আড়ালে আবডালে - পর্ব ২৯ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


শিশির ফোন করেছে। যেভাবেই হোক আজ তরুকে দেখা করতে হবে। ঐদিকে লিমনের সঙ্গে জাফলং যাওয়ার কথা। ভাইকে বারণ করার মতো সাহস তো তরুর নেই। আর সে বাসায় থাকলে বাইরে যাওয়াও অসম্ভব! কোনো দিকদিশা খুঁজে না পেয়ে তরু চিন্তিত হয়ে খাটের ওপর বসে আছে। নিহির রেডি হওয়া শেষ হলে চোখ যায় তরুর দিকে। রেডি হয়েছে বলতে শুধু খিমারটাই পরেছে নিহি। তরু তখন গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা ভাবছে। নিহি পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
"কীরে? রেডি হবি না?"
সে এক পলক নিহির দিকে তাকায়। উপায় পেয়ে গেছে! চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার। নিহির হাত ধরে ফিসফিস করে বলে,
"একটা হেল্প করবি নিহি?"
"অবশ্যই। বল।"
"শিশির ফোন করেছিল।"
"দেখলাম তো।"
"বলল অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাকি কথা আছে। যে করেই হোক আজ দেখা করতে হবে।"
"কিন্তু কী করে সম্ভব?"
"আছে একটা উপায়। কিন্তু তাতে তোর সাহায্য লাগবে।"
"আচ্ছা বল।"
"তুই ভাইয়ার সাথে জাফলং-এ যাবি।"
"আর তুই?"
"আমি বলব আমার পেট ব্যথা করছে। তুইও সাথে তাল মেলাবি।"
"তুই না গেলে আমি যাব না।"
"প্লিজ নিহি! বোঝার চেষ্টা কর। ভাইয়া বাসায় থাকলে আমি বের হতে পারব না। মাকে কোনোভাবে ঠিকই ম্যানেজ করতে পারব।"

নিহি অসহায়ভাবে তাকায় তরুর দিকে। এমনিতেই তো যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। এখন আবার তরুটাও যাবে না! নিহিকে চুপ থাকতে দেখে তরু শক্ত করে তার চেপে ধরে বলে,
"আর ভাবিস না! প্লিজ হেল্পটা কর।"
যেহেতু এই একটা উপায়ই ছিল তরুকে সাহায্য করার তাই অগত্যা বাধ্য হয়ে নিহিকে রাজি হতে হয়।
_______________

মাঝরাস্তায় অনলদের গাড়ি খারাপ হয়েছে। এমনিতেই লেট হয়েছে এখন আবার আরেক সমস্যা। এখানে গাড়ির ম্যাকানিক কোথায় পাওয়া যাবে তা কারোরই জানা নেই। রাগে গজগজ করছে অনল। মিলন তখন অনলকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে বলে,
"রাগ করিস না। আমি মামুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছি।"
"তোর আবার মামু আসলো কোথা থেকে? তোর তো কোনো মামা-ই নেই।" সুধালো সুমাইয়া।
মিলন তখন ফোনের কন্টাক্ট লিস্টে নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে উত্তর দেয়,
"মায়ের সৎ ভাই! সিলেটেই বাড়ি।"

অনল গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে খুব একটা মন্দ লাগছে না। ধুলোবালি তেমন নেই। চারপাশে চাষ করা শাকসবজির জমি। কচি কচি শাকপাতা, টমেটো, লাউ আরও অনেক সবজি রয়েছে। মিলন এসে জানায় 'ম্যাকানিকের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে একটু সময় লাগবে।'
অনল বিরক্তির স্বরে বলে, "কী আর করার!"


প্রকৃতি কন্যা হিসেবে সিলেটের জাফলং সারাদেশে পরিচিত। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে জাফলং অবস্থিত। এক কথায় সৌন্দর্যের লীলাভূমি যাকে বলে। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে পাহাড়ের স্তূপ। সীমান্তের ঐ পাড়ে ইন্ডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরামধারায় প্রবাহিত হচ্ছে জলের ধারা। সিলেট নগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর পূর্বদিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং-এর অবস্থান।

লিমন আর নিহি জাফলং-এ এসে পৌঁছিয়েছে মিনিট ত্রিশেক হবে। পানির ওপর ছোট ছোট পাথরের ওপর হাঁটছে নিহি। দু'হাতে বোরকাও ঠিকমতো সামলাতে পারছে না। যার দরুণ নিচের অংশটুকু পানিতে ভিজে যাচ্ছে। লিমন বলে,
"আরে আস্তে হাট! কিছু কিছু পাথর কিন্তু পিচ্ছিল। পড়ে যেতে পারিস।"

লিমনের বলতেই যতটুকু দেরি হয়, নিহির স্লিপ খেতে এক সেকেন্ডও দেরি হয় না। তৎক্ষণাৎ ভাগ্যিস লিমন ধরে ফেলেছিল। নিহি তখন ভয়ে জড়োসড়ো! সকলের সামনে না আবার বকাঝকা করে! কিন্তু নিহির ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। লিমন নিহির এক হাত ধরে বলে,
"বোরকা ভালো করে ধরে, এবার হাট!"

মুহূর্তেই নিহি আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। নীলমের কথা বড্ড মনে হয়। সবসময় সব পরিস্থিতিতে নীলম ভাইয়াও ঠিক এভাবেই নিহিকে আগলে রাখতো। আজ ভাইয়া কতদূর! মাসে একবার দেখা হয় ঠিকই তবে আগের মতো কাছে তো আর পায় না! নিহিকে অন্যমনস্ক দেখে লিমন জিজ্ঞেস করে,

"রাগ করেছিস নাকি?"
অশ্রুসজল চোখে নিহি হেসে ফেলে। নিকাব পরার কারণে হাসিটা দৃশ্যমান না হলেও ভাসা ভাসা চোখের হাসিতে সব স্পষ্ট। লিমন নিজেও মৃদু হাসে। নিহি লিমনের হাত ধরে পানির ভেতরের পাথরের ওপর হাঁটছে। পড়তে নিলেই আবার খিলখিল করে হাসছে। তখন লিমন নিজেও হেসে ফেলে। হঠাৎ-ই হাসতে হাসতে লিমন থেমে যায়। নিহির হাত ধরে রেখেছিল বলে নিহিকেও সঙ্গে থামতে হয়। এক হাত সামনেই একটি সুন্দরী মেয়ে হাত দুটো বগলদাবা করে অগ্নিদৃষ্টিতে লিমনের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টির নড়চড় হচ্ছে একটু পরপর। লিমনের থেকে ধরে রাখা হাতের দিকেও মেয়েটি বিস্ফোরিত দৃষ্টিনিপাত করছে। লিমন তখন হেসে বলে,
"আরে স্মৃতি! তুমি কখন এসেছ? তুমি যে আসবে আমায় বলোনি তো?"

লিমনের কণ্ঠ অবাকও বোঝালো। মেয়েটি এবার ওদের একেবারে কাছাকাছি এগিয়ে আসে। খুবই ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
"কেন? তোমার এসব কীর্তিকলাপ লুকানোর জন্য? আমি আসব জানলে তুমি আসতে?"
"কী বলছো এসব? তুমি আসবে জানলে তোমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম।"
"নাটক বন্ধ করো লিমন! কে এই মেয়ে?"
"আমার বোন।"
স্মৃতি নামের মেয়েটি এবার তাচ্ছিল্য করে হাসলো। বলল,
"মিথ্যাটা এখনো ঠিক রপ্ত করতে পারোনি তুমি। আর আমায় কি তোমার বোকা মনে হয়?"
"বোকা মনে হবে কেন?"
"সেটাই তো মনে হচ্ছে। আমি তরুকে বাইরে দেখেছি। আমার ফ্রেন্ড তোমায় এই মেয়ের সঙ্গে দেখে আমায় জানিয়েছে। আমি কিছু না জেনে এমনি এমনিই এসেছি ভেবেছো?"
"তোমার ভুল হচ্ছে স্মৃতি। ও আমার বোন ঠিকই। তবে ফুপাতো বোন।"
স্মৃতি এবার হাত তালি দিতে দিতে বলে,
"বাহ্! বাহ্! আর কত নাটক করবি তুই? প্রথমে বোন, এখন ফুপাতো বোন! আর কিছু বাকি নেই? তুই আমায় বিয়ে করে এখন আবার আরেক মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিস!"

বিয়ে! লিমন ভাইয়া বিয়ে করেছে? তার মানে এই মেয়েটিকেই ভাইয়া ভালোবাসে? পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। অলরেডি মানুষ জড়ো হতে শুরু করেছে। পর্যটকমহল এলাকায় এভাবে সিনক্রিয়েট করার তো কোনো মানেই হয় না। নিহির ভাবনায় ছেদ পড়ে।
লিমন স্মৃতিকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
"প্লিজ স্মৃতি! উত্তেজিত না হয়ে চলো আমরা কোথাও বসি। পুরো বিষয়টা আমি তোমায় ক্লিয়ার করব।"
স্মৃতি এবার দ্বিগুণ রেগে বলে,
"কীসের কথা আমার তোর সাথে? অন্য মেয়ের হাত ধরে তুই ঘুরবি, আমি এসব সহ্য করব?"
স্মৃতি কিছুতেই লিমনের কোনো কথা শুনতে চাচ্ছে না। তখন নিহি বলে,
"আপু আপনি শান্ত হোন। আমরা বসে কথা বলি?"
আগুনে ঘি ঢালার মতো অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে ওঠে স্মৃতি। নিহির দিকে তেড়ে এসে বলে,
"তুমি চুপ করো! তুমি কে হ্যাঁ? কে তুমি আমাদের মাঝে কথা বলার? একটা কথাও তুমি বলবে না।" এটা বলেই একটানে নিহির নিকাব খুলে ফেলে। হকচকিয়ে যায় নিহি, লিমন দুজনই।

নিহির ইচ্ছে করছে কতকগুলো কথা শুনিয়ে দিতে। এইটা কোনো কাজ করল? পুরো বিষয়টা না জেনে-বুঝেই লাফানো মেয়েদের ইচ্ছেমতো থাপ্রাতে ইচ্ছে করে নিহির। স্মৃতির মনের অবস্থাটা নিহি বুঝতে পারছে। আমানের সঙ্গে হুট করে কাউকে দেখলে নিহিও রাগ করবে। তবে পুরো বিষয়টা তো শোনা উচিত তাই না?

লিমন স্মৃতিকে বাঁধা দিয়ে বলে,
"তোমার যা বলার আমায় বলো। ওকে কিছু বলবে না।"
"বাঃ, বাঃ! কী দরদ! খুব দরদ তাই না? খুব জ্বলে তোর?"
"তুমি কি আমার কথাটা শুনবে প্লিজ?"
"তোরে বিয়ে করাটাই আমার ভুল হইছে ফকিন্নির বাচ্চা! আমার মতো মেয়েকে তুই ডিজার্বই করিস না কুত্তার বাচ্চা।"

সবেগে স্মৃতির গালে থাপ্পড় বসায় লিমন। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
"সবকিছুর একটা সীমা থাকে। আমার বাবা-মা তুলে গালি দেওয়ার সাহস হয় কী করে তোমার? এতক্ষণ ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছি। বুঝতেই চাইছো না!"

স্মৃতির গাল বেয়ে পানি পড়ছে। রক্তচক্ষু দ্বারা তাকিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে স্মৃতি বলে,
"তুই আমার গায়ে হাত তুললি? তোর জীবন আমি অতিষ্ঠ করে ফেলব। সঙ্গে এই মেয়েরও! দেখিস তুই।"
এরপর হাতের উল্টোপিঠে চোখের পানি মুছতে মুছতে স্মৃতি চলে যায়। কৌতুহলপ্রবণ পর্যটকরা নিজেদের মাঝে কথা বলাবলি করছে। লিমন নিচে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। নিহি বুঝতে পারছে না কী করবে বা কী বলবে। এমনটা কি হওয়ারই ছিল? উৎসুক জনতা এখনো আছে এখানে। নিহি নিকাব বেঁধে আস্তে করে বলল,
"এখান থেকে চলো ভাইয়া!"
লিমন কিছু না বলে হাঁটা শুরু করে। নিহি পিছু পিছু আসে। আজকের দিনটাই খারাপ গেল। নিহির নিজেরই খারাপ লাগছে খুব। তবে সত্যি বলতে স্মৃতি নামের মেয়েটাকে খুব বাজে লেগেছে নিহির। ব্যবহার, আচার-আচরণ, শৃঙ্খলা কিচ্ছু নেই! লিমনের কথা ভেবেই খারাপ লাগছে। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা সবার কাছে লুকিয়েছে কেন?

হাজারও কথা ভাবতে ভাবতে নিহি অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। আশেপাশে আরো অনেক পর্যটকরাও যাওয়া-আসা করছে। ভীড়ের মাঝে একজন সুদর্শন ছেলের সাথে ধাক্কা খায় নিহি। অন্যমনস্ক ছিল বলেই এই ধাক্কাটা এখন খেতে হলো। ছেলেটির হাতের পানির বোতল মাটিতে পড়ে গেছে। যেহেতু ভুলটা নিহির তাই সে নিজেই মাটি থেকে পানির বোতল তুলে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'স্যারি!' তখনই জবান বন্ধ হয়ে যায় নিহির। চোখ আটকে যায় সেই সুদর্শন পুরুষটির মুখের দিকে। সে নিজেও এমন ঘটনায় বিরক্ত হয়েছিল। তবে এবার নিকাব পরা নিহির চোখের দিকে তাকিয়ে আৎকে ওঠে। অনেক, অনেক বেশিই পরিচিত এই কাজলকালো চোখ দুটো। এই চোখের ভাষাও দীর্ঘপরিচিত। অস্ফুট স্বরে অনলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
"নিহি!"
.
.
.
চলবে...................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন