অবেলার অভিলাষ - পর্ব ১৫ - শারমিন আক্তার সাথী - ধারাবাহিক গল্প


__আ‌গে ব‌লো এত রা‌তে কার সা‌থে কথা বল‌ছিলা?

__‌নিউ জিএফ এর সা‌থে।

__গুড গুড ভে‌রী গুড। কেন এখন ওল্ড জিএফ‌কে পছন্দ হ‌চ্ছে না এখন?

__তনয়া‌কে টে‌নে বু‌কের ম‌ধ্যে নি‌য়ে বলল, আমার জানপা‌খিটা জীব‌নেও পুরাতন হ‌বেনা। সি ইজ এভারইউথ লাইক নেচার। ‌যে, কখ‌নো পুরাতন হ‌বেনা। অনন্ত‌যৌবনা, প্রকৃ‌তির সব রূপ রং যার মা‌ঝে বিদ্যমান। আমার তানুপা‌খিটা।

__বাস বাস প্রশংসা ক‌রে শেষ ক‌রে দিবা না‌কি?

__নাহ্ ভা‌লো‌বে‌সে শেষ ক‌রে দি‌বো। এত ভা‌লোবাস‌বো  এত ভা‌লোবাস‌বো যে, তু‌মি ভা‌লোবাসায় বিরক্ত হ‌য়ে যাবা, তখন আরো বে‌শি ভা‌লোবাসবো।

__ওহ রি‌য়ে‌লি! তা এত ভা‌লোবাসার কারন কী?

__কারন আই-----------ইউ।

__ধূর! কচুশাক।

__‌কেন?

__এত দিন পর থ্রী ম্যা‌জিক ওয়ার্ড থে‌কে মাত্র দু‌টো বললা, বা‌কি একটা ক‌বে বলবা?

__‌যে‌দিন তোমায় নি‌জের ক‌রে পা‌বো সে‌দিন। 

__ত‌বে কী আমি এখন তোমার নই?

__তু‌মি তো সবসময়ই আমার। তোমার সবটা আমার। (আয়াত কৌশ‌লে ফো‌নের কথাটা এড়িয়ে গে‌লো) 

__আজ তোমার বু‌কে ঘুমাই?

__এ মে‌য়ে ব‌লে কী?

__‌কেন?

__পা‌শের রু‌মে ছোট বোন আছে। সে কী ভাব‌বে? কী শিখ‌বে আমার কাছ থে‌কে!

__‌তোমার বোন তো ক‌চি খু‌কি। কিছু বু‌ঝেনা। (ভেং‌চি কে‌টে)

__আয়াত হা হা ক‌রে হে‌সে তনয়া‌কে পু‌রোটা নি‌জের মা‌ঝে আবদ্ধ ক‌রে বলল, এখন য‌দি উল্টা পাল্টা কিছু ক‌রে ফে‌লি?

__‌ঠিক অাছে ক‌রো। আমার কোন আপ‌ত্তি নেই। 

আয়াত তীক্ষ্ণ দৃ‌ষ্টি‌তে তনয়ার দি‌কে ভাব‌ছে, একটু মজা করা যাক তনয়ার সা‌থে। আয়াত শোয়া থে‌কে উঠে, হুট ক‌রে গা‌য়ের টি শার্টটা খু‌লে ফেল‌লো। 
__তনয়া চোখ বড় বড় ক‌রে তা‌কিয়ে ঢোক গি‌লে বলল, ওটা কেন খুললা?

__‌তোমার তো কোন আপ‌ত্তি নেই। তাই ভাবলাম এত ফরমা‌লে‌টি দে‌খি‌য়ে কী লাভ! মিয়া বি‌বি রা‌জি তো ক্যা ক‌রেগা কা‌জি। বি‌য়ের পর হোক বা আগে আমরা আমারাই তো। তারপর তনয়া‌কে খা‌লি গা‌য়ে জ‌ড়ি‌য়ে ধর‌তেই তনয়া বলল,
__ইয়ে মা‌নে আমি তো মজা কর‌ছিলাম। তু‌মি সি‌রিয়াস‌লি কেন নি‌চ্ছো! তু‌মি না ভা‌লো ছে‌লে!

