সামার একটা চিৎকার দিতে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করল। বাড়িভর্তি মেহমানের সামনে চেঁচামেচি করে নিজেকে কুৎসিত প্রমাণের প্রয়োজন নেই। শান্ত গলায় সে পারভীনকে বলল, 'একটা কথা তোমার জানা দরকার মা। তুমি ভুল করছো।'
'আমি ভুল করছি মানে কী?'
'মা, অর্ণবের সঙ্গে আমার কোনো পছন্দের সম্পর্ক নেই। তোমরা যা জানো সেটা ভুল জানো।'
পারভীন যেন আকাশ থেকে পড়লেন। অবিশ্বাসী চোখে তিনি সামারকে দেখছেন। তার মুখচ্ছবি দেখেই অনুমান করা যায়, এ কথাটা শোনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।
সামার বলল, 'অর্ণবকে আমি কোনোকালেই পছন্দ করতাম না। আমি ওকে ভাইয়ের মতো দেখতাম, বা বলতে পারো বন্ধুর মতো। আমি একজনকে পছন্দ করি। তার ব্যাপারে অর্ণবকে বলেছিলাম যেন সে তোমাদেরকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে। তুমি আর বাবা দুজনেই অর্ণবকে পছন্দ করো, তাই ও হয়তো তোমাদেরকে সহজে রাজি করাতে পারবে। কিন্তু এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। অর্ণব আমার কথা বুঝতে পারেনি। সে ভেবেছে আমি ওর সঙ্গে বিয়ের কথা বলতে বলেছি। এবার বুঝতে পেরেছো মা?'
পারভীন কঠিন মুখে তাকিয়ে রইলেন সামারের দিকে। তার পা কাঁপছে থরথর করে। এক্ষুণি হয়তো জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে যাবেন তিনি। সামারকে সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছেন না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
সামার মাকে ধরে ফেলল। মায়ের বাহু শক্ত করে ধরে বিনয়ের সুরে সে বলল, 'মা, অর্ণব আমাকে অনুরোধ করেছিল যেন সত্যিটা কাউকে না বলি। তাহলে ওর বাবা মা কষ্ট পাবে। ও চেয়েছিল কিছুদিন যাওয়ার পর বাসায় জানাবে, আমার সঙ্গে ওর আর বনিবনা হচ্ছে না। এভাবে সবকিছু ম্যানেজ করে নেবে ও। প্লিজ তুমিও বিষয়টাকে চেপে যাও। কাউকে কিছু বলো না আমার লক্ষী মা। শুধু আজকের দিনের মতো বিয়েটা পিছিয়ে দাও। বলো ঢাকায় গিয়ে বিয়ে হবে।'
পারভীন আর কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। ওনার মাথা ঘুরছে। ঝাপসা চোখে তিনি সামারকে ধরে রেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
মাকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিলো সামার। ওর বুক কাঁপছে। হাই প্রেশারের রোগী পারভীন। আবার হার্ট অ্যাটাক না করে বসে! দ্রুত বাইরে গিয়ে ভায়োলেটকে ডেকে আনলো সে। দুইবোন মিলে মায়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করল।
পারভীন আস্তে আস্তে চোখ মেলে নিষ্পলক চোখে সামারের দিকে তাকালেন। সামার মায়ের হাত চেপে ধরে বলল, 'মা, ঠিক আছো তুমি?'
অনেক্ষণ পর পারভীন মৃদু স্বরে বললেন, 'আমাদের মান সম্মান নষ্ট করিস না সামার। তুই বিয়েটা করে ফেল।'
সামার আঁৎকে উঠে বলল, 'এটা অসম্ভব। আমি তোমাকে সবই বললাম। তবুও এই কথা কীভাবে বলছো তুমি মা!'
পারভীন উত্তেজিত হলেন না। শান্ত গলায় বললেন, 'তোর চাচা চাচী, নানুবাড়ি, দাদাবাড়ি, সব আত্মীয় স্বজনকে বলা হয়ে গেছে তোর এনগেজমেন্ট হইছে। সবাইকে কি উত্তর দেবো আমি?'
'তাতে কি হয়েছে মা? বলবে ওই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দাওনি।'
'জাহ্নবীকে নিয়ে কথা শুনতে শুনতে আমি আর পারিনা। তোরা আমাদের সম্মানটা আর নষ্ট করিস না সামার।'
সামার পারভীনের হাত ধরে অনুরোধের সুরে বলল, 'আমরা তো খারাপ কিছু করছি না মা। বিয়ে করে সারাজীবন সংসার করবো আমরা। কাজেই এই সিদ্ধান্ত টা আমাদেরকেই নিতে দাও।'
পারভীন কিছু বললেন না। ওনার দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সম্ভবত আত্মসম্মানবোধে আঘাত লেগেছে তার। কিংবা মেয়েকে নিজের পছন্দে বিয়ে দিতে না পারার দুঃখে তীব্র কষ্ট পাচ্ছেন।
তিনি বললেন, 'তোরা যা ভালো মনে করিস তাই কর। আমি মরলে তোরাই দায়ী থাকবি।'
সামার ও ভায়োলেট বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলো। পারভীন চোখ মুখ শক্ত করে রাখলেন। সারাজীবন অসুখী ছিলেন তিনি। সবকিছু থাকার পরও কখনো নিজেকে নিয়ে সুখী হতে পারেননি। মেয়েদের কাছাকাছি আসতে পারেননি কখনো। এই বয়সে এসে তার সবার প্রতি রাগ হয়, অকারণে অসহ্য লাগে সবাইকে। তিনি আবারও বলে ফেললেন সেই কুৎসিত বাক্যটি, 'আজ যদি আমি মারা যাই, তুই আর জাহ্নবী দায়ী থাকবি। আমার মৃত্যু তোদের জন্যই হবে।'
এত নোংরা একটা বাক্য সামার হজম করতে পারলো না। মায়ের হাত ছেড়ে দিয়েছে সে অনেক আগেই। এবার পাশ থেকে উঠে পড়ল। ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাইরে। পারভীনের সঙ্গে সামারের সম্পর্কটা আর পাঁচটা মা মেয়ের সম্পর্কের মতো নয়। পারভীন কোনোদিনও পারেননি সামারকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে। সবসময় একটা অদৃশ্য দেয়াল তাদেরকে রেখেছে আলাদা করে। তা সত্ত্বেও সামার মায়ের এই কথাটি মেনে নিতে পারছে না।
কয়েক মুহুর্তের মাঝেই ঘরে প্রবেশ করল সামার। পারভীন অন্যদিকে মুখ করে রেখেছেন। সামারের চেহারায় কাঠিন্য ভর করেছে। ভায়োলেট এগিয়ে গেল তার দিকে। বোনকে কিছু বলার আগেই সামার স্পষ্ট গলায় বলল, ঠিক আছে। আমি অর্ণবকে বিয়ে করবো। কাজি ডাকতে বলো। বিয়ে আজকেই সম্পূর্ণ হবে।
পারভীন সামারের দিকে তাকালেন। ভায়োলেট কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বোনের হাত ধরতে যাবে, এমন সময় সামার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রান্নাঘরে অর্ণব তার মা ও বোনের সঙ্গে গল্প করছিল। সামার তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল, 'আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।'
অর্ণব বিব্রতবোধ করে, মায়ের মুখের দিকে তাকায়। তাদের সামনে সামারের সঙ্গে যেতে লজ্জা করছিল তার। তবুও সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল।
সামার জানতে চাইলো, 'আপনি কি জানেন আজকে আমাদের কাবিন?'
অর্ণব জানেনা কিছুই। তাকে জানানো হয়নি। কথাটা সামারের মুখে প্রথমবার শুনে যারপরনাই চমকে উঠলো সে, 'মানে!'
'মানে আজকে আমাদের বিয়ে।'
'শান্ত হোন সামার। আমি বিষয়টা দেখছি। আপনি টেনশন করবেন না।'
'কী দেখবেন? যা দেখার আগেই দেখা প্রয়োজন ছিল। এখন আর কিছু দেখার সময় নেই।'
'আমি আংকেলকে সবকিছু খুলে বলবো। প্লিজ আপনি রাগ করবেন না।'
'আপনি বিয়ের সব আয়োজন করতে বলুন। বিয়ে আজকেই সম্পূর্ণ হবে। আত্মীয় স্বজন আরও কাউকে ডাকার প্রয়োজন হলে ডাকতে বলুন। এরপর আর কোনো প্রোগ্রাম হবে না।'
অর্ণব স্তব্ধ হয়ে রইল খানিকক্ষণ। সামারের এই কাঠিন্যভাব দেখতে তার ভালো লাগছে না। সে সামারকে চায়, তবে এভাবে নয়।
অর্ণব বলল, 'আমি এখনই মাকে সবকিছু খুলে বলবো সামার। আপনি রাগের মাথায় কিছু করবেন না প্লিজ।'
'আপনাকে কি বলেছি শুনতে পাননি? বিয়ের আয়োজন করতে বলুন।'
'আংকেল আন্টি আপনাকে কিছু বলেছে?'
'সেসব আপনার না জানলেও চলবে।'
'আমি ওনাদের সঙ্গে কথা বলি। আপনি একটু সময় দিন আমাকে।'
'আমার ফ্যামিলির সঙ্গে আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই।'
অর্ণব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, 'আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।'
'আন্টি কিছু বলেছে আপনাকে তাইনা? ওনাদের সঙ্গে রাগ করে আপনি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।'
'জীবনের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত চাইলেই নিজে নিজে নেয়া যায়না। পরিস্থিতি আপনাকে বাধ্য করবে সেসব সিদ্ধান্ত নিতে।'
'আপনাকে আমি বাধ্য হতে বলছি না। আপনি দাঁড়ান। আন্টিকে যা বলার আমিই বলছি। আমাকে লাস্ট একটা সুযোগ দিন।'
অর্ণব সামারের আর কোনো কথা শোনার অপেক্ষায় রইলো না। দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে পারভীনের সঙ্গে কথা বলতে চলে গেল। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সামার। সে এখন কী করবে? অর্ণবের কথা শুনে পারভীনের কেমন প্রতিক্রিয়া হয়, সেটা ভেবেই তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
দরজায় দাঁড়িয়ে অর্ণব বলল, 'আন্টি আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।'
শোয়া অবস্থায় করুণ মুখে পারভীন তাকালেন অর্ণবের দিকে। তার মুখে বিষাদের তীব্র ছায়া। তিনি জানেন ছেলেটা কী বলতে এসেছে।
.
.
.
চলবে.......................................................................