আড়ালে আবডালে - পর্ব ৪০ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


অনলের পাগলামি বেড়েছে। ওকে কিছুতেই মানানো যাচ্ছে না। অনলের বন্ধু, ভাই, ডাক্তার সবাই মিলে ধরে৷ তারপর নার্স ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। ঘুম না আসা পর্যন্তও ওকে কেউ ছাড়েনি৷ যখন ঘুমে প্রায় ঢুলুঢুলু অবস্থা তখন ওকে বেডে শুইয়ে দেওয়া হয়৷ এক কোণায় কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিহি। আজমল আহমেদ ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলেন,
"আপনি বলেছিলেন নিহিকে আনলে অনলের অবস্থার উন্নতি হবে৷ এখন তো আমার ছেলে আরো বেশি পাগলামি করছে।"

ডাক্তার চিন্তিত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর নিহিকে জিজ্ঞেস করেন,
"উনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন কেন?"
নিহির অস্বস্তি লাগছে৷ কী বলবে তাদের? নিহিকে এই সিচুয়েশন থেকে বাঁচায় আমান৷ উত্তরে বলে,
"আপনি ডাক্তার৷ বর্তমানে অনলের চিকিৎসাও আপনি করছেন। তাই আপনার থেকে কিছু না লুকানোই ভালো।"
"জি, জি অবশ্যই।"

আমান অকপটে বলে ফেলে,
"নিহি আমার স্ত্রী।"
ডাক্তার ঘাবড়ে যান। চোখ বড় বড় করে তাকান তিনি। বড় ভাইয়ের বউয়ের জন্য ছোটভাই এমন পাগলামি করবে কেন? তিনি একটু নড়ে-চড়ে দাঁড়ান। তারপর বলেন,
"আপনারা আমার চেম্বারে আসুন। এখানে নার্সরা আছে। তারা অনলের টেক কেয়ার করবে। আমি পুরো বিষয়টা রিল্যাক্সে শুনতে চাচ্ছি।"

চেম্বারে উপস্থিত আছেন আজমল আহমেদ, অনামিকা রহমান, আমান, নিহি এবং ডাক্তার। নিহির মুখ থেকে একটু আগে যা যা শুনেছে তার সবটা শুরু থেকে বর্ণনা করে আমান বলে৷ নিহি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারের কপালে ভাঁজ পড়ে। চেয়ারে বসে খানিকটা নড়াচড়া করতে করতে বলেন,
"খুবই ক্রিটিকাল! আসলে পেশেন্ট আপনার সঙ্গে আপনার মিসেসকে সহ্য করতে পারছে না৷ যদি সে অন্য কারো ওয়াইফও হতো তাহলেও এতটা পাগলামি করত না। ভালোবাসার মানুষটি নিজেরই আপন ভাইয়ের বউ! এটা আসলেই সহ্য করা ক্ষমতার বাইরে।"

মুখ ভার করে আজমল আহমেদ প্রশ্ন করেন,
"তাহলে এখন কী করব আমরা?"
"সাইকিয়াট্রিস্ট ছাড়া আর কোনো উপায় দেখি না৷ আমার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে। আপনারা তার কাছেই যেতেই পারেন।"
কথাগুলো বলতে বলতে একটা কার্ড এগিয়ে দেন তিনি।


চেম্বার থেকে বের হয়ে থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আজমল আহমেদ। আমান খুব শান্তকণ্ঠে বলে,
"আমি নিহিকে রেখে আসছি।"
তিনি দাঁত কটমট করে বলেন,
"আসার কী দরকার আর? আসতে হবে না! বউ নিয়েই থাকো।"
আমান চারপাশে একবার তাকালো। নিহির মুখের বর্ণ পাল্টে যায়৷ আমান চাপাস্বরে বলে,
"কোথায় কী বলছ আব্বু? আশেপাশে মানুষজন আছে!"
"হ্যাঁ,তো? তারাও জানুক বিয়ের পর ছেলেরা কেমন চেঞ্জ হয়ে যায়! একটাবার আমাদের জানানোরও প্রয়োজন মনে করে না। এমনকি এখনো অসুস্থ ভাইয়ের কথা ভাবছে না। শোনো, একটা কথা সরাসরি তোমায় বলছি। এই মেয়েকে তুমি ডিভোর্স দাও। যতবার অনল তোমাকে ওর সাথে দেখবে ততবারই পাগলামি করবে। অনলকে আর কষ্ট পেতে দেখতে পারব না আমি। পাগল হয়ে গেছে ছেলেটা দেখেছ তুমি?"
আমান কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবে এখানে কিছু বলা উচিত নাকি চুপ করে থাকা। ডিভোর্স নিয়ে কথা উঠেছে। চুপ করে থাকা মানে বাবার কথায় সায় দেওয়া। তাই আমান বলে,
"আমি নিহুকে ভালোবাসি। ওকে ছেড়ে থাকার কথা যেখানে ভাবতে পারি না সেখানে ডিভোর্স তো অনেক দূরের কথা!"
"একটা মেয়ে এখন জীবনের সবকিছু হয়ে গেছে? আমরা কেউ কিছু না তোমার?"

অনামিকা রহমান বলেন,
"থামো প্লিজ!"
আজমল আহমেদ দ্বিগুন ক্ষেপে বলেন,
"ওকে আমার চোখের সামনে থেকে যেতে বলো।"
আমানও আর এক মুহূর্ত দেরি না করে নিহিকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। নাকের পাটা ফুলে আছে। কিছু বলারও সাহস পাচ্ছে না নিহি। চুপচাপ আমানের পাশের সীটে বসে আছে। অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে বলে,
"উনার ওপর রাগ করবেন না। আসলে বাবা তো উনি! ছেলের এমন অবস্থা দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেননি।"
আমান ধমকের স্বরে বলে,
"অনল ছেলে আমি ছেলে না? আমার কথা ভাবার প্রয়োজন নেই তার? সবকিছু জানার পরও কীভাবে এমন কথা বলেন? কিছু মানুষ থাকে যারা চোখ থাকতেও অন্ধ থাকতে পছন্দ করেন। আমার বাবাও হচ্ছেন ঠিক তেমন।"

নিহি চুপসে যায়। এরপর আর কেউই কিছু বলেনি। নিরব থেকেছে দুজনই। গাড়ি থামে সোজা মিহির বাড়ির সামনে। নিহি গাড়ি থেকে নামার সময় আমান বলে,
"আমি এখানেই আছি।"

নিহি কিছু বলল না৷ উপরে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর তরুকে নিয়ে ফিরে আসলো। সঙ্গে মিহিও এসেছে। আমানকে বলেছে সাবধানে পৌঁছে দিতে। আবুল, টুকটুকি, মিহি ওদের সবার থেকে বিদায় নিয়ে ওরা আবার যাত্রা শুরু করে। আমানের রাগ দমে গেছে। হুশ ফিরেছে এখন। নিহি চলে যাচ্ছে! বুকের ভেতর কেমন যেন যন্ত্রণার উদয় হচ্ছে। এত ঝামেলা পোহাতে হলো মেয়েটাকে। আমান আড়চোখে একবার নিহির দিকে তাকালো। সীটের সাথে হেলান দিয়ে জানালার পানে তাকিয়ে আছে নিহি। আমান হাত বাড়াতে গিয়েও তরুর দিকে চোখ পড়ে যায়। তাই আর নিহিকে ডাকলো না। সে তরুকে জিজ্ঞেস করে,
"পরীক্ষা শেষ হলে আসবেন তো আবার?"
তরু হেসে বলে,
"শিওর জানিনা ভাইয়া। আমরা না আসি, আপনি তো যাবেন।"
"দেখি কী হয়!"

নিহির বাড়ির সামনে আসার পর তরু আর নিহি নেমে পড়ে। তরু ব্যাগ নিয়ে আগেই ভেতরে চলে যায়। আমানও গাড়ি থেকে বের হয়েছে। নিহির মুখোমুখি দাঁড়াতেই নিহি জিজ্ঞেস করে,
"আজও নিশ্চয়ই বাড়িতে আসবেন না?"
মোহময় দৃষ্টিতে আমান তাকিয়ে থাকে তার প্রিয়তমার দিকে। কী মায়া, কী ভালোবাসা সেই চোখেমুখে৷ তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে ওঠে। গালে আলতো করে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
"ভালোবাসি।"

নিহির ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা প্রতিফলিত হয়। আমান তার হাত দুটো ধরে বলে,
"স্যরি!"
"স্যরি কেন?"
"তখন রাগ দেখিয়ে কথা বলার জন্য। ওভাবে উচ্চস্বরে কথা বলা ঠিক হয়নি।"
"আপনি তো আর আমায় বলেননি! যাই হোক, বাবার ওপর রাগ করে থাকবেন না।"
কিছুক্ষণ মৌন থেকে আমান বলল,
"আমার ভয় করে নিহু।"
"ভয়? কীসের ভয়?"
"তোমাকে হারানোর ভয়। সেই সময়গুলোই তো ভালো ছিল। যখন শুধু আমরা দুজনই দুজনার ছিলাম। হুট করে সব এমন এলোমেলো হয়ে গেল কেন?"
নিহি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল,
"কোনোকিছুই এলোমেলো হয়নি৷ সবই সাজানো-গোছানো আছে। এটা আসলে হওয়ারই ছিল।"
"যত যাই হোক, তুমি আমায় কথা দাও আমায় ছেড়ে কখনো যাবে না?"

আরেকটু শক্ত করে নিহি আমানের হাত চেপে ধরল। চোখে চোখ রেখে বলল,
"যাওয়ার হলে তো প্রথমেই চলে যেতাম। যাইনি। আর যাবও না।"
তৃপ্তির হাসি হাসে আমান। বলে,
"অনলকে তুমি ক্ষমা করে দিও। কথা দিচ্ছি, ও তোমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে তারচেয়ে হাজার গুণ ভালোবাসা দিয়ে আমি সেই কষ্ট ভুলিয়ে দেবো।"
"আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।"
"একটা কথা বলব?"
"হুম।"
"না গেলে হয় না?"
"আমার পরীক্ষা!"
"শেষ হলে আবার আসবে?"
"আসব।"
"নিহু?"
"হু!"
"তোমার বাবা যদি জেনে যায়?"
"আপনার বাবাও তো জেনে গেছে। সে আপনাকে বলেছে আমায় ডিভোর্স দিতে। আপনি কি রাজি হয়েছেন? আমার হাত ছেড়েছেন? এতটুকু ভরসা আমার ওপর করতে পারেন। আমার পরিবার না চাইলেও আমি আপনাকে ছাড়ব না।"
"আমি আমার নিহুপাখিকে বিশ্বাস করি। সাবধানে থেকো।"
"আপনিও সাবধানে থাকবেন।"
"থাকব। ভেতরে যাও এখন।"
"না। আপনি আগে যান।"
"জি না৷ তুমি আগে।"
"না, আপনি আগে।"
"তুমি আগে।"
"আপনি আগে।"
"কথা না শুনলে এখানেই চুমু খাব কিন্তু!"

নিহি চোখমুখ কুঁচকে বলে,
"ফাজিল! যাচ্ছি।"
আমান শব্দ করে হাসে। নিহি তার গাল ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বলে,
"সবসময়েই এই হাসিটা দেখতে চাই। তাহলে যত বাঁধাই আসুক না কেন আমি সব পার হতে পারব।"
"তুমি সারাজীবন আমার হয়ে আমার জীবনে থাকলে এই হাসিও সারাজীবন থাকবে।"

নিহি মৃদুমুচকি হেসে বলে,
"থাকব। আসছি।"
"যাও।"
কয়েক কদম এগিয়ে আবার ফিরে আসে নিহি৷ আমান ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা করে জিজ্ঞেস করে,
"কী?"
"আমি কিন্তু অপেক্ষায় আছি।"
"কীসের?"
"আপনার না বলা কথাগুলো শোনার জন্য।"
"সময় হলেই বলব।"
"আচ্ছা। সাবধানে যাবেন।"

নিহি ভেতরে যাওয়ার পর আমানও চলে যায়। ড্রয়িংরুমে সাহেলা বেগম টিভি দেখছিলেন। নিহি আসার পর জিজ্ঞেস করেন,
"আমান আসলো না?"
"সে তো বলেছে একেবারে নিতে আসবে।"
"তুই এক পাগল, স্বামীও পেয়েছিস আরেক পাগল।"
নিহি সাহেলা বেগমের পাশে বসে কোলে মাথা রেখে বলে,
"হুম আম্মা৷ ভালোবাসার পাগল!"
তিনি হেসে ফেলেন। বলেন,
"যা ফ্রেশ হয়ে আয়। খেতে দিচ্ছি।"

সাহেলা বেগম উঠে রান্নাঘরে যান। তমা তখন ঘর থেকে বের হয়ে আসে। নিহিকে জিজ্ঞেস করে,
"কখন আসলে?"
"এখনই৷ তিতির কোথায়?"
"ঘরে। ফ্রেশ হতে যাও।"
"যাচ্ছি।"
নিহি যাওয়ার পথে তমাকে পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করে,
"ভাবি আর কি কোনো চিঠি এসেছিল?"
"না। কেন?"
"এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।"

নিজের রুমে যেতে যেতে কতশত চিন্তাভাবনার যে উদয় হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তরু এসেই শুয়ে পড়েছে। নিহি যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে সবার সঙ্গে খেতে খেতে গল্পগুজব করে। কাউকে বুঝতে দেয় না মনের ভেতর বয়ে চলা ঝড়ের আভাস! বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আমানের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বিছানা থেকে উঠে টিবেলের ওপর থেকে ফোন নিয়ে এসে আবার শোয়। ফোন অন করতেই দেখে আননোন নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছে। আগে ম্যাসেজটা ওপেন করে সে। চমকে যেতে হয় প্রতিটা লাইন পড়ে। হুট করেই এমন ম্যাসেজ! তৎক্ষণাৎ ঐ নাম্বারে কল করে নিহি কিন্তু নাম্বারটি বন্ধ। কয়েকবার কল করে। কোনো লাভ হলো না। সে আবার ম্যাসেজটা পড়ে।

'নিহি কাজটা একদম ভালো করোনি তুমি। আমার থেকে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে চরম ভুল করেছ। এর শাস্তি তো তোমায় পেতেই হবে। সময় থাকতে চলে যাও আমানের জীবন থেকে। নয়তো এর খেসারত দিতে হবে তোমার জীবন দিয়ে!'
.
.
.
চলবে...................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন