বাংলা পিরিয়ডের ক্লাস চলছে। জানালার পাশে বসে খাতার মাঝে আঁকিবুঁকি করছে নিহি। কী লিখছে বা কী আঁকছে তা ওর জানা নেই। মূলত হাত শুধু চলছে। মন ভাবছে অন্যকিছু। সেই অন্যকিছুটা কী? অনলের কথা? হতেও পারে! না হওয়ার মতো অনাবশ্যক কোনো কারণ নেই। এত কঠিন কঠিন কথা আজ কেমন লেগেছিল তার? এক পলক চোখ বন্ধ করে অনলের তখনকার মুখটা নিহি কল্পনা করে নিলো। পরমূহুর্তেই চোখ খুলে ফেলল। অনলের ক্লেশমাখা মুখটি দর্শন করে ভালো ঠেকছে না তার। অবাক হবেন না! ভালো ঠেকছে না মানেই নয়, তার জন্য এখনো মনের মাঝে সুপ্ত ভালোবাসা আছে। বরং এজন্যই মন অসন্তুষ্ট যে, এতটুকু কষ্ট তো অনলের প্রাপ্য নয়। এরচেয়েও ঢের বেশি কষ্ট তাকে পেতে হবে।
জানালার দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলো। এক ঝাঁক পাখি দল বেঁধে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তারা? কাজে? খাবার জোগার করতে? নাকি ঘুরতে বের হয়েছে! আচ্ছা তারাও কি মানুষের মতো শখের বসে ঘুরে বেড়ায়? ঘুরতেই পারে! অসম্ভবের কি কিছু আছে? কিছু অসম্ভব নয়। সামান্য কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কেউ যদি প্রতিশোধ পরায়ণ হতে পারে, তাহলে পাখিরা শখ করে কেন ঘুরতে পারবে না?
আচ্ছা অনলের প্রতি এমন ব্যবহার কি ভুল হচ্ছে নিহির? ভুল কেনই বা হবে? সে কি এসবের যোগ্য নয়? নিহি তো কিছু করেনি। অনল তার কর্মের ফল পাচ্ছে। এটা তো একদিন হওয়ারই ছিল। কেনই বা অনল আসলো তার আত্মসম্মান খুইয়ে? তাছাড়া তাকে তো আসতে হতোই। তাই হয়তো এসেছে!
বেঞ্চের ওপর রাখা নিহির এক হাত মৃদু চেপে ধরে তরু। ভাবনার ঘোর কাটে নিহির। তরুর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,
"তোর কি মন খারাপ নিহি?"
নিহি হাসার চেষ্টা করল। হাসলোও। মেকি হাসি! হেসে বলল,
"না তো! কেন?"
"দেখে মনে হলো। এত কী ভাবছিস?"
"তেমন কিছুই না। উদ্ভট কথাবার্তা মাথায় আসে।"
"আমি তো বুঝতেছি না মেয়র কেন তোকে যেতে বলেছে?"
"আমি জানিনা।"
"তুই তাকে চিনিস?"
"না রে!"
মনমতো কোনো উত্তর না পেয়ে তরু চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করল,
"ঐ ছেলেটা কে? যাকে তুই এত কঠিন কঠিন কথা বললি!"
"আমায় পরিবর্তন করা মানুষটি।"
"মানে?"
"কিছু না। তার জন্যই আমার সিলেটে পড়তে আসা।"
"কেন? কী এমন হয়েছিল?"
"টিফিন টাইমে বলব।"
"ঠিকাছে।"
মাথা থেকে সব চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে নিহি ক্লাসে মনোযোগ দিল। আর মাত্র এক মাস পরই ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষা। সময় নষ্ট করা যাবে না কোনো। ভালোমতো পড়তে হবে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে।
টিফিন টাইমে মাঠের এক কোণে বসে নিহি তরুকে সব খুলে বলে। সব শুনে তরু ক্ষুব্ধ হয়ে যায় অনলের প্রতি। দাঁত কটমট করে বলে,
"ঠিক হয়েছে। একদম ঠিকাছে। প্রতিশোধের জন্য কেউ এমন করতে পারে?"
"পারে হয়তো! পারে বলেই তো করেছে।"
"তার নামের সাথে তার মিল রয়েছে অনেক। তার ভুলের আগুনেই সে পুড়ে মরবে দেখিস তুই।"
"আল্লাহ্-র হাতে ছেড়ে দিয়েছি সব।"
কলেজ ছুটির পর বাইরে অনেক মানুষজন দেখতে পায়। একসঙ্গে সবার ছুটি হয়েছে বলে গেটের সামনে ভীড় হয়ে গেছে। তরু নিহির হাত ধরে রেখেছে। সকালের ঐ ছেলেগুলোও এখানে আছে। একজন এসে বলে,
"মেয়র নিজেই এসেছে। আসুন।"
নিহি আর তরু দুজনই অবাক হয়। দুজন দুজনের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে। মেয়র হয়ে তিনি নিজেই আসলেন? নিহি ভয় পেল না। নিজেকে সামলে নিলো। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল,
"কোথায় সে?"
"গাড়িতে।"
"চলুন।"
নিহি তরুকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়ির সামনে যেতেই গাড়ির কাঁচ নামান তিনি। বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। তবুও চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েনি। শান্তশিষ্ট দেখালো তাকে। নিহিকে দেখে হাসলেন। বললেন,
"গাড়িতে ওঠো।"
নিহি একটু বিচলিত হলো। কিন্তু বুঝতে দিল না। তরু শক্ত করে ধরে রাখল নিহির হাত। মেয়র হেসে বললেন,
"ভয় পেয়ো না।"
এরপর তরুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
"তুমিই তরু?"
তরু নিহির দিকে একবার তাকিয়ে মাথা উপর-নিচ করল। তিনি বললেন,
"তুমিও আসো। সমস্যা নেই।"
"আমরা কোথায় যাব?" জিজ্ঞেস করল নিহি।
"আমার বাড়িতে। লিমনকেও আসতে বলেছি।"
নিহি যাবে কি যাবে না কিছু বুঝতে পারল না। পরে ভাবল যা হওয়ার হবে। যাওয়া যাক। এত মানুষের সামনে গাড়িতে উঠবে। এখানে তার বিপক্ষে থাকা লোকজনও থাকতে পারে। কোনো ক্ষতি করার কথা অন্তত তিনি ভাববেন না। তেমন ইচ্ছে থাকলে জোর করেই তুলে নিয়ে যেতে পারতেন। নিহি গাড়িতে উঠল। সঙ্গে তরুও। গাড়ি চলা শুরু করল। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর গাড়ি একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে। দারোয়ান গেইট খুলে দিতেই গাড়ি ভেতরে গেল। সবাই গাড়ি থেকে নামল। তরু বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখছে। অসম্ভব সুন্দর বাড়ি। মেয়রের বাড়ি বলে কথা! কিন্তু লিমন কেন এখানে? নিহিকেই বা কেন আনল? ভেতরে গেলেই জট খুলবে।
ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখতে পেল লিমন সোফায় বসে আছে। নিহি আর তরুকে দেখে অবাক হলো। ওর মুখভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ওদের আসার কথা সে জানতো না। মেয়র ওদেরকে বসতে বলে স্মৃতিকে ডাকলেন। ওদের সম্মুখের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলেন,
"কী খাবে তোমরা?"
লোকটি বেশ আন্তরিক বোঝা গেল। নিহি বলল,
"কিছুই না। কী জন্য ডেকেছেন বললে ভালো হতো।"
"বলব। বলার জন্যই নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছি।"
স্মৃতিকে তিনি নিজের পাশে বসিয়ে বললেন,
"স্মৃতি আমার একমাত্র মেয়ে। ওর কোনো আবদার কখনো আমি অপূর্ণ রাখিনি।"
সব না শুনে নিহিও কিছু বলবে না ভেবে চুপ করে রইল। তিনি আবার বলা শুরু করলেন,
"ছোটবেলায় ওর মা মারা যায়। আমি রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে তেমন সময় ওকে দিতে পারিনি। সেদিক থেকে বলতে গেলে, ও বাবা-মায়ের ভালোবাসা, শাসন পায়নি বললেই চলে। তাই বদমেজাজি হয়ে উঠেছে। এর অনেকটা দোষ হয়তো আমারই। রাজনীতির চেয়ে যদি মেয়েকে বেশি সময় দিতাম তাহলে হয়তো উড়নচণ্ডী স্বভাবের হতে পারতো না।"
তিনি একটু থামলেন। থেমে আবার বললেন,
"কালকের ঘটনা আমায় এসে সব বলেছে স্মৃতি। বিস্তারিত বলতে পারেনি কান্নার জন্য। তখন ওর বান্ধবীর থেকেই সব শুনলাম। ওর কাছেই জানলাম, স্মৃতি তোমার আর লিমনের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তুমি ওর ফুপাতো বোন এটা সত্যি। কিন্তু ঐযে আমার মেয়ে এক রোখা স্বভাবের। আমার কাছে উল্টা-পাল্টা বায়না করল। ও অবুঝ হলে কী হবে, আমি তো অবুঝ নই! লিমন এই বিষয়টার পর স্মৃতির ওপর খুবই বিক্ষিপ্ত ছিল। ওর এমন আচার-আচরণ বিশেষ করে তোমার সঙ্গে করা খারাপ আচরণগুলো মানতে পারেনি। ওর কথায় এটা স্পষ্ট, তরুর চেয়ে কোনো অংশে কম ভালোবাসে না তোমায়। আর নিজের বোনের মতো ভালো বোনকেই বাসা যায়। লিমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিভোর্সের।"
নিহি এবার চমকে লিমনের দিকে তাকায়। লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। এমনি এমনি তো করেনি! অবশ্যই অনেক বেশি ভালোবাসে। এবং এমন কোনো সংশয় এসেছিল যার কারণে লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। মানলাম, স্মৃতির ওমন ব্যবহার ঠিক হয়নি। তাই বলে কি একটা সুযোগ দেবে না?
তিনি আবার বললেন,
"তোমায় আমি তেমন জানিনা। তবে কয়েকজনের মুখে তোমার কথা সব শুনেছি। তুমি অসম্ভব ভালো একটি মেয়ে। তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করেছে আমার মেয়ে। তার জন্য আমি দুঃখিত। তোমার কাছে অনুরোধ, তুমি লিমনকে বোঝাবে।"
এতক্ষণে নিহি মুখ খোলে। বলে,
"এখানে বোঝানোর তো কিছু নেই আঙ্কেল। সাধারণ কোনো রিলেশন হলে ড্যাম কেয়ার ধরা যেত। বিয়ে তো যেই-সেই বিষয় নয়। আমি জানিনা কেন তারা লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। সেসব না হয় পরেও জানা যাবে। তাই বলে তো ছোট্ট একটা কারণে ডিভোর্স দেওয়া ঠিক নয়।"
নিহি লিমনের দিকে ঘুরে বসল। লিমনের হাত ধরে বলল,
"ভাইয়া আজ যদি আমি বা তরু এমন একটা কাজ করতাম। আর আমাদের হাজবেন্ড তখন তোমারই মতো আমাদের ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন তখন তুমি কী করতে? আমাদের সংসার বাঁচানোর চেষ্টা করতে না?"
লিমন নিশ্চুপ। সে আবার বলে,
"ভুল তো মানুষ মাত্রই করে। তুমি তাকে মাফ করে দাও প্লিজ। ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে দিও না।"
স্মৃতি এবার এগিয়ে আসে। লিমনের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে,
"আ'ম স্যরি লিমন! আর কখনো এমন করব না। শুধু একটা সুযোগ আমায় তুমি দাও।"
লিমনের রাগ গলে পানি হয়ে গেল। স্মৃতিকে তুলে নিজের পাশে বসালো। তার চোখেও পানি চিকচিক করছে। শত হোক, ভালোবাসার মানুষ তো! স্মৃতির বাবা-ও চশমার ফাঁকে চোখ মুছেন। এত বড় একজন ক্ষমতাশালী মানুষ। তবুও কত উদার, আন্তরিক। লিমন চেষ্টা করলেই পারবে স্মৃতিকে নিজের মতো গড়ে নিতে।
সব মিটমাট হলে স্মৃতি নিহির হাত ধরে ক্ষমা চায়। নিহি মিষ্টি করে হেসে স্মৃতিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
"ক্ষমা চাইতে হবে না ভাবি। শুধু একটা অনুরোধ করব, যত যাই হোক, যাই দেখো না কেন আগে তার সত্যতা প্রমাণ করবে।"
"দেখেছেন আঙ্কেল, আমি বলেছিলাম না নিহিই পারবে সব ঠিক করতে? সেই গুণ যে ওর আছে।"
নিহি স্মৃতির পেছনে তাকায়। চমকে যায়। অনল ওর বন্ধুদের নিয়ে পাশের ঘর থেকে বের হচ্ছে। কথাটা অনলই বলেছে। তারা এখানে আসলো কীভাবে? স্মৃতির বাবা হেসে বলেন,
"ঠিকই বলেছিলে তুমি। তাই তো নিজে গিয়েই নিহিকে নিয়ে আসলাম।"
নিহি কিছুই বুঝতে পারছে না। অনল হেসে বলে,
"একটা কথা তুমি ঠিকই বলেছ নিহি। মানুষ মাত্রই ভুল। আর ভুল ক্ষমা করা উচিত।"
কথাটা যে নিজের দিক থেকেই ইঙ্গিত করে বলেছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না নিহির। সে বাঁকা হেসে উত্তর করে,
"অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমা করা যায়। ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল নয়!"
এরপর ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,
"বাসায় যেতে হবে। অনেক পড়া বাকি আছে।"
স্মৃতি বলে,
"আজ এখানেই থেকে যাও। এখান থেকেই কাল কলেজে যেও।"
তখন মিলনও বলে,
"আরে নিহি থেকে যাও। মামুর বাসায় মজা হবে।"
তাহলে মিলনের মামা হন তিনি! এতক্ষণে পরিষ্কার সব। নিহি স্মৃতির হাত ধরে মিষ্টি হেসে বলে,
"ছুটির দিনে আসব ভাবি। তখন চুটিয়ে আড্ডা দিবো,গল্প করব আর একসঙ্গে খাব।"
"পাক্কা আসবে তো?"
"পাক্কা।"
"ঠিকাছে।"
নিহি হাসে। লিমনকে বলে,
"ভাইয়া তুমি থাকো। পরে এসো। আমি আর তরু যাই।"
"ওদেরকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলো।" একজনকে বললেন স্মৃতির বাবা।
বাড়ির বাইরে বের হতেই হাতে টান পড়ল। নিহি পিছনে ফিরে তাকালো। অনলকে দেখে ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো। বিক্ষিপ্তভাবে বলল,
"যখন তখন স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না।"
"আমি খারাপ উদ্দেশ্যে হাত ধরিনি নিহি!"
"হাহ্! তা জানা আছে। আপনাকে না বলেছিলাম আপনি সেচ্ছায় আমার সামনে আসবেন না? কেন এসেছেন তাহলে?"
"চলে যাব। তার আগে একটা উত্তর দাও।"
"কী?"
"মানুষ মাত্রই যদি ভুল হয়। তাহলে আমার ভুল কেন ক্ষমা করবে না? কেন আমি ক্ষমা পাব না?"
নিহি কিছুক্ষণ অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখে চোখ রেখেই বলে,
"বললাম না তখন, অনিচ্ছাকৃত ভুল মাফ করে দেওয়া যায়। কোনো ইচ্ছাকৃত ভুলকে নয়। তাছাড়া ক্ষমা করার প্রশ্ন তখনই আসে যখন ভুল শব্দটা আসে। আপনি তো কোনো ভুল করেননি। আপনি যেটা করেছেন সেটা ভুল নয় অন্যায়। আর অন্যায়ের ক্ষমা কখনো হয় না।"
.
.
.
চলবে.......................................