__নাহ আজ আমি খারাপ ছে‌লে হ‌বো। অনেক খারাপ। 
তারপর তনয়ার হাত দু‌টো বা‌লি‌য়ের সা‌থে চে‌পে ধ‌রে তনয়ার ঠোঁ‌টের দিকে এগো‌তেই তনয়া চোখ বন্ধ ক‌রে ফেল‌লো। আয়াত তনয়ার দি‌কে তা‌কি‌য়ে মুখ টি‌পে টি‌পে হাস‌ছে। তনয়ার কপা‌লে চু‌মো খে‌য়ে হা হা ক‌রে হে‌সে দি‌লো। তনয়া চোখ খুল‌তেই আয়াত ওর পা‌শে শু‌য়ে তনয়া‌কে উল্টে নি‌জের উপর নি‌য়ে নি‌লো। আয়া‌তের বু‌কের উষ্মতায় তনয়ার পরম সুখ সুখ অনুভূ‌তি হ‌চ্ছে। আয়াত তনয়ার মাথায় হাত বু‌লিয়ে বলল, আমি জা‌নি তান‌ুপা‌খি আপ‌নি শুধু মু‌খেই বা‌তেলাবা‌জি কর‌তে পা‌রেন। কা‌জের সময় লবডঙ্কা। এজন্য বললাম চুপচাপ পা‌শের রুমে গি‌য়ে ঘু‌মি‌য়ে পড়ুন।

__তনয়া মুখ ভেং‌চি কে‌টে বলল, কেন ছে‌লে মেয়ে বু‌ঝি একসা‌থে ঘুমা‌তে পা‌রেনা?

__‌তোমার প্র‌শ্নের উত্তর ছোট্ট একটা কাহিনী থে‌কে বলি। একবার এক লোক এক দরবে‌শের কা‌ছে গি‌য়ে জি‌জ্ঞেস কর‌লো, দর‌বেশ বাবা এক ছে‌লে আর এক মে‌য়ে এক সা‌থে এক রু‌মে এক জাগায় কেন ঘুমা‌তে পা‌রেনা। তখন দর‌বেশ বলল, ওরে হারামজাদা ওরা ঘুমা‌লে তো কোন সমস্যা ছি‌লো না। কিন্তু ওরা দুজন তো ঘুমা‌বেই না। আর না ঘু‌মি‌য়ে যেটা কর‌বে সেটায় সমস্যা। 

আয়া‌তের গল্প শু‌নে তনয়া পু‌রো শরীর দু‌লি‌য়ে হাস‌তে লাগ‌লো। আয়াত তখন বলল, 
সো ম্যাডাম মোরাল অব দ্যা স্টো‌রী আমরা দুজন একসাথে থাক‌লে ঘুম হ‌বেনা হ‌বে অন্য কিছু। তনয়া আয়া‌তের বু‌কে দু‌টো কিল ব‌সি‌য়ে বলল, 

__‌পা‌জি! ব‌লি আরো একাদন তো তোমার বু‌কে মাথা রে‌খে ঘু‌মি‌য়ে‌ছিলাম। সে‌দিন তো কিছু হলো না। তবে আজ কেন?

__‌সে‌দিন হয়‌নি ব‌লে যে, আজ হ‌বেনা তার কী গ্যারা‌ন্টি! চ‌লো রু‌মে যা‌বে। এখন পাগলা‌মি বন্ধ ক‌রো। আগে বি‌য়ে হোক তারপর দেখ‌বো কত পাগলামী কর‌তে পা‌রো। তনয়াকে কো‌লে ক‌রে নিয়ে নি‌জেই তনয়া‌কে রু‌মে নি‌য়ে গি‌য়ে বিছানায় শু‌য়ে দি‌য়ে, আয়াত নি‌জের রুমে এসে ঘু‌মি‌য়ে পর‌লো।

৩৬!!

      খুব সকা‌লে ওরা ঢাকার বা‌সে উঠে রওনা দি‌লো। মেঘা‌কে তনয়ার ফ্ল্যা‌টের চা‌বি দি‌য়ে আয়াত তনয়া ড্রাইভার‌কে নি‌য়ে বাসস্ট‌পে গে‌লো। বা‌সে উঠে ড্রাইভার‌কে বা‌ড়ি পা‌ঠি‌য়ে দি‌লো। সাতটার সময় বাস  গন্ত‌ব্যের উদ্দে‌শ্যে রওনা দি‌লো। কুয়াশার চাদ‌রে সারা পথ ঢে‌ঁকে আছে। সকালটা আজ তনয়ার কা‌ছে এত এত মি‌ষ্টি লাগ‌ছে। ঝি‌রি ঝি‌রি হিম ধরা‌নো ঠান্ডা বাতাস। তনয়া বা‌সের জানালাটা হা‌লকা খু‌লে দিতেই হিম ধরা ঠান্ডা এসে পু‌রো শরী‌রে কাঁপু‌নি ধ‌রিয়ে দি‌লো। আয়াত জানালাটা বন্ধ ক‌রে ফেল‌তেই তনয়া আবার খুল‌তে নি‌লে আয়াত ধমক দিযে বলল, চুপ চাপ বসে থাকবা। সকা‌লের ঠান্ডা বাতাস বু‌কে লাগ‌লে প‌রে ঠান্ডা লে‌গে অসুখ কর‌বে। 
তনয়া ঠোঁট বা‌কি‌য়ে ভেং‌চি কে‌টে গোমরা মু‌খে নি‌চের দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইল। আয়াত হেট ফোন বের ক‌রে একটা নি‌জের কা‌নে দি‌য়ে অপরটা তনয়ার কা‌নে গু‌জে দি‌লো। তনয়া চুপ‌টি ক‌রে আয়া‌তের কাঁ‌ধে মাথা রাখ‌লো। 
আস‌ল আয়াত ক‌বিতা রেকর্ড ক‌রে এনে‌ছে। সেটাই হেট‌ফো‌নে শুন‌ছে,

""""আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত    থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজা জানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।

আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।

না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।

তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।

শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।

ক‌বিতা: আমা‌কে ভা‌লোবাসার পর
‌লেখা: হুময়ুন আজাদ। 

তনয়া ক‌বিতাটা শু‌নে চোখ বড় বড় করে রাগী দৃ‌ষ্টি‌তে আয়া‌তের দি‌কে তাকা‌লো। আয়াত ঢোক গি‌লে বলল,
__এত সুন্দর ক‌বিতা শোনা‌নোর পর কোথায় জ‌ড়িয়ে ধরে আদর কর‌বে তা না ক‌রে চোখ রা‌ঙি‌য়ে ভয় দেখা‌চ্ছো কেন?

__তু‌মি এটা কার ক‌বিতা আবৃত্তি কর‌ছো?

__হুমায়ূন আজা‌দের। কেন ভা‌লো না?

__হ্যাঁ ভা‌লো ত‌বে এ মুহূ‌র্তের সা‌থে মা‌নে আমার সা‌থে এই ক‌বিতাটা যায়?

__‌কেন তানুপা‌খি।

__‌তোমার তানুপা‌খির মায়‌রে বাপ। এই লাইনগুলা কেন বললা?

__‌কোন গু‌লো?

__ঐ যে, লাইন কয়টা,

তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।

ব‌লি আমার কোন প্রাক্তন আমার ঠোঁ‌টে চু‌মো খে‌য়ে‌ছি‌লো?

__এই‌রে এই লাইনগু‌লোর কথা তো খেয়াল ছি‌লো। তনয়া মা‌নে তানুপা‌খি আমার লক্ষ্মী জানটা, রাগ ক‌রেনা। ওটা তো জাস্ট একটা ক‌বিত‌া। তাও হুমায়ুন আজাদ স্যার লিখ‌ছে আমি তো শুধু আবৃ‌ত্তি কর‌ছি। আমার কি দোষ! আমি তো এত কিছু ভে‌বে তো ক‌রি‌নি। স্য‌রি।

তনয়া রাগ ক‌রে অন্য দি‌কে মুখ ঘু‌রি‌য়ে রইল।

—————

তনয়া অন্য দি‌কে মুখ ঘুরি‌য়ে আছে। আয়াত ভাব‌ছে, কী করলাম? প্র‌তিবার ক‌বিতা শোনা‌নোর পর তনয়া কত আ‌বেগী হ‌য়ে জ‌ড়িয়ে ধ‌রে। আজ তো পুরাই উল্টা। এখন কী ক‌রে রাগ ভাঙাবে! এখন ক‌বিতা বল‌লে নির্ঘাত বা‌সে সবার সাম‌নে ব‌সে পিটাবে। তাই অন্য ব্যবস্থা কর‌তে হ‌বে। আয়াত দা‌ড়ি‌য়ে উপরে রাখা ব্যাগ থে‌কে ‌চিপস বের ক‌রে খে‌তে শুরু কর‌লো। তনয়া আড় চো‌খে তা‌কি‌য়ে দেখ‌ছে। আয়াত তনয়ার দি‌কে তাকা‌তেই তনয়া ভেং‌চি কে‌টে আয়াতের হাত থে‌কে চিপসটা নি‌য়ে আবার বাই‌রের দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইল আর চিপ‌স খে‌তে লাগ‌লো। আয়াত অসহায় দৃ‌ষ্টি‌তে তনয়ার দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইল। 

পাস থে‌কে একটা ছে‌লে ওদের দি‌কে অনেকক্ষন যাবত নো‌টিশ কর‌ছিলো। ছে‌লেটা আয়া‌তের দিকে খা‌নিকটা ঝু‌কে আয়াত‌কে ইশারায় কা‌ছে ডাক‌লো। আয়াত বসা অবস্থায় ঝু‌কে ছে‌লেটার দিকে গি‌য়ে বলল, 
__‌কিছু বল‌বেন?

__‌কী হয় আপনার?

__‌দে‌খে কী ম‌নে হয়?

__ম‌নে হয় স্ত্রী। 

__ত‌বে সেটাই। 

__তা ভা‌বি রাগ কর‌ছে কেন?

__আ‌ছে কিছু কারন। কেন?

__আপ‌নি মিয়া বৌ পাল‌তে জা‌নেন না। 

__‌বৌ কী পালার জি‌নিস? আর কী করে পাল‌তে হয়?

__‌শো‌নেন ঘ‌রের বৌদের বে‌শি লাই দি‌তে নেই। বে‌শি ঢং কর‌লে কা‌নের নি‌চে দি‌বেন। তা‌তেও না মান‌লে লা‌থি মে‌রে বা‌পের বাড়ি পা‌ঠি‌য়ে দি‌বেন। দেখ‌বেন তখন আপনার কথায় উঠ‌বে বস‌বে। বুঝ‌ছেন?

__বুঝ‌ছি দু‌টো জিনিস?

__কী কী?

__এই যে, আপ‌নি পাঠা, আর গাঁধা। তাই পাঠার মত ভ্যা ভ্যা ক‌রে ছাগলামী কথা ব‌লেন আর গাঁধার মত লা‌ত্থি মা‌রেন। 
‌লোকটা কিছু বল‌তে নি‌বে তখন আয়াত বলল, বে‌শি কথা বল‌লে, কা‌নের চার আঙ‌ুল নি‌চে ছোট্ট ক‌রে দু‌টো থাপ্পর দিবো। শালার লাগাম ছাড়া জং‌লী পাঠা। যা নি‌জের সিটে গিয়ে বস। আমা‌দের কেন ডিসট্রাব কর‌ছিস। আয়াত তনয়ার ডান হাতটা নি‌জের হা‌তের মু‌ঠোয় নি‌য়ে চ‌ুপচাপ ব‌সে রইল। তনয়া‌কে এখন বে‌শি কিছু বল‌লে উল্টো আরো ‌রে‌গে যা‌বে। তাই আয়াত চুপ থাকাটাই শ্রেয় ম‌নে কর‌লো। তনয়ার রাগ কম‌লে নি‌জে থে‌কে‌ই আয়াতের সা‌থে কথা বল‌বে।

বাস শিকারপুর পে‌রি‌য়ে গে‌লো, রাস্তার দু ধা‌রে বিশাল বড় ফস‌লি জ‌মি, এখন কিছু কিছু জায়গায় সব‌জি চাষ করা, বা‌কিটা যতদূর চোখ যায় ততদূর স‌রিষার ক্ষেত। কমাস পর যখন যা‌বে তখন পু‌রো মাঠ জু‌ড়ে শুধু গ‌মের সমা‌রোহ থাক‌বে। তনয়া নীরবতা ভে‌ঙে বলল, 

__জা‌নো আয়াত আমি না কখ‌নো গম ক্ষে‌তের ভিতর ঢু‌কি‌নি। খুব ইচ্ছা ক‌রে সোনালী গমগু‌লো‌কে গা‌ছের সা‌থে ছুঁ‌য়ে দেখ‌তে। এসব মা‌ঠের বিশালতা যতদূর চোখ যায় ততদূর। দে‌খো স‌রিষার ক্ষে‌তগু‌লো কেমন হলুদ সমু‌দ্রের মত লাগ‌ছে। আমার খুব ইচ্ছা কর‌ছে হলুদ সমু‌দ্রে ডুব দি‌তে। জা‌নো টাংগাই‌লেও এত বড় বড় স‌রিষার ক্ষে‌ত আছে।

__তু‌মি টাংগাইল গে‌ছিলা?

__হ্যাঁ। আমার এক আঙ্কে‌লের বি‌য়ে‌তে। এস এস সি পরীক্ষার পর। শীতকা‌লে গে‌ছিলাম তো। সেখা‌নেও এমন বিশাল বড় বড় স‌রিষা ক্ষে‌তের হলুদ সমুদ্র দেখে‌ছিলাম। জা‌নো টাংগাই‌লের বি‌য়ের কিছু নিয়ম আমার কা‌ছে খুব অদ্ভুদ লাগ‌ছে।

__‌কেমন?

__আমা‌দের এখা‌নে ‌যেমন বি‌য়ের পর নতুন বৌ কে ছে‌লের বাবা মা নি‌জে‌দের ঘ‌রে বরন ক‌রে তু‌লে। কিন্তু টাংগাই‌লে নতুন ছে‌লে বৌ এর জন্য আলাদা ঘর বানা‌নো হয়। এবং বি‌য়ের পর তা‌দের সে ঘ‌রে তু‌লে দেয়। এবং তারা তা‌দের বৈবা‌হিক জীবন নতুন ঘর থে‌কেই শুরু করে। তারপর বি‌য়ের প‌রের দিন বৌ ভাত হয়। কিন্তু বৌ ভা‌তের অনেক কাজ নতুন বৌ‌কে কর‌তে হয়। যেমন, সকা‌লে উঠে উঠান ঝাড়ু দেয়া, রা‌তের এটো ব‌াসন ধোয়া, মশলা বাটা, রান্নায় সাহায্য করা। অবশ্য বা‌ড়ির বা‌কিরা এস‌বে নতুন বৌ দের হেল্প ক‌রে তবুও নতুন বৌ বি‌য়ের প‌রের দিনই এত কাজ। ব্যাপারটা কেমন জা‌নি তাইনা। 

__আয়াত হা‌সি দিয়ে বলল, বেচারী নতুন বৌ, সারা জীবন‌ তো এম‌নি কাজ কর‌তে কর‌তে যে‌তে হ‌বে, বি‌য়ের প‌রের দিন পর্যন্ত শা‌ন্তি নেই। 

__হুমম। আর আমা‌দের এখা‌নে তো বি‌য়ের প্রথম দু তিন মাস নতুন বৌ‌কে তেমন কাজ করতেই দেয়া হয়না। টাংগাই‌লে এমন আরো কিছু অদ্ভুদ নিয়ম আছে। অবশ্য প্র‌তিটা অঞ্চ‌লেই কোন না কোন ‌নিয়ম আছে যা অন্য অঞ্চ‌লের কা‌ছে অদ্ভুদ লা‌গে।
ত‌বে টাংগাই‌লে দধি জাস্ট ওয়াও। তারা যে কোন অনুষ্ঠানে দ‌ধি নি‌জেরা বা‌ড়িতে বানায়। আর সেখা‌নের চমচম আর মি‌ষ্টিগু‌লো একদম আমা‌দের গৌড়নদীর মি‌ষ্টির মত টে‌ষ্টি। 

__‌মি‌ষ্টি টে‌ষ্টি ত‌বে তোমার মত না। (দুষ্ট‌মি ক‌রে)
তনয়া লজ্জা পে‌য়ে আয়া‌তের হা‌তে চিম‌টি কাট‌লো।

আরো কিছুক্ষন কথা বল‌ার পর তনয়া মাথাটা আয়া‌তের কাঁধে এলি‌য়ে দি‌লো। মাওয়া আস‌তে এখ‌নো ঘন্টা খা‌নিক লাগ‌বে। তনয়া হালকা গলায় বলল,
__আর কতক্ষন আয়াত?

__এই ঘন্টা খা‌নিক। কেন তোমার মাথা ব্যাথা কর‌ছে?

__হুম। মাথায় ঘুরা‌ন্টি দি‌চ্ছে। ব‌মি পা‌চ্ছে। আয়াত প‌কেট থে‌কে একটা ঝাল চক‌লেট বের ক‌রে তনয়ার মু‌খে পু‌রে দি‌লো। তারপর নি‌জের সিটটা‌কে‌ এলি‌য়ে তনয়া‌কে বু‌কে মাথা রাখ‌তে বলল। আর সা‌থের বড় চাদরটা দুজনে জ‌ড়ি‌য়ে নি‌লো। তনয়া চোখ বন্ধ ক‌রে চুপ ক‌রে আয়া‌তের বু‌কে মাথা রাখ‌লো। আয়াত তনয়ার মাথাটা নি‌জের বু‌কে চে‌পে ধ‌রে রাখ‌লো। তনয়ার মাথায় ঝা‌কি লাগ‌লে হয়ত স‌ত্যি স‌ত্যি ব‌মি ক‌রে দি‌বে। আয়াত চাদ‌রের নিচ থে‌কে তনয়া‌কে গভীর ভা‌বে জ‌ড়ি‌য়ে ধর‌লো। তনয়া চোখ বন্ধ ক‌রে ঘু‌মি‌য়ে পড়‌লো অল্প সম‌য়েই। আয়াত স্ব‌স্তির নিঃশ্বাস ফে‌ললো আর বলল, যাক ঘু‌মি‌য়ে‌ছে নয়ত বমি কর‌লে শরীর খারাপ কর‌তো। 

তনয়ার মাথাটা বু‌কের সা‌থে চে‌পে ধ‌রে ভাব‌ছে কী আছে মে‌য়েটার মাঝে! এত কেন ভা‌লোবা‌সি ওকে। ম‌নে চায় ওকে বু‌কের ভিতর ঢুকি‌য়ে রা‌খি। যা‌তে আমার নিঃশ্বা‌সের সা‌থে মি‌শে যায়। 

মাওয়া গি‌য়ে বাস থে‌কে নাম‌তেই তনয়া হরহর ক‌রে ব‌মি ক‌রে দি‌লো। আয়াত তনয়ার পি‌ঠে হাত বু‌লি‌য়ে দি‌লো। তনয়া‌কে ঠিকভা‌বে প‌রিষ্কার ক‌রে দিয়ে একটা হে‌াটে‌লে বস‌লো। তারপর জি‌জ্ঞেস কর‌লো

__কী খা‌বে?

__‌কিছুনা। তু‌মি খে‌য়ে নাও।

__ইলিশভা‌জি দি‌য়ে ভাত খা‌বে?

__ইয়াক!

__ইয়াক কেন? ই‌লিশ মাছ তো তোমার পছ‌ন্দের।

__হ্যাঁ কিন্তু যখন মাথা ব্যাথা ক‌রে তখন ইলিশ মাছ খে‌লে মাথা আরো বেশি ব্যাথা ক‌রে। 

__ওহ। আয়াত কিছুক্ষন ভে‌বে‌ চিং‌ড়ি মাছ আর ভাত অর্ডার কর‌লো।

__আয়াত ভাত অর্ডার না ক‌রে হালকা কিছু নিতা?

__নাহ্। কারন আমা‌দের দুপু‌রের খাবার খে‌তে অনেক বেলা হ‌য়ে যা‌বে। অর তাছাড়া মাত্র ব‌মি করলা। ভারী কিছু খে‌য়ে মাথা ব্যাথার ঔষধ খা‌বে দেখ‌বে ভা‌লো লাগ‌বে। 

খাবার আস‌তেই আয়াত নি‌জেই ভাত মা‌খি‌য়ে তনয়া‌কে খাই‌য়ে দি‌লো। তনয়া খা‌চ্ছে আর ভাব‌ছে ছে‌লেটা ওকে এত কেন ভালোবা‌সে! না‌কি ওর অন্য কোন মতলব আছে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন