েই করা‌লো। 

দুপু‌রে লান্স টাই‌মে আয়াত ক্যা‌ন্টি‌নে খে‌তে গি‌য়ে তনয়ার পা‌শে বস‌লো। তনয়া চুপ ক‌রে উঠে অন্য টে‌বি‌লে গি‌য়ে ব‌সে খাওয়া শেষ ক‌রে চ‌লে গে‌লো। আয়া‌তের দি‌কে একবার তাকা‌লোও না। আয়া‌তের রাগটা অনেকটা ক‌মে আস‌ছে। তনয়া‌কে দে‌খেই আয়া‌তের কষ্ট হ‌চ্ছে এক‌দি‌নেই চেহারাটা কেমন নিষ্প্রাণ হ‌য়ে গে‌ছে। 
র‌শ্মিও গত মা‌সে জব ছে‌ড়ে দি‌ছে। আস‌লে তা‌মিম বা র‌শ্মির বাবা মা চায়না র‌শ্মি জব করুক। আর র‌শ্মি তা‌মিম‌কে পাগ‌লের মত ভা‌লোবাসায় তা‌মি‌মের সব কথা মে‌নে নেয়। র‌শ্মি আর তা‌মি‌মের বি‌য়েও ঠিক হ‌য়ে‌ছে। র‌শ্মির বড় ভাই দে‌শের বা‌হি‌রে থা‌কে সে আস‌লে বি‌য়ে হ‌বে। র‌শ্মি চ‌লে যাবার পর তনয়া অফি‌সে একদম একা হ‌য়ে গে‌ছে।

দুপু‌রের পর তনয়া আমজাদ হো‌সে‌নের কে‌বি‌নে গি‌য়ে বলল, 
__স্যার কিছু কথা ছি‌লো।

__হ্যাঁ ব‌লো?

__স্যার আমি রে‌জিগ‌নেশন দি‌তে চা‌চ্ছি।

__‌কেন? ইজ এভ‌রি‌থিংস ওকে তনয়া?

__ই‌য়েস স্যার। এক্সুয়া‌লি আমার নি‌জের কিছু সমস্যা আছে। প্লিজ স্যার সেটা জান‌তে চাই‌বেন না। প্লিজ স্যার না কর‌বেন না। আমি জা‌নি আমি এক বছ‌রের কন্ট্রা‌কে আছি বাট স্যার আমার কিছু করার নেই। কন্ট্রাক ভাঙার জ‌রিমানা দি‌তে বা শা‌স্তি ভোগ কর‌তে আমি রা‌জি কিন্তু স্যার দয়া ক‌রে এখা‌নে থাক‌তে বল‌বেন না। 

আমজাদ হো‌সেন একটা দীর্ঘ‌নিঃশ্বাস ছে‌ড়ে বলল,
__ঠিক আছে। বুঝ‌তে পার‌ছিনা ‌তোমার কী হ‌য়ে‌ছে! কিন্তু আজ মা‌সের তে‌রো তা‌রিখ চাই‌লেও তু‌মি এ মা‌সে জব ছাড়‌তে পার‌বেনা। আর তাছাড়া তু‌মি আর আয়াত গত দেড় মাস যাবত একটা প্রো‌জেক্ট এ কাজ করছো। সেটার জন্য আগামী পরশু তোমা‌দের চ‌ট্টোগ্রাম যে‌তে হ‌বে। নয়‌তো ডিলটা হাত থে‌কে চ‌লে যা‌বে। আমি তোমার অনু‌রোধটা রাখ‌বো তু‌মি প্লিজ এ মাস কম‌প্লিট করে তারপর যাও।

__তনয়া কোন উপায় না পে‌য়ে বলল, ঠিক আছে। তারপর বলল, স্যার আরেকটা অনু‌রোধ আছে। 

__হ্যাঁ ব‌লো?

__আয়াত স্যার আমা‌কে যে, ফ্ল্যাটটা ঠিক ক‌রে দি‌য়ে‌ছে সেটা আমি এম‌নিও এফোর্ড ক‌রিনা। তারপরও থাক‌ছি বিষয়টা কেমন যে‌নো লাগ‌ছে। এখন তো জব কর‌বো না তাই ফ্ল্যাটটা আমি ছে‌ড়ে দি‌তে চা‌চ্ছি, আপ‌নি স্যার‌কে বল‌বেন অগ্রিম কত টাকা দি‌ছে সেটা আমায় জানা‌তে, আমি ধী‌রে ধী‌রে টাকাগু‌লো দি‌য়ে দি‌বো। একসা‌থে তো পার‌বো না, চার পাঁচ মা‌সে অল্প অল্প ক‌রে দি‌য়ে দি‌বো। প্লিজ স্যার এই উপকার ক‌রেন!

__আয়া‌তের সা‌থে তোমার কিছু হ‌য়ে‌ছে?

__না স্যার। তেমন কিছু হয়‌নি। আমি আমার সীমা ভু‌লে গে‌ছিলাম যেটা বর্তমা‌নে বুঝ‌তে পে‌রে‌ছি। আস‌ছি স্যার। 

তনয়া কে‌বিন থে‌কে বে‌ড়ি‌য়ে যে‌তেই আয়াতের সা‌থে ধাক্কা লেগে তনয়া ধুম ক‌রে নি‌চে প‌রে যায়। আয়াত তারাতা‌রি তনয়া‌কে তু‌লে দাড় করি‌য়ে জি‌জ্ঞেস কর‌লো,
__আর ইউ ওকে?

__জি স্যার। তনয়া মাথা নিচু ক‌রে আয়াত‌কে স্য‌রি ব‌লে চ‌লে গে‌লো। ‌কে‌বি‌নে গি‌য়ে হা‌তের কনুই‌য়ের দি‌কে তা‌কি‌য়ে দেখ‌লো বেশ খা‌নিটা ছু‌লে গে‌ছে। ব্যাথা কর‌ছে খুব। কোনম‌তে টিস্যু দি‌য়ে রক্তটা মু‌ছে নি‌য়ে গা‌য়ের ওড়নাটা দি‌য়ে হাতটা ঢে‌কে ফেল‌লো। 

আজও আয়াত অফিস শে‌ষে গা‌ড়ি নি‌য়ে তনয়ার জন্য অপেক্ষা কর‌ছি‌লো। তনয়া আজও সে‌দি‌কে দে‌খেও না দেখার ভান ক‌রে হেঁ‌টে হেঁ‌টে চ‌লে গে‌লো। অফিস থেকে বাসা ৩০ মি‌নিট হাঁটা পথ। এতটুকু তনয়া হেঁ‌টে যে‌তে পা‌রে। বা‌ড়ি গি‌য়ে তনয়ার হাত নাড়া‌নো মুশ‌কিল হ‌য়ে উঠ‌লো। শীতকাল যার কার‌নে ব্যাথাটা জ‌মে গে‌ছে। তনয়া সামান্য কিছু খে‌য়ে তারাতা‌রি একটা ব্যাথার আর জ্ব‌রের ঔষধ খে‌য়ে নিলো। কারন তনয়া বে‌শি আঘাত পে‌লে ওর জ্বর আসে। তনয়া ঘরটা মোটামুটি প‌রিষ্কার কর‌লো, দু এক জায়গায় মাকরসা জাল বেঁ‌ধে‌ছে সেগু‌লো প‌রিষ্কার ক‌রে, ফ্রেস হ‌য়ে বিছানায় গা এলি‌য়ে দিলো। শু‌তেই ঘুম দে‌শে ত‌লি‌য়ে গে‌লো। 

রা‌তের খাবার খে‌য়ে আয়াত ফো‌নে তনয়া‌র ছ‌বি দেখ‌ছি‌লো তখন আয়া‌তের বাবা রু‌মে ঢু‌কে আয়াত‌কে বল‌লো, 
__তনয়ার সা‌থে তোর কী হ‌য়ে‌ছে?

__‌কিছুনা বাবা! কেন?

__তাহ‌লে তনয়া রে‌জিগ‌নেশন কেন দি‌লো?

__‌হোয়াট? কী যাতা বল‌ছো বাবা?

__যা তা নয়। স‌ত্যি! ও জব কর‌বেনা বল‌লো। তারপর ওকে যে, ফ্ল্যাট ভাড়া ক‌রে দি‌য়ে‌ছিস তার কত অগ্রিম দেয়া লাগ‌ছে সেটা ওকে জান‌তে বল‌ছে! ও টাকা দি‌য়ে দি‌বে। কিছু না হ‌লে এসব কেন বল‌লো?

আয়াত ওর বাবার দি‌কে কতক্ষন তা‌কি‌য়ে থে‌কে উঠে দা‌ড়ি‌য়ে বলল, 
__বাবা কাজ আছে বে‌ড়োতে হ‌বে আমায়। আয়াত আর কোন কথা না ব‌লে বাইকটা নি‌য়ে তনয়া‌র ফ্ল্যা‌টে চ‌লে গেলো। তনয়া তখন কেবল ভাত রান্না ক‌রে ডিম ভা‌জি কর‌তে নি‌বে। তখন ঘু‌মি‌য়ে গে‌ছি‌লো, কিন্তু প‌রে ওর দাদাভাই‌য়ের ফো‌নে ঘুম ভাঙ‌তেই কথা ব‌লে ভাত রান্না কর‌লো। ক‌লিং বেল এর আওয়া‌জে তনয়া চুলা বন্ধ ক‌রে দরজার কা‌ছে গে‌লো। দরজার ছিদ্র  দি‌য়ে তা‌কি‌য়ে দেখলো আয়াত। দেখে ম‌নে হয় প্রচন্ড রে‌গে আছে। তনয়া দরজা খুল‌তেই আয়াত ভিত‌রে ঢু‌কে দুম ক‌রে দরজা বন্ধ ক‌রে বলল,

__তু‌মি রে‌জিগ‌নেশন ‌দিয়ে‌ছো কোন সাহ‌সে?(প্রচন্ড রে‌গে)

__এ‌তে সাহসের কী আছে? (শান্ত গলায়)

__তু‌মি ভু‌লে গে‌ছো তু‌মি এক বছ‌রের জন্য জব করার এগ্রিমেন্টে এ সাইন কর‌ছো? (দা‌ঁতে দাঁত চে‌পে)

__‌জি না স্যার ভু‌লি‌নি। আ‌মি আপনার বাবা‌কে বল‌ছি, এগ্রি‌মেন্ট ভাঙার সমস্ত জ‌রিমানা আমি দি‌য়ে দি‌বো।

__তা জব ছে‌ড়ে কর‌বে কী? তোমার বাবার কা‌ছে ফি‌রে যা‌বে?

__বাবা তো আমায় ফি‌রি‌য়ে নি‌বেনা। য‌দি কখ‌নো নেয় তখন নাহয় যা‌বো। 

__তো এখন কী কর‌বে?

__দু‌টো কোম্পা‌নি‌তে জব এ্যাপ্লাই ক‌রে‌ছি। আল্লাহর রহম‌তে এক জায়গা না এক জায়গায় হ‌য়েই যা‌বে। আল্লাহর পৃ‌থিবীতে কেউ না খে‌য়ে ম‌রেনা। সে সবার রু‌জির ব্যবস্থা ক‌রেই দি‌য়ে‌ছে।

আয়াত তনয়ার হাত ধ‌রে বল‌লো,
__তু‌মি স‌ত্যি ফা‌জিল, একঘু‌য়ে আর স্বার্থপর প্রকৃ‌তির একটা মে‌য়ে। (রাগ ক‌রে)

__‌জি স্যার আ‌মি সেটা জা‌নি। (শান্ত গলায়) আপ‌নি কী আর কিছু বল‌বেন?

আয়াত তনয়াকে ছে‌ড়ে দি‌য়ে হনহন ক‌রে দরজা খু‌লে চ‌লে গে‌লো। তনয়া দরজা লক ক‌রে দরজার পা‌শে ঠায় কতক্ষন ব‌সে রইল। আয়াত‌কে দে‌খে ভাব‌ছি‌লো এই বু‌ঝি আয়াত ওকে কা‌ছে টে‌নে নি‌বে কিন্তু সবটাই ভুল ধারনা। মা‌কে খুব ম‌নে পড়‌ছে তনয়ার। তাই ফোনটা হা‌তে নি‌য়ে ওর মা‌ নয়না বেগম‌কে ফোন দি‌লো, 
__হ্যা‌লো মা কেমন আছো?

__ভা‌লো মা তুই?

__হ্যাঁ মা খুব ভা‌লো। মা তু‌মি কী কাল আমার সা‌থে দেখা কর‌বে? আমার তোমা‌কে খুব দেখ‌তে ইচ্ছে কর‌ছে!

__কাল পার‌বো না‌রে মা। কাল তোর বাবার ক‌য়েকজন বন্ধু বাসায় আস‌বে। কাল সময় পা‌বো না‌রে? তোর দুই দাদাভাইও খুব ব্যস্ত থাক‌বে। পরশু বা তার প‌রের দিন দেখা হ‌বে। 

__আচ্ছা মা। 

তনয়া কা‌রো স‌ন্নিধ্য পে‌তে মন চাই‌ছে। কিন্তু কেউ নেই সবাই ব্যস্ত। র‌শ্মিটাও ওর গ্রা‌মের বা‌ড়ি গে‌ছে। সবাই যার যার জীবন নি‌য়ে গ‌তিময় আছে। শুধু তনয়ার জীবনটাই একা‌কি‌ত্বে থে‌মে আছে। 

আয়াত বা‌ড়ি পৌঁছা‌তেই মেঘা আয়া‌তের রু‌মে গি‌য়ে বলল,
__ভাইয়া ভা‌বির সা‌থে সব ঠিক হ‌য়ে‌ছে?

__ঐ ফা‌জিল মে‌য়েটার নাম আমার সাম‌নে নি‌বি না।

—————

মেঘার রাগ উঠে গে‌লো। রাগ ক‌রে বলল, 
__কা‌কে ফা‌জিল বল‌ছিস তুই? ভা‌বি‌কে? তুই তার থে‌কে বড় ফা‌জিল। 

আয়াত চোখ বড় বড় ক‌রে মেঘার দি‌কে তাকা‌লো। মেঘা বল‌তে থাক‌লো,
__কী দোষ ক‌রে‌ছে ভা‌বি? মা‌কে সরল মনে নিজের স‌ত্যিটা বল‌ছে এটাই তার দোষ? আমরা সবাই জা‌নি তনয়া ভা‌বি ম‌নে এক আর মু‌খে আরেক কথা বল‌তে পারেনা। সবসময় সরল ম‌নে সব ব‌লে। তুই নি‌জেই তো ভা‌বির এই সরলতায় পাগল হ‌য়েছিলি। তাহ‌লে আজ তোর পাগলামী ভা‌লোবাসা শেষ হ‌য়ে গে‌লো? না‌কি তনয়ার প্র‌তি তোর শুধু এট্রাকশন ছি‌লো? যা এখন শেষ!

আয়াত মেঘার কথা শু‌নে কিছুক্ষন চুপ থে‌কে বলল,
__মা‌য়ের বিষয়টা নাহয় বাদ দিলাম। ওকে শতবার নি‌ষেধ করা স‌ত্যেও ও কেন দীপুর সা‌থে কথা বলল, হাত মিলা‌লো?

__‌সেটা কেন ক‌রে‌ছে ত‌ুই জা‌নিস? তুই দীপু‌কে দেখ‌লি আর তনয়ার পা‌শে দীপুর মা‌কে দেখ‌লিনা? দীপু আর ওর মা‌য়ের সা‌থে ভা‌বির কাকতালীয় ভা‌বে দেখা হয়। তখন দীপুর মা বলল, দীপুর ভা‌লো জায়গায় চাক‌রি হ‌য়ে‌ছে। দু এক‌দিনে সেখা‌নে চ‌লে যা‌বে। তনয়া ভা‌বি দীপু‌কে অ‌ভিনন্দয় জানায়। দীপু নি‌জে হাত বা‌ড়ি‌য়ে দেয়, তনয়া ভা‌বি পা‌শে দিলরুবা আন্টি থাকায় ভদ্রতার খা‌তি‌রে দীপুর সা‌থে হাত মেলায় এটা বু‌ঝি ভা‌বি অন্যায় ক‌রে ফেল‌লো? ‌তোরা সবসময় মে‌য়ে‌দের নি‌জে‌দের স্থান থে‌কে কেন ভা‌বিস? য‌তি মে‌য়েটা কা‌রো সা‌থে কথা ব‌লে, ত‌বে তার চ‌রি‌ত্রের দোষ আছে। আর য‌দি না ব‌লে ত‌বে সে ভাব দেখায়। মে‌য়েরা কোথায় যা‌বে বল তো?

আর তুই তনয়ার কেরে যে, তোর কথা ওর অক্ষ‌রে অক্ষ‌রে পালন করা লাগ‌বে?
তুই ওর ভাই, আত্মীয় না‌কি স্বামী? কিছুনা। শুধু মাত্র  বয়‌ফ্রেন্ড হ‌য়ে এত অধিকার কিভা‌বে খাটাস! তনয়া তোর,খায় না প‌রে? তোরা ছে‌লেরা কী ভা‌বিস? গার্ল‌ফ্রেন্ড তো‌দের কেনা সম্পদ, যা তোদের সব হুকুম মে‌নে চল‌বে? 
ভা‌বি তো‌কে সবার থে‌কে আলাদা ভে‌বে কা‌ছে টে‌নে‌ছি‌লো কিন্তু তোর চিন্তাধারাও সেই বা‌কি ছে‌লে‌দের মতই। ইউস‌লেস লোক্লাস কোথাকার!

‌মেঘার কথায় আয়াত স্তব্ধ হ‌য়ে গেলো। তবুও শান্ত গলায় বলল,
__তনয়া এগু‌লো আমা‌কে কেন বল‌লো না?

__তুই বলার মত সু‌যোগ দি‌ছিস তা‌কে? আমি শিওর নি‌জেই ভা‌বি‌কে যা তা ব‌লে ফা‌জি‌লের মত আচরন ক‌রে আস‌ছিস। আবার ভা‌বি‌কে ফা‌জিল বল‌ছিস। একবারও ঠান্ডা মাথায় ভা‌বি‌র কা‌ছে সবটা জান‌তে চে‌য়ে‌ছিস?
আমি ১০০% দি‌য়ে বল‌তে পা‌ড়ি জান‌তে চাস নি। কারন তাহ‌লে তো তোর ম্যান ইগো‌তে লা‌গবে।

আমরা সবাই জা‌নি ভা‌বি কেমন সরল টাইপ মে‌য়ে। আমি ফো‌নে জি‌জ্ঞেস করার পর সে নি‌জে‌কে দোষী মান‌ছে। পাগ‌লের মত কান্না কর‌ছে। অনেক বোঝা‌নোর পর ত‌বে আমা‌কে সবটা খু‌লে বল‌ছে।
‌তোর মাথায় একবারও এ চিন্তাটা আস‌লোনা একটা মে‌য়ে নি‌জের প‌রিবার থে‌কে সম্পূর্ণ দূ‌রে আছে। চাই‌লেও তা‌দের সা‌পোর্ট পা‌চ্ছেনা। শুধু তো‌কে আক‌ড়ে  ধ‌রে সু‌খে খোঁজার চেষ্টা কর‌ছে আর সেই তুই গত দু‌দিন যাবত ভা‌বির সা‌থে ঠিক কী কী কর‌ছিস একবার ভে‌বে দেখ তো? 
‌তো‌কে তো ফালতু সিমপ্যা‌থি দে‌খি‌য়ে সা‌পোর্ট করার জন্য তোর পু‌রো প‌রিবার, বন্ধু সব আছে। একবার ভাব ভা‌বির কে আছে? কারন তোর বিষ‌য়ে চাই‌লেও তো সে কা‌রো কা‌ছে কিছু বল‌তে পার‌বেনা। এই মুহূর্তে মে‌য়েটা কী কর‌ছে জা‌নিস? আ‌মি বল‌ছি কী কর‌ছে, ঘ‌রের কো‌নে ব‌সে পাগ‌লের মত কান্না করছে। হয়‌তো গত দু‌দি‌নে ঠিকমত নাওয়া খাওয়াও বন্ধ ক‌রে দি‌ছে। তা‌তে তোর কী? তুই তো খুব ভা‌লো ছে‌লে! ঐ ফা‌জিল মে‌য়েটা ম‌রে গে‌লেওবা তোর কী? যা সর তোর মত ভা‌লো ছে‌লের সা‌থে কথা বলার রু‌চি নেই। মেঘা রা‌গে গজ গজ কর‌তে কর‌তে নি‌জের রু‌‌মে গি‌য়ে দরজা আট‌কে দি‌লো। আয়াত কিংকর্তব্য‌বিমূঢ় হ‌য়ে দা‌ড়ি‌য়ে রইল। 

কারন মেঘার প্র‌তিটা কথা অক্ষ‌রে অক্ষ‌রে সত্যি। আয়াত এক মুহূর্তও দাড়া‌লোনা। বাইকটা নি‌য়ে আবার তনয়ার ফ্ল্যা‌টে চ‌লে গে‌লো। বেল না বা‌জি‌য়ে নি‌জের কা‌ছে থাকা চা‌বিটা দি‌য়ে দরজা খুল‌লো। ভিত‌রে ঢুকে দেখে রান্না ঘ‌রের লাইন জ্বালা‌নো। তাই রান্না ঘ‌রে গি‌য়ে দে‌খে রান্নাঘর ফাঁকা। রান্না করা ভাত যেমন তা তেমনই, ভাঙা ডিম বা‌টি‌তে আর পেয়াজ আধাকু‌চি করা। তারমা‌নে তনয়া এখনও খায়‌নি। আয়াত সোজা বেডরু‌মে চ‌লে গে‌লো। কিন্তু তনয়া সেখা‌নেও নেই। আয়া‌তের মনটা ভ‌য়ে কেঁ‌পে উঠ‌লো। পা‌শের রু‌মে গি‌য়ে দে‌খে সে‌দিন আয়াত যে রু‌মে ঘু‌মি‌য়ে‌ছি‌লো, সে রু‌মে গু‌টিসু‌টি মে‌রে ব‌সে আয়া‌তের একটা শার্ট বু‌কে জ‌ড়ি‌য়ে আছে। আয়াত তনয়ার কা‌ঁধে হাত রাখ‌তেই তনয়া ভ‌য়ে কে‌ঁপে উঠ‌লো। পিছন ঘু‌রে আয়াত‌কে দে‌খে কী বল‌বে ভে‌বে পা‌চ্ছেনা। আয়াত তনয়ার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বুকটা মোচর দি‌য়ে উঠ‌লো। কান্না ক‌রে, চোখ মুখ টকট‌কে লাল বা‌নি‌য়ে ফেল‌ছে। আয়াত‌কে ‌দে‌খে তনয়া শক্ত ক‌রে আয়াত‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধরলো। তনয়ার পু‌রো শরীর থরথর ক‌রে কাঁপছে। হয়ত ভয় পে‌য়ে‌ছে খুব। ভাব‌ছে অন্য কেউ ঘ‌রে আস‌ছে।

এভা‌বে চ‌ুপচাপ কতক্ষন আয়াত‌কে তনয়া জড়ি‌য়ে ধ‌রে ছি‌লো তা কা‌রোরই খেয়াল নেই। আয়াত তনয়ার গা‌লে হাত দি‌য়ে মাথাটা তু‌লে বলল, 
__স্য‌রি তনয়া। প্লিজ মাফ ক‌রে দ‌াও।

তনয়া শুধু ফু‌পি‌য়ে ফু‌পি‌য়ে কাঁদ‌ছে। আজ তনয়ার এত কষ্ট হ‌চ্ছে যে, তনয়া সেটা কাউ‌কে বোঝা‌তে পার‌ছেনা। চুপ ক‌রে আয়া‌তের বু‌কে প‌রে রইল। কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে হিচ‌কি দি‌চ্ছে। আজ আয়া‌তের নি‌জের উপরও খুব রাগ হ‌চ্ছে। কেন যে মা‌ঝে মাঝে নি‌জের রাগটা ও নিয়ন্ত্রন কর‌তে পা‌রেনা। সেটা ভে‌বেই কুল পা‌চ্ছেনা। নি‌জে‌দের অজা‌ন্তেই তনয়াকে অনেক বড় কষ্ট দিয়ে ফেল‌লো। তনয়ার মাথায় হাত বুলা‌তে বুলা‌তে বল‌লো,
__তনয়া!

__হুমম!

__তু‌মি খে‌য়ে‌ছো?

__হুমম।

__‌মিথ্যা কেন বল‌ছো!

__তনয়া নিশ্চুপ। বেশ খা‌নিকসময় পর তনয়া, বল‌লো, আয়াত!

__হ্যাঁ তনুপা‌খি।

__তু‌মি কি আমা‌কে ছে‌ড়ে যাবে? 

__কখ‌নো না। আমার পা‌খিটা‌কে ছে‌ড়ে আমি বাঁচ‌বো কি ক‌রে?

__তাহ‌লে ওমন কেন কর‌ছিলা?

__স্য‌রি পা‌খি, তোমা‌কে অন্য কা‌রো সা‌থে মে‌নে নি‌তে পা‌রিনা।

__আয়াত আমি কোন ছে‌লের সা‌থে কথা বল‌বো না। কা‌রো কা‌ছে যা‌বো না। সবসময় তোমার সা‌থে থাক‌বো, তোমার কথামত চল‌বে‌া। তবুও প্লিজ আমায় ছে‌ড়ে যে‌ওনা। নয়ত আই কিল মাই সেলফ। 

__‌ছি এগু‌লো কী ব‌লো?

__স‌ত্যি আয়াত তু‌মি ছাড়া আমি ম‌রে যা‌বো।

আয়াত তনয়া‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে ভাব‌ছে যে, মে‌য়েটা নি‌জের আত্মসম্মা‌নের খা‌তি‌রে নি‌জের বি‌য়ে ভে‌ঙে দি‌ছে। বাবা মা, প‌রিবার থে‌কে দূ‌রে সে মে‌য়েটা ওর জন্য ওর কথা মান‌তে রা‌জি। এতে বোঝা যায়, তনয়া আয়াত‌কে কতট‌া ভালোবা‌সে। আর এই মে‌য়েটা‌কে কিনা ও এত কষ্ট দি‌চ্ছি‌লো। নি‌জের প্র‌তি ঘৃণা হ‌চ্ছে আয়া‌তের। তনয়ার মাথাটা তু‌লে তনয়ার কপা‌লে চু‌মো এঁকে দি‌য়ে, তনয়া‌কে কো‌লে তু‌লে নি‌লো। ওয়াশরু‌মে নি‌য়ে গি‌য়ে তনয়ার চো‌খে মু‌খে পা‌নি দি‌য়ে কো‌লে ক‌রেই রান্না ঘ‌রে নি‌য়ে গে‌লো। 
তনয়া‌কে একটা চেয়া‌রে ব‌সি‌য়ে, আয়াত ডিম ভা‌জি কর‌লো। তারপর ভাত নি‌য়ে এসে তনয়াকে খে‌তে বলল, তনয়া না বলায় নি‌জেই খাই‌য়ে দি‌চ্ছি‌লো। তনয়া চুপচাপ খে‌য়ে নি‌চ্ছি‌লো। আয়াত জি‌জ্ঞেস কর‌লো,

__ভাত ক‌বে খে‌য়ে‌ছো?

__তনয়া মাথা নিচু ক‌রে বলল, তোমা‌দের বা‌ড়ি থে‌কে যে‌দিন আস‌ছি সে‌দিন রা‌তে। আয়া‌তের বুকটা ধক ক‌রে উঠ‌লো। তারপর বলল, দু‌দিন কী খে‌য়ে‌ছিলে?

__হালকা নাস্তা বা চা বি‌স্কেট। (মাথা নিচু ক‌রে)

তনয়া খাই‌য়ে দি‌য়ে, আয়াত নি‌জেই প্লেটটা ধু‌য়ে রে‌খে তনয়ার কাছে এসে তনয়া‌কে শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধর‌লো। টুপ ক‌রে ক‌য়েক‌ফোটা জল আয়া‌তের চোখ থে‌কে তনয়ার কাঁ‌ধে পড়লো। তনয়া নি‌জে‌কে ছাড়া‌তে চাই‌ছে। কিন্তু আয়াত শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধরায় সেটা পার‌ছেনা। আর আয়াত তনয়া‌কে নি‌জের চো‌খের জলটা দেখা‌তে চাই‌ছেনা। কতক্ষন পর বল‌লো,

__তনয়া আমি খুব খারাপ তাইনা?

__হ্যাঁ খুব খারাপ। 

__তোমা‌কে খুব কষ্ট দেই তাইনা।

__হ্যাঁ। খুব। কিন্তু ভা‌লোওতো তু‌মিই সব‌চে‌য়ে বে‌শি বা‌সো। 

__তু‌মি কি আমার উপর একটুও রাগ ক‌রো‌নি?

__করে‌ছি খুব রাগ করে‌ছি। খুব কষ্টও পে‌য়ে‌ছি। ত‌বে তোমারই এখন সেটা সমাধান কর‌তে হ‌বে। আমার রাগও ভাঙা‌তে হ‌বে আর কষ্টও কমা‌তে হ‌বে। নয়‌তো তোমা‌দের সবাইকে ছে‌ড়ে চ‌লে যা‌বো। 

চ‌লে যাবার কথা শু‌নে আয়াত তনয়া‌কে আরো শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বল‌লো,
__বল‌লেই যে‌তে দি‌বো না‌কি? শক্ত করে নি‌জের সা‌থে বেঁ‌ধে রাখ‌বো। 

__আয়াত আমার খুব ক্লান্ত লাগ‌ছে। 

__দু‌দিন যাবত খাও‌নি ক্লান্ত তো লাগ‌বেই। আয়াত তনয়া‌কে আবার কো‌লে ক‌রে, বিছানায় শু‌য়ে দি‌য়ে মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে দি‌তে লাগ‌লো। তনয়া আয়াত‌কে টান দি‌য়ে বিছানায় ফে‌লে আয়াতের বু‌কের উপর মাথা দি‌য়ে শু‌য়ে পড়লো। আয়াত তনয়ার মাথাটা বু‌কের সা‌থে চে‌পে ধ‌রে ভাব‌ছি‌লো, ইশ সামান্য একটা বিষয় নি‌য়ে এই পাগলী মে‌য়েটা‌কে কতটা কষ্ট দিয়ে‌ছে ও। 

আস‌লেই তনয়া খুব সরল, নয়ত ওর জায়গায় অন্য কোন মে‌য়ে থাক‌লে, এতক্ষ‌নে তার রাগ ভাঙা‌তে বেগ পে‌তে হ‌তো। তনয়া সম্প‌র্কের মা‌নে বো‌ঝে, নি‌জের সরলতা দি‌য়ে সেটা‌কে আগ‌লে রাখ‌তে জা‌নে। ভা‌লোবাসা‌কে ভা‌লোবাসতে জা‌নে তনয়া। তনয়া বে‌ঘো‌রে ঘুমা‌চ্ছে। ম‌নে হ‌চ্ছে কত শা‌ন্তি‌তে আয়া‌তের বু‌কে ঘুমা‌চ্ছে। ওর নি‌জের সুখটা আয়া‌তের বু‌কে খুঁ‌জে নি‌য়ে‌ছে। 

আয়াত রা‌তে বেশ ক‌য়েকবার তনয়া‌কে নি‌জের থে‌কে ছা‌ড়ি‌য়ে নেয়ার চেষ্টা কর‌ছে। ভাব‌ছে পা‌শের রু‌মে গি‌য়ে   ঘুমা‌বে। কিন্তু যতবারই উঠার চেষ্টা কর‌ছে, ততবারই তনয়া শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে রাখ‌ছে। আয়াত মৃদু হে‌সে তনয়া‌কে নি‌জের বু‌কের মা‌ঝে জ‌ড়ি‌য়ে নি‌য়ে ঘু‌মি‌য়ে পড়‌লো। 
আজ কত‌দিন পর তনয়া এত শা‌ন্তি‌তে ঘুমা‌লো তার হিসাব নেই। 
সকা‌লে আযা‌নের শব্দ পে‌য়ে আয়াত তনয়া‌কে আস্তে ক‌রে ডাক দি‌লো।

__তনয়া, তনয়া!

__হুমমম

__ও‌ঠো নামাজ পড়বা!

__পার‌বো না। 

__‌প্লিজ নামাজ প‌ড়ে আবার ঘুমাও। 

তনয়া ঘুম ঘুম চো‌খে তা‌কি‌য়ে আয়াত‌কে দে‌খে ভূত দেখার মত চম‌কে উঠ‌লো। ধী‌রে ধী‌রে কাল রা‌তের কথা ম‌নে পড়‌লো। নি‌জে‌কে আয়া‌তের থে‌কে ছাড়া‌তে চাই‌লে আয়াত আরো শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধরে বলল,
__সারা রাত নি‌জে আমায় আট‌কে রে‌খে এখন দূ‌রে স‌রি‌য়ে দি‌চ্ছো তা হ‌বেনা।

__তু‌মি কেন এখা‌নে শু‌তে গে‌লে?

__হুহ রা‌তে ঘু‌মের মা‌ঝে নি‌জে আমা‌কে যে‌তে দেয়‌নি আবার আমার দোষ দেয়া হচ্ছে? যা যা কর‌ছো তা নাহয় নাই বলল‌াম। (দুষ্ট‌মি ক‌রে)

__মিথ্যা বল‌ছো? আমি কিছু ক‌রি‌নি (কাঁদো কাঁ‌দো গলায়)

__মোটেও মিথ্যা ব‌লি‌নি।

এবার তনয়ার চোখ থে‌কে টপটপ ক‌রে পা‌নি পড়‌তে লাগ‌লো। আয়াত তনয়া‌কে থা‌মি‌য়ে বলল, আরে বোকা মে‌য়ে কাঁদ‌ছো কেন? আমি মজা কর‌ছিলাম। বিশ্বাস ক‌রো, না তু‌মি কিছু ক‌রে‌ছো না আমি। শুধু জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে ছিলাম মাত্র। 

__স‌ত্যি তো?

__‌বিশ্বাস ক‌রে এটাই স‌ত্যি। তনয়া আমার উপর ভরসা রাখতে পা‌রো। তোমার বিশ্বাস কখ‌নো ভাঙ‌বোনা।
এখন নামাজ প‌ড়ে নাও তারপর সব কথা শুন‌বো। 

তনয়া নামাজ প‌ড়ে দু কাপ চা নি‌য়ে ব্যালক‌নি‌তে গি‌য়ে আয়া‌তের হা‌তে একটা দি‌য়ে বলল,
__কত‌দিন পর শা‌ন্তি‌তে ঘুমালাম তা নি‌জেই জা‌নিনা। 

আয়াত তনয়ার নাকটা টি‌পে বলল, সেটা রা‌তেই বু‌ঝে গে‌ছিলাম। আচ্ছা শোন বস‌তে পার‌বো না। বাসায় জরু‌রি কিছু কাজ আছে। আজ অফি‌সেও তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। জল‌দি এসো। আয়াত তনয়ার থে‌কে বিদায় নি‌য়ে চ‌লে গে‌লো।

৩৪!!

       এত সকা‌লে আয়াত বাসায় ঢুক‌তেই লুবনা বেগ‌মের সাম‌নে পড়‌লো। পা‌শে ব‌সেই মেঘা, আয়াজ আর আমজাদ হো‌সেন চা খা‌চ্ছি‌লো। লুবনা আয়াত‌কে দে‌খে জি‌জ্ঞেস কর‌লো,
__সারা রাত কোথায় ছি‌লি?

__(আয়াত সোজাসু‌জি ব‌লে দি‌লো) তনয়ার বাসায়।

__কী? (চোখ বড় বড় ক‌রে)

__হ্যাঁ । কেন মা? তোমার অবিবা‌হিত ছে‌লে সারা রাত একটা প্র‌তিবন্ধী মে‌য়ের সাথে কা‌টি‌য়ে আস‌লে‌া, বিষয়টা লে‌াক জান‌লে তোমার প্রেস‌ট্রি‌জের কী হ‌বে? আর তারপর য‌দি সেই মে‌য়েটা থানায় বা তোমা‌দের নারীশক্তি এন‌জিও‌তে গি‌য়ে য‌দি কম‌প্লেইন ক‌রে যে, আমি মে‌য়েটার সা‌থে রাত কা‌টি‌য়ে তা‌কে বি‌য়ে কর‌বো না বল‌ছি ত‌বে লো‌কে কী বল‌বে? ভে‌বে দে‌খো মা। কিন্তু তু‌মি টেনশন করো না আমি তোমা‌কে কা‌রো কা‌ছে ছোট হ‌তে দি‌বো না। ঐ মে‌য়ে‌কে বি‌য়ে ক‌রে তোমা‌কে সবার কা‌ছে ছোট হওয়া থে‌কে বাঁচা‌বো।

আয়া‌তের কথা শুনে লুবনা বেগম তব্দা খে‌য়ে দা‌ড়িয়ে রইল। অবশ্য এমন কথা হজম কর‌তে যে কা‌রোরই সময় লাগ‌বে। মেঘা আর ওর বাবা মুখ টি‌পে টি‌পে হাস‌ছে। 

আয়াত কথা না বা‌ড়ি‌য়ে রু‌মে গে‌লো। আর ভাব‌লো অফি‌সের ক‌য়েকটা‌কেও শিক্ষা দি‌তে হ‌বে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন